Friday, 6 November 2020

চীপ সাহেবের কুঠি বাড়ি। কুঠীবাড়ি ভিত্তিক ব্যবসা বানিজ্য

।। সুরুল সরকার জমিদার বাড়ি।।
--------------------------------------------------

রাজা ; জমিদার ; বড়লোক ; শাসকের কথা তো বলতেই হবে। এই তো আমাদের ব্যবস্থা। 
১৯০১ সালে এই গ্রামের জনসংখ্যা ১৫৫৮ জন। 
তখন সিউড়ী মহকুমার অন্তর্গত। 
এই গ্রাম কিন্তু পরিচিতি পেয়েছে জন চীপ সাহেবেএবং তাঁর    বিখ্যাত কুঠি বাড়ি কেন্দ্রিক বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড এর জন্য।
তখনকার দিনে তাঁর কুঠিবাড়ি তা ও ছিল দর্শনীয়।
  শুধু বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড ই নয়। তাঁকে দেখতে হত সাধারন মানুষের নানাবিধ সমস্যা। বিচার বিভাগীয় কোন ক্ষমতা তাঁর হাতে না থাকলেও তাঁকে আপোষ মীমাংসা র ব্যবস্থা করতে হত। তার জন্য কুঠিবাড়ি র এক প্রশস্ত কক্ষে বসত মীমাংসা সভা।
শুধু কি মীমাংসা। কেউ ধরে এনেছে কোন বুনো জীব। তাঁর চিড়িয়াখানা র জন্য। ইনাম পাবে এই আশায়।
কেউ ধরে এনেছে কোন এক ব্যাটা চোরকে।
আবার কেউ কেউ এসেছে মাঠে জল নিয়ে যাবার জন্যে নালা কাটার বিবাদ নিয়ে।
সবই তাঁকে সামলাতে হত। অর্থাৎ স্থানীয় প্রশাসন বলতে কিছু নেই। তিনি ই হয়ে উঠেছিলেন স্থানীয় প্রশাসক।
   এখানে এসেছেন ১৭৮২ সালে। কমার্শিয়াল রেসিডেণ্ট  হিসাবে। এসেছেন সিভিল সার্ভিস থেকে। ধনী ঘরের ধনী মানুষ। বিশাল সে কুঠি বাড়ি নির্মানে বিনিয়োগ করেছেন এত টাকা। বাগান ; জলাশয় ; নানা জাতের পশু পাখী নিয়ে তাঁর চিড়িয়াখানা। এত এত চাকর ; খানসামা ; নায়েব ; গোমস্তা ; কর্মচারী। ' তিনি বিরাট সাহেব'।মেমসাহেব আছেন। তাঁর ফুল বাগানে খুব শখ। নানা পশুপাখি ভালোবাসেন। অনেক গুলি ছেলে মেয়ে। বেশী  মেয়ে। ছেলে ও আছে। বিশিষ্ট এক বন্ধু মন্তব্যে জানিয়েছেন তাঁর সন্তানসংখ্যা না কি ছিল ১১ টি।
বর্তমানে জীবিত তাঁর এক বংশধর ইংল্যাণ্ডে শল্য চিকিৎসক।  চীপ সাহেব এবং তাঁর বিখ্যাত কুঠিবাড়ি নিয়ে আগের পর্বে লিখেছি। তাই এই পর্বে আর বিশদে যাবনা।
  সেই সময়কাল টা কে ভাবুন একবার। ১৭৭০ অর্থাৎ বাংলা ছিয়াত্তর এর মহা মন্বন্তর। সেই মহা দুর্ভিক্ষে ছারখার হয়ে গেছে দেশ। শুধু দু টি ভাতের অভাবে এত এত মানুষের মৃত্যু।
দেশ বিধ্বস্ত। হিগিনসনের রিপোর্ট অনুযায়ী ৬০০০ গ্রামের মধ্যে ১৫০০ গ্রাম নিশ্চিহ্ন। চাষাবাদের জমি জঙ্গলে ভরে গেছে। চাষ করার লোকেরা আর কেউ বেঁচে নেই। " বীরভূম বন্ধ্যা জনমানবহীন দেশ "। 
জঙ্গল ভরে যাচ্ছে বন্য জন্তু তে।  পশ্চিম ; দক্ষিণ পশ্চিমের জঙ্গল প্রসারিত হচ্ছে পূর্বে। একদা খ্যাত বাণিজ্য কেন্দ্র লাকরাকোন্দা প্রায় জনশূন্য। অজয়ের প্রবাহপথ জুড়ে একই দৃশ্য।
পশ্চিম থেকে নেমে আসছে পাহাড়িয়া ডাকাতদের দল। তাদের সঙ্গে যোগ দিচ্ছে স্থানীয় ডাকাতেরা। সেই সব ডাকাত দলে প্রায় হাজার থেকে তিন হাজার পর্যন্ত দুর্ধর্ষ সব মানুষ। 
দিনে দুপুরে লুঠপাট চলছে। ১৭৮৯ সালে বীরভূম এর অন্যতম বাণিজ্য কেন্দ্র ইলামবাজার ভর্তি দুপুরবেলা য় লূঠ হয়ে গেল। বীরভূম এর রাজনগর এর রাজাদের কোন ক্ষমতা ই নেই একে প্রতিহত করার।
সব কুঠিবাড়িতে ই সিপাই দিয়ে পাহারার ব্যবস্থা করতে হয়েছে। তাঁতিদের নিরাপত্তা র জন্য ব্যবস্থা জরুরী। ব্যবসার প্রয়োজনে ই আবশ্যিক। চীপ সাহেব সহ ইংরেজ প্রশাসন চেষ্টা করছেন।
অত্যন্ত সুরক্ষিত চীপ সাহেবের কুঠিবাড়ি। সদা সতর্ক প্রহরা।
সুরুলে র তাঁতিদের জন্য বা গ্রামের জন্য ও পাহারার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
এই তাঁতিদের " গড়া কাপড় " দিয়েই তো বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ব্যবসা আরম্ভ হয়েছে। অনেক তাঁতী ছিলেন। আবার রাইপুরের সিংহ বাবুরা চীপ সাহেবের সাথে ব্যবসায় যোগ দিয়ে তাঁদের আদি বাসস্থান চন্দ্রকোনা এলাকা থেকে প্রায় হাজার ঘর তাঁতিদের  এখানে এনেছেন। সুরুল ; সুপুর ; এর আশেপাশে র নানা গ্রামে তাঁরা বসতি স্থাপন করেছেন। তখনকার দিনে হাজার ঘর তাঁতিদের কাছ থেকে হাজার থান। আর ১০০১ টাকা। সেই সব থান মজুত হবে চীপ সাহেবের কুঠিবাড়ি র গুদামে। নৌ সেনা দের মজবুত পোষাক শুধু নয় ; এই ' গড়া ' কাপড় মানে মোটা সুতোর ঠাসবুনন কাপড়। জল ধরে রাখা যায় এমন ঘন ; পুরু। পাল তোলা নৌকা বা জাহাজের পাল তৈরী র জন্য এই কাপড়ের খুব চাহিদা ছিল।
এই ব্যবসার টানে ই হোক আর গুরুদেবের পরামর্শেই হোক খুব ই সাধারন অবস্থার ' কোঁয়ার' সদগোপ সরকার পরিবারের পূর্বপুরুষ ভারতচন্দ্র সরকার তাঁর গুরুদেব বাসুদেব ভট্টাচার্য মহাশয় এর নির্দেশে এই সুরুল গ্রামে এসে বসতি স্থাপন করলেন। সে অষ্টাদশ শতকের প্রথম ভাগে। তাঁর স্ত্রীর নাম বিমলা। আদি পদবী ঘোষ। আদি বাসিন্দা বর্ধমানে র নীলপুরে।
তাঁর পুত্র কৃষ্ণহরি। কৃষ্ণহরি র তিন পুত্র। যাদবেন্দ্র ; মাধবেন্দ্র ; কালীচরণ। এই যাদবেন্দ্র ই বড় তরফ। মাধবেন্দ্র ছোট তরফ।
কালীচরণ বড় তরফের সাথেই যোগ দেন।যাদবেন্দ্রের দুই পুত্র।ব্রজবল্লভ আর রাজবল্লভ।  এই ব্রজবল্লভের পাঁচ পুত্র। তৃতীয় শ্রীনিবাস সরকার ই ব্যবসায়ে খুবই সাফল্য লাভ করেন। 
সুরুলের সরকার বাড়ি ও প্রথমে কাপড়ের ই ব্যবসায়ী ছিলেন। তারপর আশানন্দ সরকার ; গুরুচরণ সরকার নীল ব্যবসায়ে নামেন। আশানন্দের তিনটি নীল কুঠি ছিল। 
নীলের ব্যবসা যথেষ্ট লাভজনক। সেই লাভের আশায় আশানন্দ  যথেষ্ট বিনিয়োগ করেছিলেন। উপযুক্ত পরিকাঠামো তৈরী করেছিলেন। লাভপুর এর নিকটে মস্তুলী গ্রামের কুঠি টি যথেষ্ট গুরুত্ব পূর্ণ ছিল। এছাড়া ঈশ্বরপুর ( আমোদপুর) ; কুরমিঠা ; বড়জোড়া ; চিতুড়া ; ইলামবাজার প্রভৃতি গ্রামে তাঁর নীল ; চিনি ; চাল ; গড়াকাপড় উৎপাদন ও সংগ্রহ করার জন্য নিযুক্ত গোমস্তা রা কুঠিবাড়ি তে মাল গুদাম জাত করতেন।
চীপ সাহেবের সাথে ব্যবসা আবার স্বাধীন ভাবে ব্যবসা। বিদেশে মাল চালান করতেন। কলকাতা বন্দরে ; বাজারে তাঁদের নিযুক্ত দালাল ; কর্মচারী রা ছিলেন। তাঁরা ই মালের দরদাম ওঠানামা র দিকে নজর রাখতেন এবং বিক্রি করতেন।
' সুরুল সরকার বাড়ির নথিপত্রে ' আশানন্দ সরকার এবং শ্রী নিবাস সরকারের নাম বারবার এসেছে।
  বিশ্বভারতী র সংগ্রহে সরকার বাড়ির বহু নথিপত্র স্থান পেয়েছে। এবং বিশ্বভারতী গবেষণা প্রকাশন সমিতি দ্বারা
" সুরুল নথি সংকলন প্রথম খণ্ড " প্রকাশিত হয়।
সেই সময়কে ; সমাজ  ইতিহাস কে  জানতে বুঝতে এই সংকলন এক অতীব গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। 
সেখান থেকে অনেক কথা ই জানতে পারা যায়।
আপনাদের ও শোনানো যায় অনেক কথা।
  এত কথা। যাই হোক এ তো চলবে। দেখা যাক কতটা শোনানো যায়। এখানেই এই পর্ব শেষ করি। সাথে থাকবেন।
    ( চলবে)। --------------------------------© প্রণব ভট্টাচার্য। 

গ্রন্থ সহায়তা। জেলা গেজেটিয়ার। ও ম্যালি 
কৌলাল পত্রিকা। সম্পা স্বপন ঠাকুর 
রাঢ় ভাবনা পত্রিকা। সম্পা সৌরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় 
নিজস্ব প্রবন্ধ

No comments:

Post a Comment