Friday, 6 November 2020

কুঠিবাড়ি কেন্দ্রিক ব্যবসা বাণিজ্য। দ্বাদশ পর্ব।

কুঠি বাড়ি কেন্দ্রিক ব্যবসা বাণিজ্য কথা।।  পর্ব - দ্বাদশ
----------------------------------------------------   ------------------
জতুগৃহ।
বললেই মনে পড়বে আমাদের সেই মহাভারতের কথা।
বারাণাবতের জতুগৃহের কথা।
জতৃ থেকে জতু।
আর জতু মানে গালা। দারুন দাহ্য পদার্থ।
তাকে চিনি আমরা অনেক প্রাচীন কাল থেকেই।
বারাণাবতের জতুগৃহ বানাতে যায় নি তো আবার আমাদের
এই ইলামবাজার  বীরভূম থেকে
কেন বললাম  সে কথা বলি
অজ্ঞাত বসের সময় পাণ্ডবেরা বীরভূম সহ এই এলাকায়
এসেছিলেন । পাণ্ডবেশ্বর ; ভীমগড় প্রভৃতি নামে তারই প্রভাব।
অনেক পণ্ডিতের ধারনা সেদিনের বারাণাবত এখনকার
বীরভূমে র নলহাটি থানার বারা গ্রাম।
এই বারাগ্রাম সুপ্রাচীন। অনেক পুরাকীর্তি সেখান থেকে মিলেছে। অবস্থান গত পারিপার্শ্বিকতা দেখেই পণ্ডিতেরা এই
মত পোষণ করেছেন। বিখ্যাত পুরাতাত্ত্বিক ড: অতুল সুর
ঐ মত সমর্থন করেছেন।
তাহলে তো জতুগৃহ নির্মানে নিশ্চিত ভাবেই এই এলাকার
মানে বীরভূমে র প্রাচীন গালা উৎপাদক অঞ্চল ইলামবাজার থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা ই বেশী।
  আর মুর্শিদাবাদ নবাব দরবার থেকে শুরু করে দিল্লী শাহী দরবারে এই গালার তো বিপুল চাহিদা।
আগের পর্বে ই বলেছি বিষ মেশানো খাবার সনাক্ত করনের জন্য বিশেষ পদ্ধতি তে তৈরি থালা বাটি প্রভৃতি তৈজসপত্র
এর কথা।
আর সিল মোহরের জন্য গালার ব্যবহার তো চলছে এখনও।
  ইলামবাজার সেই গালা শিল্পের প্রধান কেন্দ্র। বিখ্যাত trade mart।
   এমনকি সাজসজ্জা তেও এই গালার ব্যবহার। গালার অলংকারাদি ; পুতুল খেলনা ; এসব ছাড়াও উদ্যান সজ্জাতে
ব্যবহৃত হত গালার তৈরী নানা মূর্তি।
শিবশংকর ঘোষ মশাই তাঁর প্রবন্ধে লিখেছেন
মুর্শিদাবাদ এর নবাব সুজাউদ্দিন এর বিলাস ভবন ' ফরাসবাগ '। সেখানে ইলামবাজার এর গালা শিল্পী দের তৈরী
এক নয়ন মনোহর এক জতুবৃক্ষ দিয়ে না কি সজ্জিত ছিল
উদ্যান। সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে হলুদ ফুল ফল আর পাখি দের সমাহার। এক অনন্য শিল্পকর্ম।
  বোধহয় আগেও লিখেছি ১৯০১ সালে ই ইলামবাজার এর জনসংখ্যা ১৮১৫ জন। Trade mart ইলামবাজার এবং আশেপাশের গ্রামগুলির মানুষ সহ মোট ২২৩৫ জন নানা ভাবে এই শিল্পে নিয়োজিত। কিন্তু অতি দক্ষ artisan তখনই মাত্র দু জন। অলংকার নির্মাতা রা বা খেলনা নির্মাতারা ছিলেন।
সেই যে দুই ভাই গোপাল আর নেপাল গুঁই এর কথা বলেছিলাম। অবসন্ন চিত্তে টুকটাক কাজ করতেন।
শ্রী নিকেতনের শিল্প সদনে রবীন্দ্র নাথ নিয়ে গিয়ে ছিলেন
গালা শিল্পের প্রশিক্ষক হিসাবে। নেপাল বাবু আর্থিক অবস্থার কারণে কাজ ছেড়ে পান বিড়ির দোকান দেন। গোপাল বাবু আবার যোগ দিয়ে ছিলেন। তিনি মারা গেলে তাঁর ছেলে অজিত গুঁই চেষ্টা করেছিলেন ঐতিহ্যের এই গালা শিল্প কে
ধরে রাখতে। কিন্তু বিভাগ টি ই বন্ধ হয়ে যায়।
আজ আর ইলামবাজারে একঘর ও গালা শিল্পের সাথে যুক্ত
মানুষ নাই। ঐ পরিবারের লক্ষীকান্ত কে খুঁজে বের করেছিলাম সব্জী বাজারে। এই এখন তাঁর পেশা।
অন্যেরা পদবী বদলে নিয়েছেন। কেউ আর ' নুড়ি ' বা লরি নামে পরিচয় ও দেননা। অনেকে স্বর্ণকার হয়ে গেছেন।
যাঁরা সেই সুদিনে ভালো রোজগার করেছিলেন তাঁরা এখন
নানা ব্যবসায়ে নিয়োজিত। কোন কোন পরিবার যথেষ্ট ধনী হয়েছিলেন। গালার ব্যবসা করে।
সে দিন আর নেই। থাকার কথা ও নয়। সস্তার রাবার ; প্লাস্টিক এসে যাবার পর কে আর কিনবে মাটির পুতুল ; বা গালার পুতুল। কে পরবে গালা র তৈরী অলংকার।
মেয়েরা কি পরবে নাপিতিনি হাতে সেই ' যাবক ' বা আলতা।
যা তৈরী হত গালা প্রস্তুতি করনের এক পর্যায়ে।
না কি নুড়ি বাড়ির মেয়ে বৌরা সেই রঞ্জক পদার্থ দিয়ে রাঙাবে সুতো। আর সেই সুতো য় শুখবাজারের তাঁতী রা বানাবে নানা সুতী বস্ত্র। একঘর তাঁতী ও আর নেই যাঁরা তাঁত বোনেন।
ইলামবাজার হারিয়েছে তার অতীত গৌরব কে।
  হারিয়েছে ঐতিহ্য। যেভাবে আমরা প্রতিদিন হারাচ্ছি।
----------------------------------------------------@ প্রণব ভট্টাচার্য্য

No comments:

Post a Comment