Saturday, 7 November 2020

কিছু নাম। সুরুল নথি থেকে। কুঠীবাড়ি ভিত্তিক ব্যবসা বানিজ্য। ১৪ দশ পর্ব

।।  কুঠিবাড়ি ভিত্তিক ব্যবসা বাণিজ্য।।  সুরুল নথি থেকে কিছু
   নাম।। ১৪ দশ পর্ব।
-----------------------      ------------------+------
ভোলানাথ খুব বড় মাঝি। সে মাল সমেত নৌকা নিয়ে কলকাতা যায়। আবার ফেরার পথে সরকার বাবুদের অর্ডার অনুযায়ী নানা জিনিষ নিয়ে ফেরে। সরকার বাবুদের সে বাঁধা মাঝি। খুব দক্ষ মাঝি। গঙ্গা নদীতে নৌকা চালানো খুব সহজ কাজ নয়। নদীতে জোয়ার ভাঁটা খেলে। স্রোতের টান বাড়ে কমে। ঘূর্ণি আছে।  অনেক সময় নৌকো ডুবি হয়।
ভোলানাথ সত্যি খুব বড় মাঝি।
সে ছাড়াও আছে মস্তুলী গ্রামের বদন লোহার আর অজয় তীরের রজতপুরের নফর মেটে ও বালকরাম মুচি। এরা নৌকায় " নিলের পারওয়ারীর জন্য নৌকার চাকরির উপর দাদন " নিয়েছিলেন। এঁরা আশানন্দ বাবুর মস্তুলী কুঠির বাঁধা মাঝি।
" গড়া কাপড় " ধবধবে করে ধোয়ার জন্য তো অনেক অনেক ঘর ধোবা ছিল। তারা ও নিশ্চয়ই নানা গ্রাম থেকে এসেছিলেন।
এরকম কয়েক জনের নাম যারা কবুলতি পত্র লিখে কাজের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। নাম স্বরূপ ধোবা ; নফর ধোবা ; সনাতন ধোবা ; বক্রনাথ এবং নারায়ণ ধোবা। এদের বাড়ি ছিল সুরুল গ্রামে। তবে চিঠি তে বলা হয়েছে হাল সাকিম গোয়ালপাড়া।
কবুলতি পত্রের শেষ অংশ "-- - আপনকার পছন্দ মাফিক দিষ্টী করিয়া লইবেন আপনাকার না  পছন্দ জে হইবেক তাহা তৎক্ষনাৎফিরিয়া লইয়া পুনরায় দাস্ত তৈয়ার করিয়া দিব তাহার মুযুরির দাও য়া করিবনা - - মুযুরি ফি সও থানে ৯ নয় টাকা হিসাবে পাইব এতদার্থে আপন খুশী তে কবুলতি পত্র লিখিয়া দিলাম ইতি সন ১২২৮ সাল তারিখ ১৯ শ্রাবণ "
( বানান অপরিবর্তিত)
চুক্তির খেলাপ হলে চলবে না। সে সব ক্ষেত্রে ই। খেলাপ হলে মামলা মোকদ্দমা। যেমন তোলানি বাবদ সুপুর গ্রামের কামি তাঁতী ; শ্রী দাম পাল শ্রীনিবাস সরকার মশাই এর নিকট থেকে ৪১ টাকা দাদন নিয়েছিলেন। সেই টাকা পরিশোধ না হওয়ায়
বীরভূমের দেওয়ানী আদালতে মকদ্দমা হয়।
উভয়পক্ষের দরজবাব পত্রে শ্রী রামচন্দ্র মজুমদার মহাশয়ের নিকট বিচার প্রার্থনা করা হয়েছিল।
শেষ পর্যন্ত মিটে যায় আসামী হিসাব দেখে দোষ কবুল করে
বাকী টাকার কাপড় তুলে দেবার স্বীকার করার পর।
মস্তুল কুঠির মজুর দের সর্দার ছিল গোলোক ধাঙ্গর ও বদন ধাঙ্গড়। এরা ভালো মজুর সংগ্রহ করে আনত। " কুড়ি জন কোঁড়া " মজুর সংগ্রহ করে আনার জন্য ৫ টাকা দাদন নিয়েছিল। বলিষ্ঠ মজুরের মাসিক বেতন ছিল ৩ টাকা।
এরা " কুঠি মস্তুলের নিলের হাওজে ও কারখানাতে খাটিবার কারণ " নিযুক্ত ছিল।
আরও কিছু নাম জগদুর্লভ মেট্যা ; বিরু মেট্যা ; কালীচরণ মেট্যা ; দ্বারকানাথ মেট্যা ; ও বলাই মেট্যা  এরাও ১২৩৪ বঙ্গাব্দে চুক্তি করে কাজ নিয়েছিল। নিলের" কুঁড়ি ধরা- মজুর "
তিন টাকা বারো আনা এবং টেঁড়া টানা মজুর তিন টাকা চার আনা মাসিক মজুরিতে কাজ করত।
মস্তুলী কুঠির অধীনে বামনি গ্রাম এর মোনাজ শেখের কিস্তিবন্দি পত্রটিতে দেখা যায় তিনি নিল চাষের জন্য দাদন নিয়েছিলেন। তার জামিনদার ছিলেন রহিম শেখ।
মোনাজ শেখ প্রতিমাসে আট আনা করে শোধ দেবার অঙ্গীকার করেন।
"কলকাতা বন্দরে আশানন্দের গুদাম ছিল। সেখানে অনেক
লোক নিযুক্ত ছিল। যাঁরা বিদেশী বণিক দের দালালের সঙ্গে যোগাযোগ করে মালের দর দাম করতেন। এই সব দালাল দের কয়েকজনের নাম রামচন্দ্র মিত্র ; তিলকচন্দ্র বসু ; যজ্ঞেশ্বর সরকার ; দেবীচরণ সরকার। আর বিদেশী রা হলেন
মেকিনটিন সাহেব ; ইষপাই সাহেব প্রমুখ এঁরা গড়াকাপড় ইত্যাদি কিনতেন।
আরও যাঁরা এঁদের সাথে আশানন্দের পক্ষে কাজ করতেন
তেমন কিছু নাম দীননাথ সরকার ; পবন ঘোষাল ; গতিনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ; শিবনাথ সিংহ ; রামকিশোর রায় ; দেবীপ্রসাদ ঘোষ ; রামকৃষ্ণ মিত্র ; গুরুপ্রসাদ ঘোষ ; রামকুমার চৌধুরী ; রামমোহন মুখোপাধ্যায় ; ভোলানাথ দাস ; রামকুমার দেবশর্মা প্রমুখ। এঁদের মধ্যে গতিনাথ এবং শিবনাথ সিংহ ছিলেন অত্যন্ত চতুর।"
মালিক আশানন্দ সরকার কে লেখা পত্র থেকে জানা যায়
বিদেশী জাহাজের আনাগোনা এবং " মাল চেনাচিনি দর জানাজানি " নিয়ে দালাল লোকেরা "ফিকির সওয়াল " করে
খারাপ মাল বিক্রি করতেন। "
  আবার আশানন্দ সরকারের পক্ষে লোক টাকা ধার করতেন
কলকাতা র মহাজন দের কাছে।
কয়েকজন মহাজনের নাম রাধামোহন মিত্র ; গোলোকচন্দ্র
বসাক প্রমুখ। পরে সুদ সমেত টাকা তাঁরা ফেরত নিতেন।
সেই সময়ের কলকাতা র অনেক ধনী মানুষ এই মহাজনী কারবার করেছেন।
বিদেশী জাহাজের বেশী আনাগোনা মানেই ভালো ব্যবসা।
মালের দরের ওঠানামা  হয় চাহিদা আর মাল সাপ্লাই এর উপর নির্ভর করে। চাহিদা আর আমদানি র নিত্যবাণিজ্যসূত্র।
  কত রকমের মাল যে ফেরত নৌকায় আসছে তার নাম লিখে শেষ করা যাবেনা।  বিলাতী কাচিম কুলুপ ; গড়গড়া র নল ; বেহালার তার ; লণ্ঠন ; গোলাপজল ; গরম মশলা ; গোলমরিচ
থেকে জরি কাপড় ; বা ঘোড়ার সাজ ; ' ডোল্লাক তালা মানে (door lock) ইষপাই কোম্পানি র ইসপাই তালা।
  সেই সময় ' গড়া কাপড়ের ৩৬ হাতা বা ৩০ হাতার দাম জানা গেছে। খুব ভালো ৩০ হাতা এক থানের দাম দু টাকা চার আনা থেকে দু টাকা দশ আনা পর্যন্ত।
  কাশীর চিনি ৯ টাকা মণ। আর সাধারন চিনি ৮ টাকা দাম
বীরভূম এর মিহি চাল আড়াই টাকা মণ। রামশাল চালের যথেষ্ঠ চাহিদা। মোটা চাল দু টাকা চার আনা  মণ।
  ভালো ইংরেজ কুঠির বাক্স বন্দী নিল আড়াই শো টাকা।
আবার খারাপ হলে ১৯০ টাকা থেকে নেমে ১৬০ টাকা পর্যন্ত।
   সুরুল সরকার বাড়ির এই সব নথিপত্র নানা বিধ তথ্যের এক বিশাল ভাণ্ডার।
এই সব নথিপত্র বিশ্বভারতী র সংগ্রহ শালাকে দেওয়া হয়।
এই সব নথি পত্র ঘেঁটে  খ্যাত " সুরুল নথি সংকলন " প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয়েছিল বিশ্বভারতী গবেষণা প্রকাশন সমিতির দ্বারা ১৯৮৩ সালে। এই দুরূহ গবেষণা কাজটি করেছিলেন
বুদ্ধদেব আচার্য মহাশয়।
এই লেখার সব তথ্যই সেখান থেকে সংগৃহীত।
---------+-------------------------------------------@ প্রণব ভট্টাচার্য্য

No comments:

Post a Comment