।। সুরুল কুঠি এবং চীপ সাহেব।।
১৭৮২ সালে জন চীপ সাহেব সুরুলে এলেন।
কমার্শিয়াল রেসিডেণ্ট হিসাবে।
তিনি ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি র বেতনভুক কর্মচারী ছিলেন।
আবার স্বাধীন ভাবে নিজস্ব ব্যবসা করার অধিকার ও তাঁর ছিল।
সুরুল গ্রামের উত্তরে পশ্চিমের বিস্তৃর্ণ উঁচু নীচু ঢেউ খেলানো
ডাঙ্গা জমি। মাটি লাল। কাঁকড় পাথর। ল্যাটেরাইট মাটি।
ছোটো খাটো টিলা। সেখানেই অনেক খানি জমি ইজারা নিলেন। শুরু করলেন তাঁর কুঠি নির্মান।
চীপ সাহেব স্থির করেই নিয়েছিলেন যে এখানেই জীবন কাটাবেন। সিভিল সার্ভিস থেকে এসেছিলেন। ধনী ছিলেন।
ব্যবসার মাধ্যমে বিশাল ধনী হয়েছিলেন।
কুঠি বাড়ি তো নয়। যেন ছোট খাটো দুর্গ।
মোটা উঁচু সীমানা প্রাচীর। ভিতরে জলাশয়। অনেক গুলি নানা আকারের বাড়ির গুচ্ছ। গুপ্তকক্ষ। সুড়ঙ্গ। বিস্তৃত বাগান। বাগানে নানা ফুল ফলের গাছ। পশু পক্ষী। বাগান পরিচর্যার জন্য অনেক মালী।
স্বামী স্ত্রী দুইজন মানুষ। তাঁর স্ত্রীর ফরমায়েশ খাটার জন্য বেশ কয়েকজন মহিলা পুরুষ।
বেশ রুচিবান মানুষ।
একদিনে তৈরি হয়নি। সময় লেগেছে। জলাশয় গুলি কাটানো হয়েছে। এত এত ইঁট লেগেছে। চূণ সুরকী র গাঁথনি র জন্য '।কত মানুষের পরিশ্রম।
কাষ্ঠ ঘূটিং ' সহ কত কি যে লেগেছে।আর কত মানুষের এর সাথে সংযুক্তি। বিশাল তার আয়োজন। নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত
করার জন্য পাহারাদার সিপাই নিযুক্ত হয়েছে।
এই কুঠিবাড়ি তে বসে প্রথমে শুরু করেছেন কাপড়ের
ব্যবসা।
" গড়া কাপড় "। নামটা নূতন ঠেকছে। স্বাভাবিক।
মোটা সুতোর ঠাস বুনন শক্ত কাপড়। টুকরো টুকুরো আবার থান। নানা মাপের। সাদা ও আছে আবার রঙিন ও আছে।
ধোবারা মুগুর পিটিয়ে কেচে পরিষ্কার করে। ধবধবে সাদা চাই।
চীপ সাহেব তো ব্যবসাটাকে বড় করতে ; বাণিজ্যিক ভিত্তিতে করতে চাইলেন। আশেপাশে র সব গাঁ য়েই তাঁতি রা আছে বটে। কিন্তু -।
রাইপুরের সিংহ বাবুদের পূর্বপুরুষ লালচাঁদ বাবুর ডাক পড়ল। ইতিমধ্যে ই সিংহ বাবুরা চীপ সাহেবের ব্যবসার সাথে যুক্ত হয়েছেন।
তিনি তাঁদের আদি বাসস্থান মেদিনীপুর এর চন্দ্রকোনা এলাকা থেকে প্রায় হাজার ঘর তাঁতি কে নিয়ে এলেন এই এলাকায়। নানা গ্রামে তাঁদের বাসস্থান গড়ে উঠল। তাঁতিরা দাদন পেলেন। সব তাঁতিদের ই দাদন দেওয়া হত। দাদন অনুযায়ী তাঁদের কাছ থেকে গড়া কাপড় আদায় করা হত। দাদন দেওয়া বা নেওয়া বা তার জন্য কাপড় আদায় দেওয়ার জন্য তাঁতিদের কাছ থেকে লিখিত সম্মতি পত্র নেওয়া হত।
একহাজার ঘর তাঁতিদের কাছ থেকে হাজার থান গড়া কাপড়। তাঁতিদের তাঁত ঘর থেকে সেগুলি সংগ্রহ করে চীপ সাহেবের কুঠির গুদামে পৌঁছে দেওয়া।
শ্রী কানাই লাল দীর্ঘাঙ্গী মহাশয় তাঁর বিখ্যাত বই " বিদ্রোহ বহ্নি " তে লিখেছেন " সিংহ বাবুদের আদি বাসস্থান ছিল চন্দ্রকোনা র নতুন হাট। বাবু শ্যাম কিশোর সিংহ নতুন হাট হতে কয়েক হাজার তাঁতিদের সুরুলে নিয়ে গেছলেন। তাঁতীরা গড়া নামিত কাপড়ের থান তৈরী করবার জন্য। ঐ থান গুলি নীল কুঠির জলে রঞ্জিত করে ইংল্যান্ড এর নৌ বিভাগে নৌ সেনাদের জন্য পাঠানো হত। সে যুগে দৈনিক
১০০১ টাকা তাঁতীদের কাছ থেকে পেতেন।
শ্যামকিশোর সিংহ কে ই পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়েছে।
এবং তিনি না কি চীপ সাহেবের কুঠি র বা ব্যবসার দেওয়ান ছিলেন। বেঙ্গল পাস্ট এণ্ড প্রেজেন্ট নামে সরকারী দলিলে ( ১৯২৩) তার উল্লেখ আছে । ভল্যুম - পঁচিশ।
এই গড়া বা গড়ে কাপড় ছিল নানা মাপের। ছোট থেকে মাঝারি থেকে বড় থান। ৩৬ হাত বা ৭২ হাত লম্বা আর চওড়া এগারো পোয়া মানে সাড়ে তিন ফুটের মতো।
এই কাপড় গুলি ভালো ভাবে ধৌত করে নীলের সাহায্যে রঞ্জিত করে বিদেশের বাজারে পাঠানো হত। শুধু ইংল্যান্ড নয় রেঙ্গুন ; সিংহল ; মিশর এবং ইউরোপের বাজারে।
সমস্ত কাজের তদারককারী ছিলেন ইউনিয়র নিকলসন।
আর এই সব কাপড় ধোবার জন্য তাঁদের অধীনে ২২০০ ঘর ধোবা ছিলেন। গ্রামের উত্তর পূর্বের ডাঙ্গায় ( এখনকার শান্তিনিকেতনের বিনয় ভবন এলাকা) ।
অবাক লাগে কি বিরাট মাপে ব্যবসা করতেন চীপ সাহেব।
শুধুতো এই গড়া কাপড় নয় - নীল ; গালা ; রেশম ; গুড় ; চিনি ; লোহাপাথর থেকে লোহা তাঁর ব্যবসার পরিধি ক্রমাগত বেড়েছে এবং সম্পদের পরিমান ও। ( চলবে)
আজ এই পর্যন্ত।
---------------------------------- গ্রন্থ সহায়তা। জেলা গেজেটিয়ার। বীরভূম। ও ম্যালি।
রাঢ় ভাবনা পত্রিকা। সম্পা সৌরেন্দ্র নাথ চট্টোপাধ্যায়।
কৌলাল পত্রিকা। সম্পা স্বপন ঠাকুর।
নিজের প্রবন্ধ।
No comments:
Post a Comment