।। কুঠি বাড়ি কেন্দ্রিক ব্যবসা বাণিজ্য।। ত্রয়োদশ পর্ব।
১৭৯২ সাল নাগাদ চীপ কোম্পানির কাছ থেকে ৫০০ মন গালার জন্য ১০০০০ টাকা এবং ১৮০০ সালে ৫৪৪ মন গালার জন্য ৯৯১৫ টাকা পেয়েছিলেন আরস্কাইন সাহেব।
কিন্তু কি কারণে যে আরস্কাইন সাহেব লাক্ষার জন্য লগ্নী বন্ধ করে দেন জানা যায় না। কিন্তু বিদেশে গালার চাহিদা কমেনি। তাই এই ব্যবসায়
দেশীয় অনেক ধনী মানুষ পুঁজি নিয়োগ করেন।
শেরউইল এর রিপোর্ট ১৮৫২ সাল থেকে জানা যায় কুণ্ডহিত কড়েয়ার জঙ্গল থেকেই আগের বছর ১৫০০০০ টাকার লাক্ষা পাওয়া গিয়েছিল।
আরস্কাইন সাহেব গালার ব্যবসায় বিনিয়োগ বন্ধ করে দিলে
মেসার্স ফারকুহারসন এবং পরে ক্যাম্পবেল সাহেব এই ব্যবসা কিছুদিন চালিয়ে ছিলেন। ১৮৮২ সালে তা বন্ধ হয়ে যায়।
যদিও ১৯০৯-১০ সাল পর্যন্ত ইলামবাজার এর স্থানীয় নুড়ি সম্প্রদায় গালা সংগ্রহ বা নিষ্কাশন করত। ইলামবাজার এর হাটতলার পশ্চিমে নুড়ি পাড়ায় কাজ চলত।
গালা বা লাক্ষা - লক্ষ লক্ষ গুটিপোকা র দেহ নিঃসৃত রস থেকে এই প্রাকৃতিক রেজিন সংগৃহীত হত। তাই লাক্ষা।
আবার গলন বা গলানো থেকে গালা এমন টা ও হতে পারে।
ইলামবাজার এবং তার সংলগ্ন জঙ্গল ভূমি র কুসুম ; পলাশ ; কুল ; অশ্বত্থ গাছের কচি ডালে লক্ষ লক্ষ গুটি পোকা বাসা বাঁধত। এই সব গাছের কচি পাতা ছিল গুটিপোকা দের খাদ্য।
তাদেরি দেহ নিঃ সৃত রসে তৈরী করত তাদের নলাকৃতি বাসা। আবার ঐ বাসার মধ্যেই গুটিপোকা দের মৃতদেহ embeded হয়ে যেত। মূলতঃ জঙ্গলের মধ্যে আদিবাসী পল্লী গুলির বাসিন্দারা গাছ থেকে সেই সব কচি ডাল কেটে আনত।
সেই ডালে থাকত পুঞ্জ পুঞ্জ লাক্ষাকীট এর তৈরী নলাকৃতি বাসা। অর্ধস্বচ্ছ হলদেটে রঙের গালা। তার পর তা ডাল থেকে ছাড়িয়ে গুঁড়ো করা। তারপর জলে ভেজানো। তারপর জল থেকে তুলে রোদে শুকানো। উপরের জল কে গন্ধক মিশ্রিত করে কার্পাস পাতা দিয়ে ফোটালে পাওয়া যেত গিরি লাল রঙের রঞ্জক পদার্থ।
যার নাম ' যাবক ' বা আলতা। তা দিয়ে সুতো রাঙানো হত।
মেয়ে রাই একাজ করত। আবার মেয়েদের পায়ে পরার আলতা হিসাবে নাপিতানি রা ব্যবহার করত।
নীচে অধঃক্ষেপিত পদার্থ কে ভালো তাপে গলানো হত।
জ্বালানী হিসাবে ভালো শাল কাঠ লাগত।
তারপর সেই গলন্ত তরল গালাকে নানা ছাঁচে ফেলা হত।
নানা আকৃতি র। বোতাম থেকে চাকতির মতো। খুব পাতলা
leaf গালা র কদর বেশী। আবার কুসুম গাছের গালা র দাম ও বেশী। তারপর বস্তা বন্দী করে চালান করা হত।
লালচে মোটা গালার দাম কম। খুব পাতলা হলদেটে গালার দাম বেশী। সে আজ ও।
গালার চাহিদা আজও কমেনি। সে রঙ শিল্পেই হোক আর কাঠের আসবাব পত্র বার্নিশ করার জন্য ই হোক। তা ছাড়াও গালার ব্যবহার নানা ক্ষেত্রে।।
আমাদের বীরভূম এর ইলামবাজার গালা বা নীল শিল্পের প্রধান কেন্দ্র হলেও বীরভূমের নানা স্থান ছাড়াও বাঙ্গলার বিভিন্ন জেলাতে বা ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে লাক্ষা র চাষ হত। বিদেশে ও হত। এ এক প্রাচীন শিল্প।
আমরা জানি ১৮৮২ সালের পর নীল বা গালার ব্যবসা
কুঠিবাড়ি ; ফ্যাক্টরি ; গুদাম ঘর সব কিনে নেন বাঁকুড়া র
বাবু রায় বগলানন্দ মুখার্জী। তিনি তাঁর আত্মীয় দের সাহায্যে আরও কিছু দিন ব্যবসা চালিয়ে ছিলেন। গালা আরও অনেক দিন চলেছিল।
এখনও ইলামবাজার ব্রাহ্মণ পাড়ায় ভাঙ্গা দেওয়াল ঘেরা
একটা জায়গা আছে যেখানে একসাথে বসে গালা শিল্পী রা
কাজ করতেন। নুড়িরা স্বাধীন ভাবে নিজেদের বাড়িতে বসেও আবার এই খানে বসে সব উপকরণ নিয়ে ঠিকা প্রথাতেও কাজ করতেন।
সেই স্থান কজনই বা চেনেন। আর চিনে হবেই বা কি।
হারিয়েছে ঐতিহ্যের গালা শিল্প। কালের নিয়মে যেমন অনেক কিছু হারায়। আবার অনেক কিছু নতুন আসে।
ইলামবাজার এর তুলা পট্টিতে আর কোন তুলার বাজার ও বসেনা। নীলাম ও হয়না। নুড়িরা হারিয়েছে।
বেঁচে আছে কিছু নাম নুড়ি পুকুর ; নুড়ি গোড়ে ; চাঁদপুকুর ;
সরান গোড়ে আর তার পাশে পাশে বড় বড় ভাঙ্গা চৌবাচ্চা।
আর নীল ডাঙ্গা ; নেলেগড় ; সাহেব ডাঙ্গা এই সব নাম।
এই সব নামের মধ্যে ই বেঁচে আছে সেদিনের নীল ; গালা শিল্পের স্মৃতি।
--------------------------------------------------------@ প্রণব ভট্টাচার্য্য
তথ্য সহায়তা। জেলা গেজেটিয়ার। বীরভূম। ও ম্যালি।
পত্রিকা। রাঢ় ভাবনা। নীল গালা বিশেষ সংখ্যা। সম্পা।
সৌরেন্দ্র নাথ চট্টোপাধ্যায়।
কৌলাল প্রকাশনীর বঙ্গ সংস্কৃতির অঙ্গনে। নিজের প্রবন্ধ
No comments:
Post a Comment