।। কুঠি বাড়ি ভিত্তিক ব্যবসা বাণিজ্য।। ১৫ দশ পর্ব।
----------+---- -------- -------------------- ----------------------
ফ্রুসার্ড সাহেব।
জাতে ফরাসী।
দৃঢ় আত্মবিশ্বাস তাঁর। প্রচণ্ড উদ্যমী। পরিশ্রমী।
কয়েক বছরের মধ্যেই ভাগ্য লক্ষী র দেখা পাবেন এই বিশ্বাসে
এদেশে এসেছেন। ব্যবসা। ব্যবসার মাধ্যমেই তাঁকে তাঁর ভাগ্য
ফেরাতে হবে। হতে হবে ভীষণ ধনী।
অনেক চেষ্টা চরিত্র করে ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি র কাছ থেকে
কমার্শিয়াল এজেন্ট হবার কাগজ হাতে পেয়েছেন।
এসেছেন বীরভূম। 'Mor' নদীর উত্তর পারে। এই গুনুটিয়া য়।
বীরভূম এর উত্তর পূর্বাংশ। অতি উর্বর জমি। সেখানের স্থানীয়
মানুষ রা রেশম গুটি পোকার চাষ করেন। রেশম উৎপন্ন করেন। রেশমের কাপড় বোনেন।
নিজের টাকায় এই রেশম কিনে কোম্পানি কে নিয়মিত ; নির্দিষ্ট দরে সরবরাহ করাই তাঁর মূল কাজ।
১৭৮৫ নাগাদ ময়ূরাক্ষী র উত্তর তীরে এই গুনুটিয়া য় রেশম
কুঠি কারখানা গড়ার জন্য তিনি ' পাইকস্ত রায়ত ' হিসাবে জমি পেয়েছেন এবং এক মি: এডওয়ার্ড হে সাহেবের কাছ থেকে ২০০০০ টাকায় একটা বিল্ডিং সমেত জায়গা কিনেছেন। বছর দুয়েক বাদে পাকাপাকি ভাবে কোম্পানি র
কমার্শিয়াল এজেন্ট হিসাবে গণ্য হয়েছেন।
প্রচণ্ড পরিশ্রমী। কিন্তু শুরু থেকেই শুরু হয়েছে নানা বিড়ম্বনা।
ময়ূরাক্ষী র প্রবল বন্যায় ভেসে গেল তাঁর কুঠিবাড়ি।
মারাত্নক ক্ষয় ক্ষতি। প্রায় ১৫০০০ টাকায় কেনা ঘর বাড়ির
অনেক গুলি ধুয়ে মুছে গেল।
তাঁর এই ক্ষয় ক্ষতির সময় কোম্পানি র ছোটখাটো কর্তারা
তাঁর পাশে দাঁড়ালেন না। বরং নানা বাধা।
সব কিছু সামলাবার সময় স্থানীয় মানুষেরা মওকা বুঝে তাঁর
কাছ থেকে সব কিছুর জন্য চড়া দাম নিতে লাগলো।
বীরভূমের রাজার অধীনস্থ সব জমি। তাঁর কাছ থেকেই খাজনা দিয়ে জমির লীজ নিতে হবে। সেই সময় একর প্রতি
খাজনা ১২ আনা। রাজা নিলেন ৩-৪ টাকা একর প্রতি।
জঙ্গল পরিষ্কার সহ অন্যান্য কাজে তাঁর খরচ হতে লাগলো
তুলনায় বেশী।
পরে বন্যার জল আটকাতে তাঁকে নিজ খরচে বাঁধ নির্মান
এবং কুঠি বাড়ির চারদিকে প্রাচীর নির্মান করাতে হয়।
সেখানেও অনেক টাকা তাঁকে ঢালতে হয়।
তবু হাল ছাড়েন নি এই ফ্রুসার্ড সাহেব।
লক্ষ্যে তিনি অবিচল।
কিন্তু না। ভাগ্য তাঁর সহায় নয়। বাকী বকেয়া ; রাজার খাজনা বাকী। তার জন্য তাঁর নালিশ। আবেদন নিবেদন বকেয়া মকুবের জন্য। কিন্তু কোম্পানি র কর্তারা তাঁর প্রতি সদয় ও নন। আবার রেশম সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাবার আশংকা য় তাঁর বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা ও নেওয়া যায়নি।
শেষ পর্যন্ত ১৭৯১ সালে লর্ড কর্ণওয়ালিশ তাঁর সমস্ত বকেয়া
মকুব করে দেন। রাজাকে বলে খাজনা ও অনেক কম করিয়ে দিলে তিনি কিছুটা স্বস্তি পান। নূতন উদ্যমে আবার শুরু করেন কাজ।
ইতিমধ্যে ১০ বছর হয়ে গেছে দেশ ছাড়া। ফেরার ও আর আশা নেই। অতি সাধারন মানের জীবনযাত্রা।
এই পরিস্থিতি তে বীরভূম কেই তিনি তাঁর স্থায়ী বসবাসের স্থান করে নিলেন।
পরে কিন্তু হয়ে উঠেছিলেন একজন প্রভাবশালী মানুষ।
জঙ্গল জমি পরিষ্কার করে ; বন্য জীবজন্তু দের তাড়িয়ে ; চোর ডাকাতদের হাত থেকে স্থানীয় মানুষদের রক্ষা করে তিনি
জঙ্গল ভূমির গ্রাম গুলিতে হয়ে উঠেছিলেন প্রায় রক্ষাকর্তা।
পরে হয়েছিলেন জজ ; এবং ম্যাজিষ্ট্রেট।
কুঠি বাড়ির চারপাশে র অনেক জঙ্গল' জমি পরিষ্কার করিয়ে
রেশম চাষের জন্য জমি তৈরী করে ; তুঁত চাষের ব্যবস্থা করেন। এবং রেশম শিল্পের যথেষ্ট প্রসার ঘটান।
মি: ই ; জি ; ড্রেক - ব্রকম্যান এর গবেষণা র রিপোর্ট অনুযায়ী
১৭৯১ সাল নাগাদ সরকারের অনুরোধে বীরভূম এর রাজা তাঁকে ২৫০০ বিঘা জমি লীজ দিচ্ছেন তাঁকে ১২ বছরের জন্য বার্ষিক ১৫০০ টাকা খাজনায়। পরে ১৮০০ সাল নাগাদ
খাজনা বেড়ে হয় ৩৪১১ টাকা।
শোনা যায় তাঁর রেশম কুঠিতে তখন প্রায় ১৫০০ কর্মচারী।
সব মিলিয়ে প্রায় ৪০০০ জন কাজ করছেন তাঁর অধীনে।
বিশাল কুঠিবাড়ি র আয়তন। যেন ছোটখাটো এক শহর।
কর্মমুখর। প্রাণচঞ্চল সে কুঠি বাড়ি। গুনুটিয়া রেশম কুঠি।
১৮০৭ সালে তাঁর মৃত্যুর পর সুরুল কুঠির বিখ্যাত চীপ সাহেব ৩৪১৫ টাকার খাজনায় গুনুটিয়া কুঠির ইজারা নেন।
এই কুঠি থেকেই
বীরভূম জেলা র রেশম চাষ সহ অন্যান্য ব্যবসার শ্রী বৃদ্ধি ঘটান।
চীপ সাহেবের মৃত্যুর পর সেক্সপিয়ার নামে এক ইংরেজ ব্যবসায়ী এই কুঠি র কমার্শিয়াল রেসিডেণ্ট হন।
১৮৩৫ সালের পর এই কুঠির মালিকানা চলে যায় অন্য এক
ইংরেজ কোম্পানি র হাতে। ধীরে ধীরে ক্ষয়প্রাপ্ত হতে থাকে
এই কুঠির কর্মকাণ্ড। ১৮৫০ নাগাদ কিছুটা জেগে উঠেও
শেষ পর্যন্ত আর কিছু দিন সচল থাকার পর বন্ধ হয়ে যায় এই
কুঠি বাড়ি।১৮৩৫ এর পর সরকার ই এখান থেকে সিল্ক উৎপাদন বন্ধ করে দেন।
উনিশ শতকের গোড়াতেও যে কুঠি বাড়ি থেকে প্রায় ২৪ লক্ষ টাকার রেশম উৎপাদিত হত ; কুঠির ভিতরে মূল কারখানা। আর আশেপাশে দেশী য় এবং ইংরেজ অধীনস্থ আরও ৬ টি কারখানা ; যে কুঠি বাড়িতে এক সময় গুটি থেকে সুতো বের করার জন্য প্রায় ২৪০০ লোকের কর্মব্যস্ততা ;
পলু ; পোকাপালন ; তূঁত চাষ সব মিলিয়ে প্রায় ১৫০০০ মানুষের নিযুক্তি - -
' কালের অমোঘ নিয়মে ১৫ একর জায়গা নিয়ে ময়ুরাক্ষীর তীরে আজও পড়ে আছে তার ধ্বংসাবশেষ '।
ফ্রুসার্ড সাহেবের ব্যক্তিগত ভাবে ধনী হয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি।
দেশে ফেরা ও হয়ে ওঠেনি। বীরভূম এর মাটিতেই তাঁর শেষ শয্যা পাতা হয়েছে। কিন্তু বীরভূম এর বিখ্যাত রেশম শিল্পের উন্নতি তে তাঁর ভূমিকাকে অস্বীকার করা যাবে না।
-------------- ------------------- ----------- © প্রণব ভট্টাচার্য।
শেষ হল কুঠি বাড়ি ভিত্তিক ব্যবসা বাণিজ্য।
গ্রন্থ সহায়তা। জেলা গেজেটিয়ার। বীরভূম। ও ম্যালি।
পত্রিকা। রাঢ় ভাবনা। সম্পা সৌরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়।