Wednesday, 26 March 2025

গা ছমছম

।। গা ছমছম।।

কি বলছেন!  গা ছমছম করবেনা।
বসে আছেন ঝাঁকড়া বটগাছ তলায়। তাঁতি পুকুরের পাড়ে।
হয়তো একা নয়। দুজন আছেন। তখন রাতের দিকে একবার পুকুর দিকে আসা অনেকের অভ্যেস ছিল।
ঝড় নাই জল নাই শোঁ শোঁ বাতাস নাই। হঠাৎ ই একটা বটডাল ভেঙে পড়ল আপনার পায়ের কাছে।
ঝুরঝুর করে বালি পড়তে লাগল।
আর থাকা যায়। ঝাঁকড়া তেঁতুল গাছ থেকে উড়ে গেল রাতের পাখি একটা পাখা ঝটপট করে।
আর এখানে থাকা যায়।
একবার  রাজমিস্ত্রী দের দল এখানে ডেরা বেঁধেছিল। থাকতে পারেনি।

# ওটা কি রে বাবা। বিড়াল টা যেন অনেক বড় হয়ে যাচ্ছে।
রাস্তা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে। একবার রাস্তার ওধারে যাচ্ছে।
কেমন যেন চেহারা পালটে যাচ্ছে।
আঁকুড়ে দের ধর্ম রাজ থানের বটতলা র কাছে।
আর আপনি রাস্তা পার হতে পারেন!
গলা তো শুকিয়ে কাঠ। গলা দিয়ে কোন আওয়াজ বের হচ্ছেনা। উঁহু এরাস্তা য় পার হওয়া যাবেনা।
পাশেই গাঁয়ের বাইরে উত্তর দিকে পাশাপাশি দুই পুকুর।
মাঝখানে র জায়গা মুখগ্নির। তার ও নীচে গবাদি পশু মারা গেলে ফেলার জায়গা। মুচি রা চামড়া ছাড়িয়ে নিয়ে যায়।
তাঁতি পুকুরের পাড়ের খুব লম্বা লম্বা তালগাছ থেকে নেমে আসে শকুনেরা। মরা পশুর মাংসে তাদের মহাভোজ।
এমন এক জায়গা!
এ জায়গা পার হওয়া।

সাতকাহনিয়া গ্রামের হালদার বাড়ির দালানে গানবাজনার আসর বসেছিল। অযোধ্যার  যাত্রা দলের পালার বাজনা,
মিউজিকের রিহার্সাল হচ্ছে।  বনকাটির নবকিশোর সূত্রধর বেহালা সঙ্গত করতে গিয়েছিল । মাষ্টার মশাই ননীবাবু হারমোনিয়াম ধরে। তিনিই মোশন মাষ্টার। প্রত্যেক দৃশ্যের সাথে উপযুক্ত বাজনা চাই। 
নদীর ওপারের উদয়পুরের রাধাশ্যাম দাসএসেছে। ভালো গায়। বিবেক এর গান। বাঁকুড়া থেকে তারিণী এসেছে। ফ্লুট আর সানাই দুই ই বাজায়। ভালো দম। তবে তার জন্য বোতল লাগে।
গলায় ঢকঢক করে ঢেলে, বাইরে থেকে এসে,  ধরে ফ্লুট।  বেশ কয়েকটা দৃশ্য হতে হতেই  রাত হয়ে গেল বেশ।
সূত্রধর মশাই  আর কি  রাস্তা পেরিয়ে যেতে পারা যায়!
বেরিয়েও   ফিরে গেল সাতকাহনিয়া।  সাথে লোক নিতে হল।  হাতে হ্যারিকেন। । সারা রাস্তাই নির্জন। আঁকুড়ে পাড়া, তেঁতুল তলার বাউরি পাড়া সব ঘুমিয়ে আছে। নিঝুম সেদিনের উঁচু নীচু হাটতলা।
হাটতলার পশ্চিমে বিরাট পাকুড় গাছ । কামার দের পাকুড়, বটতলা। তার দক্ষিণে এক ডোবা। সাদা শালুক ফুটে আছে।
আকাশে সামান্য জোৎস্নার আলো।
একটা কালো সদ্যোজাত বাছুর কেবলই রাস্তার এপাশ আর ওপাশ করছে। মাঝে মাঝে যেন তার রঙ বদলে যাচ্ছে।
  চুপ করে পাকুড় তলায় দাঁড়িয়ে থাকতে হল।
একসময় সে ছানা বাছুর ডোবার জলে ঝাঁপ দিল।
এ যে বাছুর নয় কোন, বুঝতে কি আর বাকি থাকে।
শেষ পথ টুকু রাম রাম জপতে জপতে জায়গা টা পার হল
নবকিশোর। এ অন্য আরেক দিনের কথা।

# সাতকাহনিয়া আর ডাঙ্গাল আদিবাসী পাড়ার মাঝখানে
ঘণ শাল জঙ্গল। জঙ্গলের ভিতরে গোরু গাড়ি চলার পথ।
আদিবাসী পাড়ার মুখটায় চৌমাথা।
এখানে প্রায়ই লালশালু, মাটির ভাঁড়, সিঁদুর লাগানো পাতা,
কাটা মুরগী র রক্ত,কাঠের  আঙার  প্রায়ই দেখা যায়। আদিবাসী মানুষ রা
এখানে ভূত ছাড়ায়।
অত সহজ এই রাস্তায় হাঁস বা মুরগী হাতে ঝুলিয়ে কেউ
যায়। বা মাংস নিয়ে।
একবার বনকাটির রামদাস মিস্ত্রী র ডাক পড়েছে ডাঙ্গাল গ্রামের ঘোষ বাবুদের ঘরে,  কিছু ভালো কাজ হয়তো হবে।
খাসি ছাগল কাটা হয়েছিল। ভোজ হবে। প্রায় ই হয়।  কিছুটা মাংস সে পেয়েছিল।
গামছায় বেঁধে, থলিতে ভরে ফিরছে। যাবে বনকাটি। জঙ্গলের মুখে
চৌমাথার মোড় থেকে তার মনে হচ্ছে কেউ পিছু পিছু আসছে।
  আরও জোরে । পা ফেলছে। হঠাৎ ই বনকাটির পচুই মদশাল থেকে ফিরছে ঠাকুর মাঝি। হাতে লম্বা লাঠি।
দেখে চিনতে পারল। বলল যা চলে যা। আমি এই এখানে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমাকে কেউ ছোঁবেনা। তবে তোকে ছুঁয়েছে।
যা। ঘরে গিয়ে বুঝতে পারবি।
যাক। ঘরে এসে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।
কি ওটা!
- না, কিছুটা মাংস আছে। ভালো করে রাঁধো দিকি।
তো। তেল মসলা নুন ঝাল যেমন দেবার দিয়ে যথাসাধ্য ভালো করে রান্না করল মিস্ত্রীর  স্ত্রী।
আহা!  মাংসের ঝোল দিয়ে ভাত। আর কি লাগে!
কিন্তু  এ মা। একি!
কি হল!
খেয়ে দ্যাখো। তাহলেই বুঝতে পারবে।
সত্যিই তো। স্বাদহীন ট্যালটেলে ঝোল। কোন স্বাদই নাই। আর মাংসের টুকরো গুলো যেন মাংস নয়। যেন চালকুমড়োর ঝোল। এ কি খাওয়া যায়!
হঠাৎ ই তার মনে পড়ল ঠাকুর মাঝি র কথা। তোকে একটু ছুঁয়েছে। যা ঘরে গেলে বুঝতে পারবি। তার গা শিউরে উঠল।
খাওয়া উঠল মাথায়। ভয়ে কাঁপুনি আর থামেনা যেন।
# অযোধ্যা গ্রামের উত্তরে বিশাল আমবাগান। মোটা মোটা মোটা গুঁড়ি। মাথায় মাথায় ঠিকে আছে। দিনের বেলাতে ও
ছায়া ছায়া অন্ধকার যেন। একটা ফলন্ত জামগাছ তলা দিয়ে গোরু গাড়ি চলার বালি মাটির পথ। রাস্তা কিছুদূর গিয়ে বাঁক নিয়েছে পশ্চিমে। ডানপাশে তালগাছ ঘেরা পুকুর।
বাঁশবাগান। আর আঁকড় গাছের ঝোপ। এই রাস্তায় সহজে কেউ সন্ধ্যে বেলায় পা বাড়ায়না। দু ঘর ডোম বাস করত।
পরে উঠে যায়। রাতের বেলায় বাঁশ ঝোপে কারা যেন খেলা করে। মাঝে মাঝে মনে হয় যেন বাঁশের বনে ঝড় লেগেছে।
এই রাস্তা তেই একটা কালো বিড়াল কে দেখা যায়। কালো বিড়াল না কি অন্য কিছু। কখনও মনে হয় বিড়াল আবার কখনো মনে হয় অন্য কোন জন্তু।
আর দেখা যায় সাদা শাড়ি পরে কেউ রাস্তার ধারে বসে কাঁদছে। সরু, খনা সুরে। যেন কাউকে ডাকছে। তার চারপাশে
সেই জন্তু টা গোল করে ঘুরছে।
হঠাৎ হঠাৎ মাছ লাফিয়ে ওঠে নাপিত পুকুরে। যেন মনে হবে জাল টেনে কেউ মাছ ধরছে। কিন্তু কেউ কোথাও নেই।
ঘরের এই উত্তর দিকে মুখ মানে দরজা রক্ষিত রা  সবাই বন্ধ করে দিয়েছে।
# আর পাষাণ চণ্ডী বাগান। আমগাছে ভর্তি। নীচে নানা ঝোপ।
পাশেই কাঁদর। কাঁদরের পাড়ে বিরাট বিরাট অর্জুন, চাকলতা গাছ। আরও কত রকমের গাছ। পাশেই শ্মশান।
কাঁদরের উপর বাঁশের সেতু। ওপারে পঞ্চানন বাবু এসে শর মানা পরিষ্কার করে চাষযোগ্য জমি তৈরি করেছেন। ফল বাগিচা তৈরি করছেন। ওপারে যাওয়া টাই একটা ব্যাপার।
বাঁশের সাঁকো তে উঠলে মচমচ করে। মনে হয় ভেঙে পড়ে যাবে।
তো। এপারের ডাঙ্গার পাশে  মুচি পাড়া। আর বাঁশবাগান।
বেশ কিছু বেল গাছ। কানাই মুচি র ঘর।। মুচি পাড়া থেকে রাত পাহারা দিতে পঞ্চানন বাবু র বাগানে যায় কেউ কেউ।
আর চলে যায় শেষ বিকেলে ই। কেননা ঐ শ্মশানের পাশে ঝাঁকড়া গাছটা। কি যে গাছ, কেউ নাম জানেনা। ঐ গাছে তো তাদের আস্তানা। লম্বা লম্বা পা ঝুলিয়ে বসে থাকে সব।
তবে সেদিন হল এক কান্ড। রামা আর বামা যাচ্ছে পঞ্চানন বাবু র মাঠে। সেদিন সন্ধ্যে হয়ে গেছে। অন্ধকার রাত। পশ্চিম আকাশে একফালি চাঁদ।
বাঁশের সাঁকো তে উঠতে যাবে এমন সময় দেখল খালপাড় দিয়ে  সাতকাহনার হাঁড়ি পাড়ার  দিক থেকে কেউ বোধহয় আসছে। কে তা আঁধারে বোঝা যায়না। কিছুটা কাছে এলে
বোঝা গেল এক উলঙ্গিনী। মাথায় তার মাটির হোলায় আগুন জ্বলছে। ঝাঁকড়া গাছটায় শুরু হয়ে গেল যেন হুটোপুটি।
এই দৃশ্য দেখে আর সাঁকো পার হবে কি, উল্টো দিকে, নিজেদের পাড়ার দিকে দিল ছূট। বাবা গো মা গো।
তারপর এমন জ্বর এলো যে যে সে জ্বর ছাড়ল সাত দিন পর।
রায়দের কালীথানের ওষুধ খেয়ে আর ঝাড়ফুঁকে।

# ইনি না কি তিন  মাদনাবুড়ো  বা  মহাদানার ছোট ভাই। ঝাঁকড়া শ্যাওড়া গাছের তলায় তার আটন। নিমটিকুড়ি যাবার পথে
তিনি বিচরণ করেন। তাঁকে পার হয়ে যাওয়া সহজ নয়।
কখনও তিনি বাঘের পিঠে চেপে থাকেন। আবার কখনো সাদা
বিড়াল বা গোদানা। আবার কখনো বিরাট সাপ।  রাস্তা য় এপার ওপার করছে। কতজনা যে এখানে ভিমরি খেয়ে পড়েছে তার ঠিক নেই। জয় বাবা, জয় বাবা করে এখনও পার হয় কতজনা। এ জায়গা পার হবার সময় বুক ঢিপ ঢিপ করে।
এমন কত জায়গা যে ছিল  তখন, যেখান দিয়ে যেতে গেলেই  গা ছমছম। বুক ঢিপ ঢিপ। গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠা ।
  তেনারা সব গেলেন কোথা!  না কি রয়ে গেছেন এখনও।
কোথাও থাকুন আর না ই থাকুন অনেক মানুষের মনের আঁধারে  তাঁরা থেকে যাবেনই। ভূত, প্রেত, দৈত্য, দানা,
শাঁখচুন্নি, আরও কত ভূতিনী, প্রেতিনী চরে বেড়াচ্ছে
মনের কানাগলিতে।
------------ ------------ ------------ ------------ ------------  সমাপ্ত

আগামী কাল বা পরশু দ্বিতীয় অংশ। তারপর ----

No comments:

Post a Comment