বীরভূম কে বলা হয় ' ধর্মসাধনার জাদুঘর "। নানা ধর্মীয় আন্দোলনের স্রোত বীরভূমের উপর দিয়ে বয়ে গেছে।
তৈরি হয়েছে নানা মন্দির মসজিদ।
সমগ্র রাঢ়বঙ্গ তো দূর গোটা বীরভূম কে আলোচনায় ধরা সম্ভব নয়। সংক্ষিপ্ত এক রূপরেখা তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
জৈন ধর্ম বীরভূমের উপর নেমে এসেছে। কোন জৈন মন্দির এখানে যদিও নাই কিন্তু ছিল। ঘুড়িষা গ্রামে জৈন তীর্থঙ্কর সর্পছত্রধারী পার্শ্বনাথ জীর মূর্তি পথের ধারে পড়ে আছে।
গ্রামে রাস্তার পাশে পড়ে থাকা নানা জৈন মূর্তি ছোট বেলায় দেখেছি। ভগ্ন। ভাঙ্গা যে হয়েছে কঠিন আঘাতে তা পরিষ্কার বোঝা যায়।
জাতক কাহিনীতে সত্যতা যদি কিছু মাত্র থাকে তাহলে বলা যায় বুদ্ধদেব বীরভূমের উপর দিয়ে হেঁটে পুণ্ড্রবর্ধনে গিয়েছিলেন। ইলামবাজার নিকট বর্তী দেবীপুর গ্রামে
দেবী সুহ্মেশ্বরী র ভগ্ন মূর্তির পাদদেশে খোদিত ছিল
" যে ধর্মের হেতু হইতে উৎপত্তি, ------------ " যে ধর্ম্মা হেতু
প্রভবা হেতুং তেষাং তথাগতহ্যবদৎ। তেষাঞ্চ যো নিরোধঃ
এবং বাদি মহাশ্রমণঃ "
এখানের ধর্মরাজের নাম " সুহ্মরায় "। সুহ্ম অতি প্রাচীণ শব্দ।
রাঢ়দেশের প্রাচীণ নাম ই " সুহ্ম "। মহাভারতের টীকাকার নীলকন্ঠ বলেছেন " সুহ্মঃ রাঢ়া "
তাছাড়া ' বুদ্ধরায় ' বা বুধোরায় বা বুদ্ধেশ্বর শিবের নামে বেঁচে আছে বুদ্ধের স্মৃতি। কোন বৌদ্ধ স্তুপ বা মন্দিরের নিদর্শন নাই।
হয়তো ছিল। বা হয়ত এখনও মাটির নীচে।
বাঙ্গলার ইতিহাস তো অধিকাংশ ক্ষেত্রে মাটির নীচে ই।
------------ ------------ ------------ ------------ ------------
বৈচিত্রময় বীরভূম ঃ বৈচিত্র্য এর ভূ প্রকৃতি তে। মাটিই তো কথা বলে। মানুষের রক্তে। তার শরীরে, মনে।
বিচিত্র এই বীরভূম। মননের বৈচিত্র্য। সেই বৈচিত্র্য থেকেই
মন্দির স্থাপত্য রীতি র এত বিচিত্রতা বীরভূম ছাড়া অন্য কোথাও দেখা যায়না। বীরভূম কে বলা হয় " ধর্মসাধনার জাদুঘর "। নানা ধর্মীয় আন্দোলনের স্রোত বয়ে গেছে বীরভূমের উপর দিয়ে।
জৈন, সহজিয়া বৌদ্ধ, শৈব, শাক্ত, বৈষ্ণবীয় এবং ইসলাম। সুফীবাদের প্রভাব। নানা ধর্মীয় স্রোত। মানুষের মনোজগতে এর সুগভীর প্রভাব আছে।
চালা, রত্ন, শিখর, দেউল সহ ভিত্তিভূমি থেকে কৌণিক ভাবে
উপরে উঠে যাওয়া রীতি সহ নানা রীতির সমাবেশ বীরভূমে।
প্রস্তর নির্মিত, ল্যাটেরাইট বোল্ডার ( কামানো পাথর ও বলা হয়) । ছাড়া বাকী সব মন্দির ই ইঁটের তৈরী। নিকট বর্তী
ছোট নাগপুর মালভূমি থেকে পাথর এনে তাকে নির্দিষ্ট রূপ দেওয়ার জন্য যে অর্থ বিনিয়োগ দরকার তা এখানে খুব কমই হয়েছে। স্থানীয় ভূস্বামী বা ধনী ব্যবসায়ী বা রাজকর্মচারী রাই বা পণ্ডিত রা
মন্দির গুলি নির্মান করিয়েছিলেন।
বীরভূমের মন্দির স্থাপত্য এবং তার অলংকরণ বাঙ্গলার মন্দির স্থাপত্য শিল্পের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন।
বাঙ্গলার সমাজ বিবর্তনের ও বাঙালির মনস্বিতার ও ভাবপ্রবনতা র চিত্র এই মন্দির ভাস্কর্যের মধ্যে প্রতিফলিত।
মঙ্গলকাব্য সমূহের সমাজ চিত্রণের কথাকে মাথায় রেখেও বলতে হচ্ছে " পটভূমির প্রসারে, কল্পনার বিস্তারে, এবং শিল্প সৃষ্টির দক্ষতায় বাঙ্গলার মন্দির শিল্পকে সমসাময়িক যুগের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম দলিল বলে অভিহিত করা চলে। "
" বাঙ্গলার মন্দির বাঙ্গালীর জাতীয় তীর্থ। "
বাঙ্গালী র আন্তরহৃদয়ের পরিচয় দিতে, তার স্পর্শশীলতার, তার আনন্দ বেদনার এবং সর্বোপরি তার আধাত্মিক অনুভূতির ইঙ্গিতে বাংলার দেবদেউল গুলি একান্তই অপ্রতিদ্বন্দ্বী। " ( কল্যাণ কুমার গাঙ্গুলি)
প্রস্তর নির্মিত দেউল ঃ রসা বড়রা, কবিলাসপুর, পাঁচড়া, মহুলা, রসা, পারশুণ্ডি । নাগর রীতি র
ল্যাটেরাইট বোল্ডার নির্মিত, ভিত্তি ঃ দুবরাজপুর, মল্লারপুর, বক্রেশ্বর ইত্যাদি। এখন সিমেন্ট প্লাষ্টার পড়ায় আর ঠিক বোঝা যায়না।
কোথাও ভিত্তি ল্যাটেরাইটের, উপরিভাগ ইঁটের। চূণ সুরকির গাঁথনি। এবং চূনের প্লাষ্টার।।
রসার প্রস্তর নির্মিত দেউল খুবই বিখ্যাত। সংস্কার হয়েছে। কিন্তু আমলকের কাজ করা যায়নি।
শৈব এবং শাক্ত সাধনার স্থল। এখানের বিশাল বটবৃক্ষের বাহু বন্ধনে রয়েছে আরও কয়েকটি ছোট মন্দিরের ধংসাবশে্ষ। শোনা যায় বর্ধমানের সর্পি গ্রামের জমিদার অর্জুন রায় চৌধুরী এই মন্দির গুলির নির্মাতা।
উচ্চতার দিক দিয়ে ঃ ভাণ্ডীরবন। ( এখানে বিতর্ক আছে
পুরাতত্ত্ব বিভাগ বলেছেন প্রস্তর নির্মিত কিন্তু অন্য বিশেষজ্ঞ রা ম্যাককাচ্চন সাহেব সহ বলেছেন ইঁট নির্মিত)
প্রাচীন মন্দিরের ভিতের উপরে দেওয়ান রামনাথ ভাদুড়ি কর্তৃক নির্মিত। সংস্কারে সংস্কারে মূল চেহারায় পরিবর্তন যা আসা স্বাভাবিক তাই হয়েছে।
১৭৫৪ খ্রীস্টাব্দে নির্মিত। প্রায় ৪৫ ফুট উচ্চ।
* কলেশ্বর। ঢেকার রামজীবন রায় কর্তৃক নির্মিত শিবমন্দির।
* ডাবুক। ডাবুকেশ্বর শিবমন্দির। সর্বোচ্চ শিখর দেউল।
** অসামান্য ফুলপাথরের অলংকরণ সমন্বিত।
গণপুর। গণপুর কে বলা হয় এখানে ফুলপাথরের মহাকাব্য রচিত হয়েছে। অসাধারণ এখানের মন্দিরের কাল। মণ্ডল বাড়ি সহ কালীতলার মন্দির গুচ্ছ । আসামান্য অলংকৃত এখানের দোলমঞ্চ টি।
মুলুটি, মাসড়া, গণপুরের মন্দিররের অন্যতম বৈশিষ্ট্য এখানে চালা রীতি র মন্দিরের আর্চের উপরে মন্দিরলিপি সমূহ। যা নিয়ে আলাদা কাজ করা যায়।
** অনুপম ফুলপাথরের অলংকরণ সমন্বিত মন্দিরের অন্যতম সিউড়ি সোনাতোড় পাড়ার চালা রীতি র রঘুনাথ জীর মন্দির। অসামান্য এর অলংকরণ। শোনা যায় এক ঘণশ্যাম দাস বাবাজী ভিক্ষালব্ধ অর্থে এই মন্দির নির্মান করিয়েছিলেন।
বিগ্রহ হীন। চুরি হয়ে গেছে।
* দুবরাজপুর এর মন্দির। নায়ক পাড়ার মন্দিরে চমৎকার জ্যামিতিক ডিজাইন এর কাজ আছে।
এছাড়া ওঝা পাড়ার মন্দিরদুটি র কাজ চমৎকার।
* হেতমপুর এর চন্দ্রনাথ মন্দির। একটি ব্যতিক্রমী মন্দির। এখানের টেরাকোটা কাজের মাধ্যমে বিদেশি জীবন চিত্রের ছবি আছে।
*বিশালাকৃতি। নবরত্ন মন্দির। ৮০ ফুট উচ্চ। ২৫ ফুট বর্গের বিশাল মন্দির। সামনের অংশের টেরাকোটার অলংকরণ, মূলতঃ রামায়ণ কাহিনী র
রাম রাবণ এর যুদ্ধ।বানর সেনাদের ভূমিকা চমৎকার ফুটেছে। এছাড়াও আছে সামাজিক চিত্রন। বর্ধমানের রাজা কীর্তিচাঁদ জননী ব্রজকিশোরী দেবী এই মন্দির নির্মান করিয়েছিলেন
জেলা গেজেটিয়ার অনুযায়ী -
* ঘূড়িষা রঘুনাথ জীর মন্দির। ১৬৩৩ সাঃ অব্দে। নির্মিত। জেলার প্রাচীণতম।! অসাধারণ সুক্ষ্ম এর টেরাকোটা অলংকরণ।স্বর্ণালংকারের সৌন্দর্য এর দেওয়াল জুড়ে। পণ্ডিত রঘুত্তম আচার্য এর নির্মাতা। অতি প্রাচীণ শিলালেখ আছে।
* ঘুড়িষা বেণেপাড়ার ক্ষেত্রনাথ দত্ত কর্তৃক নির্মিত
লক্ষ্মী নারায়ণ মন্দির। হাই রিলিফের অতি চমৎকার কাজ এখানে রয়েছে। চৈতন্য লীলা, ত্রিপুরাসুন্দরীর অসাধারণ প্যানেল। মধ্য অষ্টাদশ শতকের নির্মান।
* ইলামবাজারের তিনটি বিখ্যাত মন্দির।
অষ্টকোনাকৃতি গৌরাঙ্গ মন্দির। হাটতলায়। আসামান্য এর জ্যামিতিক ডিজাইন। নকল দরজা।
এবং ফুলপাতার নক্সা।
* ব্রাহ্মণ পাড়ার বিষ্ণু দালান। উচ্চ বেদীর উপরে বৃহদাকৃতির পঞ্চরত্ন মন্দির। অসাধারণ এর টেরাকোটা র কাজ। রাসমণ্ডল, দুর্গাপ্যানেল, চৈতন্য লীলা এর কাজ। হাই রিলিফের কাজ ভাস্কর্যটি দিকে গেছে। ক্ষুদিরাম বন্দ্যোপাধ্যায় এর নির্মাতা। নির্মানকাল মধ্য অষ্টাদশ শতক।
* রামেশ্বর শিবমন্দির। রামধন চট্টোপাধ্যায় কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত শিবমন্দির। ছোট্ট ফলকে আসামান্য বিভঙ্গে রাধাকৃষ্ণ।হাইরিলিফে জগদ্ধাত্রী এবং দুর্গামূর্তি এর অন্যতম প্রধান কাজ।
* সুরুলের মন্দির। জমিদার সরকার বাড়ির ছোট তরফের শিবমন্দির এর টেরাকোটা অলংকরণ ছিল অসাধারণ। যথাযথ ভাবেই সংস্কার হয়েছে।
* সুপুরের জোড়া মন্দির। অষ্টকোনাকৃতি মন্দির এবং দেউল রীতি র মন্দির এবং তার টেরাকোটার কাজ চমৎকার।
* বীরভূমের অন্যতম জোড়বাংলো মন্দির রীতি র মন্দির রয়েছে ইটাণ্ডা য়। এই মন্দির এবং সাধুখান পাড়ার শিবমন্দিরের টেরাকোটা কাজ দৃষ্টি নন্দন।
**
ঘুড়িষা রঘুনাথ জী র মন্দির। জেলার প্রাচীণতম মন্দির বলে কথিত। এটির স্থাপনাকাল ১৫৫৫ শকাব্দ। ১৬৩৩ খ্রীস্টাব্দে। অসামান্য এর টেরাকোটা অলংকরণ।
কিন্তু রামপুরহাট থানা অন্তর্গত মাসড়া গ্রামের শিবমন্দির টি ১৫৩৩ শকাব্দে অর্থাৎ ১৬৩১ খ্রীস্টাব্দে নির্মিত।
মাসড়া তখন মুলুটির রাজাদের অধীনস্থ।
মন্দির টি ' রাজলোহাপাল ' সিতবদাস তাঁর মা সিদ্ধেশ্বরী র নামে প্রতিষ্ঠা করেন।
এই মন্দিরের অলংকরণ ছিল ফুলপাথরের।
সংস্কারের নামে সিন্থেটিক রঙের প্রলেপে ঢেকে গেছে প্রাচীণ কারুকার্যের সৌন্দর্য।
এই মন্দিরের প্রাচীণ প্রতিষ্ঠা লিপি টি এইরূপ -
শ্রী শ্রী রামাই ১৫৫৩ সেবক রাজলোহাপাল। ৪২৩ ××× সিতবদাস কর্মকারের মাতা শ্রী মতী সিদ্ধর শ্রী ঈশ্বর শিব স্থাপনাকারি ××× ×××
মুলুটি নিকট বর্তী এই মাসড়া গ্রাম ছিল লোহা কেনাবেচা র এক কেন্দ্র। প্রাচীণ পদ্ধতিতে লোহা গলানো হত। কর্মকার রা প্রভূত ধনী হয়ে উঠেছিলেন।
পরবর্তী তে এই সকল এলাকা ' লোহামহল ' নামে ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর ইজারার মধ্যে আসে।
গ্রামে ঝামার স্তুপে এখনও অনেক লোহামল বা slag পাওয়া যায়।
মাসড়া গ্রামের এই ছোট্ট শিবমন্দির টি প্রতিষ্ঠাকালীন হিসাব অনুযায়ী বীরভূম জেলার প্রাচীন তম মন্দির।
------------ ------------ ------------ ------------ ------------
অনেক বন্ধুর সেদিনের আমার কথিকা,আকাশবাণী শান্তিনিকেতনে শোনা হয়নি।
অনেকে শুনেছেন।
সঞ্চালক ছিলেন কমলেশ্বর চট্টোপাধ্যায়
No comments:
Post a Comment