।। দুই দিদির গল্প।।
কথা ও কাহিনী। ৷ ৷ প্রণব ভট্টাচার্য
ভাবুন তো একবার। কোথায় রংপুর আর কোথায় রাণীগঞ্জ।
এখন কার বাংলাদেশের রংপুর। আর পশ্চিম বর্ধমানের কয়লাক্ষেত্র রাণীগঞ্জ। রংপুর থেকে রাণীগঞ্জ । এক কিশোরী বৌ হয়ে এলেন এখানকার এক গ্রামে। গ্রামের নাম সাতগ্রাম।
চারপাশে তার ছয়টি গ্রাম। মাঝে সে সাতগ্রাম। সেই সাতগ্রামের চ্যাটার্জি পরিবার। নামী দামী পরিবার। কয়লাকুঠি র কেউ ম্যানেজার তো কেউ খাজাঞ্চি। কেউ বড়বাবু। কোম্পানির বিশ্বস্ত সব লোক। তাঁদের হাতে পরিচালনার অনেক খানি। তখন কয়লা ব্যবসা খুব জনপ্রিয় হয়ে গেছে।
এখান থেকে নদী পথে সে কয়লা যায় পাবনা রংপুর।
জমিদার বাবু র কয়লা ব্যবসা। তার ম্যানেজার আমাদের এই রংপুর এর দিদির বাবা। দাদারা তাঁর সব জমিদারী ফেরেস্তায়
কাজ করে। একজন তো তখনকার আসানসোলে বাসা বেঁধেছেন। সাতগ্রামের বাবুদের সাথে ব্যবসার সূত্রেই আলাপ
যোগাযোগ। কেননা তাঁদের হাতে কয়লা পাবার কাগজ।
বুদ্ধি খেলে যায় রংপুরের দিদির দাদার। এই চ্যাটার্জি বাড়িতে যদি বোনের বিয়ে দেওয়া যায়। কেমন হয়। এঁরা কি রাজি হবেন! দেখাই যাক। প্রস্তাব টা পাড়া ই যাক না কেন।
সেই প্রস্তাব নিয়ে একদিন বাড়ির কর্তার নিকট একদিন এলেন তিনি। প্রস্তাব শুনে কর্তা মশাই কিছুক্ষণ চুপ করে থাকবার পর মেয়ে দেখতে রাজি হয়ে গেলেন।
সে মেয়ে কে আত্মীয় স্বজন সমেত আনানো হল আসান সোলের বাসায়। সেখানেই মেয়ে দেখার ব্যবস্থা হল।
মেয়ে তো দেখতে চমৎকার সুন্দরী। নানা গুণসম্পন্না।
খুব ভালো রান্না জানে। হাতের কাজ জানে নানা রকমের।
কিছুটা লেখাপড়া ও জানে।
এই পরিবার সম্বন্ধে রংপুরের জমিদার বাবুর সপ্রশংস চিঠি।
তখন ছেলেদের আর মেয়ে দেখার চল ছিলনা। তবু এখানে
ছেলে মেয়ে দেখে এলো বন্ধুবান্ধব দের নিয়ে। অপছন্দের কিছু নাই।
তারপর একদিন শুভক্ষণে চার হাত এক হল। অগ্নি সাক্ষী করে। মহা ধূমধাম। সাতগ্রামের চ্যাটার্জি বাড়িতে মহা আয়োজন। গোরু গাড়িতে রাণীগঞ্জের বাজার থেকে মাল আসছে তো আসছে। আত্মীয় স্বজন ; কনে যাত্রী সব গোরু গাড়িতে। যেন গোরুগাড়ি র মেলা বসে গেল " রাজপুত বাড়ির ডাঙ্গায় "।
একা এই বোন নয়। এর পরপর তাঁর কয়েকজন জন বোন এসেছেন এই চ্যাটার্জি বাড়িতে। কয়েক বছরের ব্যবধানে।
আমি ভাবি এখনও পাত্র পাত্রী বিজ্ঞাপনে থাকে রাঢ়ী য় পাত্র
রাঢ়ী য় কন্যা চাই। বারেন্দ্রী হলে চলবে না।
আর আজ থেকে কত বছর আগে। একশো বছরে র ও আগে। তখন দুই পরিবারের মধ্যে এই প্রশ্ন তো ওঠেনি।
কে মেলালো। কিসে মিলল। এ যেন বিবাহ রাজনীতি। রাষ্ট্র নৈতিক বা কূটনৈতিক। এখানে মেলালো ব্যবসায়িক বুদ্ধি।
পরবর্তীতে দু ই পরিবারের ভীষণ ভাবে আর্থিক সমৃদ্ধি গড়ে ওঠার ইতিহাস।
।।দুই দিদির গল্প।। কথা ও কাহিনী। দ্বিতীয় গল্প
কোথায় বরানগর আর কোথায় বনকাটি।
বন কেটে বসত শুরু কবে থেকে তা বলা সম্ভব নয়।
প্রাচীন ' গোপভূম ' এর সেনপাহাড়ী পরগনার জঙ্গল মহলের
একটি গ্রাম।। একেবারে ' গড় জঙ্গলের ' গায়ে গা লাগিয়ে এই গ্রাম। ' ইছাইঘোষ এর দেউলে ' চূড়া দেখা যায় গ্রামের পশ্চিম প্রান্তের উঁচু মোরাম চাতাল থেকে।
গড় জঙ্গল। নামের ভিতরে ই " গড়' ভরা। সে ছিল একদিন।
জঙ্গলের ভিতরে ছিল গড়। পাল রাজাদের অধীনে সে গড়ের
অধিপতি ছিলেন। কর্ণসেন। সেই সেন কে অতর্কিত আক্রমণ করে গড় দখল করে নেন ইছাই ঘোষ। এ গড়ের অনেক নাম
ঢেকুর গড় ; ত্রিষষ্ঠীগড়। দেবী শ্যামারূপা ইছাই এর আরাধ্যা দেবী। তাঁর বরে ইছাই অপ্রতিরোধ্য। ধধর্মমঙ্গল এর কাহিনী তে তাকে আমরা পাব। লাউসেন ইছাই যুদ্ধকথা। দ্বিতীয় বারের যুদ্ধে ইছাই পরাজিত এবং নিহত হন। তিনি তখন বৃদ্ধ।
আবার এই জঙ্গলের মধ্যে ইংরেজ দের আক্রমণ থেকে বাঁচতে কেল্লা বানিয়েছিলেন বর্ধমানের রাজা চিত্র সেন।
সে অনেক কথা। পাশেই বয়ে চলেছে অজাবতী ; অজি ; মানে অজয়। অজয়ের ওপারে বীরভূম। লোককথা এখানেই না কি কবি জয়দেব এর সাথে রাজা লক্ষ্মণ সেনের সাক্ষাৎকার ঘটেছিল। ' দেহী পদ পল্লব মুদারম ' এর কবি তাঁর কাব্য' গীতগোবিন্দম' রচনা করেছিলেন রাজা লক্ষ্মণ সেনের অনুরোধে।
বাংলার সেন রাজাদের পূর্বপুরুষ রা কর্ণাট দেশ থেকে এদেশে এসে এখানেই না কি প্রথম তাঁদের বাসস্থান স্থির করেছিলেন।
এমন মত পণ্ডিত প্রবর সুকুমার সেন সহ আরও অনেকের।
তাই পরগণা র নাম সেনপাহাড়ী। আজও চালু মোগল আমলের পরগণা সেনপাহাড়ী।
এই জঙ্গল মহল এলাকার অযোধ্যা - বনকাটি এলাকা।
চারপাশে নানা ছোট বড় গ্রাম। আর সব গ্রামেই রয়েছে বাগদি ; বাউরী ; ডোম ; মুচি ; খয়রা ; খাঁড়াত আর হাঁড়ি দের
পাড়া। তারাই পাহারা দিচ্ছে গোটা জঙ্গল মহল।
সেই ইছাই ঘোষের আমল থেকে। সবাই ছিল তাঁর সৈন্য বাহিনী তে। সেনপাহাড়ীর ডোম ; হাঁড়ি বা মুচি রা দুর্ধর্ষ। রক্তে তাদের আজও সেদিনের যুদ্ধের উন্মাদনা।
আমাদের এই বনকাটির বাবুরা মানে রায় বাবু ; মুখোপাধ্যায় ; চট্টোপাধ্যায় বাবুরা সব মিলে মিশে পাশাপাশি থেকে একসাথে ব্যবসা করেন। যেন বারো ঘর এক উঠোন। নিশ্চয়ই ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল। তবে নানা পরিবার নানা রকমের ব্যবসা করেন।
প্রাচীণ সব বৃক্ষে ঘেরা। তপোবনের মতো। জমজমাট ব্যবসা তাদের।
ওপারে ইংরেজ সাহেব দের কুঠিবাড়ি। ইলামবাজার তখন
গঞ্জ। লাক্ষা বা গালা ; নীল ; সুতী বস্ত্রের নীলামের বাজার।
বাণিজ্য কেন্দ্র। ডেভিড আরস্কিন সাহেবের বিরাট কুঠিবাড়ি। ফরাসি দের কুঠিবাড়ি। তাঁদের সাথে এদেশীয়
সম্পন্ন মানুষেরা ভালো ব্যবসা করছেন। প্রচণ্ড ধনী হয়ে উঠছেন তাঁরা।
আমাদের বনকাটি র বাবুরা ইংরেজ দের কুঠিবাড়ি র সাথে ব্যবসা আবার স্বাধীন ভাবে ব্যবসা করেন।
লাক্ষা বা গালা ; নানা বনজ দ্রব্য ; আর কাঠ কয়লা ; এবং কয়লা র ব্যবসা। অজয়ের জলপথেই তখন ব্যবসা চলে।
ব্যবসায় মুখোপাধ্যায় বাবুরা সবাই কে ছাপিয়ে যাচ্ছেন। কলকাতায় ব্যবসা করেন। মাল আমদানি রপ্তানির। আবার পাইকারি ব্যবসার।
অন্যেরাও কম কিছু না। বানাচ্ছেন নিজেদের সুরক্ষার জন্য
উপযুক্ত প্রাসাদ। ভূগর্ভস্থ কক্ষতো আছেই। রায় পরিবার বানাচ্ছেন শিবমন্দির। ১৭০৪ শকাব্দে প্রথম। বিষ্ণু দালান ; দুর্গা দালান।
একই প্রাঙ্গনে পনেরো টি মন্দির। ১৭৫৪ ; ১৭৫৬-৫৭ শকাব্দে নির্মিত।
মুখোপাধ্যায় বাবুরা শোনা যায় একদিনের ব্যবসার আয়ে
বানিয়েছিলেন বিখ্যাত পিতলের রথ। ১২৪২ বঙ্গাব্দে। যার গায়ের অলংকরণ
নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস হবেনা। তার আগে বানিয়েছেন
অপুর্ব টেরাকোটা অলংকরণ যুক্ত বিখ্যাত পঞ্চরত্ন শিবমন্দির। ১৭৫৪ শকাব্দে। চট্টোপাধ্যায় পরিবারের বিরাট দালান। শিবমন্দির। রায় কালীবাড়ি খুবই বিখ্যাত। দ্বিতল বিষ্ণুমন্দির। দুর্গাদালান। ১৭৫৬-৫৭ তে পাশাপাশি তিনটি দেউল শিবমন্দির। কোন এক শুভ দিনে
বরানগর থেকে এক কিশোরী বৌ হয়ে এলেন এই বনকাটি তে। যেখানে সন্ধ্যা নামলে চারদিক আলো করার জন্য মশাল জ্বালায় পাহারাদার রা। পাশেই পাষাণ চণ্ডী তলার আমবাগান।
তার পাশেই গড় জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসা " রক্তনালা "গড়ঘাটা " হয়ে বয়ে মিশে যাচ্ছে অজয়ে। এই নালা দিয়ে ছোট নৌকোয় মাল চলাচল করে। রাতে শিয়াল আর গো বাঘা দের ডাক। এদিকে ওদিকে চন্দ্রবোরাদের আনাগোনা। রাতে অজানা শিস ঘণ বাঁশ বাগানে। প্রাচীন সব তালের ডগায় শকুন ছানার ডাক। তেমনি লম্বা খেজুর গাছ গুলো। আর বিশাল চাকলতা বা খেলকদম। কত টিয়া, চন্দনা যে থাকে সেখানে।
তালগাছের মাথায় থাকে শকুনেরা। তাদের ছানারা কাঁদে
ঠিক মানুষের বাচ্চার মতোই। এই সেই বনকাটি।
কোথায় বরানগর আর কোথায় এই বনকাটি।
বাবুরা তো স্বাধীন ভাবে কলকাতা র বানিজ্যিক হৌস গুলির
সাথে ব্যবসা করেন। নিশ্চিত ভাবেই সেই সুত্রেই মেয়ের বাবার আলাপ এখানকার বাবুদের সাথে। ব্যবসার জন্য জাহাজ ঘাটা থেকে শুরু করে অনেকে দালালী করে ও অনেক পয়সা করেছেন। কলকাতা র বাজারের হালচাল জানার জন্য ;
বিদেশী জাহাজে ভালো খদ্দের ধরতে পারলেই হল।
তার জন্য তাঁদের কে নিয়োগ করতেই হত।
এই ব্যবসার সুত্রেই আলাপ মেয়ের বাবার সাথে চট্টোপাধ্যায় পরিবারের কর্তার। এই ঘরে মেয়ে যাবে। সে আর বলতে।
যোগাযোগ। দেখাশোনা। অনুমান করে নিতেই পারি।
তারপর একদিন বিয়ে।
কেউ তাঁর নাম জানে না। বরানগর এর দিদি। দিদি মানে দিদিমার ও দিদিমা। সে কি আর আজকের কথা।
কি তাঁর স্মৃতি। শোনা যায় তাঁর স্বামীর অকাল মৃত্যু র পর
তিনি বানিয়েছিলেন মুখোমুখি দুটি শিবমন্দির। টেরাকোটা য় মোড়া ছিল সে মন্দির দ্বয়। তাকে সম্পূর্ণ বিনষ্ট করা হয়েছে।
কিন্তু নিশীথ রাত্রে মুখোমুখি যেন কথা বলে দুই মন্দির।
এ তাকিয়ে আছে ওর পানে।
হু হু বাতাস বয়। সেই বাতাসে মিশে থাকে সেদিনের স্মৃতি।
----------- ----------- ----------- ----------- ----------- ২ পাতা শেষ।
সমাপ্ত।
লেখক। প্রণব ভট্টাচার্য। সেনপাহাড়ী পরগনার আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চাকারী। অনেকে বলেন " সেনপাহাড়ী র কথাকার "
** চট্টোপাধ্যায় পরিবারের ভগ্ন দালান বাড়ি।
No comments:
Post a Comment