Saturday, 1 March 2025

যাত্রাপালাগান ঃ একটি শতবর্ষ প্রাচীণ আসরের কথা

।। যাত্রাপালা গান  ঃ একটি শতবর্ষ প্রাচীণ আসরের কথা।।  প্রণব ভট্টাচার্য 
স্বাভাবিক ভাবেই লেখাটি দীর্ঘ। এলাকার ঐতিহ্য। এখানকার কথা লেখা বা বলা উচিৎ ছিল। 
ভালো লাগলে পড়বেন। 

।  ১ নং পাতা 
" আমাদের জাতীয় নাট্য বলতে যদি কিছু থাকে তা হচ্ছে যাত্রা " বলেছিলেন নাট্যাচার্য শিশির ভাদূড়ী।
আর রামকৃষ্ণ দেব বলেছিলেন যাত্রা থিয়েটারে লোকশিক্ষা হয়। যাত্রা দলের গদিতে হোক বা আসরের সাজঘরে তাঁর ছবি টাঙানো থাকেই। তাঁকে প্রণাম জানিয়েই যাত্রা শুরু হয়।
যাত্রা মানে উদ্দেশ্য নিয়েই কোথাও গমন। সে তীর্থ যাত্রা ই হোক আর আনন্দ ভ্রমণ ই হোক। যাত্রা শুভ হোক। আমাদের এই কামনা থাকে।
যদি আমরা ধরে নিই যে যাত্রাপালার প্রথম অঙ্ক থেকে পঞ্চম অঙ্ক পর্যন্ত ঘটনাপ্রবাহের যে বিন্যাস, তার চলন, পরিণতি র দিকে তার যে গতি প্রবাহ তাই যাত্রা। শুরু থেকে শেষ। এই যাত্রাপথের শিল্পীত রূপ ই আমাদের যাত্রা পালা গান।
আমাদের জীবন যেমন। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত যে বিস্তৃতি তাই জীবন কাল। হাসি, কান্না, দুঃখ, বেদনা, আনন্দ,লোভ লালসা মেশানো । সব রসের সমাহার। যাত্রা পালা গানেও এই সকল রসের সমাহার। সকল রসের ধারার এক মিলিত গতি প্রবাহ।
একদিন গ্রামবাংলার অন্যতম প্রধান বিনোদনের মাধ্যম ই ছিল যাত্রা। কোথাও বিনা পয়সায় কলকাতার যাত্রা দলের যাত্রা হচ্ছে শুনলে লোক ভেঙে পড়ত সেই আসরে।
মানুষের সেই উন্মাদনা আমরা লক্ষ্য করেছি অতি বিখ্যাত এক যাত্রা পালা " নটী বিনোদিনী " তে। আমি একটি উদাহরণ দিলাম মাত্র। টিকিট কেটে যাত্রা। চারদিকের সব বেড়া খুলে দিতে বাধ্য  হতে হয়েছে আয়োজক দের। রাতের পর রাত সেই পালাগান চলেছে। তেমনই আর এক একটু পুরনো পালা
" সোনাই দিঘী "। কি অসামান্য অভিনয়। ভাবনা কাজী কে দেখার জন্য মানুষের কি উন্মাদনা।
এমন কত শত পালা। নাম লিখে বা বলে শেষ করা যাবেনা।
একে হাল্কা চোখে দেখার কোন কারণ নাই। " যাত্রা দ্যাখে ফাৎরা লোকে " বললে বুঝতে হবে কোথাও মূল্যায়নে ফাঁক থেকে যাচ্ছে।
আজ যাত্রা শিল্প অনেকটা ই মুখ থুবড়ে পড়ার মতো অবস্থায়।
কলকাতার কোন যাত্রা নয় নাটকের দল বুক ফুলিয়ে বলতে পারবে ভালো আছি। না। কেউ ভালো নেই। যাত্রাও না। নাটকও না। গানের জলসাও না। সিনেমা তো নাই। সব হল বন্ধ। মাল্টীপ্লেক্স এ আর কজন যায়।
আসলে সমগ্র বিনোদন এর জগৎ টি ই সম্পূর্ণ বদলে গেছে।
টেলি সিরিয়াল ই আজ মহিলা দের আনন্দ সন্ধ্যা।
আর মোবাইলে মত্ত কিশোর যুবক দের দল।
------------ ------------ ------------ ------------ ------------ ১ নং পাতা শেষ।  

।। যাত্রা কথা।।  ২ নং পাতা আরম্ভ।
অথচ কত দীর্ঘ পথ পার হয়ে এসেছে যাত্রা পালা গান।
সেই চৈতন্য পরবর্তী  নীলকন্ঠ মুখোপাধ্যায় মশাই এর কৃষ্ণ যাত্রা, থেকে  গোবিন্দ অধিকারী, মতিলাল রায় কত মানুষের
আজীবন এর সাধনার ফলশ্রুতিতে বিবর্তনের মধ্য দিয়ে আধুনিক যাত্রা পালা। পৌরাণিক, ঐতিহাসিক এবং সামাজিক
কত পালা। অসাধারণ অভিনেতা এবং অভিনেত্রী গণ। নারী চরিত্রে দক্ষতার সঙ্গে অভিনয় করেছেন চপল রাণী র মতো কত পুরুষ রাণী।
এরিস্টটল বলেছিলেন " প্রকৃত ইতিহাস লেখার চেয়ে শিল্প সম্মত ভাবে ইতিহাস কে উপস্থাপিত করা ই অধিকতর বিজ্ঞান সম্মত এবং বাস্তব। " প্রাচীন  গ্রীসের নাট্যচর্চা কে আমরা স্মরণ করতে ই পারি এই প্রসঙ্গে। সে ও এক দীর্ঘ ইতিহাস।
১৯৩৬-৩৭ সাল নাগাদ পূর্ব বঙ্গের বরিশাল থেকে শশী নট্ট,সূর্য দত্ত দের " মাচরং বৈকুন্ঠ যাত্রা সমাজ " যেদিন কলকাতার হরচন্দ্র মল্লিক স্ট্রিট এ তাঁদের গদিঘর পাতলেন সেদিন থেকেই প্রকৃত প্রস্তাবে কলকাতা বা কলকাতার চিৎপুর ধীরে ধীরে  হয়ে উঠল  যাত্রাপাড়া।
২০০৫ সালে চিৎপুরে প্রায় ৫৫ টি যাত্রা দল। সিজিনে  চার হাজার রাতের বায়না। ২০০১ এ ছোট বড় মিলিয়ে তিন শো র
মতো কোম্পানি। ২০০০০ মানুষের সংযুক্তি। লক্ষ কোটি টাকার ব্যবসা। এক একটি দলে সব বিভাগ মিলিয়ে প্রায় ৬০-৭০ জন মানুষ। কত বড় একটা শিল্প। এর সাথে জড়িয়ে আছে আরও হাজার হাজার মানুষ। আলো, ড্রেস,  মেক আপের দ্রব্যাদি র ব্যবসার সাথে কত মানুষ যুক্ত ছিলেন।
সবচেয়ে বেশী বায়না যেমন হত অবিভক্ত মেদিনীপুরে তেমনি মেদিনীপুর এর নন্দকুমার এবং বেলদা কে বলা হত মেদিনীপুর এর চিৎপুর। মেদিনীপুর কলকাতাকে কত শিল্পী সরবরাহ করেছে। স্টার আর্টিস্ট দের বাদ দিয়েও চরিত্র অভিনেতার ভূমিকা  একটি পূর্ণাঙ্গ প্রযোজনা য় কম মূল্যবান নয়।
বীরভূমে সম্ভবত যাত্রা পালার সূচনা ১১০০ বঙ্গাব্দে।
শিশুরাম অধিকারী বা ঐ শিষ্য পরমানন্দ অধিকারী বীরভূমের রামবাটী র বাসিন্দা ছিলেন। ধবনী গ্রামের নীলকন্ঠ মুখোপাধ্যায় মশাই তাঁর কৃষ্ণযাত্রাকে অসম্ভব জনপ্রিয় করেছিলেন। তিনি ১৩১৮ পর্যন্ত জীবিত ছিলেন।
হেতমপুরের রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠে রঞ্জন অপেরা। তাকে কলকাতায় নিয়ে গেলেন ফণীভূষণ বিদ্যাবিনোদ বা বড় ফণী।
অত্যন্ত সুনামী প্রযোজক, দল পরিচালক শম্ভুনাথ ঘোষ
তাকে নব রঞ্জন অপেরায় পরিণত করলেন।
বীরভূমের শুধু নয় সমগ্র রাঢ় এলাকার পশ্চিমাংশের যাত্রা প্রীতি সুবিদিত। পরবর্তী সময়ে বায়নার জন্য যখন এজেন্ট প্রথা চালু হল প্রথম  রাণীগঞ্জের রাণীসায়ের মোড়ে গড়ে উঠল
অনিল ভাণ্ডারী মশাই এর বুকিং অফিস। তাঁকে বলা হত
" কোলিয়ারী লর্ড " বা যাত্রা লর্ড। তাঁর মাধ্যমে ই বুকিং হত।
সব দলের ই ব্যবসার তিনি ছিলেন কাণ্ডারী।
" নট্ট কোম্পানি " - নট্ট কোম্পানি ই। ছিলেন যে সূর্য দত্তের মতো মানুষ। তারপর ই নাম করতে হয় সত্যম্বর চট্টোপাধ্যায় এর " সত্যম্বর অপেরা র "। এই অপেরার সোনাই দিঘী তো ইতিহাস। ইতিহাস রচনাকারী অনেক প্রযোজনার জন্ম দিয়েছে এই অপেরা।
কত অপেরা, কত কোম্পানী। নাম লিখতে হলে উল্লেখযোগ্য অনেক নাম বাদ পরে যাবে এই ভয়। তবু কিছু নামের কথা বলার আগে বলে নেওয়া ভালো যাত্রা তখন এতই জনপ্রিয় যে
বড় গ্রাম বা গঞ্জে গড়ে উঠেছে এমেচার যাত্রা দল। শুধু ইলামবাজার এর নাম উল্লেখ আছে। ইলামবাজার রিক্রিয়েশনাল যাত্রাপার্টি। শতবর্ষের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছেন তার প্রবীনতম সদস্য।
সেই এমেচার দলের অভিনয় আমরাও যা দেখেছি সে ফেলে দেবার মতো নয়। অমর বন্দ্যোপাধ্যায় এর মতো চেহারা এবং অভিনয় ছিল অনবদ্য। যে কোন পেশাদার অভিনেতা র সাথে তিনি পাল্লা দিতে পারতেন। তাঁর স্ত্রী ও ছিলেন নামী অভিনেত্রী।
অযোধ্যা বনকাটি এলাকায়   পেশাদার দের মতো দল অযোধ্যায় গড়ে উঠেছিল। ননীগোপাল চট্টোপাধ্যায় এর নির্দেশনা
সঙ্গীত পরিচালনা এবং অভিভাবকত্বে। বড় বড় ট্রাঙ্কে ছিল সাজপোশাক সহ মেক আপের দ্রব্যাদি। মহিলা চরিত্রে কিন্তু পুরুষ।  গোপালপুর, বামুনাড়া, আড়া ইত্যাদি গ্রাম মিলিয়ে
শক্তি মান অভিনেতা দের সম্মিলিত প্রয়াসে গড়ে উঠেছিল
পেশাদার প্রায় যাত্রাদল। অনেকে ছিলেন তার পৃষ্ঠ পোষক।
কলকাতার যে দলটির কথা না বললেই নয় তা হল " তরুন অপেরা "। প্রধান অভিনেতা শান্তিগোপাল। তাঁর হিটলার ২০০০ রজনী অভিনীত হয়েছিল। তিনিই একমাত্র অভিনেতা তাঁর লেনিন যাত্রাপালা নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নে গিয়েছিলেন। এবং সোভিয়েত ল্যাণ্ড নেহরু অ্যাওয়ার্ড লাভ করেছিলেন।
৭০ এর দশকে খবরের কাগজের যাত্রা সমালোচক খ্যাত ব্যক্তিত্ব প্রবোধবন্ধু অধিকারী হয়ে উঠেছিলেন যাত্রা পাড়ার
অভিভাবক পিতার মতো।
যাত্রায় উৎপল দত্তের আসা মাত্রই যাত্রা দেখল নূতন আঙ্গিক।
অভিনয়ের উৎকর্ষ। তাঁর পরিচালিত "  ফেরারী ফৌজ "
সন্ন্যাসীর তরবারি ইত্যাদি যাত্রা পালা যাত্রার ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবে।
অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় এর মতো শক্তিমান অভিনেতা যাত্রায় এসেছিলেন। কিন্তু সাফল্য পাননি। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিতে
" রাবণ " পালা জনতা গ্রহণ করেনি।
আবার সিনেমা থেকে কিছু অভিনেতা অভিনেত্রী এলেন
কিন্তু তাঁদের অভিনয় ধারা ভিন্ন হওয়ায় সেভাবে দর্শক নেননি।
অনেকে যেটা বলেন যাত্রার অভিনয় চড়া মোটা দাগের।
অতি অভিনয় ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু যাত্রায় কি স্বপনকুমারের
মাইকেল মধুসূদন হয়নি!  এমন আরও অনেক নাম করা যায়।
কিছু যাত্রা দলের নাম করতেই হয়। যেমন নিউ রয়্যাল বীনাপাণি অপেরা, নিউ গণেশ অপেরা, নব অম্বিকা অপেরা
নিউ প্রভাস অপেরা, আর্য্য অপেরা, নিউ আর্য্য অপেরা,
সত্যনারায়ণ অপেরা ; ভারতী অপেরা,  লোকনাট্য, নাট্যভারতী ; মুক্তঅঙ্গন, আনন্দলোক, শিল্পীতীর্থ, অগ্রগামী
ইত্যাদি অপেরা অনেক বিখ্যাত প্রযোজনার জন্ম দিয়েছেন।
অনেক নাম বাদ গেল। লেখক ক্ষমাপ্রার্থী।
বিভিন্ন সময়ে কিছু মানুষের উজ্জ্বল ভূমিকায় আলোকিত হয়ে ওঠে প্রাঙ্গণ। তেমনি কিছু মানুষ - মাখনলাল নট্ট,  শৈলেন মোহান্ত,
তিনকড়ি গুছাইত, দীনবন্ধু গুছাইত,, অমিয় বসু, দিলীপ চট্টোপাধ্যায়, কালিপদ দাস, নীলমণি দে, দুলাল চট্টোপাধ্যায়
হৃষিকেশ মিত্র, কিষান দাশগুপ্ত, নির্মল মুখোপাধ্যায়,
রমেন মল্লিক, বৈদ্য নাথ শীল ইত্যাদি মানুষেরা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছেন।
যাত্রার পালাকার ঃ প্রথমেই যে নাম সকলের মনে আসে তিনি আর কেউ নন যাত্রাপালাসম্রাট ব্রজেন দে । তার পরই
ভৈরব গঙ্গোপাধ্যায়, শম্ভু বাগ, সহ অনেক নাম।  যে নাম গুলিকে বাদ দিয়ে যাওয়া অপরাধ।
যাত্রার প্রধান অভিনেতা ঃ যাঁর নামেই দর্শক আসবেন তেমন অভিনেতা তো সহজে মেলেনা।
সেই বড় ফণী অর্থাৎ ফণীভূষণ বিদ্যাবিনোদ, ফণীভূষণ মতিলাল ( ছোট ফণী) । যাঁকে বলা হত যাত্রার যুবরাজ
নটসূর্য্য দিলীপ চট্টোপাধ্যায়, পঞ্চু সেন, ষষ্ঠীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, ফণী গাঙ্গুলি,  মাখন সমাদ্দার, অনাদি চক্রবর্তী
, স্বপনকুমার , শেখর গাঙ্গুলি,  তরুনকুমার, ভোলা পাল,
পান্না চক্রবর্তী, অভয় হালদার, অশোক কুমার, রাখাল সিংহ
শ্যামল ঘোষ, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, অসিত বসু, নির্মল মুখোপাধ্যায়।  সিনেমা থেকে এসেছিলেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়।
তাঁর " যমালয়ে জীবন্ত মানুষ " ভালো ব্যবসা করেছিল।
এসেছিলেন সন্তু মুখোপাধ্যায়।
অসাধারণ অভিনেতারা। আর আচার্য্য পূর্ণেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় এর নাম না করা তো অন্যায়।
এখনও প্রবীণ দের কানে ভাসছে গ্রীনরুম থেকে উদাত্ত গলায় গান ধরা বিনোদ ধাড়া বা তাঁর সুযোগ্য পুত্র গুরুদাস ধারার নাম। নট্ট কোম্পানি র খোকন বিশ্বাস প্রভৃতি র নাম খুবই উল্লেখযোগ্য। আরও অনেকে রয়েছেন যাঁদের গান ই ছিল সেই পালার সম্পদ।
অভিনেত্রী দের কথা এলেই প্রথমেই যে নাম মনে ভেসে উঠে আসে তিনি অদ্বিতীয়া জ্যোৎস্না দত্ত। অবিস্মরণীয়া বীণা দাশগুপ্ত,।  রুমা দাশগুপ্ত, বেলা সরকার,  সহ অন্যান্য অভিনেত্রী রা অসামান্য ভূমিকা রেখেছেন। সব নাম বলা একটি ছোট প্রবন্ধে সম্ভব নয়।
যাত্রার মিউজিক মাষ্টার,  মোশন মাষ্টার এর ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাদ্যযন্ত্রী দের নাম লিখতে বসলে সেটাই হয়ে যাবে
ইতিহাস।
রূপসজ্জাকার এবং তাঁর সহকারী গণ।
পেট্রোম্যাক্স, হ্যাজাক লাইটের যুগ। তাতেই আলোর কারিকুরি করেছেন শুধু রঙিন কাগজের সাহায্যে যাঁরা তাঁরাও একটা দলের অপরিহার্য অঙ্গ।
রান্নাঘর কে বাদ দিলে তো চলেই না। প্রধান অভিনেতা বা অভিনেত্রীর স্পেশাল রান্না চাই৷ কত জনের কত রকমের আবদার। সব রান্না ঘরকে মনে রাখতে হয়। এই রান্নাঘরে ই
ককপক্ষে পাঁচ সাত জন লোক। তাঁদের কথা আর কাদের মনে থাকে!
------------ ------------ ------------ ------------ ------------ ------------ ২ নং পাতা শেষ।

।। যাত্রা পালা গান  এবং এক শতবর্ষ প্রাচীণ যাত্রার আসর এর কথা।। ৩ নং পাতা আরম্ভ।
এমন একটা সময় ছিল " রূপাই চণ্ডী তলায় " যাত্রাকরতে যাওয়া ছিল প্রায় সব দলের কাছে তীর্থ যাত্রার মতো।
রথযাত্রার দিনে বায়নার সময় অনেকে লক্ষ্য রাখতেন ওখানে বায়না হল কি না। গদি থেকে অনেকে খবর নিতেন। লোক পাঠিয়ে।
শতবর্ষ প্রাচীণ এই যাত্রার আসর। ১২৭ বছরে পড়েছে এখানের যাত্রার আসর। সেই কৃষ্ণযাত্রা দিয়েই শুরু। তারপর পালাগান, যাত্রার আসর।
বিশাল বিশাল শিমূল,  অর্জুন গাছ, পলাশের জঙ্গল। পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে এক জলধারা। এখানে সেই জলধারা দহ র রূপ নিয়েছে। প্রাচীন কয়েক টি বন্যার স্মৃতি জড়িয়ে এই স্থান আজও টিঁকে আছে স্বমহিমায়। দেবী চণ্ডী। রূপাই চণ্ডী। দহের নাম " রূপাই দহ "। জলধারার নাম " বৃদ্ধ নদী "। দহের পাড়ে মোরাম চাতাল। আদিবাসী পাড়া। নাম " রাজাপোতার ডাঙ্গা "।
অজয় থেকে বের হয়ে একটি জলধারা এই স্রোতপথে বসুধার ভিতর দিয়ে চলে যেত পূর্বে অনেক টা। পাণ্ডুকের কাছে " পাণ্ডুরাজার ঢিবির পাশ দিয়ে আবার অজয়ে মিশত। সে স্রোতে নৌকা চলাচল করত। " রাজার পোত " থেকে পাণ্ডুরাজার ঢিবি "হয়ে অজয়ে গিয়ে নৌকা চলে যেত দূরে।
  ""রাজার পোত " থেকে রাজা পোঁতা। পাণ্ডুরাজার ঢিবির ও অপর নাম রাজা পোতার ডাঙ্গা।
তাহলে কে ছিলেন এই রাজা। আদিবাসী কোন মানুষ। না কি সদগোপ প্রাধান্যের এই এলাকায় কোন সদগোপ রাজা।
নাম কি ছিল তার রূপাই! প্রবীণেরা বলতেন এই দেবী সদগোপ দের বা এই পূজায় তাঁদের বিশেষ অংশ ছিল।   পরবর্তী সময়ে  ব্রাহ্মণ দের আনানো হয়েছিল। একসময় ডাঙ্গাল গ্রামে অনেক ব্রাহ্মণ পরিবার বাস করতেন। ডাঙ্গাল গ্রামের দু টি অংশ। 
একটি রামপুর, অপরটি ডাঙ্গাল। ডাঙ্গাল অংশে ব্রাহ্মণ বসতি ছিল। মারাত্মক কলেরা, ম্যালেরিয়া রোগে গ্রাম উজাড় হয়ে যায়। অনেকে গ্রাম ত্যাগ করেন। 
 এই দেবী চণ্ডী। রাঢ় এর মহাকাব্য মঙ্গল কাব্য গুলির অন্যতম চণ্ডীমঙ্গলের দেবী চণ্ডী যেমন বনদেবী। তিনি বনের সকল জীবের পালয়িত্রী। আদিবাসী দের " চাণ্ডী "। তিনিও
প্রকৃতি। সর্বত্র বিরাজমানা। বনভূমির কোন প্রাচীন বৃক্ষ তলে
তাঁর আবাস। তিনি বিলে আছেন, মাঠে আছেন ; জঙ্গলে লতাগুল্ম ঘেরা কোন থানে আছেন।
এই দেবী রূপাই চণ্ডী র দুর্গার ধ্যানেই তাঁর পূজা হয়। বিশেষ উল্লেখ যোগ্য চৈত্র সংক্রান্তি তে দেবীর বাৎসরিক পূজার আয়োজন হয়। শিবের গাজনের সাথে তাঁর গভীর সম্পর্ক।
এই পূজা উপলক্ষে ই বৈশাখের তিন চার তারিখ নাগাদ এখানে কবিগান ; কৃষ্ণযাত্রা ; এবং পরে কলকাতার যাত্রা দলের পালাগান চালু হয়েছে শতবর্ষ আগে। এখনও সেই ধারা অনুযায়ী যাত্রাপালা অনুষ্ঠিত হয়। প্রতি বৎসর।
আগে মানুষের ভিড়ে কোথাও তিল মাত্র জায়গা থাকতো না।
ঝোপ ঝাড় পরিষ্কার করে কিছু জায়গা বের করা হত।
দূর দূর গ্রাম থেকে গোরুগাড়ি করে মানুষ জন আসতেন।
মহিলারাও আসতেন। যথেষ্ট নজরদারি র ব্যবস্থা থাকত।
উৎসব কমিটির পক্ষ থেকে পার্শ্ববর্তী গ্রামসমূহের বিশিষ্ট মানুষ দের আমন্ত্রণ জানানো হত।
ডাঙ্গাল বসুধা গ্রামের ঘোষবাবুরা ( গোবিন্দ ঘোষ এবং তাঁদের  পরিবারের পূর্ব পুরুষ গন)  ও ডাঙ্গাল গ্রামের বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবার ( ভোলানাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁর পূর্ব পুরুষ গণ),  এঁরা ই মূলত এই পূজা এবং উৎসব, যাত্রা পালা গানের আসর বসানো ইত্যাদি র আয়োজন তথা তদারকি করতেন। বা এখনও বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবার সহ অন্যান্য রা করছেন। ডাঙ্গাল বসুধা  গ্রামবাসী গণ সহযোগিতা  করেন।    জীবিত দের মধ্যে বয়স্ক মানুষ বংশী মণ্ডল রয়েছেন। তাঁর যুবক বেলায়  তিনিই বায়না করতে চিৎপুর যেতেন। প্রবীণ দের মধ্যে আর রয়েছেন, সুকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, শিশির বন্দ্যোপাধ্যায়। এবং অন্যান্য 
গ্রামবাসী গণ। 
ঘোষ বাবুদের লিচু বাবু কাঁধে বন্দুক নিয়ে চারপাশে নজর রাখতেন। হাবল বাবু তদারকি করতেন। সাতকাহনিয়া গ্রাম থেকে হালদার বাবুরা 
যেতেন।  শারীরিক প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও নারান মাজি র  তৎপরতা ছিল নজর কাড়া।
আরও অনেক কথা থাকা স্বাভাবিক। শতবর্ষ প্রাচীণ। অনেক গুলি পুরুষ। মানেই এক এক সময়, বা কাল পর্ব। কোন অসম্পূর্ণতা থাকতেও পারে। আরও অনুসন্ধানের প্রয়োজন থেকেই যায়। 
 বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের শ্রী শিশির বন্দ্যোপাধ্যায় কিছু  আমার নজরে এনেছেন। তাঁকে ধন্যবাদ। 
 আমি সংযোজন বা সংশোধন করে নিলাম। 

------------ ------------ ------------ ------------ ------------ ৩ নং পাতা শেষ। 

 

।। যাত্রা পালা গান ঃ শতবর্ষ প্রাচীণ এক যাত্রার আসর।।
৪ নং পাতা। আরম্ভ।
প্রবীণ দের মুখে শুনেছি রূপাই চণ্ডী তলায় পালাগান পরিবেশন করেননি এমন যাত্রা দল প্রায় নেই। তবে এটাও ঠিক যাঁদের বা যে সব দলের রেট কম থাকত তাদের কেই প্রথম দেখা হত। তবে রূপাই চণ্ডী তলার নাম শুনে অনেক যাত্রাদল কম পয়সা নিয়েই গান করেছে এমন উদাহরণ অনেক আছে। কোন এক দলের একবার প্রায় বায়না হচ্ছিল ই
না। এখানে গান করার পর না কি তাঁদের ভালো বায়না হয়।
একটা সময় ছিল যখন " সত্যম্বর অপেরা " মানেই ভালো যাত্রা। আর তাদের  বাঁধা  ছিল এই জঙ্গলাকীর্ণ স্থলের আসর। মানুষের মুখে মুখে ফিরত বড় বড় শিল্পী দের নাম।

মুখে মুখে ছড়িয়ে যায় এই স্থলের মাহাত্ম্য।
এমন অনেক গল্প প্রবীণ দের মুখে শোনা যেত।
মূলত রূপাই চণ্ডী তলার চারপাশে যাঁদের কৃষি জমি রয়েছে
বা বসুধা মৌজায় তাঁদের কাছ থেকেই চাঁদা নিয়ে বিনা পয়সায় কলকাতার যাত্রা দলের যাত্রা পালা গান শোনা বা দেখার সুযোগ পেতেন সাধারণ মানুষ বছরের ঐ দুটি দিন।
সারা বছর মানুষ মুখিয়ে থাকতেন এই আসরের দিকে।
অজয়ের ওপারে ইলামবাজার থেকে যাত্রামোদী মানুষেরা দলে দলে আসতেন। পার্শ্ববর্তী এলাকা মৌখিরা কালিকাপুর থেকে বা আদুরিয়া অমরপুর থেকে কি মাজুরিয়া রঘুনাথপুর থেকে বা তেলিপাড়া, এমনকি রক্ষিতপুর মলানদিঘী এলাকা থেকেও মানুষ আসতেন এখানে। তখন যাত্রা দেখার একটা
প্রবল আগ্রহ মানুষের মধ্যে ছিল। যা আজ আর নাই।
সরকারের উদ্যোগে যাত্রা উৎসব চালু করা হয়েছিল।
যাত্রা জগতের বিশিষ্ট মানুষ দের আমন্ত্রণ জানিয়ে সেখানে আনা হত। মন্মথ রায় দের মতো  মানুষ কোন  যাত্রা দেখে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন,  আবার অদূর ভবিষ্যতে যাত্রাপালাগানের
ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আশাবাদী হতে পারেননি তেননি অনেকে।
  বাংলার বাইরে যে আসাম, ঝাড়খণ্ড, বিহারের প্রবাসী বাঙালী অধ্যুষিত এলাকা থেকে একসময় অনেক বায়না হত।
সেখানেও ভাঁটা পড়েছে। সব দিক দিয়েই যাত্রা শিল্প আজ
সংকটে। অথচ এই শিল্পের সাথে জীবন জড়িয়ে ছিল কত কত পরিবারের।
তবু টিঁকে থাকবে হয়তো। একেবারে নিঃশেষ হয়ে যাবেনা।
তবে পালারচনা থেকে শুরু করে, সেই মানের অভিনেতা অভিনেত্রী ; তেমন গান, গায়ক বা মিউজিক - একটা সমন্বিত শিল্প যেমন হয় তেমন মানে যাত্রা কে সাজাতে হবে।
যাত্রা কে ভালোবেসে এই শিল্পের আঙিনায় আর তেমন কেউ আসছেন না এমন আক্ষেপ গদিমালিক দের। আসছে  কিছু
  দ্রুত  উপার্জনের আশায়।
আর নিম্ন রুচির সস্তা পালাগান দিয়ে এই শিল্প বাঁচবে না।
সামগ্রিক পরিবেশের পরিবর্তন ঘটেছে। এবং একশ্রেণির
উচ্ছৃঙ্খল যুবক দের সব কিছু কে অবজ্ঞা, উপেক্ষা করার
মানসিকতা দেখা দিয়েছে। মানুষ ঘর থেকে বেরুতে চাইছেন না। মহিলাদের নিয়ে বের হওয়া তো দূরের কথা।
আর মধ্যবিত্ত স্তরের ভদ্র মানুষেরাই যদি আসরে না যান, সমঝদার মানুষ দের যদি উপস্থিতির অভাব ঘটে তাহলে শিল্পী দের ও মনে তার প্রভাব পড়ে। তাঁরা ও দেখে নেন শ্রোতা কেমন! গান ও তেমন। 
রূপাই চণ্ডী তলা জেগে ওঠে বৈশাখের ঐ কটা দিন। জেগে নিশ্চয়ই থাকবে। শুধু এই এলাকা নয় আমাদের কাঁকসাব্লকের
এত প্রাচীণ, ঐতিহ্য পূর্ণ যাত্রা পালা গানের আসর কিন্তু দ্বিতীয় টি নাই। এই ঐতিহ্য রক্ষা পাক।
------------ ------------ ------------ ------------ ------------ সমাপ্ত।
গ্রন্থ সহায়তা। যাত্রা শিল্পের ইতিহাস। গৌরাঙ্গ প্রসাদ ঘোষ 

 ক্ষেত্র সমীক্ষা এবং অন্যান্য লেখা

দেবীর পূজা, হোম যজ্ঞ হচ্ছে। করছেন ডাঙ্গাল গ্রামের সুনামী  পণ্ডিত শিশির বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অন্যান্য রা।

No comments:

Post a Comment