।। মানকর - খাণ্ডারী ।।
" জীবন আমার নাম, মানকরে মোর ধাম, জিলা - বর্ধমান। " --- রবীন্দ্রনাথ
' মানই যার কর - সেই গ্রাম মানকর '
' পরে তসর খায় ঘি, তার আবার অভাব কি '
' কদমার ভিতরে ভরা কনের বিয়ের লাল চেলি টি '
" কেমন কারিগর, থাকেন মানকর,
লাল চেলি ভরা থাকে কদমার ভিতর। "
' আছেন যেথা মানিকেশ্বর, নামটি তাহার মানকর '
প্রাচীন এক জনপদ মানকর। কত প্রাচীন?
জনশ্রুতি অজ্ঞাতবাসের সময় পঞ্চ পাণ্ডব না কি এখানে এসেছিলেন। অবস্থান করেছিলেন। পৌষমুনির ডাঙ্গা বা পাণ্ডব ক্ষেত্র তলার ঐতিহাসিক প্রাচীনত্ব নির্ণীত হয়নি।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সার্ভেয়ার জেনারেল রেনেল সাহেবের ম্যাপে মানকর ( Mankur) উল্লেখিত। প্রাচীন এক রাস্তা বর্ধমান থেকে বেরিয়ে মানকর হয়ে চলে যাচ্ছে উত্তর পশ্চিমে
আদুরিয়া গ্রামকে পাশে রেখে সেনপাহাড়ী পরগনার ভিতর দিয়ে অজয় পার হয়ে আরও উত্তরে রাজনগর পর্যন্ত।
কনৌজ ব্রাহ্মণ রাই মানকরের প্রকৃত জমিদার।
বর্ধমানের রাজা দের কাছ থেকে তাঁরা ব্রহ্মোত্তর হিসাবে মানকরের রাইপুর এলাকা টি পান। পরবর্তী সময়ে সেখানেই
নির্মান করেন জমিদার বাড়ি ' রঙ মহল '।
আদিতে এঁদের পদবি দুবে। মথুরায় বৈষ্ণব রাধাবল্লভ সম্প্রদায়ের কাছে দীক্ষা নিয়ে তারা গোস্বামী হন।
মূলত সংস্কৃত শিক্ষা প্রদান এবং গুরুগিরি করার উদ্দেশ্যে ই
তাঁদের বাঙ্গলায় আগমন। প্রথমে মেদিনীপুর এর চন্দ্রকোনা।
পরে এখানে আসেন।
এঁরা কিন্তু মানকর থেকে উত্তর পশ্চিমে সামান্য দূরত্বের
খাণ্ডারী গ্রাম টিকে বেছে নেন নিজেদের বসবাসের জন্য।
নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার জন্যই কি এই সিদ্ধান্ত।
যে ভূমি খণ্ডে তাঁরা বসবাস স্থাপন করলেন - তাই হল খাণ্ডারী। অনুমান মাত্র।
মূল মানকরে তারা প্রথমে বাসা বাঁধেন নি। পরে রাইপুর এর
জমিদারি পাবার পর মানকরে প্রাসাদ নির্মান করেন।
মানকর ছাড়াও ভরতপুর, খাণ্ডারী তেও ভূসম্পত্তি লাভ করেছিলেন।
গুরুদীক্ষা এবং গুরুদক্ষিণা ঃ বর্ধমানের রাজা জগৎরাম এবং রাণীমা ব্রজকিশোরী দেবী কে দীক্ষা দেন পণ্ডিত শ্যামসুন্দর গোস্বামী।
তাঁর পুত্র ভক্তলাল গোস্বামী দীক্ষা দেন রাজা কীর্তি চাঁদ এবং তাঁর পুত্র রাজা চিত্রসেন কে।
গুরুদক্ষিণা স্বরূপ ১৭২২ সালে রাইপুর এলাকার জমিদারী সত্ত্ব লাভ করেন ব্রহ্মোত্তর সম্পত্তি হিসাবে।
রাধাবল্লভ মন্দির এবং সিংহবাহিনী মন্দির নির্মান করেন
১৭২৯ সাল নাগাদ।
ভক্তলাল পরবর্তী বংশধর গন হলেন অজিতলাল, ব্রজলাল,
সেতাবলাল।
অজিতলালের দৌহিত্র হিতলাল মিশ্র। এঁকে মানকরের অন্যতম রূপকার হিসাবে গণ্য করা হয়। নানা জনহিতকর কাজ তিনি করেছিলেন। আজকের হাটতলা তাঁরই পরিকল্পনা য় গড়ে ওঠে। মানকর থেকে বুদবুদ পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার করেন।
সৌন্দর্যায়নের জন্য রাস্তার দুই পাশে তালগাছ লাগানোর ব্যবস্থা করেন। বারোটি বাঁধানো ঘাট সমেত এক বিশাল দিঘী যার নাম ' কৃষ্ণগঙ্গা ' খণন করান। সেই সময় ভীষণ খাদ্যাভাব এবং জলাভাব দেখা দিয়েছিল। কৃষ্ণগঙ্গা খণনের মাধ্যমে অনেক শ্রমজীবী মানুষ কাজ পেয়েছিলেন।
বিদ্যানুরাগী এই মানুষ টি পুঁথি সংরক্ষণের জন্য " ভাগবতালয় " নামে এক গ্রন্থাগার গড়ে তোলেন। কয়েকটি টোল স্থাপন করেন। তাঁর সময়ের বিশিষ্ট পণ্ডিত দের মধ্যে
গদাধর শিরোমণি, নারায়ণ চূড়ামণি, যাদবেন্দ্র সার্বভৌম,
প্রভৃতির নাম উল্লেখযোগ্য।
তিনি গীতা র টীকা রচনা করেছিলেন। যার প্রশংসা করেছিলেন সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র।
হিতলাল মিশ্র র ব্যবসায়িক বুদ্ধি ছিল প্রখর। তিনি নীলকুঠি র
ও মালিক ছিলেন।
অসাম্প্রদায়িক মনোভাবের হিতলাল এবং তাঁর পূর্বজ ভক্তলাল গোস্বামী মুসলমানদের জন্য মসজিদ এবং খ্রিস্টান দের জন্য চার্চ নির্মান করিয়েছিলেন।
হিতলালের পুত্রের অকালমৃত্যু তে দৌহিত্র রাজকৃষ্ণ দীক্ষিত,
জমিদার হন। তিনিই তৎকালীন সময়ের বাংলার জমিদার দের মধ্যে প্রথম, যিনি স্বদেশী আন্দোলনে (১৯০৫) অংশগ্রহন করে
কারারুদ্ধ হয়েছিলেন। তাঁর সময়ে রঙমহলে অনেক স্বদেশী
গোপনে আসতেন। আলোচনা হত। তাঁরা আর্থিক সাহায্য লাভ করতেন।
রাজকৃষ্ণ পুত্র রাধাকান্ত। তিনিও অকালপ্রয়াত। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী শক্তিবালা দেবী কাঞ্চন কুমার দীক্ষিত কে উত্তরাধিকারী হিসাবে গ্রহণ করেন। তিনিই ' রঙমহলের ' শেষ
জমিদার।
------------ ------------ ------------ ------------ ------------ ------------
খাণ্ডারী গ্রামে এখনও কয়েকঘর কনৌজ ব্রাহ্মণ বাস করেন।
' অগ্নিহোত্রী ' পদবী। এই গ্রামের পঞ্চরত্ন, টেরাকোটা অলংকরণ শোভিত রাধাগোবিন্দ মন্দির টি নির্মান করিয়েছিলেন
শান্তিময় তেওয়ারি র পূর্ব পুরুষ গন। আনুমানিক ১৮৫০ নাগাদ নির্মিত।
পাশের অষ্টকোনাকৃতি গৌরীশ্বর শিবমন্দির টি অগ্নিহোত্রী পরিবারের। সৌগত অগ্নিহোত্রী জানালেন।
মানকরে প্রায় ৪০-৪২ টি মন্দির। প্রায় সমসময়ে নির্মিত।
এই সব মন্দির কে নিয়ে আলাদা প্রবন্ধ পরবর্তী সময়ে প্রকাশিত হবে।
------------ ------------ ------------ ------------ ------------
অতি সংক্ষেপে মানকর বা মানকরের কনৌজ ব্রাহ্মণ দের
সম্পর্কে এই প্রবন্ধে বলা হল। মানকর এক প্রাচীণ জনপদ।
এবং যথেষ্টই বিস্তৃত। আকারে প্রকারে। অনেক সম্ভ্রান্ত পরিবার। অনেক ভগ্নাবশেষ। সংরক্ষণের অভাবে ভেঙে পড়েছে। যেমন ' রঙমহল ' ' কবিরাজবাড়ি ' বিশ্বাস বাড়ি, ইত্যাদি।
------------ ------------ ------------ ------------ ------------ ------------
© প্রণব ভট্টাচার্য।
No comments:
Post a Comment