চক্কোতি মশাই পইপই করে বলে দিয়েছেন, রাতে খাওয়া দাওয়া হয়ে গেলে ঘরে ঢুকে খিল। সারারাতের মধ্যে দরজা কিছুতেই খুলবি না।
তা হলে আমি আর সামলাতে পারবনা কিন্তু "
কাজ হয়েছে কিনা বুঝতে যখন চাইলি, সকালেই দেখবি। নিজে চোখে। আমি আর কিছু বলছিনা।
যা এবার। "
নদীর ওপারে মানে অজয়ের ওপারে নদীর ধারেই
ছোট্ট গ্রাম ক্ষুদ্রপুর। লোকমুখে ক্ষুদ্দুপুর।
সদগোপ রা আছে। মেটেরা আছে। আর এই চক্রবর্তী পরিবার। চারপাশের গাঁয়ের লোকেদের কাছে এই পরিবারের খুব নাম ডাক।
তন্ত্র, মন্ত্র, যাগ যজ্ঞে বংশানুক্রমিক ভাবে এই পরিবারের খ্যাতি।
নানা লোকে নিজেদের নানা সমস্যা নিয়ে এঁদের কাছে যায়। প্রায় সারাদিন কালী মন্দিরের দাওয়ায় বসে লোককে নিদান দেন। কখনও তার বাড়িতে গিয়ে তান্ত্রিক অনুষ্ঠান করতে হয়।
কালী থানটি মেটেদের। মেটেরাই পুজোর রাতে নিজেদের উদ্যোগে তাদের নিজেদের পুরোহিত বনকাটির চক্রবর্তী দের দিয়ে পুজো করায়।
আর পুজোর দিনে ক্ষুদ্রপুরের চক্রবর্তী মশাই দের বাড়িতে ব্যাপক মানুষের ভিড়। সে কোন দূর দূর এলাকা থেকে ফরেদি রা আসেন। যার সমস্যার সমাধান হয়েছে, এখন ভক্ত। কেউ মনস্কামনা পূরণের পর মানসিক শোধ করতে এসেছেন। আবার কেউ সমস্যা নিয়েও এসেছেন।
তাঁদের সবার জন্য ই থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হয়। সবই করেন চক্রবর্তী মশাই রা।
পুজোর পরদিন থেকেই আবার দায়িত্ব এঁদের।
একটি ছোট্ট পাকা মন্দির গড়িয়ে দিয়েছেন।
গ্রামের দক্ষিণে। একেবারে অজয়ের বানের জল আটকানোর জন্য মাটির বাঁধের ধারে। এখন সেই বাঁধের উপরেই পাকা রাস্তা। রাস্তা চলে গেছে পশ্চিমে জয়দেব কেন্দুলী পর্যন্ত। এখানে বসবাস মানে ভাবনা বারোমাস ই। পশ্চিমে কেমন বর্ষা হবে, অজয় কি রূপ নেবে তার ঠিক নেই। বর্ষাকালে সবাইকেই সতর্ক থাকতেই হয়। বলা তো যায়না। যদিও তেমন বর্ষা এখন আর হয়না। আর
নদীর এপারে যা শক্ত চরা পড়েছে তাতে অনেক টা নিশ্চিন্তি। গঙ্গাপুর, ভরতপুর,নারানপুর, উদয়পুর, নহনা মোড়, ক্ষুদ্দুপুর, সন্তোষপুর হয়ে জয়দেব কেন্দুলী পর্যন্ত এখন বাঁধের উপরে পাকা রাস্তা।
না হয় মাঝে মাঝে ভেঙেচূরে গেছে। স্বাভাবিক।
সে যাই হোক। আমাদের গল্প এপার ওপার জুড়েই। এপারের অযোধ্যা গ্রামের একেবারে বাইরে উত্তরে আঁকুড়ে পাড়া। আঁকুড়ে রা আলাদা মেজাজের মানুষ। বলশালী। বেশ লম্বা চেহারা।
নিজেরাও কালুবীর এর পুজো করে। আবার কালীপুজো য় করে। একজোট হয়ে থাকে।
সেই পরিবারে দীর্ঘ দিন থেকে নানা রকমের অশান্তি চলছে। নানা অঘটন ঘটছে। কোন কারণ নাই চালা ঘরে আগুন লেগে যাচ্ছে। গোরুর দুধ মরে যাচ্ছে। বাঁট দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে।
গাঁয়ের উত্তরে তাঁতিপুকুরের লম্বা লম্বা তালগাছগুলোর মাথায় শকুনেরা থাকে। পাশেই ভাগাড়। শকুনের ছানা গুলো এমন কাঁদে যেন মনে হয় মানুষের বাচ্চা কাঁদছে। মনে কু ডাকে।
আবার ঝাকড়া তেঁতুল গাছ গুলো তে বাদুড়ের
দল ঝাঁক বেঁধে থাকে। মাঝে মাঝে ক্যাওট রা জাল পাতে। বড়পাখি মানে বাদুড় জালে পড়ে। এরা তার মাংস খায়। এটা অবশ্য আঁকুড়ে পাড়ার
বুড়ো দাদুর পছন্দ নয়। সে ক্যাওট দের বারণ করেছে।
সেদিন তাঁতিদের ডোবার উত্তর দিকে গাব গাছের তলায় বসে দুই বুড়োর গল্প হচ্ছিল। কেউ একজন জাল গাবাচ্ছে। এই গাবের খুব কষ। জালের দড়িতে ভালো কষ লাগে। খয়েরী কালো রঙের হয়ে যায়। জলে সুতো টেঁকে অনেকদিন।
কাছাকাছি দুই পাড়ার এই দুই বৃদ্ধের খুব ভাব ভালো বাসা। বিকেলে, সন্ধ্যের আগে দুজনের একসাথে বসা চাই ই। দুজনে দুটি রাণীগঞ্জের
বেশ লম্বা সুলতানী বিড়ি ধরিয়ে বসে গল্প করে।
এমন সময় আঁকুড়ে বাড়ির ভিতর থেকে খবর এলো ঘরের একটা বৌমানুষ খোলা চুলে রক্ষিত পুকুরে খাবার জল আনতে গিয়েছিল। সে যখন জল নিয়ে আসছে তার মনে হল কেউ যেন পিছু পিছু আসছে। ঘরের দুয়ারে এসে দেখে কেউ নাই।
তারপর সে অজ্ঞান হয়ে গেছে। চোখে মুখে জল দেবার পর কিছুটা ধাতস্থ হল বটে কিন্তু সে মুখে আর ' রা' কাড়েনা। কেমন চুপচাপ হয়ে গেল।
ক্যাওট বুড়ো গম্ভীর মুখে আঁকূড়ে দাদুকে বলল
" ভাই সুবিধে ঠেকছেনা "। একে তোমার সংসারে নানা অঘটন ঘটছে, তার উপরে আবার এই।"
দেরি কোরোনা। কালই, কি বার যেন,! শণিবার।
ভালোই হল। ছোট ছেলেটাকে পাঠিয়ে দাও ক্ষুদ্দুপুর। চক্কোতি মশাই এর ওখানে। এই কদিন আগেই গো আমাদের গাঁয়ে এসেছিল।
ছোট ছেলে গেল ক্ষুদ্দুপুর। নদী পারাপারে অসুবিধা নাই। ওপারে সামান্যই জল। যদিও উদয়পুরে হদের ( হ্রদ) ঘাটে ছোট নৌকো চলে।
সকালে আর বিকালে। যারা এপারে আসে তাদের ফেরার সময় দুপুরে। আবার ওবেলায়। অনেকেই আসে।
নেশার খোঁজে আসে। এখানেই আছে মদের দোকান।
চক্কোতি মশাই মন্দিরের দাওয়া তে ই বসেছিলেন।
আঁকুড়ে ছোকরা কে দেখেই বললেন, তোর সঙ্গে
সাহা বাড়ির লোকেদের দেখা হয়নি পথে!
হ্যাঁ। হল যে।
ও, ওদের বাড়ির ছোট ছেলে টার অসহ্য পেট বেদনা রে। অনেক ওষুধ পত্র তে কিছু হয়নি।
আমার কাছে এসেছিল। ও, এতক্ষণে কমে গেছে।
গিয়ে খবর নিস তো। আমাকে জানাতে বলিস।
তো বল! তোর বৌ টা কেমন আছে। কথা বলবে কি, কেমন হকচকিয়ে গেল ছেলেটা। ও বলবে কি, চক্রবর্তী মশাই নিজেই বলে চললেন। যা যা বলবার জন্য ওনার কাছে গেছে।
তারপর অনেক ক্ষণ চোখ বন্ধ করে চুপ করে থাকলেন। তারপর মন্দিরে গিয়ে ঢুকলেন।
বেরিয়ে এসে বললেন " যা তোর কাজ হয়ে গেছে"
" কি করে জানব ঠাকুর মশাই "
" ও, জানতে হবে?
শোন রাতে একেবারে ঘর বন্ধ। কেউ বেরুবিনা।
তা না হলে - ভয়ানক বিপদ। সামলাতে পারবনা।
ঘরের উঠোনে কি কি গাছ আছে জেনে নিলেন।
চারপাশের গাছপালার খবর নিলেন।
বললেন " যা, যা ইচ্ছে হবে পরে এসে মায়ের নামে পুজো দিয়ে যাবি "।
ঘরে ফিরে এল। কোন রকমে দিনটা পার হল।
কখন সন্ধ্যে হয়! সন্ধ্যে একটু গাঢ় হতেই খাওয়া শেষ করে সবাই ঘরে ঢুকল। ভাল করে খিল এঁটে দিল। দেয়ালের দুই পাশে গর্তের মধ্যে মোটা বাঁশের লাঠি ঢুকিয়ে দিল।
ঘুম কি আর আসে। বৌ টা ঘরের এক কোনে চুপ করে বসে আছে।
হঠাৎ মাঝরাতে, হ্যাঁ মাঝরাতই হবে। অনুমানে। আন্দাজে বুঝল। মনে হল বাইরে যেন শোঁ শোঁ আওয়াজ। ঝড় এলো নাকি!
বৌটা কেমন যেন করছে। ঘাড় নাড়াচ্ছে দুদিকে।
সামনে পিছনে। খোলা চুল। যেন ভর নেমেছে।
একেবারে ভোরের দিকে মনে হল যেন উঠোনের
সজনে গাছ টা মাটি থেকে শিকড় সমেত কেউ তুলে উপড়ে দিল।
বৌ টা শান্ত, নিস্তেজ হয়ে মাটিতে শুয়ে পড়ল।
সকাল হল।
সবাই দেখল। হ্যাঁ সত্যিই তাই। কোন ঝড় ঝাপটা কিছুই রাতে হয়নি। ওদের উঠোনের সজনে গাছ টা উপড়ে পড়ে আছে। যেন কেউ তছনছ করেছে।
সবাই মিলে দু'হাত তুলে প্রণাম করল।
মঙ্গলবারে চক্রবর্তী মশাই এর কাছে যেতে হবে।
কালীথানে মানত করে এসেছে। শোধ করতে হবে।
------------ ------------ ------------ ------------
** পাঠক, আমি গল্প বলিয়ে। গল্প বলছি মাত্র।
No comments:
Post a Comment