Saturday, 30 August 2025

।।সন্ধ্যা মাসী : এক জীবনের অপচয়

।।সন্ধ্যা মাসী : এক  জীবনের অপচয়।। 
সন্ধ্যা মাসী তুমি এলে। আমাদের ঘরে বেড়াতে। 
 তখন সন্ধ্যা নামছে। বারান্দায় কফির চনমনে গন্ধ পেলে। বললে ‘’ কফি “! 
 আমি কফি খাচ্ছিলাম। তোমাকে শুধালাম, মাসী খাবে এক কাপ। তুমি না বললে। সেদিন যেমন আজও আমার মনে হয়, এক কাপ করে দিলে তুমি খেতে। আনন্দেই। কিন্তু তোমাকে সে কফি আমার আর খাওয়ানো হয়নি। হলনা।। 
তুমি আনমনা হয়ে গেলে। আমি কল্পনায় দেখতে পেলাম, তুমি চলে গেছো অনেক দূরে। 
সুলাইপাট মাইনস এর ম্যানেজার কোয়ার্টারে র বারান্দায়। মাইনসের ম্যানেজার পিসেমশাই , আর পিসিমা তাঁরা সন্ধ্যের সময় বারান্দায় বসতেন। 
কোয়ার্টার এর সামনে একদিকে একটা বিশাল কুসুম গাছ। আর একদিকে দুই শাল তরুবর। 
পাশে তিরতির করে বয়ে যাচ্ছে একটা পাহাড়ি ঝর্ণা। পিছনে ই পাহাড়ের সারি। লোহা পাথরে
ভর্তি। 
সাজানো বাগান। কুসুমের পাতা গুলো লাল হচ্ছে। 
তুমি কফিমগে করে দুজনের কফি এনে কফি টেবিলে সযত্নে নামাতে। নিজের জন্য এককাপ নিয়ে একটু দূরত্ব রেখে বসতে। 
কফি খেতে খেতে আমার চোখের সামনে এই দৃশ্য টা ভেসে উঠলো। ভুল হল। তোমাকে এক কাপ কফি খাওয়ানো আমাদের উচিৎ ছিল গো মাসী। 
তুমি মুখে না বললেও। 
সারা জীবন অবিবাহিত থেকে গেলে। পিসিমা কে কে দেখবে, এই ভাবনাতেই তাঁকে ছেড়ে আর যেতে পারলেনা অন্য ঘরে। সুন্দরী ছিলেনা। তবু - 
তোমার বিয়ের কোন চেষ্টা সম্ভবত তোমার পিসিমা
সেভাবে করেননি। তোমার প্রতি তাঁর ও একটা নির্ভরতা এসে গিয়েছিল। তাই স্বাভাবিক। মানুষ নিজের টা তো আগে ভাবে। 
পিসেমশাই এর অকাল মৃত্যুতে ফিরে আসতে হল 
বোলপুরে। বোলপুরে তোমার বা তোমাদের পিসিমার বাপের বাড়ি। বাপের বাড়ি তে না উঠে 
একটা পুরনো বাড়ি কিনে বসবাস শুরু হল। 
তোমার পিসিমার সাথে আমাদের গ্রামে আসছো 
অনেক দিন ধরেই। বছরে কমপক্ষে দুবার। 
তোমার পিসিমা হালদার বাড়ির বৌ। রজনীকান্ত হালদারের ছোট ছেলের বৌ। আলাদা মর্যাদা ছিল। নিজের চেহারাতেও ছিল আভিজাত্য। 
এখানে এলে কাঙাল ক্ষেপাচাঁদের বাগানবাড়ি নামে খ্যাত দালান কোঠার একটা ঘরে তোমরা অস্থায়ী বাসা বাঁধতে। 
আসা মূলত নিজের ভাগের জমির ধানের ভাগ নিতে। তোমরা এলেই অযোধ্যা গ্রাম থেকে সুলতা দিদি, এসে হাজির। আর গাঁয়ের হুবি বাউরী তো সর্বক্ষণের সঙ্গী হয়ে যেত। গাঁয়ে বেড়াবার আর জায়গা কোথায়। আমাদের বাড়িতে আসতে। 
দাদুর সাথে নানা ধরনের গল্প হত। তখন মানুষ সামাজিক সম্পর্ক তৈরী করে নিত। তোমার পিসিমা, পিসেমশাই ছিলেন দাদুর একমাত্র ছেলের ভিক্ষামা - বাবা। আমার মামা। তাঁকে নিয়ে গিয়ে  টাটা কোম্পানির কাজে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। 
আচ্ছা, সন্ধ্যা মাসী কখনও কি তোমার নিজের জন্য কোন ভাবনা আসেনি। ঘুম না আসা রাতে। 
কখনও কি মনে হয়নি পিসিমার পরে তোমার কি হবে। তোমাকে কে দেখবে। তোমার আত্মীয় স্বজন যে কেউ নেই তা নয় তবে তাঁরা আন্তরিক ছিলেন কি! তুমি ভালো জানতে। 
একদিন পিসিমা মারা গেলেন। লোকজন ডাকাডাকি করে তাঁর দাহকার্য থেকে যা কিছু পারলৌকিক কর্ম, ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী করলে। 
পাড়ার ছেলেরা সহযোগিতা করেছিল। 
তারপর অনেক দিন কাটল তোমার নিঃসঙ্গ, এক দমবন্ধ একাকী জীবন। 
নিশ্চয়ই নির্ঘুম রাতে, নির্জন বিছানায় মাথায় রাজ্যের চিন্তা এসে চাপতে লাগলো। বার্ধক্যের রোগভোগ আছে। কে দেখবে আমাকে। কে এনে দেবে ওষুধপত্র। কে করবে সেবা যত্ন। কি হয় এখানে!  যা হয় হবে। না হয় কোনভাবে গিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হব। কখনও ভেবেছো কোন আশ্রমে চলে যাবে। মুলুকে প্রায়ই তো যেতে। 
কিন্তু কেউ কি দায় নেবে। এমনকি টাকার বিনিময়েও নেবে! 
যাক। তোমার মৃতদেহ, পাড়ার ছেলেরা দরজা ভেঙে বের করল। কখন যে তুমি চলে গেছো কেউ জানতে পারলনা। কেমন নিঃশব্দে চলে গেলে। 
সন্ধ্যা মাসী নিজেকে নিয়ে কখনো কি ভেবেছিলে! 
স্বামী, পুত্রকন্যা, সংসার! তোমার কি একবারও মনে হয়নি একটাই জীবন। একবার ই মেলে। 
নিজের জীবন টাকে নিজের কাছেই অপচয় বলে মনে কি হয়নি তোমার। এমনি এমনিই ফুরিয়ে গেল। 

------------ ------------ ------------ ------------ 

 #allfollowers

No comments:

Post a Comment