Monday, 3 March 2025

খাণ্ডারী ঃ মানকর

।।  মানকর  -  খাণ্ডারী ।। 
 
" জীবন আমার নাম, মানকরে মোর ধাম, জিলা - বর্ধমান। " ---  রবীন্দ্রনাথ 
 ' মানই যার কর - সেই গ্রাম মানকর '
 ' পরে তসর খায় ঘি, তার আবার অভাব কি ' 
 ' কদমার ভিতরে ভরা কনের বিয়ের লাল চেলি টি '
 " কেমন কারিগর, থাকেন মানকর, 
  লাল চেলি ভরা থাকে কদমার ভিতর। "
 

 ' আছেন যেথা মানিকেশ্বর, নামটি তাহার মানকর '

 প্রাচীন এক জনপদ মানকর। কত প্রাচীন?  
 জনশ্রুতি অজ্ঞাতবাসের সময় পঞ্চ পাণ্ডব না কি এখানে এসেছিলেন। অবস্থান করেছিলেন। পৌষমুনির ডাঙ্গা বা পাণ্ডব ক্ষেত্র তলার ঐতিহাসিক প্রাচীনত্ব নির্ণীত হয়নি। 
 ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সার্ভেয়ার জেনারেল রেনেল সাহেবের ম্যাপে  মানকর ( Mankur)  উল্লেখিত। প্রাচীন এক রাস্তা বর্ধমান থেকে বেরিয়ে মানকর হয়ে চলে যাচ্ছে উত্তর পশ্চিমে 
 আদুরিয়া গ্রামকে পাশে রেখে সেনপাহাড়ী পরগনার ভিতর দিয়ে অজয় পার হয়ে আরও উত্তরে রাজনগর পর্যন্ত। 
 কনৌজ ব্রাহ্মণ রাই মানকরের প্রকৃত জমিদার। 
 বর্ধমানের রাজা দের কাছ থেকে তাঁরা ব্রহ্মোত্তর হিসাবে মানকরের রাইপুর এলাকা টি পান। পরবর্তী সময়ে সেখানেই 
 নির্মান করেন জমিদার বাড়ি  ' রঙ মহল '। 
 আদিতে এঁদের পদবি দুবে। মথুরায় বৈষ্ণব রাধাবল্লভ সম্প্রদায়ের  কাছে দীক্ষা নিয়ে তারা গোস্বামী হন। 
 মূলত সংস্কৃত শিক্ষা প্রদান এবং গুরুগিরি করার উদ্দেশ্যে ই 
 তাঁদের বাঙ্গলায় আগমন। প্রথমে মেদিনীপুর এর চন্দ্রকোনা। 
 পরে  এখানে আসেন। 
  এঁরা কিন্তু মানকর থেকে  উত্তর পশ্চিমে সামান্য দূরত্বের 
 খাণ্ডারী গ্রাম টিকে বেছে নেন নিজেদের বসবাসের জন্য। 
  নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার জন্যই কি এই সিদ্ধান্ত। 
  যে ভূমি খণ্ডে তাঁরা বসবাস স্থাপন করলেন - তাই হল খাণ্ডারী। অনুমান মাত্র। 
 মূল মানকরে তারা প্রথমে বাসা বাঁধেন নি। পরে রাইপুর এর
 জমিদারি পাবার পর মানকরে প্রাসাদ নির্মান করেন। 
 মানকর ছাড়াও ভরতপুর, খাণ্ডারী তেও ভূসম্পত্তি লাভ করেছিলেন। 
 গুরুদীক্ষা এবং গুরুদক্ষিণা ঃ  বর্ধমানের রাজা জগৎরাম এবং রাণীমা ব্রজকিশোরী দেবী কে দীক্ষা দেন পণ্ডিত শ্যামসুন্দর গোস্বামী। 
 তাঁর পুত্র ভক্তলাল গোস্বামী দীক্ষা দেন রাজা কীর্তি চাঁদ এবং তাঁর পুত্র রাজা চিত্রসেন কে। 
 গুরুদক্ষিণা স্বরূপ ১৭২২ সালে রাইপুর এলাকার জমিদারী সত্ত্ব লাভ করেন ব্রহ্মোত্তর সম্পত্তি হিসাবে। 
 রাধাবল্লভ মন্দির এবং সিংহবাহিনী মন্দির নির্মান করেন 
 ১৭২৯ সাল নাগাদ। 
 ভক্তলাল পরবর্তী বংশধর গন হলেন অজিতলাল, ব্রজলাল, 
 সেতাবলাল। 
 অজিতলালের দৌহিত্র  হিতলাল মিশ্র। এঁকে মানকরের অন্যতম রূপকার হিসাবে গণ্য করা হয়। নানা জনহিতকর কাজ তিনি করেছিলেন। আজকের হাটতলা তাঁরই পরিকল্পনা য় গড়ে ওঠে। মানকর থেকে বুদবুদ পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার করেন। 
 সৌন্দর্যায়নের জন্য রাস্তার দুই পাশে তালগাছ লাগানোর ব্যবস্থা করেন। বারোটি বাঁধানো ঘাট সমেত এক বিশাল দিঘী  যার নাম  ' কৃষ্ণগঙ্গা ' খণন  করান। সেই সময় ভীষণ খাদ্যাভাব এবং জলাভাব দেখা দিয়েছিল। কৃষ্ণগঙ্গা খণনের মাধ্যমে অনেক শ্রমজীবী মানুষ কাজ পেয়েছিলেন। 
বিদ্যানুরাগী এই মানুষ টি  পুঁথি সংরক্ষণের জন্য  " ভাগবতালয় " নামে এক গ্রন্থাগার গড়ে তোলেন। কয়েকটি টোল স্থাপন করেন। তাঁর সময়ের বিশিষ্ট পণ্ডিত দের মধ্যে 
গদাধর শিরোমণি, নারায়ণ চূড়ামণি, যাদবেন্দ্র সার্বভৌম, 
 প্রভৃতির নাম উল্লেখযোগ্য। 
তিনি গীতা র টীকা রচনা করেছিলেন। যার প্রশংসা করেছিলেন সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র। 
 হিতলাল মিশ্র র ব্যবসায়িক বুদ্ধি ছিল প্রখর। তিনি নীলকুঠি র
  ও  মালিক ছিলেন। 
 
 অসাম্প্রদায়িক মনোভাবের হিতলাল এবং তাঁর পূর্বজ ভক্তলাল গোস্বামী মুসলমানদের জন্য মসজিদ এবং খ্রিস্টান দের জন্য চার্চ নির্মান করিয়েছিলেন। 
  হিতলালের পুত্রের অকালমৃত্যু তে  দৌহিত্র রাজকৃষ্ণ দীক্ষিত, 
 জমিদার হন। তিনিই তৎকালীন সময়ের বাংলার জমিদার দের মধ্যে প্রথম, যিনি স্বদেশী আন্দোলনে (১৯০৫)  অংশগ্রহন করে 
কারারুদ্ধ হয়েছিলেন। তাঁর সময়ে  রঙমহলে অনেক স্বদেশী 
 গোপনে আসতেন। আলোচনা হত। তাঁরা আর্থিক সাহায্য লাভ করতেন। 
 রাজকৃষ্ণ পুত্র রাধাকান্ত। তিনিও অকালপ্রয়াত। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী শক্তিবালা দেবী কাঞ্চন কুমার দীক্ষিত কে উত্তরাধিকারী হিসাবে গ্রহণ করেন। তিনিই ' রঙমহলের ' শেষ 
 জমিদার। 
 ------------ ------------ ------------ ------------ ------------ ------------ 
 খাণ্ডারী গ্রামে এখনও কয়েকঘর কনৌজ ব্রাহ্মণ বাস করেন।
 ' অগ্নিহোত্রী ' পদবী। এই গ্রামের পঞ্চরত্ন, টেরাকোটা অলংকরণ শোভিত রাধাগোবিন্দ  মন্দির টি নির্মান করিয়েছিলেন  
 শান্তিময় তেওয়ারি র পূর্ব পুরুষ গন। আনুমানিক ১৮৫০ নাগাদ নির্মিত। 
 পাশের অষ্টকোনাকৃতি  গৌরীশ্বর শিবমন্দির টি অগ্নিহোত্রী পরিবারের। সৌগত অগ্নিহোত্রী জানালেন। 
মানকরে প্রায় ৪০-৪২ টি মন্দির। প্রায় সমসময়ে নির্মিত। 
 এই সব মন্দির কে নিয়ে আলাদা প্রবন্ধ পরবর্তী সময়ে প্রকাশিত হবে। 
------------ ------------ ------------ ------------ ------------ 
অতি সংক্ষেপে মানকর বা মানকরের কনৌজ ব্রাহ্মণ দের
 সম্পর্কে  এই প্রবন্ধে বলা হল।  মানকর এক প্রাচীণ জনপদ। 
 এবং যথেষ্টই বিস্তৃত। আকারে প্রকারে। অনেক সম্ভ্রান্ত পরিবার। অনেক ভগ্নাবশেষ। সংরক্ষণের অভাবে ভেঙে পড়েছে। যেমন ' রঙমহল '  ' কবিরাজবাড়ি '  বিশ্বাস বাড়ি, ইত্যাদি। 
------------ ------------ ------------ ------------ ------------ ------------ 
©   প্রণব ভট্টাচার্য। 
------------ ------------ ------------ ------------ ------------ ------------

Saturday, 1 March 2025

দুবরাজপুর। মন্দির সমূহ

।। দুবরাজপুর এর মন্দির সমূহ।। 

 এরা কি বিশিষ্টতা য় উজ্জ্বল নয়? 
ইতিহাস কি এতই অনুজ্জ্বল! 
কত মণিহারে বিভূষিতা ছিলে গো মা 
বঙ্গজননী 
 আমাদের সীমাহীন অবহেলা, অক্ষমতা 
ভাবনার দীনতা  নিজেদের নিষ্ঠুর ভেঙে যাওয়া 

হায়  আমরা রক্ষা করতে পারিনি 
 ক্ষমা চাইবার  অধিকার ও  হারিয়েছি 
সে কবেই 

দুবরাজপুর
 অনেক গুলি মন্দির। সবগুলি ই ইঁটের তৈরী। 
  বক্রেশ্বর এর দক্ষিণে এই দুবরাজপুরে পাথরের কোন মন্দির নাই। অথচ পাথর খণি যে খুব দূরে ছিল তা ও নয়। তবে হয়তো পাথরের কাজ করার মিস্ত্রি ছিলনা।বোধহয় রসা - বড়রা য় ছিল। সেখানে হাঁসা পাথরের কাজ এখনও হয়। 
মাকড়া পাথরের বোল্ডার দিয়েও। না  হয়নি। 
 পাকুড়তলা বাজার বা হাটতলার কাছে  তেরো চূড়ার এক মন্দির। মন্দির টি আয়তনে বা উচ্চতায় তেমন বড় নয়। 
 অত্যন্ত ঘিঞ্জি এলাকায় মন্দির টি। একদিন মন্দিরের প্রধান দ্বারপার্শ্বে ছিল " খোদিত কারিগর গোপীনাথ হাড়ি। দুবরাজপুর। আর একজনের নাম শ্রীনন্দ বাগতি। সন ১২৯৬ 
 বা ১৭৯৬ (!) । বেশ কিছু টেরাকোটা অলংকরণ ছিল। 
 আজ সব ঢেকে গেছে সিমেন্ট প্লাস্টারে। এখানে বৃষ বাহন শিবলিঙ্গ আছে। 
 উল্লেখযোগ্য যে সমাজের নিম্নবর্গের মানুষেরা, হাঁড়ি, বাগদি রাও মন্দির নির্মানে দক্ষ হয়ে উঠেছিলেন। 
 ময়রা পাড়া ঃ এখানে তিনটি মন্দির। দক্ষিণ মুখী। একটি ত্রয়োদশ রত্ন। বাকী দুটি শিখর রীতির। এখানেও সংস্কার এর কাজ হয়েছে। তবে বেশ কিছু টেরাকোটা প্লাক অবশিষ্ট আছে। 
 নায়ক পাড়া ঃ পাশাপাশি তিনটি মন্দির। একটি চালা রীতির।
 অসামান্য জ্যামিতিক ডিজাইন আছে এখানে। একটি নবরত্ন।
 অপর টি দেউল রীতি র। ধ্বংসপ্রাপ্ত। শিবের বিবাহ, কালী, মহিষাসুরমর্দিনী ইত্যাদি টেরাকোটা র কাজ  ছিল। 
 নামো পাড়া বা ওঝা পাড়ার "' পঞ্চ শিবালয় " ঃ এখানকার পাঁচটি শিবমন্দির। দুটির সিমেন্ট প্লাস্টার হয়ে গেছে। বাকী তিনটির একটি তেরো চূড়া, এবং দেউল রীতি র। 
 চমৎকার টেরাকোটা অলংকরণে সমৃদ্ধ। 
 এই ওঝা, পাণ্ডে, নায়ক রা সকলেই কেউ মৈথিলী, কেউ  কনৌজ ব্রাহ্মণ। তাঁদের ও ইতিহাস রয়েছে।

।।রাজনগর কথা।

।।  রাজনগর।। 
 নামই তার রাজনগর। 
 বা ছোট্ট করে নগর। 
 একদা বীরভূমের রাজধানী। 
 সীমান্ত এলাকা। পশ্চিমে ঝাড়খণ্ড। এই পথ দিয়ে কত 
 আক্রমণকারী ঝড়ের বেগে ঢুকেছে। স্বাভাবিক ভাবেই 
 এই সীমান্ত এলাকা সুরক্ষিত করার প্রয়োজন অনুভব করেছেন এখানকার শাসকরা। 
 রাজনগর এর ইতিহাস এর অনেক গুলি কালপর্ব। 
বীরভূমের বীর রাজাদের রাজধানী। 
এই বীর রাজাদের সম্যক পরিচয় এখনও পরিষ্কার নয়। 
 এই সেই লক্ষৌনুর। 
 বাংলার বিখ্যাত সেন রাজাদের নামাঙ্কিত। রাজা লক্ষনসেনের 
 নামে রাজা বল্লালসেন স্থাপন করেছিলেন এই নগরের। 
 গড়, গড়খাত, ইত্যাদি নির্মিত হয়েছিল। 
 হিন্দু রাজাদের পরে এখানকার শাসক হন পাঠানরা। 
 তাঁদের সময়ে বীরভূম অনেক বিস্তৃত। 
 পাঠানরাজারাও ছিলেন বিখ্যাত। 
 এই রাজনগর এর পাঠান রাজাদের উকিল, আইনী পরামর্শ দাতা, মুর্শিদাবাদ রাজদরবারের প্রতিনিধি ছিলেন 
 ধর্মমঙ্গল কাব্যের অন্যতম কবি নরসিংহ বসুর পূর্ব পুরুষ রা। 
 এঁদের পৈত্রিক বাসস্থান ছিল আমাদের এখনকার  কাঁকসা থানা  এলাকার বসুধা গ্রামে। 
  এই বসুধা ছেড়ে শাঁখারী গ্রামে চলে যান মথুরা বসু। 
 " বাঙ্গালায় বীরভূম বিখ্যাত অবণী। 
 শ্রী আসফুল্লা খান রাজা শিরোমণি "।
রাজনগর এর কথার শেষ নাই। 
 আনুমানিক ষোড়শ শতকে নির্মিত এখানকার বিখ্যাত 
 মোতি চূড় বা মোতি মসজিদ। 
 ছয় গম্বুজের এই মসজিদের গম্বুজ গুলি ভেঙে পড়েছে। 
 নির্মিত হয়েছিল চমৎকার এক ধর্মীয় স্থাপত্য। 
 অসাধারণ তার টেরাকোটা র অলংকরণ। 
 হিন্দু মুসলিম উভয় ধারার মিশ্রিত " মোটিফের "ব্যবহার হয়েছে। টেরাকোটা অলংকরণ যুক্ত কোন মসজিদ আর 
বীরভূমে নাই। 
 যদিও এই মসজিদের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়নি বা নমাজ পাঠ হয়নি। 
 এটি একটি অবহেলিত ঐতিহাসিক স্থাপত্য। 
------------ ------------ ------------ ------------ ------------ 
 সকলকে আমার ঈদের শুভেচ্ছা জানাই। 
 সৌভ্রাতৃত্ব বজায় থাক। মনুষ্যত্ব ই মানুষের শ্রেষ্ঠ পরিচয়।

যাত্রাপালাগান ঃ একটি শতবর্ষ প্রাচীণ আসরের কথা

।। যাত্রাপালা গান  ঃ একটি শতবর্ষ প্রাচীণ আসরের কথা।।  প্রণব ভট্টাচার্য 
স্বাভাবিক ভাবেই লেখাটি দীর্ঘ। এলাকার ঐতিহ্য। এখানকার কথা লেখা বা বলা উচিৎ ছিল। 
ভালো লাগলে পড়বেন। 

।  ১ নং পাতা 
" আমাদের জাতীয় নাট্য বলতে যদি কিছু থাকে তা হচ্ছে যাত্রা " বলেছিলেন নাট্যাচার্য শিশির ভাদূড়ী।
আর রামকৃষ্ণ দেব বলেছিলেন যাত্রা থিয়েটারে লোকশিক্ষা হয়। যাত্রা দলের গদিতে হোক বা আসরের সাজঘরে তাঁর ছবি টাঙানো থাকেই। তাঁকে প্রণাম জানিয়েই যাত্রা শুরু হয়।
যাত্রা মানে উদ্দেশ্য নিয়েই কোথাও গমন। সে তীর্থ যাত্রা ই হোক আর আনন্দ ভ্রমণ ই হোক। যাত্রা শুভ হোক। আমাদের এই কামনা থাকে।
যদি আমরা ধরে নিই যে যাত্রাপালার প্রথম অঙ্ক থেকে পঞ্চম অঙ্ক পর্যন্ত ঘটনাপ্রবাহের যে বিন্যাস, তার চলন, পরিণতি র দিকে তার যে গতি প্রবাহ তাই যাত্রা। শুরু থেকে শেষ। এই যাত্রাপথের শিল্পীত রূপ ই আমাদের যাত্রা পালা গান।
আমাদের জীবন যেমন। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত যে বিস্তৃতি তাই জীবন কাল। হাসি, কান্না, দুঃখ, বেদনা, আনন্দ,লোভ লালসা মেশানো । সব রসের সমাহার। যাত্রা পালা গানেও এই সকল রসের সমাহার। সকল রসের ধারার এক মিলিত গতি প্রবাহ।
একদিন গ্রামবাংলার অন্যতম প্রধান বিনোদনের মাধ্যম ই ছিল যাত্রা। কোথাও বিনা পয়সায় কলকাতার যাত্রা দলের যাত্রা হচ্ছে শুনলে লোক ভেঙে পড়ত সেই আসরে।
মানুষের সেই উন্মাদনা আমরা লক্ষ্য করেছি অতি বিখ্যাত এক যাত্রা পালা " নটী বিনোদিনী " তে। আমি একটি উদাহরণ দিলাম মাত্র। টিকিট কেটে যাত্রা। চারদিকের সব বেড়া খুলে দিতে বাধ্য  হতে হয়েছে আয়োজক দের। রাতের পর রাত সেই পালাগান চলেছে। তেমনই আর এক একটু পুরনো পালা
" সোনাই দিঘী "। কি অসামান্য অভিনয়। ভাবনা কাজী কে দেখার জন্য মানুষের কি উন্মাদনা।
এমন কত শত পালা। নাম লিখে বা বলে শেষ করা যাবেনা।
একে হাল্কা চোখে দেখার কোন কারণ নাই। " যাত্রা দ্যাখে ফাৎরা লোকে " বললে বুঝতে হবে কোথাও মূল্যায়নে ফাঁক থেকে যাচ্ছে।
আজ যাত্রা শিল্প অনেকটা ই মুখ থুবড়ে পড়ার মতো অবস্থায়।
কলকাতার কোন যাত্রা নয় নাটকের দল বুক ফুলিয়ে বলতে পারবে ভালো আছি। না। কেউ ভালো নেই। যাত্রাও না। নাটকও না। গানের জলসাও না। সিনেমা তো নাই। সব হল বন্ধ। মাল্টীপ্লেক্স এ আর কজন যায়।
আসলে সমগ্র বিনোদন এর জগৎ টি ই সম্পূর্ণ বদলে গেছে।
টেলি সিরিয়াল ই আজ মহিলা দের আনন্দ সন্ধ্যা।
আর মোবাইলে মত্ত কিশোর যুবক দের দল।
------------ ------------ ------------ ------------ ------------ ১ নং পাতা শেষ।  

।। যাত্রা কথা।।  ২ নং পাতা আরম্ভ।
অথচ কত দীর্ঘ পথ পার হয়ে এসেছে যাত্রা পালা গান।
সেই চৈতন্য পরবর্তী  নীলকন্ঠ মুখোপাধ্যায় মশাই এর কৃষ্ণ যাত্রা, থেকে  গোবিন্দ অধিকারী, মতিলাল রায় কত মানুষের
আজীবন এর সাধনার ফলশ্রুতিতে বিবর্তনের মধ্য দিয়ে আধুনিক যাত্রা পালা। পৌরাণিক, ঐতিহাসিক এবং সামাজিক
কত পালা। অসাধারণ অভিনেতা এবং অভিনেত্রী গণ। নারী চরিত্রে দক্ষতার সঙ্গে অভিনয় করেছেন চপল রাণী র মতো কত পুরুষ রাণী।
এরিস্টটল বলেছিলেন " প্রকৃত ইতিহাস লেখার চেয়ে শিল্প সম্মত ভাবে ইতিহাস কে উপস্থাপিত করা ই অধিকতর বিজ্ঞান সম্মত এবং বাস্তব। " প্রাচীন  গ্রীসের নাট্যচর্চা কে আমরা স্মরণ করতে ই পারি এই প্রসঙ্গে। সে ও এক দীর্ঘ ইতিহাস।
১৯৩৬-৩৭ সাল নাগাদ পূর্ব বঙ্গের বরিশাল থেকে শশী নট্ট,সূর্য দত্ত দের " মাচরং বৈকুন্ঠ যাত্রা সমাজ " যেদিন কলকাতার হরচন্দ্র মল্লিক স্ট্রিট এ তাঁদের গদিঘর পাতলেন সেদিন থেকেই প্রকৃত প্রস্তাবে কলকাতা বা কলকাতার চিৎপুর ধীরে ধীরে  হয়ে উঠল  যাত্রাপাড়া।
২০০৫ সালে চিৎপুরে প্রায় ৫৫ টি যাত্রা দল। সিজিনে  চার হাজার রাতের বায়না। ২০০১ এ ছোট বড় মিলিয়ে তিন শো র
মতো কোম্পানি। ২০০০০ মানুষের সংযুক্তি। লক্ষ কোটি টাকার ব্যবসা। এক একটি দলে সব বিভাগ মিলিয়ে প্রায় ৬০-৭০ জন মানুষ। কত বড় একটা শিল্প। এর সাথে জড়িয়ে আছে আরও হাজার হাজার মানুষ। আলো, ড্রেস,  মেক আপের দ্রব্যাদি র ব্যবসার সাথে কত মানুষ যুক্ত ছিলেন।
সবচেয়ে বেশী বায়না যেমন হত অবিভক্ত মেদিনীপুরে তেমনি মেদিনীপুর এর নন্দকুমার এবং বেলদা কে বলা হত মেদিনীপুর এর চিৎপুর। মেদিনীপুর কলকাতাকে কত শিল্পী সরবরাহ করেছে। স্টার আর্টিস্ট দের বাদ দিয়েও চরিত্র অভিনেতার ভূমিকা  একটি পূর্ণাঙ্গ প্রযোজনা য় কম মূল্যবান নয়।
বীরভূমে সম্ভবত যাত্রা পালার সূচনা ১১০০ বঙ্গাব্দে।
শিশুরাম অধিকারী বা ঐ শিষ্য পরমানন্দ অধিকারী বীরভূমের রামবাটী র বাসিন্দা ছিলেন। ধবনী গ্রামের নীলকন্ঠ মুখোপাধ্যায় মশাই তাঁর কৃষ্ণযাত্রাকে অসম্ভব জনপ্রিয় করেছিলেন। তিনি ১৩১৮ পর্যন্ত জীবিত ছিলেন।
হেতমপুরের রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠে রঞ্জন অপেরা। তাকে কলকাতায় নিয়ে গেলেন ফণীভূষণ বিদ্যাবিনোদ বা বড় ফণী।
অত্যন্ত সুনামী প্রযোজক, দল পরিচালক শম্ভুনাথ ঘোষ
তাকে নব রঞ্জন অপেরায় পরিণত করলেন।
বীরভূমের শুধু নয় সমগ্র রাঢ় এলাকার পশ্চিমাংশের যাত্রা প্রীতি সুবিদিত। পরবর্তী সময়ে বায়নার জন্য যখন এজেন্ট প্রথা চালু হল প্রথম  রাণীগঞ্জের রাণীসায়ের মোড়ে গড়ে উঠল
অনিল ভাণ্ডারী মশাই এর বুকিং অফিস। তাঁকে বলা হত
" কোলিয়ারী লর্ড " বা যাত্রা লর্ড। তাঁর মাধ্যমে ই বুকিং হত।
সব দলের ই ব্যবসার তিনি ছিলেন কাণ্ডারী।
" নট্ট কোম্পানি " - নট্ট কোম্পানি ই। ছিলেন যে সূর্য দত্তের মতো মানুষ। তারপর ই নাম করতে হয় সত্যম্বর চট্টোপাধ্যায় এর " সত্যম্বর অপেরা র "। এই অপেরার সোনাই দিঘী তো ইতিহাস। ইতিহাস রচনাকারী অনেক প্রযোজনার জন্ম দিয়েছে এই অপেরা।
কত অপেরা, কত কোম্পানী। নাম লিখতে হলে উল্লেখযোগ্য অনেক নাম বাদ পরে যাবে এই ভয়। তবু কিছু নামের কথা বলার আগে বলে নেওয়া ভালো যাত্রা তখন এতই জনপ্রিয় যে
বড় গ্রাম বা গঞ্জে গড়ে উঠেছে এমেচার যাত্রা দল। শুধু ইলামবাজার এর নাম উল্লেখ আছে। ইলামবাজার রিক্রিয়েশনাল যাত্রাপার্টি। শতবর্ষের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছেন তার প্রবীনতম সদস্য।
সেই এমেচার দলের অভিনয় আমরাও যা দেখেছি সে ফেলে দেবার মতো নয়। অমর বন্দ্যোপাধ্যায় এর মতো চেহারা এবং অভিনয় ছিল অনবদ্য। যে কোন পেশাদার অভিনেতা র সাথে তিনি পাল্লা দিতে পারতেন। তাঁর স্ত্রী ও ছিলেন নামী অভিনেত্রী।
অযোধ্যা বনকাটি এলাকায়   পেশাদার দের মতো দল অযোধ্যায় গড়ে উঠেছিল। ননীগোপাল চট্টোপাধ্যায় এর নির্দেশনা
সঙ্গীত পরিচালনা এবং অভিভাবকত্বে। বড় বড় ট্রাঙ্কে ছিল সাজপোশাক সহ মেক আপের দ্রব্যাদি। মহিলা চরিত্রে কিন্তু পুরুষ।  গোপালপুর, বামুনাড়া, আড়া ইত্যাদি গ্রাম মিলিয়ে
শক্তি মান অভিনেতা দের সম্মিলিত প্রয়াসে গড়ে উঠেছিল
পেশাদার প্রায় যাত্রাদল। অনেকে ছিলেন তার পৃষ্ঠ পোষক।
কলকাতার যে দলটির কথা না বললেই নয় তা হল " তরুন অপেরা "। প্রধান অভিনেতা শান্তিগোপাল। তাঁর হিটলার ২০০০ রজনী অভিনীত হয়েছিল। তিনিই একমাত্র অভিনেতা তাঁর লেনিন যাত্রাপালা নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নে গিয়েছিলেন। এবং সোভিয়েত ল্যাণ্ড নেহরু অ্যাওয়ার্ড লাভ করেছিলেন।
৭০ এর দশকে খবরের কাগজের যাত্রা সমালোচক খ্যাত ব্যক্তিত্ব প্রবোধবন্ধু অধিকারী হয়ে উঠেছিলেন যাত্রা পাড়ার
অভিভাবক পিতার মতো।
যাত্রায় উৎপল দত্তের আসা মাত্রই যাত্রা দেখল নূতন আঙ্গিক।
অভিনয়ের উৎকর্ষ। তাঁর পরিচালিত "  ফেরারী ফৌজ "
সন্ন্যাসীর তরবারি ইত্যাদি যাত্রা পালা যাত্রার ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবে।
অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় এর মতো শক্তিমান অভিনেতা যাত্রায় এসেছিলেন। কিন্তু সাফল্য পাননি। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিতে
" রাবণ " পালা জনতা গ্রহণ করেনি।
আবার সিনেমা থেকে কিছু অভিনেতা অভিনেত্রী এলেন
কিন্তু তাঁদের অভিনয় ধারা ভিন্ন হওয়ায় সেভাবে দর্শক নেননি।
অনেকে যেটা বলেন যাত্রার অভিনয় চড়া মোটা দাগের।
অতি অভিনয় ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু যাত্রায় কি স্বপনকুমারের
মাইকেল মধুসূদন হয়নি!  এমন আরও অনেক নাম করা যায়।
কিছু যাত্রা দলের নাম করতেই হয়। যেমন নিউ রয়্যাল বীনাপাণি অপেরা, নিউ গণেশ অপেরা, নব অম্বিকা অপেরা
নিউ প্রভাস অপেরা, আর্য্য অপেরা, নিউ আর্য্য অপেরা,
সত্যনারায়ণ অপেরা ; ভারতী অপেরা,  লোকনাট্য, নাট্যভারতী ; মুক্তঅঙ্গন, আনন্দলোক, শিল্পীতীর্থ, অগ্রগামী
ইত্যাদি অপেরা অনেক বিখ্যাত প্রযোজনার জন্ম দিয়েছেন।
অনেক নাম বাদ গেল। লেখক ক্ষমাপ্রার্থী।
বিভিন্ন সময়ে কিছু মানুষের উজ্জ্বল ভূমিকায় আলোকিত হয়ে ওঠে প্রাঙ্গণ। তেমনি কিছু মানুষ - মাখনলাল নট্ট,  শৈলেন মোহান্ত,
তিনকড়ি গুছাইত, দীনবন্ধু গুছাইত,, অমিয় বসু, দিলীপ চট্টোপাধ্যায়, কালিপদ দাস, নীলমণি দে, দুলাল চট্টোপাধ্যায়
হৃষিকেশ মিত্র, কিষান দাশগুপ্ত, নির্মল মুখোপাধ্যায়,
রমেন মল্লিক, বৈদ্য নাথ শীল ইত্যাদি মানুষেরা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছেন।
যাত্রার পালাকার ঃ প্রথমেই যে নাম সকলের মনে আসে তিনি আর কেউ নন যাত্রাপালাসম্রাট ব্রজেন দে । তার পরই
ভৈরব গঙ্গোপাধ্যায়, শম্ভু বাগ, সহ অনেক নাম।  যে নাম গুলিকে বাদ দিয়ে যাওয়া অপরাধ।
যাত্রার প্রধান অভিনেতা ঃ যাঁর নামেই দর্শক আসবেন তেমন অভিনেতা তো সহজে মেলেনা।
সেই বড় ফণী অর্থাৎ ফণীভূষণ বিদ্যাবিনোদ, ফণীভূষণ মতিলাল ( ছোট ফণী) । যাঁকে বলা হত যাত্রার যুবরাজ
নটসূর্য্য দিলীপ চট্টোপাধ্যায়, পঞ্চু সেন, ষষ্ঠীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, ফণী গাঙ্গুলি,  মাখন সমাদ্দার, অনাদি চক্রবর্তী
, স্বপনকুমার , শেখর গাঙ্গুলি,  তরুনকুমার, ভোলা পাল,
পান্না চক্রবর্তী, অভয় হালদার, অশোক কুমার, রাখাল সিংহ
শ্যামল ঘোষ, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, অসিত বসু, নির্মল মুখোপাধ্যায়।  সিনেমা থেকে এসেছিলেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়।
তাঁর " যমালয়ে জীবন্ত মানুষ " ভালো ব্যবসা করেছিল।
এসেছিলেন সন্তু মুখোপাধ্যায়।
অসাধারণ অভিনেতারা। আর আচার্য্য পূর্ণেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় এর নাম না করা তো অন্যায়।
এখনও প্রবীণ দের কানে ভাসছে গ্রীনরুম থেকে উদাত্ত গলায় গান ধরা বিনোদ ধাড়া বা তাঁর সুযোগ্য পুত্র গুরুদাস ধারার নাম। নট্ট কোম্পানি র খোকন বিশ্বাস প্রভৃতি র নাম খুবই উল্লেখযোগ্য। আরও অনেকে রয়েছেন যাঁদের গান ই ছিল সেই পালার সম্পদ।
অভিনেত্রী দের কথা এলেই প্রথমেই যে নাম মনে ভেসে উঠে আসে তিনি অদ্বিতীয়া জ্যোৎস্না দত্ত। অবিস্মরণীয়া বীণা দাশগুপ্ত,।  রুমা দাশগুপ্ত, বেলা সরকার,  সহ অন্যান্য অভিনেত্রী রা অসামান্য ভূমিকা রেখেছেন। সব নাম বলা একটি ছোট প্রবন্ধে সম্ভব নয়।
যাত্রার মিউজিক মাষ্টার,  মোশন মাষ্টার এর ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাদ্যযন্ত্রী দের নাম লিখতে বসলে সেটাই হয়ে যাবে
ইতিহাস।
রূপসজ্জাকার এবং তাঁর সহকারী গণ।
পেট্রোম্যাক্স, হ্যাজাক লাইটের যুগ। তাতেই আলোর কারিকুরি করেছেন শুধু রঙিন কাগজের সাহায্যে যাঁরা তাঁরাও একটা দলের অপরিহার্য অঙ্গ।
রান্নাঘর কে বাদ দিলে তো চলেই না। প্রধান অভিনেতা বা অভিনেত্রীর স্পেশাল রান্না চাই৷ কত জনের কত রকমের আবদার। সব রান্না ঘরকে মনে রাখতে হয়। এই রান্নাঘরে ই
ককপক্ষে পাঁচ সাত জন লোক। তাঁদের কথা আর কাদের মনে থাকে!
------------ ------------ ------------ ------------ ------------ ------------ ২ নং পাতা শেষ।

।। যাত্রা পালা গান  এবং এক শতবর্ষ প্রাচীণ যাত্রার আসর এর কথা।। ৩ নং পাতা আরম্ভ।
এমন একটা সময় ছিল " রূপাই চণ্ডী তলায় " যাত্রাকরতে যাওয়া ছিল প্রায় সব দলের কাছে তীর্থ যাত্রার মতো।
রথযাত্রার দিনে বায়নার সময় অনেকে লক্ষ্য রাখতেন ওখানে বায়না হল কি না। গদি থেকে অনেকে খবর নিতেন। লোক পাঠিয়ে।
শতবর্ষ প্রাচীণ এই যাত্রার আসর। ১২৭ বছরে পড়েছে এখানের যাত্রার আসর। সেই কৃষ্ণযাত্রা দিয়েই শুরু। তারপর পালাগান, যাত্রার আসর।
বিশাল বিশাল শিমূল,  অর্জুন গাছ, পলাশের জঙ্গল। পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে এক জলধারা। এখানে সেই জলধারা দহ র রূপ নিয়েছে। প্রাচীন কয়েক টি বন্যার স্মৃতি জড়িয়ে এই স্থান আজও টিঁকে আছে স্বমহিমায়। দেবী চণ্ডী। রূপাই চণ্ডী। দহের নাম " রূপাই দহ "। জলধারার নাম " বৃদ্ধ নদী "। দহের পাড়ে মোরাম চাতাল। আদিবাসী পাড়া। নাম " রাজাপোতার ডাঙ্গা "।
অজয় থেকে বের হয়ে একটি জলধারা এই স্রোতপথে বসুধার ভিতর দিয়ে চলে যেত পূর্বে অনেক টা। পাণ্ডুকের কাছে " পাণ্ডুরাজার ঢিবির পাশ দিয়ে আবার অজয়ে মিশত। সে স্রোতে নৌকা চলাচল করত। " রাজার পোত " থেকে পাণ্ডুরাজার ঢিবি "হয়ে অজয়ে গিয়ে নৌকা চলে যেত দূরে।
  ""রাজার পোত " থেকে রাজা পোঁতা। পাণ্ডুরাজার ঢিবির ও অপর নাম রাজা পোতার ডাঙ্গা।
তাহলে কে ছিলেন এই রাজা। আদিবাসী কোন মানুষ। না কি সদগোপ প্রাধান্যের এই এলাকায় কোন সদগোপ রাজা।
নাম কি ছিল তার রূপাই! প্রবীণেরা বলতেন এই দেবী সদগোপ দের বা এই পূজায় তাঁদের বিশেষ অংশ ছিল।   পরবর্তী সময়ে  ব্রাহ্মণ দের আনানো হয়েছিল। একসময় ডাঙ্গাল গ্রামে অনেক ব্রাহ্মণ পরিবার বাস করতেন। ডাঙ্গাল গ্রামের দু টি অংশ। 
একটি রামপুর, অপরটি ডাঙ্গাল। ডাঙ্গাল অংশে ব্রাহ্মণ বসতি ছিল। মারাত্মক কলেরা, ম্যালেরিয়া রোগে গ্রাম উজাড় হয়ে যায়। অনেকে গ্রাম ত্যাগ করেন। 
 এই দেবী চণ্ডী। রাঢ় এর মহাকাব্য মঙ্গল কাব্য গুলির অন্যতম চণ্ডীমঙ্গলের দেবী চণ্ডী যেমন বনদেবী। তিনি বনের সকল জীবের পালয়িত্রী। আদিবাসী দের " চাণ্ডী "। তিনিও
প্রকৃতি। সর্বত্র বিরাজমানা। বনভূমির কোন প্রাচীন বৃক্ষ তলে
তাঁর আবাস। তিনি বিলে আছেন, মাঠে আছেন ; জঙ্গলে লতাগুল্ম ঘেরা কোন থানে আছেন।
এই দেবী রূপাই চণ্ডী র দুর্গার ধ্যানেই তাঁর পূজা হয়। বিশেষ উল্লেখ যোগ্য চৈত্র সংক্রান্তি তে দেবীর বাৎসরিক পূজার আয়োজন হয়। শিবের গাজনের সাথে তাঁর গভীর সম্পর্ক।
এই পূজা উপলক্ষে ই বৈশাখের তিন চার তারিখ নাগাদ এখানে কবিগান ; কৃষ্ণযাত্রা ; এবং পরে কলকাতার যাত্রা দলের পালাগান চালু হয়েছে শতবর্ষ আগে। এখনও সেই ধারা অনুযায়ী যাত্রাপালা অনুষ্ঠিত হয়। প্রতি বৎসর।
আগে মানুষের ভিড়ে কোথাও তিল মাত্র জায়গা থাকতো না।
ঝোপ ঝাড় পরিষ্কার করে কিছু জায়গা বের করা হত।
দূর দূর গ্রাম থেকে গোরুগাড়ি করে মানুষ জন আসতেন।
মহিলারাও আসতেন। যথেষ্ট নজরদারি র ব্যবস্থা থাকত।
উৎসব কমিটির পক্ষ থেকে পার্শ্ববর্তী গ্রামসমূহের বিশিষ্ট মানুষ দের আমন্ত্রণ জানানো হত।
ডাঙ্গাল বসুধা গ্রামের ঘোষবাবুরা ( গোবিন্দ ঘোষ এবং তাঁদের  পরিবারের পূর্ব পুরুষ গন)  ও ডাঙ্গাল গ্রামের বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবার ( ভোলানাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁর পূর্ব পুরুষ গণ),  এঁরা ই মূলত এই পূজা এবং উৎসব, যাত্রা পালা গানের আসর বসানো ইত্যাদি র আয়োজন তথা তদারকি করতেন। বা এখনও বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবার সহ অন্যান্য রা করছেন। ডাঙ্গাল বসুধা  গ্রামবাসী গণ সহযোগিতা  করেন।    জীবিত দের মধ্যে বয়স্ক মানুষ বংশী মণ্ডল রয়েছেন। তাঁর যুবক বেলায়  তিনিই বায়না করতে চিৎপুর যেতেন। প্রবীণ দের মধ্যে আর রয়েছেন, সুকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, শিশির বন্দ্যোপাধ্যায়। এবং অন্যান্য 
গ্রামবাসী গণ। 
ঘোষ বাবুদের লিচু বাবু কাঁধে বন্দুক নিয়ে চারপাশে নজর রাখতেন। হাবল বাবু তদারকি করতেন। সাতকাহনিয়া গ্রাম থেকে হালদার বাবুরা 
যেতেন।  শারীরিক প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও নারান মাজি র  তৎপরতা ছিল নজর কাড়া।
আরও অনেক কথা থাকা স্বাভাবিক। শতবর্ষ প্রাচীণ। অনেক গুলি পুরুষ। মানেই এক এক সময়, বা কাল পর্ব। কোন অসম্পূর্ণতা থাকতেও পারে। আরও অনুসন্ধানের প্রয়োজন থেকেই যায়। 
 বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের শ্রী শিশির বন্দ্যোপাধ্যায় কিছু  আমার নজরে এনেছেন। তাঁকে ধন্যবাদ। 
 আমি সংযোজন বা সংশোধন করে নিলাম। 

------------ ------------ ------------ ------------ ------------ ৩ নং পাতা শেষ। 

 

।। যাত্রা পালা গান ঃ শতবর্ষ প্রাচীণ এক যাত্রার আসর।।
৪ নং পাতা। আরম্ভ।
প্রবীণ দের মুখে শুনেছি রূপাই চণ্ডী তলায় পালাগান পরিবেশন করেননি এমন যাত্রা দল প্রায় নেই। তবে এটাও ঠিক যাঁদের বা যে সব দলের রেট কম থাকত তাদের কেই প্রথম দেখা হত। তবে রূপাই চণ্ডী তলার নাম শুনে অনেক যাত্রাদল কম পয়সা নিয়েই গান করেছে এমন উদাহরণ অনেক আছে। কোন এক দলের একবার প্রায় বায়না হচ্ছিল ই
না। এখানে গান করার পর না কি তাঁদের ভালো বায়না হয়।
একটা সময় ছিল যখন " সত্যম্বর অপেরা " মানেই ভালো যাত্রা। আর তাদের  বাঁধা  ছিল এই জঙ্গলাকীর্ণ স্থলের আসর। মানুষের মুখে মুখে ফিরত বড় বড় শিল্পী দের নাম।

মুখে মুখে ছড়িয়ে যায় এই স্থলের মাহাত্ম্য।
এমন অনেক গল্প প্রবীণ দের মুখে শোনা যেত।
মূলত রূপাই চণ্ডী তলার চারপাশে যাঁদের কৃষি জমি রয়েছে
বা বসুধা মৌজায় তাঁদের কাছ থেকেই চাঁদা নিয়ে বিনা পয়সায় কলকাতার যাত্রা দলের যাত্রা পালা গান শোনা বা দেখার সুযোগ পেতেন সাধারণ মানুষ বছরের ঐ দুটি দিন।
সারা বছর মানুষ মুখিয়ে থাকতেন এই আসরের দিকে।
অজয়ের ওপারে ইলামবাজার থেকে যাত্রামোদী মানুষেরা দলে দলে আসতেন। পার্শ্ববর্তী এলাকা মৌখিরা কালিকাপুর থেকে বা আদুরিয়া অমরপুর থেকে কি মাজুরিয়া রঘুনাথপুর থেকে বা তেলিপাড়া, এমনকি রক্ষিতপুর মলানদিঘী এলাকা থেকেও মানুষ আসতেন এখানে। তখন যাত্রা দেখার একটা
প্রবল আগ্রহ মানুষের মধ্যে ছিল। যা আজ আর নাই।
সরকারের উদ্যোগে যাত্রা উৎসব চালু করা হয়েছিল।
যাত্রা জগতের বিশিষ্ট মানুষ দের আমন্ত্রণ জানিয়ে সেখানে আনা হত। মন্মথ রায় দের মতো  মানুষ কোন  যাত্রা দেখে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন,  আবার অদূর ভবিষ্যতে যাত্রাপালাগানের
ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আশাবাদী হতে পারেননি তেননি অনেকে।
  বাংলার বাইরে যে আসাম, ঝাড়খণ্ড, বিহারের প্রবাসী বাঙালী অধ্যুষিত এলাকা থেকে একসময় অনেক বায়না হত।
সেখানেও ভাঁটা পড়েছে। সব দিক দিয়েই যাত্রা শিল্প আজ
সংকটে। অথচ এই শিল্পের সাথে জীবন জড়িয়ে ছিল কত কত পরিবারের।
তবু টিঁকে থাকবে হয়তো। একেবারে নিঃশেষ হয়ে যাবেনা।
তবে পালারচনা থেকে শুরু করে, সেই মানের অভিনেতা অভিনেত্রী ; তেমন গান, গায়ক বা মিউজিক - একটা সমন্বিত শিল্প যেমন হয় তেমন মানে যাত্রা কে সাজাতে হবে।
যাত্রা কে ভালোবেসে এই শিল্পের আঙিনায় আর তেমন কেউ আসছেন না এমন আক্ষেপ গদিমালিক দের। আসছে  কিছু
  দ্রুত  উপার্জনের আশায়।
আর নিম্ন রুচির সস্তা পালাগান দিয়ে এই শিল্প বাঁচবে না।
সামগ্রিক পরিবেশের পরিবর্তন ঘটেছে। এবং একশ্রেণির
উচ্ছৃঙ্খল যুবক দের সব কিছু কে অবজ্ঞা, উপেক্ষা করার
মানসিকতা দেখা দিয়েছে। মানুষ ঘর থেকে বেরুতে চাইছেন না। মহিলাদের নিয়ে বের হওয়া তো দূরের কথা।
আর মধ্যবিত্ত স্তরের ভদ্র মানুষেরাই যদি আসরে না যান, সমঝদার মানুষ দের যদি উপস্থিতির অভাব ঘটে তাহলে শিল্পী দের ও মনে তার প্রভাব পড়ে। তাঁরা ও দেখে নেন শ্রোতা কেমন! গান ও তেমন। 
রূপাই চণ্ডী তলা জেগে ওঠে বৈশাখের ঐ কটা দিন। জেগে নিশ্চয়ই থাকবে। শুধু এই এলাকা নয় আমাদের কাঁকসাব্লকের
এত প্রাচীণ, ঐতিহ্য পূর্ণ যাত্রা পালা গানের আসর কিন্তু দ্বিতীয় টি নাই। এই ঐতিহ্য রক্ষা পাক।
------------ ------------ ------------ ------------ ------------ সমাপ্ত।
গ্রন্থ সহায়তা। যাত্রা শিল্পের ইতিহাস। গৌরাঙ্গ প্রসাদ ঘোষ 

 ক্ষেত্র সমীক্ষা এবং অন্যান্য লেখা

দেবীর পূজা, হোম যজ্ঞ হচ্ছে। করছেন ডাঙ্গাল গ্রামের সুনামী  পণ্ডিত শিশির বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অন্যান্য রা।

এলেমবাজার নিলামবাজার ইলামবাজার

।। এলেমবাজার  নিলামবাজার ইলামবাজার।। 

 বাজারে এলাম গো। এলেমবাজার।। 
 এ বাজারে এলেমদার লোকেরা ঘোরাফেরা করে। 
 নীল, গালা, সুতীবস্ত্র, তসর, রেশমের নিলামের হাট বসে। 
 প্যারিসে আন্তর্জাতিক এক প্রদর্শনী তে ইলামবাজারের 
 গালার সামগ্রী প্রদর্শিত হচ্ছে। মন্তব্যে বলা হচ্ছে " হস্তশিল্পের চমৎকার নমুনা " 
 আরস্কাইন সাহেবের কুঠিবাড়ি তে জয়দেব কেন্দুলী যাওয়ার পথে ফরাসি পণ্ডিত সিলভা লেভী এবং তাঁর স্ত্রী মাদাম লেভী 
এক রাত্রির বিশ্রাম নিচ্ছেন। 
 আচার্য্য নন্দলাল গোরুগাড়িতে চেপে ছাত্রদের নিয়ে বনকাটির পিতলের রথ দেখতে আসছেন। 
 শিল্পী মুকুল দে গোরুগাড়ি চেপে মৌখিরা যাবার পথে ইলামবাজার এর টেরাকোটা মন্দির, আরস্কাইন সাহেবের 
 সমাধিস্থলের ছবি তুলে নিচ্ছেন। 
 ব্রতচারী প্রবর্তক তৎকালীন বীরভূমের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট 
 গুরুসদয় দত্ত ইলামবাজারে একটি দাতব্য চিকিৎসালয় 
 উদ্বোধন করছেন। 
 এছাড়া, সুরুলের চীপ সাহেব, সুরুলের বিখ্যাত সরকার বাড়ি, 
রায়পুরের সিংহ বাবুদের কথা 

আরও অনেক অনেক কথা, অনেক তথ্য 
ছোট্ট এই বই টি তে আছে। 
আমি জানিনা ইলামবাজারের কত জন বন্ধু আমার এই বইটি সংগ্রহ করে পড়ে দেখলেন। আশা করি খারাপ লাগবে না। 
 পড়েই দেখুন। 
ইলামবাজার এ অনেক বন্ধু। আমার অনেক ছাত্র ছাত্রী। 
 প্রথম সংস্করণ শেষ হয়ে গেলে দ্বিতীয় সংস্করণ টি বর্ধিত আকারে করার চেষ্টা আছে। 
 আপনাদের সহযোগিতা কাম্য। 
 আমি মাত্র পাঁচ টি বই পেয়েছি। সৌজন্য সংখ্যা। এত বন্ধু কাদের দিই! 
 বন্ধুদের উদ্দেশ্যে ই এই বই উৎসর্গ করেছি। 

আমার কাজের ক্ষেত্র অজয়ের এপার আর ওপার। ইলামবাজার আমার  দ্বিতীয় ঘরের মতো। 
বই টিতে এপারেরও  কথা কম নেই। বনকাটি, মৌখিরা, কালিকাপুর তো আছেই। আরও আছে। 

বই টি র পরিবেশক অক্ষরযাত্রা প্রকাশনী র আনন্দগোপাল হালদার। তাঁকে ফোনে অর্ডার দিলেই বাড়িতে বসে বই পেয়ে যাবেন।আমি দায়িত্ব নিয়ে বলছি। 
 তাঁর নম্বর  9474907307।
দাম মাত্র। ২০০/ টাকা। পেপারব্যাক দাম কম রাখার জন্য 
ইলামবাজারে জয়দুর্গা লাইব্রেরি তে ও সম্ভবত এসেছে। খোঁজ নিন।

ইলামবাজার ঃ পাঠপ্রতিক্রিয়া

ইলামবাজার। 
আমার জীবনের অনেক খানি জুড়ে। তাই ইলামবাজার কেন্দ্রিক একটা বই হোক এ ইচ্ছা আজকের নয়। 
 সেই কোন বালকবেলায় খুঁজে পেয়েছিলাম আরস্কাইন সাহেবের ভগ্ন কুঠিবাড়ি আর তাঁর পরিবারের সমাধিস্থল। 
  সেই বয়সেই আমাকে ভাবিয়েছিল 
 " কোথায় জন্ম আর কোথায় মৃত্যু "
 প্রায়ই সেই সমাধিস্থলে যেতাম। বসে থাকতাম। 
 ব্রাহ্মণ পাড়ার মন্দিরগুলোর টেরাকোটা কাজ গুলো র দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতাম। 
 গৌরাঙ্গ মন্দির এর কাজ দেখতে দেখতে হাট 
 করতে ভুলে যেতাম। 
  ঐ সমাধিক্ষেত্র, ভগ্ন দালান, মন্দিরের সামনে এলে আমার মনে হত ইতিহাস এর মুখোমুখি হয়েছি। 
 সেই ইতিহাস এর কিছুটা আছে  
 আমার বই ' এলেমবাজার নীলামবাজার ইলামবাজার "। 
 এবারেই কলকাতা বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে। 
আপনারা সহযোগিতা করলে পরবর্তী সংস্করণ টি আরও শোভন, সুন্দর, বর্ধিত আকারে করতে পারব। 
 পরিবেশক  ঃ অক্ষরযাত্রা প্রকাশনী , কলাবতী মুদ্রা র পক্ষে    আনন্দগোপাল হালদার কে ফোন করুন। নিজের কপির অর্ডার দিন। বাড়িতে বসেই বই টি পাবেন।* * ফোন নং  9474907307  *
বন্ধুদের সহযোগিতা কামনা করি।

পুনঃ। কিছু কপি আনানোর চেষ্টা করছি। 
তেপান্তর নাট্য গ্রাম থেকেই পাওয়া যাবে।

মাননীয়া Suchandra Chakravarty এই বই পড়ে 
তাঁর পাঠপ্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তাঁকে আমার  ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি 

শ্রদ্ধেয় প্রণববাবু, আপনার  সুস্থতা কামনা করি । গতকাল আপনার বইটি পেয়েছি এবং আগাগোড়া পড়েছি। অত্যন্ত সুখপাঠ্য আর আবেগপ্রবণ লেখা। ঐ অঞ্চলের মাটির প্রতি আপনার টান, আর imaginative sympathy আপনার ইতিহাস চর্চাকে উদ্বুদ্ধ করেছে। Hunter, O'Malley, Birbhum Bibaran, সব আমার পড়া থাকলেও আপনার লেখনীতে আবার সরস প্রাণ পেয়েছে ঐসব ইতিহাস। সাধারণ পাঠকের কাছে এরকম গল্পচ্ছলে ইতিহাস জানা খুবই আকর্ষণীয়। আপনাকে এইজন্য অভিনন্দন জানাই। 
ইতিহাস ছাড়াও, আপনি কথায় ছবি আঁকেন। তাই ইলামবাজারের হাটের ও সেখানের গৌরাঙ্গ মন্দিরের বর্ণনা পড়ে আমার নিজের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মেলাতে অসুবিধা হয়নি। দেড় বছর আগে গিয়েছিলাম। ইস্ তখন যদি আপনার সঙ্গে যোগাযোগ হত! আরও চল্লিশ বছর আগেকার স্মৃতি উঠে এলো আপনার লেখায় শ্রীনিকেতনের কাছে নীলকুঠির ভগ্নাবশেষের কথা পড়ে। আজ কেউ ঐ 'নীলসাহেবের কুঠী'র হদিস ও জানেনা।

আরস্কাইন সাহেবের সমাধি ক্ষেত্রে র ছবি তুলেছিলেন প্রখ্যাত শিল্পী মুকুল দে। এই ছবি ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছেন শ্রী সত্যশ্রী উকিল দা। তাঁকে ধন্যবাদ জানাই

এলেমবাজার নিলামবাজার ইলামবাজার । পাঠ প্রতিক্রিয়া

মাননীয়া Suchandra Chakravarty  মহাশয়ার
পাঠপ্রতিক্রিয়া
আমার " এলেমবাজার নিলামবাজার ইলামবাজার " বই টি পড়ে। তাঁকে আমার ধন্যবাদ জানাই। 

Pranab Bhattacharya is a familiar name to terracotta enthusiasts and those interested in the regional histories of West Bengal, particularly around Birbhum. This recently published book is an easy and interesting read, particularly for those who wish to have an introduction to the local history of the Ilambazar area near Shantiniketan. It's a collection of essays that has already appeared in other  journals. Pranabbabu has gleaned his facts largely from Hunter, O'Malley, and older local histories such as Birbhum Bibaran. What draws the reader to this slim book is the manner in which the  older histories have been  retold with a lively passion for the place and its past. He has the engaging ability of a good story teller which enables one to excuse certain editorial lapses. I read the book in one sitting ( it's not long) in spite of being familiar with all the source documents that he has cited, which speaks volumes for his ability to paint word pictures of edifices now lost to time, as well as the present environment . His description of the haat in Ilambazar took me straight back to my visit one and a half year ago; right down to the man selling earthen pots, one of which stands in my verandah. His mention of the ruins of the house of an indigo factor, which, years back locals used to refer to as 'neel shaheber kuthi' brought back memories of a visit more than forty years back. That ruin can no longer be seen and had it not been for this book, I might have believed that my memory had been playing tricks with me. 
I would definitely recommend this book to bengali reading enthusiasts new to this area and its rich heritage. The flow of goods and people along the Ajay river brought the world to its banks even before the world met in Tagore's Visva Bharati.

আমি বীরভূমের না কি বর্ধমানের

আমি থাকি অজয়ের দক্ষিণে। পশ্চিম বর্দ্ধমান জেলায়।  অজয়ই প্রাকৃতিক  সীমারেখা। উত্তরে বীরভূম। দক্ষিণে বর্ধমান। সেই কবেকার এই সীমারেখা। অজয়ের উত্তরে উত্তর রাঢ়। বজ্রভূমি, বীরভূমি - বীরভূম। ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী ১৮০৬ সালে অজয় কে  প্রাকৃতিক সীমারেখা হিসাবে গ্রহণ করে। 
ওপারে ইলামবাজার। বীরভূমের প্রবেশ দ্বার। 
আমাদের নিকটতম গঞ্জ। এপার ওপারের  নিত্য যাতায়াত। সীমান্তের এই অংশের মানুষ দের বরাবরের টান ওপারের প্রতি। পানাগড়, দুর্গাপুর
যাওয়া অপেক্ষা বোলপুর যাওয়ার প্রতি একটা প্রবণতা কাজ করে। এই এলাকার অনেক সম্পন্ন
মানুষ ওপারে চলে গেছেন। ইলামবাজার বা বোলপুরে স্থায়ী ভাবে বসবাস করছেন। 
আমারও ইচ্ছা ছিল।কিন্তু নানা কারণে হয়নি।  ইলামবাজার হাইস্কুলে পড়েছি। 
কিছুদিন পড়িয়েছি। বোলপুর কলেজে পড়েছি। 
সামাজিক, সাংস্কৃতিক নানা কর্মকাণ্ডে বীরভূমে
অনেক গুলি বছর কাটিয়েছি। বীরভূমের প্রতি 
আলাদা এক ভালোবাসা কাজ করে। সেই ভালোবাসা থেকে ই আমার সামান্য বীরভূম চর্চা। 
আমার লেখালেখির বড় অংশ জুড়েই বীরভূম। 
তাই প্রথম বই টি করতে পেরেছি ইলামবাজার কে কেন্দ্র করেই।  কুঠিবাড়ি ভিত্তিক ব্যবসা বাণিজ্য। 
এবং ইলামবাজারের কথা ও কাহিনী। 
অন্যান্য যে সব লেখা এই সমাজমাধ্যমে, ফেসবুক পেজে বা ব্লগে রয়েছে বা নানা পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে সেই সব লেখা একত্রিত করার ইচ্ছা  আছে। ইচ্ছা ই - বুক করার ও। আমি চাই আমার সব লেখা সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিতে। 
কিনে বই খুব কম জনেই পড়ে। আমার ধারণা আগামী তে মানুষ এখানেই পড়ে নিতে চাইবে। 
 কিন্তু বইমেলায় বেশ ভিড় হয়। বই এর একটা আলাদা মূল্য আছে অস্বীকার করিনা। বই, বই ই। 
তবু অনেক কথা আছে। আমার যা অভিজ্ঞতা সে না হয় আরেক দিন বলা যাবে। 
আজ বীরভূম বিষয়ক লেখালেখির একটা  তালিকা। 
**বীরভূমের লোহা মহল 
**মুলুটির মন্দির রাজি, 
**গণপুরের মন্দির, ' ফুলপাথরের মহাকাব্য'
**মল্লারপুর 
**রাজনগর কথা 
**রসা - বড়রা র প্রস্তর দেউল 
**বীরভূমের বৈচিত্র্যময় মন্দির 
**দুবরাজপুর কথা ও কাহিনী 
**দুবরাজপুরের মন্দির 
**হেতমপুর কাহিনী। চন্দ্রনাথ মন্দির। রাজবাড়ি 
**কোটা - শীর্ষা 
**টিকরবেতার পিতল শিল্পের কথা 
**জয়দেব কেন্দুলী নিয়ে নানা লেখা 
**রাধাবিনোদ মন্দির। মোহান্ত অস্থল এর পিতলের রথ, গীতগোবিন্দম এর জয়দেব 
মানুষ জয়দেবের খোঁজে 
**ধর্মমঙ্গলের অন্যতম কবি নরসিংহ বসুএবং তাঁর  রাজনগর যোগ। 
**১৬৩৩ সালে নির্মিত ঘুড়িষার রঘুনাথজীর মন্দির এবং ১৬৩১ সালে মাসড়া গ্রামে তৈরি মন্দির। একটি তুলনামূলক আলোচনা। 
**ঘুড়িষা গ্রামের দুই বিখ্যাত মন্দির 
**ইলামবাজার। গঞ্জ ইলামবাজার কথা। 
**ইলামবাজারের মন্দির 
**ইলামবাজার কেন্দ্রিক নানা বিধ লেখা। 
**'তুলাপট্টিতে আর বসেনা নীলামের হাট '
**আনন্দবাজার পত্রিকায় বড় প্রবন্ধ। 
**সুরুল, রাইপুর, আদমপুর, চন্দনপুর, মির্জাপুর, সুপুর, ইটাণ্ডা নিয়ে নানা লেখা এবং ছবি। 
**এছাড়াও যেখানের সম্বন্ধে হয়তো লেখা হয়নি সেখানের মন্দির টেরাকোটার ছবি। 
** জয়দেব কেন্দুলী কে নিয়ে এবং অন্যান্য বিষয় নিয়ে আকাশবাণী কলকাতায় তিনবার বলেছি। 
** ইলামবাজার এবং এপার ওপার এর দুই টি পিতলের রথ নিয়ে আকাশবাণী শান্তিনিকেতনে কয়েকবার বলেছি। 
মনে হতে পারে নিজের ঢাক নিজেই পেটাচ্ছি। কিন্তু না। এই লেখাএক বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়েই লিখেছি। 
বীরভূমের বিশিষ্ট বন্ধুদের ট্যাগ করেছি। 

** আপনারা জানেন মন্দির টেরাকোটা আমার অন্যতম প্রিয় বিষয়। বনকাটির মন্দির এবং ইলামবাজারের মন্দির দেখেই সেই বালক বয়সেই এই ভালোবাসার উন্মেষ। 
যেমন ইলামবাজারের আরস্কাইন সাহেবের কুঠিবাড়ির ভগ্নাবশেষ বা তাঁদের পরিবারের সমাধি ক্ষেত্র থেকেই,নীল ও গালা শিল্পের একদা বিখ্যাত কেন্দ্র সেই প্রাচীণ ইলামবাজার কে খোঁজা। **ইলামবাজারের চারপাশ কে খোঁজা। যেমন ঊষহর, ধল্লা, দ্বারোন্দা, দেউলী, ইত্যাদি স্থান সম্পর্কে লেখা। 
এখনকার এই মাধ্যমের সুবিধা হচ্ছে 
দৃশ্য শ্রাব্য মাধ্যম। এখানে আছি দীর্ঘদিন। কয়েক হাজার ছবি নষ্ট হয়ে গেলেও, এখনও আছে কয়েক হাজার। 
বিরাট বিস্তৃত ক্ষেত্র নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে আমার সীমাবদ্ধতার কথা মাথায় রেখেই আমি নির্দিষ্ট একটা ভৌগোলিক এলাকার মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ রাখতে চেয়েছি। 
**প্রাচীণ গোপভূমের অন্তর্ভুক্ত পরগণা সেনপাহাড়ী এবং বীরভূমের সেনভূম তথা 
অজয় তীরের দুপারের মানুষের জীবন কথা। 
আমার সীমিত সামর্থে এই কাজটুকুই মাত্র করতে পেরেছি। 
**আমার কোন উচ্চাভিলাষ নাই। আমি সামান্য এক আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চাকারী। ক্ষেত্রসমীক্ষক। কোন স্থান নিজের চোখে না দেখে, আমি কোন লেখা লিখিনা। 
আমি কোন 'মুখ' নই। যেমন " বীরভূমের মুখ "। কি "পুরুলিয়ার মুখ " বা "বাঁকুড়ার মুখ "। সে সামর্থ্য নেই। অনেক জ্ঞানী, পণ্ডিত, বিদগ্ধ লেখক  জনেরা আছেন। 
আমি আঞ্চলিক ইতিহাসের  গল্পকার, কথাকার। সমাজমাধ্যমের বন্ধুরা বলেছেন " সেনপাহাড়ীর কথাকার"
কেউ " সেনপাহাড়ীর কথক ঠাকুর " 
কেউ " জঙ্গলমহলের কথাকার "
এই রকম নানা অভিধা। যথেষ্ট। 
বাইরের বন্ধুরা জানেন আমি বীরভূমের। 
বীরভূম কি জানে কি জানি! 

যে সব সংকলন গ্রন্থে আমার বীরভূম বিষয়ক প্রবন্ধ গুলি প্রকাশিত হয়েছে 
তার একটা তালিকা যদি পারি, দেব। 
আপনাদের জ্ঞাতার্থে।  কিছু কাজ তো করেছি। ভবিষ্যৎ ই বলবে। 
অনেক ধন্যবাদ। নমস্কার। 
বীরভূমের অনেক বন্ধুকে ট্যাগ করেছিলাম। 
কেউ কোন সাড়াশব্দ দেননি। 
------------ ------------ ------------ ------------ ©  প্রণব ভট্টাচার্য। 
** ইলামবাজার কেন্দ্রিক আমার ছোট্ট বই টি র 
 নাম " এলেমবাজার নিলামবাজার ইলামবাজার "
দাম মাত্র ২০০/ টাকা। বন্ধুরা ঘরে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন। পরিবেশক অক্ষরযাত্রা প্রকাশনী র আনন্দ গোপাল হালদার। ফোন নং 9474907307. ফোনে অর্ডার দিলেই হল। 
------------ ------------ ------------ ------------ 
আমাকে ফেসবুকে ই পাবেন। অনুরোধ না জানালে কোথাও লিখিনা। ফেসবুক পেজে শুধু রিলের ভীড়। ওখানে লেখা কেউ পড়েননা। 
বাংলা ব্লগের তেমন চাহিদা নাই। তবুও একটা ব্লগ আছে। 
https:// matirpradip.blogspot.com 
ফেসবুক পেজ। Pranab's canvas 
ইউ টিউব চ্যানেল খুলেছিলাম। চালাতে পারিনি। 
এই। 
------------ ------------ ------------ ------------ ----
" ভ্রমি বীরভূমের পথে  - এই রকমের নাম দিয়ে শুধু বীরভূম নিয়ে একটা বই করার ইচ্ছা। 
কোন প্রকাশক এগিয়ে আসবেন! 
------------ ------------ ------------ ------------ ------------

দুই দিদির গল্প

।। দুই দিদির গল্প।।
  কথা ও কাহিনী। ৷ ৷ প্রণব ভট্টাচার্য

  ভাবুন তো একবার। কোথায় রংপুর  আর কোথায় রাণীগঞ্জ।
  এখন কার বাংলাদেশের রংপুর। আর পশ্চিম বর্ধমানের কয়লাক্ষেত্র রাণীগঞ্জ। রংপুর থেকে রাণীগঞ্জ । এক কিশোরী বৌ হয়ে এলেন এখানকার এক গ্রামে। গ্রামের নাম সাতগ্রাম।
চারপাশে তার ছয়টি গ্রাম। মাঝে সে সাতগ্রাম। সেই সাতগ্রামের চ্যাটার্জি পরিবার। নামী দামী পরিবার। কয়লাকুঠি র কেউ ম্যানেজার তো কেউ খাজাঞ্চি। কেউ বড়বাবু। কোম্পানির বিশ্বস্ত সব লোক। তাঁদের হাতে পরিচালনার অনেক খানি। তখন কয়লা ব্যবসা খুব জনপ্রিয় হয়ে গেছে।
এখান থেকে নদী পথে সে কয়লা যায় পাবনা রংপুর।
জমিদার বাবু র কয়লা ব্যবসা। তার ম্যানেজার আমাদের এই রংপুর এর দিদির বাবা। দাদারা তাঁর সব জমিদারী ফেরেস্তায়
কাজ করে। একজন তো তখনকার আসানসোলে বাসা বেঁধেছেন। সাতগ্রামের বাবুদের সাথে ব্যবসার সূত্রেই আলাপ
যোগাযোগ। কেননা তাঁদের হাতে কয়লা পাবার কাগজ।
   বুদ্ধি খেলে যায় রংপুরের দিদির দাদার। এই চ্যাটার্জি বাড়িতে যদি বোনের বিয়ে দেওয়া যায়। কেমন হয়। এঁরা কি রাজি হবেন!  দেখাই যাক। প্রস্তাব টা পাড়া ই যাক না কেন।
সেই প্রস্তাব নিয়ে একদিন বাড়ির কর্তার নিকট একদিন এলেন তিনি। প্রস্তাব শুনে কর্তা মশাই কিছুক্ষণ চুপ করে থাকবার পর  মেয়ে দেখতে রাজি হয়ে গেলেন।
সে মেয়ে কে আত্মীয় স্বজন সমেত আনানো হল আসান সোলের বাসায়। সেখানেই মেয়ে দেখার ব্যবস্থা হল। 
  মেয়ে তো দেখতে চমৎকার সুন্দরী। নানা গুণসম্পন্না।
  খুব ভালো রান্না জানে। হাতের কাজ জানে নানা রকমের।
কিছুটা লেখাপড়া ও জানে।
এই পরিবার সম্বন্ধে  রংপুরের জমিদার বাবুর সপ্রশংস  চিঠি।
   তখন ছেলেদের আর মেয়ে দেখার চল ছিলনা। তবু এখানে
ছেলে মেয়ে দেখে এলো বন্ধুবান্ধব দের নিয়ে। অপছন্দের কিছু নাই।
তারপর একদিন শুভক্ষণে  চার হাত এক হল। অগ্নি সাক্ষী করে। মহা ধূমধাম। সাতগ্রামের চ্যাটার্জি বাড়িতে মহা আয়োজন। গোরু গাড়িতে রাণীগঞ্জের বাজার থেকে মাল আসছে তো আসছে। আত্মীয় স্বজন ; কনে যাত্রী সব গোরু গাড়িতে। যেন গোরুগাড়ি র মেলা বসে গেল " রাজপুত বাড়ির ডাঙ্গায় "।
একা এই বোন নয়। এর পরপর তাঁর কয়েকজন জন বোন এসেছেন এই চ্যাটার্জি বাড়িতে। কয়েক বছরের ব্যবধানে।
  আমি ভাবি এখনও পাত্র পাত্রী বিজ্ঞাপনে থাকে রাঢ়ী য় পাত্র
রাঢ়ী য় কন্যা চাই। বারেন্দ্রী হলে চলবে না।
আর আজ থেকে কত বছর আগে। একশো বছরে র ও আগে।  তখন দুই পরিবারের মধ্যে এই প্রশ্ন তো ওঠেনি।
কে মেলালো। কিসে মিলল। এ যেন বিবাহ রাজনীতি। রাষ্ট্র নৈতিক বা কূটনৈতিক। এখানে মেলালো ব্যবসায়িক বুদ্ধি।
পরবর্তীতে দু ই পরিবারের ভীষণ ভাবে আর্থিক সমৃদ্ধি গড়ে ওঠার ইতিহাস। 

।।দুই দিদির গল্প।।  কথা ও কাহিনী। দ্বিতীয় গল্প 

  কোথায় বরানগর আর কোথায় বনকাটি।
  বন কেটে বসত শুরু কবে থেকে তা বলা সম্ভব নয়।
   প্রাচীন ' গোপভূম ' এর সেনপাহাড়ী পরগনার জঙ্গল মহলের
  একটি গ্রাম।। একেবারে ' গড় জঙ্গলের ' গায়ে গা লাগিয়ে এই গ্রাম। ' ইছাইঘোষ এর দেউলে ' চূড়া দেখা যায় গ্রামের পশ্চিম প্রান্তের উঁচু মোরাম চাতাল থেকে।
  গড় জঙ্গল। নামের ভিতরে ই " গড়' ভরা। সে ছিল একদিন।
জঙ্গলের ভিতরে ছিল গড়। পাল রাজাদের অধীনে সে গড়ের
অধিপতি ছিলেন। কর্ণসেন।  সেই সেন কে অতর্কিত আক্রমণ করে গড় দখল করে নেন ইছাই ঘোষ। এ গড়ের অনেক নাম
ঢেকুর গড় ; ত্রিষষ্ঠীগড়। দেবী শ্যামারূপা ইছাই এর আরাধ্যা দেবী। তাঁর বরে ইছাই অপ্রতিরোধ্য। ধধর্মমঙ্গল এর কাহিনী তে তাকে আমরা পাব। লাউসেন ইছাই যুদ্ধকথা। দ্বিতীয় বারের যুদ্ধে ইছাই পরাজিত এবং নিহত হন। তিনি তখন বৃদ্ধ।
আবার এই জঙ্গলের মধ্যে ইংরেজ দের আক্রমণ থেকে বাঁচতে  কেল্লা বানিয়েছিলেন বর্ধমানের রাজা চিত্র সেন।
  সে অনেক কথা। পাশেই বয়ে চলেছে অজাবতী ; অজি ; মানে অজয়। অজয়ের ওপারে বীরভূম। লোককথা এখানেই না কি কবি জয়দেব এর সাথে রাজা লক্ষ্মণ সেনের সাক্ষাৎকার ঘটেছিল। ' দেহী পদ পল্লব মুদারম ' এর  কবি তাঁর কাব্য' গীতগোবিন্দম' রচনা করেছিলেন রাজা লক্ষ্মণ সেনের অনুরোধে।
বাংলার সেন রাজাদের পূর্বপুরুষ রা কর্ণাট দেশ থেকে এদেশে এসে এখানেই না কি প্রথম তাঁদের বাসস্থান স্থির করেছিলেন।
এমন মত পণ্ডিত প্রবর সুকুমার সেন সহ আরও অনেকের।
তাই পরগণা র নাম সেনপাহাড়ী। আজও চালু মোগল আমলের পরগণা সেনপাহাড়ী।
 এই জঙ্গল মহল এলাকার অযোধ্যা - বনকাটি এলাকা।
চারপাশে নানা ছোট বড় গ্রাম। আর সব গ্রামেই রয়েছে বাগদি ; বাউরী ; ডোম ; মুচি ; খয়রা ; খাঁড়াত  আর হাঁড়ি দের
পাড়া। তারাই পাহারা দিচ্ছে গোটা জঙ্গল মহল।
সেই ইছাই ঘোষের আমল থেকে। সবাই ছিল তাঁর সৈন্য বাহিনী তে। সেনপাহাড়ীর  ডোম ; হাঁড়ি বা মুচি রা দুর্ধর্ষ। রক্তে তাদের আজও সেদিনের যুদ্ধের উন্মাদনা।
  আমাদের এই বনকাটির বাবুরা মানে রায় বাবু ; মুখোপাধ্যায় ; চট্টোপাধ্যায় বাবুরা সব মিলে মিশে পাশাপাশি থেকে একসাথে ব্যবসা করেন। যেন বারো ঘর এক উঠোন। নিশ্চয়ই ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল। তবে নানা পরিবার নানা রকমের ব্যবসা করেন। 
প্রাচীণ সব বৃক্ষে ঘেরা। তপোবনের মতো।   জমজমাট ব্যবসা তাদের।
ওপারে ইংরেজ সাহেব দের কুঠিবাড়ি। ইলামবাজার তখন
গঞ্জ। লাক্ষা বা গালা ; নীল ; সুতী বস্ত্রের নীলামের বাজার।
  বাণিজ্য কেন্দ্র। ডেভিড  আরস্কিন  সাহেবের বিরাট কুঠিবাড়ি। ফরাসি দের কুঠিবাড়ি। তাঁদের সাথে এদেশীয়
সম্পন্ন মানুষেরা ভালো ব্যবসা করছেন। প্রচণ্ড ধনী হয়ে উঠছেন তাঁরা।
আমাদের বনকাটি র বাবুরা ইংরেজ দের কুঠিবাড়ি র সাথে ব্যবসা আবার স্বাধীন ভাবে ব্যবসা করেন।
  লাক্ষা বা গালা ; নানা বনজ দ্রব্য ; আর কাঠ কয়লা ; এবং কয়লা র ব্যবসা। অজয়ের জলপথেই  তখন ব্যবসা চলে।
ব্যবসায় মুখোপাধ্যায় বাবুরা সবাই কে ছাপিয়ে যাচ্ছেন। কলকাতায় ব্যবসা করেন। মাল আমদানি রপ্তানির। আবার পাইকারি ব্যবসার। 
অন্যেরাও কম কিছু না। বানাচ্ছেন নিজেদের সুরক্ষার জন্য
উপযুক্ত প্রাসাদ। ভূগর্ভস্থ কক্ষতো আছেই। রায় পরিবার  বানাচ্ছেন শিবমন্দির। ১৭০৪ শকাব্দে প্রথম। বিষ্ণু দালান ; দুর্গা দালান।
একই প্রাঙ্গনে পনেরো টি মন্দির। ১৭৫৪ ; ১৭৫৬-৫৭ শকাব্দে নির্মিত।
  মুখোপাধ্যায় বাবুরা শোনা যায় একদিনের ব্যবসার আয়ে
বানিয়েছিলেন বিখ্যাত পিতলের রথ। ১২৪২ বঙ্গাব্দে। যার গায়ের অলংকরণ
নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস হবেনা। তার আগে বানিয়েছেন
অপুর্ব টেরাকোটা অলংকরণ যুক্ত বিখ্যাত পঞ্চরত্ন শিবমন্দির। ১৭৫৪ শকাব্দে।  চট্টোপাধ্যায় পরিবারের বিরাট দালান। শিবমন্দির। রায় কালীবাড়ি খুবই বিখ্যাত। দ্বিতল বিষ্ণুমন্দির। দুর্গাদালান। ১৭৫৬-৫৭ তে পাশাপাশি তিনটি দেউল শিবমন্দির। কোন এক  শুভ দিনে
বরানগর থেকে এক কিশোরী বৌ হয়ে এলেন এই বনকাটি তে। যেখানে সন্ধ্যা নামলে চারদিক আলো করার জন্য মশাল জ্বালায় পাহারাদার রা। পাশেই পাষাণ চণ্ডী তলার আমবাগান।
তার পাশেই গড় জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসা " রক্তনালা "গড়ঘাটা " হয়ে বয়ে মিশে যাচ্ছে অজয়ে। এই নালা দিয়ে ছোট নৌকোয় মাল চলাচল করে। রাতে শিয়াল আর গো বাঘা দের ডাক। এদিকে ওদিকে চন্দ্রবোরাদের আনাগোনা। রাতে অজানা শিস ঘণ বাঁশ বাগানে। প্রাচীন সব তালের ডগায় শকুন ছানার ডাক। তেমনি লম্বা খেজুর গাছ গুলো। আর  বিশাল চাকলতা বা খেলকদম। কত টিয়া, চন্দনা যে থাকে সেখানে। 
তালগাছের মাথায় থাকে শকুনেরা। তাদের ছানারা কাঁদে 
ঠিক মানুষের বাচ্চার মতোই। এই সেই বনকাটি।
কোথায় বরানগর আর কোথায় এই বনকাটি।
বাবুরা তো স্বাধীন ভাবে কলকাতা র বানিজ্যিক হৌস গুলির
সাথে ব্যবসা করেন। নিশ্চিত ভাবেই সেই সুত্রেই মেয়ের বাবার আলাপ এখানকার বাবুদের সাথে। ব্যবসার জন্য জাহাজ ঘাটা থেকে শুরু করে অনেকে দালালী করে ও অনেক পয়সা করেছেন। কলকাতা র বাজারের হালচাল জানার জন্য ;
বিদেশী জাহাজে ভালো খদ্দের ধরতে পারলেই হল।
তার জন্য তাঁদের কে নিয়োগ করতেই হত।
  এই ব্যবসার সুত্রেই আলাপ মেয়ের বাবার সাথে চট্টোপাধ্যায় পরিবারের কর্তার। এই ঘরে মেয়ে যাবে। সে আর বলতে।
  যোগাযোগ। দেখাশোনা। অনুমান করে নিতেই পারি।
  তারপর একদিন বিয়ে।
কেউ তাঁর নাম জানে না। বরানগর এর দিদি। দিদি মানে দিদিমার ও দিদিমা। সে কি আর আজকের কথা।
কি তাঁর স্মৃতি। শোনা যায় তাঁর স্বামীর অকাল মৃত্যু র পর
তিনি বানিয়েছিলেন মুখোমুখি দুটি শিবমন্দির। টেরাকোটা য় মোড়া ছিল সে মন্দির দ্বয়। তাকে সম্পূর্ণ বিনষ্ট করা হয়েছে।
  কিন্তু নিশীথ রাত্রে মুখোমুখি যেন কথা বলে দুই মন্দির।
   এ তাকিয়ে আছে ওর পানে।
 হু হু বাতাস বয়। সেই বাতাসে মিশে থাকে সেদিনের স্মৃতি।
----------- ----------- ----------- ----------- ----------- ২ পাতা শেষ।
  সমাপ্ত।
লেখক। প্রণব ভট্টাচার্য। সেনপাহাড়ী পরগনার আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চাকারী। অনেকে বলেন " সেনপাহাড়ী র কথাকার "

** চট্টোপাধ্যায় পরিবারের ভগ্ন দালান বাড়ি। 
মন্দিরের ছবি পেলাম না এখন।

রেডিও ঃ স্মৃতি চারণ

।।  রেডিও  ঃ  স্মৃতিচারণ।।     প্রণব ভট্টাচার্য

ভোর    ভোর হয়ে জেগে ওঠে  বীরেন্দ্রকৃষ্ণের কণ্ঠে
পবিত্র সকাল   শুদ্ধ স্মরণ  তর্পণ। 
তাহার নামটি রঞ্জনা  সেই মায়াময় দুই কণ্ঠ। 
অজিতেশের  মধুসূদন  গোপাল অতি সুবোধ বালক
জীবনকে ভরিয়ে দিত  শান্তি বারি সিঞ্চনে। 
রেডিও নাটকের স্বর্ণ সম্ভারে ধনী  আকাশবাণী কলকাতা। 
  ভোলা অসম্ভব তাই ভোলা যায়নি। 
মুক্তিযুদ্ধে  ওপার বাংলার মরণপণ লড়াই
এপার থেকে প্রেরণা জোগায় দেবদুলালের ভাষ্য। 
  আমি ইডেন থেকে বলছি   যেন হাইকোর্ট প্রান্ত দৃষ্টি পথে
   ভেসে ওঠে  অজয় বসু    কমল বাবু দের  ধারাবিবরণী তে। 
   গানের ভুবন ভরা  রাগে অনুরাগে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের রাতে। 
   প্রকৃত পরিবেশনে  সংবাদে ছিল সিদ্ধ সার্থকতা। 
    এখানেই ছিল মানুষের আস্থা। রেডিও।
   আকাশবাণী। আকাশবীণার ঝংকার
   ছিল তো সবই  ভবন টি ও দণ্ডায়মান। 
    কিন্তু আর আমাদের ঘরে ঘরে
  মারফি ; ফিলিপস ; বুশ  দের সেট কবেই আবর্জনা
   আর কত ছিল  সন্তোষ  ইত্যাদি
   আমাদেরও বাড়িতেও অবশেষে একটা সেট এসেছিল। 
   সে টা দাদু কিছুতেই অন্যকে হাত দিতেই দিতনা। 
   একটা অবলম্বন হয়ে উঠেছিল কবে যেন
   ভালো যা কিছু শোনা   ভালোকে চিনতে শেখা
   শ্রবণ আনন্দ প্রক্রিয়া   তার প্রসাদ গুনের আস্বাদন
   যদিও তা ব্যক্তিগত অনুভব সঞ্জাত
   গরমের উঠোনে আমরা সবাই চাটাই পেতে বসে
   একসাথেই শুনতাম। 

বোলপুরের স্টেশন রোড ধরে হেঁটে যাওয়া কলেজ ছেলেরা
এক দোকান থেকে আর এক দোকানে  টেস্ট ম্যাচের স্কোর
জানতে জানতে কলেজ পৌঁছানো
কেউ স্কোর জানাতে বিরক্ত হতনা কিন্তু সে সময়

  আমাদের এই পাড়া গাঁয়ে রেডিও সে তো এক বিরাট ব্যাপার। 
বটূ কোঁড়া কি করে যে অসাধ্য সাধন করেছিল
  ফিলিপসের একটা টাইগার সেট কিনে
  কাঁধে ক্রশ করে ঝোলানো বাজাতে বাজাতে
  গ্রাম ঘুরতে বেরুত      -  'শোন হে সবে
  দ্যাখো কিনেছি আমি ' । এই ই আমার সব।
  সবাই জানে সে একা। বৌ মরে গেছে। ছেলেপুলে নাই
  সারাদিন রাত বাজত তার উঠোনের 
নারকেল গাছে পোঁতা  পেরেকের আঁংটা থেকে
  - এই নে শোন গোটা পাড়া '
কোন কিছু তার বাদ নাই কৃষি কথা কি আদিবাসী গান
দিন শুরু হত তার রেডিও তে  
রাতের আকাশের তারা দেখতে দেখতে
ঘুম না আসা পর্যন্ত ।  ঘুম আসা তো সহজ নয়
পেট পুরে তাল তাড়ি খেলে তবে কিছুটা হয়। 

নিজেকে শেষ করবই  বললে তো আর কিছু
করার থাকেনা। প্রণোদিত আত্মহত্যা করেছে
আমাদের রেডিও   আকাশবাণী কলকাতা কে
ধরা আমাদের সম্ভব নয়     না হয় দেড়শ  মাইল দূর
আকাশবাণী শান্তিনিকেতন  এই সেদিন ও কি সুন্দর
আনন্দধারায় গান শোনাতো   সে হারানো সুখস্মৃতি
বাঙলা গানের ক্রমবিবর্তন টা কে গান দিয়েই ধরুন না
জ্ঞান প্রকাশ ঘোষ বা বিমান মুখোপাধ্যায় 
এর মতো মাপের 

সঙ্গীত গুণী মানুষেরা যদি বুঝিয়ে দেন
শেখা হত  জানা হত   ঋদ্ধ হতাম
একবার এক আলাপচারিতায় বলেছিলাম
  এক আধিকারিক কে। সাথে ছিল সঞ্চালিকা অপরাজিতা।
  নিজেরও  সুখস্মৃতি  - এই আকাশ বাণী শান্তিনিকেতন
  থেকেই আঞ্চলিক ইতিহাস এর এক চর্চাকারী হিসাবে
  যখন বলেছি  আর পরিচিত জনেরা বলেছেন
আপনাকে শুনলাম রেডিও তে
সে এক অন্যরকম ভালোলাগা
চমৎকার বিষয় বাছেন সঞ্চালিকা অর্পিতা চট্টোপাধ্যায়।
  সে দিন বুঝি হারালো! হায়!
কিন্তু মানুষ যে আবার রেডিও তে ফিরতে চাইছেন
সারা পৃথিবী জুড়ে ই। 
দুর্যোগ বিপর্যয় মোকাবিলা য় রেডিও ই তো ভরসা।
  টিভি আজ দীন। প্রকট তার দৈনতা।
এতবড় বাংলাসাহিত্য। ব্রাত্য বাঙলা টিভি সিরিয়ালে।
সেখানে চলছে কর্তার ইচ্ছায় কর্ম নামক       অপকর্ম।
বাঙালী  রুচির নিম্নগামিতা ঘটানো হচ্ছে সুকৌশলে।
ভদ্রলোকেরা মুখ ফিরিয়েছেন অনেক দিনই
ঘরের মেয়ে বৌ রা আর কি করে! চোখ মেলে থাকে
  দেখে একটা মেয়েই রবিনহুড। একা সম্পূর্ণ একাই
সব সমস্যার সমাধান করে দিচ্ছে বাহান্ন জনের এক পরিবারের।
আবাসন গুলো তে বৃদ্ধ এক আর বৃদ্ধা। দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।

রেডিও কি আবার স্বমহিমায় ফিরতে চায়
প্রশ্ন তো নিজেকেই করতে হবে রেডিও কে
এখনও যাঁরা রেডিও কে ছাড়েন নি  বরং জড়িয়ে ধরে আছেন
তাঁদের কে তো আপনারা চেনেন না
তাঁদের কে চিনুন।
তাঁদের কথা শুনুন।
আকাশবাণী আবার বেজে উঠুক আমাদের ঘরে ঘরে।
কর্তারা ভাবুন রেডিও কে কি করে জনপ্রিয় করা যায় আবার। মতামত নিন গুণী জনদের। 
আমার ধারণা রেডিও বাঁচতে পারে তার পুরনো দিনকে অবলম্বন করেই। 
রেডিও শুনেই বড় হয়েছি। নিজের একটা ছোট সেট ছিল মার্ফি মিনি। বালিশের পাশে নিয়ে শুনেছি। 
ছোটবেলায় কলকাতা গেলে, আকাশবাণী ভবন টা আমাকে খুব টানত। যদি ভিতর টা ঘুরে দেখা যায়। কি ভাবে সব হচ্ছে! প্রবল কৌতুহল। 
কখনও ভাবিনি এই ভবনের ভিতরে যাব। 
এই বয়সে এসে আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চাকারী হিসেবে ডাক পেয়ে বড় আনন্দিত হয়েছি। 
ধন্যবাদ জানাই মাননীয় শ্রী সিদ্ধার্থ মাইতি বাবুকে। 
কয়েক বার ডাক পেয়েছি। হোক না ন মিনিটের কথিকা। বুঝেছি ন মিনিট সময় কম নয়।
আমার মনে হয় রেডিও কে আরও জনপ্রিয় করে তোলা যায়। ভাবতে হবে। হয়তো অনেকে মোবাইলেই শোনেন। আবার অনেকে পারেন না
অনেক বয়স্ক স্মৃতিকাতর মানুষ আছেন। 
তাঁদের জন্যই শোনান না যা কিছু আমাদের সম্পদ। আপনাদের ভাণ্ডারে আছে বিবিধ রতন। 

------------ ------------ ------------ ------------ ------------  সমাপ্ত।
লেখক। প্রণব ভট্টাচার্য। আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক। ক্ষেত্রসমীক্ষক। প্রাবন্ধিক।
গ্রাম। সাতকাহনিয়া। পোষ্ট। বনকাটি। ৭১৩১৪৮। থানা। কাঁকসা। জেলা। পশ্চিম বর্দ্ধমান। ফোন। ৮২৫০৭৬৭৫০৭।
#akashbanishantiniketan 
#akashbanikolokata
#akashbanimoitri
#prasarbharti

বীরভূম ঃ ধর্মসাধনার জাদুঘর। বৈচিত্র্যময় মন্দির রাজি

বীরভূম কে বলা হয় ' ধর্মসাধনার জাদুঘর "। নানা ধর্মীয় আন্দোলনের স্রোত বীরভূমের উপর দিয়ে বয়ে গেছে।  
 তৈরি হয়েছে নানা মন্দির মসজিদ। 
 সমগ্র রাঢ়বঙ্গ তো দূর গোটা বীরভূম কে আলোচনায় ধরা সম্ভব নয়। সংক্ষিপ্ত এক রূপরেখা তুলে ধরার চেষ্টা করছি। 
 জৈন ধর্ম বীরভূমের উপর নেমে এসেছে। কোন জৈন মন্দির এখানে যদিও নাই কিন্তু ছিল। ঘুড়িষা গ্রামে জৈন তীর্থঙ্কর সর্পছত্রধারী পার্শ্বনাথ জীর মূর্তি পথের ধারে পড়ে আছে। 
 গ্রামে রাস্তার পাশে পড়ে থাকা নানা জৈন মূর্তি ছোট বেলায় দেখেছি। ভগ্ন। ভাঙ্গা যে হয়েছে কঠিন আঘাতে তা পরিষ্কার বোঝা যায়। 
 জাতক কাহিনীতে সত্যতা যদি কিছু মাত্র থাকে তাহলে বলা যায় বুদ্ধদেব বীরভূমের উপর দিয়ে হেঁটে পুণ্ড্রবর্ধনে গিয়েছিলেন। ইলামবাজার নিকট বর্তী দেবীপুর গ্রামে 
 দেবী সুহ্মেশ্বরী র ভগ্ন মূর্তির পাদদেশে খোদিত ছিল 
 " যে ধর্মের  হেতু হইতে উৎপত্তি, ------------  " যে ধর্ম্মা  হেতু 
 প্রভবা হেতুং তেষাং তথাগতহ্যবদৎ। তেষাঞ্চ যো নিরোধঃ
এবং বাদি মহাশ্রমণঃ " 
এখানের ধর্মরাজের নাম " সুহ্মরায় "। সুহ্ম অতি প্রাচীণ শব্দ। 
 রাঢ়দেশের প্রাচীণ নাম ই " সুহ্ম "। মহাভারতের টীকাকার নীলকন্ঠ বলেছেন " সুহ্মঃ  রাঢ়া " 

 তাছাড়া ' বুদ্ধরায় ' বা বুধোরায় বা বুদ্ধেশ্বর শিবের নামে বেঁচে আছে বুদ্ধের স্মৃতি। কোন বৌদ্ধ স্তুপ বা মন্দিরের নিদর্শন নাই। 
 হয়তো ছিল। বা হয়ত এখনও মাটির নীচে। 
 বাঙ্গলার ইতিহাস তো অধিকাংশ ক্ষেত্রে মাটির নীচে ই। 
------------ ------------ ------------ ------------ ------------ 

 বৈচিত্রময় বীরভূম ঃ  বৈচিত্র্য এর ভূ প্রকৃতি তে। মাটিই তো কথা বলে। মানুষের রক্তে। তার শরীরে, মনে। 
 বিচিত্র এই বীরভূম। মননের বৈচিত্র্য। সেই বৈচিত্র্য থেকেই 
 মন্দির স্থাপত্য রীতি র এত বিচিত্রতা বীরভূম ছাড়া অন্য কোথাও দেখা যায়না। বীরভূম কে বলা হয় " ধর্মসাধনার জাদুঘর "। নানা ধর্মীয় আন্দোলনের স্রোত বয়ে গেছে বীরভূমের উপর দিয়ে। 
জৈন, সহজিয়া বৌদ্ধ, শৈব, শাক্ত, বৈষ্ণবীয় এবং ইসলাম। সুফীবাদের প্রভাব। নানা ধর্মীয় স্রোত। মানুষের মনোজগতে এর সুগভীর প্রভাব আছে। 
 চালা, রত্ন, শিখর, দেউল সহ ভিত্তিভূমি থেকে কৌণিক ভাবে 
 উপরে উঠে যাওয়া রীতি  সহ নানা রীতির সমাবেশ বীরভূমে। 
 প্রস্তর নির্মিত, ল্যাটেরাইট বোল্ডার ( কামানো পাথর ও বলা হয়) । ছাড়া বাকী সব মন্দির ই ইঁটের তৈরী। নিকট বর্তী 
ছোট নাগপুর মালভূমি থেকে পাথর এনে তাকে নির্দিষ্ট রূপ দেওয়ার জন্য যে অর্থ বিনিয়োগ দরকার তা এখানে খুব কমই হয়েছে। স্থানীয় ভূস্বামী বা ধনী ব্যবসায়ী বা রাজকর্মচারী রাই বা পণ্ডিত রা 
মন্দির গুলি নির্মান করিয়েছিলেন। 

বীরভূমের মন্দির স্থাপত্য এবং তার অলংকরণ বাঙ্গলার মন্দির স্থাপত্য শিল্পের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। 
বাঙ্গলার সমাজ বিবর্তনের ও বাঙালির মনস্বিতার ও ভাবপ্রবনতা র চিত্র এই মন্দির ভাস্কর্যের মধ্যে প্রতিফলিত। 
মঙ্গলকাব্য সমূহের সমাজ চিত্রণের কথাকে মাথায় রেখেও বলতে হচ্ছে " পটভূমির প্রসারে, কল্পনার বিস্তারে, এবং শিল্প সৃষ্টির দক্ষতায় বাঙ্গলার মন্দির শিল্পকে সমসাময়িক যুগের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম দলিল বলে অভিহিত করা চলে। "
 " বাঙ্গলার মন্দির বাঙ্গালীর জাতীয় তীর্থ। "
বাঙ্গালী র আন্তরহৃদয়ের পরিচয় দিতে, তার স্পর্শশীলতার, তার আনন্দ বেদনার এবং সর্বোপরি তার আধাত্মিক অনুভূতির ইঙ্গিতে বাংলার দেবদেউল গুলি একান্তই অপ্রতিদ্বন্দ্বী। " ( কল্যাণ কুমার গাঙ্গুলি)  
  
প্রস্তর নির্মিত দেউল ঃ রসা বড়রা,  কবিলাসপুর, পাঁচড়া, মহুলা, রসা, পারশুণ্ডি । নাগর রীতি র 
 ল্যাটেরাইট বোল্ডার নির্মিত, ভিত্তি  ঃ দুবরাজপুর, মল্লারপুর, বক্রেশ্বর  ইত্যাদি। এখন সিমেন্ট প্লাষ্টার পড়ায় আর ঠিক বোঝা যায়না। 
 কোথাও ভিত্তি  ল্যাটেরাইটের,  উপরিভাগ ইঁটের। চূণ সুরকির গাঁথনি। এবং চূনের প্লাষ্টার।।
রসার প্রস্তর নির্মিত দেউল খুবই বিখ্যাত। সংস্কার হয়েছে। কিন্তু আমলকের কাজ করা যায়নি। 
শৈব এবং শাক্ত সাধনার স্থল। এখানের বিশাল বটবৃক্ষের বাহু বন্ধনে রয়েছে আরও কয়েকটি ছোট মন্দিরের ধংসাবশে্ষ। শোনা যায় বর্ধমানের সর্পি গ্রামের জমিদার অর্জুন রায় চৌধুরী এই মন্দির গুলির নির্মাতা। 
 উচ্চতার দিক দিয়ে ঃ ভাণ্ডীরবন। ( এখানে বিতর্ক আছে 
 পুরাতত্ত্ব বিভাগ বলেছেন প্রস্তর নির্মিত কিন্তু অন্য বিশেষজ্ঞ রা ম্যাককাচ্চন সাহেব সহ বলেছেন ইঁট নির্মিত) 
 প্রাচীন মন্দিরের ভিতের উপরে দেওয়ান রামনাথ ভাদুড়ি কর্তৃক নির্মিত। সংস্কারে সংস্কারে মূল চেহারায় পরিবর্তন যা আসা স্বাভাবিক তাই হয়েছে। 
 ১৭৫৪ খ্রীস্টাব্দে নির্মিত। প্রায় ৪৫ ফুট উচ্চ। 
* কলেশ্বর।  ঢেকার রামজীবন রায় কর্তৃক নির্মিত শিবমন্দির। 
* ডাবুক। ডাবুকেশ্বর শিবমন্দির। সর্বোচ্চ শিখর দেউল।
** অসামান্য ফুলপাথরের অলংকরণ সমন্বিত। 
গণপুর। গণপুর কে বলা হয় এখানে ফুলপাথরের মহাকাব্য রচিত হয়েছে। অসাধারণ এখানের মন্দিরের কাল। মণ্ডল বাড়ি সহ কালীতলার  মন্দির গুচ্ছ । আসামান্য অলংকৃত এখানের দোলমঞ্চ টি। 
মুলুটি, মাসড়া, গণপুরের মন্দিররের অন্যতম  বৈশিষ্ট্য এখানে চালা রীতি র মন্দিরের আর্চের  উপরে মন্দিরলিপি সমূহ। যা নিয়ে আলাদা কাজ করা যায়। 
** অনুপম ফুলপাথরের অলংকরণ সমন্বিত মন্দিরের অন্যতম সিউড়ি সোনাতোড় পাড়ার চালা রীতি র রঘুনাথ জীর মন্দির। অসামান্য এর অলংকরণ। শোনা যায় এক ঘণশ্যাম দাস বাবাজী ভিক্ষালব্ধ অর্থে এই মন্দির নির্মান করিয়েছিলেন। 
বিগ্রহ হীন। চুরি হয়ে গেছে। 
* দুবরাজপুর এর মন্দির। নায়ক পাড়ার মন্দিরে চমৎকার জ্যামিতিক ডিজাইন এর কাজ আছে। 
এছাড়া ওঝা পাড়ার মন্দিরদুটি র কাজ চমৎকার। 
* হেতমপুর এর চন্দ্রনাথ মন্দির। একটি ব্যতিক্রমী মন্দির। এখানের টেরাকোটা কাজের মাধ্যমে বিদেশি জীবন চিত্রের ছবি আছে। 
*বিশালাকৃতি। নবরত্ন মন্দির। ৮০ ফুট উচ্চ। ২৫ ফুট বর্গের বিশাল মন্দির। সামনের অংশের টেরাকোটার অলংকরণ, মূলতঃ রামায়ণ কাহিনী র 
রাম রাবণ এর যুদ্ধ।বানর সেনাদের ভূমিকা চমৎকার ফুটেছে। এছাড়াও আছে সামাজিক চিত্রন। বর্ধমানের রাজা কীর্তিচাঁদ জননী ব্রজকিশোরী দেবী এই মন্দির নির্মান করিয়েছিলেন 
 জেলা গেজেটিয়ার অনুযায়ী - 
* ঘূড়িষা রঘুনাথ জীর মন্দির। ১৬৩৩ সাঃ অব্দে। নির্মিত। জেলার  প্রাচীণতম।! অসাধারণ সুক্ষ্ম এর টেরাকোটা অলংকরণ।স্বর্ণালংকারের সৌন্দর্য এর দেওয়াল জুড়ে। পণ্ডিত রঘুত্তম আচার্য এর নির্মাতা। অতি প্রাচীণ শিলালেখ আছে। 
* ঘুড়িষা বেণেপাড়ার ক্ষেত্রনাথ দত্ত কর্তৃক নির্মিত 
লক্ষ্মী নারায়ণ মন্দির। হাই রিলিফের অতি চমৎকার কাজ এখানে রয়েছে। চৈতন্য লীলা, ত্রিপুরাসুন্দরীর অসাধারণ প্যানেল। মধ্য অষ্টাদশ শতকের নির্মান। 
* ইলামবাজারের তিনটি বিখ্যাত মন্দির। 
অষ্টকোনাকৃতি গৌরাঙ্গ মন্দির। হাটতলায়। আসামান্য এর জ্যামিতিক ডিজাইন। নকল দরজা। 
এবং ফুলপাতার নক্সা। 
* ব্রাহ্মণ পাড়ার  বিষ্ণু দালান। উচ্চ বেদীর উপরে  বৃহদাকৃতির পঞ্চরত্ন মন্দির। অসাধারণ এর টেরাকোটা র কাজ। রাসমণ্ডল, দুর্গাপ্যানেল, চৈতন্য লীলা এর কাজ। হাই রিলিফের কাজ ভাস্কর্যটি দিকে গেছে। ক্ষুদিরাম বন্দ্যোপাধ্যায় এর নির্মাতা। নির্মানকাল মধ্য অষ্টাদশ শতক। 
* রামেশ্বর শিবমন্দির।  রামধন চট্টোপাধ্যায় কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত শিবমন্দির। ছোট্ট ফলকে আসামান্য বিভঙ্গে রাধাকৃষ্ণ।হাইরিলিফে জগদ্ধাত্রী এবং দুর্গামূর্তি এর অন্যতম প্রধান কাজ। 
* সুরুলের মন্দির। জমিদার সরকার বাড়ির ছোট তরফের শিবমন্দির এর টেরাকোটা অলংকরণ ছিল অসাধারণ। যথাযথ ভাবেই সংস্কার হয়েছে। 
* সুপুরের জোড়া মন্দির।  অষ্টকোনাকৃতি মন্দির এবং দেউল রীতি র মন্দির এবং তার টেরাকোটার কাজ চমৎকার। 
* বীরভূমের অন্যতম জোড়বাংলো মন্দির রীতি র মন্দির রয়েছে ইটাণ্ডা য়। এই মন্দির এবং সাধুখান পাড়ার শিবমন্দিরের টেরাকোটা কাজ দৃষ্টি নন্দন। 

**
ঘুড়িষা রঘুনাথ জী র মন্দির। জেলার প্রাচীণতম মন্দির বলে কথিত। এটির স্থাপনাকাল ১৫৫৫ শকাব্দ। ১৬৩৩ খ্রীস্টাব্দে। অসামান্য এর টেরাকোটা অলংকরণ। 
কিন্তু রামপুরহাট থানা অন্তর্গত  মাসড়া গ্রামের শিবমন্দির টি ১৫৩৩ শকাব্দে অর্থাৎ ১৬৩১ খ্রীস্টাব্দে নির্মিত। 
মাসড়া তখন মুলুটির রাজাদের অধীনস্থ। 
মন্দির টি ' রাজলোহাপাল ' সিতবদাস তাঁর মা সিদ্ধেশ্বরী র নামে প্রতিষ্ঠা করেন। 
 এই মন্দিরের অলংকরণ ছিল ফুলপাথরের। 
 সংস্কারের নামে সিন্থেটিক রঙের প্রলেপে ঢেকে গেছে প্রাচীণ কারুকার্যের সৌন্দর্য। 
 এই মন্দিরের প্রাচীণ প্রতিষ্ঠা লিপি টি এইরূপ - 
 শ্রী শ্রী রামাই ১৫৫৩ সেবক রাজলোহাপাল। ৪২৩ ××× সিতবদাস কর্মকারের মাতা শ্রী মতী সিদ্ধর শ্রী ঈশ্বর শিব স্থাপনাকারি ×××   ×××  
 মুলুটি নিকট বর্তী এই মাসড়া গ্রাম ছিল লোহা কেনাবেচা র এক কেন্দ্র। প্রাচীণ পদ্ধতিতে লোহা গলানো হত। কর্মকার রা প্রভূত ধনী হয়ে উঠেছিলেন। 
 পরবর্তী তে এই সকল এলাকা ' লোহামহল ' নামে  ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর ইজারার মধ্যে আসে। 
 গ্রামে ঝামার স্তুপে এখনও অনেক লোহামল বা slag পাওয়া যায়। 
 মাসড়া গ্রামের এই ছোট্ট শিবমন্দির টি প্রতিষ্ঠাকালীন হিসাব অনুযায়ী বীরভূম জেলার প্রাচীন তম মন্দির। 
------------ ------------ ------------ ------------ ------------ 
অনেক বন্ধুর সেদিনের আমার কথিকা,আকাশবাণী  শান্তিনিকেতনে শোনা হয়নি। 
অনেকে শুনেছেন। 
সঞ্চালক ছিলেন কমলেশ্বর চট্টোপাধ্যায় 
তাঁদের জন্যই এই লেখা। মোটামুটি এই লেখার ভিত্তিতে।

গোপভূম কথা।। কাঁ কসা রাজবংশ

গোপভূম কথা ও কাহিনী।।
কাঁকসা রাজবংশ -
এই বংশের আদিপুরুষ  রাজপুতনা থেকে আগত শিবভক্ত
কঙ্কসেন রায় বা রাও। তাঁর পুত্র কনকসেন। ঐ পুত্র প্রতাপাদিত্য। প্রতাপাদিত্য র সাত পুত্র। তিনজনের নাম পাওয়া যায়। তাঁরা  যথাক্রমে  ভবাণিপতি ; পৃত্থ্বীধর ; শত্রুভাল।
ভবাণীপতির পুত্র সুরেন্দ্রনাথ রায়।

পৃত্থ্বীধরের সাত পুত্র। অন্যতম পরমানন্দ রায়।
কাঁকসা রাজবংশ বহিঃশত্রুর, সম্ভবত সৈয়দ মহম্মদ বুখারীর হাতে পরাজিত এবং বিনষ্ট হয়।
বংশের বিভিন্ন শাখা নানা দিকে ছড়িয়ে পড়েন।
রাজকুসুম নিকটবর্তী জঙ্গলের মধ্যে যে গড় ছিল যার নাম উৎগড়। সেখানে এক পরিবার বাস করতেন। এই জঙ্গলে আক্রমণ কারী দের দ্বারা উপুর্যুপরি
সাতজন নিহত হয়েছিলেন।  তাই জঙ্গলে র এই অংশের নাম " সাতকাটা জঙ্গল "।
পৃত্থ্বীধরের সাত পুত্র ই পরমানন্দ সহ দেরিয়াপুর
গ্রামে তাঁদের বসতি স্থাপন করেন।
এই পরমানন্দ রায় ; বর্ধমানের রাজা দের এক দেওয়ান ছিলেন। তিনি তাঁর কর্মদক্ষতা র জন্য
পত্তনিদারী লাভ করে  মৌখিরা কালিকাপুর এর জমিদারি পত্তন করেন। পরে ইংরেজ দের সাথে নীলের ব্যবসা এবং অপর শাখা কয়লা র ব্যবসায় প্রভূত ধন অর্জন করেছিলেন।
পরমানন্দ তাঁর পুত্রের নামে মৌখিরা থেকে দক্ষিণের জঙ্গল লাগোয়া উচ্চ ভূমির উপরে
কালিকাপুর এর দুর্গাদালান সমন্বিত  সাতমহলা প্রাসাদ সহ ; দিঘি খণন ; শিবমন্দির নির্মান করান।
বিখ্যাত কালুঘোষের সাত পুত্রের এক পুত্রের কন্যা  শৈব্যা। শৈব্যাকে সম্প্রদান করা হয় রাজা ভল্লুপাদ কে। এঁরা দেরীপুর গ্রামে বসবাস করতেন। শৈব্যার পিতা পরবর্তী সময়ে বৈদ্যনাথ ধাম গিয়ে সেখানে নিজ রাজত্ব তৈরী করেন।
শৈব্যার বংশধরেরা " রায় " পদবী লাভ করেন।
এঁরা সৎমৌলিক হিসাবেই পরিচিত।
কালিকাপুর মৌখিরা র জমিদার বংশের ক্ষয়িষ্ণু উত্তরাধিকারী গণ " রায় " পদবী ই ব্যবহার করেন।
কালিকাপুর মৌখিরা র জন্য প্রসঙ্গ আলাদা প্রবন্ধ দাবী করে। মন্দির এবং প্রাসাদ ময় এমন
যুগ্ম গ্রাম ' হেরিটেজ ভিলেজ " এর মর্যাদার দাবী
রাখে। 
কাঁকসায় কাঁকসা রাজবংশের কোন নির্মানের অবশেষ নাই। কঙ্কেশ্বর শিব মন্দির আছে। মজে যাওয়া, প্রায় পরিত্যক্ত জীবিত কুণ্ড আছে।
সৈয়দ বুখারী , যাঁর দ্বারা কাঁকসা রাজবংশ আক্রান্ত হয়। তাঁর সমাধি আছে কাঁকসার প্রয়াগপুরে।
দিঘি ছাড়া ভালকি তে ও কোন নির্মানের অবশেষ নাই। অমরারগড় থেকে মানকর পর্যন্ত রয়েছে অনেক গুলি জলাশয়।
অমরারগড়ের উত্তরে পরিখা প্রাচীর এর ভগ্নাবশেষ প্রাচীণেরা দেখেছেন। আজ আর কিছু নাই। আছেন দেবী শিবাক্ষ্যা। আর আছে ঘোষ পরিবারের  প্রাচীর বেষ্টিত মন্দির রাজি।
কাঁকসা রাজবংশ ধ্বংস হবার পর নানা দিকে ছড়িয়ে গিয়েছিলেন বিভিন্ন শাখার বংশধরেরা।
বর্তমান প্রজন্ম তাঁদের পূর্বপুরুষ দের নাম ই জানেন না। ইতিহাস তো দূরের কথা।
কেউ কেউ এখন নিজেদের ইতিহাস খোঁজ করছেন। কিন্তু একজন ক্ষেত্রসমীক্ষক হিসাবে দেখেছি উপাদানের অভাব প্রকট।
নিজেদের ঠিকুজি কুলজী ও নাই।
কালিকাপুর মৌখিরা সাক্ষ্য দিচ্ছে অতীত গৌরব
কে। কিন্তু সেখানেও সেই একই সমস্যা।
নাই বংশ লতিকা। নাই প্রাচীণ কোন দলিল।
আনুঃ দুশো বছর আগের ইতিহাস। কেননা মৌখিরা গ্রামের প্রথম শিবমন্দির টি ১২০০ বঙ্গাব্দ নাগাদ নির্মিত হয়। পরবর্তী সময়ে নানা বিধ নির্মান হয়েছে। প্রাসাদ, মন্দির,  জলাশয়,
বাগানবাড়ি ' চাঁদনী ' প্রভৃতি।

অর্থাৎ কাঁকসা রাজবংশের সাথে একটা সম্পর্ক থেকে যাচ্ছে এই জমিদার বংশের।
কাঁকসা রাজবংশের সাথে জড়িত রা কোঙার বা কুমার, এবং রায় পদবী ব্যবহার করেন।
বিনয় ঘোষ বলেছেন " গোপভূম এর সদগোপ রাজবংশের ইতিহাস রাঢ়ের এক গৌরব ময় যুগের ইতিহাস। আজও সেই অতীতের স্মৃতি চিহ্ন
ভালকী, অমরারগড়, কাঁকসা, গৌরাঙ্গপুর প্রভৃতি অঞ্চলে রয়েছে। বাংলার সংস্কৃতির ইতিহাসে
সদগোপ দের দানের গুরুত্ব নির্ণয় করা হয়নি। "
" অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রারম্ভে গোপভূমে যে সদগোপ রাজা রাজত্ব করছিলেন তাঁর নাম শতক্রতু।
১৭১৮ সাল নাগাদ তিনি মারা গেলে তাঁর পুত্র মহেন্দ্র রাজা হন। মহেন্দ্র নিজ রাজ্য বহু দূর প্রসারিত করে ছিলেন। নবদ্বীপাধিপতি রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের জীবন চরিতে রাজা মহেন্দ্রর কথা
বিস্তৃত ভাবে লেখা আছে। যখন জগৎ শেঠের
বাড়িতে বাঙ্গলার নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে সভা আহুত হয়, তখন রাজা মহেন্দ্র একজন
প্রধান উদ্যোগী ছিলেন। নবাবের বিপক্ষে, বিরোধী হবার জন্য তাঁর রাজ্য বর্ধমানের রাজা কর্তৃক আক্রান্ত হয় এবং তিনি পরাজিত হন "।
কুলজি গ্রন্থে র ঐতিহাসিকতায় অনেকে বিশ্বাস স্থাপন করতে পারেননা। জনশ্রুতি ও তাই।
তবু যেখানে ঐতিহাসিক উপাদানের অভাব সেখানে  জনশ্রুতি কে কিছু মূল্য দিতেই হয়।
" ন্যাহ্যমূল্যা জনশ্রুতি "। ইতিহাস লুকিয়ে থাকে তারই মধ্যে। খুঁজে নিতে হয়।
এই প্রবন্ধে মোক্ষদাপ্রসাদ রায় চৌধুরী র " সদগোপ কুলীন সংহিতা " নামক একটি প্রাচীন
পুস্তকের সাহায্য নেওয়া হয়েছে। এই মানুষ টি
ও ' ম্যালি সাহেবের অধীনে জনগণনার কাজ করেছেন। মূলত ethnological। তিনিও সেই সময়েই উপাদানের অভাবে ভুগেছেন।
" সদগোপ " জাতিকে তিনি বর্ণ হিসাবে ' বৈশ্য ' বলেছেন। শাস্ত্র থেকে নানা উদ্ধৃতি দিয়েছেন।
প্রকাশকাল। ১৩২২ বঙ্গাব্দ।
এছাড়া বিনয় ঘোষ এর পশ্চিম বঙ্গের সংস্কৃতি বা
ডঃ অতুল সুর এর " বাঙলা ও বাঙালীর বিবর্তন
পুস্তক টির সাহায্য নেওয়া হয়েছে।
------------ ------------ ------------ ------------ সমাপ্ত।
লেখক। প্রণব ভট্টাচার্য। আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চাকারী।
*- আমার লেখা ' এলেমবাজার নিলামবাজার ইলামবাজার " বই টি তে বিস্তৃত রয়েছে। 
বই টি যদি সংগ্রহ করেন বা পড়েন, দেখবেন নানাবিধ তথ্য সন্নিবেশিত হয়েছে। যা একটা ছোট্ট বই এ সাধারণত পাওয়া যায়না। 
হয়তো আপনারা ভাবছেন অজয়ের উত্তরে বীরভূমের ইলামবাজার। তার সাথে কি সম্পর্ক এপারের গোপভূমির। 
মৌখিরা কালিকাপুর এর জমিদার পরিবার নিয়ে বলতেই হত। আর তা বলতে গিয়েই, বাড়তে হয়েছে। 
ইলামবাজার বই টি সংগ্রহ করতে পারেন। অক্ষর যাত্রা প্রকাশনীর আনন্দগোপাল হালদার কে ফোনে অর্ডার দিলেই বাড়িতে বসে বই টি সংগ্রহ করতে পারবেন। তাঁর নং 9474907307. 

* আশা করছি  ' ইছাই ঘোষের দেউল ঃ কথা ও কাহিনী " বই টি ও আগামী বাংলা বর্ষে প্রকাশিত হবে। অনেক কথা আর কাহিনী।

* আসলে কি জানেন এই জায়গা তো খোলা হাট। 
কতভাবে কতজন যে আমার লেখা থেকে তথ্য নিয়ে কত প্রবন্ধ লিখলেন! কোথাও আমার নাম মাত্র উল্লেখ নাই। একজন লিখলেন স্থানীয় এক লেখক। কিন্তু বললেন না সেই লেখকের লেখা থেকেই টুকছি। এই সব নানা কথা। তাই এখানে কি, কতটুকু, লিখব বা বলব ভাবতে হচ্ছে। 
যাই হোক। বাদ দিন

তেপান্তর পাঠশালা।

' এবং আমরা ' নাটকের দলের সদস্য দের অক্লান্ত পরিশ্রমে গড়ে তোলা ' তেপান্তর নাট্য গ্রাম '। 
 সময় টা খুব কম নয়। নাটকের দলের বয়স ত্রিশ বছর পার হয়ে গেছে। এই তেপান্তর গড়ে উঠেছে দীর্ঘ দিনের প্রচেষ্টায়। এই সময় কালে এই নাট্যগ্রামে মানুষ দেখেছেন কত নাটক, কত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। রাজ্যের, রাজ্যের বাইরের, বিদেশের নাট্য দল গুলি এখানে নাটক করে গেছেন। 
 তিন দিনের তেপান্তর মেলায় ( দোল মেলায়)  অগনিত মানুষ এসেছেন। মেলার আনন্দ উপভোগ করেছেন। মেলার সময়ে মুক্তমঞ্চে সারা পশ্চিম বঙ্গের বিভিন্ন লোক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখেছেন। 
 নাটকের জন্যই নাট্যগ্রাম। নিশ্চয়ই নাটক হবে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে  তেপান্তর মেলার ও  যথারীতি  আয়োজন হবে। 
 এবার টীম ' এবং আমরা ', "তেপান্তর নাট্য গ্রাম " নিতে চলেছে এক সম্পূর্ণ  নূতন উদ্যোগ। শুরু করা হচ্ছে 
   তেপান্তর পাঠশালা। আগামী ১ লা মার্চ তার শুভ উদ্বোধন হবে। অনেক বিশিষ্ট মানুষের উপস্থিতি তে। ঐদিন ই ছোটদের বসে আঁকো প্রতিযোগিতা। 
আঁকার প্রশিক্ষণের জন্য থাকবেন বিশিষ্ট শিল্পীরা। 
 এই পাঠশালা কোন প্রথাগত পাঠশালা নয়। 
এক সাংস্কৃতিক পাঠশালা। উপযুক্ত তত্ত্বাবধানে, 
 নানা বিধ সাংস্কৃতিক মাধ্যমে ছেলেমেয়েদের প্রশিক্ষিত করা হবে। যেন তারা একটা লেভেলে গিয়ে পৌঁছাতে পারে। 
 এলাকার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল কে আরও উন্নত করার লক্ষ্যে, এই পাঠশালা তার কার্যক্রম কে পরিচালিত করবে। 
 
 আসুন ১ লা মার্চ বৈকাল ৫ টায়। 
 সকলের সাদর আমন্ত্রণ।
 আসুন। এগিয়ে আসুন। আশাকরি শুভবুদ্ধি সম্পন্ন
 মানুষ রা প্রসন্ন  সহযোগিতার হাত প্রসারিত করবেন।

পছন্দের গন্তব্য তেপান্তর

তেপান্তর। 
তেপান্তর নাট্য গ্রাম। এক সৃষ্টি। 
" সৃষ্টি সুখে, সৃজন আনন্দে " গড়া এই নাট্যগ্রাম। 
দলগত প্রচেষ্টা। দীর্ঘ দিনের অক্লান্ত পরিশ্রম। 
   তেপান্তর তার  ফসল।"
আমাদের আনন্দ নিকেতন। 
আপনারাও আসুন। উপভোগ করুন। 

যদি এখনও এখানে না এসে থাকেন 
অবশ্যই এই শীতে একবার আসুন। 
তারপর তো দোল মেলা আছেই। 
যাঁরা হৈ হট্টগোল এড়িয়ে একটু নিরিবিলি তে 
নিজের সময় কাটাতে চান তাঁদের জন্য চমৎকার এক জায়গা। 
আসুন। থাকুন এখানে। চারপাশ ঘুরে দেখুন। 
আর যদি আমার কাছ থেকে চারপাশের গল্প ইতিহাস টা শুনে নিয়ে বের হন বেড়ানো টা অন্যরকম হয়ে যাবে। 
আসুন। ভালো লাগবেই।
** পশ্চিম বর্দ্ধমান এর কাঁকসা থানার, অযোধ্যা বনকাটি এলাকা র সাতকাহনিয়া গ্রামে এই তেপান্তর নাট্য গ্রাম। নিকট বর্তী বাসস্টপ পানাগড় মোরগ্রাম হাইওয়ে র উপর এগারো মাইল। 
গুগুল ম্যাপে দেখুন।
যোগাযোগ, বুকিং। তাপস চ্যাটার্জি। নং 95630 14447

** বন্ধুরা পোষ্ট টি শেয়ার করুন। এই অনুরোধ। 
আজকের আনন্দবাজার পত্রিকার জেলার পাতার কড়চা য় তেপান্তর কে নিয়ে লেখা। 
ধন্যবাদ আনন্দবাজার। 
সামান্য ত্রুটি।  রঘুনাথপুরের সাতকাহনিয়া নয়। 
অযোধ্যা বনকাটি এলাকা য় সাতকাহনিয়া গ্রামের পূর্ব অংশে এই তেপান্তর নাট্য গ্রাম।