Tuesday, 26 June 2018

জঙ্গলমহলের শিব পূজা

শিব ঠাকুরের গাজন -------------------প্রণব ভট্টাচার্য কাছে দূরে ঢাক বাজছে। শিবমন্দির প্রাঙ্গণে। গাজন আসতে আর দেরী নাই। আমাদের এই রাঢ় বাঙলার নানা গ্রামে চৈত্র সংক্রান্তি র শিবের গাজন একটি বৈশিষ্ট্য পূর্ণ লোকায়ত উৎসব। আমাদের এই এলাকার অর্থাৎ থানা - কাঁকসা ; প: বর্ধমান জেলার অন্তর্গত বনকাটি গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার এবং সংলগ্ন একটি গ্রামের গাজন উৎসব নিয়ে একটু আলোচনা করব। তার আগে সংক্ষেপে একটু ইতিহাস বলে নিই। হয়তো জানেন ; আউশগ্রাম এবং কাঁকসা থানা এলাকার জংগল ভূমি নিয়েই বর্ধমানের জংগল মহল। প্রাচীন গোপভূম। পরগণা - সেনপাহাড়ী। এখানে ই বিখ্যাত ' গড় - জংগল '। এই সেই ধর্ম্মমঙ্গল খ্যাত ইছাই ঘোষের প্রাচীন রাজত্বভূমি। জংগলের মধ্যে ছিল গড়। মোটামুটি হাজার বছর আগের কথা। গড় নাই। ধংসাবশেষ আছে।আছেন গড়ের দেবী শ্যামারূপা। আর আছে ইছাই এর স্মৃতি জড়িত স্থানে অবস্থিত বিখ্যাত পুরাকীর্তি ' ইছাই ঘোষের দেউল'। সীমান্ত এলাকা। উত্তরে অজয়।ওপারে বীরভূম। জয়দেব - কেন্দুলি। গঞ্জ - ইলামবাজার। তন্ত্র সাধনার পীঠস্থান বীরভূম। বনকাটি গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় ১৬ টি মৌজা। ২২-২৩ টি গ্রাম। লোক সংখ্যা আনু-২০-২১ হাজার। মোট শিবমন্দির ৩০ টি। ভগ্ন সমেত। বসুধা প্রাচীন গ্রাম।বেশ কয়েকটি শিব মন্দির ধ্বংস হয়ে গেছে।এখন রয়েছে একটি বেশ বড় সহ তিনটি ছোট মন্দির। রঘুনাথপুর গ্রামে রয়েছে টি মন্দির। অযোধ্যা- বনকাটি এই এলাকার কেন্দ্রভূমি।পুরোনো দিনের গঞ্জ। সমৃদ্ধ গ্রাম। এখানেই রয়েছে ১৯-২০ টি শিবমন্দির। সব ই পারিবারিক। দু টি ছাড়া।এই দুটি ই গ্রাম্য সর্বসাধারণ এর। বনকাটির রায়বাড়ির বিখ্যাত কালীমন্দির প্রাঙ্গণে নির্মিত হয়েছিল সর্বপ্রাচীন শিবমন্দির টি।১৭০৪ শকাব্দে। টেরাকোটা র কাজের জন্য বিখ্যাত গোপালেশ্বর শিব মন্দির টি১৭৫৪ শকাব্দে নির্মিত। ভূগর্ভ থেকে উত্থিত অযোধ্যা গ্রামের অনাদিনাথ শিবলিঙ্গ সহ মন্দির টি ও সু প্রাচীন। এটি সর্বসাধারণ এর। এই শিব কে কেন্দ্রকরেই শিবের গাজনের ধূম।যে ধূম ছিল তা আজ আর নেই। মানুষের সেই উৎসাহ নেই। বহু স্তরীয় নানা জটিলতা। নানা বিভাজন। যাই হোক তবু হয়। একটু দুরেই সংলগ্ন মলানদিঘী গ্রাম পঞ্চায়েতের রক্ষিত পুর প্রাচীন গ্রাম। ইছাই ঘোষের আমলের গ্রাম। ধন দৌলত এখানে সম্ভবত রক্ষিত থাকত। এখানের শিবের গাজন খুব ই বিখ্যাত। শুরুতে অযোধ্যা গ্রামের অনাদি নাথ শিবের গাজনের কথা।একটু বলি এই শিবলিঙ্গ টির সারা বছর পূজার্চনা এবং হোম যজ্ঞ চরক গাজন এর জন্য বর্ধমান এর রাজা রা ২৮ বিঘা জমি দান করেছিলেন। বামুন পাড়ায় পুরোহিত এবং তত্বাবধানের জন্য বাগদী পাড়ায় গাজনের ভক্তা মুচি পাড়ার ঢাকি - সবার জন্য ই কিছু জমি বরাদ্দ হয়েছিল। অতীতে এখানকার গাজন ছিল খুব ই বিখ্যাত।মন্দির প্রাঙ্গন পথ ঘাট একে বারে লোকে লোকারণ্যহয়ে যেত। গাজনের ভক্তাদের নাচ। বাণ ফোঁড়া অবস্থায়। সারা অঙ্গে ই বাণ ফোড়াঁ।অষ্ট অঙ্গে। হ্যাঁ বান ফোঁড়ার জন্য ; বাণ তৈরি র জন্য কামার দের দায়িত্ব নির্দিষ্ট ছিল।তার জন্য তাঁদেরও জমি ছিল। দুটি গোরুগাড়িকে জুড়ে তৈরি করা হত গাজনের ভক্তাদের গাড়ি। সামনে পিছনে মোটা কাঠের খুঁটি মাস্তুল এর মতো শক্ত করে বাঁধা। দুই খুঁটিতে বাঁধা আনুভূমিক লম্বা বাঁশ বা কাঠ। তাতে ঝুলছে ভক্তা রা। দোল খাচ্ছে।ফুল ছূড়ছে।পা উপরে মাথা নীচে। খুব সহজ নয়। তিন দিন চলছে উপোষ। সন্ধ্যায়সামান্য ফলজলে আর কি হয়। যাকে বলা হয় ছোট বানামো - সেদিন থেকেই শুরু।অশৌচ পালনের মতো কোড়াাকাপড় এর বস্ত্রখণ্ড পরিধান।গলায় সেই কাপড়ের গলবস্ত্র। লোহার এক চাবি তাতে বাঁধা। কার মৃত্যু জনিত শোক পালনের নিদর্শন? গ্রামে গ্রামে চলে পরিক্রমা। মাথায় মনুষ্য আকৃতি র একটি মোটা কাঠের প্রতীকী এক বস্তু। গায়ে তার অনেক কাঁটা পেরেক বা মোটা জলুই গাঁথা। এ কার মৃত দেহের প্রতীকী রূপ। গ্রাম পরিক্রমা ; গৃহস্থ মানুষজনের কাছ থেকে চাল ডাল আনাজ পাতি সংগ্রহ। মুখে জয় বাবা বাণেশ্বর - আওয়াজ। জয় বাবা ধর্মরাজ। কে এই বাণ। পুরাণ এর সেই শিবভক্ত বাণ রাজা। যাঁর নামে বাণ লিঙ্গ? দ্বিতীয় দিন বড় বানামো। নির্জলা উপোষ সারাদিন। সন্ধ্যায় একটু ফলজল। আবার সেই গ্রাম পরিক্রমা। বেশ কয়েকটি গ্রাম নিয়ে পরিক্রমণ। ক্লান্ত শরীর। তৃতীয় দিন চরক। কোথাও নাগরদোলা র মতো চরকের চরকি। চতুর্থদিন হোম ; যজ্ঞ। বিকালে নিমপাতা বাটা মেশানো বেলের সরবত।ভক্তা দের জন্য। রাত্রে ভোগ প্রসাদ। গাজনের অনুষ্ঠান শেষ। ভক্তাদের পালন শেষ। ------( পরের পাতায়) --

No comments:

Post a Comment