Friday, 1 June 2018
বীর কালু এবং নদীর এপারওপার
আজ ১৩ ই বৈশাখ। ১৪২৫ বঙ্গাব্দ। ইংরাজি ২০১৮ সাল।
দ্বাদশী তিথি।
সকাল থেকে আকাশ মেঘলা। সেই অসহ্য গুমোট গরম টা নেই।
নদী র ওপারে ঢাক ঢোলের আওয়াজ এপারে আসছে। আর এপারের আওয়াজ ওপারে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।
অজয়ের ওপারে ' লাউসেন তলা'। 'লাউসেন গোড়ে'। গাছপালা ঝোপঝাড়ে ভর্তি জায়গা।
আজ সেখানে বহু মানুষের জমায়েত।
মহা উৎসাহে ; বিরাট ধূমধামের সাথে সেখানে
আজ পূজা হচ্ছে ' কালুবীর' এর।
বাইরে থেকে আঁকুড়ে ডোম সম্প্রদায় এর
শিক্ষিত মানুষেরা ও অনেকে এসেছেন।
স্থানীয় আঁকুড়ে ডোম সম্প্রদায়ের মানুষেরা এসেছেন দলে দলে।
জয়দেব - কেন্দুলী র কাছেই প্রাচীন ' সুগড়'
গ্রাম। সেখানের ডোম সম্প্রদায়ের মানুষেরাও
আজ তাঁর পূজা করছেন। যথারীতি নিজস্ব আচার অনুষ্ঠান অনুযায়ী। শেষ পর্বে ছাগ বলি রীতি।
অজয়ের এপারে দক্ষিণ তীরে দুবরাজপুর মানা র উত্তরে নদী বাঁধ এর গায়েই ' বুধো রায়' এর থান। নামটি লক্ষ্য করুন। বুধো রায়।
আদিতে ইনি বুদ্ধ রায়। বিদবিহার গ্রাম পঞ্চায়েত। বিদবিহার নাম তো বৌদ্ধবিহার এর অপভ্রংশ। সেই পাল যুগে অজয়ের এপার ওপার দুপারেই তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্মের দারুন প্রসার প্রভাব। ডোম সম্প্রদায় সহ সমাজের
অন্ত্যজ শ্রেণী র মানুষেরা এই তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মে দারুন ভাবে আকৃষ্ট হয়েছিলেন।
প্রথমত জাতপাত হীন এই ধর্মে তাঁরা বিশেষ মর্যাদা পেয়েছিলেন। সমাজে বেড়েছিল তাঁদের প্রভাব প্রতিপত্তি।
ডোম্ব - ডোম্বীনি দের নানা কথা তো চর্যাপদে
আমরা পাচ্ছিই। নাচে গানে তাঁরা পারদর্শী।
আর ' দেহভাণ্ড ই ব্রহ্মাণ্ড '। দেহসুখেই - চিত্তসুখের সন্ধান। আর সে দেহ সাধনা তো আর ডোমনী দের ছাড়া হয় না। দেহ নিয়ে
অত শুচিবাই গ্রস্ততা তাদের নেই।
যাই হোক একটু সরে গেছি আমাদের বিষয় থেকে।
এই বুধোরায়ের তলাতে একদিন বহু বহু গ্রামের শত শত বাজুনে ডোম সম্প্রদায়ের
মানুষেরা জড়ো হতেন এই ' কালু বীর' এর
পুজায়।এঁরা ও ডোম সম্প্রদায় এর। তবে এঁরা বৃত্তিগত ভাবে ঢাক ঢোল এর বাজনদার।
আর আঁকুড়ে রা নিজেদের পুরোনো সৈনিকবৃত্তি র কথা ভেবে গর্ব অনুভব করেন।
উভয় থাকের মানুষেরা কালুবীর কে নিজেদের বলেই মনে করেন।
এবার প্রশ্ন কে এই' কালু বীর'?
এঁকে আমরা পাব ধর্ম্মমঙ্গল কাব্যে।ময়ূর ভট্ট;
ঘণরাম; রূপরাম চক্রবর্তী ; মাণিক গাঙ্গুলী সকলের কাব্যেই তাঁকে পাই।
জাতি তে ডোম। পেশা য় সৈনিক। মারাত্মক যোদ্ধা। স্ত্রী সাহসিনী লক্ষা। সে ও যুদ্ধ জানে।
ইছাই ঘোষের সাথে লাউসেন এর যুদ্ধে
লাউসেন এর অন্যতম সেনাপতি কালু বীর।
তার সাহসে ভর করেই লাউসেন এর যুদ্ধযাত্রা। যুদ্ধবিগ্রহ ; অস্ত্রচর্চা ছাড়া আর কিছুতেই তার মন নাই। মদ্য ; মাংস ছাড়া তার চলেনা। " দেবদেবে মোর কিবা কাজ/ মদ্য মাংস না পেলে পড়ে বাজ"।
আর ডোম মানে ই তো যুদ্ধের জাত। সে যেখানের ই হোক। ' তুপুস পুরের হোক
আর ' সেন পাহাড়ী র ই হোক । ডোম সৈন্য দল মানেই সে ভয়ংকর। আর যুদ্ধযাত্রা মানেই
" আগে ডোম বাগে ডোম ঘোড়া ডোম সাজে"
কাহিনী তো মোটামুটি আমরা জানি।
তবু সংক্ষেপে না হয় আবার শুনি।
অজয়ের ওপারে গড় জঙ্গল। শ্যামারূপার গড়।ছিল পরিখা ঘেরা গড় বাড়ী। সীমান্ত প্রহরার জন্য। তখন গৌড়ে পাল রাজাদের
রাজত্ব।
তাঁদের প্রতিনিধি হয়ে দূর্গ সামলান ময়না গড়ের অধিপতি কর্ণসেন।
স্থানীয় গোপ বীর ইছাই ঘোষ অতর্কিত আক্রমনে দুর্গ দখল করে নেন। কর্ণসেন
পালান। সেই আক্রমনে কর্ণসেনের ছয় পুত্র
নিহত হন। স্ত্রী আত্মঘাতিনী হন।
বিবাগী কর্ণসেন কে সংসারে ফেরাতে পালরাজ তাঁর শ্যালিকা রঞ্জাবতী র সাথে
কর্ণসেনের বিয়ে দেন। এটা না কি শ্যালক মন্ত্রী
মহামদ ভালো মনে নেন নি।
কর্ণসেন রঞ্জাবতী র ই সন্তান লাউসেন বা লব বা নবসেন।ধর্ম ঠাকুরের দয়ায় তাঁদের সন্তান
লাভ।
যুবক লাউসেন অস্ত্রবিদ্যায় পারদর্শী হয়ে উঠলেন।তাঁর মনে জাগল পিতার হারানো
রাজত্ব উদ্ধার। পিতার অপমান মায়ের আত্মহত্যা ভাইদের মৃত্যু তাকে অস্থির করে
তুলল। মামা মহামদ প্রবল ভাবে উৎসাহ দিলেন। তাঁর মনে কিন্তু অন্য কথা।
কালুবীর ; বিশাল সৈন্য দল ; নিয়ে লাউসেন
এসে উপস্থিত হলেন অজয়ের উত্তরে। ঘাঁটি গাড়লেন সুগড়; সন্তোষপুর এ।
তারপর অপেক্ষা। দিন ক্ষণ সময় বুঝে নদী পেরুনো। ইছাই এর ঢেকুর গড় বা ত্রিষষ্টি গড়
আক্রমন। ইছাই এতো দিনে প্রায় বৃদ্ধ। কত টা
কি পারবে- দেখা যাবে।
সেদিন শণিবার। সপ্তমী। ১৩ ই বৈশাখ।
লাউসেন গোড়ে ( ছোট্ট পুকুর) তে স্নান করে ধর্মঠাকুর এর পূজা করে লাউসেন চললেন
নদী পার হতে। সামনে তাঁর সেনাপতি কালুবীর। কালু র হু হুঙ্কারে কাঁপছে বন জঙ্গল।
ওদিকে ইছাই এর সৈন্যদল ও তৈরী।
ঘণ কাঁটাবাঁশের মোটা মোটা ঝাড় দিয়ে ঘেরা গড়।প্রাকার পরিখা ও আছে।
সমস্ত উঁচু ঢিবি গুলোর উপরে ইছাই এর
বাউড়ি ; হাঁড়ি; বাগদী ; খাঁড়াত ; কোটাল ডোম
সৈন্য রা তৈরি তীর ধনু টেঁটি খাঁড়া বল্লম
ইত্যাদি অস্ত্রসস্ত্র নিয়ে।
নদী পেরুচ্ছে লাউসেন এর সৈন্য রা।
কাঁদুনে ডাঙ্গায় বাধল মারাত্মক যুদ্ধ। রক্তে ভেসে গেল " রক্তনালা"। কালু বীর বীরবিক্রমে লড়াই চালাচ্ছে।
এদিকে ইছাই এর তো নিষেধ ই ছিল " সম্মুখে সপ্তমী শণিবার বারবেলা / আজি রণে যেওনারে ইছাই গোয়ালা"। দেবী শ্যামারূপার
দৈববাণী।
কিন্তু উপায় ও নাই। লাউসেন তারস্বরে আহ্বান জানাচ্ছে বেরিয়ে আয় - আমার সঙ্গে মুখোমুখি লড়। যেতেই হল। আর উপাই বা কি।
ঐ লাউসেন তলাতেই নাকি হয়েছিল মুখোমুখি দুজনের যুদ্ধ। বৃদ্ধ ইছাই পরাজিত এবং নিহত হলেন।
ইছাই এর কাছে হারানো গড় পুনরায় দখল করলেন লাউসেন।
জয় হল ধর্মঠাকুরের।
সংক্ষেপে এই হল কাহিনী।
এবার এরমধ্যে যেটুকু ইতিহাস।
পালবংশে ই নবসেন নামে একজন কে খুঁজে
পাওয়া গেছে। তিনিই লাউসেন।
কেউ কেউ আবার বলছেন কালুবীর ; কালু সেন। তিনি নাকি লাউসেন এর ই বৈমাত্রেয় ভাই।
লক্ষী বা লক্ষা নামের ডোম সম্প্রদায়ের মেয়েকে বিয়ে করেই তিনি এলাকার সব খবরা খবর জোগাড় করেন। যা যুদ্ধ জিততে
কাজে লেগেছিল। কালু হয়ে ওঠেন ডোম সম্প্রদায়ের নেতা। কালুর স্মৃতি আজও বহমান। ইছাই বা লাউসেন এর স্মৃতি তে
পুজা হয়না। কোন জমায়েত ও না।
ডোম সম্প্রদায় কিন্তু বংশ পরম্পরা য় কালুবীর
এর পূজা করে আসছেন। যথাসাধ্য আয়োজনে।ইতিহাস বেঁচে থাকে এই লোক সাধারনের মধ্যেই।
এই আমাদের কালু বীর। নদী র ওপারের অর্থাৎ বীরভূমের দিকে র নদী তীরবর্তী গ্রাম গুলির আঁকুড়ে বা অখিরা পদবী র ডোম সম্প্রদায়ের মানুষেরা নিজেদেরকে কালু র বংশধর বলে পরিচয় দেন।
আর ইছাই কে আমরা ইতিহাসে পাব ঈশ্বরী ঘোষ নামে। তিনি ' মহা মাণ্ডলিক ' রাঢ়াধীপ' ত্রিষষ্টি গড়ের অধিপতি।
বর্তমান বাংলা দেশের রামগঞ্জে প্রাপ্ত তাম্রশাসন থেকে তাঁর কথা জানতে পারি।
মোটামুটি হাজার বছর আগের কথা।
ইছাই এর স্মৃতি বিজড়িত জায়গা য় অনেক অনেক পরে একটি দেউল নির্মিত হয়।
সম্ভবত বর্ধমান এর রাজ বংশের রাজা
চিত্রসেন এটি নির্মাণ করান।
এটি ইছাই ঘোষের দেউল নামেই বিখ্যাত।
নদীর ওপারে এই সময়ে নির্মিত হয়েছে; বা হচ্ছে লাউসেন তলায় আটন পাট মন্দির।
কালুবীরএর স্মৃতিতে এবং ধর্মরাজ পূজার
জন্য।
এসব করছেন একদল আধুনিক ভক্ত।
ডোম সম্প্রদায়ের আঁকুড়ে বা অখিরা পদবীর
একদল শিক্ষিত মানুষ এর মূল উদ্যোক্তা।
মনে হয় তাঁরা ' বীরপূজা' র এক icon কে
কালুবীর এর মাঝে খুঁজে পেয়েছেন।
ইছাই এর বিরুদ্ধে প্রবলপরাক্রমে যুদ্ধ করলেও কালু ও এই যুদ্ধে নিহত হন।
তাঁর স্ত্রী লক্ষা বা লক্ষী নিশ্চয় ই এখানে নিজেদের লোকদের সাথে থেকে যান।
প্রশ্ন জাগে কালু কি এখানের এই মাটির মানুষ।না কি লাউসেন এর সাথে বাইরে থেকে এসেছিলেন।যদি স্থানীয় মানুষ হন - তবে তাঁর মতো বীর যোদ্ধা কে ইছাই তাঁর সৈন্যদল এর
অন্তর্ভুক্ত করলেন না কেন। কেন কালু যোগ
দিলেন লাউসেন এর পক্ষে।
সে যাই হোক রাঙ্গামাটি র এই রাঢ়দেশের
এক অনন্য চরিত্র কালুডোম ; কালুবীর। ডোম সমাজের মাথার মণি-। ধর্মরাজ থানে তাঁর ও আটন। তিনি কালু রায় ও।
------+-+--------------------++----------------------------
১৩ ই বৈশাখ: কালু বীরের পূজা
--------------------------------- প্রণব ভট্টাচার্য।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment