Thursday, 26 December 2024

চলুন, গল্প করতে করতে শান্তিনিকেতনে যাই

চলুন আপনাদের সাথে গল্প করতে করতে শান্তি নিকেতনের পৌষ মেলায় যাই। এই এগারো মাইল 
নামের বাসস্ট্যান্ড থেকে আমি আপনাদের সঙ্গী হলাম। আচ্ছা বলুন এগারো মাইল নামটা বেশ অন্যরকম কি না। তাহলে এই নামের পিছনে একটা গল্প আছে। কি গল্প!  না কাঁকসা থেকে 
 ১১ মাইল দূরে এই স্থান। নাম ই হয়ে গেল  পাকাপাকি। তখন রাস্তা তৈরি হচ্ছে। কাঁকসা পানিঘর থেকে এগারো মাইল দূরে যে মোরাম রাস্তা চলে যাচ্ছে সাতকাহনিয়া ডাকবাংলো য়। এক ডাকবাংলো থেকে পরবর্তী ডাকবাংলো। ডাকবাংলোয় বিশ্রামের ব্যবস্থা আছে। আস্তাবল আছে। ঘোড়ার দানাপানির ব্যবস্থা আছে। 
সরকারি কর্মচারী দের জন্য ইংরেজ সরকারের 
ব্যবস্থা। প্রথম দিকে ডাক পরিবহনের কাজ ও চলেছে। ডাক পরিবহনের কাজের মানুষ টির জন্য আলাদা ছোট একটা কোয়ার্টার আছে। টিনের বা টালিরও ছাউনি হতে পারে। সেখানে বিশ্রামের ব্যবস্থা। মনে পড়ে গেল শের শাহ ও মোটামুটি এগারো মাইল দূরে দূরে চটি, র ব্যবস্থা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। চটি মানে যেখানে সেই বিশ্রামের ব্যবস্থা পাওয়া যাবে। আস্তাবল পাওয়া যাবে। দানাপানির ব্যবস্থা হবে। আরও কিছুরও হতে পারে। 
যাক এই তো হল এগারো মাইল কথা। 
ঐ দেখুন পূর্ব দিকে শালের জঙ্গল। আঁকাবাঁকা পিচ ঢালা পথ চলে যাচ্ছে গুসকরা বা ভেদিয়া পর্যন্ত। চমৎকার জঙ্গল পথ। 
গিয়েছেন নাকি কালিকাপুর মৌখিরা।
এই গুসকরা মোড় থেকে মাত্র চার পাঁচ কিমি দূরে ই।কালিকাপুর। সেখানের  ভগ্ন বিশাল সাত মহলা দালান। পাশাপাশি দুটি শিবমন্দির। চমৎকার টেরাকোটা অলংকরণ সমন্বিত। 
চলুন এবার চাঁদনী কে পাশে রেখে মৌখিরা যাই। 
চাঁদনী ছিল ইংরেজ সাহেবদের সাথে কালিকাপুরের জমিদার বাবুদের একসাথে আনন্দ স্ফূর্তি করার জায়গা। 
তখন জমিদার  বাবুরা, ইংরেজ দের সাথে একজোট হয়ে নীলের ব্যবসা করে বিশাল ধনী হচ্ছেন। 
মৌখিরা কে বলা যেতে পারে মন্দির নগরী। প্রাসাদ আর মন্দিরে মন্দিরে ভরা। 
শতাব্দীপ্রাচীন পুষ্পিত অশোকতরু তলে দাঁড়িয়ে চারপাশে তাকান। ইতিহাস আপনার মনে ফিসফিস করে কথা বলবেই। 
কল্যাণচকের এই প্রাঙ্গণে একসাথে রয়েছে অনেক গুলি মন্দির। ১২০০ বঙ্গাব্দ থেকে শুরু হয়েছে মন্দির নির্মান। এখানের বিষ্ণু মন্দিরের গায়ে চমৎকার টেরাকোটা প্যানেল আছে। 
বসুধা য় এসে বড় রাস্তা ধরে এবার উত্তর পূর্ব মুখী
সামনেই অজয়। প্রাচীন নাম যার অজাবতী বা অজমতী বা অজয়াবতী। হয়তো ঋজুপালিকা। 
অজয়ের পুরনো সেতু বয়সের ভারে ক্লান্ত হওয়ায় 
নূতন ' অজেয় সেতু ' নির্মিত হল। ১৯৬২ তে উদ্বোধন করেছিলেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী শ্রী বিধান চন্দ্র রায়। 
এই অজয়কেই  ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী কাগজে কলমে ১৮০৬ সালে বীরভূম আর বর্ধমানের প্রাকৃতিক  সীমারেখা হিসাবে গ্রহন করে। 
সেতু পার হয়ে ' বীরভূমের প্রবেশ দ্বার ' ইলামবাজার। পুরাতন বানিজ্য কেন্দ্র। নীল আর গালার পাইকারি ব্যবসা কেন্দ্র। Trade mart of importance " 
আরস্কাইন সাহেবের হাত ধরে এখানে গড়ে ওঠে 
নীল এবং গালার কুঠিবাড়ি ভিত্তিক ব্যবসা বাণিজ্য। বিরাট আকারে। 
ইলামবাজারে আছে তিনটি বিখ্যাত টেরাকোটা অলংকরণ শোভিত মন্দির। টেরাকোটা প্রেমী দের 
অবশ্য দ্রষ্টব্য। 
বোলপুরের রাস্তা ধরেছেন। সুখবাজার পার হয়ে শাল জঙ্গলের অপূর্ব বনপথ শুরু হল। এই জঙ্গলে র নাম চৌপাহাড়ি বা চৌপাহারি। কেন এমন নাম! 
শুনবেন। তো বেশ। হবে। না হয় 
জঙ্গল শুরু হবার মুখেই চমৎকার নৈসর্গিক পরিবেশে গড়ে উঠেছে ইলামবাজার কবি জয়দেব মহাবিদ্যালয়। 
জঙ্গল পথের শেষে বনভিলা। সান্যাল বাবুর হাতে তৈরি বনলক্ষ্মী। আর এখন গড়ে উঠেছে অনেক 
লজ, রিসর্ট। চলে গেছে দক্ষিণে অজয়ের ধার পর্যন্ত। আবার দেউলী র দিকে। 
দেখেছেন দেউলী কে!  এখানে আছে পাল সেন যুগের পার্বতী মূর্তি। আছে বৈষ্ণব সাধক কবি লোচনদাসের স্মৃতিধন্য সাধন স্থল। 
বনভিলা পার হলেন রামনগরের দিঘীর পাশ দিয়ে 
কামারপাড়া। বড় রাস্তার গায়ে গড়ে উঠেছে বিরাট হোটেল। আর একপাশে আবাসনের হাই রাইজ। 
যেন শুরু হয়ে গেল বোলপুর শান্তিনিকেতন। 
কত আবাসন, লজ, স্কুল, দোকানপাট , পেশাগত শিক্ষার বিরাট প্রতিষ্ঠান। 
বাইপাস ধরে যাচ্ছেন। ঢুকলেন মাহিদাপুর হয়ে 
শ্রীনিকেতন। সুরুল। এই সুরুলের অনেক কথা। 
কালীসায়রের পাশ দিয়ে পূর্বাঞ্চল সংস্কৃতি কেন্দ্রের পাশ দিয়ে, বিনয় ভবনের মাঠকে ডানদিকে রেখে 
শান্তিনিকেতন। 
শান্তিনিকেতনে র চারপাশে যে গড়ে উঠেছে কত 
থাকা খাওয়ার জায়গা। রিসর্ট, হোটেল ইত্যাদি। 
আছে সোনাঝুরির হাট। খোয়াই, আর কোপাই। 
শান্তিনিকেতনের আশ্রম এলাকার কথা বললাম না। 
যদি বলেন দ্বিতীয় পর্বে হবে। 
আমি এগারো মাইল থেকে শুরু করেছি। পানাগড় থেকে শুরু করলে ভালো হত। 
মেলা তো এবার জমজমাট। অনেক অনেক মানুষের ভিড়। অনেক দোকান পাতি। যেমন মেলা হয় আর কি। এবার মেলা যেন স্বমেজাজে। 

------------ ------------ ------------ ------------ ------------ 





Saturday, 21 December 2024

একই খিদে ঃ খিদের জ্বালা

।। একই খিদে ঃ একই জ্বালা।। ২ পর্ব। 

 মাটি। মা - টি ই। জননী মৃত্তিকা। হে মহা প্রকৃতি। 
 প্রতিদিন পুড়ে যায়। কত মাটি। ইঁট ভাঁটা গুলির দিকে তাকাবেন। মাটির পাহাড়। এত মাটি পুড়ে যাচ্ছে। পাহাড় প্রমান এত উর্বর মাটি আসে কোথা থেকে। উত্তর দেবার দায় কেউ নেবেনা। ভূমি সংস্কার দপ্তর আছে কিন্তু! 
 প্রতিটি ভাঁটা বা ইঁটখোলায় কি পরিমান  ভূগর্ভস্থ জল ব্যবহৃত হয়। 
 কত বিদ্যুৎ পোড়ে। 
 হিসাব! হায় হিসাব। হিসাব নাই। তা নয়। এখানে বিনিময় প্রথা আছে। বুঝতেই পারছেন। 
 ও!  বললেন না যে কত মানুষের কর্ম সংস্থান হয়। 
 ঠিকই তো। পুরুলিয়া, সীমান্তের ঝাড়খণ্ড থেকে শ্রমিকরা আসে। কয়েক মাসের সংসার পাতা। কাঁচা ইঁটের ঝুপড়ি তে। চেহারায় শুষ্কতা। দারিদ্রের ছাপ স্পষ্ট। না। ঘুচলনা এঁদের দারিদ্র্য। স্বাধীনতার এত গুলো বছর পরেও। 
 কথা হচ্ছে ইঁট ভাঁটা নিয়ে। লক্ষ্য করে দেখবেন যেখানে যত ভালো দোঁয়াশ মাটি সেখানে পাশাপাশি ইঁটের ভাঁটা। 
 কত মাটি প্রতিদিন পুড়ে যাচ্ছে। মাটির বিকল্প মাটি। 
 এর পূরণ হবেনা। এর সাথে পুড়ে মরে যাচ্ছে কত অনুজীব।কত ক্ষুদ্র প্রাণ। 
 সব ভাঁটাই চলে কয়লায়। কিছু কাঠ ও লাগে। কাঠ মানেই বৃক্ষছেদন। আর যে কয়লায় ভাঁটা চলে সে কয়লা বাহক দের দেখতে পাবেন, একদিন ভাঁটার সামনে দাঁড়ালে। 
 কি ভাবে যে অত ভার বয়, এক একটা মোটর সাইকেলে।  
 কয়েক কুইন্টাল কয়লা। নিশ্চয়ই বলে দিতে হবেনা এই কয়লা কালো। আরে কয়লা তো কালো ই। 
 কালো টাকার মতো এই কয়লা কালো। 
 আকাশ জুড়ে কালো ধোঁয়া। শীতকালে এই ইঁট তৈরী র মরশুমে এই গ্রামাঞ্চলেও  সন্ধ্যায় মারাত্মক ধোঁয়াশা। 
অজয় তীরের বনকাটি, বিদবিহার আর দামোদর তীরের সিলামপুর, আমলাজোড়া গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় ইঁট ভাঁটার রমরমা। 
 আর ভাঁটার ট্রাকটর। ট্রিপ। মাটি ভর্তি ট্রাকটর ছুটছে যেন মার্সিডিজ। খুবই বিপজ্জনক ভাবে ছুটছে এই ভারী গাড়িগুলো । আর চালাচ্ছে সব কমবয়সী, সমাজের তথাকথিত নিম্নবর্গীয় ঘরের ছেলেরা। আপত্তির কিছু নাই। 
 এদের কিন্তু কোন ট্রেনিং নাই। লাইসেন্স নাই।  না থাক! 

 বুঝছেন না কেন ইঁট মানেই উন্নয়ন। কত বিশাল বিশাল 
 হাই রাইজ তৈরী হচ্ছে। ইঁট ছাড়া নগরায়ন সম্ভব! 
 ইঁট তো শরীর কোষের মতো। 
 মাটির ইঁট আর ছাই এর ইঁট এক হল! 
 না। এক নয়। 
 আমি দেখছি এক ভাবে। আপনি দেখছেন অন্য ভাবে। 
 দেখা তো আলাদা হবেই। 
 অথচ ভাবা যেত পারত। মাটি যে নাই তা নয়। যথেষ্ট মাটি আছে। নদীর মাঝে মাঝে যে চর জেগেছে - সেই চরের মাটিকে ব্যবহার করা যেতে পারত। নদীর স্রোতের বাধা দূর হত। দুপারেরই উপকার হত। 
 জলাধার গুলি তে ড্রেজিং করা যায়। মাটি তুলে তাকে ব্যবহার করার উপযুক্ত পরিকল্পনা করতে হবে। কে করবে। সরকার কেই এগিয়ে আসতে হবে। সরকার অবশ্য তার অপারগতা প্রকাশ করেই আছেন। 
 অতএব ছাড়ুন তাঁদের হাতেই যাঁদের ক্ষমতা আছে। 
 যাঁরা রাতারাতি একটা গোটা পাহাড় কে হজম করে দিতে পারে। আরাবল্লীর, কত পাহাড়, টিলা চুরি হয়ে গেছে। 
 আমাদের পুরুলিয়া তে ও তাদের শ্যেন দৃষ্টি। 
 অনেক দামী পাথর, মূল্যবান খণিজ সম্পদে ভরপুর। 
  লাভ আর লোভের চোখ চকচক করছে। 
 ------------ ------------ ------------ ------------ ----------- ২ য় পাতা শেষ।

Thursday, 19 December 2024

।।একই খিদে। খিদের জ্বালা।।

।।।। কি খাদ্যাভাব  এদের ।। 
 এরাও জীব। এদের ও খিদে আছে। খাদ্য নেই। 
 না খেয়ে মরে যাওয়াই কি ভবিতব্য! 
 এরা কি ভবিতব্য বোঝে! 
 কোন বোধ কাজ করে হয়তো। 
 লোকালয়ে চলে আসছে। সন্ধ্যা হতেই কাতর চিৎকার। 
 সারা দিনে পেটে কিছু পড়েনি। 
 সহজে মানুষের মতো বিপজ্জনক প্রাণী র কাছে এরা আসেনা। একেবারে নিরুপায় না হলে। 
 জানে মানুষ সবচেয়ে উঁচু প্রাণী। 
 যদি কিছু করে কেউ! না খেয়ে মরে যাবার আগে শেষ মরিয়া চেষ্টা। 
 আজ ঘরের পিছনে পুকুর পাড়ে কাতর চিৎকার। 
 সন্ধ্যা একটু ঘনিয়েছে মাত্র। 
 খাবারের খোঁজে মানুষের দুয়ারে আসছে। 
 এদের কথা ভেবেই বুঝি কোন কোন মন্দিরে ' শিবা ভোগের ' কথা ভাবা হয়েছিল। 
 এখনও কোন কোন মন্দিরে সেই রীতি চালু আছে। 
 খিচুড়ি ভোগ যথারীতি তারা খেয়ে যায়। 
 এই কয়েক বছরে তাদের সংখ্যা বেড়েছে। 
 একেবারে প্রায় শেষ হয়েই যাচ্ছিল। 
 গম্ভীর টার্ম আছে বই এর পাতা তেও। 
 যেমন শকুন হারিয়েই গেছে। 
 আরও কত জীব। 
 হাতির পাল নেমে আসছে। পাহাড়তলী তে। ধান খাবার জন্যে। পাহাড়ে কোন খাবার নাই। মানুষ তাড়াচ্ছে। মানুষের ও উপায় নাই। তার পেটের ভাতের জোগাড় শেষ করে দিচ্ছে যে। 
 বানর গুলো র কি উৎপাত! অসহ্য। সংখ্যায় যথেষ্ট বেড়েছে। প্রকৃতি কেন যে নিয়ন্ত্রণ করছেনা। 
 এত উৎপাতের কারণ তো সেই খিদের জ্বালা। 
 সহ্য করতে পারছেনা। ক্ষিপ্ত হয়ে যাচ্ছে। জঙ্গলে কোন, খাওয়া যায়, এমন গাছের পাতা নাই, ফুল নাই, ফল নাই। 
 তা না হলে আকন্দের পাতা খায়। 
  মানুষের মাঠে সব্জি নাই। মাঠের পর মাঠ পড়ে আছে। কোন সব্জি চাষ নেই। শুধু ধান। আর কিছু আলু। 
 গ্রাম আছে। থাকবে। কিন্তু সেই গ্রাম নয়। গ্রামের চারপাশের দোমাঠের  শস্য, সব্জি ভরা সেই ক্ষেত শুধু ছবি হয়ে যাবে। 
 চাষ করবে কে! চাষ করার লোক নাই। চাষির ঘরের ছেলেরা চাষ জানেও না। চায়ও না চাষ করতে। 
 আর চাষের খরচ যা বেড়েছে, সব জমি চলে যাবে শেষ পর্যন্ত কর্পোরেট এর হাতে। সেই পরিকল্পনা নিয়েই আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছে স্বাধীনতার পর থেকেই। 
 প্রসঙ্গ ভিন্ন হলেও সম্পর্কিত। অনেক কথা বলা হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু অনেক অনেক কথা থেকে যাচ্ছে। 
  চড়ুই, মৌমাছি, প্রজাপতি, জোনাকি সব হারাবার পথে। 
 দায় তো আমাদের। আমাদের সভ্যতার। কিন্তু দায় স্বীকার তো করবনা। 
 এতো পাপ। শেষ হয়ে গেল মাটি। নিজেরাই শেষ করে দিলাম। 
 ------------ ------------ ------------ ------------ ---------১ ম পর্ব 
আরও কয়েকটি পর্ব নিয়ে এক বড় প্রবন্ধ হবে। 
এখানে দেব কি না জানাবেন। ভালো না লাগলে দেবনা। 
আমি মাত্র একটি ছোট্ট এলাকা কে মডিউল ধরে কথা বলছি। একই অভিজ্ঞতা সবার না হওয়াই স্বাভাবিক। 
 পশ্চিম বর্ধমান এর কাঁকসা থানার অযোধ্যা - বনকাটি এলাকা। ৭১৩১৪৮।

ছবি। পাকা ফসলের ক্ষেত। শিল্পী । ভ্যান গগের।

Wednesday, 20 November 2024

কুঁচিকাঠি র গোছা আর ফেলুরাণী

তখন ঘরে  ঘরে মুড়ি ভাজা হতো। খোলা, খাপুরী, এসব মাটির তৈরী জিনিসপত্র ছিল। 
ছিল কাঠের চওড়া হাতা, চাল নাড়ার জন্য। 
 কাঠের উনুনে, বড় খাপুরী তে চাল কে, নুন মাখিয়ে  গরম করে তারপর খোলা য়  নদীর বালি দিয়ে বেশ গরম করে  - হ্যাঁ, তারও তাকবাক জানতে হতো। খুব গরম বালিতে চাল দিলে পূড়ে কালো হয়ে যেতে পারে, তাই কেমন গরমে চাল দিলে পূড়বে না তা জানতে বুঝতে হত। গ্রামে কিছু অসহায় মহিলা ছিল। যাঁদের এই ঘরে ঘরে মুড়ি ভাজা ই ছিল পেশা। তাদের মুড়ি ভাজুনি বলা হত।
মরশুমে তাদের নানা ঘরে ডাক পড়ত।  তাতেই পেটের ভাতের জোগাড় হত। 
 খোলার মুখটা কাটা থাকত। কুমোর রা বড় হোলা র গায়ে দাগ দিয়েই দিত। সেই দাগবরাবর  খুব সাবধানে ভেঙে নিতে হত। হল খোলা। সে ও খুব সহজ কাজ নয়। সবাই পারেনা। 
খোলায় চাল নাড়ার জন্য কুঁচি কাঠি র দরকার ছিল। নাড়াচাড়া করে কাঠি দিয়ে মুড়ি তোলার সময় সামান্য বালিও উঠে যেত। একেবারে শেষে সেই মুড়ি আবার বাঁশের চালুনি তে চেলে নিতে হত। আবার ঘরের প্রয়োজন মাফিক, হলুদ দিয়ে 
রাঙানো, কুসুম বীজ, ছোলা মেশানো, কড়কড়ে মুড়ির ও বেশ কদর ছিল। 
 একদল গরীব ঘরের  মহিলা এই কুঁচি কাঠি তুলতো।  বিক্রি করে কিছু পয়সা পেতো । না হয় দু টি মুড়ি,মুড়কি  কিম্বা কিছু চাল। এখন সে সবের পাট চুকে গেছে। এখন মিলের ইউরিয়া দিয়ে নোনানো বা খাবার সোডা মেশানো - না জানি আরও কত কায়দা আছে। সাদা ধবধবে নরম মুড়ি।  সব মুড়ি ভাজা কলের মুড়ি সমান নয়। 

 আদিবাসী মহিলারা এখনও কুঁচি কাঠি তোলে। 
শালপাতায় সেলাই দিতে কাজে লাগে। অনেক গুলো পাতাকে জুড়ে থালার মতো পাতা। পাতা গুলো কে জুড়তে হয়। কি অসম্ভব দক্ষতায়, দ্রুত৷  তাঁরা এই পাতা বোনে। 
যাগ যজ্ঞ, হোমে এখনও এই কুঁচি কাঠি লাগে। 
পুজোর মরশুমে তার চাহিদা বাড়ে। 
 বয়সের ভারে ছোটো খাটো চেহারাটি নুয়ে গেছে। 
তবু পুরনো অভ্যেস। ঠাকুর থানে থানে কুঁচি কাঠি পৌঁছে দেওয়া। ফেলুরাণী অভ্যেস ছাড়তে পারেনি 
টুকটুক করে কোমর নুইয়ে  কুঁচিকাঠি তুলেছে। 
তারপর শুকিয়ে সে গুলোর গোছা বাঁধছে। 
যা হোক বিক্রি করে  কিছু তো পাওয়া যাবে। 
 তাই এই বয়সেও -

গ্রাম বেঁচে আছে শর পাতার ঝাঁটা বেঁধে

।।শর পাতার ঝাঁটা।। 
 গাঁয়ের মাঝখানে প্রাচীন বটবৃক্ষ। নাম তার বাবাজী বটতলা। 
 সে যে কবে, কতদিন আগে, কোন বাবাজী এই বটগাছ লাগিয়েছিলেন, তা আজ আর কে বলবে। 
 বটতলায় বসে মদন শরের ঝাঁটা বুনছে। তার বৌ দীপালি 
 বাবুই ঘাসের দড়ি পাকাচ্ছে। ঝাঁটা বাঁধার কাজে লাগবে। 
 সরু, ভালো পাক দেওয়া বাবুই দড়ি কিনতে ও হয়। আর ঝাঁটার কদর গাঁ গঞ্জে আছেই। উঠোন ঝাঁট দিতে, ঘর ঝাঁট দিতে। 

 এ গাঁ তো একটা মরা গাঁ। কম ঝড় গেছে। এ গাঁয়ের উপর দিয়ে। রোগ। মারাত্মক কলেরা, ম্যালেরিয়া, প্লেগ, বর্ধমান জ্বরের মারাত্মক আক্রমণ। ঘরে ঘরে মানুষ মরেছে বিনা চিকিৎসায়। আর তখন চিকিৎসাই বা কোথা।  
 ছিয়াত্তর এর মন্বন্তরে মরেছে। দস্যু বর্গী রা সেন ভূম জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে। 
 বাঁচার তাগিদে গাঁ ছেড়ে যে যেদিকে পেরেছে পালিয়েছে। এই চলে যাওয়াটাও দফায় দফায়। 
 কত বড় গাঁ ছিল। তিনটি অংশ। সাতটি পাড়া। শোনা যায় প্রায় ষাট ঘর কুমোর, আর ষাট ঘর তাঁতি ই ছিল শুধু। তাছাড়া কামার, মালাকার, বাবাজী বোষ্টম কারা না ছিল! ঘোষ, সেন, দে , বেনে, কলু, ছুতোর। তাম্বুলী, মুসলমান। আর শুঁড়ি, বাউরি 
 মাল, হাঁড়ি, কোঁড়া রা। 
 আদিগ্রাম ছিল আরও উত্তরে। অজয়ের ধার পর্যন্ত। অজয়ের 
 বানের ধাক্কাও খেয়েছে কতবার। 
 উজাড় গাঁয়ের সব বাস্তু ভিটা একদিন ছোট বড় মাটির ঢিবি হয়ে গেল। ঝোপ জঙ্গলে ঢেকে গেল সেই গাঁ। ঘণ শর ঝোপ। 
 বাঁশের ঝাড়। গোটা গাঁয়ের চার দিকেই। 
 পুকুর পাড়ের তালগাছ গুলো রয়ে গেল। এত এত পুকুর। 
প্রায় ত্রিশ টি। সব পুকুরের পাড়ে  লম্বা লম্বা তালগাছের সারি। 
 এমন যে কোন কোন পুকুরের জলে রোদ প্রায় পড়েনা। 
 যারা রয়ে গেল - তারা আর কি করে। কিছু চাষবাস। চাষের পর আর কাজ নাই। অজয়ে মাছ ধরে। 
কি অভাব। কি অভাব হায়!  ভাদ্র মাসে পাকা তালের আঁটি চুষেই খিদে মেটায়। দুটি মুড়ি জোটানোও কঠিন। 
 তবে এই শর ঝোপ আর তালগাছ ই বাঁচিয়ে রাখল খেটে খাওয়া মানুষ দের। 
 শর পাতার ঝাঁটা বোনে। গাঁয়ে গাঁয়ে নিয়ে যায় মাথায় করে। 
 কিছু চাল, পয়সা জোটে। আবার বর্ষাকালে তাল পাতার 
 মাথা ঢাকা দেওয়ায় টোকা, মাথা থেকে হাঁটু পর্যন্ত ঢাকা দেওয়ার ' পেখে '। পিছন দিক থেকে পাখির মতো দেখতে লাগে তাই নাম পেখে। তালপাতার চাটাই, তালাই।  আর বাঁশ।
 বাঁশের ঝুড়ি। 
 আজ অবশ্য সে গ্রাম নিজেকে অনেকটা সামলে নিয়েছে। 
বালিখাদে  কাজ করে। ট্রাকে, ট্রাক্টরে বালি ভরে। তারপর একদিন নদী তে নামল যন্ত্র দানব। নৌকোয় পাম্প মেসিন। 
 যারা পারল, বালি নিয়ে ব্যবসা করে বিরাট ধনী হয়ে গেল। 
আর যারা পারলনা, তারা ঐ বালি শ্রমিক। 
 এপারে অজয়ের মোটা দানা বালি ও প্রায় ফুরিয়ে এলো। 
 নদীতে বিরাট বিরাট গভীর গর্ত হল। নদীর এপারে দক্ষিণে বর্ধমান জেলার দিকে আর বালি নাই। ওপারে বিশাল স্তরে স্তরে জমাট চর। নীচের স্তরে কাশবন। উপরের স্তর গুলিতে 
 পূর্ব বঙ্গীয় উদ্বাস্তু মানুষের দল থিতু হয়ে ভালো চাষবাস করছে এখন। নারানপুরের মানা। 
এ গাঁয়ের মানুষ, বিশেষ করে বাউরি রা ভালো শরের ঝাঁটা বোনে। সে বহুদিন আগে থেকেই। 
 মদন ঝাঁটা বাঁধছে। একা মদন নয়। প্রায় গোটা গাঁ ই। 
 মদনের বাবা, কাকারা ও ভালো কারিগর ছিল। তাল পাতার 
 নানা জিনিস, বাঁশের ঝুড়ি খুব ভালো বানাতে পারত। 
 ভালো ঘর ছাইতে পারত। তখন তো সব ঘরের চাল ছিল খড়ে ছাওয়া। ভালো মাটির দেওয়াল দিতে পারত। কাঠামো তৈরি করতে পারত। আবার তালপাতার কুঁড়ে ঘরে ই কেউ কেউ সারা জীবন কাটিয়ে দিল। বা বাঁশের কঞ্চির ছিটে বেড়ার দেয়াল আর তালপাতার ছাউনি কুঁড়েঘর। 
 এখন শরের ঝাঁটা আর গাঁয়ে গাঁয়ে মাথায় করে বিচতে যেতে হয়না। বীরভূম থেকে মুসলিম পাইকার রা মোটর ভ্যান নিয়ে আসে। ভোর থেকেই তারা এসে যায়। কাড়াকাড়ি লেগে যায়। সব শরের ঝাঁটা তারা পাইকারি দরে কিনে নেয়। বারো টাকা পিস। তারা বেচে কুড়ি টাকায়। তা হোক। সে তো তার লাভ রাখবেই। 
 মাঠে  ধান পেকে আসছে। কিছু ধানে থোড়। পাকলে, কাটার মতো হলে   তখন কিছু কাজ জুটবে। ধান কাটার। তাও আবার মেসিন নামাচ্ছে অনেকে। ধান কাটা, ঝড়ানো সবই হচ্ছে। কাজ কই। কাজ নাই। খাবে কি! 
 এখন এই শর পাতার ঝাঁটা ই বেঁচে থাকার অবলম্বন। 
 শরপাতার ও অভাব দেখা দিয়েছে। সবাই ভোর হতে না হতেই কাস্তে নিয়ে বেরিয়ে যায়। দূরে দূরে। পাতা কেটে নিয়ে আসে। 
 কচি পাতা। তাই তাইই। সে পাতা শুকানো। গোছা বাঁধা। 
 তারপর বাঁধতে বসা। 
 অন্যান্য দূরের জায়গা থেকেও গরীব মানুষেরা এসে পাতা কেটে নিয়ে যাচ্ছে। কি করবে! নিরুপায়। তাদের ও যে অন্য কাজ নেই। খিদের রঙ যে একই। 
 বাঁচতে তো হবে। 
 শরের ঝাঁটা ই অনেক কে বাঁচিয়ে রেখেছে। 
------------ ------------ ------------ ------------ ------------  সমাপ্ত। 
 এ আমার গাঁয়ের কথা। 
 সাতকাহনিয়া। বনকাটি। পশ্চিম বর্ধমান
* ছবি তে একবার ক্লিক করবেন।

ছবি গুলিতে মদন বাউরি, দীপালি, ছায়া, মধু। মাধব রা  ( সবাই বাউরি)  ঝাঁটা বাঁধছে। তাদের স্ত্রী রাও বাঁধছে বা সাহায্য করছে।

সে এক সব হারানো গ্রামের কথা ( সম্পূর্ণ লেখা)




।।  সে এক সব হারানো গ্রামের কথা।।  প্রণব ভট্টাচার্য ।  ১ ম পাতা
সে এক গ্রামের কথা। গাঁ ঘরের কথা। আশপাশের কথা।
নদী আছে পাশে। লোকে বলে নদী। পণ্ডিতেরা বলবেন নদ।
কবিও বলেন তাই। " বাড়ি আমার ভাঙন ধরা অজয় নদের বাঁকে "। ছোট্ট কুনুর  কবির  কোগ্রামের কাছেই মিশেছে অজয়ে। ছিল এক প্রাচীন দহ। ভ্রমরাদহ। বিখ্যাত সে দহ।
সওদাগর দের নৌকা বাঁধা থাকত তার ঘাটে। সে কি আর আজকের কথা। " সপ্তডিঙা " ভাসত জলে। বাণিজ্যে যেত।
" কণ্টকদ্বীপ " কে ডান হাতে রেখে  ডিঙা গিয়ে পড়ত ভাগীরথী তে। স্রোতের টানে দক্ষিণে সাগর মুখে।
কত কথা এই অজয়ের। সে পূর্ব বাহিনী। তাই পৌরাণিক মতে
সে নদী। কত তার ঘাট। আর ঘাট মানেই তীর্থ।
আবার ঘাট মানেই ব্যবসা বাণিজ্য। ছোট বড় কত নৌকো।
মালের ওঠা নামা। পাড়ে বলদ গোরু ; মহিষ এর গাড়ি।
এ গ্রামের ঘাটের নাম " কলা বাগানের ঘাট "। দুপাশে তার কলাবাগান। মাঠের নাম 'নীলবাড়ির মাঠ '। নীলের চাষ হয়।
পাশেই নীল পচানো র মোটা ইঁটের চৌবাচ্চা। কোম্পানি র সাহেব দের পক্ষে তদারকি করেন গ্রামের সৈয়দ বংশের কোন
এক করিৎকর্মা মানুষ। হয়তো নাম তার গোলাম পাঞ্জাতন।
এঁদের পূর্বপুরুষ খুষ্টিগিরি দরগা শরীফের সুফী সাধক সৈয়দ শাহ আব্দুল্লাহ কেরমানী সাহেবের অধস্তন ৬ ষ্ঠ পুরুষ সৈয়দ
শাহ মোহাম্মদ আলী তকী সাহেবের পুত্র সৈয়দ শাহ আলী
জাওয়াদ (১৭০৭- ১৭৯০)  একদিন এসে এই গ্রামের নদী তীরে র কিছু দূরে উঁচু ঢিবির উপরে তাঁর আস্তানা স্থাপন করলেন।চারদিকে  ঘণ ঝোপ জঙ্গল। তাল ; খেজুর ; নিম ; বেল ; ডেঁয়ো মাদার ; চাকলতা গাছে ঘেরা এই মনোরম তপোবনের মতো স্থান তাঁর খুব পছন্দ হয়েছিল। এখানেই তিনি তাঁর খানকাহ্
স্থাপন করলেন। কথিত আছে গুরুপ্রদত্ত নীমের দাঁতন কাঠি
এখানে আসার পরই সবুজ সজীব মুকুলিত  হয়ে উঠেছিল।
তিনি সেই দাঁতন কাঠি পাশেই পুঁতে দিয়েছিলেন। বড় এক দিঘির পাড়ে। প্রবীণ রা বলতেন তাঁরা সেই গাছ দেখেছেন।
ভক্তি র আতিশয্যে ডাল ভেঙ্গে নিতে নিতে একদিন সেই গাছ
মারা যায়।
ইউনানি চিকিৎসা য় তিনি খুবই দক্ষ মানুষ ছিলেন। সাপের কামড়ের ভালো ওষুধ জানতেন।
বর্ধমান রাজের পেটের অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক রোগের উপশম ঘটিয়ে  তিনি নাকি প্রায় ১৪০০ বিঘা মতান্তরে ৭০০ বিঘা নিষ্কর সম্পত্তি লাভ করেন। রাজার কাছে চেয়েছিলেন মাত্র
চৌদ্দ হাত পরিমান জায়গা। রাজা দিলেন বিশাল সম্পত্তি।
------------ ------------ ------------ ------------ ------------ ১ ম পাতা শেষ
 


।। সে এক গ্রামের কথা।। পাতা নং ২
নদী ধারের উঁচু ঢিবির উপরে হাঁড়ি পাড়া। বেলতলাতে কঞ্চি হাতে শনের মতো পাকাচুল বুড়ি পাহারা দেয়। মানুষের মাথার সাইজের বেল। আর তেমন ই মিষ্টি।
হাঁড়িকাঠে বলি দিত কি না জানা নেই। কিন্তু নদী তে নৌকা বায়। এপার ওপার করে। ওপারে নারানপুর ; উদয়পুর ; ক্ষুদ্দুপুর এমন সব গ্রামের লোক পারাপার করে। অযোধ্যা হাটে আসে। বেচা কেনা করে। মাছ ধরে। খালুই ভর্তি নদীর মাছ কেনার জন্য লোকে কাড়াকাড়ি করে।
আবার শোনা যায় ডাকাতি করতে অন্য দলের সাথে যায়।
  ভাড়া খাটে। রাজহাটের হাঁড়ি দের সাথে ভালো সম্পর্ক।
আর ওরা তো পাকা ডাকাত। পাষাণচণ্ডী বাগানে কালী র পুজো করে ওরা নদী র ওপারে যায় ডাকাতি করতে।
ডাকাতির মাল জমা রাখে লোকে বলে ; মোড়ল ঘরে ; এদিকের বেনে ঘরে।
  বনকাটি র মুখুজ্জে ; চাটুজ্জে ; রায় বাবুরা নানা রকম ব্যবসা
করে। প্রায় একসাথে জোট বেঁধে থাকা । ব্যবসা করে বেশ বড়লোক হয়েছে সবাই। তার মধ্যে মুখুজ্জে বাবুরা লাক্ষা বা গালার ব্যবসা করে খুব বড়লোক। বিরাট তাদের প্রাসাদ।
প্রাসাদে গুপ্ত কক্ষ। রায় বাবুদের প্রাসাদ সে ও দেখার মতো।
রায় বাবুদের বিরাট কালীপূজো। বিরাট তান্ত্রিক তাদের পূর্বপুরুষ রা। সেনপাহাড়ী র সেন রাজাদের কুল পুরোহিত ছিলেন না কি তাঁদের পূর্ব পুরুষ। ওপার বাংলা থেকে সেন রাজাদের সঙ্গে এসেছিলেন। কালীমন্দির। বিষ্ণু দালান ;
উত্তর মুখী দুটি শিবমন্দির। ১৭০৪ শকাব্দে নির্মিত হয়েছে
প্রথম দুটি মন্দির। তারপর আবার ১৭৫৬ শকাব্দে পাশাপাশি
তিনটি  দেউল রীতি র শিবমন্দির। সামনে টেরাকোটা র কাজ।
দুর্গা ; গণেশ ; দশমহাবিদ্যা।
চাটুজ্জে দের ও নানা ব্যবসা। তাদের ও বিরাট প্রাসাদ। গুপ্ত কক্ষ। পাশে মন্দির। তাদের পরিবারের এক বধূ তাঁর স্বামী মারা যাওয়ার পর বানিয়েছিলেন মুখোমুখি দুটি চমৎকার গড়নের শিবমন্দির। তাতে ছিল চমৎকার টেরাকোটার কাজ।
তাঁকে বলা হত ' বরানগরের দিদি '। পাঠক ভাবুন একবার কোথায় বরানগর আর কোথায় বনকাটির জঙ্গলে র দেশ।
সম্পর্ক হয়েছিল এই ব্যবসাসূত্রেই।
রায় বাড়ির আর এক শাখার নন্দকুমার রায় ; বনপাশ কামারপাড়ার মিস্ত্রি দের দিয়ে  বানিয়েছিলেন দুর্গা দালান ; বিষ্ণু দালান ; আর উত্তর মুখী দুটি শিবমন্দির। ১৭৩৯ শকাব্দে।
আর মুখুজ্জেরা সর্বাপেক্ষা ধনী। তাঁরা তাঁদের দুর্গাদালান ওয়ালা  প্রাসাদের সামনে বানিয়েছিলেন টেরাকোটা শোভিত
অসাধারণ শিবমন্দির ১৭৫৪ শকাব্দে। আর সেই গোপালেশ্বর শিব মন্দিরের গঠন অনুযায়ী ১২৪২ বঙ্গাব্দে অসামান্য অলংকৃত  পিতলের রথ। যা দেখতে ছাত্র দের নিয়ে গোরু গাড়িতে চেপে এসেছেন শিল্পাচার্য নন্দলাল বসু। মুকুল দে।
অমিয় ববন্দ্যোপাধ্যায় ; গুরুসদয় দত্ত  ইত্যাদি বড় মাপের  মানুষেরা।
আজও তা রসিক  দর্শক দের মোহিত করে।
ঘোর কাপালিক রায় পরিবারের পূর্ব পুরুষ রা। কালীথানে
তাঁদের পূজার মহা আড়ম্বর। ছাগ ; মেষ ; মহিষ বলি সেদিন ও
হত। আজও হয়। তন্ত্র মতে পূজা। শ্মশান থেকে শুরু যার কৃত্যক। ঘোর অমানিশায়  তমসার দেবীর মহাপূজা।
এই রায় পরিবারের ছিল  প্রচণ্ড দাপট। মধু রায় তো দুর্ধর্ষ।
  রায় দের বাহিনী তে আছে দুর্দান্ত সেনপাহাড়ী র মুচিরা।
সেই সময়কাল যে মারাত্মক।
১৭৭০ এর মহা মন্বন্তর এর পর সব ছারখার হয়ে গেছে।
গ্রামের পর গ্রাম উজাড়। না খেতে পেয়ে মারা গেল লাখে লাখে মানুষ। যে চাল পাওয়া যেত টাকায় ২-৩ মন করে তার দাম
তিন টাকা সের। কে কিনবে। চাষের জমি সব পড়ে আছে।
কে চাষ করবে। যে করবে সে ই তো নাই। " বীরভূম তখন বন্ধ্যা জনমানব হীন এক দেশ " সরকারি রিপোর্ট। হিগিনসন সাহেবের।
পশ্চিমের পাহাড়ি এলাকা থেকে নেমে আসছে দুর্ধর্ষ ডাকাতের দল। তাদের সঙ্গে যোগ দিচ্ছে যারা বেঁচে আছে তখনও। দু তিন  শো থেকে হাজার লোক দিনে দুপুরে ডাকাতি করছে।
দিনের আলোয় লুঠ হল গঞ্জ ইলামবাজার। আরস্কাইন সাহেবের কুঠিবাড়ি। এপারে অযোধ্যার জনৈক বলিনাথ  চট্টোপাধ্যায় এর বাড়িতে ডাকাতি হল। ১৭৮৯ সালে।
স্থানীয় ভূস্বামী রাও নিজেদের নিরাপত্তার জন্য পাহারার ব্যবস্থা করছেন। সোজা কথায় তারাও ডাকাতের দল গড়ে তুলছেন। সেই দল গড়ে তোলার জন্য উপযুক্ত লোক নিয়ে আসছেন বাইরে থেকে।


------------ ------------ ------------ ------------ ------------ ২ পাতা শেষ



।। সে এক গ্রামের কথা।। ৩ নং পাতা
সে এক সাংঘাতিক পরিস্থিতি। ঠিক এই সময়কালেই চলছে বর্গী আক্রমণ। সীমাহীন তাদের অত্যাচার। গ্রামের পর গ্রাম লুঠ করে আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে। " সেনভূম " কে পুড়িয়ে ছারখার করে দিল। অজয় পেরিয়ে এসে সেনপাহাড়ী জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মানকরের দিকে গেল লুঠেরা দের দল।
এই এলাকার কি যে  পরিস্থিতি হয়েছিল তার আনুপূর্বিক বিবরণ নাই।
এই এলাকায় প্রাচীণতম মন্দির গড়ে উঠেছে ১৭০৪ শকাব্দে।
অর্থাৎ ১৭৮২ সালে। তারপর একের পর এক গড়ে উঠেছে পরবর্তী পঞ্চাশ বছরের ও বেশী  সময় ধরে।
প্রাসাদ মন্দির ইত্যাদি গড়ে তোলার পিছনে নিজেদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি র বিষয় টি অবশ্যই আছে। কিন্তু মানুষ কে কাজ দেওয়ার বিষয়টি কেও  অগ্রাহ্য বোধ হয়  করা যাবেনা।
আবার শিবমন্দির স্থাপনার বিষয়ে যেটা শোনা যায় শিউ ভাটের নেতৃত্বে বর্গী দের দল যে গ্রামে শিবমন্দির দেখত সে গ্রাম না কি আক্রমণ করতনা। রাঢ়বঙ্গে যত শিবমন্দির আছে সারা ভারতে অন্য কোথাও নেই।
সেনপাহাড়ী ঃ  রেনেল সাহেবের ম্যাপে( ১৭৭৯) এই সমগ্র এলাকা সেনপাহাড়ী নামেই চিহ্নিত। পণ্ডিত প্রবর সুকুমার সেনের মতে বাঙ্গলার বিখ্যাত সেন রাজাদের পূর্ব পুরুষ রা বাঙ্গলায় এসে প্রথমে এখানে এই গড়জঙ্গল এলাকা য় তাদের বসতি স্থাপন করেছিলেন। নাম তাই সেনপাহাড়ী। অজয়ের ওপারে তাঁরা উত্তরে অনেক দূর পর্যন্ত গিয়েছিলেন।
ওপারে পরগণা সেনভূম।
১৭৪০-৪৪ সালের মধ্যে বর্ধমানের রাজা চিত্রসেন দিল্লির বাদশাহ  মহম্মদ শাহের ফরমান অনুযায়ী সেনপাহাড়ী পরগনার অধিকার লাভ করেন। যদিও আগেই তাঁরা এই এলাকা দখল করেছেন। ঐ সময়কালের মধ্যে রাজা চিত্রসেন
সেনপাহাড়ী পরগনার পুনর্গঠন করেন। গড়জঙ্গলের চারপাশের গ্রাম গুলির ভূস্বামী বা প্রভাবশালী ব্যক্তি দের
তিনি আনুকুল্য প্রদর্শন করেন। তাদের নিজেদের নিরাপত্তা র জন্য পাহারাদার দের দল গঠনের অনুমতি দেন। নিজে পাহারাদার ঘোড়সওয়ার এর দল তৈরী করেন। তাদের প্রশিক্ষণের জন্য " ঘোড় দৌড় " এর মাঠ আছে এলাকার দু তিন জায়গায়।
তিনি নিজে " গড়জঙ্গলের মধ্যে ইছাই ঘোষের গড় বেড়ী এলাকায় "  কেল্লা তৈরী করে কামান এনে বসান। কামানে ফার্সি ভাষায় লেখা ছিল রাজা চিত্রসেন। ঝাড়খণ্ড বিহার থেকে
" সিং " পদবী র ক্ষেত্রী যোদ্ধা দের এনে  কোটালপুকুর গ্রামে
এনে বসান। কেল্লা পাহারার জন্য। কেল্লাদার হায়ার সিং।
তখন ইংরেজ দের সাথে তাঁদের অশান্তি বেধেছে। যে কোন সময় আক্রমণ করার সম্ভাবনা। রাজা তাই নিজেদের নিরাপত্তা র জন্য বর্ধমান থেকে দূরে এই গড় জঙ্গল এর মধ্যে কেল্লা বানিয়েছিলেন।
চিত্রসেনের পর তাঁর উত্তরাধিকারী রাজা ত্রিলোকচন্দ্রের সময়
মুর্শিদাবাদ এর নবাব মীরকাসিম এবং ইংরেজ দের সাথে বিরোধ চরমে ওঠে। স্বাধীনচেতা ত্রিলোকচন্দ্র সিরাজের বিরুদ্ধে যে চক্রান্ত হয়েছিল তাতে যোগ দেননি। স্বাভাবিক ভাবে মুর্শিদাবাদ দরবারে প্রায় ব্রাত্য হয়ে গেছেন।
ইংরেজ রা উত্তরোত্তর রাজস্ব বৃদ্ধি করেই চলেছে। রাজা ও বোধহয় প্রস্তুতি নিচ্ছেন। অনেক সৈন্য সংগ্রহ করছেন এমন সংবাদ ইংরেজ রা পাবার পর রাজার বিরুদ্ধে সৈন্য দল নিয়ে মেজর হোয়াইট বর্ধমান অভিমুখে রওনা হলেন।
রাজা অনুমান করেছিলেন ই।
সেনপাহাড়ী কেল্লায় রাজা অবস্থান করছেন এই সংবাদ পেয়ে
মেজর হোয়াইট সৈন্য দল নিয়ে কেল্লা আক্রমণ করেন।
  কেল্লা অবরুদ্ধ হয়। কেল্লাদার হায়ার সিং কে বন্দী করা হয়।
কামান গুলি দখল করে নেওয়া হয়।
  রাজা কে কিন্তু পাওয়া যায়নি। তিনি তার আগেই কেল্লা পরিত্যাগ করেছিলেন।
ইছাই এর সময়ের গড় আর রাজা চিত্রসেন এর কেল্লা র স্মৃতি
রয়ে গেছে এখানকার এক স্থান নামে। মৌজা - গড়কেল্লা খেড়োবাড়ি। জে এল নং - ২৭।
আর মাথা উঁচু করে গৌরাঙ্গপুর মৌজায়  জে এল নং ২৮
দাঁড়িয়ে আছে ইছাই ঘোষের দেউল। ইছাই ঘোষের স্মৃতি বিজড়িত স্থানে অবস্থিত। দেবদেউল নয়। স্মৃতি দেউল।
সেনপাহাড়ী পরগনা ই আজকের কাঁকসা থানা এলাকা।
সেনপাহাড়ী নাম এখনও সরকারি রাজস্ব দপ্তরে ব্যবহৃত হয়।
------------ ------------ ------------ ------------ ------------ ------------ ৩ নং পাতা শেষ।

 


।। সে এক গ্রাম।।  ৪ নং পাতা আরম্ভ
সেনপাহাড়ী র জঙ্গল মহল তখন তার নামই হয়ে গেছে " লা মহল "। লা - মানে লাক্ষা বা গালা। পলাশ ; কুসুম ; কুল ; অর্জুন ; শাল ; পাকুড় এসব গাছে র ডালে বাসা বাঁধে লক্ষ লক্ষ লাক্ষা কীট। তাদের দেহনিঃসৃত রসে ই দেহ আবরণ তৈরী করে। সেই সব ডাল ভেঙ্গে আনে আদিবাসী মানুষেরা।
জঙ্গলের মধ্যে সরস্বতীগঞ্জ তখন তসর গুটিপোকার গুটি
বেচা কেনা র কেন্দ্র। খয়রা রা ভালো কাঠকয়লা তৈরী করে।
স্বর্ণকার মহলে এই কাঠকয়লার খুব কদর। আরও কত বনজ দ্রব্য। সবমাল  জঙ্গল থেকে ছোট ডিঙি নৌকো য় করে " রক্তনালা "
দিয়ে বনকাটির 'গড়ঘাটা ' হয়ে " পাষাণচণ্ডী " তলাকে বাঁয়ে রেখে সাতকাহনিয়ার কলাবাগানের ঘাটে এসে এখানে মাল তুলে চলে যায় গঙ্গাপুরের ঘাটে। তারপর ইলামবাজারের শিমুল তলার "সাহেব ঘাটে "। কখনও এ গাঁয়ের জন্য আলাদা নৌকো র ব্যবস্থা করতে হয়। ছোট খাটো গাঁ নয়। শোনা যায় ষাট ঘর তাঁতি আর ষাট ঘর কুমোর। এখানকার কুমোর দের জিনিসের কদর ই আলাদা। যেমন মাটির বোতল ; তেমনই
সব অন্যান্য জিনিস। এখানকার তাঁতিদের সব মাল যায় ইলামবাজার থেকে সুরুলে। মালাকার দের বাজি র খুব রমরমা। কি নাই এ গাঁয়ে। সব জাত আছে। কত পেশার মানুষ।
কত মানুষের আনাগোনা। মালপত্র বেচাকেনা। কারিগর দের
বিরাট গ্রাম। 
বোরেগী রা আছে। না জানি সে কোন কমললতা কি রামী র
প্রেমের স্মৃতি তে এক পুকুরের নাম " প্রেমসায়র "। পাড়ে তার
কর্মকার ; স্বর্ণকার দের পাড়া। কুমোর রা আছে গোটা গাঁয়ে ছড়িয়ে। ঘোষ ; সেন ; শীল ; কর ; বেণে ; দে ; গঁড়াই  রা আছে। আছে নানা পদবীর ব্রাহ্মনরা। লায়েক ; অধিকারী ; চক্রবর্তী ; মুখুজ্জে ; নানা পদবী। সেন বাবুরা উকিল। তাম্বুলী হালদার রা নানা ব্যবসা তাদের। ধান চাল মুড়ি মনোহারি মহাজনী।
" বুড়ো সাহেব " এর এখন বেশ নাম ডাক। প্রথম দিকে বনকাটির " রায় " দের সাথে দ্বন্দ্ব বেধেছিল। তারপর যাক আর অশান্তি হয়নি। যে সুফি সাধক এসে এগাঁয়ে আস্তানা পেতেছিলেন এখন তিনি বেশ প্রভাবশালী।তিনিই " বুড়ো সাহেব " নামে পরিচিত।  অনেক জমি পেয়েছেন বর্দ্ধমান রাজাদের কাছ থেকে। সে সব জমি চাষ করাবার জন্য আবার নিজেদের নিরাপত্তা র জন্য বিহার ঝাড়খণ্ড থেকে বেশ কয়েকঘর জোলা মোমিন কে নিয়ে এসেছেন। কয়েক পুরুষ আগেও এরা ছিল নিম্নবর্গের হিন্দু।
জাতপাতের জ্বালায় উচ্চবর্ণের অত্যাচারে ধর্মান্তরিত হয়েছে।
ভালো লাঠিয়াল ; তীরন্দাজ।
নদীর ওপারে নহনা ; কানুর ইত্যাদি গ্রামের অনেক মানুষ
এই সুফি সাহেবের ভক্ত শিষ্য হয়েছেন।  প্রতি সপ্তাহে তারা আসে।
নিম্নবর্গের এই সব মানুষেরা একদিন সহজযানী তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্মের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়ে মুক্তি র স্বাদ পেয়েছিলেন। তামার বলয় পরে " পোড়েল " রা হয়েছিলেন বৌদ্ধ স্তুপের পূজারী।
ডোমরা পুরোহিত। " ডোম্ব ডোম্বনী "দের তখন খুবই কদর। ডোম্বনীকে  বাদ দিয়ে তো আর "তন্ত্রের দেহসাধনা " সম্ভব নয়।
" দেহভাণ্ড ই যে ব্রহ্মাণ্ড "। দেহসুখের মাধ্যমে চিত্তসুখের সন্ধান। " সেনপাহাড়ী র জঙ্গলভূমিতে তখন তন্ত্র সাধনায় অনেকে মত্ত । তাঁদের দেবী "সুহ্মেশ্বরী "। তিনি বৌদ্ধ তারাদেবী।

তারপর সেই সহজযানী বৌদ্ধ ধর্মের শেষ অবশেষ ও মুছে গেল একদিন।
কেউ মুসলমান হলেন কেউ আউল বাউল বোষ্টম নেড়ানেড়ি র
দলে ভিড়লেন । এলেন " ধর্মঠাকুর "। এই বর্গের মানুষেরা আবার মনের মতো ঠাকুর পেলেন। বুধোরায় হলেন ধর্মঠাকুর। বা ধর্মঠাকুরের নাম হল " বুধোরায় "। শিব ও হলেন বুদ্ধেশ্বর শিব।
" সুহ্মরায় " হলেন আরেক ধর্মঠাকুর। 
ধর্মঠাকুর হয়ে উঠলেন রাঢ় দেশের সার্বজনীন দেবতা।
ধর্মঠাকুর এক অতি চমৎকার সংশ্লেষণের দেবতা। তাঁর মধ্যে মিশে গেছেন কত জন। প্রাচীন ধর্ম ; শিব ; বুদ্ধ ; যম ; সূর্য।
আবার মনে হয় তার মধ্যে ঘোড়ায় চড়া যোদ্ধা দের স্মৃতি ও
যুক্ত হয়ে গেছে।
ধর্মমঙ্গল কাব্যের বীর কালু ডোম হয়ে গেছেন কালুরায়।
১৩ ই বৈশাখ তাঁর পূজা।
অজয়ের এপার ওপার দুপার জুড়েই নানা থানে বিরাজ করছেন  মাটির ঘোড়ার স্তুপের মধ্যে বাবা ধর্মরাজ।
------------ ------------ ------------ ------------ ------------ ৪ নংপাতা শেষ

 


।। সে এক গাঁয়ের কথা।।  ৫ নং পাতা আরম্ভ।
সে এক গাঁয়ের কথা। যার কথার কোন শেষ নাই। আর কথা কবে কমে হয়েছে। সে হয় পাঁচ না হয় সাত কাহন কথা।
" অসুর কাহানী " র মতো "সাতকাহানী। অজয় তীরের জঙ্গল ভূমিতে প্রাগৈতিহাসিক যুগের মানুষরা বিচরণ করত। হয়তো লোহা পাথর থেকে লোহা গলিয়ে বের করার কৌশল জানা
" অসুর " জাতের লোকরা ছিল একদিন।   ।
    সাতকাহানী; সাতকাহন ;  সাতকাহনিয়া। নামেই তার মজা ভরা। কত কাহানী। সত্যি বলছি শুনে শুনে রাত কাবার হয়ে যাবে। তাই আগে নাম টা বলিনি। বললে তো অনেক কথা বলতে হয়। চারপাশের কথা না বললে ও বোঝা যায়না এ গাঁ কে।
" কাহন " -খড় গোনার এক বড় একক। চার আঁটিতে এক গণ্ডা। কুড়ি গণ্ডায় এক পন। ষোল পনে এক কাহন। মানে
১২৮০ আঁটিতে এক কাহন। এবার সাত কাহন। গল্প আছে সাত কাহন কড়ি দিয়ে কেনা এ গাঁ। কে যে কবে কার কাছ থেকে কিনেছিল তার কি আর হদিস মেলে ছাই। এত বড় ছড়ানো এ গাঁ যে সাত কাহন খড় বিছিয়েও কুলোয় না।
তিন ; পাঁচ ; আর এই সাত তো আমাদের পিছু ছাড়েনা।
সাত নিয়ে ই কত কথা। সাত পাকে বাঁধা।

গাঁয়ের মাঝখানে " বৈরাগী বটতলা "। কোন বাবাজী যে পুঁতে ছিল এর চারা সে কে বলবে! গ্রামের প্রাচীনত্বের স্মারক সে।
অতি প্রাচীন তমাল তলায় ছিল বুড়োবাবাজির আখড়া।
অনেক বাবাজী বোষ্টমের আখড়া ছিল একদিন। এখনও টিকে আছে এক আখড়া। এ গাঁ থেকে রাধারমণ বাবাজী হাতে হ্যারিকেন ঝুলিয়ে নদী পেরিয়ে যেত ওপারে ইলামবাজারে বলরাম বাবাজীর আখড়ায়। সে ও কি কম দিন হল।
এ গাঁয়ের ই মানুষ রজনীকান্ত হালদার।  তাঁর গুরু জয়দেব কেন্দুলী র কাঙ্গাল ক্ষেপাচাঁদ। সে আশ্রম ; মহোৎসব ল চলে।
" বুড়ো সাহেব "এর উত্তর পুরুষ রা সরকার কে জমি দান করেছিলেন। সেখানেই গড়ে উঠেছিল শতবর্ষ প্রাচীন " ডাকবাংলো "। অজয়ে র গতিবিধির উপরে নজর রাখার জন্য। বারবার বিধ্বংসী বন্যা  হয়েছে। সেই ১৭৮৭ থেকে ১৯৭৮ পর্যন্ত। ' ৭৮ এর স্মৃতি এখনও এখানের অনেকের কাছে দুঃস্বপ্ন।
অজয়ের দক্ষিণে বন্যার জল আটকানোর জন্য মাটির বাঁধ
দেওয়া হয়েছে। সে ও কম দিন হল না। শত বর্ষ পার করেছে।
বারবার সে মাটির বাঁধ ভেঙ্গেছে। ভেঙ্গে বন্যার জল বয়ে গেছে
অজয়ের এক প্রাচীন খাতে। " রূপাই চণ্ডী তলার পাশে রূপাই দহ হয়ে বসুধার কালীদহ। সেখান থেকে চলে গেছে পূর্বে মৌখিরা হয়ে পাণ্ডুরাজার ঢিবির দিকে। সেখানে গিয়ে আবার
মিশে গেছে অজয়ে  এই জলধারা। রূপাই চণ্ডী তলার পাশে ই
" রাজাপোতার ডাঙ্গা "। একটা ছোট ঢিবি। দহে একবার একটা প্রাচীন মাস্তুলের টুকরো পাওয়া গিয়েছিল। বোঝা যায় একদিন ; সে অনেক পুরনো দিনে এই জলপথ ব্যবহার হত।
এই " রূপাই চণ্ডী " তলার যাত্রার আসর ছিল খুবই বিখ্যাত।
কলকাতার সব বড় যাত্রাদলের নট নটী রা এখানে যাত্রা করে
গেছেন। বিখ্যাত " সত্যম্বর অপেরা র বাঁধা আসর ছিল।
যাত্রা দেখতে গোরু গাড়ির মেলা লেগে যেত। মানুষ আর মানুষ।

গাঁয়ের পুবদিকে ছিল বিশাল আমবাগান। কত রকমের আম।
কত তার নাম। খইনাড়ু ;  তলায় ছেলেদের দুপুরের ভিড়। আর তালগাছ। যেমন লম্বা। তেমনই তার তাল। এত তাল গাছ পুকুর পাড়ে যে জলে রোদ পড়ে না সহজে। আর সেই পাকা তালের
আঁটি চুষে বা তালের মাড়িতে দুটো মুড়ি কোনমতে যোগাড় করে সেই খেয়ে দিন পার করেছে এ গাঁয়ের গরীবেরা।
সে তো এই পঞ্চাশ ষাট বছর আগের কথা।
তারপর একদিন সেই বিরাট আমবাগান কাটা পড়ে গেল। বাবুরা বেচে দিলেন। একমাস ধরে তাঁবু খাটিয়ে করাতী রা
বাগান কাটল। বাবুদের বড় লোভ। সব না কি চলে যাবে। খাস হয়ে যাবে। তার আগেই বেচে দাও। এসব কথা  পরে বোঝা।
পুকুর পাড় গুলো ফাঁকা হয়ে গেল। সেই তাল খেজুরের সারি আর রইলো না। গ্রামসীমানার বড় বড় গাছ ; নালার ধারের সব গাছ ; এমনকি পুকুর পাড়ের বট ; অশ্বত্থ ও কাটা পড়ল।
পুকুরে চান করে দিদিমা ঠাকুমা মা মাসীরা পিতলের ঘটি করে
তার গোড়ায় জল দিত। বৈশাখে জলসত্রের সময় ভিজে বুট কলাই ; একটু গূড় ও দিতে দেখেছি। সব হারিয়ে গেল।

বাউরি রা এই গাঁয়ের অনেক পুরনো। কোঁড়া দের আনানো হয়েছে। নীলকুঠি র কাজে ; পুকুর কাটানো ; বা চাষের কাজের জন্য। নদী বাঁধ তৈরী র সময় অনেক মজুর লেগেছে।
মাল রা ও  সেই ভাবে এসেছে। কি ওস্তাদ না ছিল এই মাল আর কোঁড়া রা লাঠি খেলায়। হালদার বাবু দের পাহারাদার এর কাজ ও করেছে। বাবুদের খিদমতগারী করেছে কত জনে।
আরও কত কি! সহজে কথা ফুরাবে না। এত কথা আছে।
আছে সব গাঁ ঘরেই।
------------ ------------ ------------ ------------ ------------ ৫ নং পাতা শেষ


 

।। সে এক গাঁয়ের কথা।।
একদিন সবই ছিল। অধিকারী বামুনদের বিষ্ণু মন্দিরর সামনে দোল উৎসব ; লায়েক বাবুদের দুর্গাপূজা ; দশহরা ;
কোঁড়াদের মনসা পুজো ; হালদার বাবুদের সরস্বতী পুজো
আখড়ায় মহোৎসব এসব নিয়েই আনন্দে মাতত সেদিনের গ্রাম। ভরা ভরন্ত সে গ্রাম।
  তারপর একদিন বর্ধমান জ্বর ; ম্যালেরিয়া ; কলেরা ; প্লেগের
আক্রমনে গাঁ প্রায় উজাড় হয়ে গেল। যে যেদিকে পারল পালালো। কে যে কোথায় গেল! অনেক খুঁজেছি। তাঁতীরা অযোধ্যা ; ইলামবাজারের সুখবাজারে। অধিকারী ব্রাহ্মণ রা
রামচন্দ্রপুরে ; কলুরা ডাঙ্গাল বসুধায় ; মালাকাররা গুসকরায়
শীলরা ভুঁয়েরা ; লায়েক বাবুরা তাঁদের নিজেদের জায়গায়।
কুলটি চিনাকুড়ি। অনেকের কোন সন্ধান নাই। কে কার খোঁজ রাখে আর।
তবু মরেবেঁচে একদল রয়ে গেল সেই মরাগাঁয়ে। আজকের গাঁয়ের উত্তরে সে মরা গাঁ। মাটির ঘরের বাস্তুভিটা গুলো ছোট বড় ঢিপি। মোরাম চাতাল ; ডোবা ; শরঝোপ ; বৈঁচি ; বুনো কুলের ঝোপ। মাঝে মাঝে ফুটে ওঠে লতা কৃষ্ণচূড়া। ষাট তলায় বুনো বেলী ফুল ফোটে। কালীতলার লম্বা খেজুর গাছটায় থোকা থোকা খেজুর ধরে। বড় বাঁধের পাড়ে লম্বা ফলন্ত  জামগাছ টায় লম্বা রসালো টুসটুসে জাম এখনও ধরে।
বুড়ো সাহেবের আস্তানার চারপাশে লম্বা লম্বা তালগাছ গুলো
রয়ে গিয়েছে। কবরস্থান বলে।
পুরনো মানুষেরা আর কেউ নেই। সে সব গল্প বলবে কে। ডাকাতির  গল্প। মারামারি লাঠালাঠি র গল্প। বাবাজী বোষ্টমদের গল্প। বাউরী ঘরে নতুন কোন সুন্দরী বৌ এলো।
তারপর তার কথা। সরকার বাউরী ঘরের মেয়ে কে বিয়ে করল। হাঁকু মিঞা কুমোর ঘরের মেয়েকে বিয়ে করল। নাম হল তার কুলসুম। মোতি চাচা ডাকবাংলোর খালাসি। প্রতিদিন সে সাইকেল নিয়ে সাগরপুতুল পর্যন্ত যায়। তার দাপটে বাঁধে একটা গোরু ওঠার উপায় নাই। চাচা সাগরপুতুল থেকে নাগকেশর ফুল এনে দিত। কচি শ্যাওড়া ডাল থাকত তার ক্যারিয়ারে। ঘরের চালে গোঁজার জন্য সেই ডাল কত মেয়ে বৌ চেয়ে নিত। একটা নতুন র‍্যালে কোম্পানির " হাম্বার" সাইকেল
কিনে চাচা র কি আনন্দ। কাঁধে র গামছা দিয়ে সারাদিনে চার বার মোছে। বোঙ্গা কে ছেড়ে কালীদাসী কেন যে বটূর ঘর করতে গেল - যখন বটূর কুঠেরোগ ধরেছে জেনেও।
খাঁদী মাল গঁড়াই এর দোকানে খায়। তার ঘরের কাজ করে দেয়। গঁড়াই এর বৌ কবেই মরে গেছে। আছে এক মেয়ে।
তাকে নিয়ে খুব ভাবনা গঁড়াই এর।
কত কথা এসব নিয়ে। গাঁ ঘরের গল্প কথা। আর কে বলবে।
বলার বা শোনার লোক আর নাই।
   পুরনো গাঁয়ের মরা ঢিপি গুলো র উপরে ছেলেটা আনমনে ঘুরে বেড়ায়। মনে হয় এই সেই " মৃতের স্তুপ "। এর নীচেই আছে লুপ্ত সভ্যতা। মনে মনে সে রাখালদাস সাজে।
পশ্চিমের মোরাম চাতাল ই তার কাছে পামির মালভূমি।
বেণে পুকুরের উঁচু পাড় ই তার কাছে পাহাড়।
হেঁটে আসছেন হিউ য়েন সাঙ। দাদুর কাছে গল্প শোনে।
পশ্চিমে লাল সূর্য টা " পাষাণ চণ্ডী তলার বাগানের "নীচে নেমে
যায়।  ঐ পশ্চিম দিকে তাকাতে ই তার মন কেমন করে ওঠে।
ধীর পায়ে "  বাবাজী বটতলার " নীচে দিয়ে ঘরে ফিরতে হয়।
আর একটু পরেই বটগাছের প্যাঁচা গুলো ডাকবে।
  আখড়ার বালকমাতা ডেকে বলে ' এলি '?  চল তোকে ঘরে দিয়ে আসি। ও অন্নপূর্ণা  লণ্ঠন টা দে "।
দক্ষিণ থেকে কোনাকুনি একটা বাতাসের স্রোত বয়ে যায় উত্তরে। কি জানি কেন  মাতামা তার গায়ে ফুঁ দেয়। মাতামা জোড় হাত করে প্রণাম করে উপরের দিকে তাকিয়ে।
-  ও মা কাকে প্রণাম করছ
- সে তুই বুঝবিনা। চল। ওনারা যাচ্ছেন

  ঘরের বারান্দায় পানের বাটা নিয়ে দিদিমা বসে আছে।
  দাদু দেয়ালে ঠেস দিয়ে। এলাকার " বড়মাষ্টার "। ননীগোপাল চট্টোপাধ্যায়। নিজের হাতে গড়ে তুলেছেন অযোধ্যা প্রাথমিক বিদ্যালয় সহ এলাকার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল। যাত্রা ; নাটক ; গান বাজনা। তিনি গানের ও মাষ্টার।
  বাঁকুড়া জেলা থেকে এসে নদীতীরে র এই নিরালা গ্রামে বাসা
বেঁধেছেন। রজনীকান্ত হালদার মশাই দাদু দিদিমা কে খুব
  ভালোবাসেন। ভক্তিশ্রদ্ধা করেন।
 
  অন্ধকার রাতের আকাশে তারারা ঝিকমিক করে। মাথার উপরে কালপুরুষ। দাদু তাকে আকাশ চেনায়।পরিষ্কার  রাতের আকাশ দেখতে তার খুব ভালো লাগে। খুব ইচ্ছে করে পাশের
দালানবাড়ি র ছাদে উঠে আকাশ দেখে। তার মনে হয় ঐ আকাশে যেন কত কথা লেখা আছে।
কত কথা এ গাঁয়ের। " কথা তার কাহন সাতেক নামটি সাতকাহন "। সহজে ফুরায় না। কেউ ভোলে কেউ ভোলেনা।
রইল অনেক কথা বাকী। যেমন বাকী থেকে যায় জীবনের কত কথা।।
------------ ------------ ------------ ------------ -----------। - সমাপ্ত।
লেখক। ক্ষেত্র সমীক্ষক। প্রাবন্ধিক। লোক ইতিহাসের গবেষক


 

 










 




 

আমার জন্মদিনে শাকিলার লেখা

"দাদু গল্প বলতেন হিউয়েন সাঙ হেঁটে আসছেন পামির মালভূমির উপর দিয়ে। মরুভূমির মধ্যে দিয়ে।
আমার গাঁয়ের পশ্চিমে মোরাম চাতাল। উঁচু নীচু খোয়াই। খাদ। বর্ষায় প্রবল বেগে গিরি লাল জল নামে।
আমি হেঁটে বেড়াতাম সেই চাতালের উপরে। সেই চাতালই আমার পামির.."

এ-কথা যিনি লেখেন, তিনি কি কেবল ইতিহাসচর্চার জন্যই আঞ্চলিক ইতিহাস খোঁজেন?! নাকি, তাঁর অনুসন্ধিৎসার মূল প্রোথিত অন্য কোথাও? মূলই তো কাণ্ডের কথা বলে। চর্চার চালিকাশক্তি অনেকদূর পর্যন্ত নির্দেশ ক'রে দেয় চর্চার অবয়ব। নির্মিত হয় ঐতিহাসিকতার প্রকার, দৃষ্টিকোণ।

এই ইতিহাস-অনুসন্ধানী লেখেন..

"এই অজয়-ই আমার আমাজন। কী ভীষণ বর্ষায় তার বেগ!
'নামো পাড়া', মানে গাঁয়ের উত্তর-পশ্চিম দিকের মরে যাওয়া পোড়ো-গ্রাম। অজয়ের বন্যায় আর ম্যালেরিয়া, কলেরায় সেই বড়ো গাঁ কবেই শেষ হয়ে গেছে.. পড়ে আছে  কত না মাটির ঢিবি! গলে-ক্ষয়ে যাওয়া তবু টিকে থাকা দেয়ালের কোনা। 
তার মনে হত এই তার 'মহেঞ্জোদারো'! সেই ঢিবিগুলোর উপরে নির্জন দুপুরে ঘুরে বেড়াতাম। মনে সাধ--খুঁড়তে হবে।"

এবার আরও স্পষ্ট হয়, মূলের কথাটা..

ইতিহাস হিসাবে তাঁর লেখালিখির প্রামাণিকতা, নৈর্ব্যক্তিক তথ্যনিষ্ঠা প্রভৃতি বিচারের অন্য জায়গা আছে। আমি ইতিহাসের ছাত্রী নই, মাধ্যমিকে সবচেয়ে কম নাম্বারটা ইতিহাসেই পেয়ে পরের ক্লাসে বিষয় হিসাবে আর তাকে সঙ্গে রাখিনি। তবে তাঁর লেখা এমন গভীর অভিনিবেশে আমি কেন পড়ি!

কারণ, একটাই..
ওই ঢিবি আমারও মহেঞ্জোদারো.. আমার গাঁয়ের পশ্চিমে মোরাম চাতাল, উঁচু-নীচু খোয়াই, খাদ, কাঁদর বেয়ে বর্ষায় লাল-জল নামে.. ওই চাতাল আমারও পামির..

ইতিহাসের সাথে সাথে ভূগোলও ছেড়ে দিয়েছিলাম, তবে শাল-পিয়ালের বনে একদিন ছোটোবেলায় হঠাৎ আবিষ্কার করা আমার কাঁকর-মাটির নিচু টিলাটার মাটিটা ঠিক কতটা প্রাচীন--সে কথা যখন জানতে ইচ্ছে করে তখন বেশ বুঝতে পারি, যেকোনো জিজ্ঞাসার মূলেই থাকে সেই প্রাচীন মৌলিক ভাবদের একটি.. affinity..

আমার মাটিকে জানতে চাওয়া, আমার মাটির মানুষ, উদ্ভিদ আর বন্যপ্রাণীদের কথা শুনতে চাওয়ার সেই যে একটা দুর্নিবার আবেগ আর ইচ্ছেয় পেয়ে বসেছিল, ইন্টারনেটের কল্যাণ আমার সেই ইচ্ছের সাথে স্যারের লেখালিখির পরিচয় করিয়ে দেয়।
প্রথম দু-একটা লেখা পড়েই বেশ চমকে যাই.. সাহিত্যিকদের লেখা পড়লে যেমন হয়, কতকটা সেইরকমের অনুভূতি..
"আরে! এ তো আমার কথাই বলছে!"
"বলবে না-ই বা কেন? এক মাটি যে.."
ওই যে মানুষকে তার নিজের কথা শোনানো, এই এক ভূমিকাতেই কি তাহলে কোথাও গিয়ে সাহিত্য আর আঞ্চলিক-ইতিহাসকথা মিলে যায়? সেসব তত্ত্ব-অন্বেষণ এখন স্থগিত থাক, স্যারের লেখায় সাহিত্যগুণ যে আছে, তা অনস্বীকার্য। তাঁর একটা কবিতা দিই শেষে..

"ওরে বিষাদ বালক!
একটা ভাঙা দেয়াল বুকে পুরেই জন্ম তোর।
কোথাও কেউ লিখুক আর নাই লিখুক,
জন্ম তোর বিষাদ লগ্নে..

অঞ্জনা নদীতীরে চন্দনী গাঁয়ের সেই পোড়ো মন্দিরখানা,
জীর্ণ ফাটল ধরা,
সেই কবেকার বালকবেলায় 
তোর মনে গেঁথে গেছে..
ক্রুশের পেরেকে!
 
ভুলবি কি রে তুই?
  
তিনি তোর জন্যেই কবিতাটা লিখেছিলেন রে 
তা না হলে কি ওই ছবি 
ভেসে থাকে রক্তস্রোতে?
গেঁথে গিয়েছিল তোর জন্মক্ষণেই  রে বাপ 
তুই নিরুপায়.."

নিরুপায় হয়েই তবে ইতিহাস খোঁজেন তিনি?
আমাদের সবার জীবনেই এমন এক-একটি কবিতা থাকে, যাকে মনে হয়--এ তো আমারই জন্য লেখা! তারপর দেখতে দেখতে সেই কথামালা ধ্রুবতারা হয়ে উঠে দিক-নির্দেশ দেয়, ব'লে দেয় কতদূর তুমি যাবে..
যে কাজে কবিতা ডাকে, সে কাজ ইতিহাস হোক, বিজ্ঞান হোক, সাহিত্য যে সে হবেই, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না..
চলতে থাক এই অনুসন্ধান..
আমাদের কাছে বাধাহীন হয়ে এসে পৌঁছাক..
জন্মদিনের অনন্ত শুভেচ্ছা সেনপাহাড়ীর কথকঠাকুর, গোপভূমের ইতিহাসের অক্লান্ত সাধককে। সুস্থ থাকবেন।

** এই লেখা সাকিলা র। 
 আমার জন্মদিনে  আমার উদ্দেশ্যে লেখা।
বাংলা সাহিত্যের গবেষক ছাত্রী। 
 এটাই সেরা প্রাপ্তি। 
ভালো থেকো সা কি লা। 
 জীবনে প্রতিষ্ঠিত হও।

সে এক সব হারানো গ্রামের কথা

কথা - সাতকাহন।।
কত কথা তার।কথার কি আর শেষ আছে নাকি। লতার মতো বেড়েই যায়। বয়সে র কি গাছ পাথর আছে না কি।
'" কথা তার কাহন সাতেক  নামটি সাতকাহন "
সাতকাহন কড়ি দিয়ে কে যে কবে এ গাঁয়ের চৌহদ্দি   কিনেছিল তার হদিস কে দেবে গো আর। সাত কাহন খড় বিছিয়ে ও শেষ হয়না যে। এ গাঁ এত বড়। এত ছড়ানো।
তিনটি তার অংশ। সাতটি পাড়া। নাই এমন কোন জাত নাই।
গাঁ য়ে যে কত পুকুর আর ডোবা। ঘোষ ; বেনে ; মালাকার ; সেন ; শুঁড়ি ; বামুন ; দে ; শীল ; এই সব পদবী নামে পুকুর ডোবা তো আছেই। আছে গোলাম পুকুর ;। কিন্তু কে বলবে কেন পুকুরের নাম ' প্রেমসায়র '। ছিল অনেক বাবাজী বোষ্টম।
ছিল তাদের আখড়া। আছে বোরেগী গোড়ে। ছিল গোপাল সায়ের। গাঁয়ের মাঝে বিশাল সে বটবৃক্ষ। বৃক্ষ তুমি বট হে বটবৃক্ষ। নাম তার বাবাজী বটতলা। আছে অনেক পুরনো কালো তমাল। অতি শীতল তার ছায়া। বুড়ো বাবাজীর আখড়া নাকি ছিল সেখানে। গোটা গাঁ জুড়েই কুমোর আর তাঁতিদের বাস। কামার কুমোর ; ছুতোর ; মালাকার ; স্যাকরা ; বেণে কে নেই।তামুলী রা এসেছে। নানাবিধ ব্যবসা করে। পরবর্তী সময়ে এই তাম্বুলী বংশের রজনী কান্ত হালদার  কেন্দুলীর কাঙ্গাল ক্ষেপা চাঁদের প্রধান ভক্ত শিষ্য হয়ে নিজ পরিবারকে যথেষ্ট প্রভাবশালী হিসাবে গড়ে তোলেন।  অজয়ের দক্ষিণ পাড়ে কারিগর দের জমজমাট গাঁ।
এত তালগাছ যে মাটিতে রোদই পড়েনা। গা ছমছম পুকুর পাড়। নদী ধারে নীলের ক্ষেত। বাবাজী আখড়া। কলাবাগানের ঘাটে ছোট নৌকোর আনাগোনা। হাঁড়িরা খেয়া বায়। ওপারে নারানপুর। উদয়পুর ; ক্ষুদ্দুপুর ; ভরতপুর নানা গাঁ। এপার ওপার নিতি যাতায়াত। নীলক্ষেতে চাষের জন্যে কোঁড়া রা এসেছে। মাল রা আছে। কি তাদের শক্তপোক্ত চেহারা।
বাউরী রা আছে। আদি কয়েকঘর। ভালো ঘরামি। একেবারে সোজা মাটির দেয়াল তোলে। ঘর ছায়। খড়ের নৌকো চাল ওরা ছাড়া আর কে ছাইবে।

কুলুরা আছে। ঘরে ঘানি। ক্যাওট রা আছে। নদীতে মাছ ধরে।
এত পুকুর। মাছ চাষ করে। সবাই কে নিয়ে ভরা ভর্তি গাঁ।
  এই রকম নদী ধারের ছায়া শীতল এক গাঁ য়ে আজ থেকে প্রায় ২০০ বছর আগে নদী পার হয়ে এলেন এক সুফি সন্ত।
নাম তার সৈয়দ শাহ তকী। অন্য এক তথ্য অনুযায়ী সৈয়দ শাহ  তকী র  এক পুত্র সৈয়দ শাহ আলী জাওয়াদ  এসে এখানে এই অজয় তীরের নির্জন পরিবেশে তাঁর আস্তানা পাতেন।  ইরানের কেরমানি প্রদেশে তাঁর বাড়ি। সেখান থেকে এসেছেন আজমেঢ়ে। সঙ্গী হয়েছেন মির্জা পদবীর এক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি। শোনা যায় উচ্চ বর্ণের হিন্দু ঘরের মানুষ। সুফি সাধকের প্রভাবে সুফি ধর্মমত গ্রহন করেছেন।
সেখান থেকে নানা দেশ ঘুরে বীরভূমের খুস্টিগিরি। খুশ বা কুশ টিকুরী থেকে এমন নাম।
খুস্টিগিরি তখন সুফী সাধক দের অন্যতম কেন্দ্র। সেখান থেকেই নানা জন ছড়িয়ে পড়েন নানা দিকে।
এই গাঁয়ে এসে নদীর ধারে আস্তানা পাতলেন সৈয়দ শাহ তকী বা তাঁর পুত্র সৈয়দ  শাহ আলী জাওয়াদ।  এখানে এসেই তাঁর গুরু প্রদত্ত নিমের কাঠি তে পাতা গজিয়েছিল। যেখানে পাতা গজাবে সেখানেই আস্তানা গাড়বে। আর নিম কাঠিটি মাটিতে পুঁতে দেবে। গাছ হবে।
তিনি ইউনানি চিকিৎসা খুব ভালো জানতেন। সাপের কামড় ; পেটের অসুখ ইত্যাদি ভালো করতে পারতেন।
পরবর্তী কালে বর্ধমানের রাজা র মারাত্মক পিত্তশূল ভালো করে দিয়ে অনেক জমি জায়গা লাভ করেন। খ্যাতি তাঁর ছড়িয়ে পড়ে নানা দিকে। অনেকে তাঁর ভক্ত শিষ্য হন।
নদীর ওপারে এপারে। তিনি সেই সময় অত্যন্ত প্রভাব শালী মানুষ হয়ে ওঠেন।
  তাঁর স্ত্রী কি তাঁর সঙ্গে এসেছিলেন! জানা নেই।
তাঁর ২/৩ পুত্র। এক পুত্র সম্ভবত নিঃ সন্তান ছিলেন।
সেই বংশের গোলাম পাঞ্জাতনের দুই পুত্র। সাহামত আলী  এবং ঈশাহক আলী। সাহামত আলী র পুত্র সৈ সামসুজ্জোহা বিশেষ ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। শ্বেত শুভ্র পোষাক।
স্বল্প ভাষী। ইশাহক এর পুত্র আহম্মহ রেজা পরবর্তী জীবনে খুবই নামী হোমিও চিকিৎসক হয়েছিলেন।
হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা র একটা পরম্পরা তাঁদের পরিবারে এখনও আছে।
সামসুজ্জোহা র দুই পুত্র। বদরুদ্দোজা এবং সাদরে আলা।
বদরুদ্দোজা র স্ত্রী বীরভূমের রাজনগর এর এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে। অত্যন্ত সুন্দরী ; ব্যক্তিত্বময়ী মহিলা।
তাঁর বাবা ও ছিলেন ডাক্তার। ইব্রাহিম ডাক্তার। মা কিন্তু এই গ্রামের।  সায়রা বিবি এবং রাবিয়া বিবি দুই বোন।
এঁরা বুড়ো সাহেবের আদি বাড়িতে থাকতেন। অত্যন্ত ব্যক্তির ময়ী মহিলা। চেহারা ও তেমন। পারিবারিক বিবাদ বিরোধের নিষ্পত্তি করতেন দক্ষতার সাথে।
তখন কার সময়ে মাটির দেওয়ালের দোতালা বালাগাছি বাড়ি
যথেষ্ট আর্থিক সামর্থ এর পরিচায়ক। টিনের ছাউনি হলে তো কথাই নেই।
সামসুজ্জোহা মহাশয়ের পূর্বমুখী দোতালা বালাগাছি বাড়িতে
দোতলার বারান্দায় ছিল অনেক দামী বই। আমার ছিল সেই বাড়িতে অবাধ যাতায়াত। সেখানেই আমি খুঁজে পাই বাংলায় লেখা ভাই  গিরীশ চন্দ্র সেনের মহাগ্রন্থ ' কোরান শরিফ "।সেই বই নিয়ে পড়ার চেষ্টা করি। উপলব্ধি তো সহজ নয়। তবু চেষ্টা করি। বয়স তো তখন অল্প। তবু কিছু জ্ঞান লাভ করি।
সৈয়দ মহম্মদ এর বাবার ছিল অনেক বাঁধানো বই। তাঁরা অবশ্য সেই আলমারী তে কাউকে হাত দিতে দিতেন না।
বাংলা বই কমই ছিল। আরবী ; ফার্সি ; বা উর্দুতে লেখা।
ইসলামি শাস্ত্রে তাঁর ছিল অগাধ জ্ঞান। উত্তর প্রদেশ থেকে
পড়াশোনা করা মানুষ। অত্যন্ত রাশভারি মানুষ।  পরবর্তী জীবনে সৈয়দ মহম্মদ ইউনানি এবং হোমিও চিকিৎসা য় দক্ষতা লাভ করেছিলেন। নিজেও ছিলেন ইসলামি শাস্ত্রে সুপণ্ডিত।
অপর শাখার অর্থাৎ বুড়ো সাহেবের বড় ছেলের বংশ ধর মহম্মদ আলী। তাঁর পুত্র আয়ুব আলী। আয়ুব আলী র পুত্র আনায়ারুল হক। আমরা ফণী মামু বলতাম।
আবার ননী মামু বলতাম যাঁর ভালো নাম মহম্মদ কাশেম।
পিতা - সৈয়দ মহম্মদ মুসা। ঐ পিতা  একই ব্যক্তি মহঃ আলী।
সৈয়দ মহম্মদ এর কথা আগে বলেছি। পুরো নাম সৈয়দ মহম্মদ ইয়াসিন। এঁরা বাইরে থেকে এসেছিলেন। সরাসরি বুড়ো সাহেবের বংশধর এঁরা নন।
বড় তরফের আর একজন ছিলেন। তাঁর এক বংশধর সৈয়দ মহম্মদ আমিন। বাবলু ছিল ডাকনাম। সে মারা গেছে। তার ভাই বেঁচে আছে। অন্যত্র থাকে।

সরু গলি রাস্তার দুই পাশে সারি দিয়ে সব বাড়ি। সবই বুড়ো সাহেব বা শাহ তকী র বংশধর দের। মসজিদ পর্যন্ত সরু রাস্তা চলে গেছে। মসজিদের পিছনে বুড়ো সাহেবের সমাধি মন্দির। তা আজ বহুদিন ভগ্ন স্তুপ। তালবন আর নানা গাছের ভিড়ে তাঁর সেই সমাধি। যে নিমডাল তিনি পুঁতেছিলেন তা পরে বৃক্ষ হয়েছিল। প্রবীণ রা তা দেখেছিলেন। পরে গাছটি মারা যায় অত্যাচারে। স্মারক হিসাবে সেই গাছের ছাল ছাড়িয়ে নিতে নিতে।
  আমাদের গ্রামের এই সম্ভ্রান্ত সৈয়দ বংশীয় রা প্রাপ্ত জমি চাষের জন্য এবং নিজেদের নিরাপত্তার জন্য বর্তমানের ঝাড়খণ্ড থেকে কয়েকটি মোমিন মুসলিম পরিবার কে নিয়ে আসেন। সংখ্যায় আজ তাঁরা অনেকটা বেড়েছেন। পরিশ্রমী মানুষ। নিজেদের পরিশ্রমে আর্থিক অবস্থা র যথেষ্ট উন্নতি ঘটিয়েছেন তাঁরা।
বরং তাঁদের আনয়ন কারী সৈয়দ বংশীয় রা নানা কারণে আর্থিক ভাবে দূর্বল হয়ে গেছেন।
কিন্তু এঁদের মধ্যে আছে সেই পুরনো মর্যাদা বোধ। সম্ভ্রান্ততা।
বূড়ো সাহেবের সাথে যে মীর্জা উপাধি র সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি এখানে কিছু দিন বসবাস করার পর  ঘুড়িষা গ্রামে বসবাস করার পর
স্থায়ী হন রাইপুর সুপুর  নিকটস্থ এক নদী তীরবর্তী গ্রামে।
আমার অত্যন্ত প্রিয় মানুষ মোল্লা কামাল দা একবার আমাকে অনুসন্ধানের জন্য বলেছিলেন। কামাল দা এক অসামান্য সর্বশাস্ত্র বিদ পিতার সুযোগ্য পুত্র।
তাঁর পিতা মহান শিক্ষক মোল্লা আবদুল হালিম সাহেবের ধর্ম বিষয়ক বক্তৃতা যে না শুনেছেন তিনি বুঝতে পারবেননা যে কোন উচ্চতা র মানুষ ছিলেন তিনি।
  আমার সে সন্ধান জারি আছে। যেতে হবে নানা জায়গায়।
এই করোনা কাল আমাদের অনেক সময় কেড়ে নিল।
করারই বা কি আছে। কোথাও যে বের হব সে সাহস পাচ্ছিনা।
  জানিনা কবে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরব।
  অনেক কাজ যে বাকী পড়ে আছে।
   " সমস্ত ধুলোর মধ্যে মিশে থাক স্তব
  তোমার পায়ের মুদ্রা থেমে থেমে যাবে " - শঙখ ঘোষ।

এ মাটিতে মিশে থাক আমার প্রণতি।
---------------- ----------- ----------- ----------- ----------- ©  প্রণব ভট্টাচার্য।
তথ্য সহায়তা।  সৈয়দ হোসনে জামাল। সুখ্যাত আমিন।
বুড়ো সাহেবের উত্তর পুরুষ।

এই আমার " সব হারানো গ্রামের কথা - সাতকাহনিয়া "
 এই লেখা দিয়েই শুরু হবে পরবর্তী বই

গণক মামা। স্মৃতির সরণি বেয়ে

।।  গণক মামা।। 
 তিনি আসতেন বসুধা গ্রাম থেকে। মাঠ, ঘাট পেরিয়ে।কয়া মাঠ, কামারপাড়ার দো জমি, রূপুটে পাড়ার ভিতর দিয়ে,  পায়ে হেঁটে। 
 পায়ের ধুলো ধুতেন আমাদের ঘরে এসে। কোন কোন দিন দুপুরের আহার এখানেই। যা জুটত। খুব তৃপ্তি করে খেতেন। 
 খুব সামান্য জিনিস ও আমার দিদিমার হাতের গুনে চমৎকার রান্না হয়ে যেত। সে পুঁই চচ্চড়িই হোক বা শাক পোস্ত। ছোট ছোট  মাছের ঝাল। সে স্বাদ আজও যেন মুখে লেগে আছে। 
 হাতমুখ ধুয়ে গামছায় মুখ মুছে , মাটির ঘরের উঁচু দাওয়ার বারান্দায় 
 দাদুর পাশে বসতেন। একটা আসন পাতা হত। হাতে বোনা কারুকাজ করা বসার আসন। শাড়ির পাড় থেকে সুতো তুলে কি চমৎকার সব আসন বুনতেন আমাদের মা - মাসীরা। 
 তারও আগে দিদিমা, ঠাকুমা বা পিসিমা দের দল। দুপুর টা কাটত সেভাবেই। 
 আর একটা আসনের উপরে গণকমামা খুব যত্ন করে তাঁর 
 লাল শালুতে মোড়া পাঁজি পুঁথি খুলতেন। 
 দাদুর নির্দেশে তাঁর সামনে বসতে হত। তিনি মাথায় পাঁজি ঠেকিয়ে কি সব মন্ত্র বলতেন অস্ফুট স্বরে। 
 তারপর তার সামনে আমার ছোট্ট হাতটা পাততে হত। 
তিনি খুব মনোযোগ দিয়ে হাতের রেখা গুলি দেখতেন। 
 তারপর তাঁর যা বলার তিনি দাদুকে বলতেন। একটা কথা মনে থেকে গেছে এর বৃহস্পতির স্থান খুব ভালো। ইত্যাদি। 
 এই রোগা পটকা, মা মরা ছেলে টাকে নিয়ে, মায়ের বাবা দাদুর খুব চিন্তা। সে চিন্তা সর্বক্ষণের। এ ছেলে বাঁচবে তো। 
 কি এর ভবিষ্যৎ। কে যে দেখবে এই ছেলেকে। তাঁর ভয় তাঁদের অবর্তমানে কি গতি হবে এই ছেলের। আর যে কেউ দেখার নাই। বাবা তার আছে। কিন্তু থেকেও যে নাই। 
 গণক মামা দাদুর ও হাত দেখতেন। মৃত্যু রেখাটা ভালো করে দ্যাখো শম্ভু। 
 তারপর দাদুর সাথে গ্রহ, নক্ষত্র, তিথি, রাশি, বার এসব নিয়ে অনেক আলোচনা হত। আমি চুপ করে শুনতাম। মন দিয়ে। 
 তারপর আস্তে আস্তে সেখান থেকে সরে গিয়ে বাইরের দরজার আড়ালে নিজের হাত টাকে খুব ভালো করে দেখতাম। 
 এই হাতের রেখাগুলোতে লেখা আছে ভাগ্য ভবিষ্যৎ। 
 আকাশের গ্রহ, নক্ষত্র রা তাদের প্রভাব ফেলছে! 
 এই গণক মামা তাহলে আকাশের গ্রহ, নক্ষত্র গুলিকে ভালো চেনেন। মনে হত তাঁকে গিয়ে বলি, ও মামা রাতে থেকে যাও। 
 অন্ধকার আকাশে সব তারারা ফুটে উঠুক। 
 চল হালদার দের দালানে র ছাদে গিয়ে আকাশ টা কে ভালো করে দেখি। ততদিনে দাদু কালপুরুষ,লুব্ধক,  সপ্তর্ষিমণ্ডল, 
 বৃশ্চিকরাশি এসব আমাকে চিনিয়েছেন। আমাদের সেই মাটির ঘরটা ছিল একটু নীচু তে। উত্তরে বড়সড় কয়েকটা তালগাছ। আমাদের উঠোন থেকে পুরো আকাশ টা কে দেখা যায়না। আহা গাঢ় অন্ধকার রাতের আকাশ কি সুন্দর। একবার মাত্র ঐ দোতালা দালানে র উপরে উঠে ছাদ থেকে 
 সে আকাশ দেখেছিল। উত্তরের ধ্রুবতারা টাকে খুঁজে পেয়েছিল। কত নীচে পর্যন্ত আকাশের তারারা জোনাকির মতো আলো দিচ্ছে। এত তারা !  " আজি যত তারা তব আকাশে "  দাদু এই গানটা শেখাতেন। ইস্কুলের ছেলেমেয়েদের 
গাইতে হত। তাঁর সঙ্গে। 
 অনেক তারা তিনি আমাকে চিনিয়েছিলেন। কিন্তু -
 আমার মনে হত গণক মামা কে বলি যে মামা, আমার মা মরে গিয়ে কোন তারা টা হয়ে গেছে গো। সেই তারা টাকে আমাকে চিনিয়ে দাও। আমাকে যে বলেছে তোমার মা ঐ আকাশে একটা তারা হয়ে গেছে। সেখান থেকে তোমাকে দেখছে। 
 কোন তারা টা,  গণক মামা আমাকে চিনিয়ে দাও। 
 আমি বড় হয়ে তোমাকে অনেক টাকা দেব। 
 তোমাকে কষ্ট করে গাঁয়ে গাঁয়ে ঘুরতে হবেনা। 
 তিনি এ বাড়ি থেকে চলে যাবার সময় তার পিছু পিছু গেছি। 
 ভেবেছি বলি। কিন্তু বলা আর হয়নি। 
 ------------ ------------ ------------ ------------ ------------ শেষ

Monday, 30 September 2024

গা ছমছম

।। গা ছমছম।। 

 কি বলছেন!  গা ছমছম করবেনা। 
 বসে আছেন ঝাঁকড়া বটগাছ তলায়। তাঁতি পুকুরের পাড়ে। 
 হয়তো একা নয়। দুজন আছেন। তখন রাতের দিকে একবার পুকুর দিকে আসা অনেকের অভ্যেস ছিল। 
 ঝড় নাই জল নাই শোঁ শোঁ বাতাস নাই। হঠাৎ ই একটা বটডাল ভেঙে পড়ল আপনার পায়ের কাছে। 
 ঝুরঝুর করে বালি পড়তে লাগল। 
 আর থাকা যায়। ঝাঁকড়া তেঁতুল গাছ থেকে উড়ে গেল রাতের পাখি একটা পাখা ঝটপট করে। 
 আর এখানে থাকা যায়। 
 একবার  রাজমিস্ত্রী দের দল এখানে ডেরা বেঁধেছিল। থাকতে পারেনি। 

# ওটা কি রে বাবা। বিড়াল টা যেন অনেক বড় হয়ে যাচ্ছে। 
 রাস্তা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে। একবার রাস্তার ওধারে যাচ্ছে। 
 কেমন যেন চেহারা পালটে যাচ্ছে। 
 আঁকুড়ে দের ধর্ম রাজ থানের বটতলা র কাছে। 
 আর আপনি রাস্তা পার হতে পারেন! 
 গলা তো শুকিয়ে কাঠ। গলা দিয়ে কোন আওয়াজ বের হচ্ছেনা। উঁহু এরাস্তা য় পার হওয়া যাবেনা। 
 পাশেই গাঁয়ের বাইরে উত্তর দিকে পাশাপাশি দুই পুকুর। 
 মাঝখানে র জায়গা মুখগ্নির। তার ও নীচে গবাদি পশু মারা গেলে ফেলার জায়গা। মুচি রা চামড়া ছাড়িয়ে নিয়ে যায়। 
 তাঁতি পুকুরের পাড়ের খুব লম্বা লম্বা তালগাছ থেকে নেমে আসে শকুনেরা। মরা পশুর মাংসে তাদের মহাভোজ। 
 এমন এক জায়গা! 
 এ জায়গা পার হওয়া।

 সাতকাহনিয়া গ্রামের হালদার বাড়ির দালানে গানবাজনার আসর বসেছিল। অযোধ্যার  যাত্রা দলের পালার বাজনা, 
মিউজিকের রিহার্সাল হচ্ছে।  বনকাটির নবকিশোর সূত্রধর বেহালা সঙ্গত করতে গিয়েছিল । মাষ্টার মশাই ননীবাবু হারমোনিয়াম ধরে। তিনিই মোশন মাষ্টার। প্রত্যেক দৃশ্যের সাথে উপযুক্ত বাজনা চাই।  
 নদীর ওপারের উদয়পুরের রাধাশ্যাম দাসএসেছে। ভালো গায়। বিবেক এর গান। বাঁকুড়া থেকে তারিণী এসেছে। ফ্লুট আর সানাই দুই ই বাজায়। ভালো দম। তবে তার জন্য বোতল লাগে। 
গলায় ঢকঢক করে ঢেলে, বাইরে থেকে এসে,  ধরে ফ্লুট।  বেশ কয়েকটা দৃশ্য হতে হতেই  রাত হয়ে গেল বেশ। 
 সূত্রধর মশাই  আর কি  রাস্তা পেরিয়ে যেতে পারা যায়! 
 বেরিয়েও   ফিরে গেল সাতকাহনিয়া।  সাথে লোক নিতে হল।  হাতে হ্যারিকেন। । সারা রাস্তাই নির্জন। আঁকুড়ে পাড়া, তেঁতুল তলার বাউরি পাড়া সব ঘুমিয়ে আছে। নিঝুম সেদিনের উঁচু নীচু হাটতলা। 
 হাটতলার পশ্চিমে বিরাট পাকুড় গাছ । কামার দের পাকুড়, বটতলা। তার দক্ষিণে এক ডোবা। সাদা শালুক ফুটে আছে। 
 আকাশে সামান্য জোৎস্নার আলো। 
 একটা কালো সদ্যোজাত বাছুর কেবলই রাস্তার এপাশ আর ওপাশ করছে। মাঝে মাঝে যেন তার রঙ বদলে যাচ্ছে। 
  চুপ করে পাকুড় তলায় দাঁড়িয়ে থাকতে হল। 
 একসময় সে ছানা বাছুর ডোবার জলে ঝাঁপ দিল। 
 এ যে বাছুর নয় কোন, বুঝতে কি আর বাকি থাকে। 
 শেষ পথ টুকু রাম রাম জপতে জপতে জায়গা টা পার হল 
 নবকিশোর। এ অন্য আরেক দিনের কথা। 

# সাতকাহনিয়া আর ডাঙ্গাল আদিবাসী পাড়ার মাঝখানে 
 ঘণ শাল জঙ্গল। জঙ্গলের ভিতরে গোরু গাড়ি চলার পথ। 
 আদিবাসী পাড়ার মুখটায় চৌমাথা। 
 এখানে প্রায়ই লালশালু, মাটির ভাঁড়, সিঁদুর লাগানো পাতা, 
 কাটা মুরগী র রক্ত,কাঠের  আঙার  প্রায়ই দেখা যায়। আদিবাসী মানুষ রা 
 এখানে ভূত ছাড়ায়। 
 অত সহজ এই রাস্তায় হাঁস বা মুরগী হাতে ঝুলিয়ে কেউ 
 যায়। বা মাংস নিয়ে। 
 একবার বনকাটির রামদাস মিস্ত্রী র ডাক পড়েছে ডাঙ্গাল গ্রামের ঘোষ বাবুদের ঘরে,  কিছু ভালো কাজ হয়তো হবে। 
 খাসি ছাগল কাটা হয়েছিল। ভোজ হবে। প্রায় ই হয়।  কিছুটা মাংস সে পেয়েছিল। 
 গামছায় বেঁধে, থলিতে ভরে ফিরছে। যাবে বনকাটি। জঙ্গলের মুখে 
 চৌমাথার মোড় থেকে তার মনে হচ্ছে কেউ পিছু পিছু আসছে। 
  আরও জোরে । পা ফেলছে। হঠাৎ ই বনকাটির পচুই মদশাল থেকে ফিরছে ঠাকুর মাঝি। হাতে লম্বা লাঠি। 
 দেখে চিনতে পারল। বলল যা চলে যা। আমি এই এখানে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমাকে কেউ ছোঁবেনা। তবে তোকে ছুঁয়েছে। 
 যা। ঘরে গিয়ে বুঝতে পারবি। 
 যাক। ঘরে এসে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। 
 কি ওটা! 
 - না, কিছুটা মাংস আছে। ভালো করে রাঁধো দিকি। 
তো। তেল মসলা নুন ঝাল যেমন দেবার দিয়ে যথাসাধ্য ভালো করে রান্না করল মিস্ত্রীর  স্ত্রী। 
 আহা!  মাংসের ঝোল দিয়ে ভাত। আর কি লাগে! 
 কিন্তু  এ মা। একি! 
 কি হল! 
 খেয়ে দ্যাখো। তাহলেই বুঝতে পারবে। 
সত্যিই তো। স্বাদহীন ট্যালটেলে ঝোল। কোন স্বাদই নাই। আর মাংসের টুকরো গুলো যেন মাংস নয়। যেন চালকুমড়োর ঝোল। এ কি খাওয়া যায়! 
 হঠাৎ ই তার মনে পড়ল ঠাকুর মাঝি র কথা। তোকে একটু ছুঁয়েছে। যা ঘরে গেলে বুঝতে পারবি। তার গা শিউরে উঠল। 
 খাওয়া উঠল মাথায়। ভয়ে কাঁপুনি আর থামেনা যেন। 
# অযোধ্যা গ্রামের উত্তরে বিশাল আমবাগান। মোটা মোটা মোটা গুঁড়ি। মাথায় মাথায় ঠিকে আছে। দিনের বেলাতে ও 
 ছায়া ছায়া অন্ধকার যেন। একটা ফলন্ত জামগাছ তলা দিয়ে গোরু গাড়ি চলার বালি মাটির পথ। রাস্তা কিছুদূর গিয়ে বাঁক নিয়েছে পশ্চিমে। ডানপাশে তালগাছ ঘেরা পুকুর। 
 বাঁশবাগান। আর আঁকড় গাছের ঝোপ। এই রাস্তায় সহজে কেউ সন্ধ্যে বেলায় পা বাড়ায়না। দু ঘর ডোম বাস করত। 
 পরে উঠে যায়। রাতের বেলায় বাঁশ ঝোপে কারা যেন খেলা করে। মাঝে মাঝে মনে হয় যেন বাঁশের বনে ঝড় লেগেছে। 
 এই রাস্তা তেই একটা কালো বিড়াল কে দেখা যায়। কালো বিড়াল না কি অন্য কিছু। কখনও মনে হয় বিড়াল আবার কখনো মনে হয় অন্য কোন জন্তু। 
 আর দেখা যায় সাদা শাড়ি পরে কেউ রাস্তার ধারে বসে কাঁদছে। সরু, খনা সুরে। যেন কাউকে ডাকছে। তার চারপাশে 
 সেই জন্তু টা গোল করে ঘুরছে। 
 হঠাৎ হঠাৎ মাছ লাফিয়ে ওঠে নাপিত পুকুরে। যেন মনে হবে জাল টেনে কেউ মাছ ধরছে। কিন্তু কেউ কোথাও নেই। 
 ঘরের এই উত্তর দিকে মুখ মানে দরজা রক্ষিত রা  সবাই বন্ধ করে দিয়েছে। 
 # আর পাষাণ চণ্ডী বাগান। আমগাছে ভর্তি। নীচে নানা ঝোপ। 
 পাশেই কাঁদর। কাঁদরের পাড়ে বিরাট বিরাট অর্জুন, চাকলতা গাছ। আরও কত রকমের গাছ। পাশেই শ্মশান। 
 কাঁদরের উপর বাঁশের সেতু। ওপারে পঞ্চানন বাবু এসে শর মানা পরিষ্কার করে চাষযোগ্য জমি তৈরি করেছেন। ফল বাগিচা তৈরি করছেন। ওপারে যাওয়া টাই একটা ব্যাপার। 
 বাঁশের সাঁকো তে উঠলে মচমচ করে। মনে হয় ভেঙে পড়ে যাবে। 
 তো। এপারের ডাঙ্গার পাশে  মুচি পাড়া। আর বাঁশবাগান। 
 বেশ কিছু বেল গাছ। কানাই মুচি র ঘর।। মুচি পাড়া থেকে রাত পাহারা দিতে পঞ্চানন বাবু র বাগানে যায় কেউ কেউ। 
 আর চলে যায় শেষ বিকেলে ই। কেননা ঐ শ্মশানের পাশে ঝাঁকড়া গাছটা। কি যে গাছ, কেউ নাম জানেনা। ঐ গাছে তো তাদের আস্তানা। লম্বা লম্বা পা ঝুলিয়ে বসে থাকে সব। 
তবে সেদিন হল এক কান্ড। রামা আর বামা যাচ্ছে পঞ্চানন বাবু র মাঠে। সেদিন সন্ধ্যে হয়ে গেছে। অন্ধকার রাত। পশ্চিম আকাশে একফালি চাঁদ। 
 বাঁশের সাঁকো তে উঠতে যাবে এমন সময় দেখল খালপাড় দিয়ে  সাতকাহনার হাঁড়ি পাড়ার  দিক থেকে কেউ বোধহয় আসছে। কে তা আঁধারে বোঝা যায়না। কিছুটা কাছে এলে 
 বোঝা গেল এক উলঙ্গিনী। মাথায় তার মাটির হোলায় আগুন জ্বলছে। ঝাঁকড়া গাছটায় শুরু হয়ে গেল যেন হুটোপুটি। 
 এই দৃশ্য দেখে আর সাঁকো পার হবে কি, উল্টো দিকে, নিজেদের পাড়ার দিকে দিল ছূট। বাবা গো মা গো। 
 তারপর এমন জ্বর এলো যে যে সে জ্বর ছাড়ল সাত দিন পর। 
 রায়দের কালীথানের ওষুধ খেয়ে আর ঝাড়ফুঁকে। 

# ইনি না কি তিন  মাদনাবুড়ো  বা  মহাদানার ছোট ভাই। ঝাঁকড়া শ্যাওড়া গাছের তলায় তার আটন। নিমটিকুড়ি যাবার পথে 
 তিনি বিচরণ করেন। তাঁকে পার হয়ে যাওয়া সহজ নয়। 
 কখনও তিনি বাঘের পিঠে চেপে থাকেন। আবার কখনো সাদা 
 বিড়াল বা গোদানা। আবার কখনো বিরাট সাপ।  রাস্তা য় এপার ওপার করছে। কতজনা যে এখানে ভিমরি খেয়ে পড়েছে তার ঠিক নেই। জয় বাবা, জয় বাবা করে এখনও পার হয় কতজনা। এ জায়গা পার হবার সময় বুক ঢিপ ঢিপ করে। 
এমন কত জায়গা যে ছিল  তখন, যেখান দিয়ে যেতে গেলেই  গা ছমছম। বুক ঢিপ ঢিপ। গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠা । 
  তেনারা সব গেলেন কোথা!  না কি রয়ে গেছেন এখনও। 
 কোথাও থাকুন আর না ই থাকুন অনেক মানুষের মনের আঁধারে  তাঁরা থেকে যাবেনই। ভূত, প্রেত, দৈত্য, দানা,
 শাঁখচুন্নি, আরও কত ভূতিনী, প্রেতিনী চরে বেড়াচ্ছে 
 মনের কানাগলিতে। 
------------ ------------ ------------ ------------ ------------  সমাপ্ত 
আজ একটু  অন্য রকম গল্প করি। 
রাতে যদি ভূতের স্বপ্ন দেখেন, লিখে জানাবেন। 
 মন্তব্যের ঘরে। ওঝা রেডি আছে।

Sunday, 11 August 2024

মানকর খাণ্ডারী

।।  মানকর  -  খাণ্ডারী ।। 
 
" জীবন আমার নাম, মানকরে মোর ধাম, জিলা - বর্ধমান। "
 ' মানই যার কর - সেই গ্রাম মানকর '
 ' পরে তসর খায় ঘি, তার আবার অভাব কি ' 
 ' কদমার ভিতরে ভরা কনের বিয়ের লাল চেলি টি '
 " কেমন কারিগর, থাকেন মানকর, 
  লাল চেলি ভরা থাকে কদমার ভিতর। "
 

 ' আছেন যেথা মানিকেশ্বর, নামটি তাহার মানকর '

 প্রাচীন এক জনপদ মানকর। কত প্রাচীন?  
 জনশ্রুতি অজ্ঞাতবাসের সময় পঞ্চ পাণ্ডব না কি এখানে এসেছিলেন। অবস্থান করেছিলেন। পৌষমুনির ডাঙ্গা বা পাণ্ডব ক্ষেত্র তলার ঐতিহাসিক প্রাচীনত্ব নির্ণীত হয়নি। 
 ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সার্ভেয়ার জেনারেল রেনেল সাহেবের ম্যাপে  মানকর ( Mankur)  উল্লেখিত। প্রাচীন এক রাস্তা বর্ধমান থেকে বেরিয়ে মানকর হয়ে চলে যাচ্ছে উত্তর পশ্চিমে 
 আদুরিয়া গ্রামকে পাশে রেখে সেনপাহাড়ী পরগনার ভিতর দিয়ে অজয় পার হয়ে আরও উত্তরে রাজনগর পর্যন্ত। 
 কনৌজ ব্রাহ্মণ রাই মানকরের প্রকৃত জমিদার। 
 বর্ধমানের রাজা দের কাছ থেকে তাঁরা ব্রহ্মোত্তর হিসাবে মানকরের রাইপুর এলাকা টি পান। পরবর্তী সময়ে সেখানেই 
 নির্মান করেন জমিদার বাড়ি  ' রঙ মহল '। 
 আদিতে এঁদের পদবি দুবে। মথুরায় বৈষ্ণব রাধাবল্লভ সম্প্রদায়ের  কাছে দীক্ষা নিয়ে তারা গোস্বামী হন। 
 মূলত সংস্কৃত শিক্ষা প্রদান এবং গুরুগিরি করার উদ্দেশ্যে ই 
 তাঁদের বাঙ্গলায় আগমন। প্রথমে মেদিনীপুর এর চন্দ্রকোনা। 
 পরে  এখানে আসেন। 
  এঁরা কিন্তু মানকর থেকে  উত্তর পশ্চিমে সামান্য দূরত্বের 
 খাণ্ডারী গ্রাম টিকে বেছে নেন নিজেদের বসবাসের জন্য। 
  নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার জন্যই কি এই সিদ্ধান্ত। 
  যে ভূমি খণ্ডে তাঁরা বসবাস স্থাপন করলেন - তাই হল খাণ্ডারী। অনুমান মাত্র। 
 মূল মানকরে তারা প্রথমে বাসা বাঁধেন নি। পরে রাইপুর এর
 জমিদারি পাবার পর মানকরে প্রাসাদ নির্মান করেন। 
 মানকর ছাড়াও ভরতপুর, খাণ্ডারী তেও ভূসম্পত্তি লাভ করেছিলেন। 
 গুরুদীক্ষা এবং গুরুদক্ষিণা ঃ  বর্ধমানের রাজা জগৎরাম এবং রাণীমা ব্রজকিশোরী দেবী কে দীক্ষা দেন পণ্ডিত শ্যামসুন্দর গোস্বামী। 
 তাঁর পুত্র ভক্তলাল গোস্বামী দীক্ষা দেন রাজা কীর্তি চাঁদ এবং তাঁর পুত্র রাজা চিত্রসেন কে। 
 গুরুদক্ষিণা স্বরূপ ১৭২২ সালে রাইপুর এলাকার জমিদারী সত্ত্ব লাভ করেন ব্রহ্মোত্তর সম্পত্তি হিসাবে। 
 রাধাবল্লভ মন্দির এবং সিংহবাহিনী মন্দির নির্মান করেন 
 ১৭২৯ সাল নাগাদ। 
 ভক্তলাল পরবর্তী বংশধর গন হলেন অজিতলাল, ব্রজলাল, 
 সেতাবলাল। 
 অজিতলালের দৌহিত্র  হিতলাল মিশ্র। এঁকে মানকরের অন্যতম রূপকার হিসাবে গণ্য করা হয়। নানা জনহিতকর কাজ তিনি করেছিলেন। আজকের হাটতলা তাঁরই পরিকল্পনা য় গড়ে ওঠে। মানকর থেকে বুদবুদ পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার করেন। 
 সৌন্দর্যায়নের জন্য রাস্তার দুই পাশে তালগাছ লাগানোর ব্যবস্থা করেন। বারোটি বাঁধানো ঘাট সমেত এক বিশাল দিঘী  যার নাম  ' কৃষ্ণগঙ্গা ' খণন  করান। সেই সময় ভীষণ খাদ্যাভাব এবং জলাভাব দেখা দিয়েছিল। কৃষ্ণগঙ্গা খণনের মাধ্যমে অনেক শ্রমজীবী মানুষ কাজ পেয়েছিলেন। 
বিদ্যানুরাগী এই মানুষ টি  পুঁথি সংরক্ষণের জন্য  " ভাগবতালয় " নামে এক গ্রন্থাগার গড়ে তোলেন। কয়েকটি টোল স্থাপন করেন। তাঁর সময়ের বিশিষ্ট পণ্ডিত দের মধ্যে 
গদাধর শিরোমণি, নারায়ণ চূড়ামণি, যাদবেন্দ্র সার্বভৌম, 
 প্রভৃতির নাম উল্লেখযোগ্য। 
তিনি গীতা র টীকা রচনা করেছিলেন। যার প্রশংসা করেছিলেন সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র। 
 হিতলাল মিশ্র র ব্যবসায়িক বুদ্ধি ছিল প্রখর। তিনি নীলকুঠি র
  ও  মালিক ছিলেন। 
 
 অসাম্প্রদায়িক মনোভাবের হিতলাল এবং তাঁর পূর্বজ ভক্তলাল গোস্বামী মুসলমানদের জন্য মসজিদ এবং খ্রিস্টান দের জন্য চার্চ নির্মান করিয়েছিলেন। 
  হিতলালের পুত্রের অকালমৃত্যু তে  দৌহিত্র রাজকৃষ্ণ দীক্ষিত, 
 জমিদার হন। তিনিই তৎকালীন সময়ের বাংলার জমিদার দের মধ্যে প্রথম, যিনি স্বদেশী আন্দোলনে (১৯০৫)  অংশগ্রহন করে 
কারারুদ্ধ হয়েছিলেন। তাঁর সময়ে  রঙমহলে অনেক স্বদেশী 
 গোপনে আসতেন। আলোচনা হত। তাঁরা আর্থিক সাহায্য লাভ করতেন। 
 রাজকৃষ্ণ পুত্র রাধাকান্ত। তিনিও অকালপ্রয়াত। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী শক্তিবালা দেবী কাঞ্চন কুমার দীক্ষিত কে উত্তরাধিকারী হিসাবে গ্রহণ করেন। তিনিই ' রঙমহলের ' শেষ 
 জমিদার। 
 ------------ ------------ ------------ ------------ ------------ ------------ 
 খাণ্ডারী গ্রামে এখনও কয়েকঘর কনৌজ ব্রাহ্মণ বাস করেন।
 ' অগ্নিহোত্রী ' পদবী। এই গ্রামের পঞ্চরত্ন, টেরাকোটা অলংকরণ শোভিত রাধাগোবিন্দ  মন্দির টি নির্মান করিয়েছিলেন  
 শান্তিময় তেওয়ারি র পূর্ব পুরুষ গন। আনুমানিক ১৮৫০ নাগাদ নির্মিত। 
 পাশের অষ্টকোনাকৃতি  গৌরীশ্বর শিবমন্দির টি অগ্নিহোত্রী পরিবারের। সৌগত অগ্নিহোত্রী জানালেন। 
মানকরে প্রায় ৪০-৪২ টি মন্দির। প্রায় সমসময়ে নির্মিত। 
 এই সব মন্দির কে নিয়ে আলাদা প্রবন্ধ পরবর্তী সময়ে প্রকাশিত হবে। 
------------ ------------ ------------ ------------ ------------ 
অতি সংক্ষেপে মানকর বা মানকরের কনৌজ ব্রাহ্মণ দের
 সম্পর্কে  এই প্রবন্ধে বলা হল।  মানকর এক প্রাচীণ জনপদ। 
 এবং যথেষ্টই বিস্তৃত। আকারে প্রকারে। অনেক সম্ভ্রান্ত পরিবার। অনেক ভগ্নাবশেষ। সংরক্ষণের অভাবে ভেঙে পড়েছে। যেমন ' রঙমহল '  ' কবিরাজবাড়ি ' ইত্যাদি। 
------------ ------------ ------------ ------------ ------------ ------------ 
©   প্রণব ভট্টাচার্য। 
------------ ------------ ------------ ------------ ------------ ------------

Friday, 2 August 2024

সামান্য আমি। আমার কিছু কথা।

আমার যে ধারাবাহিক চলছে 
" কুঠি বাড়ি ভিত্তিক ব্যবসা বানিজ্য। সে টা থামিয়ে আজ একটু অন্য রকম কথা বলি 
 কথা তো লতার মতো। 
 আমি এর আগে আপনাদের কাছে বারবার বলেছি এই সকল কথা 
দেখুন আমি খুব সাধারণ মানুষ। লেখাপড়া তেমন হয়নি। যেমন টা হলে মনে করা যেত কিছু একটা বটি। 
 নিজের লেখা বই নাই। 
ISSN  কোন পত্রিকা র সম্পাদক ও নই 
অতি সামান্য এক সাধারণ আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চাকারী মাত্র। 
এই চর্চা আমার অনেক দিনের 
 বলতে পারেন সেই কোন বালক বেলায় আমার মনে গেঁথে গিয়েছিল  অঞ্জনা নদী তীরে চন্দনীগাঁয়ে    পোড়ো মন্দির খানা গঞ্জের বাঁয়ে 
 জীর্ণ ফাটল ধরা  এককোনে তারি 
অন্ধ নিয়েছে বাসা কুঞ্জবিহারী 
আমার মন কেমন করত      ঐ ভাঙ্গা মন্দির 
 অন্ধ ভিখারি ৷    লেজ কাটা কুকুর  ---
ঐ ভাঙ্গা মন্দির টা আমার বুকে গেঁথে গেছে সেই কবে কার  বালকবেলায় 
ভাঙ্গা মন্দির দেখলে দাঁড়িয়ে পড়ি। 
 এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে ছুটে যাই এখনও 
 খুঁজি তার গড়ে ওঠার ইতিহাস 
আবার আজকের করুন দশা 
 আর্থ সামাজিক পরিস্থিতি টাকে বোঝার চেষ্টা করি 
পত্তন আর পতনের মাঝে তো একটি মহামুল্যবান "ত"।
তার খোঁজ পণ্ডিতেরা জানেন 
 আমি কোন পণ্ডিত নই। একাডেমিক লোক ই নই 
 গবেষক। কোন ভাবেই নই। 
 আমি চেয়েছি আমার চারপাশ টা বুঝতে
 মানুষ । মানুষ ই তো সব। 
 চাই মানুষ তার মাটির কথা জানুক। চিনুক নিজের শিকড়। শিকড় বিচ্ছিন্ন এই জাত 
 যদি সামান্যও পারি। 
কাঠবিড়ালি র মতো 
 মোটা মোটা দামী বই কোথায় পাব। 
 কেনার সামর্থ্য ছিলনা 
অনেক দামী বই  পুরনো মাটির বাড়িতে নষ্ট হয়ে গেছে 
যা গেছে তা গেছে 
আমার এই এলাকা কাঁকসা আউসগ্রাম এর জঙ্গল মহল  ইছাইঘোষ এর দেউল  অজয়ের এপার ওপার নিয়ে কুড়ি কিলোমিটার ব্যাসার্ধের জায়গায় আমার ঘোরাঘুরি 
 এখানেই এখন লিখি৷ এই ফেসবুকে র পাতায় 
কেউ আমন্ত্রণ না জানালে কোথাও লিখিনা 
আমার কোন উচ্চাশা নাই 
অনেক সময় ফেলে এসেছি। মনকে ই বলি " তুই ফেলে এসেছিস কারে - মন মন রে আমার 
 তবু আমার লেখা আপনাদের ভালো লাগে 
 চমৎকার সব মন্তব্য লিখে আমাকে প্রাণিত করেন 
 আপনাদের ধন্যবাদ 
 কি করব বলুন গবেষক এর মতো প্রতিটি বাক্যের তথ্য সূত্র দিতে পারিনা 
ভুলে গেছি কোথায় পড়েছি যেন 
রেফারেন্স বই এর খোঁজে কোথায় যাব বলুন 
 কে দেবে আমাকে বই 
এখন দিচ্ছে এই মাধ্যম। পাচ্ছি নানা পি ডি এফ 
 একবার সাময়িক সদস্য হয়ে এক বিশ্ববিদ্যালয়ের 
 সেণ্ট্রাল লাইব্রেরি তে গিয়েছিলাম দিন কতক 
 আমার দরকার ছিল  মাৎস্য ন্যায় পর্ব 
 একান্তে শুনলাম যে দামী দামী সব বই অধ্যাপক দের দখলে ই থাকে। তাই থাক 
 কোন পণ্ডিত তো আর উপেক্ষিত  অবজ্ঞাত গ্রামের ভাঙ্গা মন্দির টির কথা আপনাদের শোনাবেন না। না কোন গবেষক 
   আমি চেষ্টা করি 
আমি চেষ্টা করেছিলাম একটা পুকুরের নাম কেন 
" সন্ধান "। খুঁজে ছিলাম তার কথা কাহিনী 
 অনেক পণ্ডিত আমার লেখা পড়েন। 
লাইক ও দেননা। মন্তব্য তো দূরের কথা। ভাবি সত্যিই তো তাঁরা ওজনদার। আমার পোষ্ট তো নূতন কিছু নয়। তাতে লাইক দিয়ে নিজের ওজন কমাবেন কেন - 
 এই আপনারা এখানে যাঁরা আছেন তাঁদের ভালোবাসাই আমার পাথেয় 

কেউ কাউকে মনে রাখেনা 
 আমি চেষ্টা করেছিলাম মাত্র
এই কথাটি কাকে বলব     মনে রেখো

রয়ে গেল আরও কিছু কথা     বাকি 
 আমি যেন  সেই  বাতি ওয়ালা 
 মাটির প্রদীপ হাতে দাঁড়াই    ঘন অন্ধকারে
পথের বাঁকে

গঞ্জ ইলামবাজার।

https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=pfbid036CeXoPnTHkm1MPkrEVf4sJFsAWKBbR28Mc9kvPssBZVdPovY9S8m9ouBUm45RufUl&id=100003636821328

ঐ তো তোমার ঘর। কথা - সাতকাহন

।। ঐ তো তোমার ঘর।।  কথা সাতকাহন।

-  কি  ব্যাটা কে নিয়ে এলি না কি রে! 
- কই, দেখি, দেখি 
 
রাস্তার পাশেই উঁচু ভিতের পাকা বৈঠক খানা ঘরের দাওয়ায় বসে আছেন এক বড়সড় চেহারার মধ্যবয়সী মহিলা।

- হ্যাঁ। 
বলেই একটা সরু গলির মতো প্রবেশ পথে ঘরে প্রবেশ।
এ ঘর বাবার নয়। জ্যাঠা দের। পাশেই কাকার পাকা বাড়ি।
তার পিছনে একেবারে পিছনে একধারে বাবার ঘর।
তাকে সবাই দেখছে। জ্যাঠাইমা তাকে তার মায়ের গল্প শোনালো। সে মানুষ গুলো কে দেখছিল।
সমবয়সী জ্যাঠতুতো দাদা র সাথে সহজেই বন্ধুত্ব হয়ে গেল।
পরদিন ঘরের সামনের রাস্তা দিয়ে গ্রামের পশ্চিম দিকে।
এদিক টাই এসে তার খুব ভালো লাগলো। বিশাল দিঘী। সায়র। তার উত্তর দিকটা পাথর বাঁধানো। রাজাদের আমলের।
পাশাপাশি বেশ কয়েকটা পুকুর। লাল মোরামের রাস্তা চলে গেছে আর ও পশ্চিমে। দক্ষিণ দিকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে একটা
পাহাড়। পরে জেনেছে পঞ্চকোট। পশ্চিম দিকে বেশ কয়েকটি
ছোট পাহাড়। একটা পাহাড়ের মাথায় মন্দির দেখা যাচ্ছে।
ফুলবেড়িয়া। ওখানে না কি মেলা বসে পূজার সময়।
রাস্তার ধারে এক অশ্বত্থ গাছ। সেই গাছের নীচে দাঁড়িয়ে সে চারপাশ দেখতে লাগলো। এই দিকটা তার খুব ভালো লেগে গেল। মনে হল ঐ যে রাস্তা চলে গেছে উঁচু নীচু হয়ে - সেটা দিয়ে হেঁটে যায়। উঁচু চাতালের উপরে সাঁওতাল পাড়া।
সাইকেল নিয়ে একজন নেমে আসছে ঐ রাস্তা দিয়ে।
  পশ্চিম দিকে  শুঁড়ি পাড়া। তারা না কি  বড়লোক। পাশেই ধোপা পাড়া। সেই পাড়াতে একটা কুয়ো। একজন  মহিলা জল তুলছিল।হাতমুখ ধুয়ে , তার জল খেতে ইচ্ছে হল।
সঙ্গে আছে জ্যাঠতুতো দাদাভাই সাধন।  তাকে তো চেনে। আমি কে জিজ্ঞেস করল। সে বলল আমার ভাই। কাকার ছেলে। প্রথম এসেছে।
- না ঠাকুর আমি জল দিতে পারবনা। আমার পাপ হবে।
সে ভাবতে লাগলো     কিসের পাপ! 
একটু জল দেবে মাত্র।
- চল ঘরে যাই। ঘরে গিয়ে খাবি।
রাতে বিছানায় শুয়ে সে ভাবতে লাগলো সেই যে এক চণ্ডালিনী বৌদ্ধ সাধুকে জল দিতে চায়নি,নীচু জাতের মেয়ে বলে,  সেই 
সেই মেয়ের হাত থেকেই তিনি জল খেয়েছিলেন। প্রথাও  ভেঙেছিলেন। 

 তাহলে কি সেইসব পুরনো প্রথা রয়েই  যাবে -
 চিত্র ঋণ ঃ  বিকাশ ভট্টাচার্য

আমার কিছু কথা।

সকলকে আন্তরিক ধন্যবাদ।
আমার আগের পোষ্ট টির প্রেক্ষিতে। এত চমৎকার সব মন্তব্য আপনারা করেছেন। আমি কৃতজ্ঞ। 
আমাকে ভালোবাসায় ভরিয়ে দিলেন। 
বেশ ভারী মন নিয়েই লেখাটি লিখেছিলাম। কিছুটা আবেগতাড়িতভাবে। 
অবশ্য আমার লুকানোর কিছু নাই। আমি এত সামান্য যে আমার আর কি আড়াল!  
এক বিশিষ্ট মানুষের মন্তব্য আমাকে এই লেখা লিখিয়েছে। 
তাঁকে ধন্যবাদ। নমস্কার। 
আবার শুরু করব। 
গল্প বলিয়ে মানুষ। আঞ্চলিক ইতিহাসের। বন্ধুরা ভালোবেসে ডাকেন সেনপাহাড়ী র কথক ঠাকুর বলে। 
কতজনকে কত কথা ও কাহিনী শুনালাম আজ পর্যন্ত। 
কত বিশিষ্ট মানুষ এলেন গেলেন থাকলেন " তেপান্তর নাট্য গ্রামে "। তাঁদের জন্য আঞ্চলিক ইতিহাস এর গল্প শোনানোর একটা সেশন থাকে। 
কত জনকে নিয়ে ঘুরলাম। তাঁদের এই এলাকার মানে আমার " সেনপাহাড়ী পরগণা " র গল্প শোনালাম। এক বন্ধু এই মাত্র জিজ্ঞেস করলেন সেনপাহাড়ী কি!  স্বাভাবিক প্রশ্ন। 
বাঙ্গলার বিখ্যাত সেন রাজা দের পূর্বপুরুষ রা কর্ণাট দেশ থেকে এসে প্রথমে এই " গড় জঙ্গল " এলাকায় বসতি স্থাপন করেন। নাম তাই সেনপাহাড়ী পরগণা। 
আমার কথা নয়। পণ্ডিত প্রবর সুকুমার সেনের কথা। এখনও চালু আছে রাজস্ব দপ্তরে। বলতে পারেন মোটামুটি এখনকার কাঁকসা থানা এলাকাই 
পরগণা সেনপাহাড়ী। এই নিয়ে আমার লেখা কত জায়গায় যে আছে। 
 আমার " মাটির প্রদীপ। আঞ্চলিক ইতিহাস। প্রণব ভট্টাচার্য এর লেখালেখি। এই ফেসবুক পেজ খুলে দেখতে পারেন। 
 মাত্র দশ টাকা দামে অনেকগুলি পুস্তিকা লিখে ছাপিয়ে ছিলাম। সাধারণ মানুষের জন্য। আমি পণ্ডিত নই। পণ্ডিতদের জন্যও নই। যদিও আজকাল পি এইচ ডি  করছেন এমন অনেকে আসেন আমার কাছে। আমি বলি ভাই আমি পথে হাঁটা মেঠো মানুষ। এই জঙ্গল দেশের মানুষ। আমার কাছে!  
আমি এই ভাবেই গুণী জন সমাবেশেও  বলি। 
অধ্যাপক তমাল দাশগুপ্ত তাঁর সপ্তডিঙা ফাউন্ডেশনের পক্ষে মহাবোধি সোসাইটি হলে বক্তা হিসাবে ডেকেছেন। গেছি - বলেছি সেই আমার এই এলাকার কথা। ইছাই ঘোষের দেউল সংক্রান্ত নানা কথা। তাঁদের কে ধন্যবাদ জানাই এই অবসরে।
 বাঙ্গালী শিকড় বিচ্ছিন্ন জাত। বাঙ্গালী কে তাঁর শিকড়ে ফিরতে হবে। জানতে হবে তার গৌরবোজ্জ্বল অতীত। আজকের অনেক বাঙ্গালী কে ছিলেন অতীশ দীপঙ্কর জানেন না।বাঙ্গালী নিজেকেই চেনে না।  বাংলাদেশেও দেখেছি একই অবস্থা। আমি অতীত বিলাসী নই। বা শুধু অতীত যাপন করতে চাইনা। কিন্তু আমার ঐতিহ্য। সেই ঐতিহ্য এর প্রতি আমি শ্রদ্ধাশীল।  আমার অতীত কে আমি জানবনা। তমাল বাবু ভালো গবেষক। বাঙ্গালী র অতীত নিয়ে খুব ভালো  কাজ করছেন। আশার কথা এলাকার ইতিহাস নিয়ে এখন অনেকে ভালো কাজ করছেন। 
ডকুমেন্টটেশনের কাজ ভালো হচ্ছে। 
চাই মানুষ তার মাটির কথা জানুক। তার লক্ষ্যে যেখানে যে আমাকে ডাকেন আমি যাই। বলি আমার এলাকার কথা। তার প্রতিবেশী এলাকার কথা। নদীর ওপারে বীরভূম। আমাদের এক পা ওপারে আর এক পা এপারে। সীমান্ত এলাকা। 
সীমান্ত এলাকা। তাই নিত্য যাতায়াত। পারাপার। 
 আপনারা অনেকে ই জানেন গ্রামে গ্রামে ঘুরি। 
গ্রাম তো উপেক্ষিত অবজ্ঞাত। কেন্দ্র থেকে দূরে। 
 সেই গ্রামের একটা ভাঙ্গা মন্দির নিয়ে কার ই বা
আগ্রহ থাকতে পারে। 
 কিন্তু আমাকে টানে। কখন গড়ে উঠল। সেই সময় আর ধীরে ধীরে ধ্বংস হয়ে গেল। এই সময়কাল। 
 বোঝার চেষ্টা করি তার আর্থ সামাজিক পরিস্থিতি। 
 আর এখানে ছবি দিয়ে সেই গ্রামটির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস আপনাদের শোনাই। ধন্যবাদ জানাই এই মাধ্যম কে। এই ফেসবুকে আমার অনেক লেখা। 
 সেই ২০১২ থেকে। কত ভালো ছবি হারিয়েছি। 
 টেকনিক্যালি অতটা দক্ষ নই। নিজে নিজে শিখেছি। ছাত্রদের কাছে শিখেছি। ওরা বার বার বলে স্যার ল্যাপটপ নেন। আমি বলি আর শিখে উঠতে বোধহয় পারবনা রে। এই ভালো - 
 সব সময় সকলকে সঙ্গ দিতে পারিনা। এই যেমন সেদিন একজন  বিশিষ্ট মানুষ গেলেন অন্য আরেক জনের সঙ্গে। বললাম ইলামবাজারের দু টি মন্দির দেখে যান ঘুড়িষা। সেখানের দু টি মন্দিরের কাজ দেখুন। তারপর যান জয়দেব  কেন্দুলী। দেখুন রাধাবিনোদ মন্দিরের কাজ। 
 এবার তুলনামূলক আলোচনা করুন। 
 আমাকে অনেকে সঙ্গে চান। পারিনা। সবসময়। 
আবার সুখ্যাত ট্যুর অপারেটর অভিজিৎ বাবু (ধর চৌধুরী ঐতিহাসিক গাইড হিসাবে ডেকে নেন। 
 এই এলাকায় এলেই। 
 মৌখিরা কালিকাপুর  কত মানুষ কে নিয়ে গেছি। 
আমার নিজের খুব প্রিয় জায়গা। মন্দির আর প্রাসাদ নগরী। হেরিটেজ ভিলেজে র দাবী এখানে বারবার লিখে সরকারের নজরে আনতে চেয়েছি। 
 অযোধ্যা বনকাটি তেমনই মন্দির ময়।
 অতি বিখ্যাত অপূর্ব টেরাকোটা অলংকরণ সজ্জিত গোপালেশ্বর শিব মন্দির। ১৭৫৪ শকাব্দে নির্মিত। 
বিখ্যাত এখানকার  পিতলের রথ। তার অলংকরণ নিজে চোখে না দেখলে বিশ্বাস হবে না।। 
 ইছাই ঘোষের দেউল  যাবার পথের উপরে। 
অথচ অনেকে না জানার জন্য মিস করেন। 
হেরিটেজ ট্যুর এখন বিদেশে খুবই জনপ্রিয়। 
 সরকার একটু  ভাবুন। 
আসবেন। এই এলাকায়। যদি হাতে সময় নিয়ে আসেন বা তেপান্তর নাট্য গ্রামে থেকে ঘুরতে চান 
 হয়তো বা আমাকে সাথে পেতে পারেন। 
 না পেলে গল্পের সেশন তো থাকবেই। 
এখানে থাকা খাওয়ার খরচ শান্তিনিকেতনের আশেপাশের রিসর্ট থেকে অনেক কম। 

আসবেন। করোনা ভীতি দূর হোক। এখন সাবধান থাকাই ভালো। এখানের শান্ত পরিবেশে অবশ্য তেমন ভয় নেই। 
 বনবিভাগের উদ্যোগে গড় জঙ্গল এলাকায় ট্রেকিং এবং দিনের বেলায় থাকার ব্যবস্থা হচ্ছে। ভালো। 
আমার সব পুস্তিকা শেষ হয়ে গেছে। বারবার ছাপা হয়েছে।। ইছাইঘোষের দেউল। গড় জঙ্গল এবং দেবী শ্যামারূপা। পরগণা সেনপাহাড়ী ঃ কাঁকসা থানার সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত। 
অযোধ্যা বনকাটি সাতকাহনিয়া গ্রামের ইতিকথা। 
এই সব। 
সাধারণ মানুষ তার মাটির কথা জানুক। 
এই ছিল আমার লক্ষ্য। 
ভেবেছিলাম একটা  সিরিজ করব। 
 কি জানি আর কতটা পারব।
 #Illambazar   ইলামবাজার কে কেন্দ্র করে, মূলত কুঠিবাড়ি ভিত্তিক ব্যবসা বাণিজ্য কে কেন্দ্র করে একটা ছোট বই প্রকাশ পেয়েছে। 
  " এলেমবাজার নিলামবাজার ইলামবাজার "
সংগ্রহ করতে পারেন। দাম ২০০/ টাকা। 
অক্ষর যাত্রা প্রকাশনীর আনন্দগোপাল হালদার কে ফোনে অর্ডার দিলেই বাড়িতে বসে বই পেয়ে যাবেন। ওঁর নং 9474907307

- * ফেসবুক লেখাটি ফিরিয়ে দিল। আর আমিও দিলাম আপনাদের দরবারে। এর মধ্যে অনেক কিছু বদলে গেছে। 
 পণ্ডিত মানুষ তমাল বাবু আমার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন। আরও কেউ কেউ করেছেন। খুব স্বাভাবিক। আবার কত বিদগ্ধ পাঠক দের বন্ধু হিসাবে পেয়েছি।

Friday, 26 July 2024

কথা- সাতকাহন। সেই ছেলেটা ভেলভেলেটা


।।  সেই ছেলেটা  ভেলভেলেটা ।।  কথা সাতকাহন।

ছেলেটা কাঁদছে তো কাঁদছেই।
মা তো শুয়ে আছে ভিতরে র বারান্দায় এককোনে।
তার না আছে ক্ষমতা। বুকে দুধ নাই। বুকের কাছটিতে ছোট্ট পুঁচকে টা কে টেনে নেবার অধিকার ও নাই। ডাক্তার বাবুর নিষেধ। কোন রকমে বলে ' ও মা দ্যাখো, কাঁদছে খুব '।
রান্নাঘর থেকে দিদিমা এসে মুখে দুমুখ ওয়ালা কাঁচের মাইপোশ ধরিয়ে দেয়। ঘরের গোরুর দুধ। চুষতে চুষতে আবার ঘুমিয়ে যায়।
  গরীব মানুষ দের ছোট্ট গাঁ। একটু বড় হলে, অনেকে তুলে নিয়ে যায়। নিজের বুকের দুধ ও খাওয়ায় কেউ কেউ। যেমন
তুলসী। জাতে বাউরি। নিজের ছেলেকে খাইয়েও, এ ছেলেকে
খাওয়ায়। দিদিমা বলে নিয়ে যা। নিয়ে যা। তোদের কোলেই বড় হোক।
এ ছেলে বাঁচতে কি না,  বড় হবে কিনা সে দুশ্চিন্তা দাদু দিদিমা র মনে পাক খায় অবিরত। মেয়ে যে বাঁচবে না তা যেন মনে গেঁথে গেছে। চিকিৎসা!  আর চিকিৎসা। কম তো হলনা।
ইলামবাজার থেকে কালী বাবু আসেন। ইঞ্জেকশন দেন।
এই ইঞ্জেকশন কিনতে কিনতেই প্রায় সর্বস্বান্ত হয়ে গেছে।
এত দাম। ফাঁকা শিশি গুলো কেও যেন ফেলে দিতে পারা যায়না।
গোয়াল ঘরের মাচা থেকে একটা বেশ পুরনো ঢাকনা ওয়ালা
বেতের ঝুড়ি নামিয়ে পরিষ্কার করে, সেই মেয়ের চিকিৎসার যত শিশি, বোতল, ইঞ্জেকশন এর শিশি ছিল এক কোনে জড়ো করা  দাদু সব এই ঝুড়িতে রেখে দেয়।
---- এগুলো জমিয়ে কি হবে । ধুয়ে জল খাবে? 
--- দাদু কোন উত্তর দেয়না।
  বিকেলের রোদে দড়ির খাটিয়া টা বারান্দা থেকে উঠোনে বের
করে দেওয়া হয়। সকাল বিকেলের রোদ গায়ে মাখতে বলা হয়েছে। বুক পর্যন্ত একটা চাদর ঢাকা।
সেই খাট থেকে মেয়ে আকাশ দেখে। ঘরের পিছনে লম্বা তালগাছ দেখে।উঠোনের সজনে গাছে  কাঠবেড়ালী গুলো লেজ তুলে তুলে ওঠা নামা করছে। খেলছে। একদৃষ্টিতে সে  তাকিয়ে থাকে।
সামনের জয়ন্তী গাছটায় অনেক ফুল এসেছে। দুর্গাপূজার সময় অনেকে নিতে আসে। স্থলপদ্ম গাছটা ফুলে ফুলে ভরে গেছে।
আকাশে একফালি রাঙা মেঘ ভেসে যায়।
আখড়া থেকে মাতামা এসে মাথার কাছে একটা মোড়ায় বসে
বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়ে।
---  আজ কি তিথি গো মাষ্টারবাবা?
   কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে  বলেন  পাঁজি দেখতে হবে।
সেই রোগগ্রস্ত মেয়ে বলে ওঠে  তিথি  বারে কি হবে গো মাতা!
অশ্লেষা, মঘা কিছু দেখার দরকার নাই "
  ---  কি হবে এসব দেখে
  বৈষ্ণবী মাতামা চুপ করে থাকেন
এক অজানা আশংকায় সারা উঠোনে জড়ো হয় এক
আশ্চর্য  নিস্তব্ধতা। একটা হিম বাতাসের স্রোত বয়ে যায়
দক্ষিণ থেকে উত্তরে। মাতামা হাতজোড় করে প্রণাম করেন।

আগের লেখাটি র লিঙ্ক।  বিধাতা পুরুষ।

https://www.facebook.com/share/p/ZeZWK9LufV1ptFwx/?mibextid=অফডক্নক
------------ ------------ ------------ ------------ ------------ ------------



 
 

সন্তোষপুর। টেরাকোটা অলংকরণ সমন্বিত শিবমন্দির

।।  সুমন্ত কোথায় যাবে যেন! ।। 

 সুমন্ত কোথায় যাবে যেন! 
 কেন  - যাবে সন্তোষপুর। 
 সুমন্ত যাবে সন্তোষপুর। 
 তো সে কোন সন্তোষপুর। 
 এই বাংলাদেশে কি কম সন্তোষপুর আছে! 
 শান্তিনিকেতনের আশেপাশে আছে না কি কোন? 
 পায়ে হেঁটে যেতে  হবে । পথে ধুলো। দুপুরের রোদ। 
  ছাতা চাই। 

 তিনি জানতেন হয়তো। 
 তাই  ন্ত  কে মাঝে নিয়ে তাঁর প্রথম মনে পড়েছে সন্তোষপুর 
 অজয়ের ধারে। একেবারে গা য়ে গা লাগিয়ে। আগে যখন 
 রাঢ় ভূখণ্ডে বৃষ্টি হত - অজয় দিয়ে নেমে আসত বান। 
 মাটি গোলা জল। উপছে ভাসিয়ে দিত মাঠ ঘাট, ঘরবাড়ি। 
 আবার অনেক আগে এই অজয়ের বুকেই প্রাকৃতিক ভাবেই 
 সৃষ্টি হয়েছিল এক বিশাল দহ। হ্রদ। গাঁয়ের মানুষের মুখে হদের ' ঘাট। অজয় তখন যথেষ্ট নাব্য। জলপথে বাণিজ্য। 
 সন্তোষপুর তখন এক জলপথ বাণিজ্য কেন্দ্র। 
 ছিল বিরাট জনবসতি। শোনা যায় হাজার বারো মানুষের না কি বাস ছিল। 
 অঢেল দোআঁশলা উর্বর জমি। 
 অতএব এ জমিতে নীলের চাষ হবে চমৎকার। 
 ইংরেজ রা চলে এলো। তাদের সাথে স্থানীয় বাবুরা। গ্রামের প্রভাবশালী, ভূস্বামী সব। মাঠের তিল ভেঙে দিয়ে চাষি কে দিয়ে করালো নীলের চাষ। জোর করে। 
 গড়ে উঠল নীল কুঠি। নীলের কারখানা । আশেপাশেই। 
 এখনও তার ভাঙ্গা দেয়াল দেখা যায়। মারাত্মক ঝোপে ঢেকে আছে সেই এলাকা। 

গ্রামটিকে দেখলে তার প্রাচীণত্বের কোন নিদর্শন ই মেলেনা। 
 ছোট্ট কয়েকঘরের একটা গ্রাম। 
 আছে সেবাইত চট্টোপাধ্যায় পরিবারের হাতে প্রাচীন এক মন্দির গুচ্ছ। তিনটি মন্দিরের সমাবেশ এক স্থলে। দুটি 
 দেউল রীতি র। পীড়া যুক্ত। একটি পঞ্চরত্ন। 
 দক্ষিণে র টির শীর্ষ দেশ মারাত্মক রকম ক্ষতিগ্রস্ত। 
 চট্টোপাধ্যায় পরিবারের ক্ষমতা নাই উপযুক্ত সংস্কারের। 
 বলছিলেন " বাবুরা আসেন। হ্যাঁ কলকাতা থেকেও আসেন। 
 ফটো তুলে নিয়ে চলে যান  " । কেউ কিছুই তো করেনা। 
 তিনটি মন্দিরের সামনেই চমৎকার টেরাকোটা অলংকরণ। 
 পরিবার সহ দুর্গা। ন্যাংটা শিববাবাজী বর। আর রামসীতা। 
 আর বটবৃক্ষের বাহু বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে আছে অনতি প্রাচীণ 
 এক কালীমন্দিরের ভগ্ন দালান মন্দিরের দেয়াল।  
 পশ্চিমে জয়দেব কেন্দুলী বেশী দূরে নয়। 
  সেখান থেকে প্রকাশিত হয় এমন একটি পত্রিকা, নাম তার  
" দেউল "। তার    শারদ সংখ্যায়  থাকবে আমার একটি প্রবন্ধ। বন্ধু সম্পাদক  সুভাষ কবিরাজ এর  অনুরোধ  লিখতে হবে টেরাকোটার  উপর একটি প্রবন্ধ। 
 সে চমৎকার একটা   টপিক দিয়েছে। 
 ইলামবাজার এর পশ্চিমে  গঙ্গাপুর, ভরতপুর, নারানপুর, 
 ক্ষুদ্রপুর, উদয়পুর, সন্তোষপুর, বালারপুর, ভুবনেশ্বর, 
 মন্দিরা,  জনুবাজার, সুগড়,  ভরাঙ্গী, রামপুর, জয়দেব কেন্দুলী। 

 কত কথা এ মাটির! 
------------ ------------ ------------ ------------ ------------ ------------ 
©  প্রণব ভট্টাচার্য।

।। বাকী তো অনেক।।

।। বাকী তো অনেক।।   

 বাকী রয়ে গেল  অনেক    
  যেমন পথ   বা     পথ চলা 
 নক্ষত্র ভরা গোটা  আকাশ টা  দেখাও হয়নি 
 আমাদের দালান ছিলনা  দূর দিগন্ত দেখার 
 পুকুরের পাড় ছিল আমার পাহাড় 
 সেখান থেকে সূর্যোদয় 
 পশ্চিমের মোরাম চাতাল আমার পামির মালভূমি 
 সেখান থেকে সূর্যাস্ত দেখতাম 
 সেই চাতাল আর নেই 
 নদী বাঁধের গায়ের বিরাট যজ্ঞ ডুমুর 
 পলাশ ঝোপের তারা তিতলি গুলো যে কোথায় গেল 
  আর করঞ্জার ঝোপে  জোনাকের দল
 গুঞ্জার কাছে ধার করেছি  তারা তিতলি 
 নাই রে         কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে যেন 
  বর্ষা নাই       সারারাত আখড়ার ডোবায় 
   ব্যাঙেদের গান 
  একঘেয়ে সুরে  ঝালাপালা কান 
 নাই হয়ে যাবে হয়তো একদিন 
  কত প্রজাপতি উড়ে বেড়াত, গঙ্গাফড়িং লাল ভেলভেট পোকা , কুলঝোপে সোনাপোকা 
 কোথা গেল সব 
 আমরা পঞ্চাশ ডিগ্রি তে পৌঁছে যাচ্ছি 
  আবার শুনছি  বনদপ্তর জঙ্গল কাটাচ্ছে 
   রাঢ়বঙ্গে কতদিন ভালো বর্ষা  হয়নি 
অজয়ে জল আসেনি     বান নামেনি 
 সব নদী মরে গেছে  
 শুধু চর , মানা, কাশবন, নদীগর্ভে বোরো ধান চাষ 
 নদী ধারে কত দেশী ঘি করলার লতা ছিল 
 কি তার স্বাদ। ঝাল দিয়ে একথালা ভাত 
 কত শতমূল, অনন্তমূল নানা ভেষজ 
 নীলকুঠির জঙ্গলে  কি ছাতু হত  মাটির নীচে 
 কুরকুরে  নাম  মাতামার সাথে সাথে যেতাম 
 আদাড়েবাদাড়ে আতা ঝোপ  সব যে কোথায় গেল 
 পুকুর পাড়ে র ধারে  ঘৃতকুমারী র ঝাড় 
 রাতে রাতে কারা সব গোড়া সমেত তুলে নিয়ে গেল
 এলোভেরা হল  এখন মাখি, খাই, 
 ধব, গাব, চালতে মাদার, ভেলা, আরও কত কি 
 কেমন নিঃশব্দে নাই হয়ে গেল 
 আহা, ছিল কত পিয়ালের গাছ 
 জঙ্গলে জঙ্গলে   কোন রকমে দু একটা টিঁকে আছে 
 আমাদের গাঁয়ে ঢোকা বা বেরোনোর রাস্তা টা 
 যেখানে দুভাগ হয়েছে সেখানে ছিল 
 ছোট খাটো এক  সুন্দরী পিয়াল 
 আমরা তার ডালে দোল খেতাম 
  একদিন সেও       নাই হয়ে গেল 
 এক রাস্তা ধরে গেলাম ' যা গেছে তা যেতে দাও 'এর কাছে 
 আর এক রাস্তা ধরে 
নিজের নিয়তি জানা 
   গাধার স্থির  চোখ নিয়ে
 মরা অজয়ের দিকে তাকিয়ে 
------------ ------------ ------------ ------------ © প্রণব ভট্টাচার্য 
 গুঞ্জাকে দিলাম। 
 গুঞ্জা শান্তিনিকেতনে থাকে 
  তারা তিতলি খোঁজে কুসুমের ডালে