।। সে এক সব হারানো গ্রামের কথা।। প্রণব ভট্টাচার্য । ১ ম পাতা
সে এক গ্রামের কথা। গাঁ ঘরের কথা। আশপাশের কথা।
নদী আছে পাশে। লোকে বলে নদী। পণ্ডিতেরা বলবেন নদ।
কবিও বলেন তাই। " বাড়ি আমার ভাঙন ধরা অজয় নদের বাঁকে "। ছোট্ট কুনুর কবির কোগ্রামের কাছেই মিশেছে অজয়ে। ছিল এক প্রাচীন দহ। ভ্রমরাদহ। বিখ্যাত সে দহ।
সওদাগর দের নৌকা বাঁধা থাকত তার ঘাটে। সে কি আর আজকের কথা। " সপ্তডিঙা " ভাসত জলে। বাণিজ্যে যেত।
" কণ্টকদ্বীপ " কে ডান হাতে রেখে ডিঙা গিয়ে পড়ত ভাগীরথী তে। স্রোতের টানে দক্ষিণে সাগর মুখে।
কত কথা এই অজয়ের। সে পূর্ব বাহিনী। তাই পৌরাণিক মতে
সে নদী। কত তার ঘাট। আর ঘাট মানেই তীর্থ।
আবার ঘাট মানেই ব্যবসা বাণিজ্য। ছোট বড় কত নৌকো।
মালের ওঠা নামা। পাড়ে বলদ গোরু ; মহিষ এর গাড়ি।
এ গ্রামের ঘাটের নাম " কলা বাগানের ঘাট "। দুপাশে তার কলাবাগান। মাঠের নাম 'নীলবাড়ির মাঠ '। নীলের চাষ হয়।
পাশেই নীল পচানো র মোটা ইঁটের চৌবাচ্চা। কোম্পানি র সাহেব দের পক্ষে তদারকি করেন গ্রামের সৈয়দ বংশের কোন
এক করিৎকর্মা মানুষ। হয়তো নাম তার গোলাম পাঞ্জাতন।
এঁদের পূর্বপুরুষ খুষ্টিগিরি দরগা শরীফের সুফী সাধক সৈয়দ শাহ আব্দুল্লাহ কেরমানী সাহেবের অধস্তন ৬ ষ্ঠ পুরুষ সৈয়দ
শাহ মোহাম্মদ আলী তকী সাহেবের পুত্র সৈয়দ শাহ আলী
জাওয়াদ (১৭০৭- ১৭৯০) একদিন এসে এই গ্রামের নদী তীরে র কিছু দূরে উঁচু ঢিবির উপরে তাঁর আস্তানা স্থাপন করলেন।চারদিকে ঘণ ঝোপ জঙ্গল। তাল ; খেজুর ; নিম ; বেল ; ডেঁয়ো মাদার ; চাকলতা গাছে ঘেরা এই মনোরম তপোবনের মতো স্থান তাঁর খুব পছন্দ হয়েছিল। এখানেই তিনি তাঁর খানকাহ্
স্থাপন করলেন। কথিত আছে গুরুপ্রদত্ত নীমের দাঁতন কাঠি
এখানে আসার পরই সবুজ সজীব মুকুলিত হয়ে উঠেছিল।
তিনি সেই দাঁতন কাঠি পাশেই পুঁতে দিয়েছিলেন। বড় এক দিঘির পাড়ে। প্রবীণ রা বলতেন তাঁরা সেই গাছ দেখেছেন।
ভক্তি র আতিশয্যে ডাল ভেঙ্গে নিতে নিতে একদিন সেই গাছ
মারা যায়।
ইউনানি চিকিৎসা য় তিনি খুবই দক্ষ মানুষ ছিলেন। সাপের কামড়ের ভালো ওষুধ জানতেন।
বর্ধমান রাজের পেটের অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক রোগের উপশম ঘটিয়ে তিনি নাকি প্রায় ১৪০০ বিঘা মতান্তরে ৭০০ বিঘা নিষ্কর সম্পত্তি লাভ করেন। রাজার কাছে চেয়েছিলেন মাত্র
চৌদ্দ হাত পরিমান জায়গা। রাজা দিলেন বিশাল সম্পত্তি।
------------ ------------ ------------ ------------ ------------ ১ ম পাতা শেষ
।। সে এক গ্রামের কথা।। পাতা নং ২
নদী ধারের উঁচু ঢিবির উপরে হাঁড়ি পাড়া। বেলতলাতে কঞ্চি হাতে শনের মতো পাকাচুল বুড়ি পাহারা দেয়। মানুষের মাথার সাইজের বেল। আর তেমন ই মিষ্টি।
হাঁড়িকাঠে বলি দিত কি না জানা নেই। কিন্তু নদী তে নৌকা বায়। এপার ওপার করে। ওপারে নারানপুর ; উদয়পুর ; ক্ষুদ্দুপুর এমন সব গ্রামের লোক পারাপার করে। অযোধ্যা হাটে আসে। বেচা কেনা করে। মাছ ধরে। খালুই ভর্তি নদীর মাছ কেনার জন্য লোকে কাড়াকাড়ি করে।
আবার শোনা যায় ডাকাতি করতে অন্য দলের সাথে যায়।
ভাড়া খাটে। রাজহাটের হাঁড়ি দের সাথে ভালো সম্পর্ক।
আর ওরা তো পাকা ডাকাত। পাষাণচণ্ডী বাগানে কালী র পুজো করে ওরা নদী র ওপারে যায় ডাকাতি করতে।
ডাকাতির মাল জমা রাখে লোকে বলে ; মোড়ল ঘরে ; এদিকের বেনে ঘরে।
বনকাটি র মুখুজ্জে ; চাটুজ্জে ; রায় বাবুরা নানা রকম ব্যবসা
করে। প্রায় একসাথে জোট বেঁধে থাকা । ব্যবসা করে বেশ বড়লোক হয়েছে সবাই। তার মধ্যে মুখুজ্জে বাবুরা লাক্ষা বা গালার ব্যবসা করে খুব বড়লোক। বিরাট তাদের প্রাসাদ।
প্রাসাদে গুপ্ত কক্ষ। রায় বাবুদের প্রাসাদ সে ও দেখার মতো।
রায় বাবুদের বিরাট কালীপূজো। বিরাট তান্ত্রিক তাদের পূর্বপুরুষ রা। সেনপাহাড়ী র সেন রাজাদের কুল পুরোহিত ছিলেন না কি তাঁদের পূর্ব পুরুষ। ওপার বাংলা থেকে সেন রাজাদের সঙ্গে এসেছিলেন। কালীমন্দির। বিষ্ণু দালান ;
উত্তর মুখী দুটি শিবমন্দির। ১৭০৪ শকাব্দে নির্মিত হয়েছে
প্রথম দুটি মন্দির। তারপর আবার ১৭৫৬ শকাব্দে পাশাপাশি
তিনটি দেউল রীতি র শিবমন্দির। সামনে টেরাকোটা র কাজ।
দুর্গা ; গণেশ ; দশমহাবিদ্যা।
চাটুজ্জে দের ও নানা ব্যবসা। তাদের ও বিরাট প্রাসাদ। গুপ্ত কক্ষ। পাশে মন্দির। তাদের পরিবারের এক বধূ তাঁর স্বামী মারা যাওয়ার পর বানিয়েছিলেন মুখোমুখি দুটি চমৎকার গড়নের শিবমন্দির। তাতে ছিল চমৎকার টেরাকোটার কাজ।
তাঁকে বলা হত ' বরানগরের দিদি '। পাঠক ভাবুন একবার কোথায় বরানগর আর কোথায় বনকাটির জঙ্গলে র দেশ।
সম্পর্ক হয়েছিল এই ব্যবসাসূত্রেই।
রায় বাড়ির আর এক শাখার নন্দকুমার রায় ; বনপাশ কামারপাড়ার মিস্ত্রি দের দিয়ে বানিয়েছিলেন দুর্গা দালান ; বিষ্ণু দালান ; আর উত্তর মুখী দুটি শিবমন্দির। ১৭৩৯ শকাব্দে।
আর মুখুজ্জেরা সর্বাপেক্ষা ধনী। তাঁরা তাঁদের দুর্গাদালান ওয়ালা প্রাসাদের সামনে বানিয়েছিলেন টেরাকোটা শোভিত
অসাধারণ শিবমন্দির ১৭৫৪ শকাব্দে। আর সেই গোপালেশ্বর শিব মন্দিরের গঠন অনুযায়ী ১২৪২ বঙ্গাব্দে অসামান্য অলংকৃত পিতলের রথ। যা দেখতে ছাত্র দের নিয়ে গোরু গাড়িতে চেপে এসেছেন শিল্পাচার্য নন্দলাল বসু। মুকুল দে।
অমিয় ববন্দ্যোপাধ্যায় ; গুরুসদয় দত্ত ইত্যাদি বড় মাপের মানুষেরা।
আজও তা রসিক দর্শক দের মোহিত করে।
ঘোর কাপালিক রায় পরিবারের পূর্ব পুরুষ রা। কালীথানে
তাঁদের পূজার মহা আড়ম্বর। ছাগ ; মেষ ; মহিষ বলি সেদিন ও
হত। আজও হয়। তন্ত্র মতে পূজা। শ্মশান থেকে শুরু যার কৃত্যক। ঘোর অমানিশায় তমসার দেবীর মহাপূজা।
এই রায় পরিবারের ছিল প্রচণ্ড দাপট। মধু রায় তো দুর্ধর্ষ।
রায় দের বাহিনী তে আছে দুর্দান্ত সেনপাহাড়ী র মুচিরা।
সেই সময়কাল যে মারাত্মক।
১৭৭০ এর মহা মন্বন্তর এর পর সব ছারখার হয়ে গেছে।
গ্রামের পর গ্রাম উজাড়। না খেতে পেয়ে মারা গেল লাখে লাখে মানুষ। যে চাল পাওয়া যেত টাকায় ২-৩ মন করে তার দাম
তিন টাকা সের। কে কিনবে। চাষের জমি সব পড়ে আছে।
কে চাষ করবে। যে করবে সে ই তো নাই। " বীরভূম তখন বন্ধ্যা জনমানব হীন এক দেশ " সরকারি রিপোর্ট। হিগিনসন সাহেবের।
পশ্চিমের পাহাড়ি এলাকা থেকে নেমে আসছে দুর্ধর্ষ ডাকাতের দল। তাদের সঙ্গে যোগ দিচ্ছে যারা বেঁচে আছে তখনও। দু তিন শো থেকে হাজার লোক দিনে দুপুরে ডাকাতি করছে।
দিনের আলোয় লুঠ হল গঞ্জ ইলামবাজার। আরস্কাইন সাহেবের কুঠিবাড়ি। এপারে অযোধ্যার জনৈক বলিনাথ চট্টোপাধ্যায় এর বাড়িতে ডাকাতি হল। ১৭৮৯ সালে।
স্থানীয় ভূস্বামী রাও নিজেদের নিরাপত্তার জন্য পাহারার ব্যবস্থা করছেন। সোজা কথায় তারাও ডাকাতের দল গড়ে তুলছেন। সেই দল গড়ে তোলার জন্য উপযুক্ত লোক নিয়ে আসছেন বাইরে থেকে।
------------ ------------ ------------ ------------ ------------ ২ পাতা শেষ
।। সে এক গ্রামের কথা।। ৩ নং পাতা
সে এক সাংঘাতিক পরিস্থিতি। ঠিক এই সময়কালেই চলছে বর্গী আক্রমণ। সীমাহীন তাদের অত্যাচার। গ্রামের পর গ্রাম লুঠ করে আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে। " সেনভূম " কে পুড়িয়ে ছারখার করে দিল। অজয় পেরিয়ে এসে সেনপাহাড়ী জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মানকরের দিকে গেল লুঠেরা দের দল।
এই এলাকার কি যে পরিস্থিতি হয়েছিল তার আনুপূর্বিক বিবরণ নাই।
এই এলাকায় প্রাচীণতম মন্দির গড়ে উঠেছে ১৭০৪ শকাব্দে।
অর্থাৎ ১৭৮২ সালে। তারপর একের পর এক গড়ে উঠেছে পরবর্তী পঞ্চাশ বছরের ও বেশী সময় ধরে।
প্রাসাদ মন্দির ইত্যাদি গড়ে তোলার পিছনে নিজেদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি র বিষয় টি অবশ্যই আছে। কিন্তু মানুষ কে কাজ দেওয়ার বিষয়টি কেও অগ্রাহ্য বোধ হয় করা যাবেনা।
আবার শিবমন্দির স্থাপনার বিষয়ে যেটা শোনা যায় শিউ ভাটের নেতৃত্বে বর্গী দের দল যে গ্রামে শিবমন্দির দেখত সে গ্রাম না কি আক্রমণ করতনা। রাঢ়বঙ্গে যত শিবমন্দির আছে সারা ভারতে অন্য কোথাও নেই।
সেনপাহাড়ী ঃ রেনেল সাহেবের ম্যাপে( ১৭৭৯) এই সমগ্র এলাকা সেনপাহাড়ী নামেই চিহ্নিত। পণ্ডিত প্রবর সুকুমার সেনের মতে বাঙ্গলার বিখ্যাত সেন রাজাদের পূর্ব পুরুষ রা বাঙ্গলায় এসে প্রথমে এখানে এই গড়জঙ্গল এলাকা য় তাদের বসতি স্থাপন করেছিলেন। নাম তাই সেনপাহাড়ী। অজয়ের ওপারে তাঁরা উত্তরে অনেক দূর পর্যন্ত গিয়েছিলেন।
ওপারে পরগণা সেনভূম।
১৭৪০-৪৪ সালের মধ্যে বর্ধমানের রাজা চিত্রসেন দিল্লির বাদশাহ মহম্মদ শাহের ফরমান অনুযায়ী সেনপাহাড়ী পরগনার অধিকার লাভ করেন। যদিও আগেই তাঁরা এই এলাকা দখল করেছেন। ঐ সময়কালের মধ্যে রাজা চিত্রসেন
সেনপাহাড়ী পরগনার পুনর্গঠন করেন। গড়জঙ্গলের চারপাশের গ্রাম গুলির ভূস্বামী বা প্রভাবশালী ব্যক্তি দের
তিনি আনুকুল্য প্রদর্শন করেন। তাদের নিজেদের নিরাপত্তা র জন্য পাহারাদার দের দল গঠনের অনুমতি দেন। নিজে পাহারাদার ঘোড়সওয়ার এর দল তৈরী করেন। তাদের প্রশিক্ষণের জন্য " ঘোড় দৌড় " এর মাঠ আছে এলাকার দু তিন জায়গায়।
তিনি নিজে " গড়জঙ্গলের মধ্যে ইছাই ঘোষের গড় বেড়ী এলাকায় " কেল্লা তৈরী করে কামান এনে বসান। কামানে ফার্সি ভাষায় লেখা ছিল রাজা চিত্রসেন। ঝাড়খণ্ড বিহার থেকে
" সিং " পদবী র ক্ষেত্রী যোদ্ধা দের এনে কোটালপুকুর গ্রামে
এনে বসান। কেল্লা পাহারার জন্য। কেল্লাদার হায়ার সিং।
তখন ইংরেজ দের সাথে তাঁদের অশান্তি বেধেছে। যে কোন সময় আক্রমণ করার সম্ভাবনা। রাজা তাই নিজেদের নিরাপত্তা র জন্য বর্ধমান থেকে দূরে এই গড় জঙ্গল এর মধ্যে কেল্লা বানিয়েছিলেন।
চিত্রসেনের পর তাঁর উত্তরাধিকারী রাজা ত্রিলোকচন্দ্রের সময়
মুর্শিদাবাদ এর নবাব মীরকাসিম এবং ইংরেজ দের সাথে বিরোধ চরমে ওঠে। স্বাধীনচেতা ত্রিলোকচন্দ্র সিরাজের বিরুদ্ধে যে চক্রান্ত হয়েছিল তাতে যোগ দেননি। স্বাভাবিক ভাবে মুর্শিদাবাদ দরবারে প্রায় ব্রাত্য হয়ে গেছেন।
ইংরেজ রা উত্তরোত্তর রাজস্ব বৃদ্ধি করেই চলেছে। রাজা ও বোধহয় প্রস্তুতি নিচ্ছেন। অনেক সৈন্য সংগ্রহ করছেন এমন সংবাদ ইংরেজ রা পাবার পর রাজার বিরুদ্ধে সৈন্য দল নিয়ে মেজর হোয়াইট বর্ধমান অভিমুখে রওনা হলেন।
রাজা অনুমান করেছিলেন ই।
সেনপাহাড়ী কেল্লায় রাজা অবস্থান করছেন এই সংবাদ পেয়ে
মেজর হোয়াইট সৈন্য দল নিয়ে কেল্লা আক্রমণ করেন।
কেল্লা অবরুদ্ধ হয়। কেল্লাদার হায়ার সিং কে বন্দী করা হয়।
কামান গুলি দখল করে নেওয়া হয়।
রাজা কে কিন্তু পাওয়া যায়নি। তিনি তার আগেই কেল্লা পরিত্যাগ করেছিলেন।
ইছাই এর সময়ের গড় আর রাজা চিত্রসেন এর কেল্লা র স্মৃতি
রয়ে গেছে এখানকার এক স্থান নামে। মৌজা - গড়কেল্লা খেড়োবাড়ি। জে এল নং - ২৭।
আর মাথা উঁচু করে গৌরাঙ্গপুর মৌজায় জে এল নং ২৮
দাঁড়িয়ে আছে ইছাই ঘোষের দেউল। ইছাই ঘোষের স্মৃতি বিজড়িত স্থানে অবস্থিত। দেবদেউল নয়। স্মৃতি দেউল।
সেনপাহাড়ী পরগনা ই আজকের কাঁকসা থানা এলাকা।
সেনপাহাড়ী নাম এখনও সরকারি রাজস্ব দপ্তরে ব্যবহৃত হয়।
------------ ------------ ------------ ------------ ------------ ------------ ৩ নং পাতা শেষ।
।। সে এক গ্রাম।। ৪ নং পাতা আরম্ভ
সেনপাহাড়ী র জঙ্গল মহল তখন তার নামই হয়ে গেছে " লা মহল "। লা - মানে লাক্ষা বা গালা। পলাশ ; কুসুম ; কুল ; অর্জুন ; শাল ; পাকুড় এসব গাছে র ডালে বাসা বাঁধে লক্ষ লক্ষ লাক্ষা কীট। তাদের দেহনিঃসৃত রসে ই দেহ আবরণ তৈরী করে। সেই সব ডাল ভেঙ্গে আনে আদিবাসী মানুষেরা।
জঙ্গলের মধ্যে সরস্বতীগঞ্জ তখন তসর গুটিপোকার গুটি
বেচা কেনা র কেন্দ্র। খয়রা রা ভালো কাঠকয়লা তৈরী করে।
স্বর্ণকার মহলে এই কাঠকয়লার খুব কদর। আরও কত বনজ দ্রব্য। সবমাল জঙ্গল থেকে ছোট ডিঙি নৌকো য় করে " রক্তনালা "
দিয়ে বনকাটির 'গড়ঘাটা ' হয়ে " পাষাণচণ্ডী " তলাকে বাঁয়ে রেখে সাতকাহনিয়ার কলাবাগানের ঘাটে এসে এখানে মাল তুলে চলে যায় গঙ্গাপুরের ঘাটে। তারপর ইলামবাজারের শিমুল তলার "সাহেব ঘাটে "। কখনও এ গাঁয়ের জন্য আলাদা নৌকো র ব্যবস্থা করতে হয়। ছোট খাটো গাঁ নয়। শোনা যায় ষাট ঘর তাঁতি আর ষাট ঘর কুমোর। এখানকার কুমোর দের জিনিসের কদর ই আলাদা। যেমন মাটির বোতল ; তেমনই
সব অন্যান্য জিনিস। এখানকার তাঁতিদের সব মাল যায় ইলামবাজার থেকে সুরুলে। মালাকার দের বাজি র খুব রমরমা। কি নাই এ গাঁয়ে। সব জাত আছে। কত পেশার মানুষ।
কত মানুষের আনাগোনা। মালপত্র বেচাকেনা। কারিগর দের
বিরাট গ্রাম।
বোরেগী রা আছে। না জানি সে কোন কমললতা কি রামী র
প্রেমের স্মৃতি তে এক পুকুরের নাম " প্রেমসায়র "। পাড়ে তার
কর্মকার ; স্বর্ণকার দের পাড়া। কুমোর রা আছে গোটা গাঁয়ে ছড়িয়ে। ঘোষ ; সেন ; শীল ; কর ; বেণে ; দে ; গঁড়াই রা আছে। আছে নানা পদবীর ব্রাহ্মনরা। লায়েক ; অধিকারী ; চক্রবর্তী ; মুখুজ্জে ; নানা পদবী। সেন বাবুরা উকিল। তাম্বুলী হালদার রা নানা ব্যবসা তাদের। ধান চাল মুড়ি মনোহারি মহাজনী।
" বুড়ো সাহেব " এর এখন বেশ নাম ডাক। প্রথম দিকে বনকাটির " রায় " দের সাথে দ্বন্দ্ব বেধেছিল। তারপর যাক আর অশান্তি হয়নি। যে সুফি সাধক এসে এগাঁয়ে আস্তানা পেতেছিলেন এখন তিনি বেশ প্রভাবশালী।তিনিই " বুড়ো সাহেব " নামে পরিচিত। অনেক জমি পেয়েছেন বর্দ্ধমান রাজাদের কাছ থেকে। সে সব জমি চাষ করাবার জন্য আবার নিজেদের নিরাপত্তা র জন্য বিহার ঝাড়খণ্ড থেকে বেশ কয়েকঘর জোলা মোমিন কে নিয়ে এসেছেন। কয়েক পুরুষ আগেও এরা ছিল নিম্নবর্গের হিন্দু।
জাতপাতের জ্বালায় উচ্চবর্ণের অত্যাচারে ধর্মান্তরিত হয়েছে।
ভালো লাঠিয়াল ; তীরন্দাজ।
নদীর ওপারে নহনা ; কানুর ইত্যাদি গ্রামের অনেক মানুষ
এই সুফি সাহেবের ভক্ত শিষ্য হয়েছেন। প্রতি সপ্তাহে তারা আসে।
নিম্নবর্গের এই সব মানুষেরা একদিন সহজযানী তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্মের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়ে মুক্তি র স্বাদ পেয়েছিলেন। তামার বলয় পরে " পোড়েল " রা হয়েছিলেন বৌদ্ধ স্তুপের পূজারী।
ডোমরা পুরোহিত। " ডোম্ব ডোম্বনী "দের তখন খুবই কদর। ডোম্বনীকে বাদ দিয়ে তো আর "তন্ত্রের দেহসাধনা " সম্ভব নয়।
" দেহভাণ্ড ই যে ব্রহ্মাণ্ড "। দেহসুখের মাধ্যমে চিত্তসুখের সন্ধান। " সেনপাহাড়ী র জঙ্গলভূমিতে তখন তন্ত্র সাধনায় অনেকে মত্ত । তাঁদের দেবী "সুহ্মেশ্বরী "। তিনি বৌদ্ধ তারাদেবী।
তারপর সেই সহজযানী বৌদ্ধ ধর্মের শেষ অবশেষ ও মুছে গেল একদিন।
কেউ মুসলমান হলেন কেউ আউল বাউল বোষ্টম নেড়ানেড়ি র
দলে ভিড়লেন । এলেন " ধর্মঠাকুর "। এই বর্গের মানুষেরা আবার মনের মতো ঠাকুর পেলেন। বুধোরায় হলেন ধর্মঠাকুর। বা ধর্মঠাকুরের নাম হল " বুধোরায় "। শিব ও হলেন বুদ্ধেশ্বর শিব।
" সুহ্মরায় " হলেন আরেক ধর্মঠাকুর।
ধর্মঠাকুর হয়ে উঠলেন রাঢ় দেশের সার্বজনীন দেবতা।
ধর্মঠাকুর এক অতি চমৎকার সংশ্লেষণের দেবতা। তাঁর মধ্যে মিশে গেছেন কত জন। প্রাচীন ধর্ম ; শিব ; বুদ্ধ ; যম ; সূর্য।
আবার মনে হয় তার মধ্যে ঘোড়ায় চড়া যোদ্ধা দের স্মৃতি ও
যুক্ত হয়ে গেছে।
ধর্মমঙ্গল কাব্যের বীর কালু ডোম হয়ে গেছেন কালুরায়।
১৩ ই বৈশাখ তাঁর পূজা।
অজয়ের এপার ওপার দুপার জুড়েই নানা থানে বিরাজ করছেন মাটির ঘোড়ার স্তুপের মধ্যে বাবা ধর্মরাজ।
------------ ------------ ------------ ------------ ------------ ৪ নংপাতা শেষ
।। সে এক গাঁয়ের কথা।। ৫ নং পাতা আরম্ভ।
সে এক গাঁয়ের কথা। যার কথার কোন শেষ নাই। আর কথা কবে কমে হয়েছে। সে হয় পাঁচ না হয় সাত কাহন কথা।
" অসুর কাহানী " র মতো "সাতকাহানী। অজয় তীরের জঙ্গল ভূমিতে প্রাগৈতিহাসিক যুগের মানুষরা বিচরণ করত। হয়তো লোহা পাথর থেকে লোহা গলিয়ে বের করার কৌশল জানা
" অসুর " জাতের লোকরা ছিল একদিন। ।
সাতকাহানী; সাতকাহন ; সাতকাহনিয়া। নামেই তার মজা ভরা। কত কাহানী। সত্যি বলছি শুনে শুনে রাত কাবার হয়ে যাবে। তাই আগে নাম টা বলিনি। বললে তো অনেক কথা বলতে হয়। চারপাশের কথা না বললে ও বোঝা যায়না এ গাঁ কে।
" কাহন " -খড় গোনার এক বড় একক। চার আঁটিতে এক গণ্ডা। কুড়ি গণ্ডায় এক পন। ষোল পনে এক কাহন। মানে
১২৮০ আঁটিতে এক কাহন। এবার সাত কাহন। গল্প আছে সাত কাহন কড়ি দিয়ে কেনা এ গাঁ। কে যে কবে কার কাছ থেকে কিনেছিল তার কি আর হদিস মেলে ছাই। এত বড় ছড়ানো এ গাঁ যে সাত কাহন খড় বিছিয়েও কুলোয় না।
তিন ; পাঁচ ; আর এই সাত তো আমাদের পিছু ছাড়েনা।
সাত নিয়ে ই কত কথা। সাত পাকে বাঁধা।
গাঁয়ের মাঝখানে " বৈরাগী বটতলা "। কোন বাবাজী যে পুঁতে ছিল এর চারা সে কে বলবে! গ্রামের প্রাচীনত্বের স্মারক সে।
অতি প্রাচীন তমাল তলায় ছিল বুড়োবাবাজির আখড়া।
অনেক বাবাজী বোষ্টমের আখড়া ছিল একদিন। এখনও টিকে আছে এক আখড়া। এ গাঁ থেকে রাধারমণ বাবাজী হাতে হ্যারিকেন ঝুলিয়ে নদী পেরিয়ে যেত ওপারে ইলামবাজারে বলরাম বাবাজীর আখড়ায়। সে ও কি কম দিন হল।
এ গাঁয়ের ই মানুষ রজনীকান্ত হালদার। তাঁর গুরু জয়দেব কেন্দুলী র কাঙ্গাল ক্ষেপাচাঁদ। সে আশ্রম ; মহোৎসব ল চলে।
" বুড়ো সাহেব "এর উত্তর পুরুষ রা সরকার কে জমি দান করেছিলেন। সেখানেই গড়ে উঠেছিল শতবর্ষ প্রাচীন " ডাকবাংলো "। অজয়ে র গতিবিধির উপরে নজর রাখার জন্য। বারবার বিধ্বংসী বন্যা হয়েছে। সেই ১৭৮৭ থেকে ১৯৭৮ পর্যন্ত। ' ৭৮ এর স্মৃতি এখনও এখানের অনেকের কাছে দুঃস্বপ্ন।
অজয়ের দক্ষিণে বন্যার জল আটকানোর জন্য মাটির বাঁধ
দেওয়া হয়েছে। সে ও কম দিন হল না। শত বর্ষ পার করেছে।
বারবার সে মাটির বাঁধ ভেঙ্গেছে। ভেঙ্গে বন্যার জল বয়ে গেছে
অজয়ের এক প্রাচীন খাতে। " রূপাই চণ্ডী তলার পাশে রূপাই দহ হয়ে বসুধার কালীদহ। সেখান থেকে চলে গেছে পূর্বে মৌখিরা হয়ে পাণ্ডুরাজার ঢিবির দিকে। সেখানে গিয়ে আবার
মিশে গেছে অজয়ে এই জলধারা। রূপাই চণ্ডী তলার পাশে ই
" রাজাপোতার ডাঙ্গা "। একটা ছোট ঢিবি। দহে একবার একটা প্রাচীন মাস্তুলের টুকরো পাওয়া গিয়েছিল। বোঝা যায় একদিন ; সে অনেক পুরনো দিনে এই জলপথ ব্যবহার হত।
এই " রূপাই চণ্ডী " তলার যাত্রার আসর ছিল খুবই বিখ্যাত।
কলকাতার সব বড় যাত্রাদলের নট নটী রা এখানে যাত্রা করে
গেছেন। বিখ্যাত " সত্যম্বর অপেরা র বাঁধা আসর ছিল।
যাত্রা দেখতে গোরু গাড়ির মেলা লেগে যেত। মানুষ আর মানুষ।
গাঁয়ের পুবদিকে ছিল বিশাল আমবাগান। কত রকমের আম।
কত তার নাম। খইনাড়ু ; তলায় ছেলেদের দুপুরের ভিড়। আর তালগাছ। যেমন লম্বা। তেমনই তার তাল। এত তাল গাছ পুকুর পাড়ে যে জলে রোদ পড়ে না সহজে। আর সেই পাকা তালের
আঁটি চুষে বা তালের মাড়িতে দুটো মুড়ি কোনমতে যোগাড় করে সেই খেয়ে দিন পার করেছে এ গাঁয়ের গরীবেরা।
সে তো এই পঞ্চাশ ষাট বছর আগের কথা।
তারপর একদিন সেই বিরাট আমবাগান কাটা পড়ে গেল। বাবুরা বেচে দিলেন। একমাস ধরে তাঁবু খাটিয়ে করাতী রা
বাগান কাটল। বাবুদের বড় লোভ। সব না কি চলে যাবে। খাস হয়ে যাবে। তার আগেই বেচে দাও। এসব কথা পরে বোঝা।
পুকুর পাড় গুলো ফাঁকা হয়ে গেল। সেই তাল খেজুরের সারি আর রইলো না। গ্রামসীমানার বড় বড় গাছ ; নালার ধারের সব গাছ ; এমনকি পুকুর পাড়ের বট ; অশ্বত্থ ও কাটা পড়ল।
পুকুরে চান করে দিদিমা ঠাকুমা মা মাসীরা পিতলের ঘটি করে
তার গোড়ায় জল দিত। বৈশাখে জলসত্রের সময় ভিজে বুট কলাই ; একটু গূড় ও দিতে দেখেছি। সব হারিয়ে গেল।
বাউরি রা এই গাঁয়ের অনেক পুরনো। কোঁড়া দের আনানো হয়েছে। নীলকুঠি র কাজে ; পুকুর কাটানো ; বা চাষের কাজের জন্য। নদী বাঁধ তৈরী র সময় অনেক মজুর লেগেছে।
মাল রা ও সেই ভাবে এসেছে। কি ওস্তাদ না ছিল এই মাল আর কোঁড়া রা লাঠি খেলায়। হালদার বাবু দের পাহারাদার এর কাজ ও করেছে। বাবুদের খিদমতগারী করেছে কত জনে।
আরও কত কি! সহজে কথা ফুরাবে না। এত কথা আছে।
আছে সব গাঁ ঘরেই।
------------ ------------ ------------ ------------ ------------ ৫ নং পাতা শেষ
।। সে এক গাঁয়ের কথা।।
একদিন সবই ছিল। অধিকারী বামুনদের বিষ্ণু মন্দিরর সামনে দোল উৎসব ; লায়েক বাবুদের দুর্গাপূজা ; দশহরা ;
কোঁড়াদের মনসা পুজো ; হালদার বাবুদের সরস্বতী পুজো
আখড়ায় মহোৎসব এসব নিয়েই আনন্দে মাতত সেদিনের গ্রাম। ভরা ভরন্ত সে গ্রাম।
তারপর একদিন বর্ধমান জ্বর ; ম্যালেরিয়া ; কলেরা ; প্লেগের
আক্রমনে গাঁ প্রায় উজাড় হয়ে গেল। যে যেদিকে পারল পালালো। কে যে কোথায় গেল! অনেক খুঁজেছি। তাঁতীরা অযোধ্যা ; ইলামবাজারের সুখবাজারে। অধিকারী ব্রাহ্মণ রা
রামচন্দ্রপুরে ; কলুরা ডাঙ্গাল বসুধায় ; মালাকাররা গুসকরায়
শীলরা ভুঁয়েরা ; লায়েক বাবুরা তাঁদের নিজেদের জায়গায়।
কুলটি চিনাকুড়ি। অনেকের কোন সন্ধান নাই। কে কার খোঁজ রাখে আর।
তবু মরেবেঁচে একদল রয়ে গেল সেই মরাগাঁয়ে। আজকের গাঁয়ের উত্তরে সে মরা গাঁ। মাটির ঘরের বাস্তুভিটা গুলো ছোট বড় ঢিপি। মোরাম চাতাল ; ডোবা ; শরঝোপ ; বৈঁচি ; বুনো কুলের ঝোপ। মাঝে মাঝে ফুটে ওঠে লতা কৃষ্ণচূড়া। ষাট তলায় বুনো বেলী ফুল ফোটে। কালীতলার লম্বা খেজুর গাছটায় থোকা থোকা খেজুর ধরে। বড় বাঁধের পাড়ে লম্বা ফলন্ত জামগাছ টায় লম্বা রসালো টুসটুসে জাম এখনও ধরে।
বুড়ো সাহেবের আস্তানার চারপাশে লম্বা লম্বা তালগাছ গুলো
রয়ে গিয়েছে। কবরস্থান বলে।
পুরনো মানুষেরা আর কেউ নেই। সে সব গল্প বলবে কে। ডাকাতির গল্প। মারামারি লাঠালাঠি র গল্প। বাবাজী বোষ্টমদের গল্প। বাউরী ঘরে নতুন কোন সুন্দরী বৌ এলো।
তারপর তার কথা। সরকার বাউরী ঘরের মেয়ে কে বিয়ে করল। হাঁকু মিঞা কুমোর ঘরের মেয়েকে বিয়ে করল। নাম হল তার কুলসুম। মোতি চাচা ডাকবাংলোর খালাসি। প্রতিদিন সে সাইকেল নিয়ে সাগরপুতুল পর্যন্ত যায়। তার দাপটে বাঁধে একটা গোরু ওঠার উপায় নাই। চাচা সাগরপুতুল থেকে নাগকেশর ফুল এনে দিত। কচি শ্যাওড়া ডাল থাকত তার ক্যারিয়ারে। ঘরের চালে গোঁজার জন্য সেই ডাল কত মেয়ে বৌ চেয়ে নিত। একটা নতুন র্যালে কোম্পানির " হাম্বার" সাইকেল
কিনে চাচা র কি আনন্দ। কাঁধে র গামছা দিয়ে সারাদিনে চার বার মোছে। বোঙ্গা কে ছেড়ে কালীদাসী কেন যে বটূর ঘর করতে গেল - যখন বটূর কুঠেরোগ ধরেছে জেনেও।
খাঁদী মাল গঁড়াই এর দোকানে খায়। তার ঘরের কাজ করে দেয়। গঁড়াই এর বৌ কবেই মরে গেছে। আছে এক মেয়ে।
তাকে নিয়ে খুব ভাবনা গঁড়াই এর।
কত কথা এসব নিয়ে। গাঁ ঘরের গল্প কথা। আর কে বলবে।
বলার বা শোনার লোক আর নাই।
পুরনো গাঁয়ের মরা ঢিপি গুলো র উপরে ছেলেটা আনমনে ঘুরে বেড়ায়। মনে হয় এই সেই " মৃতের স্তুপ "। এর নীচেই আছে লুপ্ত সভ্যতা। মনে মনে সে রাখালদাস সাজে।
পশ্চিমের মোরাম চাতাল ই তার কাছে পামির মালভূমি।
বেণে পুকুরের উঁচু পাড় ই তার কাছে পাহাড়।
হেঁটে আসছেন হিউ য়েন সাঙ। দাদুর কাছে গল্প শোনে।
পশ্চিমে লাল সূর্য টা " পাষাণ চণ্ডী তলার বাগানের "নীচে নেমে
যায়। ঐ পশ্চিম দিকে তাকাতে ই তার মন কেমন করে ওঠে।
ধীর পায়ে " বাবাজী বটতলার " নীচে দিয়ে ঘরে ফিরতে হয়।
আর একটু পরেই বটগাছের প্যাঁচা গুলো ডাকবে।
আখড়ার বালকমাতা ডেকে বলে ' এলি '? চল তোকে ঘরে দিয়ে আসি। ও অন্নপূর্ণা লণ্ঠন টা দে "।
দক্ষিণ থেকে কোনাকুনি একটা বাতাসের স্রোত বয়ে যায় উত্তরে। কি জানি কেন মাতামা তার গায়ে ফুঁ দেয়। মাতামা জোড় হাত করে প্রণাম করে উপরের দিকে তাকিয়ে।
- ও মা কাকে প্রণাম করছ
- সে তুই বুঝবিনা। চল। ওনারা যাচ্ছেন
ঘরের বারান্দায় পানের বাটা নিয়ে দিদিমা বসে আছে।
দাদু দেয়ালে ঠেস দিয়ে। এলাকার " বড়মাষ্টার "। ননীগোপাল চট্টোপাধ্যায়। নিজের হাতে গড়ে তুলেছেন অযোধ্যা প্রাথমিক বিদ্যালয় সহ এলাকার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল। যাত্রা ; নাটক ; গান বাজনা। তিনি গানের ও মাষ্টার।
বাঁকুড়া জেলা থেকে এসে নদীতীরে র এই নিরালা গ্রামে বাসা
বেঁধেছেন। রজনীকান্ত হালদার মশাই দাদু দিদিমা কে খুব
ভালোবাসেন। ভক্তিশ্রদ্ধা করেন।
অন্ধকার রাতের আকাশে তারারা ঝিকমিক করে। মাথার উপরে কালপুরুষ। দাদু তাকে আকাশ চেনায়।পরিষ্কার রাতের আকাশ দেখতে তার খুব ভালো লাগে। খুব ইচ্ছে করে পাশের
দালানবাড়ি র ছাদে উঠে আকাশ দেখে। তার মনে হয় ঐ আকাশে যেন কত কথা লেখা আছে।
কত কথা এ গাঁয়ের। " কথা তার কাহন সাতেক নামটি সাতকাহন "। সহজে ফুরায় না। কেউ ভোলে কেউ ভোলেনা।
রইল অনেক কথা বাকী। যেমন বাকী থেকে যায় জীবনের কত কথা।।
------------ ------------ ------------ ------------ -----------। - সমাপ্ত।
লেখক। ক্ষেত্র সমীক্ষক। প্রাবন্ধিক। লোক ইতিহাসের গবেষক
No comments:
Post a Comment