।।শর পাতার ঝাঁটা।।
গাঁয়ের মাঝখানে প্রাচীন বটবৃক্ষ। নাম তার বাবাজী বটতলা।
সে যে কবে, কতদিন আগে, কোন বাবাজী এই বটগাছ লাগিয়েছিলেন, তা আজ আর কে বলবে।
বটতলায় বসে মদন শরের ঝাঁটা বুনছে। তার বৌ দীপালি
বাবুই ঘাসের দড়ি পাকাচ্ছে। ঝাঁটা বাঁধার কাজে লাগবে।
সরু, ভালো পাক দেওয়া বাবুই দড়ি কিনতে ও হয়। আর ঝাঁটার কদর গাঁ গঞ্জে আছেই। উঠোন ঝাঁট দিতে, ঘর ঝাঁট দিতে।
এ গাঁ তো একটা মরা গাঁ। কম ঝড় গেছে। এ গাঁয়ের উপর দিয়ে। রোগ। মারাত্মক কলেরা, ম্যালেরিয়া, প্লেগ, বর্ধমান জ্বরের মারাত্মক আক্রমণ। ঘরে ঘরে মানুষ মরেছে বিনা চিকিৎসায়। আর তখন চিকিৎসাই বা কোথা।
ছিয়াত্তর এর মন্বন্তরে মরেছে। দস্যু বর্গী রা সেন ভূম জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে।
বাঁচার তাগিদে গাঁ ছেড়ে যে যেদিকে পেরেছে পালিয়েছে। এই চলে যাওয়াটাও দফায় দফায়।
কত বড় গাঁ ছিল। তিনটি অংশ। সাতটি পাড়া। শোনা যায় প্রায় ষাট ঘর কুমোর, আর ষাট ঘর তাঁতি ই ছিল শুধু। তাছাড়া কামার, মালাকার, বাবাজী বোষ্টম কারা না ছিল! ঘোষ, সেন, দে , বেনে, কলু, ছুতোর। তাম্বুলী, মুসলমান। আর শুঁড়ি, বাউরি
মাল, হাঁড়ি, কোঁড়া রা।
আদিগ্রাম ছিল আরও উত্তরে। অজয়ের ধার পর্যন্ত। অজয়ের
বানের ধাক্কাও খেয়েছে কতবার।
উজাড় গাঁয়ের সব বাস্তু ভিটা একদিন ছোট বড় মাটির ঢিবি হয়ে গেল। ঝোপ জঙ্গলে ঢেকে গেল সেই গাঁ। ঘণ শর ঝোপ।
বাঁশের ঝাড়। গোটা গাঁয়ের চার দিকেই।
পুকুর পাড়ের তালগাছ গুলো রয়ে গেল। এত এত পুকুর।
প্রায় ত্রিশ টি। সব পুকুরের পাড়ে লম্বা লম্বা তালগাছের সারি।
এমন যে কোন কোন পুকুরের জলে রোদ প্রায় পড়েনা।
যারা রয়ে গেল - তারা আর কি করে। কিছু চাষবাস। চাষের পর আর কাজ নাই। অজয়ে মাছ ধরে।
কি অভাব। কি অভাব হায়! ভাদ্র মাসে পাকা তালের আঁটি চুষেই খিদে মেটায়। দুটি মুড়ি জোটানোও কঠিন।
তবে এই শর ঝোপ আর তালগাছ ই বাঁচিয়ে রাখল খেটে খাওয়া মানুষ দের।
শর পাতার ঝাঁটা বোনে। গাঁয়ে গাঁয়ে নিয়ে যায় মাথায় করে।
কিছু চাল, পয়সা জোটে। আবার বর্ষাকালে তাল পাতার
মাথা ঢাকা দেওয়ায় টোকা, মাথা থেকে হাঁটু পর্যন্ত ঢাকা দেওয়ার ' পেখে '। পিছন দিক থেকে পাখির মতো দেখতে লাগে তাই নাম পেখে। তালপাতার চাটাই, তালাই। আর বাঁশ।
বাঁশের ঝুড়ি।
আজ অবশ্য সে গ্রাম নিজেকে অনেকটা সামলে নিয়েছে।
বালিখাদে কাজ করে। ট্রাকে, ট্রাক্টরে বালি ভরে। তারপর একদিন নদী তে নামল যন্ত্র দানব। নৌকোয় পাম্প মেসিন।
যারা পারল, বালি নিয়ে ব্যবসা করে বিরাট ধনী হয়ে গেল।
আর যারা পারলনা, তারা ঐ বালি শ্রমিক।
এপারে অজয়ের মোটা দানা বালি ও প্রায় ফুরিয়ে এলো।
নদীতে বিরাট বিরাট গভীর গর্ত হল। নদীর এপারে দক্ষিণে বর্ধমান জেলার দিকে আর বালি নাই। ওপারে বিশাল স্তরে স্তরে জমাট চর। নীচের স্তরে কাশবন। উপরের স্তর গুলিতে
পূর্ব বঙ্গীয় উদ্বাস্তু মানুষের দল থিতু হয়ে ভালো চাষবাস করছে এখন। নারানপুরের মানা।
এ গাঁয়ের মানুষ, বিশেষ করে বাউরি রা ভালো শরের ঝাঁটা বোনে। সে বহুদিন আগে থেকেই।
মদন ঝাঁটা বাঁধছে। একা মদন নয়। প্রায় গোটা গাঁ ই।
মদনের বাবা, কাকারা ও ভালো কারিগর ছিল। তাল পাতার
নানা জিনিস, বাঁশের ঝুড়ি খুব ভালো বানাতে পারত।
ভালো ঘর ছাইতে পারত। তখন তো সব ঘরের চাল ছিল খড়ে ছাওয়া। ভালো মাটির দেওয়াল দিতে পারত। কাঠামো তৈরি করতে পারত। আবার তালপাতার কুঁড়ে ঘরে ই কেউ কেউ সারা জীবন কাটিয়ে দিল। বা বাঁশের কঞ্চির ছিটে বেড়ার দেয়াল আর তালপাতার ছাউনি কুঁড়েঘর।
এখন শরের ঝাঁটা আর গাঁয়ে গাঁয়ে মাথায় করে বিচতে যেতে হয়না। বীরভূম থেকে মুসলিম পাইকার রা মোটর ভ্যান নিয়ে আসে। ভোর থেকেই তারা এসে যায়। কাড়াকাড়ি লেগে যায়। সব শরের ঝাঁটা তারা পাইকারি দরে কিনে নেয়। বারো টাকা পিস। তারা বেচে কুড়ি টাকায়। তা হোক। সে তো তার লাভ রাখবেই।
মাঠে ধান পেকে আসছে। কিছু ধানে থোড়। পাকলে, কাটার মতো হলে তখন কিছু কাজ জুটবে। ধান কাটার। তাও আবার মেসিন নামাচ্ছে অনেকে। ধান কাটা, ঝড়ানো সবই হচ্ছে। কাজ কই। কাজ নাই। খাবে কি!
এখন এই শর পাতার ঝাঁটা ই বেঁচে থাকার অবলম্বন।
শরপাতার ও অভাব দেখা দিয়েছে। সবাই ভোর হতে না হতেই কাস্তে নিয়ে বেরিয়ে যায়। দূরে দূরে। পাতা কেটে নিয়ে আসে।
কচি পাতা। তাই তাইই। সে পাতা শুকানো। গোছা বাঁধা।
তারপর বাঁধতে বসা।
অন্যান্য দূরের জায়গা থেকেও গরীব মানুষেরা এসে পাতা কেটে নিয়ে যাচ্ছে। কি করবে! নিরুপায়। তাদের ও যে অন্য কাজ নেই। খিদের রঙ যে একই।
বাঁচতে তো হবে।
শরের ঝাঁটা ই অনেক কে বাঁচিয়ে রেখেছে।
------------ ------------ ------------ ------------ ------------ সমাপ্ত।
এ আমার গাঁয়ের কথা।
সাতকাহনিয়া। বনকাটি। পশ্চিম বর্ধমান
* ছবি তে একবার ক্লিক করবেন।
No comments:
Post a Comment