"দাদু গল্প বলতেন হিউয়েন সাঙ হেঁটে আসছেন পামির মালভূমির উপর দিয়ে। মরুভূমির মধ্যে দিয়ে।
আমার গাঁয়ের পশ্চিমে মোরাম চাতাল। উঁচু নীচু খোয়াই। খাদ। বর্ষায় প্রবল বেগে গিরি লাল জল নামে।
আমি হেঁটে বেড়াতাম সেই চাতালের উপরে। সেই চাতালই আমার পামির.."
এ-কথা যিনি লেখেন, তিনি কি কেবল ইতিহাসচর্চার জন্যই আঞ্চলিক ইতিহাস খোঁজেন?! নাকি, তাঁর অনুসন্ধিৎসার মূল প্রোথিত অন্য কোথাও? মূলই তো কাণ্ডের কথা বলে। চর্চার চালিকাশক্তি অনেকদূর পর্যন্ত নির্দেশ ক'রে দেয় চর্চার অবয়ব। নির্মিত হয় ঐতিহাসিকতার প্রকার, দৃষ্টিকোণ।
এই ইতিহাস-অনুসন্ধানী লেখেন..
"এই অজয়-ই আমার আমাজন। কী ভীষণ বর্ষায় তার বেগ!
'নামো পাড়া', মানে গাঁয়ের উত্তর-পশ্চিম দিকের মরে যাওয়া পোড়ো-গ্রাম। অজয়ের বন্যায় আর ম্যালেরিয়া, কলেরায় সেই বড়ো গাঁ কবেই শেষ হয়ে গেছে.. পড়ে আছে কত না মাটির ঢিবি! গলে-ক্ষয়ে যাওয়া তবু টিকে থাকা দেয়ালের কোনা।
তার মনে হত এই তার 'মহেঞ্জোদারো'! সেই ঢিবিগুলোর উপরে নির্জন দুপুরে ঘুরে বেড়াতাম। মনে সাধ--খুঁড়তে হবে।"
এবার আরও স্পষ্ট হয়, মূলের কথাটা..
ইতিহাস হিসাবে তাঁর লেখালিখির প্রামাণিকতা, নৈর্ব্যক্তিক তথ্যনিষ্ঠা প্রভৃতি বিচারের অন্য জায়গা আছে। আমি ইতিহাসের ছাত্রী নই, মাধ্যমিকে সবচেয়ে কম নাম্বারটা ইতিহাসেই পেয়ে পরের ক্লাসে বিষয় হিসাবে আর তাকে সঙ্গে রাখিনি। তবে তাঁর লেখা এমন গভীর অভিনিবেশে আমি কেন পড়ি!
কারণ, একটাই..
ওই ঢিবি আমারও মহেঞ্জোদারো.. আমার গাঁয়ের পশ্চিমে মোরাম চাতাল, উঁচু-নীচু খোয়াই, খাদ, কাঁদর বেয়ে বর্ষায় লাল-জল নামে.. ওই চাতাল আমারও পামির..
ইতিহাসের সাথে সাথে ভূগোলও ছেড়ে দিয়েছিলাম, তবে শাল-পিয়ালের বনে একদিন ছোটোবেলায় হঠাৎ আবিষ্কার করা আমার কাঁকর-মাটির নিচু টিলাটার মাটিটা ঠিক কতটা প্রাচীন--সে কথা যখন জানতে ইচ্ছে করে তখন বেশ বুঝতে পারি, যেকোনো জিজ্ঞাসার মূলেই থাকে সেই প্রাচীন মৌলিক ভাবদের একটি.. affinity..
আমার মাটিকে জানতে চাওয়া, আমার মাটির মানুষ, উদ্ভিদ আর বন্যপ্রাণীদের কথা শুনতে চাওয়ার সেই যে একটা দুর্নিবার আবেগ আর ইচ্ছেয় পেয়ে বসেছিল, ইন্টারনেটের কল্যাণ আমার সেই ইচ্ছের সাথে স্যারের লেখালিখির পরিচয় করিয়ে দেয়।
প্রথম দু-একটা লেখা পড়েই বেশ চমকে যাই.. সাহিত্যিকদের লেখা পড়লে যেমন হয়, কতকটা সেইরকমের অনুভূতি..
"আরে! এ তো আমার কথাই বলছে!"
"বলবে না-ই বা কেন? এক মাটি যে.."
ওই যে মানুষকে তার নিজের কথা শোনানো, এই এক ভূমিকাতেই কি তাহলে কোথাও গিয়ে সাহিত্য আর আঞ্চলিক-ইতিহাসকথা মিলে যায়? সেসব তত্ত্ব-অন্বেষণ এখন স্থগিত থাক, স্যারের লেখায় সাহিত্যগুণ যে আছে, তা অনস্বীকার্য। তাঁর একটা কবিতা দিই শেষে..
"ওরে বিষাদ বালক!
একটা ভাঙা দেয়াল বুকে পুরেই জন্ম তোর।
কোথাও কেউ লিখুক আর নাই লিখুক,
জন্ম তোর বিষাদ লগ্নে..
অঞ্জনা নদীতীরে চন্দনী গাঁয়ের সেই পোড়ো মন্দিরখানা,
জীর্ণ ফাটল ধরা,
সেই কবেকার বালকবেলায়
তোর মনে গেঁথে গেছে..
ক্রুশের পেরেকে!
ভুলবি কি রে তুই?
তিনি তোর জন্যেই কবিতাটা লিখেছিলেন রে
তা না হলে কি ওই ছবি
ভেসে থাকে রক্তস্রোতে?
গেঁথে গিয়েছিল তোর জন্মক্ষণেই রে বাপ
তুই নিরুপায়.."
নিরুপায় হয়েই তবে ইতিহাস খোঁজেন তিনি?
আমাদের সবার জীবনেই এমন এক-একটি কবিতা থাকে, যাকে মনে হয়--এ তো আমারই জন্য লেখা! তারপর দেখতে দেখতে সেই কথামালা ধ্রুবতারা হয়ে উঠে দিক-নির্দেশ দেয়, ব'লে দেয় কতদূর তুমি যাবে..
যে কাজে কবিতা ডাকে, সে কাজ ইতিহাস হোক, বিজ্ঞান হোক, সাহিত্য যে সে হবেই, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না..
চলতে থাক এই অনুসন্ধান..
আমাদের কাছে বাধাহীন হয়ে এসে পৌঁছাক..
জন্মদিনের অনন্ত শুভেচ্ছা সেনপাহাড়ীর কথকঠাকুর, গোপভূমের ইতিহাসের অক্লান্ত সাধককে। সুস্থ থাকবেন।
** এই লেখা সাকিলা র।
আমার জন্মদিনে আমার উদ্দেশ্যে লেখা।
বাংলা সাহিত্যের গবেষক ছাত্রী।
এটাই সেরা প্রাপ্তি।
ভালো থেকো সা কি লা।
No comments:
Post a Comment