Wednesday, 24 February 2021

বাবাজী বৈষ্ণব আখড়া। গৌরী মা

অযোধ্যা আশ্রমের গৌরী মা            পর্ব  ৯
--------------------------------------------------------------
তারপর
ঘর তো ছাড়ল গৌরী। ভোলানাথের সাথে।
ভোলানাথ তাকে নিয়ে এলো অযোধ্যায়।
এতই সোজা। সেদিনের সমাজে মেনে নেওয়া।
ভোলানাথ কে তার আত্মীয় পরিজন তাম্বুলী সমাজের চাপে সমাজ চ্যুতই করল।
নিজের ঘরে ঠাঁই নেই নিজেরই তো আবার গৌরী।
কোনভাবে একটা ঘর জুটল। বাঁচতে তো হবে।
নিজের মনোহারী ব্যবসা। মেলায় খেলায় ফেরী করে।
নিজের ভাগের জমিজায়গা অন্য শরিকরা প্রায় হাতিয়ে নিল।
এ দিকে একের পর এক সন্তানের জন্ম দিয়ে গেছে গৌরী। তাদের বড় করে তোলার চিন্তা। মানুষ করার ভাবনা। সংসারে অনটন দেখা দিল। ভোলানাথের কর্মক্ষমতা কমে আসছে।
' জাত খোয়ালে বোরেগী '। গাঁ ঘরে তো চালু আছে এ কথা। গাঁয়ের শেষে পূর্বদিকে সূত্রধর পাড়ার ধারে
বলাই দাস বাবাজী র আশ্রম।
একদিন সেখানে পৌঁছাতে হল। দুজনকেই।
সেখানেই ঠাঁই মিলল। বাঁশের কঞ্চির বেড়া র উপরে মাটি লেপে দেওয়াল। খড়ের ছাউনি। এই আশ্রয়।
  সহজিয়া বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষা নিলেন গৌরী।
বলাই দাস বাবাজী র কাছে ই।
এবার পথে নামতে হয়। মাধুকরী র জন্য। তার মুখশ্রী তে কান্না করুন শ্রী। মিষ্ট মধুর বচন।
কেউ ফেরাতে পারেন না। মহিলারা ই মূলতঃ। সংসার চলে এভাবেই। কোন মতে। নিরূপায়।
  রোগভোগের পর একদিন ভোলানাথ দেহ রাখলেন।
শবদেহ দাহের জন্য কেউ এলোনা। কি পরিণতি।
সেই মৃতদেহ আগলে বসে থাকে গৌরী। কোনরকমে আশ্রমের বাইরে পুকুর পাড়ে ঝোপের ধারে তাঁর মৃতদেহ রেখে আসতে হয়।
পরে সেই সময়ের ইউনিয়নবোর্ড এর মাধ্যমে শবদেহ দাহের ব্যবস্থা হয়।
গৌরী একা। তিন সন্তানই বড় হয়ে উঠছে। উঠেছে।
দীনবন্ধু মেলায় মনোহারী ব্যবসা করার চেষ্টা করে।
মেণকা কাজের খোঁজে কলকাতা চলে যায়। বরাবরের সাহসী। পরে ভাই এর জন্য ও একটা কাজ খুঁজে ভাইকে ও নিয়ে যায়। যদিও কিছুদিন পর অসুস্থতা র জন্য  ফিরে আসতে হয় দীনবন্ধুকে।
কি চমৎকার ব্যারিটোন ভয়েস ছিল তাঁর। পরবর্তী সময়ে তাঁর ভোরের টহল ছিল অনবদ্য।
আমার খুব আক্ষেপ হয় কেন যে সে গান শেখেনি।আদুরিয়ার গোবর্ধন রায় মশাই এর কাছে কিছুদিন শিখেছিল।
গান তাকে অনেক উঁচু জায়গায় পৌঁছে দিতে পারত। পরবর্তী সময়ে  শ্রীবাস দাস বাবাজী র স্নেহাশ্রয়েই কেটেছে এঁদের জীবন।শ্রীবাস দাস তার বেশ কিছু জমি আশ্রমকে দান করেছিলেন। এভাবেই চলে যায়।
মেণকা দাসী র মাধ্যমে কেন্দুলী র মেলা থেকে বিশ্বনাথ দাস বাউল কে অযোধ্যার আশ্রমে নিয়ে আসা।
তাঁর সুমধুর গানে জমে উঠল আখড়া আশ্রম।
মানুষের ভিড় বাড়ল। মানুষ যথাসাধ্য দেয়।
বিশ্বনাথ দাসের গান আর দীনবন্ধু র সাদর আমন্ত্রনে এখানে অনেকে এসেছেন।
বিশ্বনাথের গানে ছিল এক আশ্চর্য ভাবময়তা।
তাঁর মা ও ছিলেন কীর্তন গায়িকা। অতি চমৎকার গলা। মাঝে মাঝে গুনগুন করে গান গাইতেন। আমি তার কোলে বসে সে গান শুনেছি সাতকাহনিয়া আখড়ায়। আমি যে মাতা মার পালিত পুত্র। অতএব -
বিশ্বনাথের পিতা ছিলেন কোটা - শীর্ষা গ্রামের ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান। সে জীবনের কথা আলাদা করে ই বলতে হবে।
চমৎকার সুশ্রী সুন্দর চেহারা ছিল বিশ্বনাথ দাস বাউলের। চোখ দুটি ছিল মায়াময়। বাউল গানের আসরে তাঁর উপস্থিতি র এক আলাদা মাত্রা ছিল।
ঘাড় পর্যন্ত নেমে আসা চুল। সুঠাম কাঠামো।
আসরে বাউলের স্বল্প ছোট ছোট নাচ।
পরবর্তী সময়ে এই আখড়ার গৌরী বালার ছোট কন্যা পদ্মাবতী র সাথে তাঁর বৈষ্ণবীয় মতে বিবাহ হয়।
ধীরে ধীরে বিশ্বনাথ দাস বাউলের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে।
কেন্দুলী র আখড়ায় আখড়ায় গান।
পূর্ণদাস তো আছেন ই স্বমহিমায়। মনোহর ক্ষেপার আখড়ায় তাঁর বাঁধা আসর। তখন সরকারী মঞ্চ নাই।
পূর্ণদাস ; বিশ্বনাথ দাস ; আর সেই সময়ের আরেক নামী দিলীপ বন্দোপাধ্যায়। আরও কেউ কেউ আছেন। তবে এখনকার মতো নিজেকে তৈরী না করে তার স্বরে চিৎকৃত কীর্তনের অসংখ্য গায়ক গায়িকা নয়।
হায়রে কীর্তনের মধুর রস। অন্ততঃ জয়দেব - কেন্দুলী র মেলায় আমরা কেউ যেন না খুঁজি।
সময় সম্পূর্ণ বদলে গেছে। অর্থোপার্জন করতে ই হবে। প্রমোশন ও চাই। তিলোত্তমা আশ্রমের প্রয়াত শিব নারায়ন সাহা এই কাজটা করছিলেন। অনেককে তিনি আসর পাইয়ে দিয়েছেন। তাঁরা প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন।
  বিশ্বনাথ দের প্রতিষ্ঠা র পিছনে দৌড়তে হয়নি।
গান ছিল তাঁর সহজাত। মা এবং বাবার উভয়ের তরফ থেকে। অনেক মহাজন পদকর্তার পদ ছিল তাঁদের ঝুলিতে।
লেখাপড়া জানতেন না। কেন যে হয়নি ; কি জানি।
অথচ কি ভাবে যে বিদেশিনী মহিলা ভক্ত দের সামলাতেন! মধ্যবয়সে তখন তাঁর অনেক মহিলা ভক্ত। বেশ কয়েকবার বিদেশ গেছেন।
সুইডেন তো অনেক শিষ্য জুটে গিয়েছিল।
আবার তাঁরা দিনের পর দিন তাঁর বোলপুরের বাড়িতে এসে থেকেছেন। তাঁর কাছ থেকে শিখেছেন।
আবার যখন এই সব বিদেশী বিদেশিনী ভক্ত দের নিয়ে অযোধ্যা গ্রামে আসতেন  তখন আশ্রমে অনেকের ভিড় জমে যেত। গ্রামের সাধারন মানুষ কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাঁদের দিকে চেয়ে থাকত।
সাতকাহনিয়া আশ্রমে ৩ তারিখের মহোৎসব এর প্রসাদ বিতরণ  শেষ হতে হতে বিকেল গড়িয়ে যেত।
চারপাশের গ্রাম থেকে ভক্ত জনরা আসতেন।
যথাসাধ্য আয়োজনের দ্বারাই সবাই কে পাতা পেড়ে খাওয়ানো হত।
বিকাল শেষ হলেই আবার রাতের আয়োজন।
আর রাতে বসত গানের আসর।
সে আসরের মধ্যমণি বিশ্বনাথ দাস বাউল।
তাঁর গান শোনার জন্য আখড়ার উঠোন ভরে যেত।
" রাখিতে নারিলি প্রেম জল কাঁচা হাঁড়িতে "
---------------   --------------  ---------------------------
© প্রণব ভট্টাচার্য।
তথ্য সহায়তা। স্বপন দাস বৈরাগ্য। পিতা। দীনবন্ধু দাস বৈরাগ্য। অযোধ্যা আশ্রম। বনকাটি। কাঁকসা

No comments:

Post a Comment