নবীন দাস বাবাজীর আশ্রম সাতকাহনিয়া।
মাতামা বালকদাসী এবং অন্নপূর্ণা দেব্যা। পর্ব --৬।
( এই পর্ব টি বোলপুর কলেজের অধ্যাপক স্নেহভাজন রামানুজ মুখোপাধ্যায় কে উৎসর্গ করছি)
তাবিজ ; কবজ ; জলপড়া বা গাছ গাছড়ার টোটকা ওষুধ নিতে আশ্রমে তখন অনেকে আসত। অ্যালোপ্যাথি ওষুধের প্রচলন গাঁ গঞ্জে হলেও এসবের প্রতি মানুষের বিশ্বাস ছিলই।
থাকবে না ই বা কেন। এতদিনের অভ্যেস।
রোগা পাতলা দুবলা চেহারার আমাকে তো মাতামার পাঁচন খেতেই হত। কালমেঘ বাসক আর শিউলী র থেতো রস।
কালমেঘের তেতো। মুখ থেকে তেতো স্বাদ কাটতেই চাইতোনা। তাকে কাটানোর জন্য আবার কত ঝকমারি।
আমলা হরিতকী বহেড়ার ত্রিফলার জল। রাতে ভেজানো থাকত। পেটের জন্য সত্যিই উপকারী। এগুলো আমরা প্রায় সকলেই জানি। অম্বল হলে ভাস্কর লবণ। বাচ্চাদের কৃমিতে আনারস পাতার রস। জ্বরের পর মুখের স্বাদ ফেরাতে কচি শিউলি পাতার রস বা বড়া করে গরম ভাতে মেখে খাওয়া।
কি গাঁদালের পাতার বড়া। বলবেন কি দুর্গন্ধ।
কি পলতা পাতা মানে পটল পাতা র বড়া।
ঘৃতকুমারী তো অ্যালোভেরা হবার পর দাম পাচ্ছে
আর তখন মাতামা কত ভাবে তার ব্যবহার করত।
আজ আর কোথাও কোন পুকুর পাড়ে সেই ' 'ঘিতকুমরী ' দেখতে পাবেন না। সে সব কবেই রাতের অন্ধকারে গোঁড়া সমেত চুরি হয়ে গেল। এখন ট্যিসু কালচার করে চাষ হচ্ছে বহুজাতিক বাগানে। এমন যে কত হারালাম।
লাগে। কাজে লাগে। উপকার হয়।
প্রায়ই জঙ্গলে যেত মাতামা। আর সঙ্গে আমি কি আর না থাকি। বর্ষা য় জঙ্গল এর রূপ আলাদা। মাটিতে কত গুল্ম লতা। অনন্ত মূল ; ঈশ্বর মূল ; অশ্বগন্ধা ; সর্পগন্ধা ; আরও কত লতা গুল্ম।
জঙ্গল তো চার দিকেই। উত্তরে নদী। অজয়। কোন কোন সময় সেই দিকে। অজয়ের চরে বা পতিত জমিতে নানা গাছ গাছড়া।
তখন নদীর ধারে জমিতে প্রাকৃতিক ' ঘি করলা ' হত প্রচুর।
মাতামার সাথে তুলতাম। তার স্বাদ কি আজকের - কি বলে যেন কাঁকরোল তার সাথে তুলনা হয়। সেই ঘি করলার সর্ষে ঝাল বা পোস্ত - আহা তার স্বাদ। যেন আজও মুখে লেগে আছে। নদী ধারে অনেক শতমূলের লতা হত। অনেকে মোরব্বা নিশ্চয়ই খেয়েছেন। তার ফুলের কি অপূর্ব গন্ধ। এর ও ওষধি গুণ আছে। আরও কত লতা পাতা তুলত মাতামা।
আর জঙ্গলে যাওয়ার অন্য মজা ছিল ' ছাতু ' তোলা।
শাল ছাড়া কি জঙ্গল হয়! শাল পাতা পচে মাটিকে উর্বর করত। আর এখন জঙ্গল ফাঁক তো ভরাট করো সোনাঝুরি ; ইউক্যালিপটাস দিয়ে। হ্যাঁ । এত লোক বাড়ল। সোনাঝুরি গাছের কাঠ ভালো। ভালো আসবাবপত্র তৈরী হয়।
ইউক্যালিপটাস এর কাঠ এতো ভালো নয়। তবে কাগজ কারখানায় দারুণ চাহিদা। আর জঙ্গলে র মাটির গেল বারোটা বেজে। অনুর্বর করে দিল মাটিকে।
আমাদের রাঢ় মাটির স্বাভাবিক উদ্ভিদ গুলো হারিয়ে গেলো।
অনেক খুঁজেও একটা ' ভেলা ' বা ধব বা মুর্গা বা গাব গাছ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। কত নাম আর বলব। লতা পলাশ বললে কে আর চিনবে। ভুঁই কুমড়ো ; একরকম এর সাদা বুনো রসুন ইত্যাদি ইত্যাদি।
কত রকমের ছাতু হত শাল জঙ্গলে। পাতা পচে ছাতু মানে ছত্রাক জন্মালে একধরনের আঁষটে গন্ধ পাওয়া যেত।
সব জার্মিনেশনের এক ধরনের গন্ধ থাকেই।
সব ছাতু তো খাওয়ার নয়। বিষাক্ত আছে। কালো একধরনের ছাতু ' আঙ্গারে ' বলতাম। খেতে মাংসের মেটের মতো। তবে আমার বেশী লোভ মাটির নীচে হয় যে ' কুরকুরে ' ছাতু।
ঠিক চিনতাম। মাতামা শিখিয়ে দিয়েছিল। তুলতে তুলতে
খুঁজতে খুঁজতে অনেক ভিতরে চলে যেতাম।
জঙ্গলে যাবার আগে মা গা বেঁধে দিত। কি যে মন্ত্র বলত আর ফূঁ দিত। যাই হোক জঙ্গলে কোন দিন কিছু হয়নি। শাল পাতার নীচে একরকম এর ছোট্ট শুঁয়ো জাতীয় পোকা। গায়ে লাগলে ভীষণ জ্বলন। লেগেছে তো বটেই কয়েক বার।
আহা। সেই কুরকুরে ছাতুর কি স্বাদ। খোসা ছাড়িয়ে গোল গোল ছাতুর ঝাল। ছোট ছোট আলু দিয়ে।
এখনকার খড়ে আর পোয়াল ছাতু হয়না। দুর্গাপুজো র সময়ে শর ঝোঁপের ধারে প্রচুর দুর্গাছাতু হত। সব গেছে। গেল।
এখন মাশরুম চাষ কর। শক্ত স্বাদহীন। তবু রেষ্টুরেন্ট এ খেয়ে আহা মাশরুমের স্যুপ খেলাম!
জঙ্গলে ঘুরতে ঘুরতে দূরে ও চলে যেতাম। ঐ নীল কুঠি র জঙ্গলে র দিকে। সেখানে একবার এক ঝোপের ধারে বেজি আর এক বিষধর সাপের লড়াই দেখেছিলাম।
পিয়ালের সময় পাকা পিয়াল তুলতাম। ছোট্ট ছোট্ট গাছে ততদিনে চাপতে পারি বেশ। পাকা কেন্দু ফল খেতে চমৎকার লাগত। কত রকমের জাম ছিল জঙ্গলে। খুব ছোট ছোট কুড়ুর জাম। কি মিষ্টি। মাটিতে ছোট ঝোপ মতো খেজুর গাছে
পাকা কালো খেজুর। কি মিষ্টি ছিল। এর পাতা দিয়ে যে চাটাই বোনা হত তা ছিল শীতল পাটির মতো।
জঙ্গল কথা সহজে ফুরোবার নয়। ' আলকুশি ' ও আছে।
তার কালো বীজ। উপকারী।
একবার মষ্টারমশাই চণ্ডী বাবুর সাথে অযোধ্যা জুনিয়র হাই স্কুলে প্রায় সদ্য জয়েন করা এক সুদর্শন যুবক মাষ্টার মশাই
এলেন আমাদের বাড়িতে দাদুর কাছে। দাদুর সাথে আলোচনা করে তিনজনেই গেলেন মাতামার কাছে। সব শুনে মাতামা
সকালে এসে ওষুধ খেয়ে যেতে বললেন। প্রস্রাবের সমস্যা ; তার সাথে আরও কিছু। কয়েক দিনের মধ্যে তাঁর সমস্যা কমে গেল। ওলটকম্বল এর পাতা থেতো করে মিছরির জলে ভেজানো রস। পিচ্ছিল ; ল্যালপেলে সরবৎ। আর কিছু ওষুধ।
মাতামাদের কাছে মেয়েরা আসে তাদের সমস্যা নিয়ে।
মেয়েদের তো নানা সমস্যা। সহজে বলতে পারেনা।
এখানে এসে মন খুলে বলতে পারত।
নানা গাছগাছড়ার ওষুধ নিত।
যা সাধ্য পয়সা দিত। বা চাল আলু।
অনেকে তাদের স্বামীদের সমস্যা নিয়েও আসত।
স্বামী বাবুদের ও তো লজ্জা কম নয়।
কি করবে বৌ কে ই পাঠাতো।
তখন ভালো ও হত।
না হলে মানুষ আসবে কেন।
এত বিষ তো তখন শরীরে ঢোকে নি। তাই কাজ হত।
আর এখন জেনে শুনেই বিষপান করতে হচ্ছে প্রতিদিন।
আর উপায় নাই।
একটা গল্প মনে পড়ে গেল। যদি শোনেন। তখন ভীরু পায়ে কলেজে পড়তে গেছি। সে না হয় অন্য কথা -
কলেজে আমাদের এক কেমিস্ট্রির মাষ্টার মশাই কে অন্যেরা বেশ খেপাতেন । আমাদের কয়েক জন কে সঙ্গ দিতে হত।
ভদ্রলোক সকালের টিউশনি পড়িয়ে যখন হাটে বাজারে বেরুতেন তখন বেশ দেরী হয়ে গেছে। তিনি আর টাটকা নিটোল কিছু পেতেন না। ঐ কানা কুঁজো যা পেতেন ঝটপট কম দামে কিনে
বাসায় পৌঁছাতেন। তারপর বাড়ির অবস্থা টা কল্পনা করে নিন। অফ পিরিয়ডে বা টিফিনের সময় -
- স্যার আজ আর হাটে কিছু পেয়েছিলেন
- কেন হে। সবই পেয়েছি। তা তোমাদের কি দরকার।
অন্য এক মজাদার মাষ্টার মশাই ঠিক তখুনি বলতেন
যাও বৌ দিকে জিজ্ঞেস করে এসো। দ্যাখো গিয়ে মজা -
যত সব কানা কুঁজো পোকা কাটা কিনে ঘর গেছে -
আর যায় কোথা
- কি জন্যে যে তোমরা সব কেমেস্ট্রী পড়তে এসেছিলে হে
এ টুকু জ্ঞানও নেই যে পোকা কাটা গুলো তে অন্তত ইনসেক্টিসাইড পড়েনি। শুধাও ওঁকে কেমিক্যাল কম্পোজিশন টা কি। আর তার শরীরে এফেক্ট টা কি -
এই রকম মজা চলত।
হোমিওপ্যাথি তে বিশ্বাসী এক মাষ্টারমশাই কে বলে দিলেই হত স্যার ঐ টিকটিকি র ডিমের মতো গুলিতে -
ব্যস। আর যায় কোথা।
শুরু হয়ে যেত তর্ক
তার ভিতরে ও মজা ছিল। শিক্ষাও ছিল। ইনঅর্গানিক এর সাথে লাগত ফিজিকাল এর। অরগ্যানিকের মাষ্টারমশাই রেফারি।
আহা। সে দিন গুলোয় আর ফেরা যাবে না।
কোথায় চলে এসেছি গল্প করতে করতে।
গল্প বলিয়ে মানুষ।
জানেন ই তো যে অনেকে ভালোবেসে ' কথক ঠাকুর ' বলেন।
আবার কেউ " সেনপাহাড়ী 'র কথাকার।
আপনাদের ভালোবাসা ই পাথেয়।
এখনও পথ হাঁটি অখ্যাত অবজ্ঞাত গ্রামের পথে।
কত গল্প কথা কাহিনী যে রয়ে গেল মাটিতে মাটিতে।
----------- ------------- ------- © প্রণব ভট্টাচার্য।
No comments:
Post a Comment