বাবাজী বৈষ্ণব আখড়া। ভারতী বাবা।
------------------------------------------------------- ১০ ম পর্ব
বলা যায় হঠাৎ ই একদিন এই অযোধ্যা আশ্রমে এলেন ভারতী বাবা। নিয়ে এসেছিলেন সুধীর মণ্ডল। সাধারনের কাছে সুধীর বাবাজী। তাঁর মধ্যেও আধ্যাত্মিক চেতনা ছিল। গৈরিক বসন। শ্মশ্রু মণ্ডিত মুখমণ্ডল। বেশ উজ্জ্বল চোখ। কাঁধে বেশ বড়ো ঝোলা। তাতে একটা বড় মাপের ডায়েরী। গ্রাম ঘোরেন।শিক্ষিত বিশিষ্ট মানুষদের সাথে আলাপ করেন। আমাদের বাড়িতে এসে দাদুর সাথে গল্প করেন। এ বাড়িতে তো সবারই যাতায়াত। কারো কোন বাধা নেই। তখন গ্রামজীবন তো তাই ই ছিল। আজকের মতো জটিল মুখগোমড়া ভাব তো ছিলনা।
তাঁকে চারপাশ টা ঘুরিয়ে দেখান ; কোনদিন মেনকা দাসী কোনদিন দীনবন্ধু দাস বৈরাগ্য।
শেষপর্যন্ত তিনি স্থির করলেন স্থায়ী ভাবে এই আশ্রমেই থাকবেন। কিন্তু থাকবেন কোথায়। প্রথম দিকে ঘর ভাড়া চেয়েছিলেন। তো তা মেলা তো আর সহজ নয় এই গ্রাম গঞ্জে। যাই হোক আশ্রমের উত্তর দিকে অনুমতি সাপেক্ষে ই শুরু করলেন মাটির দেওয়ালের উপরকোঠা বাড়ি। তার আগেই বানিয়ে নিলেন পাকা বাথরুম এবং পায়খানা। এখানেই তাঁর রুচির পরিচয়। তখন এখানের কোন বাড়িতেই ওসব নেই।
একদিন সেই বাড়ি সম্পূর্ণ হল। নিজের কিছু উপার্জনের জন্য ঠিক করলেন হাইস্কুলের ছেলেমেয়েদের টিউশন পড়াবেন। কিন্তু সম্পূর্ণ অপরিচিত এক মানুষের কাছে পড়াতে দিতে অভিভাবক দের আপত্তি ছিল। তবু কিছু ছেলে মেয়ে তাঁর কাছে পড়তে এলো। তাতে আর কি হয়।
অথচ আমি তাঁর ডায়েরী দেখেছি। ইংরেজি তে নানা নোট। ইংরেজি এবং সংস্কৃত সাহিত্যে তাঁর যথেষ্ট জ্ঞান ছিল। আমাদের বাড়িতে গল্পে গল্পে বলেছিলেন যে তিনি কুরুক্ষেত্র বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাষ্টারস। সেখানে না কি পড়িয়েওছেন। জানিনা ঠিক।
পূর্বজীবন এর কথা এঁরা বলেন না। জানতে চাওয়া ও হয়তো ঠিকও নয়। তবু মানুষের কৌতুহল তো মেটেনা। নানা চোখ নানা ভাবে দেখে।
'বাঃ। ভালো জুটল বাপু। আখড়ার কেমন উন্নতি হচ্ছে। দোতালা মাটির ঘর হল। পাকা পায়খানা বাথরুম হল। কি জানি আর ও কত কি হবে '
দীনুর কপাল খুলে গেল। এ তো বেশ টাকা পয়সা ওয়ালা লোক '। অবাক চাহনি মানুষের। নানা কথা। নানা প্রশ্ন। কত সন্দেহ।
তারপর ধীরে ধীরে মেনকা দাসীর সাথে গ্রাম থেকে গ্রামে ঘুরতে লাগলেন। মেনকা মাধুকরী করে। উনি তো তা পারেন না। মানুষ যদি তাঁকে ভালোবেসে কিছু দিলে আপত্তি ও করেন না।
আবার মাঝে মাঝে মেনকা র সাথে মনোমালিন্য ও হয়।
হঠাৎ ই একদিন ঠিক করলেন এই এলাকা ছেড়ে চলে যাবেন। কিন্তু কোথায় যাবেন। মেনকা র উপর নির্ভরতা জন্মে গেছে। ত্রিলোকচন্দ্রপুরের আশ্রমে গিয়ে একদিন উঠলেন। সেখানে তখন দীনবন্ধু র মেয়ের বিয়ে হয়েছে বৈরাগী ঘরের ছেলের সাথে। ছেলেটি ভালো। এবার এখানে ঘর বাঁধা। ঐ এলাকা য় ত্রিলোকচন্দ্রপুরের আশেপাশে নানা গ্রামে ঘোরেন।
মেণকার সাথেই। মেণকা ই সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। একটা ভালো পরিচিতি গড়ে ওঠে তাঁর।
মাঝে মাঝে বৈষ্ণবীয় অনুষ্ঠানাদিতে অযোধ্যা আখড়ায় আসেন। কয়েকদিন থাকেন।
মেণকা দাসী ছিলেন বাস্তববাদী। তিনি জানতেন ভাই ; বা ভাই বৌ এর সাথে একসাথে থাকা যাবেনা।
হয়তো আরো কিছু সমস্যা ছিল।
ভাই দীনবন্ধু তখন বেশ কিছুদিন বনকাটি আশ্রমে বসবাস করছেন। প্রথমা স্ত্রীকে নিয়ে।
তাই নিজে থেকেই সরে যাবার পরিকল্পনা করেন।
ভারতী বাবা কে তো ফেলে যাওয়া যায়না।
সাথেই নিয়ে যান।
তিনিও ততোদিনে মেনকা র উপরে নির্ভরশীল হয়ে উঠেছেন।
এই মানুষটি অনেকের কাছেই অচেনা অধরা রয়ে গেলেন। অথচ পরে জেনেছি শিক্ষিত সম্ভ্রান্ত বংশের সন্তান। মুর্শিদাবাদ এর কান্দি এলাকার সিংহ রায় পরিবারের সন্তান।তাঁর ভাই রেলে কাজ করতেন। অফিসার ছিলেন। রেলের পাসে প্রায় সারা ভারত ঘুরেছেন ভারতী বাবা। মানসিক শান্তি খুঁজেছেন।
সংসার ত্যাগের কারন - অজানা ই।
তাঁর মৃত্যুর পর সংবাদ পেয়ে তাঁর দুই মেয়ে এসে তাঁর মরদেহ নিয়ে যান। তখনই কিছুটা হলেও জানা যায়। মেনকা দাসীর সমাধি অযোধ্যা আশ্রমের সমাধি চত্বরেই আছে।
স্বপন দাসবৈরাগ্য স্বীকার করেন যে ' ভারতী দাদু আমাদের জন্য অনেক করেছেন - তাঁর অবদান অনেক'
সেই মানুষ টি কে খুব মনে পড়ে।
চেনা হয়নি। চেনা যায়নি। মানুষকে কি সহজে চেনা বোঝা যায়।!
No comments:
Post a Comment