Friday, 26 February 2021

ভারতী বাবা। মেনকা দাসী। বাবাজী বৈষ্ণব আখড়া

বাবাজী বৈষ্ণব আখড়া। ভারতী বাবা।
-------------------------------------------------------  ১০ ম পর্ব
  বলা যায় হঠাৎ ই একদিন এই অযোধ্যা আশ্রমে এলেন ভারতী বাবা। নিয়ে এসেছিলেন সুধীর মণ্ডল। সাধারনের কাছে সুধীর বাবাজী। তাঁর মধ্যেও আধ্যাত্মিক চেতনা ছিল। গৈরিক বসন। শ্মশ্রু মণ্ডিত মুখমণ্ডল। বেশ উজ্জ্বল চোখ। কাঁধে বেশ বড়ো ঝোলা। তাতে একটা বড় মাপের ডায়েরী। গ্রাম ঘোরেন।শিক্ষিত বিশিষ্ট মানুষদের সাথে আলাপ করেন।  আমাদের বাড়িতে এসে দাদুর সাথে গল্প করেন। এ বাড়িতে তো সবারই যাতায়াত। কারো কোন বাধা নেই। তখন গ্রামজীবন তো তাই ই ছিল। আজকের মতো জটিল মুখগোমড়া ভাব তো ছিলনা।
তাঁকে  চারপাশ টা ঘুরিয়ে দেখান ; কোনদিন মেনকা দাসী কোনদিন দীনবন্ধু দাস বৈরাগ্য।
শেষপর্যন্ত তিনি স্থির করলেন স্থায়ী ভাবে এই আশ্রমেই থাকবেন। কিন্তু থাকবেন কোথায়। প্রথম দিকে ঘর ভাড়া চেয়েছিলেন। তো তা মেলা তো আর সহজ নয় এই গ্রাম গঞ্জে। যাই হোক আশ্রমের উত্তর দিকে অনুমতি সাপেক্ষে ই শুরু করলেন মাটির দেওয়ালের উপরকোঠা বাড়ি। তার আগেই বানিয়ে নিলেন পাকা বাথরুম এবং পায়খানা। এখানেই তাঁর রুচির পরিচয়। তখন এখানের কোন বাড়িতেই ওসব নেই।
একদিন সেই বাড়ি সম্পূর্ণ হল। নিজের কিছু উপার্জনের জন্য ঠিক করলেন  হাইস্কুলের ছেলেমেয়েদের টিউশন পড়াবেন। কিন্তু সম্পূর্ণ অপরিচিত এক মানুষের কাছে পড়াতে দিতে অভিভাবক দের আপত্তি ছিল। তবু কিছু ছেলে মেয়ে তাঁর কাছে পড়তে এলো। তাতে আর কি হয়।
অথচ আমি তাঁর ডায়েরী দেখেছি। ইংরেজি তে নানা নোট। ইংরেজি এবং সংস্কৃত সাহিত্যে তাঁর যথেষ্ট জ্ঞান ছিল। আমাদের বাড়িতে গল্পে গল্পে বলেছিলেন যে তিনি কুরুক্ষেত্র বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাষ্টারস। সেখানে না কি পড়িয়েওছেন। জানিনা ঠিক।
পূর্বজীবন এর কথা এঁরা বলেন না। জানতে চাওয়া ও হয়তো ঠিকও নয়। তবু মানুষের কৌতুহল তো মেটেনা। নানা চোখ নানা ভাবে দেখে।
'বাঃ। ভালো জুটল বাপু। আখড়ার কেমন উন্নতি হচ্ছে। দোতালা মাটির ঘর হল। পাকা পায়খানা বাথরুম হল। কি জানি আর ও কত কি হবে '
দীনুর কপাল খুলে গেল। এ তো বেশ টাকা পয়সা ওয়ালা লোক '। অবাক চাহনি মানুষের। নানা কথা। নানা প্রশ্ন। কত সন্দেহ।
  তারপর ধীরে ধীরে মেনকা দাসীর সাথে গ্রাম থেকে গ্রামে ঘুরতে লাগলেন। মেনকা মাধুকরী করে। উনি তো তা পারেন না। মানুষ যদি তাঁকে ভালোবেসে কিছু দিলে আপত্তি ও করেন না।
আবার মাঝে মাঝে মেনকা র সাথে মনোমালিন্য ও হয়।
হঠাৎ ই একদিন ঠিক করলেন এই এলাকা ছেড়ে চলে যাবেন। কিন্তু কোথায় যাবেন। মেনকা র উপর নির্ভরতা জন্মে গেছে। ত্রিলোকচন্দ্রপুরের আশ্রমে গিয়ে একদিন উঠলেন। সেখানে তখন দীনবন্ধু র মেয়ের বিয়ে হয়েছে বৈরাগী ঘরের ছেলের সাথে। ছেলেটি ভালো। এবার এখানে ঘর বাঁধা। ঐ এলাকা য় ত্রিলোকচন্দ্রপুরের আশেপাশে নানা গ্রামে ঘোরেন।
মেণকার সাথেই। মেণকা ই সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। একটা ভালো পরিচিতি গড়ে ওঠে তাঁর।
  মাঝে মাঝে বৈষ্ণবীয় অনুষ্ঠানাদিতে অযোধ্যা আখড়ায় আসেন। কয়েকদিন থাকেন।
মেণকা দাসী ছিলেন বাস্তববাদী। তিনি জানতেন ভাই ; বা ভাই বৌ এর সাথে একসাথে থাকা যাবেনা।
হয়তো আরো কিছু সমস্যা ছিল।
ভাই দীনবন্ধু তখন বেশ কিছুদিন বনকাটি আশ্রমে বসবাস করছেন। প্রথমা স্ত্রীকে নিয়ে।

তাই নিজে থেকেই সরে যাবার পরিকল্পনা করেন।
ভারতী বাবা কে তো ফেলে যাওয়া যায়না।
সাথেই নিয়ে যান।
তিনিও ততোদিনে মেনকা র উপরে নির্ভরশীল হয়ে উঠেছেন।
এই মানুষটি অনেকের কাছেই অচেনা অধরা রয়ে গেলেন। অথচ পরে জেনেছি শিক্ষিত সম্ভ্রান্ত বংশের সন্তান। মুর্শিদাবাদ এর কান্দি এলাকার সিংহ রায় পরিবারের সন্তান।তাঁর ভাই রেলে কাজ করতেন। অফিসার ছিলেন। রেলের পাসে প্রায় সারা ভারত ঘুরেছেন ভারতী বাবা। মানসিক শান্তি খুঁজেছেন।
সংসার ত্যাগের কারন  - অজানা ই।
তাঁর মৃত্যুর পর সংবাদ পেয়ে তাঁর দুই মেয়ে এসে তাঁর মরদেহ নিয়ে যান। তখনই কিছুটা হলেও জানা যায়। মেনকা দাসীর সমাধি অযোধ্যা আশ্রমের সমাধি চত্বরেই আছে।
স্বপন দাসবৈরাগ্য স্বীকার করেন যে ' ভারতী দাদু আমাদের জন্য অনেক করেছেন - তাঁর অবদান অনেক'
  সেই মানুষ টি কে খুব মনে পড়ে।
চেনা হয়নি। চেনা যায়নি। মানুষকে কি সহজে চেনা বোঝা যায়।!
---------------------------   ---------------© প্রণব ভট্টাচার্য।

Wednesday, 24 February 2021

বাবাজী বৈষ্ণব আখড়া। গৌরী মা

অযোধ্যা আশ্রমের গৌরী মা            পর্ব  ৯
--------------------------------------------------------------
তারপর
ঘর তো ছাড়ল গৌরী। ভোলানাথের সাথে।
ভোলানাথ তাকে নিয়ে এলো অযোধ্যায়।
এতই সোজা। সেদিনের সমাজে মেনে নেওয়া।
ভোলানাথ কে তার আত্মীয় পরিজন তাম্বুলী সমাজের চাপে সমাজ চ্যুতই করল।
নিজের ঘরে ঠাঁই নেই নিজেরই তো আবার গৌরী।
কোনভাবে একটা ঘর জুটল। বাঁচতে তো হবে।
নিজের মনোহারী ব্যবসা। মেলায় খেলায় ফেরী করে।
নিজের ভাগের জমিজায়গা অন্য শরিকরা প্রায় হাতিয়ে নিল।
এ দিকে একের পর এক সন্তানের জন্ম দিয়ে গেছে গৌরী। তাদের বড় করে তোলার চিন্তা। মানুষ করার ভাবনা। সংসারে অনটন দেখা দিল। ভোলানাথের কর্মক্ষমতা কমে আসছে।
' জাত খোয়ালে বোরেগী '। গাঁ ঘরে তো চালু আছে এ কথা। গাঁয়ের শেষে পূর্বদিকে সূত্রধর পাড়ার ধারে
বলাই দাস বাবাজী র আশ্রম।
একদিন সেখানে পৌঁছাতে হল। দুজনকেই।
সেখানেই ঠাঁই মিলল। বাঁশের কঞ্চির বেড়া র উপরে মাটি লেপে দেওয়াল। খড়ের ছাউনি। এই আশ্রয়।
  সহজিয়া বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষা নিলেন গৌরী।
বলাই দাস বাবাজী র কাছে ই।
এবার পথে নামতে হয়। মাধুকরী র জন্য। তার মুখশ্রী তে কান্না করুন শ্রী। মিষ্ট মধুর বচন।
কেউ ফেরাতে পারেন না। মহিলারা ই মূলতঃ। সংসার চলে এভাবেই। কোন মতে। নিরূপায়।
  রোগভোগের পর একদিন ভোলানাথ দেহ রাখলেন।
শবদেহ দাহের জন্য কেউ এলোনা। কি পরিণতি।
সেই মৃতদেহ আগলে বসে থাকে গৌরী। কোনরকমে আশ্রমের বাইরে পুকুর পাড়ে ঝোপের ধারে তাঁর মৃতদেহ রেখে আসতে হয়।
পরে সেই সময়ের ইউনিয়নবোর্ড এর মাধ্যমে শবদেহ দাহের ব্যবস্থা হয়।
গৌরী একা। তিন সন্তানই বড় হয়ে উঠছে। উঠেছে।
দীনবন্ধু মেলায় মনোহারী ব্যবসা করার চেষ্টা করে।
মেণকা কাজের খোঁজে কলকাতা চলে যায়। বরাবরের সাহসী। পরে ভাই এর জন্য ও একটা কাজ খুঁজে ভাইকে ও নিয়ে যায়। যদিও কিছুদিন পর অসুস্থতা র জন্য  ফিরে আসতে হয় দীনবন্ধুকে।
কি চমৎকার ব্যারিটোন ভয়েস ছিল তাঁর। পরবর্তী সময়ে তাঁর ভোরের টহল ছিল অনবদ্য।
আমার খুব আক্ষেপ হয় কেন যে সে গান শেখেনি।আদুরিয়ার গোবর্ধন রায় মশাই এর কাছে কিছুদিন শিখেছিল।
গান তাকে অনেক উঁচু জায়গায় পৌঁছে দিতে পারত। পরবর্তী সময়ে  শ্রীবাস দাস বাবাজী র স্নেহাশ্রয়েই কেটেছে এঁদের জীবন।শ্রীবাস দাস তার বেশ কিছু জমি আশ্রমকে দান করেছিলেন। এভাবেই চলে যায়।
মেণকা দাসী র মাধ্যমে কেন্দুলী র মেলা থেকে বিশ্বনাথ দাস বাউল কে অযোধ্যার আশ্রমে নিয়ে আসা।
তাঁর সুমধুর গানে জমে উঠল আখড়া আশ্রম।
মানুষের ভিড় বাড়ল। মানুষ যথাসাধ্য দেয়।
বিশ্বনাথ দাসের গান আর দীনবন্ধু র সাদর আমন্ত্রনে এখানে অনেকে এসেছেন।
বিশ্বনাথের গানে ছিল এক আশ্চর্য ভাবময়তা।
তাঁর মা ও ছিলেন কীর্তন গায়িকা। অতি চমৎকার গলা। মাঝে মাঝে গুনগুন করে গান গাইতেন। আমি তার কোলে বসে সে গান শুনেছি সাতকাহনিয়া আখড়ায়। আমি যে মাতা মার পালিত পুত্র। অতএব -
বিশ্বনাথের পিতা ছিলেন কোটা - শীর্ষা গ্রামের ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান। সে জীবনের কথা আলাদা করে ই বলতে হবে।
চমৎকার সুশ্রী সুন্দর চেহারা ছিল বিশ্বনাথ দাস বাউলের। চোখ দুটি ছিল মায়াময়। বাউল গানের আসরে তাঁর উপস্থিতি র এক আলাদা মাত্রা ছিল।
ঘাড় পর্যন্ত নেমে আসা চুল। সুঠাম কাঠামো।
আসরে বাউলের স্বল্প ছোট ছোট নাচ।
পরবর্তী সময়ে এই আখড়ার গৌরী বালার ছোট কন্যা পদ্মাবতী র সাথে তাঁর বৈষ্ণবীয় মতে বিবাহ হয়।
ধীরে ধীরে বিশ্বনাথ দাস বাউলের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে।
কেন্দুলী র আখড়ায় আখড়ায় গান।
পূর্ণদাস তো আছেন ই স্বমহিমায়। মনোহর ক্ষেপার আখড়ায় তাঁর বাঁধা আসর। তখন সরকারী মঞ্চ নাই।
পূর্ণদাস ; বিশ্বনাথ দাস ; আর সেই সময়ের আরেক নামী দিলীপ বন্দোপাধ্যায়। আরও কেউ কেউ আছেন। তবে এখনকার মতো নিজেকে তৈরী না করে তার স্বরে চিৎকৃত কীর্তনের অসংখ্য গায়ক গায়িকা নয়।
হায়রে কীর্তনের মধুর রস। অন্ততঃ জয়দেব - কেন্দুলী র মেলায় আমরা কেউ যেন না খুঁজি।
সময় সম্পূর্ণ বদলে গেছে। অর্থোপার্জন করতে ই হবে। প্রমোশন ও চাই। তিলোত্তমা আশ্রমের প্রয়াত শিব নারায়ন সাহা এই কাজটা করছিলেন। অনেককে তিনি আসর পাইয়ে দিয়েছেন। তাঁরা প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন।
  বিশ্বনাথ দের প্রতিষ্ঠা র পিছনে দৌড়তে হয়নি।
গান ছিল তাঁর সহজাত। মা এবং বাবার উভয়ের তরফ থেকে। অনেক মহাজন পদকর্তার পদ ছিল তাঁদের ঝুলিতে।
লেখাপড়া জানতেন না। কেন যে হয়নি ; কি জানি।
অথচ কি ভাবে যে বিদেশিনী মহিলা ভক্ত দের সামলাতেন! মধ্যবয়সে তখন তাঁর অনেক মহিলা ভক্ত। বেশ কয়েকবার বিদেশ গেছেন।
সুইডেন তো অনেক শিষ্য জুটে গিয়েছিল।
আবার তাঁরা দিনের পর দিন তাঁর বোলপুরের বাড়িতে এসে থেকেছেন। তাঁর কাছ থেকে শিখেছেন।
আবার যখন এই সব বিদেশী বিদেশিনী ভক্ত দের নিয়ে অযোধ্যা গ্রামে আসতেন  তখন আশ্রমে অনেকের ভিড় জমে যেত। গ্রামের সাধারন মানুষ কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাঁদের দিকে চেয়ে থাকত।
সাতকাহনিয়া আশ্রমে ৩ তারিখের মহোৎসব এর প্রসাদ বিতরণ  শেষ হতে হতে বিকেল গড়িয়ে যেত।
চারপাশের গ্রাম থেকে ভক্ত জনরা আসতেন।
যথাসাধ্য আয়োজনের দ্বারাই সবাই কে পাতা পেড়ে খাওয়ানো হত।
বিকাল শেষ হলেই আবার রাতের আয়োজন।
আর রাতে বসত গানের আসর।
সে আসরের মধ্যমণি বিশ্বনাথ দাস বাউল।
তাঁর গান শোনার জন্য আখড়ার উঠোন ভরে যেত।
" রাখিতে নারিলি প্রেম জল কাঁচা হাঁড়িতে "
---------------   --------------  ---------------------------
© প্রণব ভট্টাচার্য।
তথ্য সহায়তা। স্বপন দাস বৈরাগ্য। পিতা। দীনবন্ধু দাস বৈরাগ্য। অযোধ্যা আশ্রম। বনকাটি। কাঁকসা

বাবাজী বৈষ্ণব আখড়া। গৌরী মা

বাবাজী বাউল বৈষ্ণব আখড়া আশ্রম। পর্ব - ৮
-----------------------   --------------  -------------------
  মাত্র চার দিন আগে বলেছিলেন
  ' আমাকে একবার অযোধ্যা আশ্রমে বেড়াতে নিয়ে যাবি '
জীবিত অবস্থায় বেড়াতে আসা আর হলনা। আনা হল তাঁর মৃতদেহ। এই আশ্রমের সমাধি চত্বরে বৈষ্ণবীয় রীতি অনুযায়ী সমাধিস্থ করা হল ' ভাব সাগর' বিশ্বনাথ দাস বাউলের মরদেহ। তাঁর দুই সুপুত্র বিশিষ্ট বাউল গায়ক আনন্দদাস বাউল এবং ভাই নির্দিষ্ট কিছুদিন পরে আয়োজন করলেন ব্রাহ্মণ ; বৈষ্ণব ; বাবাজী বাউল এবং গ্রামবাসী দের জন্য  তাঁদের পিতা এবং গুরু র স্মরণে এক ভোজসভা র। বহু মানুষ এসেছিলেন।
বাইরে থেকে অনেক বাউল ; বৈষ্ণব। দু তিন দিন ধরে চলেছিল মহোৎসব।
বোলপুরে শুঁড়িপাড়ায় বিশ্বনাথ দাস বাউলের বাড়ি এবং আশ্রম। সেখানেই তাঁর স্ত্রী পদ্মা দাসী এবং অন্যান্য দের সমাধি। বিশ্বনাথ চিরনিদ্রায় শায়িত থাকলেন অযোধ্যা আশ্রমের মাটিতে।
এই মাটিতেই শায়িতা আছেন তাঁর শাশুড়ি মাতা গৌরীবালা দাসী ; তাঁর পুত্র দীনবন্ধু দাস বৈরাগ্য এবং আরও কয়েকজনের নশ্বর দেহ।
এই অযোধ্যা আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা ব্রজবাসী ; বৃন্দাবন থেকে আগত বলভদ্র দাস মোহান্ত। বা বলাই দাস বাবাজী। কিভাবে তিনি এখানে এলেন বা এখানে আশ্রম গড়ে তুললেন তা জানার আর কোন উপায় নেই। জয়দেব কেন্দুলী র নিম্বার্ক আশ্রমের মোহান্ত দের সাথে  তাঁর কি কোন যোগাযোগ ছিল! কি জানি।
কোন সূত্র পাইনি।
সাতকাহনিয়া আশ্রমের মাতামা বালক দাসী র সাথে খুব ছোটবেলা থেকেই অযোধ্যা আশ্রমে যাই।
খুব মনে পড়ে গৌরী মা কে। আমি গৌরী মা ই বলতাম। বলাই দাস বাবাজী কে আমার মনে পড়েনা।
শ্রী বাস দাস বাবাজী কে মনে পড়ে। কিন্তু সব ছাপিয়ে গৌরী মা কে। মুখ জুড়ে তার সদাপ্রসন্ন এক মাতৃভাব।
কোথাও একফোঁটা  ক্লেশ মালিন্য নেই। আর কি মিষ্টি ছিল তার বচন। আমার খুব ভালো লাগত।
তখন তো ছোট। কিছুই জানিনা। কিন্তু বড় হয়ে যখন শুনেছি -
কি আশ্চর্য তাঁর জীবন। কত ঝড় বয়ে গিয়েছিল সে জীবনের উপরে। তার কোন ছাপ আমি অন্ততপক্ষে সেই ছোটবেলায় লক্ষ্য করিনি। কিন্তু পরে অনেক ভেবেছি।
গৌরী বালার গর্ভজাত তিন পুত্র কন্যা। মেণকা দাসী ; দীনবন্ধু দাস ; পদ্মা দাসী।
এই গৌরী বালা সূত্রধর পরিবারের মেয়ে। তাঁর বাবা এই অযোধ্যা - বনকাটি ছেড়ে পাশের গ্রাম মাজুরিয়া য়
বাসা বেঁধে ছিলেন। কাজের খোঁজেই। বয়স একটু বাড়লেই গৌরী র বিয়ে হয়ে যায় অজয়ের ওপারে কেন্দুলী র পথে আকম্বা গ্রামে। সূত্রধর পরিবারেই।
বিবাহিত জীবন তাঁর সুখের হয়নি। সেখানের পরিবেশে তিনি নিজেকে মানাতে পারেন নি।
অযোধ্যা গ্রামের তাম্বুলী পরিবারের ব্যবসায়ী ভোলানাথ রক্ষিতের সাথে তাঁর সম্ভবত পূর্বপ্রণয় সম্পর্ক ছিল। ভোলানাথ মনোহারী দ্রব্যের ব্যবসা করতেন। সাইকেল নিয়ে মনোহারী দ্রব্যের   কাঁচ লাগানো বাক্স নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরতেন। আকম্বাও
যেতেন। গৌরী  র সাথে দেখা হত। নিশ্চয়ই কথা ও হত। তাঁদের সম্পর্কের কথা রটতে গ্রাম জীবনে বেশী সময় লাগলো না।
  তারপর একদিন ভোলানাথের সঙ্গে গৌরী স্বামী র ঘর ছাড়লেন।
----------------------------------© প্রণব ভট্টাচার্য।
( চলবে)
তথ্য সহায়তা। স্বপন দাস বৈরাগ্য। পিতা। প্রয়াত দীনবন্ধু দাস বৈরাগ্য
অযোধ্যা আশ্রম। পো বনকাটি থানা। কাঁকসা। জেলা। প বর্ধমান

Thursday, 11 February 2021

ক্রন্দন। কেউ শোনে কেউ শোনেনা

ক্রন্দন। The Cry 
ক্ষত। The Wounds 
ঘুরে ফিরে মনে পড়ে  সেই সব মুখ
ক্ষত আর ক্রন্দনের গভীর অন্ধকার মাখা 
আর অন্ধকার উচ্চারিত হলেই 
যিনি এসে বসেন সামনে
 জীবন তৃষার সেই অমোঘ  কবি
 অবধারিত ভাবেই

রূপ তার কবেকার ঘণ অন্ধকার 
শত সহস্র বৎসরের ওপার থেকে 
ভেসে আসে ক্রন্দন রোল 
দেখা দেয় সেই সব ক্ষত বিক্ষত দেহ

তিনি আর ' পাইন ' দেখেছিলেন 

সে কি  মাত্র  শুধু ছবি ; ভাস্কর্য বা কবিতা 

গভীর ভিতরে তার নিরুপায় রক্ত ক্ষরণ।  
বুকের ভিতরে একটা ভাঙ্গা দেয়াল পুরেই 
যার জন্ম 
 সে কি না দেখে পারে হায়

চির বিস্মৃতির অন্ধকারে চলে যাবে জানি একদিন 
 আমি তার আগে দেখি শুধু জ্বালা ধরা চোখে

বালক মাতা দাসী আর সে। জঙ্গল কথা

নবীন দাস বাবাজীর আশ্রম সাতকাহনিয়া। 
 মাতামা বালকদাসী এবং অন্নপূর্ণা দেব্যা।  পর্ব --৬। 

 ( এই পর্ব টি বোলপুর কলেজের অধ্যাপক স্নেহভাজন রামানুজ মুখোপাধ্যায় কে উৎসর্গ করছি) 

তাবিজ ; কবজ ; জলপড়া বা গাছ গাছড়ার টোটকা ওষুধ নিতে আশ্রমে তখন অনেকে আসত। অ্যালোপ্যাথি ওষুধের প্রচলন গাঁ গঞ্জে হলেও এসবের প্রতি মানুষের বিশ্বাস ছিলই। 
 থাকবে না ই বা কেন। এতদিনের অভ্যেস। 
  রোগা পাতলা দুবলা চেহারার আমাকে তো মাতামার পাঁচন খেতেই হত। কালমেঘ বাসক আর শিউলী র থেতো রস। 
 কালমেঘের তেতো। মুখ থেকে তেতো স্বাদ কাটতেই চাইতোনা।  তাকে কাটানোর জন্য আবার কত ঝকমারি। 
 আমলা হরিতকী বহেড়ার ত্রিফলার জল। রাতে ভেজানো থাকত। পেটের জন্য সত্যিই উপকারী। এগুলো আমরা প্রায় সকলেই জানি। অম্বল হলে ভাস্কর লবণ। বাচ্চাদের কৃমিতে আনারস পাতার রস। জ্বরের পর মুখের স্বাদ ফেরাতে কচি শিউলি পাতার রস বা বড়া করে গরম ভাতে মেখে খাওয়া। 
কি গাঁদালের পাতার বড়া। বলবেন কি দুর্গন্ধ। 
কি পলতা পাতা মানে পটল পাতা র বড়া। 
ঘৃতকুমারী তো অ্যালোভেরা হবার পর দাম পাচ্ছে 
আর তখন মাতামা কত ভাবে তার ব্যবহার করত। 
আজ আর কোথাও কোন পুকুর পাড়ে সেই ' 'ঘিতকুমরী ' দেখতে পাবেন না। সে সব কবেই রাতের অন্ধকারে গোঁড়া সমেত চুরি হয়ে গেল। এখন ট্যিসু কালচার করে চাষ হচ্ছে বহুজাতিক বাগানে। এমন যে কত হারালাম। 
লাগে। কাজে লাগে। উপকার হয়। 
 প্রায়ই জঙ্গলে যেত মাতামা। আর সঙ্গে আমি কি আর না থাকি। বর্ষা য় জঙ্গল এর রূপ আলাদা। মাটিতে কত গুল্ম লতা। অনন্ত মূল ; ঈশ্বর মূল ; অশ্বগন্ধা ; সর্পগন্ধা ; আরও কত লতা গুল্ম। 
 জঙ্গল তো চার দিকেই। উত্তরে নদী। অজয়। কোন কোন সময় সেই দিকে। অজয়ের চরে বা পতিত জমিতে নানা গাছ গাছড়া। 
 তখন নদীর ধারে জমিতে প্রাকৃতিক ' ঘি করলা ' হত প্রচুর। 
 মাতামার সাথে তুলতাম। তার স্বাদ কি আজকের  - কি বলে যেন কাঁকরোল তার সাথে তুলনা হয়। সেই ঘি করলার সর্ষে ঝাল বা পোস্ত  - আহা তার স্বাদ। যেন আজও মুখে লেগে আছে। নদী ধারে অনেক শতমূলের লতা হত। অনেকে মোরব্বা নিশ্চয়ই খেয়েছেন। তার ফুলের কি অপূর্ব গন্ধ। এর ও ওষধি গুণ আছে। আরও কত লতা পাতা তুলত মাতামা। 
 আর জঙ্গলে যাওয়ার অন্য মজা ছিল ' ছাতু ' তোলা। 
 শাল ছাড়া কি জঙ্গল হয়! শাল পাতা পচে মাটিকে উর্বর করত। আর এখন জঙ্গল ফাঁক তো ভরাট করো সোনাঝুরি ; ইউক্যালিপটাস দিয়ে। হ্যাঁ । এত লোক বাড়ল। সোনাঝুরি গাছের কাঠ ভালো। ভালো আসবাবপত্র তৈরী হয়। 
 ইউক্যালিপটাস এর কাঠ এতো ভালো নয়। তবে কাগজ কারখানায় দারুণ চাহিদা। আর জঙ্গলে র মাটির গেল বারোটা বেজে। অনুর্বর করে দিল মাটিকে। 
 আমাদের রাঢ় মাটির স্বাভাবিক উদ্ভিদ গুলো হারিয়ে গেলো। 
অনেক খুঁজেও একটা ' ভেলা ' বা ধব বা মুর্গা বা গাব গাছ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। কত নাম আর বলব। লতা পলাশ বললে কে আর চিনবে। ভুঁই কুমড়ো ; একরকম এর সাদা বুনো রসুন ইত্যাদি ইত্যাদি। 
 কত রকমের ছাতু হত শাল জঙ্গলে। পাতা পচে ছাতু মানে ছত্রাক জন্মালে একধরনের আঁষটে গন্ধ পাওয়া যেত। 
  সব জার্মিনেশনের এক ধরনের গন্ধ থাকেই। 
 সব ছাতু তো খাওয়ার নয়। বিষাক্ত আছে। কালো একধরনের ছাতু ' আঙ্গারে ' বলতাম। খেতে মাংসের মেটের মতো। তবে আমার বেশী লোভ মাটির নীচে হয় যে ' কুরকুরে ' ছাতু। 
 ঠিক চিনতাম। মাতামা শিখিয়ে দিয়েছিল। তুলতে তুলতে 
 খুঁজতে খুঁজতে অনেক ভিতরে চলে যেতাম। 
 জঙ্গলে যাবার আগে মা গা বেঁধে দিত। কি যে মন্ত্র বলত আর ফূঁ দিত। যাই হোক জঙ্গলে কোন দিন কিছু হয়নি। শাল পাতার নীচে একরকম এর ছোট্ট শুঁয়ো জাতীয় পোকা। গায়ে লাগলে ভীষণ জ্বলন। লেগেছে তো বটেই কয়েক বার। 
 আহা। সেই কুরকুরে ছাতুর কি স্বাদ। খোসা ছাড়িয়ে গোল গোল ছাতুর ঝাল। ছোট ছোট আলু দিয়ে। 
 এখনকার খড়ে আর পোয়াল ছাতু হয়না। দুর্গাপুজো র সময়ে শর ঝোঁপের ধারে প্রচুর দুর্গাছাতু হত। সব গেছে। গেল। 
 এখন মাশরুম চাষ কর। শক্ত স্বাদহীন। তবু রেষ্টুরেন্ট এ খেয়ে আহা মাশরুমের স্যুপ খেলাম!  
  জঙ্গলে ঘুরতে ঘুরতে দূরে ও চলে যেতাম। ঐ নীল কুঠি র জঙ্গলে র দিকে। সেখানে একবার এক ঝোপের ধারে বেজি আর এক বিষধর সাপের লড়াই দেখেছিলাম। 
 পিয়ালের সময় পাকা পিয়াল তুলতাম। ছোট্ট ছোট্ট গাছে ততদিনে চাপতে পারি বেশ। পাকা কেন্দু ফল খেতে  চমৎকার লাগত। কত রকমের জাম ছিল জঙ্গলে। খুব ছোট ছোট কুড়ুর জাম। কি মিষ্টি। মাটিতে ছোট ঝোপ মতো খেজুর গাছে 
 পাকা কালো খেজুর। কি মিষ্টি ছিল। এর পাতা দিয়ে যে চাটাই বোনা হত তা ছিল শীতল পাটির মতো। 
 জঙ্গল কথা সহজে ফুরোবার নয়। ' আলকুশি ' ও আছে। 
তার কালো বীজ। উপকারী। 
একবার মষ্টারমশাই চণ্ডী বাবুর সাথে অযোধ্যা জুনিয়র হাই স্কুলে  প্রায় সদ্য জয়েন করা এক সুদর্শন যুবক মাষ্টার মশাই 
এলেন আমাদের বাড়িতে দাদুর কাছে। দাদুর সাথে আলোচনা করে তিনজনেই গেলেন মাতামার কাছে। সব শুনে মাতামা 
সকালে এসে ওষুধ খেয়ে যেতে বললেন। প্রস্রাবের সমস্যা ; তার সাথে  আরও কিছু। কয়েক দিনের মধ্যে তাঁর সমস্যা কমে গেল। ওলটকম্বল এর পাতা থেতো করে মিছরির জলে ভেজানো রস। পিচ্ছিল ; ল্যালপেলে সরবৎ। আর কিছু ওষুধ।
 
 মাতামাদের কাছে মেয়েরা আসে তাদের সমস্যা নিয়ে। 
 মেয়েদের তো নানা সমস্যা। সহজে বলতে পারেনা। 
 এখানে এসে মন খুলে বলতে পারত। 
 নানা গাছগাছড়ার ওষুধ নিত। 
 যা সাধ্য পয়সা দিত। বা চাল আলু। 
 অনেকে তাদের স্বামীদের সমস্যা নিয়েও আসত। 
 স্বামী বাবুদের ও তো লজ্জা কম নয়। 
 কি করবে বৌ কে ই পাঠাতো। 
 তখন ভালো ও হত। 
না হলে মানুষ আসবে কেন। 
 এত বিষ তো তখন শরীরে ঢোকে নি। তাই কাজ হত। 
 আর এখন জেনে শুনেই বিষপান করতে হচ্ছে প্রতিদিন। 
 আর উপায় নাই। 

একটা গল্প মনে পড়ে গেল। যদি শোনেন। তখন ভীরু পায়ে কলেজে পড়তে গেছি। সে না হয় অন্য কথা - 
 কলেজে আমাদের এক কেমিস্ট্রির মাষ্টার মশাই কে অন্যেরা বেশ খেপাতেন । আমাদের কয়েক জন কে সঙ্গ দিতে হত। 
 ভদ্রলোক সকালের টিউশনি পড়িয়ে যখন হাটে বাজারে বেরুতেন তখন বেশ দেরী হয়ে গেছে। তিনি আর টাটকা  নিটোল কিছু পেতেন না। ঐ কানা কুঁজো যা পেতেন ঝটপট কম দামে কিনে 
 বাসায় পৌঁছাতেন। তারপর বাড়ির অবস্থা টা কল্পনা করে নিন। অফ পিরিয়ডে বা টিফিনের সময় - 
 - স্যার আজ আর হাটে কিছু পেয়েছিলেন 
- কেন হে। সবই পেয়েছি।  তা তোমাদের কি দরকার।
 অন্য এক মজাদার মাষ্টার মশাই ঠিক তখুনি বলতেন 
যাও বৌ দিকে জিজ্ঞেস করে এসো। দ্যাখো গিয়ে মজা -

 যত সব কানা কুঁজো পোকা কাটা কিনে ঘর গেছে -
 আর যায় কোথা 
 - কি জন্যে যে তোমরা সব কেমেস্ট্রী পড়তে এসেছিলে হে 
 এ টুকু জ্ঞানও নেই যে পোকা কাটা গুলো তে অন্তত ইনসেক্টিসাইড পড়েনি। শুধাও ওঁকে কেমিক্যাল কম্পোজিশন টা কি। আর তার শরীরে এফেক্ট টা কি -
এই রকম মজা চলত। 
 হোমিওপ্যাথি তে বিশ্বাসী এক মাষ্টারমশাই কে বলে দিলেই হত স্যার ঐ টিকটিকি র ডিমের মতো গুলিতে -
 ব্যস। আর যায় কোথা। 
 শুরু হয়ে যেত তর্ক 
 তার ভিতরে ও মজা ছিল। শিক্ষাও ছিল। ইনঅর্গানিক এর সাথে লাগত ফিজিকাল এর। অরগ্যানিকের মাষ্টারমশাই রেফারি। 
 আহা। সে দিন গুলোয় আর ফেরা যাবে না। 
 কোথায় চলে এসেছি গল্প করতে করতে। 
 গল্প বলিয়ে মানুষ। 
 জানেন ই তো যে অনেকে ভালোবেসে ' কথক ঠাকুর ' বলেন।
  আবার কেউ " সেনপাহাড়ী 'র কথাকার। 
  আপনাদের ভালোবাসা ই পাথেয়। 
 এখনও পথ হাঁটি অখ্যাত অবজ্ঞাত গ্রামের পথে। 
   কত গল্প কথা কাহিনী  যে রয়ে গেল  মাটিতে মাটিতে। 

 -----------    -------------    ------- ©  প্রণব ভট্টাচার্য। 
  বোলপুর কলেজের অধ্যাপক স্নেহ ভাজন শ্রী রামানুজ মুখোপাধ্যায় কে এই পর্ব  উৎসর্গ করলাম।

বাবাজী বৈষ্ণব আখড়া। যা লিখতে চাই

ফেসবুকের পাতায় 
 এখন আমি লিখছি 
 বাউল বৈষ্ণব আখড়া 
 বিষয়ক এক ধারা বাহিক। 
 ৫ টি পর্ব লেখা হয়েছে। 
 এর পরের পর্ব টির জন্য 
 আপনারা অনুগ্রহ পূর্বক 
  একটু অপেক্ষা করুন। 
 এর পর যাদের জীবন কথা আসবে 
 তাদের উত্তর পুরুষ দের সাথে 
 একটু কথা বলে নিই। 
 কারও ভাবাবেগে যাতে আঘাত না লাগে। 
  বাউল বৈষ্ণব দের জীবনে নানা ঘটনা থাকে। 
 বিচিত্র তাঁদের অভিজ্ঞতা। 
  সাতকাহনিয়া আশ্রমের মাতামা বালকদাসী 
 আমাকে কোলে পিঠে মানুষ করেছেন। 
 খুব ছোট থেকে অনেক কিছুর ধারণা পেয়েছি। 
 অন্নপূর্ণা মাসীমা র সাথে আমার মা মাসী দের 
 ছিল গভীর বন্ধুত্ব। এইজন্য অনেককে মাসী বলেছি। 
 অনেককে মামা। মেসো। ইত্যাদি। 
 সাধারণ কিন্তু অসাধারণ অনেক মানুষ কে দেখেছি। ' ওরে সহজ হওয়া সহজ নয় '। 
 কায়া সাধন ও সহজ নয়। 
 ' দেহভাণ্ড ই ব্রহ্মাণ্ড '। 
 'দেহ সুখের মাধ্যমে চিত্তসুখের সন্ধান সে বড় সহজ নয়। '
 দেহ কে যে চোখে তাঁরা দেখেন বা দেহ নিঃসৃত 
  সব কিছু কে  - সেভাবে আমাদের পক্ষে ভাবা 
 সম্ভব নয়। 
 ' সকলের সার হয় আপন শরীর ' 
" নিজ দেহ দিয়া ভজিতে পারে ; সহজ ভজন বলিবে তারে ; - চণ্ডীদাস 
 ' পদপল্লব মুদারমের ' দেশের মানুষ আমি 
' নন্দের কুমার ; কি ধন লাগিয়া ধরে চরণে আমার ' 

' নিঁদ যায় চাঁদবদনী শ্যাম অঙ্গে দিয়া পা " 
 
আর ; আর 
 I am you and you are me ; I am your body; 
You are my soul ; So none should hereafter
say ; I am some one and you someone else "  আমির খসরু র এক সুফি গানের ইংরেজি অনুবাদ 
 এই সব যে গূঢ় আধ্যাত্মিক কথা সে সব শুনেছি 
 সে বয়সে বুঝিনি।
 এ বয়সেই কি ছাই বুঝেছি।। 

একটা জীবন বড় ছোট 
 বড় ছোট। 

 ছবি। সংগৃহীত।  শিল্পী সুহাস রায়ের রাধা সিরিজ।

সাতকাহনিয়া নবীন দাস বাবাজী র আখড়া য় ৩রা মাঘের মহোৎসব

সাতকাহনিয়া নবীন দাস বাবাজী র আশ্রম 
 ৩রা মাঘের মহোৎসব। ৫ ম পর্ব। 

 মনে অনেককে পড়ে।  সব নাম আজ আর  মনে পড়েনা যে। 
 কত মানুষ। এলো। গেলো। জগৎ চলছে। 
 দিগনগরের সুবল দাস বাবাজী। গৃহী বৈষ্ণব। তাঁর স্ত্রী। নাম গুরুদাসী। মাতামা তাকে বড় ভালোবাসতো। মেয়ের মতো। আবার সে আমাকে খুব ভালোবাসতো। মাতামা র
 সাথে রথের মেলার সময় একবার গিয়েছি। 
 তাঁদের দিগনগর আখড়ায়। সুবল দাস কি সুন্দর সব খেলনা বানাত। রথের মেলায় বেচার জন্য। কাগজের চরকি ফুল  কুমীর আরও কতকি। মাটির নানা খেলনা। আমার চোখ চকচক করত। 
 মাতামা আমাকে দিয়ে চিঠি লেখাত। ৩ রা মাঘ আসার জন্য। 
 ' আমাকে একবার দেখে যা '। ' আয়  গুরুদাসী '। যত দিন
পেরেছিল এসেছিল। তারপর আর -
 খুব মনে পড়ে ধরম দাস বাবাজী কে। 
 কি উজ্জ্বল কৃষ্ণবর্ণের ত্বক। আর সত্য সাঁই বাবার মতো মাথার চুল। চোখে মুখে আলাদা জ্যোতি। 
 সোনামুখি র বিখ্যাত ' বাঁড়ুজ্জ্যে আশ্রম 'থেকে আসত। আমাকে খুব ভালো বাসতো। আমি তুমি করে ই ডাকতাম। 
 সামান্য গাঁজায় তার পোষাতনা।  আমাকে বলত ' ওরে খেতে জানতে হয় '
 তার সাধনার জোর ছিল। 
 এই আশ্রমে তাদের মালাচন্দন হয়েছিল। ললিতা হয়েছিল তার সাধন সঙ্গিনী। তাদের মালা চন্দনে আমার দাদু দিদিমা কে সাক্ষী রেখেছিল।  আমার দিদিমা ললিতাকে 'ভিক্ষে মেয়ে'  করেছিল। ললিতার মা ও আসতেন। 
আমার দাদু দিদিমা কে বাবা মা এর মতো তারা শ্রদ্ধা করত। 
  কিন্তু ধরম দাস ' বিন্দু ধারনে ' অসমর্থ হয়েছিল প্রথম বার। 
 ইশারায় ঘাড় নেড়ে অন্নপূর্ণা মাসীমা কে জানিয়েছিল। 
 আখড়ার কুঠুরি থেকে বেরিয়ে। 
 সে বয়সে সব বুঝিনি। পরে বুঝেছি। জেনেছি। 

  ' দেহভাণ্ড ই ব্রহ্মাণ্ড '। এই দেহেই সব। তাকে জাগাতে হবে। 
 সে একবার আমাকে বলছিলেন তন্ময় হয়ে ইলামবাজারে র বাবাজী। সাধক। ব্রহ্মচারী। বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গিয়েছিলেন। ' যা ঘর যা '। 
 আমি বলি 'বল না দাদু '। 
 'ঘর যা '। 'সময় হয়নি '। ' হলে বলব '.... 
 হায়রে সময় কি আর বলে কয়ে আসে। 
 আমার মা কে কোলে পিঠে নিয়েছেন। বাঁকুড়া র মানুষ। 
 আমার দাদুর সাথে সেই বাঁকড়ি টান। বন্ধুত্ব। 
 যখন তাঁর ১০১ কি ১০২ তখনও আমি তাঁকে দি হাতে দূটো বালতি তে সাহাপাড়ার নলকূপ থেকে জল আনতে দেখেছি। 
 ছোট কুড়ুল দিয়ে কাঠ কাটতে দেখেছি। 
  এত দ্রুত হাঁটতেন। সাতকাহনিয়া থেকে ইলামবাজার পর্যন্ত হেঁটে যেতে বোধহয় পনেরো মিনিট ও লাগতো না। 
 তাঁদের এক পালিতা কন্যা ছিল। 
  তাঁদের বললাম এই জন্য যে তাঁর ও এক সাধন সঙ্গিনী ছিলেন। তিনি কি ছিলেন তাঁর স্ত্রী। সাধন মার্গের স্ত্রী র মর্যাদা দিয়েছিলেন তাঁকে। 
 নানা ভাষায় অসাধারণ বুৎপত্তি ছিল তাঁর। 
 ছিল অনেক বই পুঁথি। লাল শালু দিয়ে বাঁধা। 
 " দাদু বই গুলো কি হবে " 
 - সমাধি তে থাকবে। 
 - কত বয়েস হল দাদু? 
 - বয়েস নিয়ে কি হবে  বল 
  - না। এমনি জানতে চাইছি। 
   আবার সেই কথা।  ' ওরে আমার গুরুর কোন শিষ্য একশো পার না করে মরবে না রে '। আমার এখন একশো দুই টুই হবে। 
  আর ক টা দিন ------"
 "মাতামা বড় কষ্ট পাচ্ছে যে '। 
  -হ্যাঁ তোর মাতা বড় কষ্ট পাচ্ছে তা তো জানি রে  কিন্তু - 
 - কি কিন্তু দাদু!  অনেকক্ষণ কোন কথা নেই তারপর অস্ফুটে  একশো  এক। '   
সংস্কৃত তামিল তেলেগু উড়িয়া হিন্দি তে স্বচ্ছন্দ। 
একবার শান্তি নিকেতন যাবার পথে শেষ বাস ফেল করে এক যুবক তাঁর আশ্রমে আশ্রয় নিয়েছিল। সে তামিল। তাকে অবাক করে দিয়ে তার সাথে সমানে তামিলে কথা বলে গিয়েছিলেন। 

 পরদিন যখন গেলাম আমাকে বললেন " দ্যাখ আমার একটা ছবি এঁকেছে "। 
 আমি দেখলাম পেন্সিলে আঁকা প্রোফাইল পোট্রেট। সুন্দর। 
 তাঁদের এক পালিতা কন্যা ছিল। তার নাম আর মনে নাই। 
 আসলে তাকে আশ্রয় দিয়েছিলেন আশ্রমে। 
 তাঁরও ছিল এক মেয়ে। সে তখন বড় হয়ে উঠছে। বয়েস বারো তেরো হবে। বড় বড়  ভারী পাতার চোখে সে আমার দিকে তাকাতো। তার নামও আর মনে নাই। ভুলে গেছি। অথচ - -
   মনে গেঁথে আছে তার মুখচ্ছবি। ' ভুলে গেছি তব পরিচয় ' 
 ' কিন্তু তোমারে তো ভুলি নাই ------------
(ক্রমশ)  ৫ ম পর্ব। 
 কেমন লাগছে যদি সবাই জানান। আমার ভালো লাগে। 
© প্রণব ভট্টাচার্য।https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=2275583972572808&id=100003636821328

সাতকাহনিয়া নবীন দাস বাবাজী র আখড়ায় ৩ রা মাঘের মহোৎসব

সাতকাহনিয়া নবীন দাস বাবাজী র আশ্রমে 
 ৩ রা মাঘের মহোৎসব। 
 ----------------------------------------------------  
 ২ তারিখের বিকেল নাগাদ অনেকে এসে গেছেন। 
ছাউনির তলায় ; খড়ের কুঁড়েতে যে যার মতো আটন পেতে নিয়েছেন। নবীন দাস বাবাজী র সমাধি মন্দিরের সামনে একদল ধুনি জ্বালিয়েছেন। বটগাছের গোড়ায় আরেকদল। 
 মাঝামাঝি জায়গায় আর এক দল। মোট তিনটি ধুনি জ্বলেছে। আঁকড় গাছের গোড়া র কাঠ। খুব শক্ত। তাপও ভালো। তাতেই শীত পালাচ্ছে অনেকটা। গায়ে প্রায়  সবারই মোটা কম্বল। অবশ্য যার যেমন জোটে। মাঝামাঝি জায়গায় দক্ষিণ দিকে মুখ করে একা বসেন এক দীর্ঘ দেহী জটাজুট ধারী। গায়ে প্রায় কিছু নাই। তার জন্য ভ্রূক্ষেপ ও নাই। ধূনির সামনে বসে কলকের পর কলকে গাঁজা খাচ্ছেন। আর মাঝে মাঝে হুঙ্কার দিয়ে ওঠেন। সব আসরেই গাঁজা চলছে। বাবাজী দের জন্য সে সব জোগাড় করতেই হয়। না পেলে গোঁসা হয় খুব। দক্ষিণ দিকে মন্দার গাছের তলায় এক বাবাজী মাতাজী 
 গুনগুন করে গান ধরেছেন। আওয়াজ ক্রমশ বাড়ছে। গলার স্বর চড়ছে। হুংকার দিয়ে উঠে সেই দীর্ঘ দেহী বাবাজী নাচ আরম্ভ করলেন। শরীরে প্রায় কিছুই নাই। একসময় একেবারে উলঙ্গ। সে প্রায় তাণ্ডব নৃত্য। তাঁর নাচের সাথে শুরু হয়েছে বেশ উচ্চস্বরে দেহতত্ত্বের গান। একতারা দোতারা খঞ্জনী ঝনঝন বাজে। একসময় সবাই উঠে দাঁড়িয়ে নাচ গান শুরু করেন। সে এক দৃশ্য। অবাক চোখে সে সব দেখে। এখন দুদিন পড়াশোনা থেকে ছুটি। 
 সেই নাচ গান থামাতে হয় মাতামা কে উঠোনে নেমে। 
 বাবারা এবার থামুন। রাত অনেক হল। রান্না শাল থেকে খবর আসে খাবার প্রস্তুত। ডোবার পাড়ে রান্না শালা। গাঁয়ের মেয়ে বৌরা সব এসে কাজে লাগে। তারাই সব সব্জি কেটে দেয়। দিনে ই কেটে দিয়েছে। আবার কালকের মচ্ছবের জন্য এখন কাটছে। ওরা আমতলার দিকে তালপাতার তালাই এর উপরে 
 সব্জী কাটছে। বাঁধাকপি ; ফুলকপি ; শাক ; বেগুন ; আলু ; বিলাতী বেগুন ; যা জোগাড় হয়েছে আর কি। সব মিলিয়ে মিশিয়ে একটা তরকারি। 
 রান্না ঘরের সরঞ্জাম এর তার ঘর থেকে চেয়ে চিন্তে আনতে হয়েছে। মেয়ে বৌরা নিজের নিজের ঘর থেকে বঁটি এনেছে। 
 কাজের তদারকি করার লোক নান্দু মামা ; অন্নপূর্ণা মাসীমা র ভাই আর ফণী বাউরী রা। রান্নার লোক ; কাজের লোক ; সবই গাঁ ঘরের মানুষ জন। অযোধ্যা আর নারানপুর এর কর্মী কিছু মানুষ। এত সব হচ্ছে কিন্তু রামানন্দ মামা আখড়ার বারান্দায় বসে একমনে নাম জপ করছে। মাতামা তার দড়ির খাটিয়ায়। 
 অন্নপূর্ণা মাসীমা কেই সামলাতে হচ্ছে নানা দিক। নানা জনের নানা আবদার। 
 তখন ডেকোরেটার ব্যবসার যুগ নয়। রান্নার সরঞ্জাম থেকে সবকিছু মানে একটা হ্যাসাক লাইট জোগাড় করতে ও অনেক ছোটাছুটি করতে হয়। জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ - সে এক সমস্যা। যাই হোক তবু শেষ পর্যন্ত হয়ে যায়। জামডোবা জঙ্গলের মাঝে এক গ্রাম। সেখান থেকেই জ্বালানী কাঠ আসে। 
 ওদিকে রান্নাশাল থেকে ডাক আসছে। আবার কালকের জন্য 
 আজ রাতে বেশ কিছু আয়োজন সেরে রাখতে হয়। 
 ওখান টাই তো আসল। রান্না ঘরের কর্মী রা কিছু সেরে রেখে ভোর রাত থেকে উঠে রান্নার কাজে লাগেন। 
 অন্নপূর্ণা মাসীমা হাত জোড় করে সবাইকে অন্ন গ্রহনের জন্য 
 অনুরোধ জানালেন। 
 মুখোমুখি দু লাইনে সবাই বসলেন। পাতা পড়ল। পরিবেশন কারীরা শুরু করলেন পরিবেশন করতে। 
 সবার পাতায় অন্ন পড়ার পর মুখে তোলার আগে আওয়াজ
 উঠলো ' প্রেমানন্দে সবাই একবার হরি হরি বলো '
 (ক্রমশ)  ৫ ম পর্ব। 
  ©   প্রণব ভট্টাচার্য। 
--------------      -------------------------    -------------------

সাতকাহনিয়া নবীন দাস বাবাজী র আখড়া। মাতামা আর অন্নপূর্ণা দেব্যা আর সে

সাতকাহনিয়া নবীন দাস বাবাজী র আখড়া। 
 বালক মাতা দাসী আর অন্নপূর্ণা দেব্যা 
--------------------------------------------------------
আশ্রমের  ৩ রা মাঘের মহোৎসব এর প্রস্তুতি 

 পায়ে হেঁটে হেঁটে ঘুরতে হয় চার পাশের নানা গ্রামে। 
 ঘুরতে হয় সব আশ্রম আখড়ায়। 
 বৈষ্ণবী র ঝোলা। কর্তাল। নামগান। মাধুকরী। আমন্ত্রণ। 
 আদুরিয়া  অমরপুর   জিজিরা  পদুমা  লবণ ধার  পরিশা 
 দেবশালা দোমড়া তিলকচাঁদপুর  জামডোবা  রঘুনাথপুর 
 মাজুরিয়া শ্রীচন্দ্রপুর  ডাঙ্গাল বসুধা বাগুড়া। 
 অযোধ্যা বনকাটি তো ঘর ই। 
 অজয়ের ওপারে নারানপুর উদয়পুর ক্ষুদ্রপুর ভরতপুর 
   ইত্যাদি সব গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে আছে ভক্তবৃন্দ। 
তাদের কাছে একবার তো পৌঁছাতে হবে। 
 তারপর তারা না হয় যার যা সামর্থ্য চাল ডাল আলু সব্জি শালপাতা  জ্বালানী কাঠ পৌঁছে দেবে। 
 অনেক কাজ। আখড়ার ছোট্ট ঘর টা ছাইতে হবে। ছোট ছোট কুঁড়ে ঘর বাঁশ খড় দিয়ে বানাতে হবে। ছাউনি করতে হবে। 
 আয় বাবা আয় বাবা করে লোক ডেকে ডেকে  করাতে হবে। 
খড় বাঁশ না হয় চেয়ে চিন্তে জোগাড় হবে। 
 হালদার বাবুরা কিছু খড় বাঁশ  চাল দেন। গাঁয়ের লোক যে যেমন পারে দেয়। কাঁসার থালায় এক থালা চাল গোটা চার আলু। তার বেশি আর সাধ্য নেই কারও। গরীবের গাঁ। 
 এক আধ কাঠা চাষের জমি নিজের কারও নেই। 
 হালদার বাবু দের জমি চাষ করে যে চাষীরা তারা কিছু বেশী দেয়। তবে কি আর বেশী!  
 বরং নারানপুর থেকে বেশ ভালো আসে। যে রেণুপদ পরে দীক্ষা নিয়ে রামানন্দ হয় তার বাড়ি থেকে ভালো পরিমান চাল ডাল আলু আসে।  মাতামার 'বাগদী বাবাদের' ঘরের ছেলেরা নানা কাজের জন্য কদিন আগে থেকেই এসে লাগে। এরা খুব ভালো মানুষ। মাতামার সঙ্গে নারানপুর গেলে বামুনের ছেলে বলে ওরা আমাকে কাঁসার থালায় চিঁড়ে গুড় দুধ খেতে দিত। 
 পাকা আমের সময় খুব মজা। আম কলা দুধ চিঁড়ের 'ফলার '।  এই নারানপুরের ধর্মরাজ পুজো খুব বিখ্যাত। এ আজকের পুজো নয়। এপারে ' ধর্মমঙ্গল ' এর বিখ্যাত ' কালু ডোম ' এর 
 'ধর্মরাজের থান। ' লাউসেন তলা ' কাছেই। 
 পাশেই 'উদয় পুর '। যেখানে পূবের সূর্য উত্তরে উঠেছিল। 
 ধর্মমঙ্গল এর আখ্যান। 
 মাতামা প্রায়ই নারানপুর যায়। আর সাথে সে।
 নদীর বালিতে পা ডুবিয়ে হাঁটতে কষ্ট আবার মজা। 
  জল তো মা কোলে করে পার করে। 
 ধর্মরাজ পুজো র সময় তো যায় ই। এই থানের মাটি মাখলে বাত ভালো হয়ে যায় এমনই লোকবিশ্বাস। এ গাঁ য়ে অনেক ডোম সম্প্রদায়ের মানুষ আছেন। আদিতে পুজো তাঁদেরই। 
 জয়দেব কেন্দুলীর মেলায় যাবার সময় অর্থাৎ পৌষ সংক্রান্তির অনেক আগে থেকেই সাধু বাবাজী বৈষ্ণব রা 
 নানা আখড়া য় বিশ্রাম নিতে নিতে কেন্দুলী পৌঁছান। 
 সংক্রান্তি র ভোরে সাধু সন্ন্যাসী রা অজয় - গঙ্গা য় স্নান সারেন। তাঁরা লগ্ন দেখে স্নান সারেন। সে নিজে ভোর তিন টে তে এক জটাজুট ধারী সন্ন্যাসীকে স্নান সেরে উঠতে দেখেছে । তখন অবশ্য সে বড় হয়েছে।  কানুর সাথে কাঙ্গাল ক্ষেপার আখড়ায় থেকেছে। আর ছিল দীনু ; ধনেশ্বর। একটা বেশ বন্ধুদের দল। 
 মেলা আনুষ্ঠানিক ভাবে শেষ হয় ২ তারিখে। ২রা মাঘ। তখন মেলা চালাতেন  মোহান্ত অস্থলের মোহান্ত মহারাজ। 
 এঁরা নিম্বার্ক সম্প্রদায়ের। বৃন্দাবন থেকে মোহান্ত মহারাজ আসেন কেন্দুলীর গদিতে। এই ' অস্থল ' সম্পর্কে আলাদা করে বলতে হবে ই। মোহান্ত অস্থলের আমন্ত্রণ পত্রটি র কোন বদল ঘটেনি। " পৌষসংক্রান্তি র দিবস হইতে ভগবৎকুল তিলক কবিকুল চূড়ামণি ভূদেবোপম শ্রী শ্রী ঁজয়দেব গোস্বামী মহাত্মা র তিরোধান উপলক্ষে জয়দেব - কেন্দুবিল্ব ধামে মহোৎসব আরম্ভ হইয়া ২ রা মাঘ তারিখে ধূলট হইবে "। 
 এবার ফেরার পালা। সাধু সন্ন্যাসী বাবাজী বৈষ্ণব রা 
 আশ্রমে আশ্রমে বিশ্রাম সহ নানা বৈষ্ণবী য় অনুষ্ঠান এবং 
নানা গুহ্য সাধনার ক্রিয়া প্রকরণ প্রণালী শিক্ষা সহ দীক্ষা দান  
 করতে করতে উপস্থিত হন দধিয়া বৈরাগী তলার বৈষ্ণব সমাবেশে। 
  আমার এই  সাতকাহনিয়া আশ্রমের ইতিহাস শতাব্দী প্রাচীন।
 অনেক ঘটনা র সাক্ষী ' বৈরাগী বটতলা '। আজ আর মাতা মা বা আমার ' ননু মা ' মানে অন্নপূর্ণা মাসীমা রা কেউ নেই। 
 যেমন নেই সোনামুখি আশ্রমের বা ইলাম বাজার আশ্রমের বাবাজী রা। যাঁদের আলাদা এক আসন ছিল বৈষ্ণব মণ্ডলী তে। আমি তাঁদের যতটা দেখেছি যতটুকু পারি বলে যাই।
  সাধু সন্ন্যাসী বাবাজী বৈষ্ণব রা আসছেন ২ রা মাঘ সন্ধ্যায় সাতকাহনিয়া আশ্রমে। বটতলার প্রবেশদ্বারে  দাঁড়িয়ে আগে 
 নানা নাম ধ্বণি। নামধ্বণিতে মুখরিত হয়ে ওঠে আশ্রমের উঠোন। মাতামা আর তাঁর শিষ্যা অন্নপূর্ণা জোড় হাতে দাঁড়ান। 
                        মুখে হরিবোল। 
( ক্রমশঃ)  ৪ র্থ পর্ব শেষ। 
 ©   প্রণব ভট্টাচার্য

মাতামা আর সে। জয়দেব কেন্দুলীর মেলা

মাতামা ; কেন্দুলীর মেলা ; আর সে 

 মাতামার সাথে কেন্দুলীর মেলায় যায়। 
 যাবার পথে পড়ে নদীর ওপারে এক গ্রাম। ভুবনেশ্বর। 
 সেখানে এক গাছে শত শত বাদুড় ঝোলে।নীচের দিকে মুখ করে ওরা ঝোলে।  কতদিন ধরে ওরা এখানে ঝুলছে -।  ওদের দেখতে ওর খুব ভালো লাগে। বেশ মজা ও লাগে। 
মজাটা এই জন্যে যে নীচে দিকে মুখ করে ঝোলা। 
 একটু একটু করে মেলা কাছে চলে আসে। 
 কুশেশ্বর শিব মন্দির এর পাশ দিয়ে রাস্তা। 
 মাতামা প্রথমে যায় কোটরে বাবার আখড়ায়। 
 গাছের কোটরে বাবা কে গিয়ে প্রণাম করে। 
 তারপর নানা আখড়ায়। 
 প্রাচীন বটবৃক্ষের তলে সাধু ; বাবাজী ; বোষ্টম মাতাজী দের সাথে দেখা করে। হাতজোড় করে তাঁদের কে নিজের আখড়া য় 
 আমন্ত্রণ জানায়। মনোহর ক্ষেপার আখড়ায় যায়। 
 মুখুজ্জে দের কালী কাত্যায়নী আশ্রম হয়ে কাঙ্গাল ক্ষেপার আখড়ায় যাদের সাথে দেখা করার করে নিয়ে আবার কোটরে বাবা র আশ্রমে এসে বসে। আমার জন্য প্রসাদের ফলমূল ; চিঁড়ে মাখা প্রসাদ আসে। তারপর আমাকে নিয়ে যায় সিউড়ি থেকে আসা মিষ্টি র দোকানে। দোকানের সব চেয়ে বড় রসগোল্লা টা আসে আমার জন্যে। খুব ভালোবাসি মিষ্টি। 
 অযোধ্যার হাটে কিশোরী ময়রার দোকানে বাঁধা দু টি রসগোল্লা। পশ্চিমে র মাঠে গোরু গাড়ি র মেলা। 
গাড়ি র নীচে গাড়োয়ান দের অস্থায়ী সংসার। 
চপ ; মুড়ি ; জিলিপি। দুপুরে সুযোগ বুঝে মচ্ছব খাওয়া। যমুনা দিঘির পাড় দিয়ে রাস্তা। মাঠে সিনেমা ; সার্কাস ; ম্যাজিক ; নাগরদোলা।  আমাকে নিয়ে কাঠপট্টির পাশ দিয়ে পাথর পট্টি হয়ে পাক দিয়ে মূল রাস্তা দিয়ে মেলা দেখতে দেখতে নিয়ে আসে মোহান্ত অস্থলে। ঠাকুর মন্দিরে প্রণাম করে বেরিয়ে এসে 
 বড় মন্দির টা আমাকে দেখায়। আমি দেখি কত ছবি মন্দিরের গায়ে। হাঁ করে তাকিয়ে থাকি। 
 তারপর আবার সেই কোটরে বাবার আশ্রমে। 
  রাতে ঘুম আসেনা খড়ের উপরে কম্বল পাতা বিছানায়। 
 গায়ে ভালো করে ঢাকা দিয়ে মা বাইরে যায়। 
 গান শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে যাই। 
 পরের দিন বেলার দিকে প্রসাদ খেয়ে আবার ফেরা। তার আগে অবশ্য মুড়ি ; গরম চপ ; গরম জিলিপি একবার হয়েছে। আর একবার ছোট করে মেলা য় চক্কর। 
 আমার মন ভরেনা। আমার জন্য মাটির রঙ করা খেলনা পাতি কিনে দেয়। কলাপট্টির পাশ দিয়ে রাস্তা। বাঁধে উঠে দেখে পূবের মাঠেও গোরু গাড়ি র মেলা। এক দুটো বাস। জীপ। 
 বাঁধের উপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আবার শিয়াললাড়ার  ঘাট। পাশে আখের ক্ষেত। মাঠে চাষী থাকলে ' দাও বাবা ভেঙে ছেলেটাকে একটা '
 দক্ষিণে ঘণ জঙ্গল। মাতামা বলে ' গড় জঙ্গল ' শ্যামারূপার থানের কথা ' আর ঐ যে মাথা উঁচু মন্দির টা। ওটা? 
 ওটা ' দেউল '। 
 আবার এপারে সেই ফেরার পথ। মাঝে মাঝে গোরুগাড়ি করে লোকেরা মেলা চলেছে। আমার মনে হয় ওদের গাড়িতে যদি আমাকে নিয়ে নেয়। 
 মসনা মানায় পথের ধারে কামরাঙা গাছটা কে একে বারে ন্যাড়া করে দিয়েছে। একটা ও নেই। এখানের কুল ঝোঁপের কুল গুলো বেশ বড় বড়। একটা দুটো করে পাকছে। কাঁটা বাঁচিয়ে দু এক টা তুলে নি। আর বার বার পিছনে র পথের দিকে  তাকাই। 
  
 ©প্রণব ভট্টাচার্য ।  ৩ য় পর্ব।

একটি বিখ্যাত ছবি ব্যবহার করেছি। সত্যশ্রী উকিল দা র সৌজন্যে। এ ছবি আর কারও কাছে আছে কিনা জানিনা। মুকুল দে র তোলা সেই সময়ের ছবি।  অনেক ধন্যবাদ উকিল দা কে। 
এ শুধু ছবি নয়। ইতিহাস।
১ ম পর্ব। ২ য় পর্ব এর জন্য আমার ব্লগ বা পেজ 
মাটির প্রদীপ। আঞ্চলিক ইতিহাস। প্রণব ভট্টাচার্য এর লেখালেখি  তে দেখুন।

একাকী সেই দীর্ঘ প্রাচীন খেজুর আর সে

একাকী সেই দীর্ঘ প্রাচীন খেজুর  একা দাঁড়িয়ে থাকে। 
 পশ্চিমে মোরাম চাতাল। উঁচু নীচু খোয়াই। ছোটো খাটো ঢিবি নিয়ে গড়িয়ে যায় পুরো দক্ষিণ পশ্চিমে। 
'পাষাণ চণ্ডী' বাগানের ওপারে পশ্চিমে র সূর্য পাটে নামে। 
 একেলা ছেলেটি দাঁড়িয়ে থাকে মোরাম চাতাল এর উপরে পশ্চিমে র ঐ অস্তগামী সূর্যের দিকে তাকিয়ে। 
 সে জানেনা কেন তার মন হু হু করে। 
 আবার তো ঘরে ফিরতে হবে বাবাজী বটতলা র নীচ দিয়ে। 
 ফেরার পথে সে ঐ খেজুরের নীচে দাঁড়ায়। সেখানে তখন ছাতিম গাছের পাতার ঝোপে পাতলা আঁধার নেমেছে। 
 খেজুরের নীচে একটা ত্রিশূল গাঁথা। কয়েক টা মাটির ঘোড়া। 
 কারা যে রেখেছে সে জানেনা। 
 জানে এটা গোঁসাই থান। 
 সে কোন গোঁসাই?  মাতামা কে জিজ্ঞেস করে। 
 মাতা কেমন উদাস হয়ে যায়। 
 তারপর বলে সে ছিল রে বাবা এক গোপাল দাস বাবাজী। 
 পিছনে র জলাটা র নাম গোপাল সায়ের। এখন মজে গেছে।
 আর?  আর কিছু জানিনা বাবা। এ তো অনেক পুরনো গাঁ বাবা। ছিল সনাতন বাবাজী র আখড়া। আর নদী ধারে ঐ যে তমাল গাছটা র পাশে ছিল বুড়ো বাবাজীর আখড়া। ঐ যে 'বোরেগী গোড়ে ' পাড়ে। এখন পাড়ে বাবুরা বসিয়েছে  কোঁড়াদের। 
 হ্যাঁ মা ওর নাম ছিল বুড়ো। 
না রে। অন্য কি যে নাম ছিল তা কেউ জানে না বাবা। 
 ও। তুমি তাকে দেখনি। 
 আমি কেন রে এ গাঁয়ের কেউ তাকে দেখেনি। 
আরও ছিল। একদম নদী ধারে  কলাবাগানের ঘাটের কাছে। সাহেব দের নীল চাষ হত ওই যে 
 নীল বাড়িতে তার এক ধারে ছিল আর এক বাবাজী র আখড়া। 
 তার মানে এ গাঁয়ে অনেক বাবাজী র আখড়া ছিল। 
  যা। ঘরে যা এবার। পড়তে বসগা। দাদু বকবে তা না হলে। 
 চ। আমি দিয়ে আসি। আমার কাজ আছে। ও অন্নপূর্ণা কোথা গেলি। লণ্ঠন  টা দে।  
 হালদার দের ডুমুর গাছ তলায় এলে মাতামা তার গা য়ে ফুঁ দিত। একটা বাতাসের স্রোত বইত কোনাকুনি। অগ্নি থেকে বায়ুর দিকে। মাতামা অস্ফুটে বিড়বিড় করত। 
 ও মা কি বলছ। 
 কিছু না। কিছু না। ওনারা যাচ্ছেন। হাত জোড় করে প্রণাম করতেন  মাতামা। বালক দাসী। 
 ( ক্রমশঃ)
--------------------   -------------------    ----------------
  © প্রণব ভট্টাচার্য

সাতকাহনিয়া নবীন দাস বাবাজী র আখড়া। বালকমাতা দাসী আর অন্নপূর্ণা দেব্যা

মাটির প্রদীপ। আঞ্চলিক ইতিহাস। প্রণব ভট্টাচার্য এর লেখালেখি।
আঞ্চলিক ইতিহাসের কথা ও কাহিনী

Home
Friday, 23 August 2019
সাতকাহনিয়া বাবাজী আখড়া
সাতকাহনিয়ার বাবাজী আখড়া। অনেক পুরোনো গ্রাম। অজয়ের দক্ষিণ তীরে। একদিন ছিল অনেক গুলো বৈষ্ণব আশ্রম বা আখড়া। গাঁয়ের মাঝ খানে বিরাট পুরোনো বট জানান দিচ্ছে তার প্রাচীনত্ব।। নাম তার বাবাজী বটতলা। কোন বাবাজী যে রোপণ করেছিলেন -। বটতলার পাশেই বৈষ্ণব সমাধি স্থল । পাশেই নবীন দাস বাবাজীর আখড়া। সে অনেক পুরনো। শতবর্ষের ও বেশী। আরও ছিলেন বুড়ো বাবাজী ; সনাতন বাবাজী ; গোপাল বাবাজীর মতো সহজ সাধকেরা। আজ যদিও আর তাদের আশ্রমের চিহ্ন নাই। আছে কেবল এই নবীন দাস বাবাজীর আশ্রম। সে ও টিকে গেছে এই আশ্রমে একদিন এসে ঠাঁই পেয়ে ছিল বালকমাতা দাসী। গৃহী বোষ্টম ঘরের বাল্যবিধবা। আবার তাঁর কাছে ঠাঁই পেয়েছিলেন বামুন ঘরের প্রায় বাল্যবিধবা অন্নপূর্ণা দেব্যা। বালকমাতা কে আমি মাতামা বলেই ডাকতাম। মা ই বলতাম। কোলে পিঠে করে মানুষ করেছেন। প্রায় কোলে চাপিয়ে নিয়ে যেতেন ওপারে ভিক্ষা বা মাধুকরী করতে। বনে জঙ্গলে নানা লতা পাতা তুলতে। কেন্দুলীর মেলায় নিয়ে যেতেন  আমাকে। নানা আখড়ায় ঘুরতাম। ছোট থেকেই সহজ সাধনার নানা গুহ্য প্রক্রিয়া সম্পর্কে আগ্রহ তৈরী হয়ে গিয়েছিল। কত সাধক বাবাজী বাউল বোষ্টম যে এই সাতকাহনিয়ার আশ্রমে এসেছেন। কত জনের গান শুনেছি তাদের কোলে বসে। আমি যে ছিলাম বালক মাতার পালিত ছেলের মতো। সবাই খুব ভালোবাসতেন। পরিণত বয়সে মানে ১০১ বছর বয়সে মারা যান। কানে ভাসে তাঁর গুরু র সেই কথা " ওরে আমাদের গুরুর কোন শিষ্য ১০০র নীচে দেহ রাখবেনা রে " তোর মাতার বয়েস ১০১ " আশ্রমের বাইরে এই তমাল টি হলুদ ফলে ফলে ভরে গেছে। বুড়ো বাবাজী তলার তমাল টি ২০০ বছরের কাছাকাছি। আহা কি শীতল তার ছায়া।
(ক্রমশ) ©  প্রণব ভট্টাচার্য

আমার লেখালেখি

https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=2286973971433808&id=100003636821328

ক্ষত The Wounds. ক্রন্দন। The cry

ক্রন্দন। The Cry 
ক্ষত। The Wounds 
ঘুরে ফিরে মনে পড়ে  সেই সব মুখ
ক্ষত আর ক্রন্দনের গভীর অন্ধকার মাখা 
আর অন্ধকার উচ্চারিত হলেই 
যিনি এসে বসেন সামনে
 জীবন তৃষার সেই অমোঘ  কবি
 অবধারিত ভাবেই

রূপ তার কবেকার ঘণ অন্ধকার 
শত সহস্র বৎসরের ওপার থেকে 
ভেসে আসে ক্রন্দন রোল 
দেখা দেয় সেই সব ক্ষত বিক্ষত দেহ

তিনি আর ' পাইন ' দেখেছিলেন 

সে কি  মাত্র  শুধু ছবি ; ভাস্কর্য বা কবিতা 

গভীর ভিতরে তার নিরুপায় রক্ত ক্ষরণ।  
বুকের ভিতরে একটা ভাঙ্গা দেয়াল পুরেই 
যার জন্ম 
 সে কি না দেখে পারে হায়

চির বিস্মৃতির অন্ধকারে চলে যাবে জানি একদিন 
 আমি তার আগে দেখি শুধু জ্বালা ধরা চোখে

ওষুধ সম্পর্কে দু চার কথা যা জানি মাত্র

ওষুধ সম্পর্কে দু চার কথা যা জানি মাত্র
-----------------      ----------------    ------------------
   গল্প শুরু করি।
প্রতিদিন এক মদ্যপায়ী  মদ্য পান সেরে এসে
প্রথম প্রথম ' র‍্যান ট্যাক ; জিন্ট্যাক চাইত। তারপর কম দামের মানে এক টাকার ' প্রহিবিন ' তারপর ' অ্যাসিলক ' আর  তারপর  এসে চায় ' ওমেজ '।
আমার কাছে নয়। ওষুধ দোকানের কাউন্টারে। কাগজের কৌটো টা দেখিয়ে দেয়। এভাবে অনেক দিন চলেছিল।
সেদিন দেখলাম অন্য একটা কৌটো দেখাল।
যার বেচা কাজ সে বেচবে। এতে অবাক হওয়ার কিছু নাই।
সে নিল একটা রাবেপ্রাজোল + ডমপেরিডন + লেভোসালপিরাইড কম্বিনেশন।  দাম ১৪ টাকা। মার্কেটেড বাই এক বড় কোম্পানি। ম্যানুফ্যাকচারড বাই পড়া যায়না এত ছোট লেখা। ব্যাচ নং  এসব বাদ দিন। কে দেখে?
আমি বুঝি জেনেরিক প্রিপারেশন।
আমি তাকে শুধালাম হ্যাঁ রে এটা নিলি কেন? 
ভাল কাজ করে। মনটা মাষ্টার ভালো থাকে।
ভাবলাম হ্যাঁ লেভো সালপিরাইডের একটা ভূমিকা আছে বটে  মনের উপর। একটা ওয়েল বিয়িংনেস ভাব আনে।
আচ্ছা ইটোপ্রাইড ; লেভো সাল পিরাইড  এগুলো তাহলে বাজারে আছে। সাইড এফেক্ট এর জন্য বন্ধ হবার কথা শুনেছিলাম। ভুল শুনেছিলাম হয়তো। যেমন ক্লোরামফেনিকল আছে। আরও কত যে রয়েছে। কত কম্বিনেশন। থিয়োরি  অনুমোদন করেনা। করেনা তো কি। আমি কোম্পানি। আমার নিজস্ব গবেষণা আছে। তার জন্য আমাকে দাম নিতে হয়।
বাজারে দেখছি কত নতুন নতুন কোম্পানির নাম।
গুজরাট ; হরিয়ানা ; হিমাচল প্রদেশে র ঠিকানা সব।
গ্রাম গঞ্জের ওষুধের বাজার ছেয়ে গেছে জেনেরিক ওষুধে।
দাম কিন্তু বড় বড় কোম্পানি ব্র‍্যাণ্ডে ড ওষুধের মতোই।
তেমনই লেখা থাকে প্যাকেটে র উপর। এবার যে যেমন বেচে।
মনের উপর কাজ করে যে ওষুধ গুলো সে গুলো কাউন্টার থেকে ই বিক্রি হয়। না কি নিষেধাজ্ঞা ছিল না আছে।
বড় রাস্তার ধারে এক ওষুধ দোকানে বসেছিলাম।
মোটর বাইক নিয়ে দুজন যুবক এলো।
নামল। আঙুল দিয়ে চার দেখাল।
দুজনে দুটি করে চারটি নাইট্রোসান টেন ট্যাবলেট নিল।
দুটি করে একসাথে খেল। জলের বোতল টা কাউন্টার থেকে নিয়ে। তারপর যেমন উড়ে এসেছিল তেমনি উড়ে চলে গেল।
দাম দেয় সাত দশ দিন পরে বা সাথে সাথে।
ফেনসিডিল কফ সিরাপ খাবার জন্য গাড়ি নিয়ে আসেন এক ভদ্রলোক। তিনি ডিকিতে আগে থেকে প্যাক করে রাখা বাক্স তুলে নিয়ে বেরিয়ে যান।
আমি দেখি। তারাও দেখে।
যার বেচা কাজ সে বেচে।
ঠিক আছে। সব ঠিক আছে।
না। ঠিক নাই। ঠিক যে নাই তা অনেকেই বুঝছেন। কিন্তু -
মনোরোগ ক্রমাগত বাড়ছে। অনেক সময় তা ফেলে রাখছি। ডাক্তার এর কাছে যাব। পাগল হলাম না কি।
আরে বাবা পাগলামি সে তো অনেক দূরের পর্যায়।

তার আগে ডাক্তার বাবু র  কাছে যাও।
বারবার মন খারাপে ভুগতে ভুগতে একদিন যে রোগ চেপে
বসবে। একই চিন্তা দুঃশ্চিন্তা বারবার মনে পাক খাচ্ছে।
ডাক্তার বাবু যদি মনে করেন ওষুধের দরকার আছে। তিনি লিখবেন।
মনোরোগ একদিন মহামারি র রূপ নেবে। আজ এ পৃথিবী মনোরোগাক্রান্ত।
ওষুধ। হ্যাঁ আছে। যদিও মন কে যে সব বুঝে উঠতে পেরেছি তা নয়। কিন্তু হাতে যা ওষুধ আছে তা দিয়ে অনেকটা ভালো থাকা যায়।
রোগ অসুখ  আর ডাক্তার ওষুধের মাঝে তো আর কেউ নেই রে বাবা।
মনোরোগ এর ওষুধ গুলির যা দাম বাড়ল। প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি গুলির ব্র‍্যাণ্ডেড ওষুধ গুলির দাম ক্রমাগত বেড়েই চলেছে -
সামান্য  এমিট্রিপ্টিলিন ; ক্লোর ডায়াজিপোক্সাইড  থেকে শুরু করে  এসসিটালোপ্রাম ;  সার্টালিন ; প্রোথিয়াডিন ; প্যারো বা  ফেনোক্সেটিন আরও কত নাম - -
উদ্বেগ ; উৎকণ্ঠা দিন দিন বাড়ছে।  আলপ্রাজোলাম ; ক্লোনাজিপাম ; কি লোরাজিপাম ছাড়া তো অনেকের চলছেই না। মনের মধ্যে কালো মেঘ পাক খেয়ে খেয়ে উঠছে কেবলই।
এগুলো সব গাঁগঞ্জে কাউন্টারেই পাওয়া যায়।  নানা জেনেরিক প্রোডাক্ট। দাম সেই নামী ব্র‍্যাণ্ডের মতো ই।
বাজারে যে কত বলবর্ধক ওষুধ। নাম তাদের ফুড
সাপ্লিমেন্ট।  দেশী বিদেশি কত কোম্পানি নেমেছে। এত বড় বাজার এদেশের। কার না লোভ হবে। কত দেশী বিদেশি কোম্পানির নিউট্রিশন  প্রোডাক্ট।
আর কত যে টনিক। যে দোকানে ডাক্তার বাবু বসেন ; তার মালিক কে কিছু তো পাইয়ে দিতে হবে। সব জেনেরিক প্রোডাক্ট। একশো টাকার নীচে কোন দাম নেই। হ্যাঁ ডাক্তার বাবুরা লিখছেন।
সমস্যা নিয়ে ডাক্তার বাবু র কাছে যাওয়ার আগেই ওষুধের দোকান দার ধরিয়ে দিচ্ছেন  সিলডেনাফিল। চারটি ট্যাবলেট এর দাম লেখা একশো র কাছাকাছি। এক দোকানদার সেদিন আমাকে বলল বীরভূমের গ্রামে গঞ্জে খুব বিক্রি। যে যা দামে পারে বেচে। বেচো বাবা বেচো।
গাঁ গঞ্জে এই সব ওষুধ দোকানের বিক্রেতা ( যদিও একটা ফার্মাসিস্ট লাইসেন্স)  টাঙানো আছে সব দোকানে ই। হতে পারে সেটা ভাড়া য়। যাই হোক জ্বর জ্বালা তে এই সব মানুষেরা ই ভরসা। আর গ্রামীণ  ডাক্তার যাঁরা আছেন তাঁরা ই।
কোথাও এমন গ্রামীণ ডাক্তার আছেন যাঁর একটা আর ; এম  পি লাইসেন্স আছে শুধু। তাঁর পসার এবং আর্থিক প্রতিপত্তি শহরের বড় ডাক্তার দের চেয়ে বেশী। সব কাজ জানেন। দাঁত তোলা থেকে ; গর্ভপাত ; এমন কি অপারেশন।
আমি অবাক হয়ে যাই তাঁদের দুয়ারে রোগী র ভীড় দেখে।
অনেক কেই রাত্রে প্রস্টেট গ্ল্যান্ড বৃদ্ধির জন্য একটা ওষুধ নিতেই হয়। ট্যামসুলোসিন ( ব্র‍্যাণ্ড নাম ইউরিম্যাক্স ; ভেলটাম ; ডায়নাপ্রেস ইত্যাদি)  আর তার সাথে ফেনাস্টিরাইড বা ডুটা স্টেরাইড যুক্ত থাকলে তো কথাই নেই। দাম তিন শো থেকে চলল উর্ধ্বে -
  অ্যান্টি বায়োটিকের দাম ; যে ভাবে বাড়ছে গ্রামের সাধারণ মানুষ কোর্স শেষ করতে পারছে না। আর হাসপাতাল সাপ্লাই এর ওষুধে মানুষের কোন ভরসাই নেই।
তাহলে বাঁচব কিভাবে। না। টাকা না থাকলে আপনি বাঁচবেন না।
বাঙ্গালী ডাক্তার রা কি একবারও ভেবে দেখেছেন যে কেন মানুষ দক্ষিণে ছোটেন। আমাদের কাছের শহর দুর্গাপুরে অবাঙ্গালী ডাক্তার দের দাম বেশী। বিতর্ক হবে। দেখুন বিজ্ঞাপন।  হার্ট বা নার্ভের জটিল অপারেশন হবে। ডাক্তারবাবু আসবেন দক্ষিণ থেকে।
হায় বাঙ্গালী তোমার দিন গিয়াছে।
একদিন সারা ভারত আসত কলকাতায়।
কলকাতা মেডিকেল কলেজ থেকে পাশ করলে ব্র‍্যাকেটে লেখা থাকত  ক্যাল। আর আজ?  সবাই নিজেকে প্রশ্ন করুন।
  হঠাৎ সেদিন নজর পড়ল ' ভারতীয় জনওষধী পরিযোজনা ' নামের প্রকল্পের ওষুধ দোকানে। আলাপ হল মালিকের সাথে। তিনি ভিতরে ঢোকার অনুমতি দিলেন। আমি র‍্যাক গুলো তে চোখ বুলিয়ে দেখলাম প্রয়োজনীয় প্রায় সব ওষুধ ই রয়েছে।
আমি প্রথমেই ট্যামসুলোসিন ত্রিশ টি নিলাম। অবাক হলাম দাম দেখে। মাত্র ৫৪ টাকা। কাজ করবে তো!  মনে প্রশ্ন।
না দেখলাম ঠিক ই তো আছে।
এখন নিয়মিত ই নিচ্ছি। আমাদের স্বামী স্ত্রী র সব ওষুধ মিলিয়ে বাজার থেকে নিলে প্রায় ৪০০০ টাকা লাগত। এখন সব ওখান থেকে নিচ্ছি। পড়ছে বারো চোদ্দ শো টাকা।
কিন্তু এই দোকান তো আর হাতের কাছে নেই।
আর আমাদের ডাক্তার বাবু রা ব্র‍্যাণ্ড ই লিখবেন।
আবার লিখবেন  ; বদলাবেন না।
রোগী র আর্থ সামাজিক পরিস্থিতি র কথা ভেবে ডাক্তার বাবুরা ওষুধ লিখছেন তো। গরীব এক সুগারের রোগী কে ওষুধ যদি লিখি ঐ গ্লিপটিন গ্রুপের। কিনে খেতে পারবেন? 
  কাউকে জ্ঞান দিচ্ছিনা। জ্ঞান আমি আর কি দেব।
একবার তেপান্তর নাট্য গ্রামে বাংলাদেশের এক দল এসেছিলেন নাটক নিয়ে। এক ভদ্রলোকের সাথে বসে গল্প করছিলাম। খাবার সময় হল। ভদ্রলোক পকেট থেকে বের করলেন সুগারের ওষুধ। বাংলায় লেখা ' গ্লিবিজাইড '।
বাংলায় ওষুধের নাম লেখা দেখে বাঙ্গালী হিসাবে আমার স্বাভাবিক আনন্দ হল। আবার একটু ভাবলাম। একটু পিছনের জেনারেশেন এর ওষুধ। আমি খাই ' গ্লিমেপিরাইড '।
ওঁদের দেশে সব ওষুধ ই জেনেরিক। ব্র‍্যাণ্ডের বহর নাই।
উনি বললেন দেখুন গরীব দেশ। কম দামের ওষুধ দিয়ে যদি রোগ ভালো হয়।
আর আমরা যেন বড়লোক।
হ্যাঁ। যারা বড়লোক তারা বড়লোক।ওখানেও তাই। কিন্তু আপামর জনগণ।
  তাদের সংখ্যা টা সঠিক ভাবে নিরূপিত হোক।
আর তার বিপরীতে র সংখ্যা টা ও।
কার কত দেনা তাও প্রকাশিত হোক।
লিস্টি টাঙ্গিয়ে দেওয়া হোক।
ওষুধের বাজার টা দেখা হোক। লক্ষাধিক ব্র‍্যাণ্ড। কোটি কোটি মানুষ। লক্ষাধিক কোটি টাকার ওষুধ ব্যবসা।
ওষুধের মান নির্ণয়ের জন্য সংস্থা আছে। তাঁদের সত্যি কোন কাজ আছে কি না জানা নেই আমার। ওষুধের এফিকেসি বা বায়োএভেলিবিলিটি নিয়ে এত প্রশ্ন সংশয় কেন তাহলে।
হাসপাতালের ডাক্তার বাবুরা কি হাসপাতালের ওষুধ এর উপর ভরসা রাখেন!  নিজের বুকে হাত দিয়ে বলুন।
তাঁরা খুব ভালই জানেন স্যাম্পেল টেস্টিং এর সময় যে মাল পাঠানো হয় আর বাজারজাত করার মাল এক নয়।
আরও অনেক কথা বলা বাকী থাকল। বলব।
আপনারা যাঁরা আমাকে জানেন চেনেন তাঁরা বলবেন আরে মশাই আপনি আবার আঞ্চলিক ইতিহাস ছেড়ে ওষুধে এলেন।
কি ব্যাপার!  রঙ বদলালেন না কি। ট্র‍্যাক চেঞ্জ?  না। না। মোটেই  না। আমার অল্প বিদ্যা ভয়ংকরী না হয় যেন বাবা -
আমি দেখি চারিদিকে চলে শুধু লুঠ।
রঙ বেশ জটিল ব্যাপার। লুঠের কি কোন রঙ আছে নাকি
রঙের রসায়ন আছে।
হলুদে মেটালিক ইয়োলো মেশানোর গণিত কেশব নাগে নাই।
দুধে জল মেশানোর আছে। মেনে নিয়েছি
ছিল। আছে। থাকবে।
-----------  -----------    -----------     ------- ©  প্রণব ভট্টাচার্য। প্রথম পর্ব এখানেই শেষ করি।  নমস্কার। ভালো থাকুন।
একটি আমার আঁকা ছবি 
বাকী গুলির জন্য ওয়াসেফ জামান  এর কাছে ঋণী