।। পৌষ সংক্রান্তি এবং সাতকাহনিয়া র অজয় তীরের মহোৎসব।।
------------ ------------ ------------ ------------ ------------ ------------ -----
সেনো বাগদি । ভালো নাম তার সন্তোষ বাগদি।
তাকে আজ অনেকে ভুলেছে।
কিন্তু নদী তীরে সংক্রান্তি র দিন মেগে যেচে মচ্ছব মানে মহোৎসব করার ইচ্ছা নিয়ে আমাদের কাছে সে এসেছিল
নদী ধারে একখণ্ড জায়গার জন্য।
অযোধ্যা গ্রামের বাসিন্দা সে। ভালো চেহারা। উঁচু পুরু।
একটা ক্ষ্যাপা বাউণ্ডুলে বাউল তার ভিতরে ছিলই।
তারপর কমলা রঙের বাউলের আলখাল্লা পোষাক পরলে আর পাগড়ি বেঁধে গাবগুবি হাতে নিয়ে
গান ধরলে সে হয়ে যায় একেবারেই অন্যমানুষ।
বেশ জমিয়ে বসে আমার ঘরে সে পাড়ল কথা। ' একটু জায়গা দাও নদী ধারে '।
' আখড়া বানাবি '?
- সে কি আর পারব! তবে ইচ্ছে ঐ পৌষ সংক্রান্তি র দিনে মচ্ছব দেব। কত মেয়েরা তুসু ভাসিয়ে চান করতে আসে। চান করে উঠে মচ্ছব খেয়ে ঘর যাবে। দেখবে খুব ভালো হবে। জমে যাবে।
- বললাম একটু গাঁয়ের ধারে করলে হয়না। ঐ বুড়ো বাবাজী তমাল তলার কাছাকাছি। ওখানে খানিকটা সরকারি খাস জায়গা রয়েছে।
আমার ভাবনা তখন অনেক দূরে। একদিন তো ঐ প্রাচীণ তমাল তলায় এক বুড়ো বাবাজী র আখড়া ছিল। না হয় -
কিন্তু সে জায়গা টা নদী থেকে সামান্য একটু দূরে হয়ে যাচ্ছে
সন্তোষ সে জায়গায় রাজি নয়। তার ইচ্ছে একেবারে নদীর ধারে। তারপর নিজেই খুঁজে বের করল একেবারে তেমন একটা জায়গা। নদীর পাড়ে ই। সিকস্তি জায়গা।মালিকানাধীন অব্যবহৃত। আঁকড় গাছের ঝোপের ধারে।
তারপর হ্যাঁ যোগাড় পাতি করে একটা ত্রিপল টাঙ্গিয়ে সে সংক্রান্তির দিনে শুরু করল বটে। সামান্য কিছু লোকজন কে
জুটিয়ে আনল। খিচুড়ি তরকারি র মচ্ছব লোকে আনন্দ করে
খেল। তখন অযোধ্যা বনকাটি সাতকাহনিয়া গ্রামের গরীব
মানুষের পাড়াগুলো থেকে মেয়েরা সারারাত পৌষ আগলে
তুসু ভাসাতে দল বেঁধে আসত।গান গাইতে গাইতে। পাড়ায় পাড়ায় গানের লড়াই
চলত। কত রকমের গান। নিজেরা বাঁধত। আমরাও যারা পারি গান লিখে দিতাম। তখন শ্রমজীবী সাংস্কৃতিক উৎসব
চালু হয়েছে। ' ৮০ র দশকের শেষ দিকে। পরে তা সাক্ষরতা
আন্দোলনের সাথে জুড়ে গিয়ে আলাদা মাত্রা পায়।
উৎসব। প্রতিযোগিতা। লৌকিক সংস্কৃতি কে উৎসাহ দেওয়া।
আমাদের এখানের মেয়েরা ছেলেরা ভাদু গান ; তুসু গান ; বাউল গান এসব নিয়ে অনেক দূর পর্যন্ত গেছে।
এই সন্তোষ ও গেছে। আবার ঢাক ঢোল নিয়ে ও কয়েক জন
গেছে।
আজ সে রসের ধারা শুকিয়ে গেছে। কোন পাড়াতেই আর
মেয়েরা রাত ও জাগেনা। তুসু গান ও গায়না। কোলাহল তৈরী করা মাইক বাজে। কি যে তার ভাষা! আর কি যে গান।
বেজে উঠলেই বুক ধড়ফড়।
বাউণ্ডুলে স্বভাব তো ছিল ই। আর ছিল আকণ্ঠ মদের নেশা।
তার মাত্রা দিন দিন বাড়ল বই কমলনা। সংসারের কিছুই দেখেনা। বেশ কিছু জমির ভাগচাষী ছিল। মন দিয়ে চাষ ও করেনা। ঐ মদের নেশাই তাকে অকালে খেয়ে নিল।
কিন্তু সাতকাহনিয়া অজয় তীরের সেই মহোৎসব যা সে শুরু করে গেছে আজও তা বন্ধ হয়নি। বরং অযোধ্যা গ্রামের
মধু দে সহ অনেক মানুষের উৎসাহে ; অনেকের সহযোগিতা য়
তা এক গ্রামীণ মেলার রূপ পেয়ে গেছে।
অজয়ে স্নান সারতে ভোর থেকে ই মানুষের ঢল নামে। অটো ;
টোটো ; বাইকে করে এখন সব মানুষেরা আসে। বেড়াতেও আসে অনেকে। অনেক অনেক মানুষ পাত পারেন এখানে আজ। ছোট খাটো কয়েকটা অস্থায়ী মনোহারী ; খেলনাপাতির
দোকান ও বসে। মায়েরা এলেই বাচ্চারাও। আর প্রায় সব বাচ্চার হাতে গোল গোল বড়ো বেলুন।
এবারের আবহাওয়া ছিল বিশ্রী। কদিন ধরেই মেঘলা আকাশ।
কুয়াশায় মোড়া। মাঝে মাঝে টাপুরটুপুর।
এই আবহাওয়া তে কি আর ভালো লাগে!
তবুও শরীর খারাপ নিয়ে উঠে একবার গেলাম।
'তোর কথা মনে পড়ে রে খুব সেনো। এর মাঝেই তুই বেঁচে থাকবি। '
মনের ভিতরে জয়দেব কেন্দুলী র ডাক।
কিন্তু না। পারলাম না।
------------ ------------ ------------ ------------ ------------ শেষ করি।
No comments:
Post a Comment