Sunday, 6 November 2022

ইলামবাজার। এক প্রাচীন গঞ্জের কথা


।। গঞ্জ ইলামবাজার। প্রাচীন এক বানিজ্য কেন্দ্রের ইতিকথা।। প্রণব ভট্টাচার্য।
ইলামবাজার। বীরভূমের প্রবেশ দ্বার।
শুধুমাত্র বীরভূমের না। উত্তর বঙ্গের ও। পথ চলে গেছে ভায়া দুবরাজপুর   সিউড়ি হয়ে আরও উত্তরে।
আর এক পথ চলে গেছে বোলপুরের দিকে। " চৌপাহারী " জঙ্গলভূমির মধ্য দিয়ে।
আসলে ইলামবাজার এক জাংশন। তার এই অবস্থান খুবই
গুরুত্বপূর্ণ। দক্ষিণে পূর্ব বাহিনী অজয়। তার উপরে "অজয় সেতু "। ১৯৬২ তে উদ্বোধন হয়েছিল যে অজয় সেতুর  সে বয়সের ভারে দূর্বল হয়ে যাওয়ায়  রাজ্য সরকার কর্তৃক  নূতন সেতু নির্মিত হয়েছে। সম্প্রতি তার ও উদ্বোধন হল।
খুবই গুরুত্বপূর্ণ এই সেতু এবং পানাগড় মোরগ্রাম হাইওয়ে।
  পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে এই রাজ্য সড়ক খুবই উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে।
প্রাচীন জনপদ ইলামবাজার। যে বাজারের এলেম আছে। যেখানে এলেমদার মানুষ জনের আনাগোনা। যেখানে সুতা ;
তুলা ; রেশম ; তসর এর পাশাপাশি নীল ; গালা র নীলাম বাজার বসে। তখন তার নাম " তুলাপট্টি "। সে কোন ইলামবাজার। আসব সে কথায়। সে কথায় আসতেই হবে।
ইলামবাজার এর গ্রামীণ হাট অনেক পুরনো। সেই হাটে পাওয়া যায়না এমন কোন জিনিস নাই।  সব ; সব  কিছু পাওয়া যায়।  দুমকা থেকে আদিবাসী কর্মকার রা
তাদের লোহার তৈরী জিনিসপত্র এনেও  এই হাটে বেচে।
ওপার বর্ধমানের বসুধার চাষীরা সবজি নিয়ে না এলে হাটই জমেনা। এপারের সাথে ওপারের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ।
যখন পাকা সেতু ছিলনা তখন ছিল অস্থায়ী কাঠ বাঁশের
পারাপারের সাঁকো। তার উপর দিয়েই ওপার বর্ধমান জেলার
কত মানুষ আসা যাওয়া করত এই ইলামবাজারে।
এটি ই নিকটতম গঞ্জ। ইলামবাজার এর হাট কে কেন্দ্র করেই
এর বৃহত্তর গঞ্জ হিসাবে গড়ে ওঠার প্রাকপ্রস্তুতি।
ময়রা ; মুদি ; কয়লা ; বাসনপত্র ; মনোহারী ;পোশাক আশাক  সবের ই গঞ্জ। আর মেয়ের বিয়ের সোনার গহনা ; তার জন্য তো যেতেই হবে সাহা বাবুদের বা হাজী সাহেব দের দোকানে।
হাট কে ঘিরেই চারদিকে পাকা  দোকান দানি। একদিকে ' লরি পাড়ার" গালার খেলনাপাতি।গলি তে বসে মেছুনী রা। টাটকা নদীর মাছ। নারানপুর ; ক্ষুদ্রপুরের চাষীরা আনে আখের গূড়।  হাটের উত্তরে গৌরাঙ্গ মন্দির। মাঝখানে এক প্রাচীন বটবৃক্ষ।
তার সামনে মাটির তৈরী নানা সামগ্রী নিয়ে বসে এপার ওপারের কুমোরে রা।
চারপাশের নানা গ্রাম থেকে মানুষ আসে এই হাটে।
হাট বসে যে জায়গায় সেই জায়গা মৌখিরা কালিকাপুর এর
জমিদার বাবুদের। তাঁদের লোকে তোলা তোলে। তাঁদের কাছারী বাড়ি আছে এখানে।
তারপর যখন সিনেমা হল তৈরী হল " চন্দ্রকুমার " বা চাঁদকুমার পুকুরের ধারে - গোরু গাড়ির ভিড় বলে দেখে যা।
সাহা বাবুরা ; ডাক্তার কালী বাবু রা উদ্যোগ নিয়েছিলেন
সিনেমা হল তৈরী তে। তার আগে দুবরাজপুরের এক ব্যবসায়ী। তিনি জয়দেব কেন্দুলী র মেলাতে ও সিনেমা দেখাতেন।
------------ ------------ ------------ ------------ ------------ ১ ম পাতা শেষ।

গঞ্জ ইলামবাজার  কথা।।  ২ পাতা আরম্ভ।
আজ থেকে ৬০-৭০ বছর আগের প্রাথমিক বিদ্যালয় পাঠ্য
ভূগোল বইয়ে  'কি কোথায়  কি জন্য বিখ্যাত  ' নামে একটি
অধ্যায় থাকত। সেখানে ইলামবাজার এর পরিচয় " লাক্ষা বা গালা শিল্পের কেন্দ্র। একটি গঞ্জ  বীরভূম জেলা য় "
একদা  নীল ও গালা শিল্পের এক প্রধান কেন্দ্র হিসাবে গড়ে উঠেছিল এই ইলামবাজার। এবং গঞ্জ হিসাবে তার খ্যাতিও
সেই নীল গালার ব্যবসাকেন্দ্র হিসাবে। বিখ্যাত।
"Trade mart of importance ". ইউরোপীয় যুবক মিঃ ডেভিড আরস্কাইন এর হাতে যার সূচনা। বীরভূমের প্রথম
কমার্শিয়াল রেসিডেন্ট হিসাবে সুরুলে এসে ঘাঁটি গেড়েছেন
মিঃ জন চীপ ১৭৮২ সালে। প্রায় দুর্গতুল্য কুঠিবাড়ি বানিয়েছেন। কয়েকবছর এর মধ্যেই তিনি " গড়া কাপড় "
এবং বাণিজ্যিক ভিত্তিতে নীল উৎপাদন এর ব্যবসায় প্রভূত সাফল্য লাভ করেছেন। সুরুলের সরকার বাবুরা বা রায়পুরের
সিংহ বাবু রা তাঁর সাথে ব্যবসা করেই ধনী হয়েছেন।
এই চীপ সাহেবের কাছে হাতে কলেমে কাজ শিখে ; তাঁর কাছ থেকে সাহায্য সহযোগিতা নিয়েই  আরস্কাইন সাহেব  দ্বারোন্দা
গ্রামে তাঁর নীলকুঠি বানিয়ে জমিয়ে ব্যবসা করেছেন। প্রভূত লাভ করেছেন নীল ব্যবসায়ে। তারপর একদিন দ্বারোন্দার
পাট চুকিয়ে তিনি চলে এলেন অবস্থান গত দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ  এই ইলামবাজারে। ইলামবাজারের পূর্ব দিকের
বিরাট ডাঙ্গা য় গড়ে উঠল তার বিশাল ডাকবাংলো গড়নের
কুঠিবাড়ি। গুদাম। বাসগৃহ। এমনকি নিজের পরিবারের জন্য
কুঠিবাড়ি র উত্তরে একখণ্ড জমিতে " সমাধিক্ষেত্র "।
আবার দক্ষিণে অজয়ের ধারে আমবাগানের মধ্যে তাঁর স্ত্রী র
জন্য আবাসগৃহ। অতি সুন্দর ; নির্জন সেই স্থান। মনোরম।
ইলামবাজার এবং পার্শ্ববর্তী এলাকার এবং অজয়ের ওপারে
প্রভাবশালী ব্যক্তি দের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুললেন।
ইলামবাজার বা বসুধার " লরি " সম্প্রদায়ের মানুষ দের
সংগঠিত করে এক ছাদের নীচে নিয়ে এসে গালার ব্যবসা কে
সুসংগঠিত বাণিজ্যিক রূপ দিলেন।
একটা সময় তিনি স্থানীয় ভূস্বামী দের সাহায্যে প্রায় ১৪৫২৫
বিঘা জমিতে নীলের চাষ করাতেন। তাঁর দাদনের পরিমান বেশী ছিল। এবং প্রায় চেষ্টা করেছেন অনাবাদী জমিতে নীল
চাষ করানোর। কৃষক বিক্ষোভ তার জন্যই দেখা দেয়নি।
ইলামবাজার এর খয়েরবুনির শিমূল তলার ঘাটের নামই হয়ে গিয়েছিল " সাহেব ঘাট "। ছোট  নৌকা য় করে নীল গাছ ; শাল ; পলাশ ; কুসুম ; কুল ; পাকূড় গাছের সরু ডালে লাক্ষা কীটের তৈরী করা তাদের দেহ আবরণী ঘর সমেত ডাল  ; সব মাল আসে
সাহেবের গুদামে। পশ্চিমে র ঝাড়খণ্ড এর জঙ্গল ভূমি
এবং " সেনপাহাড়ী " র জঙ্গল ভূমি র নামই হয়ে গিয়েছে
" লা মহল "। লা মানে লাক্ষা।
লক্ষ লক্ষ লাক্ষা কীটের মুখের লালায় তৈরি তাদের পুঞ্জীভূত
নলাকৃতি দেহ আবরণ ; সেখান থেকেই তৈরী হয় গালা।
নির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে। ডাল থেকে ছাড়ানো। তাকে গুঁড়ো করা।
বড় বড় জালায় জলে ভিজিয়ে রাখা। তুলে নিয়ে গরম জলে
কার্পাস পাতা মিশিয়ে ফোটানো। তারপর থিতিয়ে গেলে উপরের জলীয় অংশ " যাবক " বা আলতা। তা দিয়েও  সুতো
রঙ করা হয়। সবশেষে নীচের অবক্ষেপিত পদার্থ কে গনগনে
আগুনে গরম করে গলিয়ে ফেলে নানা ছাঁচে ফেলা। নানা নাম
তার। চাকতি ; বোতাম ; পাতা। তারপর রোদে শুকিয়ে ঠাণ্ডা করে বস্তা বন্দী করে চালান দেওয়া। অতি চমৎকার প্রাকৃতিক
" রেজিন " এই গালা। এখনও এর বাজার মূল্য যথেষ্ট।
এবং যথেষ্ট তার চাহিদা।
এখানে ফরাসি কোম্পানির ও একটা ছোট্ট কেন্দ্র ছিল।
কিন্তু ইলামবাজার এর বিখ্যাত গঞ্জ হিসাবে গড়ে ওঠা
ডেভিড আরস্কাইন সাহেবের হাত ধরে। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর
ছেলে হেনরি  ব্যবসা চালিয়েছেন ৩৫ বছর।
তারপর তাঁদের আত্মীয় ফারকুহারসন এবং ত্রিহুত এর ক্যাম্পবেল সাহেবকে ব্যবসা বিক্রি করে দেন। তাঁরা চালালেন
১৮৮২ সাল পর্যন্ত। তারপর তাঁদের সমস্ত সম্পত্তি সহ ব্যবসা
কিনে নেন জমিদার রায় বগলানন্দ মুখার্জি। তার আগেই তিনি এবং তাঁর আত্মীয় রা স্বাধীন ভাবে আবার কোম্পানি সাথে নীল ; গালার ব্যবসা করছেন।  তিনি তাঁর আত্মীয় দের দিয়ে এই ব্যবসা চালিয়েছিলেন আরও অনেক দিন। ব্যানার্জি ; মুখার্জি ; চ্যাটার্জি ইত্যাদি পরিবার।
এছাড়াও আরও অনেকে তখন ছোট আকারে হলেও নীলের বা রঙের ব্যবসা করেছেন ভরপুর। ইলামবাজারের বারুইপুরের পাল পরিবার। অজয়ের ওপারে অযোধ্যা বনকাটি এলাকা র
বনকাটি র মুখার্জি বাবুরা গালা ব্যবসায় এতই ধনী হয়েছিলেন যে নিজেদের বসবাসের জন্য প্রাসাদ সহ নির্মান
করিয়েছিলেন  টেরাকোটা অলংকরণ যুক্ত বিখ্যাত " গোপালেশ্বর শিব মন্দির। এবং বিখ্যাত কারুকার্য মণ্ডিত
বনকাটি র পিতলের রথ।
সাহেব কোম্পানির সাথে নীলের ব্যবসা করে প্রভূত ধনী হয়ে উঠেছিলেন  মৌখিরা কালিকাপুর এর জমিদার বাবুরা।
কালিকাপুর এর সাতমহলা প্রাসাদ সহ দুটি বিখ্যাত শিবমন্দির নির্মান করিয়েছিলেন। টেরাকোটা অলংকরণ
যার অসামান্য। সম্মুখে দিঘি। তার পশ্চিমে আজও দাঁড়িয়ে আছে ভগ্ন অবস্থায় বিখ্যাত দ্বিতল " চাঁদনী "। গোটা গ্রাম জুড়ে ছড়িয়ে আছে কত স্থাপত্য। বিশাল এক বিষ্ণু মন্দির নির্মিত হয়েও তার প্রতিষ্ঠা হয়নি। আর মৌখিরা এক প্রাসাদ মন্দির নগরী। কত যে মন্দির আর প্রাসাদ!
ইলামবাজার এর  পাল ; দত্ত ( দালাল) ; লাহা ; সাহা; লরি ; দাস (তাঁতি) ইত্যাদি এবং কয়েক টি মুসলিম
পরিবার  যথেষ্ট ধনী হয়ে উঠেছিলেন নানাবিধ ব্যবসা য়।
ব্যবসার একটা পরিমণ্ডল গড়ে উঠেছিল সেই সময়
  সাহেব কোম্পানির কুঠিবাড়ি ভিত্তিক ব্যবসা বাণিজ্য কে কেন্দ্র করে।
------------ ------------ ------------ ------------ ------------ ২ পাতা শেষ



।। গঞ্জ ইলামবাজার কথা।। ৩ নং পাতা আরম্ভ।
সেই সময়কাল ঃ  সেই  সময় কাল বড়োই উত্তাল। অস্থির।
১৭৫৭। পলাশীর যুদ্ধে সিরাজের আশ্চর্য পরাজয়। মুর্শিদাবাদ
নবাব কোষাগার রাতারাতি লুঠ হয়ে গেল।
১৭৭০ এর মহামন্বন্তর। যা বাংলা(১১৭৬) ছিয়াত্তর এর নামে কুখ্যাত।
বীরভূমের ৬০০০ গ্রামের মধ্যে প্রায় ১৫০০ গ্রাম জনশূন্য হয়ে গেছে। চাষযোগ্য জমি সব পড়ে আছে। চাষ করবে কে?  ভাত খাবার চাল নাই। যে চাল এক টাকায় ২-৩ মন পাওয়া যেত সেই চাল ৩ টাকা সের। কিন্তু কিনবে কে। লক্ষ লক্ষ মানুষ
না খেতে পেয়ে মারা গেল। এ প্রায় গণহত্যা ই।
সুপারভাইজার হিগিনসনের সরকারি রিপোর্ট অনুযায়ী
" বীরভূম বন্ধ্যা জনমানব হীন দেশ "।
আর ইউরোপীয় ব্যবসায়ী রা সারা বীরভূম জুড়ে ছুটে বেড়াচ্ছে  কোথায় কোন ব্যবসা ভালো হতে পারে সেই সম্ভাবনার সন্ধানে।    পূর্বাংশে ভালো রেশম। পরে আমরা দেখব গড়ে উঠছে বিখ্যাত
গুণুটিয়া রেশম কুঠি। সুতী ; রেশম ; তসর ; গুড় ; লোহাপাথর থেকে লোহা ; নীল ; গালা ইত্যাদি সব কিছুর ভাবনা তাদের মাথায়। ভালো ব্যবসা মানেই ভালো কর আদায়। তা না হলে
সিভিল সার্ভিস থেকে কমার্শিয়াল রেসিডেন্ট হিসাবে কি ১৭৮২ সালে জন চীপ সাহেব কে নিযুক্ত করা হয়!
সবার আগে এসেছে আর্মেনিয়ান রা। তারপর ফরাসী ; ইংরেজ ; ওলন্দাজ রা। সারা বাঙ্গলা জুড়েই ছূটে বেড়াচ্ছে
তারা। হাণ্টার সাহেবের বিবরণী তে ই আছে ' বড় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে গালার এই ব্যবসার উদ্বোধন ডেভিড আরস্কাইন এর হাতেই। এবং নীল ; গালা ; কার্পাস বস্ত্র এর ব্যবসার মাধ্যমে মরে যাওয়া অর্থনীতি র কিছুটা হলেও উন্নতি হয়।
মন্বন্তর এর পর সারা জমিদারি তে ৫০ জনও ধনী মানুষ নেই।
কিন্তু কোম্পানির ট্যাক্স আদায় কিন্তু কমছেনা।
" বণিকের মানদণ্ড এবার রাজদণ্ড "।
১৭৭৯ সালে ভুখা মানুষ  ; কৃষক দের স্বাভাবিক বিক্ষোভ দেখা দিল। বিক্ষোভ প্রবল হল। প্রকাশ্যে ডাকাতি হচ্ছে।
ডাকাত (!) দের দল ক্রমশ বিশাল হচ্ছে। দলে শত শত ; হাজার হাজার   বিক্ষুব্ধ মানুষ। পশ্চিম থেকে নেমে আসছে দুর্ধর্ষ পাহাড়ি এলাকার মানুষের দল। আরস্কাইন সাহেবের কুঠিবাড়ি ( পাহারা সত্বেও) সহ গোটা ইলামবাজার দিনে দুপুরে লুঠ হল।
কুঠিবাড়ি সহ শুকবাজারের তাঁতিদের বাঁচাতে সুরুল কুঠি থেকে সেপাই পাঠানো হল। ১৭৮৯ সালে। নদীর ওপারে অযোধ্যা - বনকাটির  চট্টোপাধ্যায় পরিবারে ডাকাতি হল।
তখন এই ডাকাত দলকে সামলানো কোম্পানির কাছে এক চরম মাথাব্যথার কারণ। কেননা স্থানীয় ভূস্বামী দের সে ক্ষমতা নেই। তারা অনেকে  নিজেরাই ডাকাত দল গড়েছে বা তাদের দলে গোপনে  যোগ দিয়েছে।
এই সেই সময়।
আজ আর ইলামবাজার এ এক ঘর " লরি বা নুরী " দের খুঁজে পাওয়া যাবে না। কেউ নিজের পরিচয় দেয়না। সবাই পেশা বদল করে নিয়েছে।
অথচ একদিন অর্থাৎ ১৮৫৫ সালে প্যারিসে র এক আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী তে  ইলামবাজারের গালা শিল্পী দের তৈরী  শিল্পবস্তু স্থান পেয়েছে যথেষ্ট সমাদরেই।
ডেভিড আরস্কাইন সাহেবের দেশে ফেরা আর হয়নি।
তিনি শুয়ে আছেন এই ইলামবাজারে ই। তাঁর পারিবারিক সমাধিক্ষেত্রে সাতটি সমাধি ছিল। মার্বেল ফলকে লেখা ছিল
নাম ; জন্ম ;  জন্মস্থান ; মৃত্য তারিখ ; আর ইলামবাজার।
সেই সমাধি ক্ষেত্রের সব মার্বেল ফলক চুরি হয়ে গেছে।
যে কুঠিবাড়ি তে শান্তিনিকেতন থেকে জয়দেব কেন্দুলী র মেলা দেখতে যাওয়ার পথে ফরাসী পণ্ডিত সিলভা লেভী এবং
মাদাম লেভী এক রাত্রি বিশ্রাম নিয়েছিলেন সেই উঁচু ভিতের
খোলা বারান্দা র ডাকবাংলো রীতির কুঠিবাড়ি র একটি ইঁট ও
অবশিষ্ট নাই।
আমরা সংরক্ষণ করিনি। তার প্রয়োজনীয়তা অনুভবই করিনি।
------------ ------------ ------------ ------------ ------------ ৩ নং পাতা শেষ
 

।। ইলামবাজার কথা।। ৪ নং পাতা আরম্ভ।
ইলামবাজারের তিনটি বিখ্যাত মন্দির ঃ অসামান্য টেরাকোটা অলংকরণ শোভিত তিনটি মন্দির আছে এই ইলামবাজারে।
১)   হাটতলার গৌরাঙ্গ মন্দির ২) ব্রাহ্মণ পাড়ায় রামেশ্বর শিবমন্দির এবং ৩) ব্রাহ্মণ পাড়ায় বিখ্যাত বিরাট লক্ষ্মী জনার্দন মন্দির।
গৌরাঙ্গ মন্দিরের প্রতিষ্ঠা লিপি নাই। মন্দির টিও  অসম্পূর্ণ
বলে মনে হয়। অষ্টকোনাকৃতি এই মন্দির টির কাঠের ফ্রেম করে টিনের চালা বানানো হয়েছে। মন্দির প্রেমী দের কাছে
অসাধারণ একটি মন্দির। এর টেরাকোটা র কাজ অনুপম।
যেমন জ্যামিতিক ডিজাইন ; ফুল লতা পাতার লতা তেমনি
জ্যামিতিক ডিজাইন এ  " নকল দরজা। উপরের দিকে নানা পৌরাণিক চিত্র। লম্বিত প্যানেল।মৃত্যু লতা। দুর্গা ; রাম রাবণ সহ নানা পৌরাণিক আখ্যান চিত্রায়িত।  একেবারে নীচে নানা মূর্তি।
কিছু সামাজিক চিত্রণ। নীচের দিকের অনেক টালি ক্ষয়প্রাপ্ত  হয়ে নষ্ট হয়ে গেছে। অতি দ্রুত নিম্নভাগের ক্ষয় হচ্ছে।
এই মন্দিরের গোড়ায় মানসিক এর নুন দেওয়া হত। এই দশার কারণ সেটা ও। কথিত আছে
মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য দেব রাঢ় ভ্রমণের সময় এখানে বটতলায়
বিশ্রাম নিয়েছিলেন এবং ভাতের সাথে একটু নুন চেয়েছিলেন।
উনি ইলামবাজার সংলগ্ন পায়ের গ্রামে ও নাকি গিয়েছিলেন।
রামেশ্বর শিবমন্দির ঃ উঁচু ভিতের উপরে দেউল রীতি র
পীরা যুক্ত মন্দির। ১৮৪৬ এর কাছাকাছি সময়ের  নির্মান। চমৎকার টেরাকোটা র কাজ। সংস্কারে সিন্থেটিক রঙের প্রলেপ পড়েছে।
তাও কাজ গুলি স্পষ্ট। দুর্গা ; জগদ্ধাত্রী আছেন দুপাশে।
সামনে র রাম-সীতার রাজ্যাভিষেক। নানাবিধ পৌরাণিক চিত্র। এবং বেশ কিছু সামাজিক চিত্রণ। যুদ্ধ যাত্রা।সৈনিক দের দল।
লক্ষ্মী জনার্দন মন্দির ঃ ১৮৪৬  খ্রীস্টাব্দে নির্মিত। ৭০ ফুট উচ্চতা। পঞ্চরত্ন মন্দির। চূড়ায় পীড়ার কাজ।
ক্ষুদিরাম বন্দ্যোপাধ্যায় এর প্রতিষ্ঠাতা।
রক্ষা পেয়েছে এর প্রতিষ্ঠা লিপি। এই মন্দিরের কাজ কে অসাধারণ বললে কম বলা হবে। এর দুর্গার চালচিত্র ; রাম রাবণের যুদ্ধ  রাসমণ্ডল সহ অন্যান্য পৌরাণিক চিত্র।প্রতিটি কাজেই শিল্পী দের অসামান্য দক্ষতার প্রকাশ।  দলিল  কিছুটা হাই রিলিফের কাজ। পটের থেকে ফিগার যেন বেরিয়ে আসছে।
ত্রিমাত্রিকতা দেবার প্রচেষ্টা। এবং অনবদ্য এর এক্সপ্রেসন।
নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস ই হবেনা। কি অসামান্য এর
শিল্পগুন সম্পন্ন টেরাকোটা ফলকের কাজ। শিল্পীদের কারিগরি দক্ষতাকে কুর্নিশ। তাদের নাম কোথাও নেই।
পাশেই আছে বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের ভগ্ন প্রাসাদ এর ধ্বংসাবশেষ। তার পাশেই ছিল গালা শিল্পী দের একত্র বসে কাজ করার এক প্রাচীর ঘেরা প্রাঙ্গণ। কয়েকটি ঘর সমেত।
এই তিনটি ছাড়াও আরও কিছু মন্দির আছে।
পাল দের ছিল বিশাল এক দুর্গা দালান। সু উচ্চ তোরণ দ্বার।
ভগ্নাবশেষ দেখেও  এই দালান মন্দির এর বিশালত্ব অনুমান করা যায়। এর সম্মুখ ভাগে ছিল অপূর্ব জ্যামিতিক ডিজাইন এর পঙখের কাজ। দুই দিকে দুই প্রকোষ্ঠ। মাঝে বেদী।
সামনে ছিল লম্বা বারান্দা। বারান্দার মধ্যস্থলে ছিল কৌনিক
উচ্চ স্তম্ভ।
এটিই ইলামবাজারের প্রাচীনতম এক অতি চমৎকার দুর্গা দালান।
ইলামবাজার এর প্রাচীনত্বের নিদর্শন হিসাবে রয়েছেন বৌদ্ধ
দেবী সুহ্মেশ্বরী। দেবী মূর্তি ভগ্ন। পাদপীঠে ক্ষোদিত ছিল
বৌদ্ধ শ্লোক। " যে ধর্ম্মা হেতু প্রভবা হেতুং তেষাং তথাগতাহ্যবদৎ / তেষাঞ্চ যো নিরোধঃ এবং বাদি মহাশ্রমণঃ "
  এখানের ধর্মরাজের নাম সুহ্মরায়। সুহ্ম অতি প্রাচীন শব্দ।
  রাঢ় দেশের নামই ছিল -  সুহ্ম।
বীরভূম এর উপর দিয়ে বয়ে গেছে নানা ধর্মীয় সাধনার স্রোত।
বীরভূমি বীরভূম। বজ্রভূমি। কামকোটি।
বজ্রযানী বৌদ্ধ দের প্রভাব বিস্তৃত হয়েছিল এখানে ব্যাপক ভাবে। সমাজের নিম্নবর্গের মানুষ জন সবাই এই ধর্মে মর্যাদার সাথে স্থান পেয়েছিলেন।
অনেক জৈন নিদর্শন ও রয়েছে বীরভূমের নানা স্থানে।  ইলামবাজার
নিকট বর্তী ঘুড়িষা গ্রামে আছে জৈন তীর্থঙ্কর পার্শ্বনাথের ভগ্ন
মূর্তি। এই সবই ইলামবাজারের প্রাচীনত্বের প্রমান। 
আজকের ইলামবাজার ঃ ১৯০১ সালে ইলামবাজার এর জনসংখ্যা ১৮১৫ জন। Sherwill সাহেবের সমীক্ষায় গালা সহ অন্যান্য শিল্পের Trade Mart ইলামবাজার এবং পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলির প্রায় ২২৩৫ জন মানুষ নিয়োজিত। যদিও তখনই
নুড়ি দের মধ্যে ভালো গালা শিল্পী মাত্র দুজন। গালার অলংকার নির্মাতা রা ছিলেন। মূল চল্লিশ টি পরিবার। আশপাশের গ্রামগুলির পরিবারগুলিকে ধরলে প্রায় দুশো
পরিবার এই শিল্পের সাথে যুক্ত।
ইলামবাজার এর শেষ দুই নামী গালা শিল্পী ছিলেন নেপাল আর গোপাল গুঁই। রবীন্দ্রনাথ তাঁদের দুই ভাইকে প্রশিক্ষক হিসাবে নিয়ে গিয়েছিলেন শ্রীনিকেতনে।
আজকের ইলামবাজার এক বিস্তৃত মিউনিসিপ্যাল এলাকা।
বৃহত্তর ইলামবাজারের সেই স্বীকৃতি পাওয়া দরকার।
কিন্তু আধুনিক ইলামবাজার ভুলেছে তার সমৃদ্ধ অতীত। তার ঐতিহ্য। তার ইতিহাস।
------------ ------------ ------------ ------------ প্রবন্ধ সমাপ্ত।
গ্রন্থ ঋণ।  জেলা গেজেটিয়ার।  এল এল এস ও ম্যালি ১৯১০
বঙ্গসংস্কৃতির অঙ্গনে। সম্পাদক  শ্রী স্বপন ঠাকুর। নিজস্ব প্রবন্ধ।
রাঢ় ভাবনা পত্রিকা। সম্পাদনা। শ্রী সৌরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়
চিত্র ঋণ। আরস্কাইন সাহেবের সমাধি ক্ষেত্র। শ্রী সত্যশ্রী উকিল।


 

 



 




 
Show quoted text

No comments:

Post a Comment