Wednesday, 2 November 2022

।।অরুণ আর তার মেয়ের কথা।।


।। কথা - সাতকাহন।।
" দাদা আমি বাঁচতে চাই "। কি করুণ আর্তি। দৃশ্য টা চোখের
সামনে ভেসে উঠত।
  মেয়েটাকে দেখতে যেতাম মাঝে মাঝে।
  একবুক  হতাশা নিয়ে। কিছু না করতে পারার যন্ত্রণা।
  আমি গেলে পাশে মোড়ায় বসতাম।
  আমার দিকে তাকিয়ে দেখত। কিছু বলতনা। শুধু বড় বড়
ম্লান চোখ দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ত।
গরীব বাউরী বাপের মেয়ে। বাপের গতর টাই ভরসা। যেখানে যা পায়। মাঠের কাজে ই বেশী যায়। ভালো কোদাল পাড়তে পারে। বনকাটির সব্জি ক্ষেতে কচুর ভেলি করতে বা আখের গোড়ায় মাটি দিতে তার ই ডাক পড়ে। ঘরে একজনের ই রোজগার। পেট অনেক গুলো। বুড়ো বাবা মা আছে। তিন ছেলে মেয়ে। নিজেরা। সব মিলিয়ে সাত জনা। গোপেশ্বর আর কালীদাসী ছোট একটা কুঁড়ে তে থাকে। মাঝে সাঝে কিছু বয়সকালের ভাতা পায়।সবে গ্রামপঞ্চায়েত গড়ে উঠেছে।  কিছু চাল গমের জি আর পায়
ছোট  বেটা অরুণে র কাছেই খায়। অরুণ  রা একটা ঘর করার টাকা পেয়েছে।
তখনকার দিনের কম টাকা। কয়েক হাজার হবে।
তবে সে টাকার দাম ছিল। ঘরের কাজে কিছু লাগালো। আর কিছু রাখল বোধহয় ছোট মেয়ের বিয়ের জন্যে। ছোটটি বড়োসড়ো  হয়ে উঠছে। মনসা। ছেলে এখনও  ছোট। কাজের উপযুক্ত হয়নি।
আর বড় মেয়ে টি। মনসা মন্দিরের পিছনে ঘর। ঠাকুমা তাই নাম রেখেছিল চিন্তা। মা চিন্তামণি র নামে। গরীব বাপের মেয়ে
চিন্তা তো আছেই। মেয়ে টা বড় হয়েও যেন কেমন শুকনো।
মুখটি বড় দেখায়। চোখ দুটি আরও বড়ো।
  - উঁহু অরুণ।  একবার ভাই ডাক্তার দেখা। মানুষের উঠোনে গিয়ে মোড়া পেতে বসার একটা অভ্যেস আমার ছিল।
- দাদা একবার হাতটা ওর দ্যাখো।
- কিছুই জানিনা। তবু কিছু জানি।
হাতটা নিয়ে পালস দেখে খুব সন্দেহ লাগলো। এত দূর্বল। রিদম ও ঠিক নাই। পেস ও না।
আমি অরুণের মা কে জিজ্ঞেস করলাম হ্যাঁ গো কালুনী মাসী
ছোটতে ওর বাত হয়েছিল? 
  ভাবতেও হলনা। হ্যাঁ। বাবা। পায়ের গাঁট গুলো দ্যাখো ফোলা।
সত্যিই তাই।
  - অরুণ ভাই ভালো বুকের ডাক্তার এর কাছে নিয়ে যেতে হবে।
  প্রথমে ইলামবাজার। তারপর দুর্গাপুর। বড় ডাক্তার বাবু বলে দিলেন। অসুখ গুরুতর। বাতে বুকের ধুকপুক করা যন্ত্র টা খারাপ। বড় হয়ে গেছে। আর যা বলার তা লিখে দিলেন তাঁদের
প্রেসক্রিপশনে।
আমি ভেঙে বুঝিয়ে সব বললাম অরুণ কে। একটু আড়ালে।
এ যে এখানে হবেনা ভাই। বর্ধমান। বর্ধমানে ও হবে না। যেতে হবে কলকাতা।
হার্টের সাইজ বড় হয়ে গেছে। পাম্পিং ক্ষমতা কমে গেছে।
ভালব নষ্ট। এ কি সোজা ব্যাপার। গরীবের ঘরে ঘোড়া রোগ।
বর্ধমান। কলকাতা। ভাবনার বাইরে। কে নিয়ে যাবে। যাতায়াতের খরচ। কে থাকবে ওর কাছে। ভর্তি করার সমস্যা।
এম এল এ ; এম পি র চিঠি না হয় জোগাড় করা যাবে।
কে ওকে নিয়ে ছোটাছুটি করবে। টাকা কোথা!
গরীব মানুষের গাঁ। কটা টাকাই বা মেগে যেচে আদায় করা যাবে। তাও না হয় করা গেল।
অরুণ  আত্মীয় স্বজন সবাই কে নিয়ে একবার আলোচনা কর। দ্যাখা যাক কে কি বলে।
কে কাকে দেখে। সবাই তো নিজেকে নিয়ে অস্থির। শতচ্ছিদ্র জীবন। বাঁচিয়ে টিঁকিয়ে রাখাই দায়। সে দিনের অভাব আজ আর অনেকের মনে নাই। বাবা কাকা র বয়সী দের থাকলেও
আজকের ছেলে মেয়েরা কেউ জানেই না। শোনেই নি।
বাবা কাকা রা কেউ বলেও নি। বলতে বা ভাবতে চায়না বোধহয়। ভাঙা ক্ষুদ কুঁড়ো  চালের ভাত
আর পুকুর ধারের " পেছে  ভরে  তুলে আনা শাক " এর চচ্চড়ি। সে শুশুনি হোক আর গিমে হোক আর হিঞ্চে হোক।
তাতে কুচি আলু বা সরষে পড়লে তো অনেক টা হল।
ভাদর মাসে তাল মাড়ি তেই জীবন।
অরুণ  অনেক ভাবল। কিন্তু কোন খেই পায়না। তল নাই।
অভাবের অতল কালো জল   সকাল হলে
আবার চল। পরের মাঠে খাটতে। উপায় ই বা কি। ও হচ্ছে বাঁধা মুনিষ। ওর অবশ্য প্রতিদিনের কাজ।
- দাদা। কি হবে
  - আমি ই বা কি বলি। বলি দেখি দাঁড়া আলোচনা করি।
দুর্গাপুরের ডাক্তার বাবু র পরামর্শ মতো ওষুধ ; ইঞ্জেকশন চলে। পেনিসিলিন পেনিডিওর এল এ  ১২ ; ল্যানোক্সিন বা ডিজোক্সিন এই সব আর কিছু ভিটামিন।  কিছুটা হলেও আরাম বোধ করে চিন্তা।
  ঐ ভাবেই চলে। যে ভাবে হোক অরুন মেয়ের চিকিৎসা করায়। কিন্তু এতো এতে  সুস্থ হবার নয়। প্রায়ই কাহিল হয়ে
পড়ে। একটু তেই সর্দি জ্বর কাশি। হাঁপ ধরে। কত আর দুর্গাপুর যাবে। স্থানীয় ওষুধ দোকান থেকে ওষুধ এনে খাওয়ায়।
কোন কোন দিন রাতে সমস্যা খুব বাড়লে আমার কাছে ছুটে
আসে। শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। ঘরে থাকে কিছু ওষুধ। সবাই জানে। কি দেব?  খুঁজে পেতে যদি  অ্যাসথালিন জাতীয় কিছু
পাই । ওর কষ্ট চোখে দেখা যায়না। বুকে বালিশ গুঁজে আধশোয়া হয়ে পড়ে থাকে। মাঝে মাঝে খুব বেড়ে যায়। আবার কখনো কমে আসে। এরই মধ্যে ছোট বোনের বিয়ে টা দেখল। সে এক আশ্চর্য দৃষ্টি নিয়ে। আমি ওর মুখটা দেখছিলাম। দেখছিলাম সেখানে খেলা করছে কত রুদ্ধ
আবেগ।
  মেয়েটা চোখের সামনে শুকিয়ে  শুকিয়ে যায়। নিজে তো  মেয়ে। বড় হয়েছে। 
আমি ওদের বাড়ি গেলে  বড় বড় চোখ দুটি নিয়ে আমার দিকে বোবার মতো তাকিয়ে থাকে। ভাবে হয়তো তার এই
জ্যাঠা টা কিছু করলে করতে পারে। আমি নিশ্চুপ হয়ে থাকি।
  কেমন রয়েছিস জিজ্ঞেস করলে ঘাড় নাড়ে।
  হ্যাঁ কি না কিছুই যায়না বোঝা।
  আমি আর তাকে কি করে বলি যে আমার একার সাধ্য কি রে
বড়ো অসহায় লাগে নিজেকে। কোন ব্যবস্থা ই করে তুলতে পারিনি। পারা সম্ভব ছিলনা।
এমন জায়গায় আমরা থাকি। আর তখনকার দিনে অন্ধকার   এক গাঁয়ে। কে কার পাশে দাঁড়ায়! সব ফুটোফাটা।
মেয়েটার মুখটা খুব মনে পড়ে। মনে হয় বড় বড় চোখ দুটি নিয়ে  অব্যক্ত ভাষায় আমাকে যেন বলছে
আমাকে জ্যাঠা না বলে বড়বাবা বলত।
" বড়বাবা      আমি বাঁচতে চাই।
  মনে পড়ে। মনে পড়লে মনে মনে ই বলি ' না রে তোর জন্য কিছু করতে পারিনি  মা '
------------ ------------ ------------ ------------ ------------© প্রণব ভট্টাচার্য।




 

No comments:

Post a Comment