।। মানাই মিঞার মাঠ আর মাঠনাম নিয়ে কিছু কথা।।
ধান পাকল না কি! কত দেরি আর -
দুবেলা টুকটুক করে হাতে ছড়ির মতো একটা ছোট লাঠি নিয়ে
মাঠ দেখতে যাওয়া চাই। মানাই মিঞা র।
গাঁয়ের সৈয়দ বংশীয় মানুষ। সৈয়দ মান্নান হোসেন।
আছে বাকি আর বিঘে চার। নীলবাড়ির মাঠ। অজয়ের পলিতে জমি খুব উর্বর। সার দিতে প্রায় হয়না। একদিন এই মাঠে নীল চাষ হত। নাম তাই নীল বাড়ির মাঠ। আর কলা বাগানের ঘাট। একেবারে দক্ষিণ থেকে রাস্তা চলে এসেছে গাঁয়ের মাঝ দিয়ে ঘাট পর্যন্ত। তাঁতি পাড়া ; কুমোর পাড়া ;মালাকার দের ঘরের পাশ দিয়ে ; কামার পাড়ার গা ঘেঁসে। কালীতলাকে পাশে রেখে। নীল ভেজানোর চৌবাচ্চা ছিল একটু দূরেই। হয়তো গোলাম পাঞ্জাতন ই এই নীল চাষ
তদারকি করতেন। এই রাস্তার পশ্চিমে থাকল অধিকারী বামুনদের বিষ্ণু দালান। আর এক পুকুর। নামটি তার "প্রেমসায়র "। না জানি কোন প্রেম কাহিনী ভেসে আছে তার কালো জলে।
চন্দ দের মাঠ । নাম তাই " চন্দের মাঠ "। এই চন্দরা যে বেণে
তাতে কোন ভুল নাই। কি ব্যবসা করতেন তাঁরা। এই গাঁয়ের ই
মানুষ। নদী ভেঙে বানের জলের তোড়ে মাঠ গেল ভেসে। সে কতদিন আগে কেউ বলার নাই। মাঠের নাম "নদীপাথর "
মোষ ও ডুবে যায় এমন নরম কাদা মাটি। মাঠের নাম " মোষডোবা "। আবার মেঘের জল গড়িয়ে যায় দক্ষিণ থেকে
উত্তর হয়ে " রূপাই দহের " দিকে। মাঠ নামটি খুব সুন্দর
" মেঘনালা "। সে যে কোন রসিক প্রবর - কে জানে!
একদিন তার ই ছিল। মাঠের নাম "রসিক চক "। " শালতলার মাঠ " বললে বোঝাই যায় যে দুটো শাল গাছ ছিল মাঠের আলে। আর " বারি মোল্লা "। সে কোন বারি সাহেব। তিনি আবার মোল্লা। এখানে কি কোন মোল্লা ছিলেন! কে জানে!
একেবারে " কোঁদা য়। মানে একধারে। এককোনে। কোঁদার মাঠ "। তার উপরে এক মিঞার মাঠ। নাম তার নাসু। তার চাতাল। ডাঙা জমি। জমির পাড়ে তালগাছে র সারি। দক্ষিণে ; পুবে।
নাম তাই " নাসু মিঞা র চাতাল "।
কিছু মাঠ পশ্চিমে আর কিছু মাঠ পূর্বে। মাঝে জঙ্গল থেকে
গড়িয়ে আসা লাল জল বয়ে প্রাকৃতিক নালা দিয়ে। গাঁয়ের মানুষ বলে " গই "। এই গই বয়ে চলে গেছে সেই পূবে রূপাই দহের দিকে। পলাশ বনের ভিতর দিয়ে। এই গই এর উত্তরে
আরও কিছু জমি। মানা ধরনের। বালি মাটির মাঠ।
আর কত জমি যে অজয় খেয়েছে এই গাঁয়ের তার কোন
ঠিক হদিস নাই। অজয়ের জল জমে থাকে। তাই তার স্বাভাবিক নাম " জোল গাবা "। গাবা মানে নীচু খাল মতো জায়গা। নদীর বালি পড়ে " রাঙরে " নাম। ভিতর থেকে লাল
জল আর তেলতেলে সর ওঠে। ভালো ধান হয়না।
গাঁয়ের পশ্চিম দিকে মাঠ। আলাদা নাম নাই। " পছি মাঠ "
আবার দুফসলী জমি ; সব্জি চাষ ; আখ চাষ হয়। এর নাম
" তপল "। এই তপল মাঠের উত্তরে নালা। সেই গড়জঙ্গল থেকে " রক্তনালা " বেয়ে " গড়ঘাটা " হয়ে "পাষাণ চণ্ডী " বাগানের ভিতর দিয়ে বয়ে এসে এই নালা দিয়ে জল মিশে যাচ্ছে অজয়ে।
ম্যাপে তো দাগ নম্বর থাকে। কিন্তু মাঠ নাম তো আর থাকেনা।
পুকুরের নাম ও না। কিন্তু যখন ম্যাপ ছিলনা। ছিল " চৌহদ্দি "
লাঠি বা নল দিয়ে একটা চতুঃসীমা নির্ধারণ। প্রাকৃতিক উপাদান গুলিকেই ব্যবহার করা হত। বিশেষ বৃক্ষ ; জলাশয় ; পাহাড় ;পর্বত ; টিলা
নালা ; নদী ইত্যাদি দিয়েই সীমা নির্ধারণ করতে হবে। কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্রে " জনপদ নিবেশ " অধ্যায়ে সুস্পষ্ট নির্দেশ দিয়ে গেছেন।
এখন ও কিছু আছে।কিন্তু বিশেষ বৃক্ষ গুলি যদি চলে যায়। টিলা টি হারিয়ে যায়। জলা টি বুজে যায়। পুকুর ; নালা তো সব মজে এলো।
বোঝা যায় কোন এক সময় ভেলা গাছ ছিল। তাই নাম
" ভেলা ঘাটের দ " মানে অজয়ের এক দহ। পুকুরের পাড়ে
ছিল " ধব " " গাব " গাছ। মাঠের নাম ছিল " গাব তলার মাঠ "
কি " ধব গোড়ে "। মানে ছোট পুকুর। সে সব গাছ গুলিকে রাখিনি। এই " গাব " এর ফলের রস দিয়ে ক্যাওট রা জাল
" গাবাতো "। দারুণ কষ।
ধব ; গাব ; ভেলা ; রিঠা ; বাঘলাল ; এসব আর দেখা যাবেনা।
মাঠ নাম থেকে সরে এসে আরও কিছু কথা বলতে হল।
মানাই মিঞা কে মনে পড়ে খুব। দু'বেলা তাঁর মাঠ দেখতে যাওয়া চাই। কতটুকু আর জমি। তারই মায়া। কোনদিন বাঁধের উপর থেকেই দ্যাখে। কখনও বা মাঠে নেমে ধান গাছে হাত বুলায়।
আর ঐ টুকু জমির উপরে নির্ভর করে বেঁচে থাকা।
স্ত্রী ছেলে মেয়ে নিয়ে কি করে যে সংসার চলে তার খবর আর কে রাখে। বড়ো কষ্ট। বড়ো অভাব। কার ও কাছে হাত পাততেও সঙ্কোচ। লজ্জা। তাও ঘরের সামনের জায়গা টুকু
দিতেই হল বেচে। স্ত্রী র চিকিৎসা হচ্ছেনা। এই টাকাতে যতটুকু হয়। জমিতে হাত পড়বে না কি সেই চিন্তা তেই অস্থির।
ছেলে মেয়ে দের ছোট রেখেই একদিন স্ত্রী চলে গেল।
ঐ মাঠ টুকুর দিকে তাকিয়ে সব কিছু ভোলার চেষ্টা করত।
বিষাদময় গাম্ভীর্য ভরা মুখ। মাটির দিকে তাকিয়ে ;
সম্ভ্রান্ত পদক্ষেপে বড় ক্লান্ত সে পথ চলা। হায়রে জীবন।
" তাল দিঘি তে আজ আর ঘটি ও ডোবেনা। নাম তবু যে তার তালদিঘি "। দিঘি ছিল একদিন।
------------ ------------ ------------ ------------ -----© প্রণব ভট্টাচার্য
।আমার লেখার পাঠক রাই আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নেন। তাঁদের সকলকে আমার আন্তরিক ধন্যবাদ।
No comments:
Post a Comment