।। কথা - সাতকাহন।।
বিধাতা পুরুষ।
কেমন সে বিধাতা পুরুষ!
তাকে দেখতে হবে। আজ ষষ্ঠী। রাতের কোন প্রহরে এসে
তার ছেলের কপালে তিনি কি লেখেন তাকে জানতে হবে।
এ মা একটু ছোট থেকেই ডাকাবুকো। ভয় ডর নাই বললেই
হয়। ছেলেদের মতো গাছে চাপা। সাঁতার কাটা। সমুদ্রের ঢেউ নেওয়া। সবেতেই দামাল। স্বাস্থ্য ও ভালো।
আর বুদ্ধি। প্রখর। অঙ্ক কে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়। তখনকার দিনে অঙ্ক। মানে পাটীগণিত। চতুর্থ শ্রেণী তেই শতকরা ; সুদকষা ; ভগ্নাংশ। সিঁড়ি ভাঙ্গা সরল। সরল কর। সে বলত
' সরল কিন্তু সরল নয়কো মোটেই '। যদিও সে সরল করত
সে যেমনই গরল হোক না কেন।
এই যে মেয়ে মা হয়েছে বেশ কিছুটা সময় পরে।
সংসারে উদাসীন স্বামী। শ্বশুর বাড়ির পরিবেশ ও তার মনোমত হয়নি। তবু যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে মানিয়ে নিতে।
বাচ্চা হবার জন্য বাপের বাড়ি তে আসা। তখন তো বাড়িতেই
প্রসব। ধাইমা দের হাতে।
ঘরের মেঝেতে মাদুর পেতে শোয়া। পুব দিকে মাথা। মাথার কাছে জ্বলছে প্রদীপ দানিতে প্রদীপ। পাশে তার বাচ্চা। অতি ছোট খাটো একটা পুঁটলি যেন।
মা রাত জাগছে। এখন কত রাত কে জানে। ঘরের বাইরে বারান্দায় শুয়ে আছে সেই মায়ের মা।
ভোর রাতের দিকে সে যে কি দেখেছিল সে ই জানে। মুখ দিয়ে
একটা ভয়ার্ত আওয়াজ বের হয়েছিল। তারপর অজ্ঞান হয়ে
গিয়েছিল। তার পরদিন আর কারও সাথে কোন কথা বলেনি। নিজের মধ্যেই আত্মস্থ হয়ে ছিল।
তার একদিন পরে থেকে শুরু হল জ্বর আসা।
তখন এই এলাকায় ভূতনাথ দালাল। তিনি ই চিকিৎসা করেন।
জ্বর কমে। বাড়ে। দুপুরের পর জ্বর আসে।
অগত্যা ইলামবাজার এর কালীবাবু। তিনি এল ; এম ; এফ পাশ করা ডাক্তার। তাঁর চিকিৎসায় জ্বর ভালো হল কিন্তু শরীর খুবই দূর্বল।
সেই দূর্বলতা সহজে কাটলনা।
কয়েকমাস পরে ছেলেকে কোলে নিয়ে যেতে হল নিজের স্বামীর ঘরে।
নিজের মেজো বোন তখন একটু বড় হয়েছে। ছেলেকে আগলাতে পারবে। এই ভাবনায় নিজের বোনকে নিয়ে গেল সাথে করে।
শিশুর যত্ন তাও ঠিক মতো হয়না। কেউ মুখ বাঁকিয়ে বলে
" বার্লি তেই হবে দুধ চাইনা "।
কিন্তু রোগ জ্বালা হলে ওষুধ তো চাই। গ্রামে পুইতণ্ডী ডাক্তার আছেন। যাই হোক মিকশ্চার দেন।
রান্না বান্না করার মতো শারীরিক ক্ষমতা নাই।
মেজবোন যেমন পারে তেমন করে।
তা আবার জামাইবাবুর পছন্দ হয়না। কড়া কথায় কান্না আসে
মেজ বোনের চোখে।
সংসার ; স্ত্রী পুত্র দের বা শ্যালিকার প্রতি মন দেবার মন নাই। মন যে তার কোথায় কোনখানে তার হদিস হয়তো সে জানে কিম্বা হয়তো জানেনা।
দাদা মানুষ টি র মমত্ব আছে। ভাই কে বকাবকি করেন।
সংসারে মন দিতে বলেন। পূজা পাঠের পরেও সংসারে মন দেবার সময় অনেক আছে।
ভাসুরের ছেলে কেষ্ট মেজবো নের বয়সী।
সে তার সাধ্যমতো সাহায্য করে।
বড়জা সুন্দরী। তার গর্ব আছে। স্বামী কুলটি কারখানায় কাজ করে। তার মাসমাহিনা আছে। পরিবারে কর্তৃত্ব প্রবল।
আর এই বাবু রাগারাগি করে কোলিয়ারীর চাকরি ছেড়েছেন।
ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের ছেলে। পূজা পাঠ নিয়েই থাকবেন।
তাতে কি আর আয় তখন! ভালো কিছু শিষ্যবাড়িতে খাতির ছিল খুব। সেখানেই কেটে যেত বেশ কয়েকদিন।
এদিকে তার স্ত্রী র ; সেই মায়ের আবার জ্বর আসছে।
প্রায় প্রত্যেকদিনই কাঁথা চাপা দিয়ে পড়ে থাকা।
আর যন্ত্রণা বাড়ে এগারো বারো বছরের বোনের। এত কাজ সে পারে। চোখে জল আসে। দিদি বলে 'কি করবি বল '
একটু কষ্ট কর। বাবাকে চিঠি লেখ। আমাকে এখান থেকে
নিয়ে যাক "। হয়তো কোন এক চিঠি পৌঁছেছিল।
দিদির অযত্ন ; জামাইবাবুর ব্যবহার প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ করেছিল
সেই মা য়ের ভাইকে। সে ভাই সেখানে গিয়ে রাগের মাথায়
গোটা পরিবার কে ' যা কথা শোনানোর শুনিয়ে ' রাগে গজগজ করতে করতে ; পাড়ার লোকদিকে ডেকে জানিয়ে
বোন ; দিদি আর তার পুঁচকে বাচ্চাটা আর বাক্স প্যাঁটরা নিয়ে চলে এলো বাপের বাড়ি তে।
সেই মা কি জানত এই তার শেষ যাওয়া!
সে কি জ্বরগ্রস্ত শরীরে পিছন ফিরে তাকিয়েছিল!
তার স্বামী কি তাকে স্কুল মোড়ের যেখান থেকে একটি বাস ছেড়ে যায় সেই জায়গা পর্যন্ত এসেছিল!
তাদের বিদায় জানাতে!
কে জানে!
------------ ------------ ------------ ------------ ------------ এই পর্ব শেষ।
No comments:
Post a Comment