ইলামবাজার। গালা শিল্প । অজিত গুঁই এবং তাঁর ছাত্র ইউসুফ ভাই ও অন্যান্য কথা।
- --------৷ যাঁরা আমার ২৭/১১/২১ তারিখের সিউড়ি কর্মশালার কথা পড়েছেন। তাঁদের জন্য এবং নূতন দের জন্য। একটু ছড়িয়ে বললাম।
দেখুন ভালো লাগে কিনা!
জয়দেব - কেন্দুলী ভক্তিভবন এর বন্ধু দের উদ্দেশ্যে এই পর্বটি নিবেদন করলাম। -----------------------------------------------------------------------
আমাদের এক পা এপারে আর এক পা ওপারে।
মাঝে বয়ে যায় অজয়।
দু বেলা পারাপার।
যখন অজয় সেতু ছিলনা ; তখন ছিল অস্থায়ী পারাপারের ব্যবস্থা। কিছুটা কাঠ বাঁশের সাঁকো। কিছুটা নৌকো। বাগুড়া
গ্রামের ভিতর দিয়ে মোরাম রাস্তা। নদী চর এর উপর দিয়ে
একেবারে সাঁকো পর্যন্ত।
তারপর অজয় সেতু র উদ্বোধন হল ১৯৬২ সালে। মুখ্যমন্ত্রী
ডাঃ বিধান চন্দ্র রায় উদ্বোধন করলেন। বহু মানুষ দেখতে গিয়েছিলেন। সবার ই খুব আনন্দ। এপার আর ওপারের যে নিবিড় সম্পর্ক। বর্ষা য় পারাপার বন্ধ হয়ে গেলে বড় কষ্ট মনে।
মাতামা ; দিদিমা র কোলে চেপে বা গোরুর গাড়ি তে সেই কবেকার ছোট বেলা থেকে ইলামবাজার যাওয়া।
দল বেঁধে হেঁটে যাওয়াই ছিল বুঝি আনন্দ।
সিনেমা দেখতে যাওয়ার আনন্দে পথ হাঁটার কষ্ট হারিয়ে যেত।
প্রথম সিনেমা হল চালু হয়েছে ইলামবাজারে।
বলছি যখন বলেই নি - আমার স্মৃতি তে আছে একটা ঘটনা।
সিনেমার নাম ' মরুতীর্থ হিংলাজ '।
রাতের অন্ধকারে পথ হাঁটছে তীর্থযাত্রীর দল। মরুভূমি র উপর দিয়ে। স্ক্রিনে সেই অন্ধকার যাত্রা।
হলের দর্শক দের চিৎকার ' আলো কই। আলো দাও হে '।
হট্টগোল। তারপর বোধ হয় মাইকে বলা হল 'রাতের দৃশ্য '।
এমন ই হবে। '
কিছু দর্শক বোধহয় বেরিয়ে গেল।
আমাদের বাড়িতে দাদু দিদিমার ততদিনে অবধূতের সেই বিখ্যাত বই পড়া হয়ে গেছে। সে ও কিছুটা শুনেছে।
অ্যাটলাস এর ম্যাপ বই নিয়ে বসে যায় কোথায় হিংলাজ খুঁজতে। এটা তার খুব প্রিয় ছিল। খোঁজা। কত সাল কি জানি সে আর তার মনে নাই। তবে চণ্ডীচরণ চট্টোপাধ্যায় কোম্পানির সে ম্যাপ বই এখনও আছে। আহা কি সুন্দর ছিল
সে ম্যাপ বই।
যাই হোক অযোধ্যা জুনিয়র হাই স্কুল থেকে ক্লাস এইট পাশ করে ইলামবাজারে গেল ক্লাস নাইন থেকে পড়তে। সে তো আরেক কাহিনী। সাইকেল চাই। নাই। দাদু চিঠি লিখল বাবাকে। বাবা একমাস পরে একটা সেকেন্ড হ্যাণ্ড সাইকেল ;
কিন্তু ভালো কন্ডিশনের এনে দিয়ে গেল। সেন র্যালে কারখানার পাশ দিয়ে এলেও সে সাইকেল ছিল হারকিউলিস।
একটু উঁচু। সে সব কথা ' কথা - সাতকাহন ' এ কোন এক পর্বে লিখেছে সে।
এই এলাকা থেকে যেত তারা পাঁচ জন।
অজয়ের নদী বাঁধ ধরে। সে বাঁক গুনতে গুনতে যেত আর বাঁধের গায়ে গায়ে প্রাচীন শিমুল গাছ গুলিকে গুনতে গুনতে।
শতাব্দী প্রাচীন সে সব গাছ। বিপুল তাদের গুঁড়ির বিস্তার ; খাঁজ।
ইলামবাজার হাই স্কুলের দোতালায় একেবারে পূব দিকের ঘরে ক্লাস নাইন। সে ছিল বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র। কিন্তু বাংলা ; ইংরেজি একসাথে। স্কুলের পিছনে গেরুয়া রঙের জলের পুকুর । তার নাম ' লরি পুকুর '। তার উত্তরে প্রাইমারি স্কুলের পিছনের পুকুর টির ও নাম ' লরি পুকুর '।পরে জেনেছে আরও আছে। মনে প্রশ্ন ' লরি পুকুর '। এমন নাম কেন? বাস লরি জানে। তার সাথে কি সম্পর্ক! কারও কাছ থেকে তো জানতে হবে। আরও বেশ কিছু দিন পরে মাষ্টার মশাই কিরীটী বাবুর কাছ থেকে জেনেছে ' লরি ' রা ছিল গালার কারবারি। গালার
জিনিস তৈরী র কারিগর। তারা কারা? ' লরি ' বা ' নুড়ি ' কারা। কেউ কিছু ই বলে না। কেমন যেন লুকোছাপা ভাব।
অনেক পরে জেনেছে ' গুঁই ' রা ' দাস ' রা 'পাল ' রা এরা সব
'লরি '। এখন আর এরা কেউ' লরি ' বলে পরিচয় ও দেয়না।অথচ পাড়াটার পুরনো নাম ই লরি পাড়া। আর ' লরি ' দের নামে কয়েকটা ই পুকুর।
আর পদবী বা পেশা সব বদলে নিয়েছে। এখানেও সেই জাতের প্রশ্ন। নীচু জাত। উঁচু জাত।জল চল অচল। অথচ তার বেশ কয়েকজন বন্ধু রয়েছে সেই পাড়ার। তাদের বাড়ি তে ও গেছে। কে আর সে পরিচয় দেয়। কেন ই বা দেবে। সদ্য যুবক প্রয়াত রাধাশ্যাম গুঁই
অঙ্কের শিক্ষক হিসাবে যোগ দিয়েছেন হাই স্কুলে।
অত্যন্ত ভালো মানুষ। শেষ জীবনে উদাসী বৈষ্ণবের মতো জীবন কাটিয়েছেন।
এই গুঁই পরিবারের বিখ্যাত গালা শিল্পী গোপাল ও নেপাল গুঁই কে রবীন্দ্রনাথ নিয়ে গিয়েছিলেন শ্রীনিকেতন শিল্প সদনে গালা শিল্পের প্রশিক্ষক হিসাবে। তাঁদের ই উত্তর পুরুষ অজিত গুঁই।
তিনিও কিছুদিন প্রশিক্ষণ দান করেছিলেন। তাঁর ই প্রত্যক্ষ ছাত্র শ্রীনিকেতন সুরুলের মসজিদ পাড়ার শেখ ইউসুফ ভাই।
তাঁরা স্বামী স্ত্রী গালা শিল্পের গুণী শিল্পী। চমৎকার তাঁদের হাতের কাজ। বীরভূম আর্টিসানি নামক সংস্থা একদিনের প্রশিক্ষণ শিবিরের আয়োজন করেছিলেন। হাতে কলমে কাজ
শেখার জন্য। বেশ কয়েকজন শিল্পশিক্ষার্থী যোগ দিয়েছিলেন। সংস্থা র পক্ষে অভিষেক সেনগুপ্ত আমাকে বিশেষ ভাবে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়ে ছিলেন। বিশেষ আমন্ত্রিত ছিলেন ' রাঢ় ভাবনা ' পত্রিকার সম্পাদক মাষ্টার মশাই সৌরেন্দ্র নাথ চট্টোপাধ্যায়। শিল্পী বিধান বিশ্বাস ছিলেন অন্যতম উদ্যোক্তা।
ইউসুফ ভাই এর কাজ দেখলাম সারা দিন বসে। এই প্রথম
হাতে কলমে কাজ দেখা। তিনি যখন তাঁর মাষ্টার মশাই অজিত গুঁই এর কথা বলছিলেন - কৃতজ্ঞতা ফুটে উঠছিল
তাঁর চোখ মুখে। আর আমি ভাবছিলাম - না ; মরেনি। ইলামবাজার এর গালা শিল্পী রা বেঁচে আছেন ইউসুফ ভাই এর মধ্যে। কিন্তু এই কাজ করে সংসার চলেনা তাঁর। তাঁকে টোটো ও চালাতে হয়। হায় রে। আমরা কি পারিনা সম্মিলিত উদ্যোগে
এই গালা শিল্প কে বাঁচাতে। পারিনা ইলামবাজারের ' চৌপাহারী' জঙ্গল ভূমির মধ্যে বাস করা আদিবাসী পল্লী গুলির ' স্বয়ম্ভর গোষ্ঠী ' গুলির মহিলা দের মাধ্যমে লাক্ষা কীটের চাষের দ্বারা গালা র উৎপাদন করতে বা জেলা শিল্পদপ্তরের মাধ্যমে তা বাজার জাত করতে।
ভেবেছি অনুরোধ জানাব ইলামবাজার ব্লক প্রশাসন কে ভেবে দেখার জন্য। আমার ধারণা প্রশাসন সচেষ্ট হলে এই প্রয়াস সার্থক রূপ পাবে।
-------------------------------------------------------- © প্রণব ভট্টাচার্য
জীবন ই শ্রেষ্ঠ শিক্ষক। জীবনই শিক্ষা অঙ্গন ।
আজীবন ই আমি ছাত্র। মানুষের মাঝেই ছড়িয়ে আছে জীবনের প্রকৃত শিক্ষা। সকল শিক্ষক কে আমার প্রণতি। সকল শিক্ষার্থী কে আমার ভালোবাসা।
------------ ------------ ------------ ------------ ------------
আমি কি আমার এই লেখার মাধ্যমে ইলামবাজার পঞ্চায়েত সমিতির মাননীয় সভাপতি এবং মাননীয়
বি ডি ও সাহেবের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারি।
এ আমার অনুরোধ।
আমার ইলামবাজারের বন্ধুদের প্রতি অনুরোধ এই লেখাটি আমার 'আঞ্চলিক ইতিহাসের সামান্য এক চর্চাকারী' হিসাবে র পরিচয়ে তাঁদের কাছে পৌঁছে দিন।
No comments:
Post a Comment