Tuesday, 9 July 2024

পরগণা সেনপাহাড়ী। সেনভূম। জঙ্গল মহলের ইতিহাস। ঐতিহ্য মণ্ডিত পুরাকীর্তি



।।  পরগণা সেনপাহাড়ী। সেনভূম । । জঙ্গলমহলের ইতিহাস।।   ঐতিহ্য মণ্ডিত পুরাকীর্তি।।   প্রণব ভট্টাচার্য
------------ ------------ ------------ ------------ ----------------------

ঃ  গড়জঙ্গল ; ইছাই ঘোষের দেউল ; বনকাটির পিতলের রথ,  টেরাকোটা শোভিত মন্দির,  অযোধ্যার মন্দির
কালিকাপুর মৌখিরা। জয়দেব কেন্দুলী,  ঘুড়িষা ; ইলামবাজার।
------------ ------------ ------------ ------------ ------------ ------------
জঙ্গল মহল। অবিভক্ত বর্ধমান জেলার আউসগ্রাম থানা এবং কাঁকসা থানা  ও দুর্গাপুর ফরিদপুর থানার জঙ্গল ভূমিই  এই জেলার জঙ্গল মহল।
মাত্র দুশো বছর আগে গুসকরা থেকে বরাকর পর্যন্ত এই জঙ্গল ভূমি বিস্তৃত ছিল। দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চল গড়ার প্রয়োজনে এই জঙ্গলের সর্বাপেক্ষা সমৃদ্ধ অংশ ই বিনষ্ট হয়। সেই সব
" মহাবৃক্ষ " রূপ শালতরু আজ আর প্রায় দেখাই যায়না। প্রাচীণ গ্রন্থাদিতে শাল কে মহীরুহ বলা হয়েছে। ল্যাটেরাইট মাটির উপর এই জঙ্গল একদিন এতই ঘণ ছিল যে কোন কোন স্থানে দিনের আলো প্রবেশ করত না। হাণ্টার সাহেবের এনালস অফ রুরাল বেঙ্গল এ এই জঙ্গল ভূমির
উল্লেখ আছে। ছিয়াত্তর এর মন্বন্তর এর পর উজাড় হয়ে যাওয়া গ্রাম গঞ্জ গভীর জঙ্গলে ঢেকে যায়। নির্ভয়ে সেই জঙ্গলে বিচরণ করে
হিংস্র শ্বাপদের দল। বন্য হস্তীর দল ছারখার করে দেয় কত গ্রাম। পথ ঢেকে যায় জঙ্গলে।
পথহীন সেই দেশে একদল সৈন্য কোন ভাবে
একশো কুড়ি মাইল দীর্ঘ সেই বনভূমি পার হয়ে বীরভূম পৌঁছায়। কোথাও তাঁবু ফেলার মতো
জনপদ নাই। যদিবা ছোট্ট কোন গ্রাম কোন মতে ঐ জঙ্গলের মধ্যে টিঁকে আছে তো সেখানে সৈন্য দলের তাঁবু পাতার মতো স্থান নাই। বীরভূম তখন এক " জনমানবহীন বন্ধ্যা দেশ "। অনাবিষ্কৃত। মন্বন্তর এ  বীরভূমের ছয় হাজার গ্রামের মধ্যে প্রায় দেড় হাজার নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। কৃষি জমি ঢেকে গেছে আগাছায়। ঝোপে জঙ্গলে। চাষ করার মানুষ ই নাই। কে চাষ করবে। যে চাল ছিল এক টাকায় এক মন বা দেড় মন সেই চাল এখন তিন টাকা সের। কে কিনবে! না খেতে পেয়ে মারা গিয়েছিল প্রায় আশি লক্ষ মানুষ। একে গণহত্যাই বলা উচিৎ।
মজুতদার রা মজুত করেছে। যা তাদের কাজ। আর ইংরেজ রা বাজার থেকে সমস্ত চাল সৈনিক দের জন্য কিনে নিয়েছে।
সাধারণ মানুষ বাঁচল কি মরল তাতে তাদের কোন মাথাব্যথা নাই। তাদের চাই কর। টাকা। আর লোভী ইউরোপীয় বণিক রা
সারা বাঙ্গলা য় ছুটে বেড়াচ্ছে কোথায় কোন ব্যবসা ভালো হতে পারে! কোথায় কাঁচা মাল সহজলভ্য? 
জনশূন্য জনবসতি সব। ডি পপুলেশন এর সমস্যা।
নেমে এসেছে জঙ্গলের রাজত্ব। নিরন্ন মানুষ পথের ধারে মরে পড়ে আছে আর এ দেশীয়  কর আদায়কারী রা আরও আদায়ের জন্য চেষ্টার কসুর করছেনা। অবাক হতে হয় আদায় ও অনেক টা বেড়েছিল। ঘরে মজুত থাকে যে খাবার ধান সেটুকু তাদের হাতে তুলে দিয়ে নিজেরা না খেয়ে মরতে বাধ্য হয়েছে।
ইংরেজ ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি র সেই প্রথম যুগে বন্য হস্তী বা শার্দূল দের অত্যাচারে
বিপর্যস্ত এক পরিস্থিতি। তাদের তাড়াবার জন্য বা মেরে ফেলার জন্য পাহাড়িয়া আদিবাসী দের
ডাক পড়ছে। পুরস্কারের ব্যবস্থা হয়েছে। মাথায় রাখতে হবে তখন পশ্চিমের সীমান্তবর্তী এই এলাকা - বীরভূম থেকে বিষ্ণুপুর পর্যন্ত এবং পশ্চিমে বৈদ্যনাথ ধাম পর্যন্ত সমগ্র এলাকাই  বীরভূম। বীরভূম নামে আলাদা জেলা গঠিত হয়েছে। সদর শহর বিষ্ণুপুর থেকে সিউড়ি তে আনা হয়েছে। প্রাথমিক অবস্থায় সিউড়িতে কোন ও পাকা বাড়ি মেলেনি জেলা কালেক্টর এর অফিস বানানোর জন্য।
ব্যবসা করতে এসে হঠাৎ বাঙ্গলার রাজা হয়ে বসেছে ইংরেজ। পলাশীর প্রহসনের যুদ্ধে নবাব
সিরাজের পরাজয় ঘটেছে। লুণ্ঠনকারী রা মিলে নবাব এর কোষাগার থেকে লুঠ করেছে কমপক্ষে আশী  লক্ষ টাকা।  এত বড় দেশ টাকে নিয়ে যে কিভাবে শাসন কার্য্য চালানো যায় তা
ইংরেজ প্রশাসনের মাথাব্যথা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
স্থানীয় শাসক দের ই রাখা হয়েছে ক্ষমতায়। রাজ কর্মচারীরাও
আছে। সিতাব রায় বা রেজা খাঁয়ের মতো আদায়কারী রা আছে। আজ উপঢৌকন দিয়ে মীরজাফর নবাব তো আরও বেশী উপঢৌকন দিয়ে মীরকাশিম।  সে ক্ষমতা নামে মাত্র। কর আদায়ের দায়িত্ব পেয়েছে অর্থাৎ দেওয়ানী লাভ করেছে ইংরেজ রা।১৭৬৫ সালে।  শুরু হয়েছে " দ্বৈত শাসন " ব্যবস্থা।
১৭ ৭৮ সাল নাগাদ কোম্পানি নিজ হাতে শাসন ব্যবস্থা তুলে নিয়েছে। তারপর নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা। সে এক বিস্তৃত ইতিহাস।
১৭৭০ সালের সেই মহা মন্বন্তর এর আগে মারাঠা বর্গী দের আক্রমণ এই বাংলায় নেমে এসেছে এক মহা বিপর্যয় হিসাবে। গ্রামের পর গ্রাম তারা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছে। ভাস্কর পণ্ডিত এর নেতৃত্বে কুড়ি হাজার
অশ্বারোহী সৈন্যের অমানুষিক অত্যাচার নেমে এসেছে বাঙ্গলায়। মহিলা দের উপরে ঘটেছে বর্বরোচিত অত্যাচার। মুখে তাদের ভীষণ চিৎকার " টাকা দাও, সোনা দাও ".। বাঙ্গলার নবাবের কাছ থেকে চৌথ আদায় তাদের লক্ষ্য।
নবাব আলীবর্দি তাদের  অতর্কিত আক্রমণ প্রতিরোধে ব্যর্থ প্রায়। সম্মুখ সমরে তারা আসেনা। শেষ পর্যন্ত ছলনার আশ্রয় নিয়েই
" সন্ধি চুক্তি র নামে " শিবিরে ডেকে ভাস্কর পণ্ডিত কে এবং তাঁর সঙ্গী দের হত্যা করা হয়েছে। এখানেই শেষ নয়। শেষ পর্যন্ত পাঁচ বারের যুদ্ধের পর বছরে বারো লক্ষ টাকার চৌথ প্রদানের চুক্তি হয়েছে মারাঠা দের সাথে।
বর্গীর আক্রমণে কত যে মানুষ ভিটেমাটি ছেড়ে যে যেদিকে পেরেছে পালিয়েছে। গঙ্গার ওপারে
অনেক ব্রাহ্মণ পণ্ডিত, সহ সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরা পালিয়ে বেঁচেছেন। কত মানুষ যে ভিটেমাটি ছেড়ে অন্যত্র পালিয়েছেন তার কোন হিসাব নাই। লক্ষ লক্ষ মানুষ নিহত হয়েছেন। বড় দুর্ভাগা এই বাঙ্গলা। বারবার নানা বিধ আক্রমনে তার প্রাণশক্তি ক্ষয়ে গেছে। লুণ্ঠিত হয়েছে তার ঐশ্বর্য। সে এক মর্মন্তুদ ইতিহাস।
চিরদিনের জন্যই এই পশ্চিম প্রান্তের মালভূমি,
বনাঞ্চল দিয়েই সব বহিঃশক্তির আক্রমণ ধেয়ে এসেছে বাঙ্গলার দিকে। পাহাড় ; জঙ্গল ডিঙিয়ে ওরা এসেছে। ঝাড়খণ্ড এর জঙ্গল ভূমি ; যার উল্লেখ আছে ভবিষ্য পুরাণে। " ঝাড়িখণ্ড জাঙ্গল ভূমি " নামেই। পশ্চিমের সীমান্ত পাহারা দেয় কয়েকটি রাজ্য। রাজনগর,  বিষ্ণুপুর,  পঞ্চকোট। কিন্তু সামরিক শক্তি তে বহিঃশত্রু প্রবল। শক্তি, সাহস, সামর্থ্য, যুদ্ধ কৌশলে তারা প্রভূত বলশালী।
ছিয়াত্তর এর মন্বন্তর এর পর ১৭৮৬ নাগাদ বীরভূম হয়ে দাঁড়িয়েছে  " ডাকাতদলের স্থায়ী আস্তানা "। পশ্চিম এর পাহাড়
জঙ্গল থেকে নেমে এসেছে পাহাড়িয়া দের দল। তাদের সাথে যোগ দিয়েছে উচ্চ এবং নিম্ন বর্গের অনেক মানুষ। এক এক দলে হাজারের বেশী লোক। তাদের লক্ষ্য আড়তদার ; অত্যাচারী জমিদার,  কোম্পানির রাজস্ব ; কুঠিবাড়ি ইত্যাদি।
দিনে দুপুরে ইলামবাজার লুঠ হল ১৭৮৯ সালে। নদী পার হয়ে
অযোধ্যা বনকাটি র জমিদার চট্টোপাধ্যায় বাড়িতে।
জয়দেব কেন্দুলী র ভরতচাঁদ ব্রজবাসী র মোহান্ত অস্থল এ
১৭৯০ এ ডাকাত দলের হাতে রাজনগর অবরুদ্ধ, লুণ্ঠিত।
  এই ডাকাত দলে র নেতৃত্বে আছে জীবন ( জ্যাবনা) ডাকাত
তার ভাই বিশু ; ভবাণী সিং ; অজিত লাল ; গৌর হাঁড়ি, ভুবন হাঁড়ি সহ অনেক রজপুত ক্ষেত্রী, কায়স্থ ;  ব্রাহ্মনের দল।
জীবন গ্রেপ্তার হবার পর তার ভাই বিশু ই ডাকাত দলের হাল ধরে।
" দুর্ভিক্ষ পীড়িত ; নিঃস্ব, রিক্ত মানুষের হাহাকারে ভরে আছে
বাংলার সেই ক্রান্তিকাল। " - বঙ্কিমচন্দ্র।
সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে ই লেখা বঙ্কিমচন্দ্রের " আনন্দ মঠ "কে দেখতে হবে।
সেই সময় কালের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস থেকে  এবার

আমরা ফিরি আমাদের এলাকায়। প্রাচীন " গোপভূম " এর  " সেনপাহাড়ী পরগনা " য়। অজয় বা অজি বা আরও প্রাচীণ অজাবতী র দক্ষিণে সেনপাহাড়ী আর ওপার সেনভূম।

এখানে যেমন আছে " সাতকাটার জঙ্গল "।
মুসলিম আক্রমণ কারী দের হাতে কাঁকসার রাজবংশ ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। সৈয়দ বুখারীর নেতৃত্বে বা তার আহ্বানে আক্রমণ কারী সৈন্য
দল ঝাঁপিয়ে পড়েছে গোপভূম এর উপরে।
কাঁকসার উত্তরে যে জঙ্গল ভূমি সেখানে আক্রমণ কারী দের হাতে উপুর্যুপরি সাতটি খুন সংঘটিত হয়েছিল। জঙ্গলে র মধ্যে " উৎগড়ে "
লুকিয়ে আছেন কাঁকসার রাজবংশের এক
বংশধর তাঁর পরিবার নিয়ে।

জঙ্গলের নামই ' গড় জঙ্গল '। নামের মধ্যেই ইতিহাস লুকিয়ে।
আনুমানিক হাজার বছর আগে এখানে ছিল গড়। আবার ২৮৩ বছর আগে এখানে ছিল কেল্লা। এখানের একটি মৌজার নাম " গড়কেল্লা খেড়োবাড়ি "।একই শব্দ বন্ধে গড় এবং কেল্লা।  জে এল নং - ২৭ থানা কাঁকসা জেলা পশ্চিম বর্দ্ধমান
পাশের মৌজা গৌরাঙ্গপুর। জে এল নং - ২৮  থানা কাঁকসা।
এখানে ছিল গৌরাঙ্গ মন্দির। কথিত  রাঢ় পরিভ্রমণের সময়
চৈতন্য দেব এখানে এসেছিলেন। এই মৌজাতেই মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে বাঙ্গলার বিখ্যাত পুরাকীর্তি " ইছাই ঘোষের দেউল " সুউচ্চ। প্রায় ৮০ ফুট এর উচ্চতা। পাতলা টালির মতো
ইঁট দিয়ে তৈরি। দেউল রীতি র। রথ শৈলীর। সামনে উড়িষ্যা রীতির কীর্তি মুখ।  চারদিকে নানা দেবদেবীর মূর্তি। প্রচলিত টেরাকোটা নয়। টালিকে কে কেটে। ব্রিক কাট পদ্ধতিতে নির্মিত। ভারত সরকার এর পুরাত্তত্ব বিভাগের দ্বারা সংরক্ষিত।
নির্মানকারী বা নির্মানকাল নিয়ে বিতর্ক আছে।
বর্ধমানের রাজা চিত্রসেন ১৭৪০-৪৪ সাল নাগাদ সেনপাহাড়ী পরগনার অধিকারের ফরমান  দিল্লির বাদশাহের নিকট হতে লাভ করে
এই পরগণা র পুনর্গঠনের প্রতি নজর দেন। তিনিই কেল্লা নির্মান করিয়েছিলেন। কামান এনে বসিয়েছিলেন। একদিকে বর্গী আক্রমণের আশংকা এবং অপর দিকে ইংরেজ দের
দ্বন্দ্ব। যে কোন সময় আক্রমণের মুখে পড়তে হতে পারে।
তাই এই সামরিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে কেল্লা নির্মান করিয়েছিলেন। উত্তরে অজয়। দক্ষিণে ঘণঘোর জঙ্গল।
পরগণার  নাম সেনপাহাড়ী। ডক্টর সুকুমার সেনের মতে বাঙ্গলার সেন রাজাদের পূর্ব পুরুষ রা এখানে এসে প্রথম বসবাস স্থাপন করেছিলেন। নাম তাই সেনপাহাড়ী। অজয়ের ওপারে ও তাঁরা উপযুক্ত বাসস্থানের সন্ধানে গিয়েছিলেন।
রাজনগর পর্যন্ত। রাজা বীরসেন ছিলেন সেন রাজাদের পূর্ব পুরুষ। নানা সম্ভাবনার মধ্যে এটাও। বীর রাজা র  দেশ - বীরভূম। ওপারের নানা জায়গায় তাঁরা ছড়িয়ে গিয়েছিলেন।
ওপারের নাম তাই সেনভূম। এখনকার কাঁকসা থানা এলাকাই সেই প্রাচীন " গোপভূম " এর সেনপাহাড়ী পরগনা। কাঁকসা এবং আউসগ্রামের জঙ্গল ভূমিই বর্ধমান জেলার " জঙ্গল মহল "।
এই জঙ্গলে র উল্লেখ আছে হাণ্টার সাহেবের এনালস অফ রুরাল বেঙ্গল এ এবং অন্যত্র।
আনুমানিক হাজার বছর আগে এই সীমান্তবর্তী এলাকায় ছিল পাল রাজাদের এক গড়। সেই গড়ের অধিপতি কর্ণসেন কে অতর্কিত আক্রমনে পরাজিত করে গড় দখল করে নেন
দুর্দমনীয় ইছাই ঘোষ। পাল রাজাদের কর দেওয়া বন্ধ করে নিজেকে স্বাধীন রাজা হিসাবে ঘোষণা করেন।
ধর্মমঙ্গল কাব্যে যেমন তাঁকে আমরা পাব। পাব ইছাই লাউসেন যুদ্ধ কাহিনী। দ্বিতীয় বারের যুদ্ধে ইছাই পরাজিত এবং নিহত হন। ধর্মমঙ্গল এর কবি বলছেন " শণিবার সপ্তমী
সম্মুখে বারবেলা। আজি রণে যেওয়া না রে ইছাই গোয়ালা "
ইছাই এর আরাধ্যা দেবী শ্যামারূপার না কি তেমনই নির্দেশ ছিল। ভক্ত সন্তানকে হারিয়ে " মা সারারাত কেঁদে বেড়ালেন কাঁদুনে ডাঙ্গার মাঠে "। আছে রক্তনালা। যেখান দিয়ে বয়ে গিয়েছিল রক্তস্রোতে র ধারা। আছে লাউসেন তলা। যেখানে তার শিবির পাতা হয়েছিল। অজয়ের ওপারে। উত্তরে।
আছেন দেবী শামারূপা। প্রাচীণ মন্দির আর নাই। কিন্তু দুর্গাপূজার সময় জঙ্গল ভরে যায় মানুষ আর মানুষে।
ইছাই ঘোষের ঢেকুর গড় এর মোটা মোটা মাটি আর ল্যাটেরাইট বোল্ডার এর সীমানা প্রাচীর এর অবশেষ আজও দেখা যায়। প্রবীনেরা গড়বেড়ি এলাকায় দেখেছেন নানা নির্মান। একটির নাম না কি ছিল "হাজার দুয়ারী "।
ইছাই ঘোষ ঐতিহাসিক ব্যক্তি। তাঁকে আমরা পাব বাংলাদেশের রামগঞ্জে প্রাপ্ত তাম্রশাসনে। সেই তাম্রশাসনে
শুরুতে ই " বভুব রাঢ়াধিপ লব্ধজন্মা "। তিনি রাঢ়াধীপ ; মহামাণ্ডলিক। তাঁর অধীনস্হ নানা নামের নানা পদের কর্মচারী। পিতা - ধবল ঘোষ  পিতামহ  - বালঘোষ, ঐ পিতা ধূর্ত ঘোষ।  তাম্রশাসনে
তিনি ঈশ্বরী ঘোষ। ঈশ্বরী র অপভ্রংশ ই ইছাই।
বনকাটি অযোধ্যা এই এলাকা গড়জঙ্গলের উত্তর অংশে।
লোকমুখের কথা এখানে " চারঘর মিলে পুকুর আর এক শো হাত দূরে দূরে ঠাকুর থান "। এতো মন্দির খুব কম এলাকাতেই আছে। ১৭০৪ শকাব্দে নির্মিত হয় এখানকার প্রথম দুটি আটচালা রীতি র শিবমন্দির। তারপর ১৭৫৪ সালে বিখ্যাত টেরাকোটা অলংকরণ সমন্বিত গোপালেশ্বর শিব মন্দির।
অনুপম তার টেরাকোটা অলংকরণ। সম্মুখ ভাগে রাম-সীতার রাজ্যাভিষেক। তাছাড়া দশমহাবিদ্যা এবং কৃষ্ণ লীলা, চৈতন্য লীলা এবং নানা সামাজিক চিত্রণ।
এই মন্দিরের গঠনের সাথে সাযুজ্য রেখে ১২৪২ বঙ্গাব্দে নির্মিত হয় এখানকার বিখ্যাত পিতলের রথ। বাঙ্গলার প্রাচীণ তম পিতলের রথ। অসাধারণ এর অলংকরণ। এনগ্রেভিং।
কত যে বিষয়ের সমাহার। মহাভারত রামায়ণ এর ঘঘটনাবলী
ছাড়া আছে নানা সামাজিক চিত্রণ। অসামান্য এই পুরাকীর্তি টি দেখে মুগ্ধ হয়েছেন আচার্য নন্দলাল সহ অনেক গুণী মানুষ। এখানের রথের কাজ কে তুলে নিয়ে গিয়ে নন্দলাল ছাত্রদের দিয়ে করিয়েছিলেন শান্তিনিকেতনে র কালোবাড়ির
রিলিফ ভাস্কর্য। এই মন্দির এবং পিতলের রথ নির্মান করিয়েছিলেন তৎকালীন বনকাটির জমিদার এবং ধণী লাক্ষা ব্যবসায়ী রামপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়।
১৭৫৬-৫৭ শকাব্দে নির্মিত হয় বনকাটির রায় কালীবাড়ি প্রাঙ্গণে পাশাপাশি উচ্চ বেদীর উপর তিনটি শিখর রীতি র
শিবমন্দির। এই কালীবাড়ি প্রাঙ্গণে র চারপাশে আছে আটটি ভগ্ন মন্দির, প্রাসাদ। কয়েক টি ব্রাহ্মণ পরিবার এখানে একত্রে থেকে নানাবিধ ব্যবসায় প্রভূত ধনী হয়ে উঠেছিলেন।
অযোধ্যা গ্রামের কর্মকার পাড়ার বিশালাকৃতির পাশাপাশি চারটি শিবমন্দির বিখ্যাত। এছাড়া ও আছে বেশ কয়েকটি শিবমন্দির ; বিষ্ণ দালান ; দুর্গাদালান। প্রসঙ্গত এই এলাকায়
দশটি পারিবারিক দুর্গাপূজা সহ দুটি সার্বজনীন পূজা অনুষ্ঠিত হয়।
কাঁকসা থানা এলাকার একমাত্র প্রস্তর নির্মিত উড়িষ্যা রীতি নাগর দেউল টি রয়েছে আড়রা গ্রামের বহির্ভাগে। গর্ভগৃহে আছে বিশাল শিবলিঙ্গ। 
মন্দির গঠনে আছে বৈশিষ্ট্য। 
পাশেই বামুনাড়া গ্রামে পথিপার্শ্বে  রয়েছে আশ্চর্য এক অষ্টভুজ নটরাজ শিব মূর্তি। 
গোপালপুর প্রাচীণ গ্রাম। এখানে আছে অনেকগুলি শিবমন্দির। দুটি বৃহৎ আকৃতি র। 
একটির সম্মুখভাগে টেরাকোটার কাজ রয়েছে। 
এছাড়া ও পানাগড় গ্রামের কোঙার পরিবারের 
বৃহদাকৃতির শিবমন্দির টি অনবদ্য টেরাকোটা অলংকরণ যুক্ত। তাম্বুলী সম্প্রদায়ের,  একই আকৃতি র, টেরাকোটা অলংকরণ সমন্বিত শিবমন্দির টি পুরোপুরি ধ্বংস। 
কাঁকসা প্রাচীণ জায়গা। তার প্রমান অদূরেই আছে 
ভরতপুরের বৌদ্ধ স্তুপ। সম্ভবত এখানে বৌদ্ধ বিহার ছিল। 
আমলাজোড়া, বামনাবেড়া, বিদবিহার এলাকাতেও আছে কয়েকটি শিবমন্দির। 


ওপারের কথা ঃ  গীতগোবিন্দম এর কবি জয়দেব এর জন্মস্থান হিসাবে বিখ্যাত কেন্দুলী। সেখানকার রাধাবিনোদ মন্দির। বর্ধমান রাজ কীর্তিচাঁদ জননী ব্রজকিশোরী দেবী
এই মন্দিরের নির্মান করিয়েছিলেন ।  সেনপাহাড়ী থেকে বিগ্রহ এনে এখানে স্থাপন করা হয়। অনবদ্য এর টেরাকোটার কাজ।
নির্মানকাল। জেলা গেজেটিয়ার অনুযায়ী ১৬০৫ শকাব্দ।
অন্য সূত্র।  ১৬৯৪-৯৬ ইং সাল।

মোহান্ত অস্থল এর বিখ্যাত পিতলের রথ। বনমালী মণ্ডল ছিলেন এঁর প্রধান নির্মাতা। তাঁর সাথে ছিলেন আরও দশ বারো জন। তখনকার দিনে তাঁদের মজুরী পড়েছিল ১৫০০/।
মোহান্ত ফুলচাঁদ ব্রজবাসীর সময়ে এটি নির্মিত হয়।
নির্মান কাল। ১২৯৬-৯৮ বঙ্গাব্দ।
ঘুড়িষা ঃ  এখানের অনবদ্য টেরাকোটা অলংকরণ যুক্ত বিখ্যাত দু টি মন্দির বিখ্যাত। রঘুনাথ জীর মন্দির জেলার দ্বিতীয় প্রাচীণ তম মন্দির। ১৬৩৩ সালে নির্মিত। এখানে না কি সোনার বিগ্রহ ছিল। বর্গী আক্রমণের সময় লুঠ হয়ে যায়।
এই গ্রামের বেণে পাড়ার লক্ষ্মী জনার্দন মন্দির খুবই বিখ্যাত।
মসলা সহ অন্যান্য দ্রব্যের ব্যবসায়ী ক্ষেত্রনাথ দত্ত  এই মন্দিরের নির্মাতা।
প্রাচীণ গঞ্জ ইলামবাজার ঃ নীল ও গালা শিল্পের জন্য বিখ্যাত অতীতের এক বিখ্যাত গঞ্জ।
এখানের তিনটি টেরাকোটা শোভিত মন্দির খুবই বিখ্যাত।
হাটতলার গৌরাঙ্গ মন্দির। ব্রাহ্মণ পাড়ার রামেশ্বর শিবমন্দির এবং লক্ষ্মী নারায়ণ মন্দির খুবই বিখ্যাত। জনৈক ক্ষুদিরাম বন্দ্যোপাধ্যায় এই মন্দিরের নির্মাতা। নির্মানকাল - ১৮৪৬-৫০।
রামেশ্বর শিবমন্দির এর প্রতিষ্ঠাতা - রামধন চট্টোপাধ্যায়।
অজয় পার হলে বসুধা। এই গ্রামে ছিল ধর্মমঙ্গল এর অন্যতম কবি ; রাজনগর এর রাজাদের দেওয়ান, উকিল এবং মুর্শিদাবাদ রাজ দরবারে প্রতিনিধি। তিনিই করের টাকা নিয়ে গিয়ে জমা দিতেন। সেই নরসিংহ বসুদের পৈতৃক বাস্তুবাটী।
যদিও তাঁর পিতামহ মথুরা বসু বসুধা ত্যাগ করে শাঁকারী গ্রামে চলে যান । নরসিংহের ধর্মমঙ্গল রচনাকাল ১৭১৩-১৪ খ্রীঃ।
মধুক্ষরা নাম মৌখিরা। বসুধা থেকে মৌখিরা নরম, শীতল, উর্বর মাটির উপরে দুপাশে সব্জি ক্ষেত। এই এলাকা সব্জীচাষের জন্য বিখ্যাত।
মৌখিরা কালিকাপুর এর জমিদারির পত্তন করেন বর্ধমান রাজাদের এক দেওয়ান  পরমানন্দ রায়। মন্দির আর প্রাসাদ ময় গ্রাম এই মৌখিরা কালিকাপুর। কালিকাপুর কিছুটা দক্ষিণে জঙ্গলের পাশে ল্যাটেরাইট মাটির উচ্চ ভূমির উপরে অবস্থিত। এখানে আছে " দুর্গা দালান সমন্বিত সাত মহলা প্রাসাদ। বিশাল দিঘি। নীচে থেকে পাতলা টালির মতো ইঁট বাঁধানো পুকুর। পুকুরের পাড়ে ছিল দ্বিতল বিষ্ণুমন্দির।
এখন আছে তার  ভগ্নাবশেষ। প্রাসাদের সামনে দুটি অনন্য
টেরাকোটা শোভিত শিবমন্দির। নির্মাণকাল - ১২ ৪৬ বঙ্গাব্দ।
এই কালিকাপুর অংশের পরমানন্দ বংশধরেরা ইংরেজ দের সাথে নীলের ব্যবসা করে প্রভূত ধনী হয়ে ওঠেন। নির্মান করিয়েছিলেন  ইংরেজ নীলকর দের আমোদপ্রমোদ এর জন্য বাগান বাড়ি " চাঁদনি "। সামনে দিঘি। পূর্ব দিকে আমবাগান।
মৌখিরা র একই চত্বরে অনেক গুলি শিবমন্দির এবং অনবদ্য টেরাকোটা  কাজ সমৃদ্ধ বিষ্ণুমন্দির। মন্দির নির্মানের কাজ শুরু হয় ১২০০ বঙ্গাব্দ থেকে। বিষ্ণু মন্দির। নির্মানকাল ১২০৮ বঙ্গাব্দ। একই চত্বরে ১১ টি মন্দির। মৌখিরার এই অংশকে বলা হয় রাজা কল্যান রায়ের নামে " কল্যাণ চক "।
শতবর্ষ প্রাচীণ পুষ্পিত অশোকতরু তলে দাঁড়ালে যে কোন মানুষের মনে ইতিহাস কথা বলে উঠবে। কালিকাপুর মৌখিরা এই যুগ্ম গ্রাম দুটি  হেরিটেজ মর্যাদা পাবার দাবী রাখে।
তিয়াত্তর এর মন্বন্তর এর পর গ্রামীণ কৃষি নির্ভর অর্থনীতি একেবারে ভেঙে পড়ে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে র মাধ্যমে সেই কৃষি কে উৎসাহিত করার চেষ্টা হয়। ভূস্বামী রা স্বস্তি পান। তাঁরাও কিছু জনহিতকর কার্যে মনোযোগ দেন।  মরে যাওয়া অর্থনীতি কিছুটা হলেও প্রাণ পেয়েছিল ইংরেজ দের কুঠি বাড়ি ভিত্তিক  বাণিজ্যিক রূপে সুতী বস্ত্র, রেশম চাষ, নীল, এবং গালা শিল্পের
  ব্যবসার মাধ্যমে। তাঁদের সাথে ব্যবসা করে যাঁরা প্রভূত ধনার্জন করেছিলেন তাঁরা ও নানাবিধ জনহিতকর কাজ করিয়েছিলেন । জলাশয় খণন, বৃক্ষ রোপন, প্রাসাদ, মন্দির নির্মান। এর মাধ্যমেও কারিগর সহ গ্রামীণ শ্রমজীবী মানুষেরা
কাজ পেয়েছিলেন। কিছুটা হলেও সেদিনের প্রেক্ষিতে এর মূল্য ছিল যথেষ্টই।
পানাগড় মোরগ্রাম হাইওয়ে র উপর বাসস্ট্যান্ডের নাম
" এগারো মাইল "। এখান থেকে টোটো নিয়ে সব দিকেই যাওয়া যায়। চমৎকার  নীলকুঠী র জঙ্গল পথ ধরে কালিকাপুর মৌখিরা। আবার অযোধ্যা বনকাটি এলাকা।
তেপান্তর নাট্য গ্রামে নিরিবিলিতে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এর মাঝে
  দিন রাত কাটাতে পারেন। এখানে সব রকম ব্যবস্থা আছে।
  আবার ইছাই ঘোষের দেউল এর পাশে আছে দেউল রিসর্ট।
সেখানেও থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা আছে।
  দুটি দিন হাতে নিয়ে এখানে এসে থেকে চারপাশ ঘুরে না  দেখলে  বোঝা যাবেনা " কত  রত্নমালায় বিভূষিত ছিল আমাদের বঙ্গভূমি "।
------------ ------------ ------------ ------------ ------------ সমাপ্ত।
( লেখক  আঞ্চলিক ইতিহাস এর গবেষক ; প্রাবন্ধিক)








 

No comments:

Post a Comment