।। অজয়ের এপার ওপার ঃমন্দির সমূহ নির্মান । সেই সময় কাল।। প্রণব ভট্টাচার্য।
অজয় ই সীমারেখা।
উত্তরে বীরভূম। দক্ষিণে বর্ধমান।
এপার এবং ওপার দুপারেই অনেক গুলি মন্দির।
টেরাকোটা অলংকরণ শোভিত।
এই মন্দির গুলির নির্মানকাল এবং নির্মানকর্তা দের সম্পর্কে যতটা জানা যায়, শুরুতে তারই আলোচনা করে নেওয়া যাক।
বনকাটি অযোধ্যা এই এলাকা দিয়েই শুরু হোক । এই এলাকায় লোকমুখে একটা কথা আছে " চারঘর মিলে একটি পুকুর এবং একশো হাত দূরে দূরে ঠাকুর থান "।
কথাটা মোটেই মিথ্যা বা অতিকথন নয়।
বনকাটি অযোধ্যা ঃ রায় কালীবাড়ি প্রাঙ্গণে উত্তর মুখী দুটি আটচালা রীতি র মন্দির ১৭০৪ শকাব্দে। ১৭৮২ খ্রীস্টাব্দে।
পূর্ব মুখী শিখর দেউল রীতি র ১৭৫৬-৫৭ শকাব্দ। ১৮৩৪ খ্রীস্টাব্দে।
ঐ প্রাঙ্গণে আছে প্রাচীণ দালানের ভগ্নাবশেষ। সমসাময়িক নির্মান। বরানগরের দিদির নির্মান বলে কথিত মুখোমুখি মন্দির দুটি খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সমসাময়িক নির্মান। চমৎকার ছোট ছোট টেরাকোটা প্লাক ছিল।
ভগ্ন দুর্গাদালান দক্ষিণ মুখী, পশ্চিম মুখী বিষ্ণু দালান ; উত্তর মুখী আটচালা রীতি র শিবমন্দির। নির্মান কাল ১২২৪ বঙ্গাব্দ বা ১৭৩৮-৩৯ শকাব্দ। নন্দকুমার রায় কর্তৃক নির্মিত।
রাজমিস্ত্রী ছিলেন বনপাশ গ্রামের গোলক নাথ রাজ।
এক চট্টোপাধ্যায় পরিবারের চারচালা রীতি র শিবমন্দির টি র
নির্মানকাল প্রায় সমসাময়িক।
রায় পরিবারের কালীবাড়ি ১৭০৪ শকাব্দ নাগাদ ই তৈরী হয়েছে। দক্ষিণের দ্বিতল বিষ্ণু দালান এবং ভূগর্ভে বসে যাওয়া
পাকা বাড়ি সম্ভবত আরও প্রাচীণ।
বিখ্যাত টেরাকোটা অলংকরণ সমন্বিত গোপালেশ্বর শিব মন্দির ১৭৫৪ শকাব্দে নির্মিত।
পিতলের বিখ্যাত রথ। ১২৪২ বঙ্গাব্দে নির্মিত।
নির্মানকারী সেই সময়ের বিখ্যাত লাক্ষা ব্যবসায়ী, ধনী, জমিদার রামপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়।
অযোধ্যা ঃ কর্মকার পাড়ার একই উচ্চ ভিত্তি ভূমির উপরে পাশাপাশি চারটি শিবমন্দির বিখ্যাত। কোটা শীর্ষার কর্মকার জমিদারেরা বানিয়েছিলেন এই মন্দির গুলি। আনুঃ দুইশত বছরের মধ্যে ই।
চট্টোপাধ্যায় বা মুখোপাধ্যায় পরিবারের ছোট চালা রীতি র শিবমন্দির ১৭০৭ শকাব্দে নির্মিত। দুর্গাদালান বা বিষ্ণু দালান
সহ।
অপর চট্টোপাধ্যায় পরিবারের শিবমন্দির এবং কালীমন্দির
বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের শিবমন্দির পরবর্তী সময়ে র।
পুরনো হাটতলার গঙ্গা রামেশ্বর শিবমন্দির ১৮৭৩ বা ১২৮০ বঙ্গাব্দে র পরবর্তী সময়ে নির্মিত। এখানে মোহান্ত এলোকেশী
ঘটনার প্লাক আছে। প্রতিষ্ঠা লিপি কবেই হারিয়েছে।
বেণে পরিবারের শিবমন্দির ১২৭২ বঙ্গাব্দে বা ১৭৮৭ শকে নির্মিত। বেণেরা যথেষ্ট ধনী ছিলেন। গুড় থেকেচিনি। এবং নানাবিধ ব্যবসা ছিল তাঁদের।।
ভগ্ন প্রায় বিষ্ণু দালান দাঁ পদবীর বেণে দের তৈরী।
অতি চমৎকার টেরাকোটা অলংকরণ সমন্বিত ছিল এই বিষ্ণু দালান। যদিও এই মন্দির প্রতিষ্ঠা হয়নি বলেই শোনা যায়। কিন্তু কারণ জানা যায়না।
ছিল এক প্রাচীন ধর্মরাজ মন্দির। ছোট্ট কিন্তু সুন্দর। বর্তমান সময়ে বেশ কয়েকটি মন্দির নির্মানসহ
দুটি বিষ্ণু দালান চমৎকার ভাবে সংস্কার করা হয়েছে।
প্রাচীণ ধর্মরাজ মন্দির গ্রাম প্রতিষ্ঠা র সাথে নির্মিত। প্রাচীণ বটবৃক্ষ বা অশ্বত্থ তার সাক্ষী।
ঘটক পাড়ার আটচালা রীতি র শিবমন্দির টি একেবারে ভেঙে গেছে। অন্য আরও তিনটি মন্দির ছিল। দুটি নিমটিকুড়ি গ্রামের মণ্ডল দের।
প্রতিবেশী এলাকা ঃ কালিকাপুর মৌখিরা।
মৌখিরা কল্যানচকের একই প্রাঙ্গণে ১১ টি মন্দির। দুর্গাদালান সহ।
প্রাচীণ তম দক্ষিণমুখী চালা রীতি র শিবমন্দির টি ১২০০-১২০৩ সালে নির্মিত।
বিষ্ণু মন্দির। ১৭২৩ শক। বাংলা ১২০৮ সাল।
পূর্ব মুখী বা পশ্চিম মুখী, উত্তর মুখী, মন্দির গুলি এই সময়কালের মধ্যবর্তী সময়ে নির্মিত।
গ্রামটি মন্দিরময়। ছড়িয়ে আছে অনেক মন্দির কিন্তু কোন টির ই আর প্রতিষ্ঠা লিপি নাই।
বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের শিবমন্দির এবং সংলগ্ন বিষ্ণুদালান
উল্লেখযোগ্য।
পুরনো মৌখিরার মেটে পাড়া য় একটি ছোট ভগ্ন চালা রীতি র
শিবমন্দির এবং সংলগ্ন ধর্মরাজ মন্দির এবং দুইটি শিখর রীতি র শিবমন্দির রয়েছে। নির্মানকাল -
কালিকাপুর ঃ প্রাসাদের সামনে উঁচু বেদীর উপর পাশাপাশি দুটি দক্ষিণ মুখী দেউল রীতি র শিবমন্দির। পরমেশ্বর আর হংশেশ্বর শিবের নামে। পরমানন্দ রায় ই নির্মাতা। নির্মানকাল
১২৪৬ বঙ্গাব্দ বা ১৭৬১ শকাব্দ। ১৮৩৯ ইং সাল।
ইলামবাজার ঃ তিনটি বিখ্যাত মন্দির। হাটতলার গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু র মন্দির। আসামান্য জ্যামিতিক নকশা সহ টেরাকোটা র কাজ সমন্বিত। সময়কালের হদিস নাই।
রামেশ্বর শিবমন্দির। রামধন চট্টোপাধ্যায় প্রতিষ্ঠিত। চমৎকার টেরাকোটা শোভিত।
ক্ষুদিরাম বন্দ্যোপাধ্যায় কর্তৃক নির্মিত বিষ্ণু মন্দির। এর টেরাকোটার কাজ অতুলনীয়।
১৮৪৬- ৫০ ইং সালের মধ্যে নির্মিত।
ঘুড়িষা ঃ বিখ্যাত টেরাকোটা অলংকরণ যুক্ত দুই টি মন্দির।
বেনে পাড়ার ক্ষেত্রনাথ দত্ত প্রতিষ্ঠিত বিরাট আকৃতি র
বিষ্ণু মন্দির। নির্মাণকাল -
ভট্টাচার্য পাড়ার রঘুনাথ জীর মন্দির। অসামান্য সুক্ষ্ম টেরাকোটা কাজ সমন্বিত। চালা রীতি র মন্দির। উঁচু ভিত্তি ভূমির উপরে। বীরভূম জেলার দ্বিতীয় প্রাচীণতম মন্দির।
রঘুত্তম আচার্যা এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা। এখানে রঘুনাথ জীর
সোনার বিগ্রহ ছিল। বর্গী আক্রমণের সময় লুণ্ঠিত হয়।
১৬৩৩ খ্রীস্টাব্দে নির্মিত। মলুটি নিকটবর্তী মাসড়া র একই রীতি র শিবমন্দির টি ১৬৩১ সালে নির্মিত।
বিশাল গ্রাম ঘুড়িষা। জেলার দ্বিতীয় বৃহত্তম। এখানে আছে সর্প ছত্রধারী জৈন তীর্থঙ্কর পার্শ্বনাথ এর এক ক্ষয়প্রাপ্ত শিলা মূর্তি।
একদা জৈন এবং বৌদ্ধ ধর্ম এই এলাকায় যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে ছিল।
আদুরিয়া অমরপুর ঃ অমরপুরের কর্মকার পাড়ার প্রথম নির্মিত চালা রীতি র উচ্চ বেদীর উপর শিবমন্দির টি
১২২৩ বঙ্গাব্দে এবং পাশাপাশি দুটি শিবমন্দির ১২৩৯ বঙ্গাব্দে
নির্মিত। অন্যান্য মন্দির গুলি ও সমসাময়িক।
আদুরিয়া গ্রামের এক কর্মকার পরিবারের সামনে নির্মিত শিবমন্দির টি ও সমসাময়িক।
লবণধার ঃ এখানের শিবমন্দির গুলি ১৭৫১ শকাব্দে বা ইং সাল ১৮২৯ এ নির্মিত। সুন্দর টেরাকোটার কাজ ছিল। নষ্ট প্রায়। বিলাসপুর গ্রামের গ্রামমধ্যস্থ শিবমন্দির টির সংস্কার(!) করা হয়েছে.। প্রায় সমসাময়িক। প্রতিষ্ঠা লিপি নাই।
অধিকাংশ মন্দির ই প্রতিষ্ঠা লিপি হীন। লিপি চুরি গেছে।
একটু বড় গ্রাম হলে শিবমন্দির থাকবেই। সাধারণত সেই গ্রামের ভূস্বামী দের নির্মান৷
কাঁকসা থানার গোপালপুর এর মতো বিরাট গ্রামে অনেক শিবমন্দির রয়েছে। কোন টির ই প্রতিষ্ঠা লিপি নাই।
মিশ্র বাড়ি বা পাল, বাড়ির নিকটস্থ বৃহদাকার মন্দির।
বৈষ্ণব অস্থলের কাছে একটি প্রাচীণ মন্দির রয়েছে। সামান্য টেরাকোটা র কাজ ও আছে। কিন্তু সমস্যা সেই একই।
পানাগড় গ্রাম, সিলামপুর ; আমলাজোড়া , বামনাবেড়া ; বান্দরা ; বামুনাড়া
আড়ঢ়া ; , কুলডিহা ; মলানদিঘী, শিবপুর, আকন্দারা
রক্ষিতপুর, তেলিপাড়া ; পিয়ারীগঞ্জ ; রঘুনাথপুর গ্রামে প্রতিষ্ঠা লিপি হীন শিবমন্দির গুলি রয়েছে।
বামুনাড়া গ্রামে রয়েছে একটি অতি চমৎকার নটরাজ মূর্তি।
আড়ঢ়া বামুনাড়া গোপালপুর প্রাচীণ ইতিহাস সমৃদ্ধ গ্রাম।
আড়ঢ়া গ্রামের পোড়েল পুকুর সংস্কার করার সময় পাওয়া গিয়েছিল অনেক বৌদ্ধ মূর্তি। ধর্মরাজতলায় এখনও রয়েছে
একটি পাথরে ক্ষোদিত বৌদ্ধ মূর্তি।
আড়ঢ়া গ্রামের বিখ্যাত শিবমন্দির। প্রস্তর নির্মিত উড়িষ্যা নাগর রীতি র অসামান্য মন্দির। বিশাল শিবলিঙ্গ।
এলাকার চারপাশে চোখ বুলালেই এর প্রাচীণত্বের আভাস মিলবে। এই মন্দির সেন রাজাদের আমলে ( সম্ভবত রাজা বল্লাল সেনের আমলে) নির্মিত।
ইছাই ঘোষের দেউল এক অনবদ্য প্রাচীন পুরাকীর্তি।
শিখর দেউল রীতি র নির্মান। পাতলা টালির মতো ইঁট দিয়ে তৈরী। প্রায় ৮০ ফুট উচ্চ। ব্রিক কাট পদ্ধতিতে ক্ষোদিত চার দিকের নানা দেবদেবী র মূর্তি বিনষ্ট প্রায়। এটি কিন্তু কোন
মন্দির নয়। ইছাই ঘোষের স্মৃতি বিজড়িত জায়গায় অবস্থিত
স্মৃতি দেউল। নির্মানকাল নিয়েও নানা মতভেদ।
ইছাই ঘোষ ঐতিহাসিক ব্যক্তি। জঙ্গলের নাম গড়জঙ্গল।
একটি মৌজার নাম গড়কেল্লা খেড়োবাড়ি। গড় এবং কেল্লা একই শব্দবন্ধে। হাজার বছর আগে ইছাই এর সময়কালে র
" ঢেকুর গড় " এবং বর্ধমানের রাজা চিত্রসেন এর নির্মিত কেল্লা। পরগণা র নাম "সেনপাহাড়ী "। সেন রাজাদের পূর্ব পুরুষ রা এখানে এসে প্রথম বসবাস স্থাপন করেছিলেন।
তাই সেনপাহাড়ী নাম। এই এলাকাকে ঘিরে অনেক ইতিহাস।
ধর্মমঙ্গল কাব্যের পটভূমি ও এই এলাকা। অজয়ের ওপারে
লাউসেন তলা। যেখানে লাউসেনের শিবির পাতা হয়েছিল।
তাঁর সেনা পতি বীর কালু ডোম এই এলাকায় এক মান্য পূজ্য
ব্যক্তি। ডোম সম্প্রদায়ের মানুষ রা ১৩ ই বৈশাখ তাঁর পূজা করেন।
বনকাটি র পিতলের রথ এক অসামান্য পুরাকীর্তি। ১২৪২ বঙ্গাব্দে এর নির্মান। অসাধারণ এর খোদাই বা এনগ্রেভিং এর কাজ। রামায়ণ মহাভারতের কাহিনী ছাড়াও আছে নানা সামাজিক চিত্রণ। শিল্পাচার্য নন্দলাল বসু সহ অনেক গুণী মানুষ এই রথের কাজ দেখে মুগ্ধ হয়েছেন। শিল্প রসিক যে কোন মানুষ ই মুগ্ধ হবেন এই রথের শিল্পকর্ম দেখে।
দিল্লির বাদশা মহম্মদ শাহের ফরমান অনুযায়ী গোপভূম পরগণা বা সেনপাহাড়ীর জমিদারি লাভ করে বর্ধমানের রাজা চিত্রসেন এই এলাকার পুনর্গঠনের কাজ করেন।
১৭৪০-৪৪ সালের মধ্যে।
সেই সময়কাল ঃ বাঙ্গলার ইতিহাসে সে এক চরম সন্ধিক্ষণ।
১৭৪০ থেকে শুরু হয়ে ৫০-৫১ পর্যন্ত চলেছে দফায় দফায় বর্গী আক্রমণ। ভাস্কর পণ্ডিতের নেতৃত্বে ২০০০০ অশ্বারোহী র দল ঝাঁপিয়ে পড়েছে বাংলার উপরে। তারা নবাব আলীবর্দি র কাছ থেকে চৌথ আদায় করবে। দিল্লির অকর্মন্য বাদশা
তাঁদের পাঠিয়ে দিয়েছেন বাঙ্গলায়। নিজে বাঁচার আশায়।
গ্রামের পর গ্রাম তাদের অত্যাচারে ছারখার হয়ে গেছে।
ভিটেমাটি ছেড়ে পালিয়েছে কত মানুষ। গঙ্গার ওপারে গিয়ে
স্বস্তি পেয়েছেন। কিন্তু সেখানেও জনসংখ্যার চাপ বেড়ে গেছে। সীমাহীন অত্যাচার হয়েছে মহিলা দের উপর।
যে গ্রাম থেকে টাকা কড়ি, সোনা দানা পায়নি সে গ্রাম চারদিক ঘিরে ধরে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। অপহরণ লোলুপ, নৃসংস
বর্বর বর্গী দের দল অতর্কিত আক্রমন করে। সম্মুখ সমরে তারা অবতীর্ণ সহজে হয়না।
নিরুপায় হয়ে নবাব আলীবর্দি ছলনার আশ্রয় নিয়ে " সন্ধিচুক্তি " র নামে তাঁবুতে ডেকে ভাস্কর এবং তার সঙ্গী সাথী দের হত্যা করে।
ভাস্করের মৃত্যুতে ছত্রভঙ্গ হয়ে বর্গী রা দুর্গাপূজা ছেড়ে পালায়।
কাটোয়ার দাঁইহাট ছিল তাদের অন্যতম এক ঘাঁটি।
অবশ্য এখানেই শেষ হয়না। বর্গী আক্রমণ। বিশ্বাসঘাতক
রহিম খাঁ আবার ডেকে এনেছে তাদের।
শেষ পর্যন্ত পাঁচ বারের যুদ্ধ শেষে বছরে ১২ লক্ষ টাকা চৌথ আদায় দেবার প্রতিশ্রুতির পর বন্ধ হয়েছে এই আক্রমণ।
চার লক্ষ মানুষ বর্গী আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন এবং নিহত হয়েছিলেন। আর কত যে টাকা, সোনা রূপা লুণ্ঠিত হয়েছে তার কোন হিসাব নাই। মুর্শিদাবাদে জগৎ শেঠের গদি থেকেই তিন লক্ষ টাকা।
মাঝে মাত্র কয়েকটি বছর নিরুপদ্রব। আলীবর্দি র মৃত্যুর পর
নবাব সিরাজ। বাঙ্গলার ইতিহাসে এক বিতর্কিত চরিত্র।
কিন্তু চরম ইংরেজ বিদ্বেষ তাঁর। কলকাতায় তারা জাঁকিয়ে বসছে। দুর্গ শক্তিশালী করছে।
সিরাজের কলকাতা আক্রমণ। বেশ কিছু ইংরেজ বা ইউরোপীয় মারা গেলেন। বাকী রা পালালেন মাদ্রাজ।
আবার শক্তিশালী হয়ে ক্লাইড এলেন দায়িত্ব নিয়ে। তাঁর কাছে
নবাব বিরোধী রা সিরাজ কে হঠানোর জন্য ক্লাইভ এর সাথে মন্ত্রণা করলেন। ক্লাইভ চরিত্রে ছিলেন সাহসী ; দুর্দমনীয় এবং
দূরদৃষ্টি সম্পন্ন। তাঁর মনে আশার ঝিলিক খেলে গেল।
১৭৫৭ র পলাশীর সর্বনাশ। যুদ্ধের নামে প্রহসন।
সিরাজ পরাজিত এবং পরে নিহত হলেন। মুর্শিদাবাদ রাজকোষ থেকে সর্বমোট প্রায় ৬০ লক্ষ টাকা লুঠ করা হল।
বিশ্বাসঘাতক দের মধ্যে তা বণ্টিত হল।
একা ক্লাইভ ই পেলেন ২০ লক্ষ - টাকা।
১৭৫৭ থেকে শুরু করে ১৭৭২ এর মধ্যে প্রায় ঘুষ সহ লুঠ হল
প্রায় ১ কোটি ২৫ লক্ষ পাউণ্ড।
মীরজাফর নবাব হলেন। উপঢৌকন আর কর আদায় না দিতে পারার জন্য তাঁর জামাতা মীরকাসিম কে করা হল নবাব। তিনি আরও বেশি উপঢৌকন দিলেন। আর ও বেশী কর আদায়ের প্রতিশ্রুতি দিলেন।
ইংরেজ কোম্পানি দেওয়ানী লাভ করেছে -১৭৬৫ সালে।
কর আদায় করছে তারা। দেশীয় নবাবী আমলের কর্মচারী দের দ্বারা। আছেন কুখ্যাত সিতাব রায় বা রেজা খাঁ।
শুরু হয়েছে " দ্বৈত শাসন "। চলেছে এই দ্বৈত শাসন ১৭৬৫- ৭২ সাল পর্যন্ত। চলছে প্রজাদের উপর নিপীড়ন।
বক্সার এর যুদ্ধে মীরকাসিমের পরাজয়। ইংরেজ সর্বময় কর্তা
হয়ে গেল।
১৭৬৮-৬৯ নাগাদ দেশে খাদ্যাভাব দেখা দিল। এবং সেই অভাব পরিণত হল ছিয়াত্তর এর মন্বন্তরে ১৭৭০ সালে।
এক টাকার একমন, দেড়মন চালের দাম হল তিন টাকা সের।
কে কিনবে! ইংরেজ রা সাধারণ মানুষের কথা ভাববার কোন প্রয়োজন বোধ করেনি। তারা তাদের সৈন্য দলের জন্য বাজার থেকে সব চাল কিনে নিল। আর আড়তদার, মজুতদার রা যথানিয়মে মজুত করল।
না খেতে পেয়ে বাঙ্গলার কমপক্ষে ৮০ লক্ষ মানুষ মারা গেল।
এর মারাত্মক প্রভাব পড়েছিল রাঢ়বঙ্গে। ঝাড়খণ্ড, বীরভূম, আজকের বর্ধমানের পশ্চিমাংশে।
ভাবা যায় বাঁচার তাগিদে মানুষ মানুষের মাংস খেতে বাধ্য হয়েছে।
বীরভূম " জনমানবহীন বন্ধ্যা দেশ "। ছয় হাজার গ্রামের মধ্যে দেড় হাজার গ্রাম একেবারে শূন্য। পতিত সব কৃষিজমি।
অনাবৃষ্টি র যদি বা বৃষ্টি নামল কে চাষ করবে। চাষি ই তো নাই। সব মরে গেছে। কৃষি জমি সব আগাছা, জঙ্গলে ঢেকে গেছে। জঙ্গল ভূমি আরও গভীর হয়েছে। হিংস্র শ্বাপদের দল নির্ভয়ে সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বন্য হস্তী আর শার্দূল এর দল
বীরভূমের অবশিষ্ট গ্রামাঞ্চল কে তছনছ করে দিচ্ছে।
মানুষ রাতের বেলা গাছের উপরে মাচায় রাত জাগে। তাদের মেরে, তাড়াবার জন্য পুরস্কারের ব্যবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে। পশ্চিমের জঙ্গল দেশের সাহসী মানুষ দের ডাকা হল।
এই পরিস্থিতির মাঝে মরীয়া হয়েই পশ্চিম থেকে নেমে এসেছে
ডাকাত দল। তাদের সংগে যোগ দিয়েছে অনেক উচ্চবর্গের, নিম্ন বর্গের মানুষের দল। আগে রাজা, জমিদার দের অধীনে কাজ করত যে সব ছেড়ে দেওয়া সৈন্য রা - তারাও।
ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, রজপুত ক্ষেত্রী রা নেতৃত্বে। এক এক দলে হাজারের উপর মানুষ। দিনে দুপুরে ডাকাতি হচ্ছে। ইলামবাজার গঞ্জ লুঠ হল। জয়দেব কেন্দুলী র মোহান্ত অস্থল এর ভরত চাঁদ ব্রজবাসী র গদি লুঠ হল। অজয় পার হয়ে
অযোধ্যা বনকাটি র জমিদার জনৈক বলিনাথ চট্টোপাধ্যায় এর বাড়ি তে ডাকাতি হল। সে সব ১৭৮৯ সালের ঘটনা।
তাদের লক্ষ্য ইংরেজ কুঠিবাড়ি, করের টাকা, অত্যাচারী ধনী
জমিদার, মজুতদার রা। জীবন ডাকাত, তার ভাই বিশু, ভুবন হাঁড়ি, উদিত লাল, গৌরী হাঁড়ি ; ভবাণী সিং এরা সব ছিল ডাকাত দলের মাথা। জীবন গ্রেপ্তার হবার পর তার ভাই বিশু
দল পরিচালনা করে। অযোধ্যা র ডাকাতি বা কেন্দুলী র ডাকাতি তে বেশ কয়েক জন রায়ত ( পাহারাদার) মারা যায়।
এই সময়কাল এবং ঘটনাপ্রবাহের প্রেক্ষিতে বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর " আনন্দ মঠ " কে দেখতে হবে। " দুর্ভিক্ষ পীড়িত, নিঃস্ব, রিক্ত মানুষের হাহাকারে ভরে আছে বাংলার সেই ক্রান্তিকাল "। ইংরেজ দের অধীনে চাকরি করেও সেই শাসনের প্রতি তীব্র কষাঘাত আর কে করেছেন। " ইংরাজের শাসন কৌশলে আমরা সভ্য হইতেছি। আমাদের দেশের বড় মঙ্গল হইতেছে। দেশের মঙ্গল কাহার মঙ্গল? তোমার আমার মঙ্গল দেখিতেছি কিন্তু তুমি আমি কি দেশ! তুমি আমি দেশের কয়জন? আর এই কৃষিজীবি কয়জন? তাহাদের ত্যাগ করিলে দেশে কয়জন থাকে? হিসাব করিলে তাহারাই দেশ - দেশের অধিকাংশ লোকই কৃষিজীবি "।
------------ " এই নয়শত নিরানব্বই জনের শ্রীবৃদ্ধি না দেখিলে আমি কাহারও জয়গান করিবনা "
এই সাধারণ মানুষ, কৃষক কে বাঁচাবার কোন প্রশাসনিক উদ্যোগ নিতে কোম্পানি সরকার কে দেখা যায়নি।
কিভাবে মরে যাওয়া কৃষি অর্থনীতি কে বাঁচানো যায় এই ভাবনায় ১৭৯৩ সালে কর্ণওয়ালিস " চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে র "
ব্যবস্থা করলেন। ভূস্বামী রা স্বস্তি পেলেন। করের টাকা দিতে না পারলে জমিদারি অন্তত নীলাম হয়ে যাবেনা।
তাঁরাই এবার চেষ্টা করতে লাগলেন পতিত কৃষি জমি কে কিভাবে আবার সুফলা করে তোলা যায়। স্থায়ী রায়ত রা অনেকেই নাই। অস্থায়ী রায়ত দিয়ে চাষের ব্যবস্থা করা হল।
বাইরে থেকে বিশেষত বীরভূমের পশ্চিমাঞ্চল থেকে অনেক কোঁড়া, মাল, সাঁওতাল আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ দের আনানো হল। নীল কুঠি গুলিতেও এই সব শ্রমিক দের যথেষ্ট কদর ছিল।
ছিয়াত্তর এর মন্বন্তর এর ধাক্কা পরবর্তী অনেক গুলি বছরেও কাটানো যায়নি।
অনেক চেষ্টায় কৃষি আবার প্রাণ ফিরে পেল। ভূস্বামীরা ও
অনেকে ইংরেজ ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির সাথে মসলা, নীল, গালা, ' গড়া " কাপড়ের পরে কয়লা র ব্যবসা করে প্রভূত ধনী হয়ে উঠলেন।
উদ্বৃত্ত অর্থে তাঁরা নানাবিধ জনহিতকর কাজ করতে প্রবৃত্ত হলেন। জলাশয় খণন, বৃক্ষ রোপন, আম কাঁঠালের বাগান তৈরী ইত্যাদি সব কাজ। এই সব কাজের মাধ্যমে ইংরেজ সরকার এর বিশেষ নজরে আসার তাগিদ ও কাজ করেছে।
কত ধরনের উপাধি - রায়, রায় চৌধুরী, প্রদান করা হচ্ছে।
সেই রকমের উপাধি পাবার ইচ্ছা প্রায় সকল ভূস্বামী দের
এই ভূস্বামী জমিদার তন্ত্রের উপরই নির্ভর করাছে ইংরেজ ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি। দেশীয় সহযোগী তো চাই।
কর্ণওয়ালিস চেয়েছিলেন " ঔপনিবেশিক সামন্ত তান্ত্রিক এক
কৃষি ব্যবস্থা এবং উৎপাদন "।যাতে কর আদায় যথাযথ থাকে।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে র পর ছোট বড় মাঝারী সব ভূস্বামী, জমিদার রা
বানিয়েছেন দুর্গাদালান, বিষ্ণু দালান, শিবমন্দির ; দালান কোঠা , প্রাসাদ ইত্যাদি। যাঁর যেমন সামর্থ্য। এতে তাঁদের আত্মগরিমা ও প্রচারিত হয়েছে।
কিন্তু অস্বীকার করার কোন উপায় নাই যে এই সব কাজের মাধ্যমে শ্রমজীবী মানুষ কাজ পেয়েছেন৷ গ্রামীণ কারিগর রা
কাজ পেয়েছেন। মরে যাওয়া গ্রামগুলি আবার জেগে উঠেছে। অনেক সমালোচনা সত্ত্বেও একথা অস্বীকার করা বোধহয় করা যায়না।
কয়েকটি বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য নির্মান বা পুরাকীর্তি কে বাদ দিলে অজয়ের উত্তরে সেনভূম বা দক্ষিণে সেনপাহাড়ী এলাকায় গ্রামীণ ভূস্বামী দের দ্বারা নির্মিত এত গুলি মন্দির
গড়ে উঠেছে। সেই মন্দির ই হয়েছে গ্রামের " ল্যাণ্ড মার্ক "।
এই রাঢ় বাঙ্গলায় ধর্মরাজ সর্বজনীন দেবতায় পরিণত হয়েছেন। বাগদি পাড়া য় বা কোঁড়া পাড়ায়
মনসা থান তো আছেই। উচ্চ, নীচ উভয় বর্গের মানুষ কালী পূজা করছেন। কালী মন্দির গড়ে তোলা হয়েছে। আর নানা গাছতলার ঝোপে নিরিবিলিতে আছেন কত চণ্ডী। চণ্ডী থান।
গ্রামের উচ্চবর্গের মানুষের সাথে নিম্নবর্গের মানুষের একটা
পারস্পরিক সম্পর্ক - এই সব দেব দেবী র পূজা উপলক্ষ্যে গড়ে তোলার চেষ্টা ও সেই সময়ে লক্ষ্য করা যায় । হয়তো দেখা গেল ব্রাহ্মণ পাড়ার কালী হলেন বড় বোন তো মুচি পাড়ার কালী মেজবোন কি আরেক মুচি পাড়ায় ছোট বোন
পূজিতা হচ্ছেন। এতো আর কিছু নয় দেবদেবী কে কেন্দ্র করে
উচ্চবর্ণের সাথে নিম্ন বর্ণের একটা আপাত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা।
প্রতিটি সময়কালের নিজস্ব চরিত্র আছেই। অর্থনীতিই সে চরিত্র কে নির্ধারণ করে। নির্ধারিত হয় মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক। প্রত্যেক নির্দিষ্ট সময়কালের গণমানসের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেই সময়ে ফেরা যায়না। অনেক দূর থেকে সেই সময় কে ফিরে দেখতে হয়। স্বাভাবিক ভাবেই সেই
দেখা কে হতে হবে বহু কৌণিক। এই হল ইতিহাস এর শিক্ষা।
------------ ------------ ------------ ------------ ---------- সমাপ্ত।
লেখক আঞ্চলিক ইতিহাস এর একজন গবেষক। প্রাবন্ধিক।
গ্রন্থ সহায়তা। বর্ধমান ঃ ইতিহাস ও সংস্কৃতি। যজ্ঞেশ্বর চৌধুরী। জেলা গেজেটিয়ার বীরভূম। ও ' ম্যালি।
হাণ্টার এর " এনালস অফ রুরাল বেঙ্গল "'
রঞ্জন গুপ্তের - দি ইকোনমিক হিস্ট্রি অফ এ বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট।
বীরভূম।
তারাপদ সাঁতরা - বাঙলার মন্দির মসজিদ স্থাপত্য
নিজস্ব ক্ষেত্রানুসন্ধান। নিজস্ব প্রবন্ধ।
কুঠিবাড়ি ভিত্তিক ব্যবসা বাণিজ্য ঃ সেই সময়কাল
ইত্যাদি।
------------ ------------ ------------ ------------ ------------
কাঁকসা সাহিত্য সংস্কৃতি অ্যাকাডেমির " ডুবুরী" পত্রিকা র
শারদ সংখ্যায় প্রকাশিত, ২০২৩।
No comments:
Post a Comment