Friday, 26 July 2024

কথা- সাতকাহন। সেই ছেলেটা ভেলভেলেটা


।।  সেই ছেলেটা  ভেলভেলেটা ।।  কথা সাতকাহন।

ছেলেটা কাঁদছে তো কাঁদছেই।
মা তো শুয়ে আছে ভিতরে র বারান্দায় এককোনে।
তার না আছে ক্ষমতা। বুকে দুধ নাই। বুকের কাছটিতে ছোট্ট পুঁচকে টা কে টেনে নেবার অধিকার ও নাই। ডাক্তার বাবুর নিষেধ। কোন রকমে বলে ' ও মা দ্যাখো, কাঁদছে খুব '।
রান্নাঘর থেকে দিদিমা এসে মুখে দুমুখ ওয়ালা কাঁচের মাইপোশ ধরিয়ে দেয়। ঘরের গোরুর দুধ। চুষতে চুষতে আবার ঘুমিয়ে যায়।
  গরীব মানুষ দের ছোট্ট গাঁ। একটু বড় হলে, অনেকে তুলে নিয়ে যায়। নিজের বুকের দুধ ও খাওয়ায় কেউ কেউ। যেমন
তুলসী। জাতে বাউরি। নিজের ছেলেকে খাইয়েও, এ ছেলেকে
খাওয়ায়। দিদিমা বলে নিয়ে যা। নিয়ে যা। তোদের কোলেই বড় হোক।
এ ছেলে বাঁচতে কি না,  বড় হবে কিনা সে দুশ্চিন্তা দাদু দিদিমা র মনে পাক খায় অবিরত। মেয়ে যে বাঁচবে না তা যেন মনে গেঁথে গেছে। চিকিৎসা!  আর চিকিৎসা। কম তো হলনা।
ইলামবাজার থেকে কালী বাবু আসেন। ইঞ্জেকশন দেন।
এই ইঞ্জেকশন কিনতে কিনতেই প্রায় সর্বস্বান্ত হয়ে গেছে।
এত দাম। ফাঁকা শিশি গুলো কেও যেন ফেলে দিতে পারা যায়না।
গোয়াল ঘরের মাচা থেকে একটা বেশ পুরনো ঢাকনা ওয়ালা
বেতের ঝুড়ি নামিয়ে পরিষ্কার করে, সেই মেয়ের চিকিৎসার যত শিশি, বোতল, ইঞ্জেকশন এর শিশি ছিল এক কোনে জড়ো করা  দাদু সব এই ঝুড়িতে রেখে দেয়।
---- এগুলো জমিয়ে কি হবে । ধুয়ে জল খাবে? 
--- দাদু কোন উত্তর দেয়না।
  বিকেলের রোদে দড়ির খাটিয়া টা বারান্দা থেকে উঠোনে বের
করে দেওয়া হয়। সকাল বিকেলের রোদ গায়ে মাখতে বলা হয়েছে। বুক পর্যন্ত একটা চাদর ঢাকা।
সেই খাট থেকে মেয়ে আকাশ দেখে। ঘরের পিছনে লম্বা তালগাছ দেখে।উঠোনের সজনে গাছে  কাঠবেড়ালী গুলো লেজ তুলে তুলে ওঠা নামা করছে। খেলছে। একদৃষ্টিতে সে  তাকিয়ে থাকে।
সামনের জয়ন্তী গাছটায় অনেক ফুল এসেছে। দুর্গাপূজার সময় অনেকে নিতে আসে। স্থলপদ্ম গাছটা ফুলে ফুলে ভরে গেছে।
আকাশে একফালি রাঙা মেঘ ভেসে যায়।
আখড়া থেকে মাতামা এসে মাথার কাছে একটা মোড়ায় বসে
বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়ে।
---  আজ কি তিথি গো মাষ্টারবাবা?
   কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে  বলেন  পাঁজি দেখতে হবে।
সেই রোগগ্রস্ত মেয়ে বলে ওঠে  তিথি  বারে কি হবে গো মাতা!
অশ্লেষা, মঘা কিছু দেখার দরকার নাই "
  ---  কি হবে এসব দেখে
  বৈষ্ণবী মাতামা চুপ করে থাকেন
এক অজানা আশংকায় সারা উঠোনে জড়ো হয় এক
আশ্চর্য  নিস্তব্ধতা। একটা হিম বাতাসের স্রোত বয়ে যায়
দক্ষিণ থেকে উত্তরে। মাতামা হাতজোড় করে প্রণাম করেন।

আগের লেখাটি র লিঙ্ক।  বিধাতা পুরুষ।

https://www.facebook.com/share/p/ZeZWK9LufV1ptFwx/?mibextid=অফডক্নক
------------ ------------ ------------ ------------ ------------ ------------



 
 

সন্তোষপুর। টেরাকোটা অলংকরণ সমন্বিত শিবমন্দির

।।  সুমন্ত কোথায় যাবে যেন! ।। 

 সুমন্ত কোথায় যাবে যেন! 
 কেন  - যাবে সন্তোষপুর। 
 সুমন্ত যাবে সন্তোষপুর। 
 তো সে কোন সন্তোষপুর। 
 এই বাংলাদেশে কি কম সন্তোষপুর আছে! 
 শান্তিনিকেতনের আশেপাশে আছে না কি কোন? 
 পায়ে হেঁটে যেতে  হবে । পথে ধুলো। দুপুরের রোদ। 
  ছাতা চাই। 

 তিনি জানতেন হয়তো। 
 তাই  ন্ত  কে মাঝে নিয়ে তাঁর প্রথম মনে পড়েছে সন্তোষপুর 
 অজয়ের ধারে। একেবারে গা য়ে গা লাগিয়ে। আগে যখন 
 রাঢ় ভূখণ্ডে বৃষ্টি হত - অজয় দিয়ে নেমে আসত বান। 
 মাটি গোলা জল। উপছে ভাসিয়ে দিত মাঠ ঘাট, ঘরবাড়ি। 
 আবার অনেক আগে এই অজয়ের বুকেই প্রাকৃতিক ভাবেই 
 সৃষ্টি হয়েছিল এক বিশাল দহ। হ্রদ। গাঁয়ের মানুষের মুখে হদের ' ঘাট। অজয় তখন যথেষ্ট নাব্য। জলপথে বাণিজ্য। 
 সন্তোষপুর তখন এক জলপথ বাণিজ্য কেন্দ্র। 
 ছিল বিরাট জনবসতি। শোনা যায় হাজার বারো মানুষের না কি বাস ছিল। 
 অঢেল দোআঁশলা উর্বর জমি। 
 অতএব এ জমিতে নীলের চাষ হবে চমৎকার। 
 ইংরেজ রা চলে এলো। তাদের সাথে স্থানীয় বাবুরা। গ্রামের প্রভাবশালী, ভূস্বামী সব। মাঠের তিল ভেঙে দিয়ে চাষি কে দিয়ে করালো নীলের চাষ। জোর করে। 
 গড়ে উঠল নীল কুঠি। নীলের কারখানা । আশেপাশেই। 
 এখনও তার ভাঙ্গা দেয়াল দেখা যায়। মারাত্মক ঝোপে ঢেকে আছে সেই এলাকা। 

গ্রামটিকে দেখলে তার প্রাচীণত্বের কোন নিদর্শন ই মেলেনা। 
 ছোট্ট কয়েকঘরের একটা গ্রাম। 
 আছে সেবাইত চট্টোপাধ্যায় পরিবারের হাতে প্রাচীন এক মন্দির গুচ্ছ। তিনটি মন্দিরের সমাবেশ এক স্থলে। দুটি 
 দেউল রীতি র। পীড়া যুক্ত। একটি পঞ্চরত্ন। 
 দক্ষিণে র টির শীর্ষ দেশ মারাত্মক রকম ক্ষতিগ্রস্ত। 
 চট্টোপাধ্যায় পরিবারের ক্ষমতা নাই উপযুক্ত সংস্কারের। 
 বলছিলেন " বাবুরা আসেন। হ্যাঁ কলকাতা থেকেও আসেন। 
 ফটো তুলে নিয়ে চলে যান  " । কেউ কিছুই তো করেনা। 
 তিনটি মন্দিরের সামনেই চমৎকার টেরাকোটা অলংকরণ। 
 পরিবার সহ দুর্গা। ন্যাংটা শিববাবাজী বর। আর রামসীতা। 
 আর বটবৃক্ষের বাহু বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে আছে অনতি প্রাচীণ 
 এক কালীমন্দিরের ভগ্ন দালান মন্দিরের দেয়াল।  
 পশ্চিমে জয়দেব কেন্দুলী বেশী দূরে নয়। 
  সেখান থেকে প্রকাশিত হয় এমন একটি পত্রিকা, নাম তার  
" দেউল "। তার    শারদ সংখ্যায়  থাকবে আমার একটি প্রবন্ধ। বন্ধু সম্পাদক  সুভাষ কবিরাজ এর  অনুরোধ  লিখতে হবে টেরাকোটার  উপর একটি প্রবন্ধ। 
 সে চমৎকার একটা   টপিক দিয়েছে। 
 ইলামবাজার এর পশ্চিমে  গঙ্গাপুর, ভরতপুর, নারানপুর, 
 ক্ষুদ্রপুর, উদয়পুর, সন্তোষপুর, বালারপুর, ভুবনেশ্বর, 
 মন্দিরা,  জনুবাজার, সুগড়,  ভরাঙ্গী, রামপুর, জয়দেব কেন্দুলী। 

 কত কথা এ মাটির! 
------------ ------------ ------------ ------------ ------------ ------------ 
©  প্রণব ভট্টাচার্য।

।। বাকী তো অনেক।।

।। বাকী তো অনেক।।   

 বাকী রয়ে গেল  অনেক    
  যেমন পথ   বা     পথ চলা 
 নক্ষত্র ভরা গোটা  আকাশ টা  দেখাও হয়নি 
 আমাদের দালান ছিলনা  দূর দিগন্ত দেখার 
 পুকুরের পাড় ছিল আমার পাহাড় 
 সেখান থেকে সূর্যোদয় 
 পশ্চিমের মোরাম চাতাল আমার পামির মালভূমি 
 সেখান থেকে সূর্যাস্ত দেখতাম 
 সেই চাতাল আর নেই 
 নদী বাঁধের গায়ের বিরাট যজ্ঞ ডুমুর 
 পলাশ ঝোপের তারা তিতলি গুলো যে কোথায় গেল 
  আর করঞ্জার ঝোপে  জোনাকের দল
 গুঞ্জার কাছে ধার করেছি  তারা তিতলি 
 নাই রে         কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে যেন 
  বর্ষা নাই       সারারাত আখড়ার ডোবায় 
   ব্যাঙেদের গান 
  একঘেয়ে সুরে  ঝালাপালা কান 
 নাই হয়ে যাবে হয়তো একদিন 
  কত প্রজাপতি উড়ে বেড়াত, গঙ্গাফড়িং লাল ভেলভেট পোকা , কুলঝোপে সোনাপোকা 
 কোথা গেল সব 
 আমরা পঞ্চাশ ডিগ্রি তে পৌঁছে যাচ্ছি 
  আবার শুনছি  বনদপ্তর জঙ্গল কাটাচ্ছে 
   রাঢ়বঙ্গে কতদিন ভালো বর্ষা  হয়নি 
অজয়ে জল আসেনি     বান নামেনি 
 সব নদী মরে গেছে  
 শুধু চর , মানা, কাশবন, নদীগর্ভে বোরো ধান চাষ 
 নদী ধারে কত দেশী ঘি করলার লতা ছিল 
 কি তার স্বাদ। ঝাল দিয়ে একথালা ভাত 
 কত শতমূল, অনন্তমূল নানা ভেষজ 
 নীলকুঠির জঙ্গলে  কি ছাতু হত  মাটির নীচে 
 কুরকুরে  নাম  মাতামার সাথে সাথে যেতাম 
 আদাড়েবাদাড়ে আতা ঝোপ  সব যে কোথায় গেল 
 পুকুর পাড়ে র ধারে  ঘৃতকুমারী র ঝাড় 
 রাতে রাতে কারা সব গোড়া সমেত তুলে নিয়ে গেল
 এলোভেরা হল  এখন মাখি, খাই, 
 ধব, গাব, চালতে মাদার, ভেলা, আরও কত কি 
 কেমন নিঃশব্দে নাই হয়ে গেল 
 আহা, ছিল কত পিয়ালের গাছ 
 জঙ্গলে জঙ্গলে   কোন রকমে দু একটা টিঁকে আছে 
 আমাদের গাঁয়ে ঢোকা বা বেরোনোর রাস্তা টা 
 যেখানে দুভাগ হয়েছে সেখানে ছিল 
 ছোট খাটো এক  সুন্দরী পিয়াল 
 আমরা তার ডালে দোল খেতাম 
  একদিন সেও       নাই হয়ে গেল 
 এক রাস্তা ধরে গেলাম ' যা গেছে তা যেতে দাও 'এর কাছে 
 আর এক রাস্তা ধরে 
নিজের নিয়তি জানা 
   গাধার স্থির  চোখ নিয়ে
 মরা অজয়ের দিকে তাকিয়ে 
------------ ------------ ------------ ------------ © প্রণব ভট্টাচার্য 
 গুঞ্জাকে দিলাম। 
 গুঞ্জা শান্তিনিকেতনে থাকে 
  তারা তিতলি খোঁজে কুসুমের ডালে

কথা - সাতকাহন। ঐ তো তোমার ঘর

।।  ঐ তো তোমার ঘর।।

ঐ তো তোমার ঘর। মাটির দেয়াল। খড়ের চাল। চাল নেমে এসেছে বারান্দা পর্যন্ত। দেয়াল অর্ধেক টা ভিজে। মেঝে স্যাঁতসেঁতে। উনুনে জল। যত জল নেমে যায় বুঝি তোমার ঘরের নীচে দিয়েই। ঘরের মেঝেতে একটা দড়ির খাটিয়া।
তোমার বিছানা। একটা শতরঞ্চি। একটা কাঁথা। আর একটা পাতলা চাদর।
এই তোমার ঘর!  এখানে ই তুমি থাক!
আশ্বিনে দুর্গাপূজা। এবার তুমি কোথাও যাওনি। গ্রামেই আছো। পাড়ার পুজো।
আমাকে নিয়ে গেছো। সেই প্রথম যাচ্ছি। দিদিমা কত করে সাবধান করেছে। আসানসোলে বাস থেকে নেমে, গ্রাম পর্যন্ত যাওয়ার যে একটা বাস চলত সেটা বন্ধ। তখন মিনি বাসের যুগ আসেনি। সেনর‍্যালে পর্যন্ত কিসে যেন একটা চেপে আসা হল। তারপর হাঁটা। তা ছাড়া উপায় কিছু নাই।
- তুমি হাঁটতে পারবে!
- হ্যাঁ । পারব
আমার মনে তো নানা কৌতুহল। উৎসাহ কম নয়।
বাবার ঘরে যাব। এখানেই আমার মা --
গ্রামের অনেকে সাইকেল কারখানায় কাজ করে। সাইকেল কারখানার সুন্দর সাজানো কোয়ার্টার।
ডিউটি সেরে বাড়ি ফিরছে এমন দুজনের সাইকেলের ক্যারিয়ারে বসে অনেক টা পথ আসা গেল। মরিচকোটা হয়ে
আঙ্গারিয়া। তারপর গ্রাম পর্যন্ত হাঁটা।
গ্রামের পথ উঁচু নীচু। একটা কুলি পার হলাম। কুলিতে ঝিরঝির জল বইছে। পথের ধারে একটা পাতকুয়ো। চারপাশ তার বাঁধানো নয়। ভুল হলেই একেবারে কুয়োতে। আসলে এটা একটা ঘরের কুয়ো। রাস্তা ঠিক নয়। গাঁয়ের গলিপথ।
পাশে ই একটা দুর্গামন্দির। সামনে ছোট্ট উঠোন। উঠোনের মাঝখানে বলির খুঁটো।
তারপর আবার একটা রাস্তা। রাস্তা মানে কুলি। সেই কুলিতেও জল বইছে। জল চলে যাচ্ছে নীচে দিকে। নিশ্চয়ই মাঠের দিকে।
রাস্তা পার হয়ে কিছুটা উঁচু জায়গা। সেই উঁচু জায়গার উপর দিয়ে রাস্তা চলে গেছে। মনে হচ্ছে যেন পশ্চিম দিকে যাচ্ছি।
রাস্তার দু'ধারে ঘরবাড়ি। পাশে দুর্গাদালান। প্লাষ্টার বিহীন ইঁটের ঘর।  
ঠিক তার উল্টো দিকের যে গলি টা, সেই গলি দিয়ে তারা  ঢুকল একটা  বড় মাটির ঘরে। এই ঘরটা নাকি জ্যাঠা দের। 
সবাই তাকে দেখছে। 
সেও সবাই কে দেখছে। 
এই তো প্রথম দেখা। 
------------ ------------ ------------ ------------ 
ছেড়ে যাবেন না। আরও কয়েকটি পর্ব দেব এখানে 
কথা - সাতকাহন  নামেই এই সব লেখা লিখেছিলাম। সেই সময় কে জড়িয়ে, এক একা বিষন্ন বালকের ডাউন মেমোরি লেন ধরে হাঁটা। 
 অনেক কথা। 
 এই সব লেখা গুলো কে একজায়গায় করার ইচ্ছে। 
 ফেসবুকে আমার অনেক বিশিষ্ট বন্ধু। 
একটা ভালো নাম সাজেস্ট করুন। 
 অনুরোধ।

Thursday, 11 July 2024

বনকাটি র পিতলের রথ।

।।বনকাটি র পিতলের রথ।।

  ।। বনকাটি র পিতলের রথ।।   প্রণব ভট্টাচার্য।৷   ১ ম পাতা

বন কেটে বসত কবে শুরু হয়েছিল  তা বলা কিছুতেই বলা সম্ভব নয়। গড়জঙ্গলের গায়ে গা লাগিয়ে এই এলাকা।
উত্তরে অজয়। গড়জঙ্গল থেকে নেমে এসেছে নালা। নালার নাম ' রক্তনালা '। পশ্চিমে ' গড়ঘাটা ' কে রেখে ' পাষাণ চণ্ডী '
বাগানের পাশ দিয়ে সে নালা গিয়ে মিশেছে অজয়ে। ' গড় ঘাটা' মানে গড়ে যাবার ঘাট। গড় জঙ্গলের ভিতর পর্যন্ত চলে গেছে এই নালা। কেন এই নাম?  ল্যাটেরাইট রাঙা মাটি র উপর জঙ্গল ভূমি। বর্ষায় সেই রাঙা মাটি ধোয়া লাল জল প্রবল বেগে গড়িয়ে আসে। তাই নাম রক্তনালা। আবার ধর্ম মঙ্গল কাহিনী তে ইছাই - লাউসেন যুদ্ধে নিহত সৈন্যদের রক্ত
গড়িয়ে এসেছিল এই নালা বেয়ে। আবার ইছাই আরাধ্যা দেবী  দশভূজা শ্যামারূপা র তন্ত্র মতে পূজার সন্ধিক্ষণে শত সহস্র
ছাগ  বলির রক্ত গড়িয়ে যায় এই নালা বেয়ে।
এই নালা দিয়ে আর অজয়ের জলপথে একদিন কত ব্যবসা
বাণিজ্য হয়েছে। সে সব কথায় আমরা পরে আসব।
  শুধু বনকাটি বললে ঠিক বোঝানো যায়না। অনেক বনকাটি আছে। আমাদের এই বনকাটি  অযোধ্যা - বনকাটি এলাকায়। আর জোড়ে না বললে আমাদের মনও ভরেনা। আর অবস্থান বোঝাতেও সুবিধা। বনকাটি। পোষ্ট বনকাটি। জে এল নং - ৩২।
এখনকার পশ্চিম বর্ধমান জেলা র  কাঁকসা থানা র অন্তর্ভুক্ত
এই এলাকা। সীমান্তবর্তী এলাকা। অজয়ের ওপারে উত্তরে
বীরভূম। গঞ্জ ইলামবাজার। ' বীরভূমের প্রবেশ দ্বার '। শুধু মাত্র বীরভূমের ই নয় সমগ্র উত্তর বঙ্গের প্রবেশপথ ইলামবাজারের উপর দিয়ে। ইলামবাজারে র উপর দিয়ে ই চলে গেছে এখনকার পানাগড় - মোরগ্রাম হাইওয়ে। এই পানাগড় - মোরগ্রাম হাইওয়ে র উপর ' এগারো মাইল ' বাসস্ট্যান্ডে  নেমে টোটো নিয়ে অযোধ্যা বনকাটি তে আসা যায়। বাসস্ট্যান্ড থেকে ৩ কিমি পথ। পাকা পিচ ঢালা রাস্তা।
যে দিক দিয়ে ই আসুন সে বোলপুরে নেমে বা পানাগড় বা দুর্গাপুরে নেমে। স্টেট বাস ; প্রাইভেট বাস সবই পাওয়া যায়।
দুর্গাপুর - বোলপুর বা দুর্গাপুরে ছেড়ে যে সব গাড়ি উত্তর বঙ্গের দিকে চলে যাচ্ছে সব গাড়িই থামে এই এগারো মাইল বাসস্ট্যান্ডে। কলকাতা - সিউড়ি  বাসও থামে। আসার বা ফেরার কোন সমস্যা নেই।
  কেন আসবেন! ''গড় জঙ্গল' দেখবেন না। দেখবেন না বিখ্যাত
ঐতিহাসিক পুরাকীর্তি ' ইছাই ঘোষের দেউল '। দেখবেন না
' মন্দির ময় অযোধ্যা বনকাটি ' কে। আর এই প্রবন্ধে আমাদের আলোচ্য বিখ্যাত সেই বনকাটির পিতলের রথ।
আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব তার একটা ছবি আপনাদের মনে এঁকে দেবার। কিন্তু নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস হবেনা
এই পিতলের রথের অলংকরণ এর অসামান্যতা।
এখন আসা যাওয়া তো সোজা। কিন্তু এর শিল্প সুষমা র সন্ধান পেয়েছেন শান্তিনিকেতন এ আচার্য্য নন্দলাল। তিনি তাঁর ছাত্র দের নিয়ে কমপক্ষে দুবার এসেছেন। আনুমানিক '৪২ -'৪৩ সালে। ছাত্র দের দিয়ে  স্কেচ করে বা রাবিং করে নিয়ে গেছেন।
  এঁরা তো তখন এসেছেন হয়তো গোরু গাড়িতে চেপে।
মুকুল দে মশাই গোরু গাড়িতে ই আসতেন। মৌখিরা র জমিদার  রায় বাবুদের আতিথ্য গ্রহণ করতেন। তাঁর তোলা সাদা কালো সব ছবি কথা বলে। সে সবই ইতিহাস। ওনার তোলা আমাদের এই বনকাটি র পিতলের রথের যে ছবি সে অনবদ্য।
  অমিয় কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় মশাই বোলপুর - দুর্গাপুর বাসে চেপে ' এগারো মাইল ' নামক গ্রামে নেমে পায়ে হেঁটে অযোধ্যা বনকাটি  পৌঁছেছেন। তাঁর ' দেখা হয় নাই ' বই টি তে চমৎকার বর্ণনা আছে।
    "দীর্ঘ দিনের অনুসন্ধানের পর তারাপদ সাঁতরা মশাই  সাহিত্য পত্র পত্রিকা য় ১৩৭৭ খ্রীঃ বর্ষা সংকলনে জেলা ভিত্তিক  ৪১ টি পিতলের রথের তালিকা প্রকাশ করেন।
কলকাতায় ২ টি ; বর্ধমানে ৪ টি ; বীরভূমে ৯ টি ; পুরুলিয়া য় ১ টি ; বাঁকুড়া য় ১২ টি ; মেদিনীপুর এ ৬ টি ; মুর্শিদাবাদে ৪টি
এবং হুগলি তে ৩ টি। "
" চিরাচরিত কাঠের রথের বদলে পিতলের রথ তৈরী হয়েছে নানা কারণে। প্রতিষ্ঠাতা রা প্রায় সব ক্ষেত্রেই ছিলেন বড় ভূস্বামী অথবা ধনী বণিক। অর্থ ব্যয় টা তাদের কাছে বড় কথা ছিলনা। একই আয়তনের কাঠের রথের থেকে পিতলের রথের
খরচ অনেক বেশী পড়লেও তাঁরা কাঠের ক্ষয়িষ্ণুতা ও পিতলের দীর্ঘস্থায়িত্বের কথা বিবেচনা করে এই ' নতুন ' সৃষ্টি র দিকে ঝুকেছিলেন। ' নতুন' বলছি এই জন্য যে শ্রীযুত সাঁতরা ও আমার দেখা যাবতীয় প্রতিষ্ঠালিপিসংবলিত পিতলের রথের মধ্যে বনকাটি র নিদর্শন টি প্রাচীনতম "
এটি র নির্মান কাল ১২৪১-৪২ বঙ্গাব্দ ( ১৮৩৪- ৩৫)
  রথের সামনের প্রতিষ্ঠা লিপি টি হুবুহু এখানে দেওয়া হল।
  ' সন ১২৪১ সান (ল!)তাঃ ২রা মাঘ য়ারম্ভ সন ১২৪২ সান (ল!) ১৫ ই য়াশাড় তোয়র '
সান কে সাল ধরাই মনে হয় ঠিক। ব্রাকেটের ভিতরে (ল!) দেওয়া এই প্রবন্ধ লেখকের।
  অর্থাৎ রথটি নির্মিত হয়েছে আজ থেকে  প্রায় ১৮৬ বছর আগে। ১৭৫৪ শকাব্দে অর্থাৎ ১৮৩২ ইং  সালে নির্মিত হয়েছে
পঞ্চরত্ন অসামান্য টেরাকোটা অলংকরণ এ সজ্জিত বিখ্যাত
গোপালেশ্বর শিব মন্দির। এই মন্দিরের আকৃতির অনুযায়ী
পঞ্চচূড়া রথ টি ও নির্মিত হয়েছে।
  নির্মাতা সেই সময়ের বিখ্যাত ধনী লাক্ষা বা গালা ব্যবসায়ী
জমিদার রামপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় পরিবার।
  মন্দির কে সামনে রেখে পিছনে ছিল দুর্গাদালান সমন্বিত ; দ্বিতল  বিরাট  প্রাসাদ। সেই প্রাসাদে ছিল ভূ গর্ভস্থ গুপ্ত কক্ষ।
সে প্রাসাদের একটি ভগ্ন দেওয়াল আজও দাঁড়িয়ে আছে।
কি ভাবে যে এত বড় মোটা দেওয়ালের প্রাসাদ টি এই ভাবে
ভেঙে পড়ল বা ইঁট কাঠ পাথর সব লুঠ হয়ে গেল ; ভাবলে অবাক লাগে। হতে পারে প্রাকৃতিক বিপর্যয়। ধন রত্নের লোভে
অনেক খোঁড়াখুঁড়ি হয়েছে। মাঝে প্রায় দু শো বছরের ব্যবধান।
আজ আর কে বলবে - এর ভেঙ্গে পড়ার কারণ।
    সেই সময় টাকে জানতে আমাদের ও পিছিয়ে যেতে হবে প্রায় দু শো বছর আগে। 

" অধ্যাপক হেনরি ব্লকম্যান এর মতে পাল আমলে কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থার আঞ্চলিক শাসন কর্তাদের " ভূম " এর অধিপতি দের ভৌমিক রাজা নামে আখ্যা দেওয়া হত। বিভিন্ন সূত্র হতে বারোটি ভূম বা ক্ষুদ্র জনপদের নাম জানা যায়।
যথা  বীরভূম ; সেনভূম ; শিখরভূম ;গোপভূম ; ব্রাহ্মণভূম ; মানভূম ; বরাভূম ; ধলভূম ; সিংভূম ; তুণভূম ; মাল ভূম ; ভঞ্জভূম।  উপরোক্ত ক্ষুদ্র জনপদ গুলির মধ্যে সেনভূম ; গোপভূম ; শিখরভূম ( আংশিক) বর্ধমান জেলার মধ্যে অবস্থিত। "
  প্রাচীণ সেই গোপভূম ; সেনভূম এর যে জঙ্গল মহল এখনকার আউসগ্রাম এবং কাঁকসা থানা এলাকার উত্তরাংশ
জুড়ে বিস্তৃত - যে জঙ্গল ভূমি র কথা উল্লেখ আছে হাণ্টার সাহেবের  Annals of Rural Bengal  এ।  মাত্র দুশো বছর আগে গুসকরা থেকে বরাকর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল সেই বনভূমি।
হিংস্র শ্বাপদের দল নির্ভয়ে বিচরণ করত এই জঙ্গলে। জঙ্গল কোথাও কোথাও এতই ঘণ ঘোর যে দিনের বেলাতেও সূর্যের আলো প্রবেশ করেনা। " মহাবৃক্ষ " রূপ শাল ই প্রধান বৃক্ষ।
আমাদের প্রাচীন শাস্ত্র গ্রন্থে তো শালবৃক্ষ কে মহাবৃক্ষ ই বলা হয়েছে। সেই বনভূমি সর্বাপেক্ষা সমৃদ্ধ অংশ টি  দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলার স্বার্থে বিসর্জন দিতে হয়েছে।
এই জঙ্গলভূমি এবং বীরভুম সীমান্ত লাগোয়া বা তার ও পশ্চিমের জঙ্গল ভূমি র নাম ই হয়ে গেছে " লা মহল "।
মানে লাক্ষা মহল। প্রাকৃতিক ভাবে প্রচুর লাক্ষা উৎপাদিত হয় এখানকার জঙ্গল ভূমি তে। শাল ; পলাশ ; পাকুড় ; কুসুম গাছে র ডালে ডালে লাক্ষা পোকারা ( Coccus Lacca)  তাদের দেহনিঃসৃত রস বা লালা দিয়ে বাসা বাঁধে। ঈষৎ হলুদ বা সাদা রঙের এই বাসা কিছুটা নলাকৃতি ; বা  গুটি গুটি।
কুসুম গাছের লাক্ষা সবচেয়ে ভালো। গাছের ডগার সেই সব
ডাল কেটে নিয়ে আসে মূলতঃ আদিবাসী সাঁওতাল বা নিম্ন বর্গের মানুষেরা। তারপর ডাল থেকে ছাড়িয়ে ভালো করে গুঁড়ো করে ; জলে ভিজিয়ে রাখা হয়। গরম জলে কার্পাস পাতা আর গন্ধক  মিশিয়ে ফোটানো হলে তৈরি হয়  ' যাবক ' বা আলতা। আগে এই আলতা মহিলারা ব্যবহার করতেন। এটি ভালো রঞ্জক পদার্থ ও বটে। সাদা কার্পাস সুতো রাঙানো হত। তাঁতি বাড়ির মহিলারা সে কাজ করতেন।
ভালো করে ছেঁকে নিয়ে ; আবার রোদে শুকিয়ে  গনগনে আগুনের তাপে গলিয়ে বাজার জাত করার জন্য নানা আকারের ছাঁচে ফেলিয়ে গোলাকার ; বোতামের মতো নানা আকৃতি র গালা তৈরি করা হয়। চমৎকার প্রাকৃতিক এই রেজিন তৈরী র পদ্ধতি গত কিছু পার্থক্য থাকলেও মুল এই ই।
  এই গালার তখন বিশাল বাজার। বিদেশে যথেষ্ট আদর।
অজয়ের এপারের গ্রাম বসুধা র ' লরি ' বা 'নুরি ' রা ভালো
গালা তৈরী করে। তবে ওপারে ইলামবাজার এ ডেভিড আরস্কিন সাহেবের বিরাট কুঠিবাড়ি। তিনি এই লাক্ষা বা গালার ব্যবসা ; নীলের ব্যবসা কে একটা বিরাট ব্যবসায়িক মাত্রা দিয়েছেন। একজন  কুঠি বাড়ি ভিত্তিক ব্যবসা র সফল
ব্যবসায়ী। সেদিনের গঞ্জ ইলাম বাজার গড়ে উঠছে। Trade Centre of importance.
হাণ্টার সাহেবের Stastical Accounts of Bengal - 1876 তে রয়েছে বড় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে গালার এই ব্যবসার উদ্বাধন ডেভিড আরস্কিন এর হাতে ই এবং নীল ; গালা ; কার্পাস বস্ত্র এর ব্যবসার মাধ্যমে সেই সময়ে মরে যাওয়া সামাজিক অর্থনৈতিক অবস্থা র ও কিছুটা উন্নতি হয়।
ইলামবাজার এর গালার কারিগর রা বরাবর ই ছিলেন।
তাঁরা ছোট আকারে ব্যবসা করতেন। গালার তৈরি নানা সামগ্রী তৈরী করতেন। গালা প্রস্তুতি র কাজটা ভালো ই জানতেন। আরস্কিন সাহেব সকলকে একত্রিত করে ব্যবসা টাকে বিরাট বাণিজ্যিক  আকার দিয়েছিলেন। নিশ্চিত ভাবেই নিজের লাভের জন্য 

সময়কাল বড়ই কণ্টকাকীর্ণ। ১৭৭০ এর (৭৬ এর)  মন্বন্তর এর পর সব ছারখার হয়ে গেছে। এই মহা মন্বন্তর এর পর বীরভূমের ৬০০০ গ্রামের মধ্যে ১৫০০ গ্রাম নিশ্চিহ্ন। কৃষিজমি সব পতিত পড়ে আছে। এপারের অবস্থা ও তাই। ভাত খাবার চাল নাই। যে চাল  এক টাকায় ২-৩ মন পাওয়া যেত সেইচাল টাকায় ৩ সের। তা ও তো অমিল। এই দরে কিনবে কে। কাতারে কাতারে মানুষ মারা যাচ্ছে। সুপারভাইজার
হিগিনসনের রিপোর্ট অনুযায়ী " বীরভূম বন্ধ্যা জনমানবহীন দেশ "। ১৭৭৯ সালে গরীব কৃষক দের স্বাভাবিক বিক্ষোভ দেখা দিল জমিদার আর কোম্পানির বিরুদ্ধে। কোম্পানি র ট্যাক্স আদায় কমছেনা বরং বাড়ছে। সারা বাংলা চষে বেড়াচ্ছে নানা ইউরোপীয়  কোম্পানি র লোকেরা। কোথায় হতে পারে কিসের ভালো ব্যবসা।
সাধারণ মানুষের বিক্ষোভ প্রবল হচ্ছে। পশ্চিম থেকে নেমে আসছে দুর্ধর্ষ ডাকাতের দল। তাদের সাথে যোগ দিচ্ছে স্থানীয় রা। আরস্কিন সাহেবের কুঠিবাড়ির  পাহারা সত্বেও দিনের আলোয় ইলামবাজার লুঠ হচ্ছে। ভেঙে পড়েছে সাধারণ এর অবস্থা। শুকবাজারের তাঁতিদের বাঁচাতে সুরুল কুঠি থেকে সেপাই চেয়ে পাঠানো হচ্ছে। সেই ১৭৭৯ সাল। অজয়ের
এপারে অযোধ্যা বনকাটি র ধনী  চট্টোপাধ্যায় পরিবারে ডাকাতি হচ্ছে।
১৭৯২ সালের সেই সময়ে গালা ব্যবসার একটা হিসাব - ৫০০ মন গালার জন্য ১০ ০০০ টাকা এবং ১৮০০ সালে ৫৪৪ মন গালার জন্য ৯৯১৫ মুদ্রা পেয়েছিলেন আরস্কিন সাহেব।

  বনকাটি তে কয়েকটি ব্রাহ্মণ পরিবার একসাথে জোট বেঁধে থেকে  একসাথে ই নানা ধরনের ব্যবসা করেন। কাঠকয়লা ;
নানা বনজ দ্রব্য। পরবর্তী তে কয়লা। আর লাক্ষা তো প্রধান।
এঁদের মধ্যে মুখোপাধ্যায় পরিবার ব্যবসায় যথেষ্ট  অগ্রনী।
  বনকাটি তে মাল গুদাম জাত করে পরে ছোট নৌকো দিয়ে
রক্তনালা বেয়ে অজয়ের জলপথে মাল নিয়ে যাওয়া।
অজয়ের শিমূল তলার ঘাট তখন খুবই কর্মব্যস্ত। গোরুর গাড়ি র সার লেগে ই আছে। মালের ওঠা নামা। মাল যাচ্ছে কুঠিবাড়ি তে। ইলামবাজার সাহেব কুঠির সাথে ব্যবসা। আবার স্বাধীন ভাবে ও ব্যবসা। ব্যবসা সূত্রে এখানকার বাবুরা পৌঁছে গেছেন
কলকাতা। নানা সাহেব কোম্পানি র সাথে ; ব্যবসায়িক হৌসের সাথে স্বাধীন ব্যবসা। শোনা যায় উদ্বৃত্ত টাকা মুখোপাধ্যায় বাবুরা নিয়োগ করতেন অন্য ভাবে ও। এবং বিশাল ধনী হয়ে
উঠছেন তাঁরা।
রায় পরিবারের বর্তমানে জীবিত  প্রায় ৮০ বৎসর বয়সী শ্রী অনিল রায় মশাই এর কাছ থেকে শোনা এই মুখোপাধ্যায় পরিবার  তাঁদেরই বাড়ির জামাই। এঁরা তখন বসুধায় অবস্থান করছিলেন। বসুধার লরি দের গালা তৈরী সম্পর্কে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা ছিল। সম্ভবত বসুধার লরি দের শিব মন্দির গুলির  পূজারী ব্রাহ্মণ। রামপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় মশাই ব্যবসাটাকে
ধরলেন দক্ষ হাতে। বিপুল অর্থাগম ছাড়া  ঐ প্রাসাদ ; মন্দির ;
বা পিতলের রথ তৈরী করানো সম্ভব নয়। ১৭০৪ শকাব্দ থেকে শুরু করে পরবর্তী ৫০-৬০ বছর ধরে চলেছে নানা নির্মানকার্য্য।
শোনা যায় একদিনের গালার ব্যবসা র আয় থেকে না কি তৈরী করানো হয়েছে পিতলের এই রথ। তখনকার দিনে একটি
মন্দির নির্মানে খরচ হত ৮-৯ হাজার টাকার মতো। তাহলে
লোহার ফ্রেমের উপর পিতলের পাত দিয়ে মোড়া এই প্রায় ১৫ ফুট উচ্চতা র এই রথের খরচ কত হতে পারে  তার হিসেব পাঠক মনে মনে করুন একবার।
 
  রথটি প্রায় ১৫ ফুট উচ্চতা র। ৮ টি লোহার চাকা। লোহার শক্ত ফ্রেম। প্রায় সম চতুষ্কোণ প্লাটফর্ম।  ১ ম তলের দৈর্ঘ্য প্রস্থ
৬' ৫"  আর ২ তলের দৈর্ঘ্য প্রস্থ ৪' ৫''। আগেই বলা হয়েছে পাঁচ চূড়া। প্রধান চূড়ার উপর বিষ্ণু চক্র। গোটা রথ ই লোহার ফ্রেমের উপর পিতলের পাত দিয়ে মোড়া। সারা গায়ে অজস্র অলংকরণ। এত  তার বিচিত্রতা ; এবং স্বতঃস্ফূর্ততা যে অবাক হতেই হয়।
" নকশার নির্বাচনে সংশ্লিষ্ট  ধাতুশিল্পীরা মন্দির টেরাকোটা শিল্পী দের কল্পলোকেই শুধু বিচরণ করেন নি। তাঁদের এবং পটুয়া শিল্পী দের আঙ্গিকের ও অনুসরণ করেছেন নিষ্ঠার সঙ্গে। রামায়ণ ; মহাভারতের উপাখ্যান ; পৌরাণিক কাহিনী
দশাবতার ; সামাজিক মায় ফিরিঙ্গি জীবন চিত্র ; শিকার ;
প্রমোদ ভ্রমণে র দৃশ্য ; ও অজস্র ফুলকারি নকশা স্থান পেয়েছে বনকাটির রথের গায়ে। "
সম্ভবতঃ খড়ি দিয়ে প্লেটের উপরে নকসা এঁকে নেওয়া হত।
তারাপদ সাঁতরা মশাই তাঁর অনুসন্ধানে ' খড়িপেত্যে ' নামে এক শিল্পী গোষ্ঠী র নাম বলেছেন। তা যদি হয় একদল নকসা এঁকেছেন। আরেক দল খোদাই করেছেন। মাত্র ৬ মাসের মধ্যে
কাজ শেষ করতে হয়েছে। অর্থাৎ অনেককে নিয়োজিত করতে হয়েছে।
  পিতলের পাত ধরে নেওয়াই যায়  যে সেই সময়ের বিখ্যাত পিতল কাঁসার কেন্দ্র কেন্দুলী - টিকরবেতা  বা আদুরিয়া - অমরপুর এর কর্মকারেরা বানিয়েছেন। ঢালাই এর যে কাজ
আছে রথের ' মৃত্যুলতা ' বা বর্শায় তা এখানের ই।
রথের সারথি ; এবং দু টি ঘোড়া তাও পিতলের। ধরে নেওয়া ই যায় তা এখানের। স্থানীয় শিল্পী কারিগর দের সহায়তা আছেই।
আটটি ভারী চাকা। তার লোহার ফ্রেমিং অর্থাৎ কাঠামো বানানো ; জোড়ের কাজ করা ( এখন কার মতো ওয়েল্ডিং)  এর যুগ নয়। সে বড় সহজ কাজ নয়।
আর নকসা অঙ্কনের কাজ যে বা যাঁরা ই করে থাকুন না কেন
তাঁরা অন্ততঃ টিকরবেতা বা অমরপুরের নন। এঁদের কাজের
থেকে এখানের কাজ উচ্চাঙ্গের। রেখার চলন অনেক সাবলীল স্বতঃস্ফূর্ত। বাবুরা কলকাতা থেকে শিল্পী দের নিয়ে এলেন। এমন অনেক শিল্পী তো তখন আপার চিৎপুর এলাকায়  ছিলেন। এলাকার প্রাচীণ মানুষেরা বলেন মুখুজ্জে বাবুরা কলকাতা থেকে সবাইকে নিয়ে এসেছিলেন।
" শেষ মধ্যযুগে বাঙালী সূত্রধর শিল্পীরা কাষ্ঠ ;পাষাণ ; মৃত্তিকা ও চিত্র এই চারটির মাধ্যমে যে উচ্চাঙ্গের শিল্পচর্চা করে গিয়েছেন ঠিক এই সময়টিতে তার কিছু অবনতি ঘটলেও পাথরের স্থাপত্য ভাস্কর্য্য ছাড়া অন্যগুলি অল্পবিস্তর সজীব ই ছিল। সেজন্য কাঠ খোদাই ; পোড়ামাটির মন্দির অলংকরণ
বা পটচিত্রের আঙ্গিকের সাথে পিতলের রথের নকাশি কাজের
বেশ সাদৃশ্য দেখা যায়। "
  " এই বইয়ের অন্যত্র সন্নিবিষ্ট বনকাটি র পিতলের রথ থেকে
আহৃত বলরাম ও বেহালা বাদিকার ছবি দুটি যে মন্দির টেরাকোটা র সগোত্র তা যে কোন অভিজ্ঞ ব্যক্তি র ই নজরে পড়বে। আবার বলরামের ছবিটি র সঙ্গে পটচিত্রের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা বর্ণনার অপেক্ষা রাখেনা। সেজন্য সূত্রধর শিল্পী রা যে পিতলের মাধ্যমে কাজ করেছেন এরকম একটা ধারণা হওয়া স্বাভাবিক। যদিও এ বিষয়ে অকাট্য কোন প্রমান নেই।
তবে কাঁসারী বা কর্মকার সম্প্রদায়ের কারিগর যাঁরাই এ শিল্পের চর্চা করে থাকুন না কেন ; সমকালীন সূত্রধর শিল্পীদের
কলাকৌশল যে তাঁদের খুবই প্রভাবিত করেছিল তা সন্দেহাতীত। "
কে না মুগ্ধ হয়েছেন এই রথের অলংকরণ দেখে। এর সহজ ; সাবলীল ; স্বতঃস্ফূর্ত রেখার চলন দেখে। বিষয় বৈচিত্র্য দেখে। এত বিষয়ের সন্নিবেশ কমই দেখা যায়। মহিলা জিমন্যাস্ট ; পাখি শিকার ; চরকের দৃশ্য ; সহ নানা সামাজিক চিত্রন। এই রথের অলংকরণ দেখে মুগ্ধ হয়েছেন আচার্য্য  নন্দলাল।
এই রথের একটি কৌতুককর চিত্রের অনুকরণে কালো বাড়ির
গায়ে রিলিফ ভাস্কর্য করিয়েছেন। টিকিধারী পিঠ বাঁকা এক বৃদ্ধের পিঠে বসে বানরের ছানা। বেশ মজার ই বটে।
  বিশিষ্ট শিল্পী মুকুল দে খড়ের গাদার পিছনে অবহেলায় পড়ে থাকতে দেখেছেন অমূল্য এই শিল্পকীর্তি টিকে।
শ্রী অমিয় কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় মশাই এসেছেন কষ্ট করেই এগারো মাইল থেকে হেঁটে অযোধ্যা হয়ে বনকাটির এই রথের সামনে। তাঁর অমূল্য লেখা থেকে এখানে নানা অংশ  উদ্ধৃত করা হয়েছে। শ্রী গুরুসদয় দত্ত মশাই বীরভূমের জেলা শাসক থাকা কালীন লোক শিল্পের সন্ধানে অবিশ্রান্ত ঘুরেছেন।
বীরভূমের প্রতি তাঁর বিশেষ ভালোবাসা ছিল। বারবার বীরভূমে ফিরে ফিরে এসেছেন। আর এ তো সংলগ্ন এলাকা। একই মাটি। মাঝে শুধু অজয়। এপার আর ওপার।
তিনি বলেছেন  যেন গুটিয়ে রাখা পট চিত্র কে মেলে ধরা হয়েছে তার সকল সৌন্দর্য নিয়ে।
  এই রথে রয়েছে দু টি erotic চিত্রণ। মুকুল দে মশাই লিখেছেন " Among the engravings on the ratha there are also two erotic subjects. As this type of erotic
engraving in temples is not common in Birbhum ".
  পুরোহিত ব্রাহ্মণ কে তিনি এই চিত্র দু টি কেন এই রথের গায়ে
জিজ্ঞাসা করেছেন। ব্রাহ্মণ উত্তর দিয়েছেন রথের মেলায় অনেকে দেখে আনন্দ পায়। তিনি যে খুব ভুল বলেছেন তা নয়।
  মানুষ তো মজা পায় ই। মেলার মজা তো আলাদা ই। গ্রাম বাঙলায় চাষের আগে রথের মেলা সে এক বিশেষ আনন্দ।
পাঁপড় ভাজা ; গরম জিলিপি ; আর  ঘুড়ি ওড়ানোর আনন্দ।
  এই erotic চিত্র দুটির বিষয়ে অন্যত্র ও আমি লিখেছি।
আমি যেভাবে দেখেছি। বুঝেছি শিল্পী মনকে।
রথের উপরের দিকের গঠন অনুযায়ী অর্ধবৃত্তাকার প্যানেল।
সেভাবেই সাজানো যুদ্ধের দৃশ্য। সৈন্য দলের যুদ্ধ যাত্রা র দৃশ্য।
  এই যুদ্ধে যাওয়া ই কি শেষ যাওয়া!  তার আগে শেষবারের মতো ই কি নরনারী র শারীরিক মিলন ?  দুপাশে দু টি মৈথুন দৃশ্য।  ভাবায়।
যুদ্ধ অবিরাম।  রথের গায়ে লিখিত  ' কুরূক্ষেত্র "। সম্মুখ ভাগের প্রধান চিত্র  ভীষ্মের শরশয্যা। অর্জুনের লক্ষ্যভেদ। রাম
রাবণের যুদ্ধ।
আর এক দিকে সবার উপরে  ' নবনারীকুঞ্জর '।
নীচে ' রাম সীতার রাজ্যাভিষেক "
আর এক দিকে লেখা ' সুধন্নার জুর্ধু '
  অপর এক দিকে ' অক্রুর গমন '। চৈতন্য লীলা র নানা দৃশ্য।
শরশয্যায় ভীষ্মকে অর্জুন মাটিতে তীর নিক্ষেপ করে পাতাল গঙ্গা থেকে জল উত্তোলিত করে পান করাচ্ছেন।
নীচের দিকে থাকলেও 'সমুদ্র মন্থন ' একটি অনেক গুলি ফিগার সমন্বিত চিত্র। প্রতিটি চিত্রে ই শারীর সংস্থান বা কম্পোজিশন বেশ উঁচু মানের।
কি ধরনের ধৈর্য ; নিষ্ঠা ; শিল্পের প্রতি ভালোবাসা ;শিল্পজ্ঞান থাকলে এই জাতীয় অঙ্কন সম্ভব ভাবলে অবাক হতে হয়।
নমস্য সেই সব শিল্পী রা। তাঁরা স্থানীয় বা আগত সূত্রধর ই হোন আর কর্মকার যাই হোন না কেন  তাঁরা রেখে গেছেন
অমর এক শিল্পকীর্তি।
 পুরুষানুক্রমে বর্তমান  সেবাইত
নীলমণি রায় ( বয়স ৬৭)।
কিন্তু মুকুল দে র লেখায়  বা অন্যত্র রামপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এর নামই আমরা পাচ্ছি। যদিও বিশাল  ছিল না কি এই মুখোপাধ্যায় পরিবার। ব্যবসা সূত্রে এক শাখা কলকাতা তেই না কি বসবাস করতেন। আবার মারাত্মক কলেরায় এই পরিবারের কয়েকজন একদিনে ই মারা যাওয়ায় তাঁরা স্থান ত্যাগ করেন।
আবার এমনটা ও শোনা যায় যে ওয়ারেন হেস্টিংস এর অনেক গোপন অসাধু কারবারের কথা জানতেন এঁরা।
বর্দ্ধমানের রাজা দের সাথে যথেষ্ট সুসম্পর্ক ছিল। রাজা
ত্রিলোকচাঁদ কে ইংরেজ রা আক্রমণ করতে পারে ভেবে
রাজা সেনপাহাড়ী কেল্লায় অবস্থান করছিলেন। রাজা চিত্রসেন এই কেল্লা বানিয়েছিলেন। কামান এনে বসিয়েছিলেন। তার আগে ১৭৪০-৪৪ নাগাদ রাজা চিত্রসেন
এই সেনপাহাড়ী পরগনার ( বর্তমানের থানা কাঁকসা) পুনর্গঠনের কাজ করেছিলেন। রাজা ত্রিলোকচাঁদ ছিলেন
স্বাধীন চেতা।  সিরাজের বিরুদ্ধে যে চক্রান্ত হয়েছিল তাতে তিনি এবং বীরভূমের পাঠান রাজা আসাদুল্লাহ খান যোগদান
করেন নাই। হেষ্টিংসের বিরুদ্ধে মহারাজ নন্দকুমার এর অভিযোগ পত্র নিয়ে তখন মামলা চলছে। নন্দকুমার এর পক্ষে
স্থানীয় বিশিষ্ট ধনী প্রভাবশালী জমিদার রা যাতে সাক্ষ্য দিতে না পারেন বা না দেন তার জন্য  নানা ভাবে চাপ তৈরি করা হয়।
শোনা যায় মেজর হোয়াইট নাকি এই মুখোপাধ্যায় পরিবার এর উপর প্রবল চাপ তৈরি করেছিলেন। আক্রান্ত হবার ভয়ে
রাতারাতি না কি এই স্থান তাঁরা ত্যাগ করেন বা ত্যাগ করতে বাধ্য করানো হয়। নানা জায়গায় তাঁরা ছড়িয়ে যান।
  আর এক বাল্যের স্মৃতি এই রথের সব অলংকরণ চিত্র কপি
করে নিয়ে গেছেন জনৈক মন মোহন দাস। বছরে একবার
নিজেদের গাড়ি নিয়ে দিল্লি থেকে স্বামী স্ত্রী আসতেন। নীলমণি রায়ের পিতা প্রয়াত শম্ভুনাথ রায়ের মাটির একটি বাইরের উপর কোঠা ঘরে তাঁরা থাকতেন। আর রথ চিত্র কপি করতেন।
নিশ্চিত ভাবেই ব্যবসায়িক কারণে ই।
  আগে রথ টিকে তেঁতুল দিয়ে মাজানো হত। পিতলের রথ চকচক করত। সামগ্রিক খরচ বহন করতেন  উখরার জমিদার রা। রাণী বিষ্ণুকুমারী র একটা সদর্থক ভূমিকা ছিল। তিনি ছিলেন উখরার হাণ্ডা জমিদার পরিবারের মেয়ে। পরবর্তী কালে তা বন্ধ হয়ে গেলে আর রথ মেজে পরিষ্কার করা হয়না।
  রথের মেলা আজও বসে। আগে রথ যেত অযোধ্যা গ্রামের উত্তরে আমবাগানের ' রথ তলার ডাঙায় '। এখন আর এতটা টেনে নিয়ে যাওয়া হয়না। অযোধ্যা -বনকাটি হাটতলা পর্যন্ত রথ টেনে নিয়ে যাওয়া হয়। ছোট্ট গ্রামীণ মেলা বসে।
চারপাশের গ্রাম থেকে অনেক মানুষ এই মেলায় আসেন।
  রথের রশি ধরেন অনেক মানুষ ভক্তি ভরে আর রথের বিগ্রহ
এখানে জগন্নাথ নন। গোপাল বা গোপালেশ্বর।
" ভক্তেরা লুটায়ে সবে করিছে প্রণাম "।
----------- ----------- ----------- ----------- ----------- -----------  -------
গ্রন্থ সহায়তা।  দেখা হয় নাই। শ্রী অমিয় কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়
  বীরভূম জেলা গেজেটিয়ার।  ও ' ম্যালি
বর্ধমান ঃ ইতিহাস ও সংস্কৃতি। শ্রী যজ্ঞেশ্বর চৌধুরী
সাক্ষাতকার। শ্রী অনিল রায়  বয়স ৮০।
  শ্রী নীলমণি রায়। বয়স ৬৭।
শ্রী আশীষ মুখোপাধ্যায়। বয়স  ৬৫।
নিজস্ব ক্ষেত্র সমীক্ষা এবং নিজের লেখা নানা প্রবন্ধ।
  বঙ্গ সংস্কৃতির অঙ্গনে। সম্পাদনা শ্রী স্বপন ঠাকুর। নিজের প্রবন্ধ।
সাপ্তাহিক বর্তমান। নিজের লেখা প্রবন্ধ।
রাঢ়ভাবনা পত্রিকা। সম্পাদক। শ্রী সৌরেন্দ্র নাথ চট্টোপাধ্যায়
  " বীরভূমের নীল গালা রেশম শিল্প।  বিশেষ সংখ্যা।
ফেসবুক পোষ্ট। সৌজন্যে। শ্রী সত্যশ্রী উকিল। শুভদীপ সান্যাল৷ ইন্দ্রনীল মজুমদার।
চিত্র ঋণ। সত্যশ্রী উকিল। সাদা কালো ছবি। মুকুল দে মশাই এর তোলা। 
----------- ----------- ----------- ----------- ----------- ---  সমাপ্ত

 

 
Show quoted text

Wednesday, 10 July 2024

অজয়ের এপার ওপার ঃ মন্দির নির্মান সমূহ

।। অজয়ের এপার ওপার ঃমন্দির সমূহ নির্মান ।  সেই সময় কাল।।  প্রণব ভট্টাচার্য।

 অজয় ই সীমারেখা। 
উত্তরে বীরভূম। দক্ষিণে বর্ধমান। 
এপার এবং ওপার  দুপারেই  অনেক গুলি মন্দির। 
 টেরাকোটা অলংকরণ শোভিত। 
এই মন্দির গুলির নির্মানকাল এবং নির্মানকর্তা দের সম্পর্কে যতটা জানা যায়, শুরুতে তারই আলোচনা করে নেওয়া যাক। 

বনকাটি অযোধ্যা এই এলাকা দিয়েই শুরু হোক । এই এলাকায় লোকমুখে একটা কথা আছে " চারঘর মিলে একটি পুকুর এবং একশো হাত দূরে দূরে ঠাকুর থান "।
কথাটা মোটেই মিথ্যা বা অতিকথন নয়।
বনকাটি অযোধ্যা ঃ  রায় কালীবাড়ি প্রাঙ্গণে উত্তর মুখী দুটি আটচালা রীতি র মন্দির  ১৭০৪ শকাব্দে। ১৭৮২ খ্রীস্টাব্দে।
পূর্ব মুখী শিখর দেউল রীতি র  ১৭৫৬-৫৭ শকাব্দ। ১৮৩৪ খ্রীস্টাব্দে।
ঐ প্রাঙ্গণে আছে প্রাচীণ দালানের ভগ্নাবশেষ। সমসাময়িক নির্মান। বরানগরের দিদির নির্মান বলে কথিত মুখোমুখি মন্দির দুটি খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সমসাময়িক নির্মান। চমৎকার ছোট ছোট টেরাকোটা প্লাক ছিল। 
ভগ্ন দুর্গাদালান দক্ষিণ মুখী,  পশ্চিম মুখী বিষ্ণু দালান ; উত্তর মুখী আটচালা রীতি র শিবমন্দির। নির্মান কাল ১২২৪ বঙ্গাব্দ বা ১৭৩৮-৩৯ শকাব্দ। নন্দকুমার রায় কর্তৃক নির্মিত।
রাজমিস্ত্রী ছিলেন বনপাশ গ্রামের গোলক নাথ রাজ।
এক চট্টোপাধ্যায় পরিবারের চারচালা রীতি র শিবমন্দির টি র
নির্মানকাল প্রায় সমসাময়িক।
রায় পরিবারের কালীবাড়ি ১৭০৪ শকাব্দ নাগাদ ই তৈরী হয়েছে। দক্ষিণের দ্বিতল বিষ্ণু দালান এবং ভূগর্ভে বসে যাওয়া
পাকা বাড়ি  সম্ভবত আরও প্রাচীণ।
বিখ্যাত টেরাকোটা অলংকরণ সমন্বিত গোপালেশ্বর শিব মন্দির  ১৭৫৪ শকাব্দে নির্মিত।
পিতলের বিখ্যাত রথ। ১২৪২ বঙ্গাব্দে নির্মিত।
নির্মানকারী সেই সময়ের বিখ্যাত লাক্ষা ব্যবসায়ী, ধনী, জমিদার রামপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়।
অযোধ্যা ঃ  কর্মকার পাড়ার একই উচ্চ ভিত্তি ভূমির উপরে পাশাপাশি চারটি শিবমন্দির বিখ্যাত। কোটা শীর্ষার কর্মকার জমিদারেরা বানিয়েছিলেন এই মন্দির গুলি। আনুঃ দুইশত বছরের মধ্যে ই।
চট্টোপাধ্যায় বা মুখোপাধ্যায় পরিবারের ছোট চালা রীতি র শিবমন্দির ১৭০৭ শকাব্দে নির্মিত। দুর্গাদালান বা বিষ্ণু দালান
সহ।
অপর চট্টোপাধ্যায় পরিবারের শিবমন্দির এবং কালীমন্দির
বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের শিবমন্দির পরবর্তী সময়ে র।
পুরনো হাটতলার  গঙ্গা রামেশ্বর শিবমন্দির ১৮৭৩ বা ১২৮০ বঙ্গাব্দে র পরবর্তী সময়ে নির্মিত। এখানে মোহান্ত এলোকেশী
ঘটনার প্লাক আছে। প্রতিষ্ঠা লিপি কবেই হারিয়েছে।
বেণে পরিবারের শিবমন্দির ১২৭২ বঙ্গাব্দে বা ১৭৮৭ শকে নির্মিত। বেণেরা যথেষ্ট ধনী ছিলেন। গুড় থেকেচিনি। এবং নানাবিধ ব্যবসা ছিল তাঁদের।।
ভগ্ন প্রায় বিষ্ণু দালান দাঁ পদবীর বেণে দের তৈরী।
অতি চমৎকার টেরাকোটা অলংকরণ সমন্বিত ছিল এই বিষ্ণু দালান। যদিও এই মন্দির প্রতিষ্ঠা হয়নি বলেই শোনা যায়। কিন্তু কারণ জানা যায়না। 
ছিল এক প্রাচীন ধর্মরাজ মন্দির। ছোট্ট কিন্তু সুন্দর। বর্তমান সময়ে বেশ কয়েকটি মন্দির নির্মানসহ 
দুটি বিষ্ণু দালান চমৎকার ভাবে সংস্কার করা হয়েছে।
প্রাচীণ ধর্মরাজ মন্দির গ্রাম প্রতিষ্ঠা র সাথে নির্মিত। প্রাচীণ বটবৃক্ষ বা অশ্বত্থ তার সাক্ষী।
ঘটক পাড়ার আটচালা রীতি র শিবমন্দির টি একেবারে ভেঙে গেছে। অন্য আরও তিনটি মন্দির ছিল। দুটি নিমটিকুড়ি গ্রামের মণ্ডল দের।

প্রতিবেশী এলাকা ঃ কালিকাপুর মৌখিরা।
মৌখিরা কল্যানচকের একই প্রাঙ্গণে ১১ টি মন্দির। দুর্গাদালান সহ।
প্রাচীণ তম দক্ষিণমুখী চালা রীতি র শিবমন্দির টি ১২০০-১২০৩ সালে নির্মিত।
বিষ্ণু মন্দির। ১৭২৩ শক। বাংলা ১২০৮ সাল।
পূর্ব মুখী বা পশ্চিম মুখী, উত্তর মুখী, মন্দির গুলি এই সময়কালের  মধ্যবর্তী সময়ে নির্মিত।
গ্রামটি মন্দিরময়। ছড়িয়ে আছে অনেক মন্দির কিন্তু কোন টির ই আর প্রতিষ্ঠা লিপি নাই।
বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের শিবমন্দির এবং সংলগ্ন বিষ্ণুদালান
  উল্লেখযোগ্য।
পুরনো মৌখিরার মেটে পাড়া য় একটি ছোট ভগ্ন চালা রীতি র
শিবমন্দির এবং সংলগ্ন ধর্মরাজ মন্দির এবং দুইটি শিখর রীতি র শিবমন্দির রয়েছে। নির্মানকাল -
কালিকাপুর ঃ প্রাসাদের সামনে উঁচু বেদীর উপর পাশাপাশি দুটি দক্ষিণ মুখী দেউল রীতি র শিবমন্দির। পরমেশ্বর আর হংশেশ্বর শিবের নামে। পরমানন্দ রায় ই নির্মাতা। নির্মানকাল
১২৪৬ বঙ্গাব্দ বা ১৭৬১ শকাব্দ। ১৮৩৯ ইং সাল।
 
ইলামবাজার ঃ তিনটি বিখ্যাত মন্দির। হাটতলার গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু র মন্দির। আসামান্য জ্যামিতিক নকশা সহ টেরাকোটা র কাজ সমন্বিত। সময়কালের হদিস নাই।
রামেশ্বর শিবমন্দির। রামধন চট্টোপাধ্যায় প্রতিষ্ঠিত। চমৎকার টেরাকোটা শোভিত।
ক্ষুদিরাম বন্দ্যোপাধ্যায় কর্তৃক নির্মিত বিষ্ণু মন্দির। এর টেরাকোটার কাজ অতুলনীয়।
১৮৪৬- ৫০ ইং সালের মধ্যে নির্মিত।
ঘুড়িষা ঃ বিখ্যাত টেরাকোটা অলংকরণ যুক্ত দুই টি মন্দির।
বেনে পাড়ার ক্ষেত্রনাথ দত্ত প্রতিষ্ঠিত বিরাট আকৃতি র
বিষ্ণু মন্দির। নির্মাণকাল -
ভট্টাচার্য পাড়ার রঘুনাথ জীর মন্দির। অসামান্য সুক্ষ্ম টেরাকোটা কাজ সমন্বিত। চালা রীতি র মন্দির। উঁচু ভিত্তি ভূমির উপরে। বীরভূম জেলার দ্বিতীয় প্রাচীণতম মন্দির।
রঘুত্তম আচার্যা এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা। এখানে রঘুনাথ জীর
সোনার বিগ্রহ ছিল। বর্গী আক্রমণের সময় লুণ্ঠিত হয়।

১৬৩৩ খ্রীস্টাব্দে নির্মিত।  মলুটি নিকটবর্তী মাসড়া র একই রীতি র শিবমন্দির টি ১৬৩১ সালে নির্মিত।
  বিশাল গ্রাম ঘুড়িষা। জেলার দ্বিতীয় বৃহত্তম। এখানে আছে সর্প ছত্রধারী জৈন তীর্থঙ্কর পার্শ্বনাথ এর এক ক্ষয়প্রাপ্ত শিলা মূর্তি।
  একদা জৈন এবং বৌদ্ধ ধর্ম এই এলাকায় যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে ছিল।
আদুরিয়া অমরপুর ঃ অমরপুরের কর্মকার পাড়ার প্রথম নির্মিত চালা রীতি র  উচ্চ বেদীর উপর শিবমন্দির টি
১২২৩ বঙ্গাব্দে এবং পাশাপাশি দুটি শিবমন্দির ১২৩৯ বঙ্গাব্দে
নির্মিত। অন্যান্য মন্দির গুলি ও সমসাময়িক।
আদুরিয়া গ্রামের এক কর্মকার পরিবারের সামনে নির্মিত শিবমন্দির টি ও সমসাময়িক।
লবণধার ঃ  এখানের শিবমন্দির গুলি ১৭৫১ শকাব্দে বা ইং সাল ১৮২৯ এ নির্মিত। সুন্দর টেরাকোটার কাজ ছিল। নষ্ট প্রায়। বিলাসপুর গ্রামের গ্রামমধ্যস্থ শিবমন্দির টির সংস্কার(!)  করা হয়েছে.। প্রায় সমসাময়িক। প্রতিষ্ঠা লিপি নাই।
অধিকাংশ মন্দির ই প্রতিষ্ঠা লিপি হীন। লিপি চুরি গেছে।
একটু বড় গ্রাম হলে শিবমন্দির থাকবেই। সাধারণত সেই গ্রামের ভূস্বামী দের নির্মান৷
কাঁকসা থানার গোপালপুর এর মতো বিরাট গ্রামে অনেক শিবমন্দির রয়েছে। কোন টির ই প্রতিষ্ঠা লিপি নাই।
মিশ্র বাড়ি বা পাল,  বাড়ির  নিকটস্থ  বৃহদাকার মন্দির।
বৈষ্ণব অস্থলের কাছে একটি প্রাচীণ মন্দির রয়েছে। সামান্য টেরাকোটা র কাজ ও আছে। কিন্তু সমস্যা সেই একই।
পানাগড় গ্রাম,  সিলামপুর ; আমলাজোড়া , বামনাবেড়া ; বান্দরা ; বামুনাড়া
আড়ঢ়া ; , কুলডিহা ; মলানদিঘী,  শিবপুর, আকন্দারা
রক্ষিতপুর, তেলিপাড়া ; পিয়ারীগঞ্জ ; রঘুনাথপুর গ্রামে  প্রতিষ্ঠা লিপি হীন শিবমন্দির গুলি রয়েছে।
বামুনাড়া গ্রামে রয়েছে একটি অতি চমৎকার  নটরাজ মূর্তি।
আড়ঢ়া বামুনাড়া গোপালপুর   প্রাচীণ ইতিহাস সমৃদ্ধ গ্রাম।
আড়ঢ়া গ্রামের পোড়েল পুকুর সংস্কার করার সময় পাওয়া গিয়েছিল অনেক বৌদ্ধ মূর্তি। ধর্মরাজতলায় এখনও রয়েছে
একটি পাথরে ক্ষোদিত বৌদ্ধ মূর্তি।
আড়ঢ়া গ্রামের বিখ্যাত শিবমন্দির। প্রস্তর নির্মিত উড়িষ্যা নাগর রীতি র অসামান্য মন্দির। বিশাল শিবলিঙ্গ।
এলাকার চারপাশে চোখ বুলালেই  এর প্রাচীণত্বের আভাস মিলবে। এই মন্দির সেন রাজাদের আমলে ( সম্ভবত রাজা বল্লাল সেনের আমলে)  নির্মিত।
ইছাই ঘোষের দেউল এক অনবদ্য প্রাচীন পুরাকীর্তি।
শিখর দেউল রীতি র নির্মান। পাতলা টালির মতো ইঁট দিয়ে তৈরী। প্রায় ৮০ ফুট উচ্চ। ব্রিক কাট পদ্ধতিতে ক্ষোদিত চার দিকের নানা দেবদেবী র মূর্তি বিনষ্ট প্রায়। এটি কিন্তু কোন
মন্দির নয়। ইছাই ঘোষের স্মৃতি বিজড়িত জায়গায় অবস্থিত
স্মৃতি দেউল। নির্মানকাল নিয়েও নানা মতভেদ।
ইছাই ঘোষ ঐতিহাসিক ব্যক্তি। জঙ্গলের নাম গড়জঙ্গল।
একটি মৌজার নাম  গড়কেল্লা খেড়োবাড়ি। গড় এবং কেল্লা একই শব্দবন্ধে। হাজার বছর আগে ইছাই এর সময়কালে র
" ঢেকুর গড় " এবং বর্ধমানের রাজা চিত্রসেন এর নির্মিত কেল্লা। পরগণা র নাম  "সেনপাহাড়ী "। সেন রাজাদের পূর্ব পুরুষ রা এখানে এসে প্রথম বসবাস স্থাপন করেছিলেন।
তাই সেনপাহাড়ী নাম। এই এলাকাকে ঘিরে অনেক ইতিহাস।
ধর্মমঙ্গল কাব্যের পটভূমি ও এই এলাকা। অজয়ের ওপারে
লাউসেন তলা। যেখানে লাউসেনের শিবির পাতা হয়েছিল।
তাঁর সেনা পতি বীর কালু ডোম এই এলাকায় এক মান্য পূজ্য
ব্যক্তি। ডোম সম্প্রদায়ের মানুষ রা  ১৩ ই বৈশাখ তাঁর পূজা করেন।
বনকাটি র পিতলের রথ এক অসামান্য পুরাকীর্তি। ১২৪২ বঙ্গাব্দে এর নির্মান। অসাধারণ এর  খোদাই বা এনগ্রেভিং এর কাজ। রামায়ণ মহাভারতের কাহিনী ছাড়াও আছে নানা সামাজিক চিত্রণ। শিল্পাচার্য নন্দলাল বসু সহ অনেক গুণী মানুষ এই রথের কাজ দেখে মুগ্ধ হয়েছেন। শিল্প রসিক যে কোন মানুষ ই মুগ্ধ হবেন এই রথের শিল্পকর্ম দেখে।
দিল্লির বাদশা মহম্মদ শাহের ফরমান অনুযায়ী গোপভূম পরগণা বা সেনপাহাড়ীর   জমিদারি লাভ করে বর্ধমানের রাজা চিত্রসেন এই এলাকার পুনর্গঠনের কাজ করেন।
১৭৪০-৪৪ সালের মধ্যে।
সেই সময়কাল ঃ  বাঙ্গলার ইতিহাসে সে এক চরম সন্ধিক্ষণ।
  ১৭৪০ থেকে শুরু হয়ে ৫০-৫১ পর্যন্ত চলেছে দফায় দফায় বর্গী আক্রমণ। ভাস্কর পণ্ডিতের নেতৃত্বে ২০০০০ অশ্বারোহী র দল ঝাঁপিয়ে পড়েছে বাংলার উপরে। তারা নবাব আলীবর্দি র কাছ থেকে চৌথ আদায় করবে। দিল্লির  অকর্মন্য বাদশা
তাঁদের পাঠিয়ে দিয়েছেন বাঙ্গলায়। নিজে বাঁচার আশায়।
গ্রামের পর গ্রাম তাদের অত্যাচারে ছারখার হয়ে গেছে।
ভিটেমাটি ছেড়ে পালিয়েছে কত মানুষ। গঙ্গার ওপারে গিয়ে
স্বস্তি পেয়েছেন। কিন্তু সেখানেও জনসংখ্যার চাপ বেড়ে গেছে। সীমাহীন অত্যাচার হয়েছে মহিলা দের উপর।
যে গ্রাম থেকে টাকা কড়ি, সোনা দানা পায়নি সে গ্রাম চারদিক ঘিরে ধরে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। অপহরণ লোলুপ, নৃসংস
বর্বর বর্গী দের দল অতর্কিত আক্রমন করে। সম্মুখ সমরে তারা অবতীর্ণ সহজে হয়না।
নিরুপায় হয়ে নবাব আলীবর্দি ছলনার আশ্রয় নিয়ে " সন্ধিচুক্তি " র নামে তাঁবুতে ডেকে ভাস্কর এবং তার সঙ্গী সাথী দের হত্যা করে।
ভাস্করের মৃত্যুতে ছত্রভঙ্গ হয়ে বর্গী রা দুর্গাপূজা ছেড়ে পালায়।
কাটোয়ার দাঁইহাট ছিল তাদের অন্যতম এক ঘাঁটি।
অবশ্য এখানেই শেষ হয়না। বর্গী আক্রমণ। বিশ্বাসঘাতক
রহিম খাঁ আবার ডেকে এনেছে তাদের।
শেষ পর্যন্ত পাঁচ বারের যুদ্ধ শেষে বছরে ১২ লক্ষ টাকা চৌথ আদায় দেবার প্রতিশ্রুতির পর বন্ধ হয়েছে এই আক্রমণ।
চার লক্ষ মানুষ বর্গী আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন এবং নিহত হয়েছিলেন। আর কত যে টাকা, সোনা রূপা লুণ্ঠিত হয়েছে তার কোন হিসাব নাই। মুর্শিদাবাদে জগৎ শেঠের গদি থেকেই তিন লক্ষ টাকা।
মাঝে মাত্র কয়েকটি বছর নিরুপদ্রব। আলীবর্দি র মৃত্যুর পর
নবাব সিরাজ। বাঙ্গলার ইতিহাসে এক বিতর্কিত চরিত্র।
কিন্তু চরম ইংরেজ বিদ্বেষ তাঁর। কলকাতায় তারা জাঁকিয়ে বসছে। দুর্গ শক্তিশালী করছে।
সিরাজের কলকাতা আক্রমণ। বেশ কিছু ইংরেজ বা ইউরোপীয় মারা গেলেন। বাকী রা পালালেন মাদ্রাজ।
আবার শক্তিশালী হয়ে ক্লাইড এলেন দায়িত্ব নিয়ে। তাঁর কাছে
নবাব বিরোধী রা  সিরাজ কে হঠানোর জন্য ক্লাইভ এর সাথে মন্ত্রণা করলেন। ক্লাইভ চরিত্রে ছিলেন সাহসী ; দুর্দমনীয় এবং
দূরদৃষ্টি সম্পন্ন। তাঁর মনে আশার ঝিলিক খেলে গেল।
১৭৫৭ র পলাশীর সর্বনাশ। যুদ্ধের নামে প্রহসন।
সিরাজ পরাজিত এবং পরে নিহত হলেন। মুর্শিদাবাদ রাজকোষ থেকে সর্বমোট প্রায় ৬০  লক্ষ টাকা লুঠ করা হল।
বিশ্বাসঘাতক দের মধ্যে তা বণ্টিত হল।
একা ক্লাইভ ই পেলেন ২০ লক্ষ - টাকা।
১৭৫৭ থেকে শুরু করে ১৭৭২ এর মধ্যে প্রায় ঘুষ সহ লুঠ হল
প্রায় ১ কোটি ২৫ লক্ষ পাউণ্ড।
মীরজাফর নবাব হলেন। উপঢৌকন আর কর আদায় না দিতে পারার জন্য তাঁর জামাতা মীরকাসিম কে করা হল নবাব। তিনি আরও বেশি উপঢৌকন দিলেন। আর ও বেশী কর আদায়ের প্রতিশ্রুতি দিলেন।
ইংরেজ কোম্পানি  দেওয়ানী লাভ করেছে -১৭৬৫ সালে।
কর আদায় করছে তারা। দেশীয় নবাবী আমলের কর্মচারী দের দ্বারা। আছেন কুখ্যাত সিতাব রায় বা রেজা খাঁ।
শুরু হয়েছে " দ্বৈত শাসন "। চলেছে এই দ্বৈত শাসন ১৭৬৫- ৭২ সাল পর্যন্ত।  চলছে প্রজাদের উপর নিপীড়ন।
  বক্সার এর যুদ্ধে মীরকাসিমের পরাজয়। ইংরেজ সর্বময় কর্তা
  হয়ে গেল।
  ১৭৬৮-৬৯ নাগাদ দেশে খাদ্যাভাব দেখা দিল। এবং সেই অভাব পরিণত হল ছিয়াত্তর এর মন্বন্তরে ১৭৭০ সালে।
এক টাকার একমন, দেড়মন চালের দাম হল তিন টাকা সের।
কে কিনবে!  ইংরেজ রা সাধারণ মানুষের কথা ভাববার কোন প্রয়োজন বোধ করেনি। তারা তাদের সৈন্য দলের জন্য বাজার থেকে সব চাল কিনে নিল। আর আড়তদার, মজুতদার রা যথানিয়মে মজুত করল।
না খেতে পেয়ে বাঙ্গলার কমপক্ষে ৮০ লক্ষ মানুষ মারা গেল।
এর মারাত্মক প্রভাব পড়েছিল রাঢ়বঙ্গে। ঝাড়খণ্ড, বীরভূম, আজকের বর্ধমানের পশ্চিমাংশে।
ভাবা যায় বাঁচার তাগিদে মানুষ মানুষের মাংস খেতে বাধ্য হয়েছে।
   বীরভূম  " জনমানবহীন বন্ধ্যা দেশ "।  ছয় হাজার গ্রামের মধ্যে দেড় হাজার গ্রাম একেবারে শূন্য। পতিত সব কৃষিজমি।
অনাবৃষ্টি র যদি বা বৃষ্টি নামল কে চাষ করবে। চাষি ই তো নাই। সব মরে গেছে। কৃষি জমি সব আগাছা, জঙ্গলে ঢেকে গেছে। জঙ্গল ভূমি আরও গভীর হয়েছে। হিংস্র শ্বাপদের দল নির্ভয়ে সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বন্য হস্তী আর শার্দূল এর দল
বীরভূমের অবশিষ্ট গ্রামাঞ্চল কে তছনছ করে দিচ্ছে।
মানুষ রাতের বেলা গাছের উপরে মাচায় রাত জাগে। তাদের মেরে, তাড়াবার জন্য পুরস্কারের ব্যবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে। পশ্চিমের জঙ্গল দেশের সাহসী মানুষ দের ডাকা হল। 
এই পরিস্থিতির মাঝে মরীয়া হয়েই পশ্চিম থেকে নেমে এসেছে
  ডাকাত দল। তাদের সংগে যোগ দিয়েছে অনেক উচ্চবর্গের,  নিম্ন বর্গের মানুষের দল। আগে রাজা, জমিদার দের অধীনে কাজ করত যে সব ছেড়ে দেওয়া সৈন্য রা - তারাও। 
ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, রজপুত ক্ষেত্রী রা নেতৃত্বে। এক এক দলে হাজারের উপর মানুষ। দিনে দুপুরে ডাকাতি হচ্ছে। ইলামবাজার গঞ্জ লুঠ হল। জয়দেব কেন্দুলী র মোহান্ত অস্থল এর ভরত চাঁদ ব্রজবাসী র গদি লুঠ হল। অজয় পার হয়ে
অযোধ্যা বনকাটি র জমিদার জনৈক বলিনাথ চট্টোপাধ্যায় এর বাড়ি তে ডাকাতি হল। সে সব ১৭৮৯ সালের ঘটনা।
তাদের লক্ষ্য ইংরেজ কুঠিবাড়ি, করের টাকা, অত্যাচারী ধনী
জমিদার, মজুতদার রা। জীবন ডাকাত, তার ভাই বিশু, ভুবন হাঁড়ি, উদিত লাল, গৌরী হাঁড়ি ; ভবাণী সিং এরা সব ছিল ডাকাত দলের মাথা। জীবন গ্রেপ্তার হবার পর তার ভাই বিশু
দল পরিচালনা করে। অযোধ্যা র ডাকাতি বা কেন্দুলী র ডাকাতি তে বেশ কয়েক জন রায়ত ( পাহারাদার) মারা যায়।
  এই সময়কাল এবং ঘটনাপ্রবাহের প্রেক্ষিতে  বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর " আনন্দ মঠ " কে দেখতে হবে। " দুর্ভিক্ষ পীড়িত, নিঃস্ব, রিক্ত মানুষের হাহাকারে ভরে আছে বাংলার সেই ক্রান্তিকাল "। ইংরেজ দের অধীনে চাকরি করেও সেই শাসনের প্রতি তীব্র কষাঘাত আর কে করেছেন। " ইংরাজের শাসন কৌশলে আমরা সভ্য হইতেছি। আমাদের দেশের বড় মঙ্গল হইতেছে। দেশের মঙ্গল কাহার মঙ্গল? তোমার আমার মঙ্গল দেখিতেছি কিন্তু তুমি আমি কি দেশ!  তুমি আমি দেশের কয়জন?  আর এই কৃষিজীবি কয়জন? তাহাদের ত্যাগ করিলে দেশে কয়জন থাকে? হিসাব করিলে তাহারাই দেশ - দেশের অধিকাংশ লোকই কৃষিজীবি "।
------------ " এই নয়শত নিরানব্বই জনের শ্রীবৃদ্ধি না দেখিলে আমি কাহারও জয়গান করিবনা "
  এই সাধারণ মানুষ, কৃষক কে বাঁচাবার কোন প্রশাসনিক উদ্যোগ নিতে কোম্পানি সরকার কে দেখা যায়নি।
কিভাবে মরে যাওয়া কৃষি অর্থনীতি কে বাঁচানো যায় এই ভাবনায়  ১৭৯৩ সালে  কর্ণওয়ালিস " চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে র "
ব্যবস্থা করলেন। ভূস্বামী রা স্বস্তি পেলেন। করের টাকা দিতে না পারলে জমিদারি অন্তত নীলাম হয়ে যাবেনা।
তাঁরাই এবার চেষ্টা করতে লাগলেন পতিত কৃষি জমি কে কিভাবে আবার সুফলা করে তোলা যায়। স্থায়ী রায়ত রা অনেকেই নাই। অস্থায়ী রায়ত দিয়ে চাষের ব্যবস্থা করা হল।
বাইরে থেকে বিশেষত বীরভূমের পশ্চিমাঞ্চল থেকে অনেক কোঁড়া, মাল, সাঁওতাল আদিবাসী  সম্প্রদায়ের মানুষ দের আনানো হল। নীল কুঠি গুলিতেও এই সব শ্রমিক দের যথেষ্ট কদর ছিল।
ছিয়াত্তর এর মন্বন্তর এর ধাক্কা পরবর্তী অনেক গুলি বছরেও কাটানো যায়নি।
অনেক চেষ্টায় কৃষি আবার প্রাণ ফিরে পেল। ভূস্বামীরা ও
অনেকে ইংরেজ ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির সাথে মসলা,   নীল, গালা, ' গড়া " কাপড়ের  পরে কয়লা র  ব্যবসা করে প্রভূত ধনী হয়ে উঠলেন।
উদ্বৃত্ত অর্থে তাঁরা নানাবিধ জনহিতকর কাজ করতে প্রবৃত্ত হলেন। জলাশয় খণন,  বৃক্ষ রোপন,  আম কাঁঠালের বাগান তৈরী ইত্যাদি সব কাজ। এই সব কাজের মাধ্যমে ইংরেজ সরকার এর বিশেষ নজরে আসার তাগিদ ও কাজ করেছে।
কত ধরনের উপাধি - রায়, রায় চৌধুরী, প্রদান করা হচ্ছে।
সেই রকমের উপাধি পাবার ইচ্ছা প্রায় সকল ভূস্বামী দের
এই ভূস্বামী জমিদার তন্ত্রের উপরই নির্ভর করাছে ইংরেজ ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি। দেশীয় সহযোগী তো চাই।
কর্ণওয়ালিস চেয়েছিলেন " ঔপনিবেশিক সামন্ত তান্ত্রিক এক
কৃষি ব্যবস্থা এবং উৎপাদন "।যাতে কর আদায় যথাযথ থাকে।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে র পর ছোট বড় মাঝারী সব ভূস্বামী, জমিদার রা
  বানিয়েছেন দুর্গাদালান, বিষ্ণু দালান, শিবমন্দির ; দালান কোঠা , প্রাসাদ  ইত্যাদি। যাঁর যেমন সামর্থ্য। এতে তাঁদের আত্মগরিমা ও প্রচারিত হয়েছে।
কিন্তু অস্বীকার করার কোন উপায় নাই যে এই সব কাজের মাধ্যমে শ্রমজীবী মানুষ কাজ পেয়েছেন৷ গ্রামীণ কারিগর রা
কাজ পেয়েছেন। মরে যাওয়া গ্রামগুলি আবার জেগে উঠেছে। অনেক সমালোচনা সত্ত্বেও একথা অস্বীকার করা বোধহয় করা যায়না।
কয়েকটি বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য নির্মান বা পুরাকীর্তি কে বাদ দিলে অজয়ের উত্তরে সেনভূম বা দক্ষিণে সেনপাহাড়ী এলাকায় গ্রামীণ ভূস্বামী দের দ্বারা  নির্মিত  এত গুলি মন্দির
গড়ে উঠেছে। সেই মন্দির ই হয়েছে গ্রামের " ল্যাণ্ড মার্ক "।
এই রাঢ় বাঙ্গলায় ধর্মরাজ সর্বজনীন দেবতায় পরিণত হয়েছেন।  বাগদি পাড়া য় বা কোঁড়া পাড়ায়
মনসা থান তো আছেই। উচ্চ, নীচ উভয় বর্গের মানুষ কালী পূজা করছেন। কালী মন্দির গড়ে তোলা হয়েছে। আর নানা গাছতলার ঝোপে নিরিবিলিতে আছেন কত চণ্ডী। চণ্ডী থান।
  গ্রামের উচ্চবর্গের মানুষের সাথে নিম্নবর্গের মানুষের একটা
পারস্পরিক সম্পর্ক - এই সব দেব দেবী র পূজা উপলক্ষ্যে  গড়ে তোলার চেষ্টা ও  সেই সময়ে লক্ষ্য করা যায় । হয়তো দেখা গেল ব্রাহ্মণ পাড়ার কালী হলেন বড় বোন তো মুচি পাড়ার কালী মেজবোন কি আরেক মুচি পাড়ায় ছোট বোন
পূজিতা হচ্ছেন। এতো আর কিছু নয় দেবদেবী কে কেন্দ্র করে
উচ্চবর্ণের সাথে নিম্ন বর্ণের একটা আপাত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা।
প্রতিটি সময়কালের নিজস্ব চরিত্র আছেই। অর্থনীতিই  সে চরিত্র কে নির্ধারণ করে। নির্ধারিত হয় মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক। প্রত্যেক নির্দিষ্ট সময়কালের গণমানসের  মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেই সময়ে ফেরা যায়না। অনেক দূর থেকে সেই সময় কে ফিরে দেখতে হয়। স্বাভাবিক ভাবেই সেই
দেখা কে হতে হবে বহু কৌণিক। এই হল ইতিহাস এর শিক্ষা।
------------ ------------ ------------ ------------ ---------- সমাপ্ত।
লেখক আঞ্চলিক ইতিহাস এর একজন গবেষক। প্রাবন্ধিক।
গ্রন্থ সহায়তা।  বর্ধমান  ঃ ইতিহাস ও সংস্কৃতি। যজ্ঞেশ্বর চৌধুরী।  জেলা গেজেটিয়ার বীরভূম। ও ' ম্যালি।
হাণ্টার এর " এনালস অফ রুরাল বেঙ্গল "'
রঞ্জন গুপ্তের - দি ইকোনমিক হিস্ট্রি অফ এ বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট।
বীরভূম।
তারাপদ সাঁতরা - বাঙলার মন্দির মসজিদ স্থাপত্য
নিজস্ব ক্ষেত্রানুসন্ধান। নিজস্ব প্রবন্ধ।
কুঠিবাড়ি ভিত্তিক ব্যবসা বাণিজ্য ঃ সেই সময়কাল
ইত্যাদি।
------------ ------------ ------------ ------------ ------------
কাঁকসা সাহিত্য সংস্কৃতি অ্যাকাডেমির  " ডুবুরী" পত্রিকা র 
 শারদ সংখ্যায় প্রকাশিত, ২০২৩। 
একটু দীর্ঘ প্রবন্ধ। পড়ে, মন্তব্য করলে ভালো লাগবে। সব মন্দিরের ছবি দিলাম না।

Tuesday, 9 July 2024

পরগণা সেনপাহাড়ী। সেনভূম। জঙ্গল মহলের ইতিহাস। ঐতিহ্য মণ্ডিত পুরাকীর্তি



।।  পরগণা সেনপাহাড়ী। সেনভূম । । জঙ্গলমহলের ইতিহাস।।   ঐতিহ্য মণ্ডিত পুরাকীর্তি।।   প্রণব ভট্টাচার্য
------------ ------------ ------------ ------------ ----------------------

ঃ  গড়জঙ্গল ; ইছাই ঘোষের দেউল ; বনকাটির পিতলের রথ,  টেরাকোটা শোভিত মন্দির,  অযোধ্যার মন্দির
কালিকাপুর মৌখিরা। জয়দেব কেন্দুলী,  ঘুড়িষা ; ইলামবাজার।
------------ ------------ ------------ ------------ ------------ ------------
জঙ্গল মহল। অবিভক্ত বর্ধমান জেলার আউসগ্রাম থানা এবং কাঁকসা থানা  ও দুর্গাপুর ফরিদপুর থানার জঙ্গল ভূমিই  এই জেলার জঙ্গল মহল।
মাত্র দুশো বছর আগে গুসকরা থেকে বরাকর পর্যন্ত এই জঙ্গল ভূমি বিস্তৃত ছিল। দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চল গড়ার প্রয়োজনে এই জঙ্গলের সর্বাপেক্ষা সমৃদ্ধ অংশ ই বিনষ্ট হয়। সেই সব
" মহাবৃক্ষ " রূপ শালতরু আজ আর প্রায় দেখাই যায়না। প্রাচীণ গ্রন্থাদিতে শাল কে মহীরুহ বলা হয়েছে। ল্যাটেরাইট মাটির উপর এই জঙ্গল একদিন এতই ঘণ ছিল যে কোন কোন স্থানে দিনের আলো প্রবেশ করত না। হাণ্টার সাহেবের এনালস অফ রুরাল বেঙ্গল এ এই জঙ্গল ভূমির
উল্লেখ আছে। ছিয়াত্তর এর মন্বন্তর এর পর উজাড় হয়ে যাওয়া গ্রাম গঞ্জ গভীর জঙ্গলে ঢেকে যায়। নির্ভয়ে সেই জঙ্গলে বিচরণ করে
হিংস্র শ্বাপদের দল। বন্য হস্তীর দল ছারখার করে দেয় কত গ্রাম। পথ ঢেকে যায় জঙ্গলে।
পথহীন সেই দেশে একদল সৈন্য কোন ভাবে
একশো কুড়ি মাইল দীর্ঘ সেই বনভূমি পার হয়ে বীরভূম পৌঁছায়। কোথাও তাঁবু ফেলার মতো
জনপদ নাই। যদিবা ছোট্ট কোন গ্রাম কোন মতে ঐ জঙ্গলের মধ্যে টিঁকে আছে তো সেখানে সৈন্য দলের তাঁবু পাতার মতো স্থান নাই। বীরভূম তখন এক " জনমানবহীন বন্ধ্যা দেশ "। অনাবিষ্কৃত। মন্বন্তর এ  বীরভূমের ছয় হাজার গ্রামের মধ্যে প্রায় দেড় হাজার নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। কৃষি জমি ঢেকে গেছে আগাছায়। ঝোপে জঙ্গলে। চাষ করার মানুষ ই নাই। কে চাষ করবে। যে চাল ছিল এক টাকায় এক মন বা দেড় মন সেই চাল এখন তিন টাকা সের। কে কিনবে! না খেতে পেয়ে মারা গিয়েছিল প্রায় আশি লক্ষ মানুষ। একে গণহত্যাই বলা উচিৎ।
মজুতদার রা মজুত করেছে। যা তাদের কাজ। আর ইংরেজ রা বাজার থেকে সমস্ত চাল সৈনিক দের জন্য কিনে নিয়েছে।
সাধারণ মানুষ বাঁচল কি মরল তাতে তাদের কোন মাথাব্যথা নাই। তাদের চাই কর। টাকা। আর লোভী ইউরোপীয় বণিক রা
সারা বাঙ্গলা য় ছুটে বেড়াচ্ছে কোথায় কোন ব্যবসা ভালো হতে পারে! কোথায় কাঁচা মাল সহজলভ্য? 
জনশূন্য জনবসতি সব। ডি পপুলেশন এর সমস্যা।
নেমে এসেছে জঙ্গলের রাজত্ব। নিরন্ন মানুষ পথের ধারে মরে পড়ে আছে আর এ দেশীয়  কর আদায়কারী রা আরও আদায়ের জন্য চেষ্টার কসুর করছেনা। অবাক হতে হয় আদায় ও অনেক টা বেড়েছিল। ঘরে মজুত থাকে যে খাবার ধান সেটুকু তাদের হাতে তুলে দিয়ে নিজেরা না খেয়ে মরতে বাধ্য হয়েছে।
ইংরেজ ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি র সেই প্রথম যুগে বন্য হস্তী বা শার্দূল দের অত্যাচারে
বিপর্যস্ত এক পরিস্থিতি। তাদের তাড়াবার জন্য বা মেরে ফেলার জন্য পাহাড়িয়া আদিবাসী দের
ডাক পড়ছে। পুরস্কারের ব্যবস্থা হয়েছে। মাথায় রাখতে হবে তখন পশ্চিমের সীমান্তবর্তী এই এলাকা - বীরভূম থেকে বিষ্ণুপুর পর্যন্ত এবং পশ্চিমে বৈদ্যনাথ ধাম পর্যন্ত সমগ্র এলাকাই  বীরভূম। বীরভূম নামে আলাদা জেলা গঠিত হয়েছে। সদর শহর বিষ্ণুপুর থেকে সিউড়ি তে আনা হয়েছে। প্রাথমিক অবস্থায় সিউড়িতে কোন ও পাকা বাড়ি মেলেনি জেলা কালেক্টর এর অফিস বানানোর জন্য।
ব্যবসা করতে এসে হঠাৎ বাঙ্গলার রাজা হয়ে বসেছে ইংরেজ। পলাশীর প্রহসনের যুদ্ধে নবাব
সিরাজের পরাজয় ঘটেছে। লুণ্ঠনকারী রা মিলে নবাব এর কোষাগার থেকে লুঠ করেছে কমপক্ষে আশী  লক্ষ টাকা।  এত বড় দেশ টাকে নিয়ে যে কিভাবে শাসন কার্য্য চালানো যায় তা
ইংরেজ প্রশাসনের মাথাব্যথা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
স্থানীয় শাসক দের ই রাখা হয়েছে ক্ষমতায়। রাজ কর্মচারীরাও
আছে। সিতাব রায় বা রেজা খাঁয়ের মতো আদায়কারী রা আছে। আজ উপঢৌকন দিয়ে মীরজাফর নবাব তো আরও বেশী উপঢৌকন দিয়ে মীরকাশিম।  সে ক্ষমতা নামে মাত্র। কর আদায়ের দায়িত্ব পেয়েছে অর্থাৎ দেওয়ানী লাভ করেছে ইংরেজ রা।১৭৬৫ সালে।  শুরু হয়েছে " দ্বৈত শাসন " ব্যবস্থা।
১৭ ৭৮ সাল নাগাদ কোম্পানি নিজ হাতে শাসন ব্যবস্থা তুলে নিয়েছে। তারপর নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা। সে এক বিস্তৃত ইতিহাস।
১৭৭০ সালের সেই মহা মন্বন্তর এর আগে মারাঠা বর্গী দের আক্রমণ এই বাংলায় নেমে এসেছে এক মহা বিপর্যয় হিসাবে। গ্রামের পর গ্রাম তারা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছে। ভাস্কর পণ্ডিত এর নেতৃত্বে কুড়ি হাজার
অশ্বারোহী সৈন্যের অমানুষিক অত্যাচার নেমে এসেছে বাঙ্গলায়। মহিলা দের উপরে ঘটেছে বর্বরোচিত অত্যাচার। মুখে তাদের ভীষণ চিৎকার " টাকা দাও, সোনা দাও ".। বাঙ্গলার নবাবের কাছ থেকে চৌথ আদায় তাদের লক্ষ্য।
নবাব আলীবর্দি তাদের  অতর্কিত আক্রমণ প্রতিরোধে ব্যর্থ প্রায়। সম্মুখ সমরে তারা আসেনা। শেষ পর্যন্ত ছলনার আশ্রয় নিয়েই
" সন্ধি চুক্তি র নামে " শিবিরে ডেকে ভাস্কর পণ্ডিত কে এবং তাঁর সঙ্গী দের হত্যা করা হয়েছে। এখানেই শেষ নয়। শেষ পর্যন্ত পাঁচ বারের যুদ্ধের পর বছরে বারো লক্ষ টাকার চৌথ প্রদানের চুক্তি হয়েছে মারাঠা দের সাথে।
বর্গীর আক্রমণে কত যে মানুষ ভিটেমাটি ছেড়ে যে যেদিকে পেরেছে পালিয়েছে। গঙ্গার ওপারে
অনেক ব্রাহ্মণ পণ্ডিত, সহ সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরা পালিয়ে বেঁচেছেন। কত মানুষ যে ভিটেমাটি ছেড়ে অন্যত্র পালিয়েছেন তার কোন হিসাব নাই। লক্ষ লক্ষ মানুষ নিহত হয়েছেন। বড় দুর্ভাগা এই বাঙ্গলা। বারবার নানা বিধ আক্রমনে তার প্রাণশক্তি ক্ষয়ে গেছে। লুণ্ঠিত হয়েছে তার ঐশ্বর্য। সে এক মর্মন্তুদ ইতিহাস।
চিরদিনের জন্যই এই পশ্চিম প্রান্তের মালভূমি,
বনাঞ্চল দিয়েই সব বহিঃশক্তির আক্রমণ ধেয়ে এসেছে বাঙ্গলার দিকে। পাহাড় ; জঙ্গল ডিঙিয়ে ওরা এসেছে। ঝাড়খণ্ড এর জঙ্গল ভূমি ; যার উল্লেখ আছে ভবিষ্য পুরাণে। " ঝাড়িখণ্ড জাঙ্গল ভূমি " নামেই। পশ্চিমের সীমান্ত পাহারা দেয় কয়েকটি রাজ্য। রাজনগর,  বিষ্ণুপুর,  পঞ্চকোট। কিন্তু সামরিক শক্তি তে বহিঃশত্রু প্রবল। শক্তি, সাহস, সামর্থ্য, যুদ্ধ কৌশলে তারা প্রভূত বলশালী।
ছিয়াত্তর এর মন্বন্তর এর পর ১৭৮৬ নাগাদ বীরভূম হয়ে দাঁড়িয়েছে  " ডাকাতদলের স্থায়ী আস্তানা "। পশ্চিম এর পাহাড়
জঙ্গল থেকে নেমে এসেছে পাহাড়িয়া দের দল। তাদের সাথে যোগ দিয়েছে উচ্চ এবং নিম্ন বর্গের অনেক মানুষ। এক এক দলে হাজারের বেশী লোক। তাদের লক্ষ্য আড়তদার ; অত্যাচারী জমিদার,  কোম্পানির রাজস্ব ; কুঠিবাড়ি ইত্যাদি।
দিনে দুপুরে ইলামবাজার লুঠ হল ১৭৮৯ সালে। নদী পার হয়ে
অযোধ্যা বনকাটি র জমিদার চট্টোপাধ্যায় বাড়িতে।
জয়দেব কেন্দুলী র ভরতচাঁদ ব্রজবাসী র মোহান্ত অস্থল এ
১৭৯০ এ ডাকাত দলের হাতে রাজনগর অবরুদ্ধ, লুণ্ঠিত।
  এই ডাকাত দলে র নেতৃত্বে আছে জীবন ( জ্যাবনা) ডাকাত
তার ভাই বিশু ; ভবাণী সিং ; অজিত লাল ; গৌর হাঁড়ি, ভুবন হাঁড়ি সহ অনেক রজপুত ক্ষেত্রী, কায়স্থ ;  ব্রাহ্মনের দল।
জীবন গ্রেপ্তার হবার পর তার ভাই বিশু ই ডাকাত দলের হাল ধরে।
" দুর্ভিক্ষ পীড়িত ; নিঃস্ব, রিক্ত মানুষের হাহাকারে ভরে আছে
বাংলার সেই ক্রান্তিকাল। " - বঙ্কিমচন্দ্র।
সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে ই লেখা বঙ্কিমচন্দ্রের " আনন্দ মঠ "কে দেখতে হবে।
সেই সময় কালের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস থেকে  এবার

আমরা ফিরি আমাদের এলাকায়। প্রাচীন " গোপভূম " এর  " সেনপাহাড়ী পরগনা " য়। অজয় বা অজি বা আরও প্রাচীণ অজাবতী র দক্ষিণে সেনপাহাড়ী আর ওপার সেনভূম।

এখানে যেমন আছে " সাতকাটার জঙ্গল "।
মুসলিম আক্রমণ কারী দের হাতে কাঁকসার রাজবংশ ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। সৈয়দ বুখারীর নেতৃত্বে বা তার আহ্বানে আক্রমণ কারী সৈন্য
দল ঝাঁপিয়ে পড়েছে গোপভূম এর উপরে।
কাঁকসার উত্তরে যে জঙ্গল ভূমি সেখানে আক্রমণ কারী দের হাতে উপুর্যুপরি সাতটি খুন সংঘটিত হয়েছিল। জঙ্গলে র মধ্যে " উৎগড়ে "
লুকিয়ে আছেন কাঁকসার রাজবংশের এক
বংশধর তাঁর পরিবার নিয়ে।

জঙ্গলের নামই ' গড় জঙ্গল '। নামের মধ্যেই ইতিহাস লুকিয়ে।
আনুমানিক হাজার বছর আগে এখানে ছিল গড়। আবার ২৮৩ বছর আগে এখানে ছিল কেল্লা। এখানের একটি মৌজার নাম " গড়কেল্লা খেড়োবাড়ি "।একই শব্দ বন্ধে গড় এবং কেল্লা।  জে এল নং - ২৭ থানা কাঁকসা জেলা পশ্চিম বর্দ্ধমান
পাশের মৌজা গৌরাঙ্গপুর। জে এল নং - ২৮  থানা কাঁকসা।
এখানে ছিল গৌরাঙ্গ মন্দির। কথিত  রাঢ় পরিভ্রমণের সময়
চৈতন্য দেব এখানে এসেছিলেন। এই মৌজাতেই মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে বাঙ্গলার বিখ্যাত পুরাকীর্তি " ইছাই ঘোষের দেউল " সুউচ্চ। প্রায় ৮০ ফুট এর উচ্চতা। পাতলা টালির মতো
ইঁট দিয়ে তৈরি। দেউল রীতি র। রথ শৈলীর। সামনে উড়িষ্যা রীতির কীর্তি মুখ।  চারদিকে নানা দেবদেবীর মূর্তি। প্রচলিত টেরাকোটা নয়। টালিকে কে কেটে। ব্রিক কাট পদ্ধতিতে নির্মিত। ভারত সরকার এর পুরাত্তত্ব বিভাগের দ্বারা সংরক্ষিত।
নির্মানকারী বা নির্মানকাল নিয়ে বিতর্ক আছে।
বর্ধমানের রাজা চিত্রসেন ১৭৪০-৪৪ সাল নাগাদ সেনপাহাড়ী পরগনার অধিকারের ফরমান  দিল্লির বাদশাহের নিকট হতে লাভ করে
এই পরগণা র পুনর্গঠনের প্রতি নজর দেন। তিনিই কেল্লা নির্মান করিয়েছিলেন। কামান এনে বসিয়েছিলেন। একদিকে বর্গী আক্রমণের আশংকা এবং অপর দিকে ইংরেজ দের
দ্বন্দ্ব। যে কোন সময় আক্রমণের মুখে পড়তে হতে পারে।
তাই এই সামরিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে কেল্লা নির্মান করিয়েছিলেন। উত্তরে অজয়। দক্ষিণে ঘণঘোর জঙ্গল।
পরগণার  নাম সেনপাহাড়ী। ডক্টর সুকুমার সেনের মতে বাঙ্গলার সেন রাজাদের পূর্ব পুরুষ রা এখানে এসে প্রথম বসবাস স্থাপন করেছিলেন। নাম তাই সেনপাহাড়ী। অজয়ের ওপারে ও তাঁরা উপযুক্ত বাসস্থানের সন্ধানে গিয়েছিলেন।
রাজনগর পর্যন্ত। রাজা বীরসেন ছিলেন সেন রাজাদের পূর্ব পুরুষ। নানা সম্ভাবনার মধ্যে এটাও। বীর রাজা র  দেশ - বীরভূম। ওপারের নানা জায়গায় তাঁরা ছড়িয়ে গিয়েছিলেন।
ওপারের নাম তাই সেনভূম। এখনকার কাঁকসা থানা এলাকাই সেই প্রাচীন " গোপভূম " এর সেনপাহাড়ী পরগনা। কাঁকসা এবং আউসগ্রামের জঙ্গল ভূমিই বর্ধমান জেলার " জঙ্গল মহল "।
এই জঙ্গলে র উল্লেখ আছে হাণ্টার সাহেবের এনালস অফ রুরাল বেঙ্গল এ এবং অন্যত্র।
আনুমানিক হাজার বছর আগে এই সীমান্তবর্তী এলাকায় ছিল পাল রাজাদের এক গড়। সেই গড়ের অধিপতি কর্ণসেন কে অতর্কিত আক্রমনে পরাজিত করে গড় দখল করে নেন
দুর্দমনীয় ইছাই ঘোষ। পাল রাজাদের কর দেওয়া বন্ধ করে নিজেকে স্বাধীন রাজা হিসাবে ঘোষণা করেন।
ধর্মমঙ্গল কাব্যে যেমন তাঁকে আমরা পাব। পাব ইছাই লাউসেন যুদ্ধ কাহিনী। দ্বিতীয় বারের যুদ্ধে ইছাই পরাজিত এবং নিহত হন। ধর্মমঙ্গল এর কবি বলছেন " শণিবার সপ্তমী
সম্মুখে বারবেলা। আজি রণে যেওয়া না রে ইছাই গোয়ালা "
ইছাই এর আরাধ্যা দেবী শ্যামারূপার না কি তেমনই নির্দেশ ছিল। ভক্ত সন্তানকে হারিয়ে " মা সারারাত কেঁদে বেড়ালেন কাঁদুনে ডাঙ্গার মাঠে "। আছে রক্তনালা। যেখান দিয়ে বয়ে গিয়েছিল রক্তস্রোতে র ধারা। আছে লাউসেন তলা। যেখানে তার শিবির পাতা হয়েছিল। অজয়ের ওপারে। উত্তরে।
আছেন দেবী শামারূপা। প্রাচীণ মন্দির আর নাই। কিন্তু দুর্গাপূজার সময় জঙ্গল ভরে যায় মানুষ আর মানুষে।
ইছাই ঘোষের ঢেকুর গড় এর মোটা মোটা মাটি আর ল্যাটেরাইট বোল্ডার এর সীমানা প্রাচীর এর অবশেষ আজও দেখা যায়। প্রবীনেরা গড়বেড়ি এলাকায় দেখেছেন নানা নির্মান। একটির নাম না কি ছিল "হাজার দুয়ারী "।
ইছাই ঘোষ ঐতিহাসিক ব্যক্তি। তাঁকে আমরা পাব বাংলাদেশের রামগঞ্জে প্রাপ্ত তাম্রশাসনে। সেই তাম্রশাসনে
শুরুতে ই " বভুব রাঢ়াধিপ লব্ধজন্মা "। তিনি রাঢ়াধীপ ; মহামাণ্ডলিক। তাঁর অধীনস্হ নানা নামের নানা পদের কর্মচারী। পিতা - ধবল ঘোষ  পিতামহ  - বালঘোষ, ঐ পিতা ধূর্ত ঘোষ।  তাম্রশাসনে
তিনি ঈশ্বরী ঘোষ। ঈশ্বরী র অপভ্রংশ ই ইছাই।
বনকাটি অযোধ্যা এই এলাকা গড়জঙ্গলের উত্তর অংশে।
লোকমুখের কথা এখানে " চারঘর মিলে পুকুর আর এক শো হাত দূরে দূরে ঠাকুর থান "। এতো মন্দির খুব কম এলাকাতেই আছে। ১৭০৪ শকাব্দে নির্মিত হয় এখানকার প্রথম দুটি আটচালা রীতি র শিবমন্দির। তারপর ১৭৫৪ সালে বিখ্যাত টেরাকোটা অলংকরণ সমন্বিত গোপালেশ্বর শিব মন্দির।
অনুপম তার টেরাকোটা অলংকরণ। সম্মুখ ভাগে রাম-সীতার রাজ্যাভিষেক। তাছাড়া দশমহাবিদ্যা এবং কৃষ্ণ লীলা, চৈতন্য লীলা এবং নানা সামাজিক চিত্রণ।
এই মন্দিরের গঠনের সাথে সাযুজ্য রেখে ১২৪২ বঙ্গাব্দে নির্মিত হয় এখানকার বিখ্যাত পিতলের রথ। বাঙ্গলার প্রাচীণ তম পিতলের রথ। অসাধারণ এর অলংকরণ। এনগ্রেভিং।
কত যে বিষয়ের সমাহার। মহাভারত রামায়ণ এর ঘঘটনাবলী
ছাড়া আছে নানা সামাজিক চিত্রণ। অসামান্য এই পুরাকীর্তি টি দেখে মুগ্ধ হয়েছেন আচার্য নন্দলাল সহ অনেক গুণী মানুষ। এখানের রথের কাজ কে তুলে নিয়ে গিয়ে নন্দলাল ছাত্রদের দিয়ে করিয়েছিলেন শান্তিনিকেতনে র কালোবাড়ির
রিলিফ ভাস্কর্য। এই মন্দির এবং পিতলের রথ নির্মান করিয়েছিলেন তৎকালীন বনকাটির জমিদার এবং ধণী লাক্ষা ব্যবসায়ী রামপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়।
১৭৫৬-৫৭ শকাব্দে নির্মিত হয় বনকাটির রায় কালীবাড়ি প্রাঙ্গণে পাশাপাশি উচ্চ বেদীর উপর তিনটি শিখর রীতি র
শিবমন্দির। এই কালীবাড়ি প্রাঙ্গণে র চারপাশে আছে আটটি ভগ্ন মন্দির, প্রাসাদ। কয়েক টি ব্রাহ্মণ পরিবার এখানে একত্রে থেকে নানাবিধ ব্যবসায় প্রভূত ধনী হয়ে উঠেছিলেন।
অযোধ্যা গ্রামের কর্মকার পাড়ার বিশালাকৃতির পাশাপাশি চারটি শিবমন্দির বিখ্যাত। এছাড়া ও আছে বেশ কয়েকটি শিবমন্দির ; বিষ্ণ দালান ; দুর্গাদালান। প্রসঙ্গত এই এলাকায়
দশটি পারিবারিক দুর্গাপূজা সহ দুটি সার্বজনীন পূজা অনুষ্ঠিত হয়।
কাঁকসা থানা এলাকার একমাত্র প্রস্তর নির্মিত উড়িষ্যা রীতি নাগর দেউল টি রয়েছে আড়রা গ্রামের বহির্ভাগে। গর্ভগৃহে আছে বিশাল শিবলিঙ্গ। 
মন্দির গঠনে আছে বৈশিষ্ট্য। 
পাশেই বামুনাড়া গ্রামে পথিপার্শ্বে  রয়েছে আশ্চর্য এক অষ্টভুজ নটরাজ শিব মূর্তি। 
গোপালপুর প্রাচীণ গ্রাম। এখানে আছে অনেকগুলি শিবমন্দির। দুটি বৃহৎ আকৃতি র। 
একটির সম্মুখভাগে টেরাকোটার কাজ রয়েছে। 
এছাড়া ও পানাগড় গ্রামের কোঙার পরিবারের 
বৃহদাকৃতির শিবমন্দির টি অনবদ্য টেরাকোটা অলংকরণ যুক্ত। তাম্বুলী সম্প্রদায়ের,  একই আকৃতি র, টেরাকোটা অলংকরণ সমন্বিত শিবমন্দির টি পুরোপুরি ধ্বংস। 
কাঁকসা প্রাচীণ জায়গা। তার প্রমান অদূরেই আছে 
ভরতপুরের বৌদ্ধ স্তুপ। সম্ভবত এখানে বৌদ্ধ বিহার ছিল। 
আমলাজোড়া, বামনাবেড়া, বিদবিহার এলাকাতেও আছে কয়েকটি শিবমন্দির। 


ওপারের কথা ঃ  গীতগোবিন্দম এর কবি জয়দেব এর জন্মস্থান হিসাবে বিখ্যাত কেন্দুলী। সেখানকার রাধাবিনোদ মন্দির। বর্ধমান রাজ কীর্তিচাঁদ জননী ব্রজকিশোরী দেবী
এই মন্দিরের নির্মান করিয়েছিলেন ।  সেনপাহাড়ী থেকে বিগ্রহ এনে এখানে স্থাপন করা হয়। অনবদ্য এর টেরাকোটার কাজ।
নির্মানকাল। জেলা গেজেটিয়ার অনুযায়ী ১৬০৫ শকাব্দ।
অন্য সূত্র।  ১৬৯৪-৯৬ ইং সাল।

মোহান্ত অস্থল এর বিখ্যাত পিতলের রথ। বনমালী মণ্ডল ছিলেন এঁর প্রধান নির্মাতা। তাঁর সাথে ছিলেন আরও দশ বারো জন। তখনকার দিনে তাঁদের মজুরী পড়েছিল ১৫০০/।
মোহান্ত ফুলচাঁদ ব্রজবাসীর সময়ে এটি নির্মিত হয়।
নির্মান কাল। ১২৯৬-৯৮ বঙ্গাব্দ।
ঘুড়িষা ঃ  এখানের অনবদ্য টেরাকোটা অলংকরণ যুক্ত বিখ্যাত দু টি মন্দির বিখ্যাত। রঘুনাথ জীর মন্দির জেলার দ্বিতীয় প্রাচীণ তম মন্দির। ১৬৩৩ সালে নির্মিত। এখানে না কি সোনার বিগ্রহ ছিল। বর্গী আক্রমণের সময় লুঠ হয়ে যায়।
এই গ্রামের বেণে পাড়ার লক্ষ্মী জনার্দন মন্দির খুবই বিখ্যাত।
মসলা সহ অন্যান্য দ্রব্যের ব্যবসায়ী ক্ষেত্রনাথ দত্ত  এই মন্দিরের নির্মাতা।
প্রাচীণ গঞ্জ ইলামবাজার ঃ নীল ও গালা শিল্পের জন্য বিখ্যাত অতীতের এক বিখ্যাত গঞ্জ।
এখানের তিনটি টেরাকোটা শোভিত মন্দির খুবই বিখ্যাত।
হাটতলার গৌরাঙ্গ মন্দির। ব্রাহ্মণ পাড়ার রামেশ্বর শিবমন্দির এবং লক্ষ্মী নারায়ণ মন্দির খুবই বিখ্যাত। জনৈক ক্ষুদিরাম বন্দ্যোপাধ্যায় এই মন্দিরের নির্মাতা। নির্মানকাল - ১৮৪৬-৫০।
রামেশ্বর শিবমন্দির এর প্রতিষ্ঠাতা - রামধন চট্টোপাধ্যায়।
অজয় পার হলে বসুধা। এই গ্রামে ছিল ধর্মমঙ্গল এর অন্যতম কবি ; রাজনগর এর রাজাদের দেওয়ান, উকিল এবং মুর্শিদাবাদ রাজ দরবারে প্রতিনিধি। তিনিই করের টাকা নিয়ে গিয়ে জমা দিতেন। সেই নরসিংহ বসুদের পৈতৃক বাস্তুবাটী।
যদিও তাঁর পিতামহ মথুরা বসু বসুধা ত্যাগ করে শাঁকারী গ্রামে চলে যান । নরসিংহের ধর্মমঙ্গল রচনাকাল ১৭১৩-১৪ খ্রীঃ।
মধুক্ষরা নাম মৌখিরা। বসুধা থেকে মৌখিরা নরম, শীতল, উর্বর মাটির উপরে দুপাশে সব্জি ক্ষেত। এই এলাকা সব্জীচাষের জন্য বিখ্যাত।
মৌখিরা কালিকাপুর এর জমিদারির পত্তন করেন বর্ধমান রাজাদের এক দেওয়ান  পরমানন্দ রায়। মন্দির আর প্রাসাদ ময় গ্রাম এই মৌখিরা কালিকাপুর। কালিকাপুর কিছুটা দক্ষিণে জঙ্গলের পাশে ল্যাটেরাইট মাটির উচ্চ ভূমির উপরে অবস্থিত। এখানে আছে " দুর্গা দালান সমন্বিত সাত মহলা প্রাসাদ। বিশাল দিঘি। নীচে থেকে পাতলা টালির মতো ইঁট বাঁধানো পুকুর। পুকুরের পাড়ে ছিল দ্বিতল বিষ্ণুমন্দির।
এখন আছে তার  ভগ্নাবশেষ। প্রাসাদের সামনে দুটি অনন্য
টেরাকোটা শোভিত শিবমন্দির। নির্মাণকাল - ১২ ৪৬ বঙ্গাব্দ।
এই কালিকাপুর অংশের পরমানন্দ বংশধরেরা ইংরেজ দের সাথে নীলের ব্যবসা করে প্রভূত ধনী হয়ে ওঠেন। নির্মান করিয়েছিলেন  ইংরেজ নীলকর দের আমোদপ্রমোদ এর জন্য বাগান বাড়ি " চাঁদনি "। সামনে দিঘি। পূর্ব দিকে আমবাগান।
মৌখিরা র একই চত্বরে অনেক গুলি শিবমন্দির এবং অনবদ্য টেরাকোটা  কাজ সমৃদ্ধ বিষ্ণুমন্দির। মন্দির নির্মানের কাজ শুরু হয় ১২০০ বঙ্গাব্দ থেকে। বিষ্ণু মন্দির। নির্মানকাল ১২০৮ বঙ্গাব্দ। একই চত্বরে ১১ টি মন্দির। মৌখিরার এই অংশকে বলা হয় রাজা কল্যান রায়ের নামে " কল্যাণ চক "।
শতবর্ষ প্রাচীণ পুষ্পিত অশোকতরু তলে দাঁড়ালে যে কোন মানুষের মনে ইতিহাস কথা বলে উঠবে। কালিকাপুর মৌখিরা এই যুগ্ম গ্রাম দুটি  হেরিটেজ মর্যাদা পাবার দাবী রাখে।
তিয়াত্তর এর মন্বন্তর এর পর গ্রামীণ কৃষি নির্ভর অর্থনীতি একেবারে ভেঙে পড়ে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে র মাধ্যমে সেই কৃষি কে উৎসাহিত করার চেষ্টা হয়। ভূস্বামী রা স্বস্তি পান। তাঁরাও কিছু জনহিতকর কার্যে মনোযোগ দেন।  মরে যাওয়া অর্থনীতি কিছুটা হলেও প্রাণ পেয়েছিল ইংরেজ দের কুঠি বাড়ি ভিত্তিক  বাণিজ্যিক রূপে সুতী বস্ত্র, রেশম চাষ, নীল, এবং গালা শিল্পের
  ব্যবসার মাধ্যমে। তাঁদের সাথে ব্যবসা করে যাঁরা প্রভূত ধনার্জন করেছিলেন তাঁরা ও নানাবিধ জনহিতকর কাজ করিয়েছিলেন । জলাশয় খণন, বৃক্ষ রোপন, প্রাসাদ, মন্দির নির্মান। এর মাধ্যমেও কারিগর সহ গ্রামীণ শ্রমজীবী মানুষেরা
কাজ পেয়েছিলেন। কিছুটা হলেও সেদিনের প্রেক্ষিতে এর মূল্য ছিল যথেষ্টই।
পানাগড় মোরগ্রাম হাইওয়ে র উপর বাসস্ট্যান্ডের নাম
" এগারো মাইল "। এখান থেকে টোটো নিয়ে সব দিকেই যাওয়া যায়। চমৎকার  নীলকুঠী র জঙ্গল পথ ধরে কালিকাপুর মৌখিরা। আবার অযোধ্যা বনকাটি এলাকা।
তেপান্তর নাট্য গ্রামে নিরিবিলিতে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এর মাঝে
  দিন রাত কাটাতে পারেন। এখানে সব রকম ব্যবস্থা আছে।
  আবার ইছাই ঘোষের দেউল এর পাশে আছে দেউল রিসর্ট।
সেখানেও থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা আছে।
  দুটি দিন হাতে নিয়ে এখানে এসে থেকে চারপাশ ঘুরে না  দেখলে  বোঝা যাবেনা " কত  রত্নমালায় বিভূষিত ছিল আমাদের বঙ্গভূমি "।
------------ ------------ ------------ ------------ ------------ সমাপ্ত।
( লেখক  আঞ্চলিক ইতিহাস এর গবেষক ; প্রাবন্ধিক)