কথা - সাতকাহন।
লোকে তাকে বলত ' মাষ্টার '।
ছেলে বেলায় কিছুতেই বুঝতে পারতাম না কেন যে লোকে তাকে বলে ' মাষ্টার '। পরণে একটা হাফ প্যান্ট এর উপর গামছা জড়ানো। আর কাঁধে বা গায়ে একটা গেঞ্জি। ছোট খাটো চেহারা।এই লোকটা মাষ্টার! তার দাদু ছাড়া গাঁয়ে তো কেউ মাষ্টারী করেনা। স্কুলে পড়ায় না। তবে -।
আবার ভাদ্দর মাস এলে মানুষ টার দাম বেড়ে যেত।
আসলে সে ভাদু গানের দলের মাষ্টার। ছোট একটা হারমোনিয়াম বাজিয়ে সুর তুলত। আর দলের বাকী দের মধ্যে
যার যেমন মনে আসত কথা বসাত। ভাদু গান তৈরী হত।
সন্ধ্যের পর বাউরী পাড়ার কারো না কারো উঠোনে বসত
ভাদু গানের মহলার আসর। তালাই পেতে বসত সবাই গোল হয়ে। মাঝখানে সে। তো মানুষ টার নাম চণ্ডী। চণ্ডী বাউরী।
গোবর্ধন বাউরী র ছেলে। তার বাবা ডাকবাংলো র সেচ অফিসের খালাসি। কিন্তু নিজে তেমন কোন কাজ করত না।
তখন গাঁ য়ে আর তেমন কি কাজ! লোকের বাড়ির মুনিষ খাটা। না হলে শর পাতার ঝাঁটা বাঁধা। বা তাল পাতার তালাই ; চাটাই বোনা। না। সে সবে তার মন নাই। মন তার বাঁধা আছে হারমোনিয়াম এর বাঁশী তে।
ভক্তি কোঁড়া ভালো বাঁশের বাঁশী বাজায়। তার ডাক পড়ে। দলে যোগ দিলে গান ভালো জমে। ষষ্ঠী বাউরী র খুব উৎসাহ।
সে ই মূল গায়েনের হাল ধরে। সুঠাম চেহারা। অন্ন চিন্তা নাই।
তার বাবা ভালো কাজের মানুষ। অমূল্য বাউরী ; সুধন বাউরী দের সুন্দর নিকোনো উঠোনে ই সন্ধ্যেতে আসর বসে। কাঁঠাল গাছের তলায়। ডাক বাংলা র একটা হ্যারিকেন মাঝে।
অমূল্য বাউরী লোকটি স্বতন্ত্র। কম কথার লোক। ঐ ডাক বাংলা র খালাসি। কিন্তু তার দাম আলাদা। তার ছোট ছেলে। নাম তার মন্ত্রী। তার ও খুব উৎসাহ। সে ও দলে আছে। কোঁড়া পাড়া থেকে বটু ও আসে। সে একটু জানে বোঝে। একটু মাতব্বর ভাব তার আছে। তবে কথা বুনতে পারে।
গোপাল বাউরী ভালো হারমোনিয়াম বাজায়। চণ্ডী না পারলে
তার শরণাপন্ন হয়। বয়সে এদের থেকে বড় আর বেশ চুপচাপ ভালো মানুষ। কারো সাথে তার বিবাদ নাই। মিষ্টি ধীর কথা।
তার বাবা ও ডাকবাংলা র খালাসি। সতন বাউরী। ঘরে ভাত আছে।
সে ও কথা বসিয়ে সুর তুলে দেয়। ওপাড়া মানে পূবপাড়া থেকে
এ পাড়াতেও মাঝে মাঝে আসে শ্রীধর বাউরী র কাছে। সে ভালো হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গাইতে পারে। গোপাল আর শ্রীধর আমার দাদুর কাছে কিছুদিন শিখেছিল। তারপর নিজে নিজে চর্চা করে মোটামুটি ভালোই। চণ্ডী গোপালেরই ছাত্র। আর ছোট খাটো চেহারার গোপাল মাল ভালো নাচে। সেই নাচনী।
মোটামুটি আট দশ জনের দল দাঁড়িয়ে যেত। গাঁয়ে গাঁয়ে দল
ভাদু নাচাতে যেত। অযোধ্যা বা আদুরিয়া বা মাজুরিয়া ছুতোর ঘর থেকে ভাদু প্রতিমা আনত। বেশ মিষ্টি মুখের গোল বা পানপাতা মুখের প্রতিমা। মেয়ে ভদ্রেশ্বরী। মা ভদ্রেশ্বরী। তাকে
নিয়েই ; তাকে উদ্দেশ্য করেই গান। সে গানে গরীব গ্রাম সমাজের জীবনের নানা কথা। ' ভাত নাই গো সবার ঘরে / ও ভাদু মা চল যাই দূরে '। গাঁ ছেড়ে আর কোথায় যাবি। ভাত নাই সবার ঘরে। ভাদর মাসে ' রাজার ভাড়াঁর খালি ' ভেবেই সান্ত্বনা। তাল আঁটি চুষে ই কত জনে পেট ভরায়। " ঘরে নাইকো চাল ; গাছে আছে তাল। " তালের মাড়ি ; চারটি মুড়ি ; আর একটু গুড়। মেখে খেয়েই দিন কাটে।
পরনে ট্যানা জোটেনা। ভাদুকে নিয়ে রাণীগঞ্জের বা দুবরাজপুরের বাজারে যাবার ইচ্ছে। লাল শাড়ি কেনার জন্যে।
আর কাঁচের চুড়ি ; গন্ধ তেল ; স্নো ; পাউডার ;আলতা ; সিঁদুর । আর খাবার তো খুব ইচ্ছে লেডিকেনি ; পান্তুয়া ; মিহিদানা ; সীতা ভোগ।
কোন গাঁয়ে না দল ছিল। প্রায় সব গাঁ য়ে। বাউরী ; বাগদী ; মেটে ; মাল ; কোঁড়া ঘরের যুবক ছেলেরা দল গড়ে। দলে নাচনী থাকে। বাজনদার থাকে। আর মাষ্টার ; মূল গায়েন তো
আছেই। কোন গাঁয়ের কোন দলের গান বেশ জমাটি হলে সেটা সব দলেই ছড়িয়ে যায়। কথার সামান্য অদল বদল ঘটিয়ে। সাতকাহনিয়া ; অযোধ্যা ; ডাঙ্গাল ; মাজুরিয়া ; রঘুনাথপুর ; আদুরিয়া ; শ্রীচন্দ্রপুরের ভালো দল ছিল।
গাঁয়ে গাঁয়ে ঘুরে ঘুরে ভাদু নাচানো। চাল ; আলু ; পয়সা যা জোটে। বাবুদের বাড়িতে বেশীক্ষন নাচ গান চলে। বেশী কিছু পাবার আশায়। এক এক দিন এক এক দল এক এক দিকে যায়। সে বোঝাপড়া থাকে।
সব দলের প্রথম গান ' নম নম নম ভাদু ; নমি তোমার চরণে /
কাল পূজেছি সাদা ফুলে আজকে হলুদ বরনে। "
" ভাদু আমার ছুট্ট / মোড়ে মেয়ে ; কাপড় পরতে জানেনা। "
কাপড় ই নাই তো পরবে আবার কি!
সাতকাহনিয়া গ্রামের প্রাচীন বটগাছের তলায় একবার আমরা উদ্যোগ নিয়েছিলাম ; সেই প্রথম এলাকায় ; চারপাশের
গ্রামের ভাদু দল গুলিকে এক জায়গায় করে ভাদু গানের আসর বসানো র। হয়েছিল। ' ৭৬ - ৭৭ সাল হবে। সে কথা আজ আর কার ও মনে নেই। না থাকার ই কথা। এ আর এমন কি ব্যাপার যে মনে থাকবে!
পরে বাম সরকারের সময়ে কৃষক সভার উদ্যোগে শুরু করা হয়েছিল " শ্রমজীবী সাংস্কৃতিক উৎসব "। ভাদু ; তুসু ; বাউল ; ফকিরী ইত্যাদি লোক গানের অনুষ্ঠান।
পরে তা ত্রিস্তর পঞ্চায়েতের উদ্যোগ লাভ করে।সাক্ষরতা কে কেন্দ্র করে উৎসব চালু হয়। নূতন উৎসাহ। কৃষক আন্দোলনের সাফল্যে গরীব গ্রামের পাড়া গুলি জাগছে ; জেগেছে। যেন প্রাণ ফিরে এসেছে। অভাব নিয়েও আনন্দ।
গ্রাম গুলি জেগেছিল। তখন আর পুরনো রা প্রায় নেই। বা তাদের উৎসাহ নেই। আমাদের মধ্যে যারা পারে তারা হাল ধরেছিল। গান লিখে দল গুলিকে তৈরী করে দেওয়া হয়েছিল।
কোন গ্রামের মেয়েরা তুসু গান ভালো গায় তো - কোন গ্রামের দল ভাদু। তারপর শুরু হল প্রতিযোগিতা। পুরস্কার।পাড়ায় পাড়ায় নতুন উৎসাহ উদ্দীপনা। কাঁকসা জুড়ে ই। নানা জায়গায় গরীব পাড়ার মেয়েদের গান লিখে দিচ্ছেন ; পরেশ ; স্বরাজ দা পরশুকরেশ দা রা ; বিলাস দা ; শান্তি দা রা সুর করে দিচ্ছেন। নব ; নারান ;পবিত্র রা বাঁশি তে প্রাণমাতানো সুর তুলছে।ভরত রা ফকিরী গানে মাতিয়ে দিচ্ছে। সব নাম এই মুহূর্তে মনে আসছেনা। পরে তুলে নেব।
আমার এ গ্রামের ভাদু দল কে দাঁড় করানো আর যায়নি। অযোধ্যা গ্রামের ভাদুর দল টা দাঁড়িয়েছিল। কুমাই বাগদি। ভালো চেহারা। মূল গায়েন। রামপ্রসাদ ভালো গান লেখে।পালা লেখে। একটা কবি গানের দল ও ভালো হয়েছিল। কুমাই আর স্বভাব অভিনেতা দীনবন্ধু মানে চাঁপু চ্যাটার্জি দুজন দুপক্ষের মূল গায়েন। এরাও অনেক দূর গিয়েছিল। আরও অনেকে সেই সময় মঞ্চে চেপে ঢাক ঢোল ; পাতার বাঁশী ; বাউল গান শুনিয়েছে মানুষ কে। অনেক নাম পবন ; হরবিলাস ; অশোক ; নিরঞ্জন ; অষ্ট ; সন্তোষ ; লখু ; দুলাল
এমন আরও কতো নাম। বনকাটি তখন এগিয়ে।
বনকাটি মানে বনকাটি গ্রাম পঞ্চায়েত।
প্রতিবারেই কোন না কোন দল জেলা বা রাজ্য স্তরে যাচ্ছে। পুরস্কার আনছে। একবার তো পানাগড়ে মিত্র সংঘের মাঠে বোধহয় জেলা স্তর প্রতিযোগিতার আসর বসল। মূল মঞ্চ বিদ্যাসাগরের নামে। তাছাড়া আরও অনেক গুলি মঞ্চ। সব মঞ্চ ই বিখ্যাত মনীষী দের নামে। তাঁদের প্রতিকৃতি মঞ্চে টাঙানো। সব প্রতিকৃতি আমি এঁকেছিলাম। তাছাড়া ও ছিল মঞ্চ সজ্জার কাজ।
অনেকে নেমেছিল সে কাজে। দিন রাত কাজ চলেছিল।
এ গাঁয়ের মেয়ে রা তুসু গানে অনেক দূর এগিয়েছিল। সামাজিক সচেতনতা গড়ে তোলা র প্রয়োজনে গানের শীর্ষক
( টপিক) বলে দেওয়া হত। সেবার ছিল ' মেয়েদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ' বিষয়ক তুসু গান। গাঁয়ের গরীব ঘরের মেয়ে দের ডেকে
জড়ো করত উদয়। উদয় বাউরী। ওর খুব উৎসাহ ছিল।
আমার ঘরের বারান্দায় বসত ওদের আসর। গান লিখে দিতে
হত আমাকে। গান লেখা আমার তেমন হয়না। তবু ওদের জন্য পারতে হত। ব্লক স্তর পর্যন্ত আমাদের গাঁয়ের মেয়েরা এগুতে পারত। দুবার গেছে জেলা স্তর পর্যন্ত।আমার মেয়েটাও যেত ওদের সঙ্গে। জেলা থেকেও পুরস্কার নিয়ে ফিরেছে। সব সার্টিফিকেট আমার কাছে আজও জমা।
ঘর গেরস্থালী র প্রয়োজনীয় ভালো স্টেনলেস স্টিলের জিনিস পত্র প্রাইজ হিসাবে দলের প্রত্যেকে পেত। তাদের কাজে লাগত। সে সব মেয়েরা আজ গিন্নীবান্নি। হয়তো দিদিমা ঠাকুমা হয়ে গেছে। সে সব গান ও কোথায় হারিয়ে গেছে।
তাদের জীবনে ও বোধহয় আর গান নেই।
কি জানি তাদের আর মনে আছে কি না যে 'হ্যাঁ ; আমরাও পারি '। আমরা ও স্টেজে চেপে গান গাইতে পারি। পুরস্কার পেতে পারি। তারা যখন ফিরত পুরস্কার নিয়ে তাদের সেই
ঝকঝকে আনন্দ উজ্জ্বল মুখ চোখ গুলো শুধু আমার মনে রয়ে গেছে।
------------ ------------ ------------ ------------ ----© প্রণব ভট্টাচার্য।
পুনঃ। চারপাশের গ্রাম গুলিতে কোথাও আর ভাদু গানের দল
No comments:
Post a Comment