Thursday, 8 September 2022

।। বুড়ির বাঁধ।।

।। বুড়ির বাঁধ ।। 
সে এক বুড়ি। 
 দিয়েছিল জমি। 
 সেই জমির মাটি নিয়ে তৈরী হয়েছিল অনেকটা নদী বাঁধ। সাতকাহনিয়া গ্রাম থেকে। 
 আর বুড়ির সেই জায়গায় হয়েছিল একটা লম্বা জলাশয়। 
 নাম হয়েছিল মানুষের মুখে মুখে ' বুড়ির বাঁধ '। 
 কোন সে  বুড়ি। কি তার নাম। তার আর কোন হদিস নেই। তাই কি থাকে! সে প্রায় দেড়শো বছর আগের কথা। 
  সে যে কোন সেন বাবুরা কাটালেন পুকুর। না তার ও কোন হদিশ নাই। হতে পারে সেন বাবুদের জায়গার থেকে বাঁধ তৈরীর মাটি নেওয়া হয়েছিল। 
 হল ' সেনপুকুর '। 
 শোনা যায় এক সেন বাবু না কি ছিলেন উকিল। 
  আজ আর কোন সেন বাবু আর মাছের ভাগ নিতে আসেন না 
  তাঁদের ' সেন পুকুরে ' মাছ ধরানো হলে। 
 আছে ' শীল পুকুর ' ' বামুন পুকুর ' ঘোষ পুকুর ' ' কর পুকুর ' 
  ' বেণে পুকুর '  ' দে পুকুর ' ' বামুন পুকুর ' বামুন গোড়ে ' শুঁড়ি
 গোড়ে ' মালি গোড়ে ' বৈরাগী গোড়ে ' 
  গাঁয়ের মানুষের দায় পড়েছে বৈরাগী বলতে। সোজা কথায় 
 'বোরেগী গোড়ে'। 
  আছে ' বড় বাঁধ '। ছোট বাঁধ। 
   নাম তার ' গোলাম পুকুর '। ছিল একদিন গোলাম মিঁয়া র। 
 সৈয়দ বংশের গোলাম পাঞ্জাতন। তিনি যে কিভাবে হারালেন 
 পুকুরের মালিকানা। যথেষ্ট প্রভাবশালী মানুষ ছিলেন। করিতকর্মা।  নীলকুঠি র নীল চাষ তদারকি করতেন। এই গাঁয়ে তো বটেই। আবার অজয়ের ওপারে 
 নহনা ; কানুর  এই সব গ্রামে ও। সুরুল নথি তে তাঁর নাম পেয়েছি।অবশ্য যদি তিনিই সেই ব্যক্তি হন।  তারপর শুনেছি নানা মামলা মোকদ্দমা য় জড়িয়ে 
গিয়েছিলেন। আর তার খরচ মেটাতে ই সম্পত্তি হাতছাড়া। 
  অযোধ্যা গ্রামের বেণে রা যথেষ্ট ধনী। সোনার কারবার তো 
 বটেই। আরও কত কারবার। ঘরে তাদের কতো রূপোর মোহর। ঝুড়ি ভর্তি করে গুপ্ত ঘর থেকে বার করে ; ভালো করে ধুয়ে রোদে শুকোতে দিত। দত্ত ; কর ; চন্দ রা বিরাট বড়লোক। 
 এ গাঁয়ে যে বেণে পুকুর তা কি ওঁদের। চন্দের মাঠ কি ঐ চন্দ দের। কর পুকুর কি  কর দের।  না কি তাঁরা তখন এ গাঁয়ে বাস করত। 
 এ গাঁ তো কারিগর দের বিশাল গ্রাম। তাঁতি ; কামার ; কুমোর ;
 কলু ; মালাকার  আরও কত জাত। বাউরী ; মাল ; কোঁড়া ; হাঁড়ি ; চণ্ডাল  রা আছে। বামুন ; কায়েত ; তাম্বুলী রা আছে। ঘোষ রা সদগোপ না কি গোয়ালা। সন্ধান নেই। 
 নদী ধারের গাঁ। অজয়ের জলপথে ছোট ছোট নৌকো য় কত মাল যাচ্ছে আসছে। এখানের মাটির বোতল না কি ছিল খুব 
 বিখ্যাত। মাটির তৈরী হরেক জিনিস। তাঁতিদের তাঁতের খটাখট  শব্দ সারা গাঁ জুড়ে। সাহেব বাবুদের নীল চাষ। 
 নীল বাড়ি র মাঠ আজও আছে। আর আছে অজয়ের তিনটে 
ঘাট। কলাবাগানের ঘাটের বেশ নাম ডাক। সেখান থেকেই মাল 
 ওঠানামা করে। সে তো অনেক কথা। নদী ধারে বোরেগী আখড়া। এ গাঁয়ে অনেক বৈরাগী বাবাজী। গোপাল বাবাজী র 
 ' গোপাল সায়ের ' মজে সমতল হয়ে গেছে। বাড়ি ঘর সব হয়ে গেল। শুধু নাম টা আছে। আর আছে এক প্রাচীন খেজুর একা 
 দাঁড়িয়ে। তার পাশেই না কি ছিল গোপাল বাবাজী র আখড়া। 
 গাঁয়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে প্রাচীন এক বটবৃক্ষ। বৈরাগী বটতলা। সে ই এই গাঁয়ে র প্রাচীনত্বের স্মারক। 
  এ গাঁয়ের অনেক কথা। কথা সহজে ফুরাবে না। সাত কাহন কথা তার। নাম তার সাতকাহনিয়া। 
 আজ শুরু করেছি পুকুর দিয়ে। এত পুকুর ; ডোবা ; গোড়ে। 
 নাই আজ অনেক কিছু। কিন্তু ছিল একদিন। ছিল বিশাল 
 আমবাগান। গাঁয়ের পূব দিকে। নাম ছিল তার অধিকারী আম 
 বাগান। গোলাম পুকুর এর পাড়ে তাঁতিদের ছোট আমবাগান। 
 খই নাড়ু আমগাছ টা কে খুব মনে পড়ে। কি সুন্দর গোল গোল 
 নাড়ু র মতো মিষ্টি সে আম। গাছ টা যে দিন কাটা পড়ল। 
মনে পড়ে ছুটে গিয়েছিলাম তার কাছে। লাল রঙের আম আঁঠা র গড়ানো রস আমার মনে হয়েছিল যেন রক্ত। 
 সারাদিন খুব মন খারাপ। কেন কাটল?  কেন?  কি ক্ষতি করছিল গাছ টা - !  গাছটা বেচে সেই টাকায়  সংসারের কোন 
 খরচ মেটানো হচ্ছে  সে সব বোঝার বয়স তখন  নয়। 
দেখতে দেখতে এক এক করে বিশাল আমবাগান টা শেষ হয়ে 
 গেল। গাছ গুলো কে কাটার জন্য বাগানে তাঁবু খাটিয়ে করাতি রা ছিল কতদিন। গোলাম পুকুর পাড়ের খুব উঁচু উঁচু 
তালগাছ। উত্তর পাড়ে এক টা গাছ। চার আঁটি তাল। কালো 
 কুচকুচে। আর কি মিষ্টি তার ' মাড়ি '। সব কেটে দিল। 
 বেনে পুকুরের পাড়ে সেই পাকুড় গাছটা। যার গোড়াতে সে 
 গাঁয়ের মা মাসী দের দিদিমা ঠাকুমা দের পিতলের ঘটি করে 
 জল ঢালতে দেখেছে। গরমের দিনে জল সত্রের সময় ভিজে 
 বুটকলাই আর একটু গুড় দিয়ে প্রণাম করতে ও দেখেছে। 
 দাদুর সঙ্গে চান করতে গিয়ে দাদু পদ্ম পাতা তুলে এনেছে। 
 পদ্ম ফুল আর পদ্মের টাঁটি। তার ভিতরের বীজ টা খেতে কি সুন্দর। আর পদ্ম পাতায় ভাত। কি সুন্দর একটা ভিজে নরম 
 গন্ধ। গোলাম পুকুরে কোন দিন পদ্ম দেখেনি। আলো করে ফুটে থাকতো সাদা ; আর লাল শালুক। 
 এ শুধু এই গাঁয়ের কথা নয়। সব গাঁয়ের। সব পুকুর পাড়ের। 
 যত পুরাতন তাল গাছ ; আমবাগান ছিল সব বাবুরা কেটে 
 বেচে দিল। বাবুদের বড়ো টাকার লোভ। আর ভয় কে জানে 
 কখন বেহাত হয়ে যায়। কি সব আইন আসছে যেন!  
 যত তাড়াতাড়ি পারল সব কেটে বেচে দিল। 
  ছোট থেকে ঝোপেঝাড়ে ;মোরাম চাতালে ; আর উঁচু নীচু মাটির ঢিবিগুলোর উপরে ঘুরে বেড়ানো ; আর কল্পনায় সেই পুরনো গাঁ টা কে 
 খুঁজে যাওয়া  ছেলেটা ই কেবল ভুলতে পারেনা। বাকী সবাই 
 ভুলেছে। মনে রেখে তো কোন লাভ নেই। কোন কাজে ই আসেনা। 
 কোথায় যে গেল। এত এত মানুষ। এত জাতের। কতো পদবীর
 কে যে কোন দিকে ছড়িয়ে গেল। অনেক খুঁজেছে সে। রোগের ভয়ে যে যেদিকে পেরেছে চলে গেছে। 
  মালাকার রা গুসকরা ; শীল রা ভুঁয়েরা ; লায়েক বাবুরা কুলটি চিনাকুড়ির লোক ছিলেন। এখানে এসে জমিজায়গা কিনে বসতি স্থাপন করেছিলেন। কয়লা ব্যবসার জন্য। 
 নদী পথে কয়লা আসত। বনকাটির রায় বাবুরা কয়লার ব্যবসা করতেন। কয়লা যেত ভেদিয়ার কাছে বক্সীবাজারে। 
 কাটোয়া পর্যন্ত। 
   খোঁজ। খোঁজা বুঝি এক নেশা। আজও সে খুঁজে যায়। 
 এ গাঁ কে খুঁজতে খুঁজতে কত গাঁ য়ে গিয়ে উঠেছে। 
  আরও কত জায়গায় যেতে হবে। কত কাজ বাকী। 
 কথা দেওয়া আছে কামাল দা কে। খুঁজে দেব। সে কাহিনী বলেছি। আবারও বলব। 
   আজ পুকুরের কথা। ঘোষ ; সেন ; কর ; বেনে ; দে ; শীল পুকুর বোঝা যায় কাদের কাটানো। আবার বামুন পুকুর বললে তো বোঝা যায়না কোন বামুনের। কত নাম পাচ্ছি। লায়েক ; চক্রবর্তী ; মুখোপাধ্যায় ; অধিকারী এই সব পদবী। একশো বছরের ও আগের দলিলে। অনেক দিন আগেই সব হাতবদল হয়ে গেছে। অতএব আধুনিক কালের রেকর্ডে কিছু পাওয়া যাবেনা। আর কি ভাবে যে পাওয়া যাবে -  
  পুকুরের নাম যদি হয় ' প্রেমসায়র '। 
  কি ভাবে যে এমন  নাম হল পুকুরের!  
  আমার মনে যে ভাসছে একটা বেশ সুন্দর কাহিনী। ' রাধা ' কে মনে পড়ে। ' কমললতা ' উঁকি দিয়ে যায় মনে। 
 গাঁয়ে এত বাবাজী বোষ্টমের আখড়া। 
   কি জানি সে কোন বাবাজী চণ্ডীদাস আর রামী ধোপানী! 
  না কি অন্য কোন প্রেম ভেসে আছে প্রেমসায়রের কালো জলে! কি জানি। 
  খুঁজছি। কিন্তু অতীত বড়ো নীরব। 
   বড়ো অন্ধকার সেই কালগর্ভ । 

গ্রাম। সাতকাহনিয়া। জে এল নং ৩৪। পোঃ বনকাটি । জেলা পশ্চিম বর্দ্ধমান। 
।গ্রামের পুকুর ডোবা জলাশয় বৃক্ষাদির কথা। 
------------ ------------ ------------ ------------ ------------ ------- শেষ করি। 

No comments:

Post a Comment