শুনুন। শুনুন
আমি এই মাটির মানুষ। জন্মেছি এই রাঢ় মাটিতে। অজয়ের কুলে
জল জঙ্গলের দেশের মানুষ।
ছোট থেকেই ঘুরে বেড়াই একা একা। হেঁটে হেঁটে বা
বড় হলে সাইকেলে।
যখন ছোট পাহাড় তো দেখিনি। অথচ ভূগোল বইয়ে পড়ি।
তো আমার গাঁয়ে ' বেণে পুকুরের " উঁচু পাড়ে উঠে ভাবতাম এই বুঝি পাহাড়।
দাদু গল্প বলতেন হিউয়েন সাঙ হেঁটে আসছেন পামির মালভূমি র উপর দিয়ে মরুভূমি র মধ্যে দিয়ে।
আমার গাঁয়ের পশ্চিমে মোরাম চাতাল। উঁচু নীচু খোয়াই। খাদ। বর্ষায় প্রবল বেগে গিরি লাল জল নামে।
আমি হেঁটে বেড়াতাম সেই চাতালের উপরে।সেই চাতাল ই আমার পামির
বৃষ্টি বন্ধ হলেই দে ছুট।
দেখতে হবে না জলের ছুটে যাওয়া
' মাতা মা ' সাথে করে নিয়ে যেত জঙ্গলে। লতা পাতা চিনতাম। এই বৈষ্ণবী আমাকে কোলে পিঠে মানুষ করেছে। কত ওষুধের গাছ লতা পাতা চিনেছি তার কাছ থেকে।
শাল পাতা পচে ছাতু ফোটে। কত রকমের ছাতু।
কোনটা খায়। কোনটা খায়না-
মাটির নীচে ফোটে ' কুড়কুড়ে ' গোল গোল ছাতু।
তুলতে যেতাম। মা মানে মাতামা র সাথে। আহা কি স্বাদ। উই ঢিবির উপরে ছাতু। খড়ের 'পোয়াল ' গাদায় ছাতু।
তার ঝাল। কি স্বাদ তার।
এই জঙ্গল ই আমার কাছে কঙ্গো র জঙ্গল।
চেনেন কি " আঁতমোচড়ানো " কি " বৃহৎ গজদন্ত পিপুল " কি " বাঁদুরে কলা "।বানর রা চেনে হুপিং কাশির মতো কাশি হলে ওরা খুঁজে খায়। কি ঝাল!
সাপ আর বেজীর লড়াই দেখেছেন।
একবার একটা ঝোপের আড়াল থেকে দেখছিলাম। কোনও ভাবে বেজী টা বিষধর এর কামড় খেয়ে ছুটে ঢুকে পড়ল জঙ্গলে র একটা ঝোপে। কি একটা মূল তুলে চিবিয়ে খেয়ে নিল।
আমি আর ভয়ে সেই ঝোপে ঢুকতে পারিনি।
মাতামা কে দেখিয়ে দিলাম সেই ঝোপ । মাতামা সংগ্রহ করে
আমার হাতে তাগার মতো করে একটুকরো বেঁধে ফুঁ দিল। জঙ্গলে ভয় " পাতাশী " র। শাল পাতারনীচে থাকে বিষাক্ত পোকা। কি জ্বলন!
আর ফুলে যায়। " অনন্ত মূলের " শিকড় খোঁজো।
তার রসে জ্বালা কমে যায়।
" আঙ্গারে " নামে একটা কালচে খয়েরী রঙের ছাতু ছিল। কি স্বাদ তার। মাংসের মেটের মতো।
আর ছিল নদী ধারে বুনো " ঘি কল্লা " র কত ঝোপ। সেই ঘি করলা তুলে এনে তার ঝাল ; পোস্ত।
আহা কি ছিল তার স্বাদ। কত " শতমূলের কাঁটা ঝোপ "। ফুলের কি মিষ্টি গন্ধ।
এই অজয় ই আমার আমাজন। কি ভীষণ বর্ষায় তার বেগ।
' নামো পাড়া '। মানে গাঁয়ের উত্তর পশ্চিম দিকের মরে যাওয়া ' পোড়ো ' গ্রাম। অজয়ের বন্যায় আর
ম্যালেরিয়া ; কলেরায় সেই বড় গাঁ কবেই শেষ হয়ে গেছে। পড়ে আছে কত না মাটির ঢিবি। গলে ক্ষয়ে যাওয়া তবু টিঁকে থাকা দেয়ালের কোনা।
তার মনে হত এই তার ' মহেঞ্জোদারো '। সেই ঢিবি গুলোর উপরে নির্জন দুপুরে ঘুরে বেড়াতাম।
মনে সাধ -খুঁড়তে হবে। রাখালদাস -
একটু বড় না হওয়া পর্যন্ত " গড় জঙ্গল " এ ঢুকতে পারিনি। তখন ঘন ঘোর অরণ্যানী। দুর্গম।' আর ' আলকুশি'র জ্বলুনি। ইছাইঘোষের দেউল। সন্ধ্যে নামলেই গো বাঘা দের জ্বলজ্বলে চোখ। মশাল জ্বালিয়ে লোক যায়। দামোদরপুরে ' হেঁড়োল বাঁধি'।
হেঁড়োল গুলো সব জল খায় এখানে। জঙ্গলে র ভিতরে পুকুর। নাম তার ' চৌদল্লা'। চতুর্দোলা থেকে। এখন সেখানে যে ঢুকি - সাধ্য কার!
জঙ্গলের ভিতরে আছে গ্রাম। গ্রাম নাম তার সরস্বতী গঞ্জ। ভাবুন একবার - গঞ্জ। আছে অনেক আদিবাসী পাড়া। নাম আলী নগর। ভাবুন নামটা।
আছে। আছে। আছে বই কি অনেক কথা
আছে 'রক্তনালা' টুমনী নদী। হ্যাঁ বর্ষায় একবার কুমির উঠে এলো। এখানে বেশ গভীর।
আছে বাঁধে র গায়ে শত বর্ষে র ও বেশী প্রাচীন সব শিমুল। কি সব তাদের গোড়া। খাঁজে ভাঁজে বড় তাঁবু। পাঁচ ছ জন ঢুকে যাবে আরাম করে।
আছে বিরাট " রাজার দিঘী '
গড় কেল্লা খেড়োবাড়ি। নামটা দেখুন
'গড় কেল্লা '। গড় মানেও দুর্গ। কেল্লা মানেও দুর্গ।
গড় কেল্লা। আছে ' ঘোড় দৌড় 'এর মাঠ।
সময় কালের ব্যবধান প্রায় হাজার বছরের।
সে কথা অনেক শুনে ছেন আমার কাছে। কথা আর কাহিনী তে মেশানো। না হয় আবার শুনবেন।
অনেক গল্প অনেকে শোনাচ্ছেন। শোনাবেন বই কি!
আপনারা ও শুনবেন।
কিন্তু
আমার গল্প কথা। সে আমার ই।
" পাষাণ চণ্ডী তলার বাগানের " ওপারে সূর্য অস্ত যায়। আর আমি " গোপাল সায়েরের " পাড়ে একলা নির্জন এক দীর্ঘ খেজুর গাছের তলায়
দাঁড়িয়ে তাকেই বলি " বল আমার গল্প আমারই কি না "
No comments:
Post a Comment