কথা - সাতকাহন।। প্রথম পর্ব। প্রথম অধ্যায়
কত কথা তার।কথার কি আর শেষ আছে নাকি। লতার মতো বেড়েই যায়। বয়সে র কি গাছ পাথর আছে না কি এ গাঁয়ের।
'" কথা তার কাহন সাতেক নামটি সাতকাহন "
সাতকাহন কড়ি দিয়ে কে যে কবে এ গাঁয়ের চৌহদ্দি কিনেছিল তার হদিস কে দেবে গো আর। সাত কাহন খড় বিছিয়ে ও শেষ হয়না যে। এ গাঁ এত বড়। এত ছড়ানো।
তিনটি তার অংশ। সাতটি পাড়া। নাই এমন কোন জাত নাই।
গাঁ য়ে যে কত পুকুর আর ডোবা। ঘোষ ; বেনে ; মালাকার ; সেন ; শুঁড়ি ; বামুন ; দে ; শীল ; এই সব পদবী নামে পুকুর ডোবা তো আছেই। আছে গোলাম পুকুর ;। কিন্তু কে বলবে কেন পুকুরের নাম ' প্রেমসায়র '। ছিল অনেক বাবাজী বোষ্টম।
ছিল তাদের আখড়া। আছে বোরেগী গোড়ে। ছিল গোপাল সায়ের। গাঁয়ের মাঝে বিশাল সে বটবৃক্ষ। বৃক্ষ তুমি বট হে বটবৃক্ষ। নাম তার বাবাজী বটতলা। আছে অনেক পুরনো কালো তমাল। অতি শীতল তার ছায়া। বুড়ো বাবাজীর আখড়া নাকি ছিল সেখানে। গোটা গাঁ জুড়েই কুমোর আর তাঁতিদের বাস। কামার কুমোর ; ছুতোর ; মালাকার ; স্যাকরা ; বেণে কে নেই।তামুলী রা এসেছে। নানাবিধ ব্যবসা করে। পরবর্তী সময়ে এই তাম্বুলী বংশের রজনী কান্ত হালদার কেন্দুলীর কাঙ্গাল ক্ষেপা চাঁদের প্রধান ভক্ত শিষ্য হয়ে নিজ পরিবারকে যথেষ্ট প্রভাবশালী হিসাবে গড়ে তোলেন। অজয়ের দক্ষিণ পাড়ে কারিগর দের জমজমাট গাঁ।
এত তালগাছ যে মাটিতে রোদই পড়েনা। গা ছমছম পুকুর পাড়। নদী ধারে নীলের ক্ষেত। বাবাজী আখড়া। কলাবাগানের ঘাটে ছোট নৌকোর আনাগোনা। হাঁড়িরা খেয়া বায়। ওপারে নারানপুর। উদয়পুর ; ক্ষুদ্দুপুর ; ভরতপুর নানা গাঁ।গাঁয়ের দুদিকে দুটো ঘাট। উঁচু ডিবি র উপর হাঁড়িপাড়া। মানুষের মাথার সাইজের বেল গাছ ছিল পাড়ার মাঝে। আর ডেঁয়ো মাদারের গাছ।
খেয়াতো বায় ই। আবার ডাকাতি তে ও যায়। ভাড়া খাটে। কোথায় যে গেল তারা। ছোট বেলাতেও দেখেছি।
এপার ওপার নিতি যাতায়াত। নীলক্ষেতে চাষের জন্যে কোঁড়া রা এসেছে। মাল রা আছে। কি তাদের শক্তপোক্ত চেহারা।কি তাদের লাঠিখেলা।
বাউরী রা আছে। আদি কয়েকঘর। ভালো ঘরামি। একেবারে সোজা মাটির দেয়াল তোলে। ঘর ছায়। খড়ের নৌকো চাল ওরা ছাড়া আর কে ছাইবে।
কুলুরা আছে। ঘরে ঘানি। ক্যাওট রা আছে। নদীতে মাছ ধরে।আর মা মনসার পুজো করে। দশহরায়।
এত পুকুর। মাছ চাষ করে। সবাই কে নিয়ে ভরা ভর্তি গাঁ।
এই রকম নদী ধারের ছায়া শীতল এক গাঁ য়ে আজ থেকে প্রায় ২০০ বছর আগে নদী পার হয়ে এলেন এক সুফি সন্ত।
নাম তার সৈয়দ শাহ জাওয়াদ আলী পিতা সৈয়দ শাহ তকী। ইরানের কেরমানি প্রদেশে তাঁদের আদি বাড়ি। সেখান থেকে এসেছেন আজমেঢ়ে। সঙ্গী হয়েছেন মির্জা পদবীর এক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি। শোনা যায় উচ্চ বর্ণের হিন্দু ঘরের মানুষ। সুফি সাধকের প্রভাবে সুফি ধর্মমত গ্রহন করেছেন।
সেখান থেকে নানা দেশ ঘুরে বীরভূমের খুস্টিগিরি। খুশ বা কুশ টিকুরী থেকে এমন নাম।
খুস্টিগিরি তখন সুফী সাধক দের অন্যতম কেন্দ্র। সেখান থেকেই নানা জন ছড়িয়ে পড়েন নানা দিকে।
এই গাঁয়ে এসে নদীর ধারে আস্তানা পাতলেন সৈয়দ শাহ তকী। এখানে এসেই তাঁর গুরু প্রদত্ত নিমের কাঠি তে পাতা গজিয়েছিল। যেখানে পাতা গজাবে সেখানেই আস্তানা গাড়বে। আর নিম কাঠিটি মাটিতে পুঁতে দেবে। গাছ হবে।
তিনি ইউনানি চিকিৎসা খুব ভালো জানতেন। সাপের কামড় ; পেটের অসুখ ইত্যাদি ভালো করতে পারতেন।
পরবর্তী কালে বর্ধমানের রাজা র মারাত্মক পিত্তশূল ভালো করে দিয়ে অনেক জমি জায়গা লাভ করেন। খ্যাতি তাঁর ছড়িয়ে পড়ে নানা দিকে। অনেকে তাঁর ভক্ত শিষ্য হন।
নদীর ওপারে এপারে। তিনি সেই সময় অত্যন্ত প্রভাব শালী মানুষ হয়ে ওঠেন।
তাঁর স্ত্রী কি তাঁর সঙ্গে এসেছিলেন! জানা নেই।
তাঁর ২/৩ পুত্র। এক পুত্র সম্ভবত নিঃ সন্তান ছিলেন।
সেই বংশের গোলাম পাঞ্জাতনের দুই পুত্র। সাহামত আলী এবং ঈশাহক আলী। সাহামত আলী র পুত্র সামসুজ্জোহা বিশেষ ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। শ্বেত শুভ্র পোষাক।
স্বল্প ভাষী। ইশাহক এর পুত্র আহম্মহ রেজা পরবর্তী জীবনে খুবই নামী হোমিও চিকিৎসক হয়েছিলেন।
হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা র একটা পরম্পরা তাঁদের পরিবারে এখনও আছে।
সামসুজ্জোহা র দুই পুত্র। বদরুদ্দোজা এবং সাদরে আলা।
বদরুদ্দোজা র স্ত্রী বীরভূমের রাজনগর এর এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে। অত্যন্ত সুন্দরী ; ব্যক্তিত্বময়ী মহিলা। বদাই মিঞা র গোলদারি দোকান একসময় খুব চালু হয়েছিল। বদরুদ্দোজা র ডাক নাম বদাই। স্বল্প কথার ভালো মানুষ।
তাঁর স্ত্রী র বাবা ও ছিলেন ডাক্তার। ইব্রাহিম ডাক্তার। মা কিন্তু এই গ্রামের। সায়রা বিবি এবং রাবিয়া বিবি দুই বোন।
এঁরা বুড়ো সাহেবের আদি বাড়িতে থাকতেন। অত্যন্ত ব্যক্তিত্বময়ী মহিলা। চেহারা ও তেমন। পারিবারিক বিবাদ বিরোধের নিষ্পত্তি করতেন দক্ষতার সাথে।
তখন কার সময়ে মাটির দেওয়ালের দোতালা বালাগাছি বাড়ি
যথেষ্ট আর্থিক সামর্থ এর পরিচায়ক। টিনের ছাউনি হলে তো কথাই নেই।
সামসুজ্জোহা মহাশয়ের পূর্বমুখী দোতালা বালাগাছি বাড়িতে
দোতলার বারান্দায় ছিল অনেক দামী বই। আমার ছিল সেই বাড়িতে অবাধ যাতায়াত। সেখানেই আমি খুঁজে পাই বাংলায় লেখা ভাই গিরীশ চন্দ্র সেনের মহাগ্রন্থ ' কোরান শরিফ "।সেই বই নিয়ে পড়ার চেষ্টা করি। উপলব্ধি তো সহজ নয়। তবু চেষ্টা করি। বয়স তো তখন অল্প। তবু কিছু জ্ঞান লাভ করি।
সৈয়দ মহম্মদ এর বাবার ছিল অনেক বাঁধানো বই। তাঁরা অবশ্য সেই আলমারী তে কাউকে হাত দিতে দিতেন না।সৈয়দ মহম্মদ কে আমি ডাকতাম ' পীর মামু ' বলে। লোকে ' কালো পীর ' বলতো। অত্যন্ত পরিশ্রমী মানুষ ছিলেন। অযোধ্যা হাটে কাপড়ের ব্যবসা করেছেন। সাথে হোমিও ওষুধ। যোগেশ মাষ্টার মানে চানু বাবু খুব বন্ধু ছিলেন। হাটে তাঁর চালায় বসে দুজনে চা খেতেন। শেষ বয়সে হজ করে এলেন। গুণী মানুষ ছিলেন। তাঁদের বাড়িতে বই অনেক ছিল আলমারি ভর্তি কিন্তু বাংলা বই কমই ছিল। সে সব বই এর হদিস পাচ্ছিনা।
আরবী ; ফার্সি ; বা উর্দুতে লেখা তাঁর বাবার অনেক বই ছিল।
ইসলামি শাস্ত্রে তাঁর বাবার ছিল অগাধ জ্ঞান। উত্তর প্রদেশ থেকে
পড়াশোনা করা মানুষ। অত্যন্ত রাশভারি মানুষ। পরবর্তী জীবনে সৈয়দ মহম্মদ ইউনানি এবং হোমিও চিকিৎসা য় দক্ষতা লাভ করেছিলেন। নিজেও ছিলেন ইসলামি শাস্ত্রে সুপণ্ডিত।
অপর শাখার অর্থাৎ বুড়ো সাহেবের বড় ছেলের বংশ ধর মহম্মদ আলী। তাঁর পুত্র আয়ুব আলী। আয়ুব আলী র পুত্র আনোয়ারুল হক। আমরা ফণী মামু বলতাম।খুব ভালো মানুষ। স্বল্প ভাষী। চিন্তাশীল। তাঁদের ছিল টিনের ছাউনি র বালাগাছি দোতালা মাটির বাড়ি। বড় তরফের বলে তাঁদের বিশেষ মর্যাদা বোধ ছিল। তাবিজ ; কবজ দিতেন।
আবার ননী মামু বলতাম যাঁর ভালো নাম মহম্মদ কাশেম। শনিবারে সুখবাজার পশু হাটে তাঁর যাওয়া চাই ই চাই। অবশ্য তাঁকে দরকার ছিল। তাঁর আত্মীয়ের ব্যবসার কাজে। দক্ষ মানুষ ছিলেন। মিষ্টভাষী। কালো আফগানী জ্যাকেট টি পরে সাইকেল নিয়ে হাটে যেতেন। তাঁর
পিতা - সৈয়দ মহম্মদ মুসা। পিতা র পিতা ঐ একই ব্যক্তি মহঃ আলী।
সৈয়দ মহম্মদ এর কথা আগে বলেছি। তাঁর বাবার নাম সৈয়দ মহম্মদ ইয়াসিন। এঁরা বাইরে থেকে এসেছিলেন। সরাসরি বুড়ো সাহেবের বংশধর এঁরা নন।বিহারে র বোকারো এলাকা থেকে এসেছিলেন।
বড় তরফের আর একজন ছিলেন। তাঁর এক বংশধর সৈয়দ মহম্মদ আমিন। বাবলু ছিল ডাকনাম। সে মারা গেছে। তার ভাই বেঁচে আছে। অন্যত্র থাকে।
সরু গলি রাস্তার দুই পাশে সারি দিয়ে সব বাড়ি। সবই বুড়ো সাহেব বা শাহ তকী র বংশধর দের। মসজিদ পর্যন্ত সরু রাস্তা চলে গেছে। মসজিদের পিছনে বুড়ো সাহেবের সমাধি মন্দির। তা আজ বহুদিন ভগ্ন স্তুপ। তালবন আর নানা গাছের ভিড়ে তাঁর সেই সমাধি। যে নিমডাল তিনি পুঁতেছিলেন তা পরে বৃক্ষ হয়েছিল। প্রবীণ রা তা দেখেছিলেন। পরে গাছটি মারা যায় অত্যাচারে। স্মারক হিসাবে সেই গাছের ছাল ছাড়িয়ে নিতে নিতে।
আমাদের গ্রামের এই সম্ভ্রান্ত সৈয়দ বংশীয় রা প্রাপ্ত জমি চাষের জন্য এবং নিজেদের নিরাপত্তার জন্য বর্তমানের ঝাড়খণ্ড থেকে কয়েকটি মোমিন মুসলিম পরিবার কে নিয়ে আসেন। সংখ্যায় আজ তাঁরা অনেকটা বেড়েছেন। পরিশ্রমী মানুষ। নিজেদের পরিশ্রমে আর্থিক অবস্থা র যথেষ্ট উন্নতি ঘটিয়েছেন তাঁরা।
বরং তাঁদের আনয়ন কারী সৈয়দ বংশীয় রা নানা কারণে আর্থিক ভাবে দূর্বল হয়ে গেছেন।
কিন্তু এঁদের মধ্যে আছে সেই পুরনো মর্যাদা বোধ। সম্ভ্রান্ততা।
বূড়ো সাহেবের সাথে যে মীর্জা উপাধি র সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি এখানে কিছু দিন বসবাস করার পর ঘুড়িষা গ্রামে বসবাস করার পর
স্থায়ী হন মুলুক নিকটস্থ এক নদী তীরবর্তী গ্রামে।
আমার অত্যন্ত প্রিয় মানুষ মোল্লা আহাসান কামাল দা তাঁদের সেই পূর্বপুরুষ এর তথ্যানুসন্ধান করার জন্য বলেছিলেন । কামাল দা এক অসামান্য সর্বশাস্ত্র বিদ পিতার সুযোগ্য পুত্র।
তাঁর পিতা মহান শিক্ষক মোল্লা আবদুল হালিম সাহেবের ধর্ম বিষয়ক বক্তৃতা যে না শুনেছেন তিনি বুঝতে পারবেননা যে কোন উচ্চতা র মানুষ ছিলেন তিনি।তাঁর উপনিষদের ব্যাখ্যা - আহা অসামান্য।
আমার সে সন্ধান জারি আছে। যেতে হবে নানা জায়গায়।
এই করোনা কাল আমাদের অনেক সময় কেড়ে নিল।
করারই বা কি আছে। কোথাও যে বের হব সে সাহস পাচ্ছিনা।
জানিনা কবে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরব।
অনেক কাজ যে বাকী রয়ে যায়।
কি জানি আর কতটা পারব!
এ মাটিতে মিশে থাক আমার প্রণতি।
" বাড়ি আমার ভাঙ্গন ধরা অজয় নদের বাঁকে।
জল যেখানে সোহাগ ভরে স্থল কে ঘিরে রাখে। "
এ মাটিতেই মাতৃগর্ভ থেকে জন্ম নিয়ে স্থান পেয়েছি। এ মাটি কে ই মা বলে জেনেছি।
' মাটি' মোর রক্তে মিশেছে '
---------------- ----------- ----------- ----------- ----------- © প্রণব ভট্টাচার্য। ১৯/৫/২১
তথ্য সহায়তা। সৈয়দ হোসনে জামাল। সুখ্যাত আমিন।
No comments:
Post a Comment