। রাজকুসুম।
পাথর প্রতিমা ; বা ফুলকুসমা এই সব নাম উচ্চারণ করলেই যেমন মনের ভিতর থেকে একটা ' আহা ' উঠে আসে - ঠিক তেমনই আমাদের এই 'রাজকুসুম '।
কি সুন্দর নাম বলুন। কে বা কারা রেখেছিল এই নাম।
কে বলবে। এই বাঙ্গলার অসংখ্য গ্রাম নামে এই ধরনের লালিত্য। যেন কবিতার স্পর্শ।
পূর্বে শালের জঙ্গল। সে জঙ্গলের ওপারে পানাগড় - মোরগ্রাম হাইওয়ে। সে জঙ্গলের নাম আছে ' সাতকাটার জঙ্গল '। কিন্তু অনেক খোঁজে র পরও জানতে পারিনি সেই সাতজন কারা। তাদের হত্যাকারী ই বা কে। তবে চোর ; ডাকাত দের উপদ্রব তো ছিলই এক সময়। তা দমনের চেষ্টা ও হয়েছে। যাক সে কথা।
উর্বর ভূমির বিস্তৃত ক্ষেত গ্রামের তিনদিকেই। অঢেল ফসল ফলে। কৃষিপ্রধান সম্পন্ন গ্রাম। পশ্চিমে রাস্তা চলে গেছে বাঁদরা - গোপালপুরের দিকে। দক্ষিণে পানাগড় এর দিকে। উত্তরে ত্রিলোকচন্দ্রপুরের দিকে।
এখন চমৎকার পাকা রাস্তা। গ্রামকে ঘিরে।
তবে গ্রামের সম্পন্ন পরিবার গুলি গ্রাম ত্যাগ করে চলে গেছেন অন্যত্র। আসানসোলের গঁড়াই পরিবার। সেখানে এক রাস্তার নামই এস বি গড়াই রোড। ব্যবসায়ী পরিবার। তাদের পরিবারের সরস্বতী পূজা বিখ্যাত। পূজার সময় বংশের মানুষেরা গ্রামে আসেন।
গ্রামে তৈরী করিয়েছেন বিরাট আধুনিক মন্দির।
গ্রামের বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাতা ও তাঁরা। এখন মাধ্যমিক বিদ্যালয়। তেমনই 'রায় ' পরিবার। পানাগড়ে থাকেন।
আসলে সেই ১৮৫৫ তে হাওড়া - রাণীগঞ্জ রেল লাইন পাতার পর ই গঞ্জ হিসাবে গড়ে উঠতে থাকে পানাগড় ; রাজবাঁধ দুর্গাপুর ইত্যাদি জায়গা।আর্থিক ভাবে সবল ; দূরদৃষ্টি সম্পন্ন মানুষেরা ব্যবসার জন্য চলে যান বাইরে। সেখানে তাঁরা প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। গ্রামের সাথে সংযোগ ধীরেধীরে কমে যায়। তবু ক্ষীণ হলেও সংযোগ একটা থাকে ই। মাটির টান।
মারাত্মক কলেরার সময় এবং বর্ধমান জ্বরের সময় ও অনেক মানুষ গ্রাম ত্যাগ করেন। যেমন অনেকে গোপালপুরে যান।
গ্রাম ও সেই সময় দক্ষিণ থেকে সরে আসে উত্তরে। এখন যেখানে গ্রাম। আগে ছিল না কি শ্মশান।
গ্রামের বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবার একসময় ছিলেন খুবই প্রতাপশালী। জমিদার। সেই পরিবারের ভগবতী প্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় মশাই এই গ্রামে নাচন গ্রাম থেকে এনে হরগৌরী মূর্তি এবং মন্দির স্থাপন করেন। এখানে সব দেবদেবী র পূজা হয়। এই ভগবতী প্রসাদের সাথে তাঁর মেয়ে পরিচয় দিয়ে 'মায়ের শাঁখা পরার কাহিনী ' জড়িয়ে আছে। শাঁখারী ছিলেন গোপালপুর গ্রামের। দীর্ঘ দিন সেই পরিবার থেকে মায়ের পূজার সময় শাঁখা আসত।
গ্রামের উগ্রক্ষত্রিয় ( আগুড়ী) রা ও যথেষ্ট সম্পন্ন ছিলেন।
স্থাপন করেছিলেন এখানকার বিখ্যাত শিবমন্দির টির।
প্রতিষ্ঠাতা মদনমোহন রায়। সামান্য টেরাকোটা র কাজ আছে। প্রতিষ্ঠা লিপি নাই। মাঝে সংস্কার হয়েছে। তবে মূল আকৃতির ক্ষতি হয়নি।
হরগৌরী মন্দিরের সামনে মুখোমুখি ছোট আকৃতি র শিব মন্দির দুটি ভগ্ন প্রায়। মুখোপাধ্যায় পরিবার ও যথেষ্ট প্রভাবশালী ছিলেন। রাজকুসুম মৌজার একটা বড় অংশে র খাজনা বর্ধমান রাজবংশের আনুকুল্যে পেতেন গোপালপুর এর গোস্বামী স্থানের জগজ্জীবন গোস্বামী। খাজনা আদায় করতেন মুখোপাধ্যায় পরিবার এর ভূধর মুখোপাধ্যায়।
আর বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের সম্পত্তির খাজনা বছরে দুবার জমা হত বর্ধমান কালেক্টর অফিসে। বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের সাথে মুখোপাধ্যায় পরিবার এর বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল। আবার রাজবাঁধে ব্যবসা করার জন্য শ্রীরামপুর থেকেও এক মুখোপাধ্যায় পরিবার এখানে এসেছেন।
আবার এই গ্রামের কিছু অংশের জমিদারী ক্রয় করেছিলেন বৈদ্যনাথ দত্ত এবং সরজুবালা দত্ত।
একসময় হাজরা পদবী র ব্রাহ্মণ রা ছিলেন। ' হাজরা বাঁধ ' সেই স্মৃতি বহন করছে। জঙ্গলে র মধ্যে রয়েছে ভগ্ন দালান।
ইজ্জৎগঞ্জ প্রসঙ্গে এখানে পরে আসব।
গ্রামে আছেন ' সামন্ত পরিবার ; আগুড়ি ; সদগোপ এবং শ্রমজীবী সম্প্রদায়ের অন্যান্য মানুষ জন। সবাই পরস্পর মিলে মিশে আছেন। তাই তো একদিন ছিল গ্রাম।
কাঁকসা র জঙ্গল মহলের একদিনের বিখ্যাত গ্রাম এই রাজকুসুম। এই রাজ আর অন্য কোন রাজ নয় আমাদের বর্ধমানের রাজাদের জমিদারী র অংশ। একটু দূরেই ত্রিলোক চন্দ্রপুর। বর্ধমান রাজ ত্রিলোকচন্দ্রের নামে ই। আবার এই রাজবংশের রাজা চিত্রসেন ১৭৪০-৪৪ এর মধ্যে এই সেনপাহাড়ী পরগণা র পুনর্গঠনের কাজ করেছিলেন।
গোপালপুর এর বিখ্যাত গোস্বামী স্থলে র স্থাপনা ও সেই বর্ধমানের রাজাদের ই অর্থানুকূল্যে। এবং সেই বৈষ্ণব মঠ মন্দিরের পূজার্চনা এবং সারা বছরের বৈষ্ণবী য় অনুষ্ঠানাদি পরিচালনা র জন্য পুজার অর্ঘ্য হিসাবে এই মৌজার খাজনা আশ্রমকে দান - তাই ' রাজকুসুম ' নাম।
আরও কিছু কথা থাকল বাকী।
দেখি সংযোজিত করা যায় কি না।
@প্রণব ভট্টাচার্য
No comments:
Post a Comment