।। চলুন ফেরা যাক।।
তাহলে এবার ফিরতে হয়।আর কেন। বেশ হল। ভালোই তো। এসেছিলাম শান্তি নিকেতনের মেলা। আর যদি হয়ে যায় একটু এদিক ওদিক ঘোরা। এই সুরুল, রাইপুর, সুপুর, ইটাণ্ডা, এই সব জায়গায়। বেশ একটা হেরিটেজ ট্যুর এর মতো।
তো প্রণব বাবুর সাথে গল্প করতে করতে ইটাণ্ডা হল। বেশ ভালো লাগলো।
শুধু ইটাণ্ডা কেন সবগুলিই হল। নিজেদের গাড়ি ছিল। ফিরতে তো হবেই। সপ্তাহ অন্ত হল যে।
সেই এগারো মাইলে এসে আবার প্রণব বাবুকে সাথে পেলাম। এবার ওঁর কথা শুনতে শুনতে চলেছি পানাগড় এর পথে। রাজ্য সড়ক। পানাগড় মোরগ্রাম হাইওয়ে।
,, আমরা দাঁড়িয়ে আছি সীমান্ত রেখায়। বুঝলেন।
এই রাস্তা সীমান্ত। এর পূর্বে, ঐ দেখুন রাস্তা চলে গেছে আদুরিয়া অমরপুর এর হয়ে আরও পূবে।
থানা - আউসগ্রাম। গুসকরা মোড় থেকে চমৎকার বনপথ চলে গেছে গুসকরা বা ভেদিয়ার দিকে।
কালিকাপুর মৌখিরা আছে ঠিক এই নীলকুঠীর জঙ্গলের খোয়াই এর নীচে। প্রাসাদ আর মন্দির নগরী। না দেখা থাকলে দেখতেই হবে
আর ঐ দেখুন রাস্তা চলে গেছে অযোধ্যা বনকাটি হয়ে আরও পশ্চিমে গড়জঙ্গল, ইছাই ঘোষের দেউল পার হয়ে আরও পশ্চিমে। কাজলাডিহি নবগ্রাম , শিবপুর দুর্গাপুর রাস্তাপর্যন্ত। পাশে পাশে অজয়।
অজয়ের ওপারে মানে উত্তর পাড়ে জয়দেব কেন্দুলী। বেশী দূরে নয় কিন্তু। বীরভূমে।
কি জানি মেলার সময় এসেছেন কি না।
এই পথের পাশেই আছে " তেপান্তর নাট্য গ্রাম "
যদি না এসেছেন, একবার এসে নিজের চোখে ই দেখবেন। বেশী এখানে বলছিনা।
রাস্তার এপারে মানে পশ্চিমে কাঁকসা থানা।
অর্থাৎ দুটো থানা এলাকার সীমানা আমাদের এই বড় রাস্তা পানাগড় মোরগ্রাম হাইওয়ে।
জঙ্গল শুরু হবার আগে বাঁদিকে মাজুড়িয়া গ্রাম।
আর ডানদিকে রঘুনাথপুর গ্রাম।
আদুরিয়া। বড়ো আদর করে রাখা নাম। কি বলুন।
সার্ভেয়ার জেনারেল রেণেল সাহেবের ম্যাপে (১৭৬৯) আদুরিয়ার উল্লেখ আছে। পথ চলে গেছে
আদুরিয়ার পাশ দিয়ে ভাতকুণ্ডা মানকর হয়ে বর্ধমানের দিকে।
আর পশ্চিম দিকে সেই রাস্তা সেনপাহাড়ি র ভিতর দিয়ে। এই পশ্চিম প্রান্তের কোন গ্রাম নামের উল্লেখ নাই। একটু অবাক লাগে। গোটা টাই জঙ্গল দেখানো আছে। অজয় পার হয়ে সে রাস্তা চলে গেছে রাজনগর এর দিকে।
ইছাইঘোষের দেউল আছে। অযোধ্যা বনকাটি র মতো জনপদ আছে। সাতকাহনিয়া আছে।
গৌরাঙ্গপুর আছে। বা সেদিনও ছিল। মাথা উঁচু করেই ছিল। কেন ম্যাপে কোন স্থান উল্লেখ নাই। আমাকে ভাবিয়েছে খুব। হয়তো তাঁর সহকারী রা
উল্লেখযোগ্য নয় ভেবে ভুল করেছেন।
যাই হোক আমাদের পূব দিকে ঐ যে আদুরিয়া অমরপুর শ্রীচন্দ্রপুর গ্রাম। সম্পন্ন গ্রাম ছিল আদুরিয়া।
অমরপুর এর পিতল শিল্পের খ্যাতি ছিল খুব।
দেবী অমরচণ্ডী র নামে অমরপুর।
পিতলের দ্রব্যের কারিগররা ছিলেন খুবই দক্ষ।
বিখ্যাত উখরার হাণ্ডা জমিদার বাবুদের পিতলের রথের প্রধান কারিগর ছিলেন রাধাবল্লভ মেহতরী।
নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাসই হবেনা। এত সুন্দর তার অলংকরণ।
কবিরাজ রা খুবই ধনী ছিলেন। ঝুড়ি ভর্তি মোহর
জলে ধুয়ে ছাতে রোদে শুখুতে দিতেন
গোটা পাড়া জুড়ে ছোট ছোট চালা রীতির শিবমন্দির। আবার পাশাপাশি মুখোমুখি দুটি
শিখর দেউল শিবমন্দির। আর ছিলেন বিষ্ণু।
এক পরিবারে নৃসিংহ দেবতার ক্ষোদিত মূর্তি পূজিত হন। মিলিত ভাবে অমরপুর আদুরিয়া
ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ এক গ্রাম।
মাজুড়িয়ার কথা। জুড়ি নাই যার। টোল শিক্ষার কেন্দ্র ছিল।
রঘুনাথপুর সম্পন্ন গ্রাম ছিল।
রঘুনাথপুর থেকে ঐ যে পশ্চিমে পিচ রাস্তা চলে গেছে মলানদিঘী হয়ে দুর্গাপুরের দিকে। মলানদিঘী এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা।
কেন গুরুত্বপূর্ণ! বলতে গেলে আরও একটু সময় লেগে যাবে। মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। এবং পেশগত শিক্ষার নানা প্রতিষ্ঠান এখানে গড়ে উঠেছে।
রঘুনাথপুর এর জঙ্গল বড় নয়। পার হয়ে এলাম।
বাঁদিকে বেলডাঙা গ্রাম। ব্যতিক্রম। এ গ্রাম আছে
বড় রাস্তার পূর্বে। এই বেলডাঙা থেকে রাস্তা চলে গেছে ধানতোড় কে পাশে রেখে ছোট রামচন্দ্রপুর, আড়জুড়ি, তিলং, রাঙাখুলা। আপনাদের মনে হবে বড়রাস্তা থেকে এত ভিতরে এই সব গ্রাম আছে! যাইহোক
এবার পিয়ারীগঞ্জ, আর পশ্চিমে তেলিপাড়া।
বর্ধমানের এক রাণী প্যারীকুমারী র নামে পিয়ারীগঞ্জ। পুরনো গ্রামে অনেক শিবমন্দির ছিল।
তেলিপাড়া। তাবলে তেলিদের গ্রাম নয়। তেলিরা আছেন বটে। গাছতলায় আছেন দেবী তিলাইচণ্ডী
বা তিলুইচণ্ডী। সেখান থেকে তেলিপাড়া।
এই দেখলেন, কখন হুস করে পেরিয়ে গেছি ছোট্ট কুনুরের সেতু। ছোট্ট কুনুর এখানে একটা নালার মতো। কিন্তু আরও নীচে বেশ চওড়া। অতিবৃষ্টি হলে ভাসায়। এমনকি গুসকরা শহরের নীচু এলাকা জলমগ্ন হয়। এই গুসকরা শহরের উপর দিয়ে কর্কটক্রান্তি রেখা চলে গেছে। গরম সামান্য বেশী অনুভূত হয়।
দোমড়া। দুই মোড়ের জায়গা। আবার কেউ বলেন ডোম রা। এখানের বৈষ্ণব আশ্রম টি প্রাচীণ।
গ্রামের ভিতরে আছে একটি শিবমন্দির। বাইরে একটি চাঁদনী রীতির বিষ্ণু দালান। এখানেরামকৃষ্ণ আশ্রমের শাখা কেন্দ্র আছে।
বর্ধমানের রাজা ত্রিলোক চন্দ্রের নামে গ্রামের নাম ত্রিলোকচন্দ্রপুর। অনেক বিশিষ্ট, সম্পন্ন পরিবার এখানে আছেন। পাল পরিবারের খ্যাতি ছিল নানা ব্যাধি উপশমের জন্য আয়ুর্বেদিক তেল তৈরী তে।
পূর্ব দিকে রাস্তা চলে গেছে দেবশালা হয়ে মানকরের দিকে। দেবশালার প্রাচীন নাম রাজগড়। তার মানে বুঝতেই পারছেন যে একটা গড় ছিল। তাবলে এ গড় রাজস্থানের দুর্গ নয়।
মোটা ইঁটের প্রাচীরের ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়।
রাজগড়ের অনেক গল্প কথা। পরে হবে। আচ্ছা আপনারা কাগজে হয়তো লবনধার গ্রামের নাম শুনেছেন। ভুল ভাবে বলা হচ্ছে আল্পনা গ্রাম।
আলপনা নয় বরং বলা উচিৎ " চিত্রিত গ্রাম। "
আপনারা যাঁরা শহরে থাকেন তাঁরা ভাবতেই পারবেন না ঐ মাঠ, জঙ্গলের ওপারে এমন সব সম্পন্ন, সমৃদ্ধ গ্রাম আছে।
যাই হোক শুরু হল ধোবারুর জঙ্গল। এই জঙ্গল কে বলা হয় " সাতকাটার জঙ্গল "। সেই সময়ে মানে মাত্র দুশো বছর আগে জঙ্গল ছিল জঙ্গলই।
আর চোর, ডাকাত, রাও ছিল। এই জঙ্গল ই তো ছিল তাদের ডেরা। কার বা কাদের হাতে সাতজন কাটা পড়েছিলেন। তার কোন নথি নাই।
অনুমান বৈদেশিক আক্রমণের মুখে পড়ে কাঁকসা রাজবংশ ধ্বংস হয়। সৈয়দ বুখারী ছিলেন তাঁদের নেতা। প্রবল যুদ্ধের শেষে কাঁকসা পরাজিত হয়।
সেই সময়ের ঘটনা হবার সম্ভাবনা বেশী। রাজবংশের সাত সৈনিক বা পাহারাদার, বা সেনাপতি বা রাজবংশের সাত ব্যক্তি যাঁরা হয়তো যুদ্ধ পরিচালনা করছিলেন, তাঁরা অতি দ্রুতগামী অশ্বের সামনে দাঁড়াতে পারেননি। নিহত হয়েছিলেন।
এই আমাদের এখনকার কাঁকসা থানা এলাকা সেদিনের পরগণা সেনপাহাড়ী। সেন রাজাদের পূর্ব পুরুষ রা এসে গড়জঙ্গলের গভীরে সম্ভবত রাজা
কর্ণসেনের আশ্রয় নিয়েছিলেন। কর্ণসেন ছিলেন পাল রাজাদের সামন্ত। মেদিনীপুর এর ময়নায় ছিল তাঁর আসল রাজত্ব। তিনিও দক্ষিনী। সেন রাজাদের বাঙ্গলায় আদি বাসস্থান হিসাবে এই এলাকার নাম হয়ে যায়
" সেনপাহাড়ী "
চলুন, প্রায় এসে গেছি। জঙ্গলের ভিতরে ভিতরে আছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের রাস্তা,রানওয়ে, নানা নির্মান। একটু দূরেই বিমানঘাঁটি।
রেল লাইন স্থাপনা কে কেন্দ্র করে পানাগড় বাজারের গড়ে ওঠা। মাঝখান দিয়ে চলে গেছে
আদি জি টি রোড।
কাঁকসা প্রাচীণ জনপদ। রাজা কঙ্কসেন - কনকসেন থেকেই কাঁকসা নাম এসেছে। এই এক মত। আর এক মত কাঁকসা তাঁদের পদবী।
যেমন ভবানীপতি কাঁকসা। তাঁর নাম থেকে কাঁকসা।
এসে গেছি পানাগড় রেলস্টেশনে।
এবার ট্রেন আসার দেরি আছে। বসে বসে মনে মনে এঁকে ফেলুন ছবি। সাল ১৮৫৫। রেল চালু হল হাওড়া থেকে রাণীগঞ্জ। পানাগড় স্টেশন হল।
আজকের স্টেশন রোড হল মাটি মোরামের রাস্তা।
চলে গেছে কাঁকসা ডাকবাংলোর পাশ দিয়ে উত্তরে এগারোমাইল, ইলামবাজারের দিকে।
দাঁড়িয়ে আছে গোরুর গাড়ি। খড় চিবুচ্ছে বলদ দুটো। গাড়োয়ান জল খেতে গেছে পাকুড়তলার ময়রাদের দোকানে। ভালো বাতাসা, কদমা, মণ্ডা পাওয়া যায়।
বেশ আসুন। আবার আসবেন। এবার যখন আসবেন এই গোটা এলাকা টা চক্কর দেবেন।
আর যদি আমাকে সঙ্গে পেয়ে যান। "
–------------ ------------ ------------ ------------
------------ ------------ ------------ ------------
© প্রণব ভট্টাচার্য।
হ্যাঁ, একটা কথা বলে নিই। প্রণব বাবুর লেখা একটা ছোট্ট বই আছে। ইলামবাজার কে কেন্দ্র করে কুঠিবাড়ি ভিত্তিক সেদিনের নীল গালা সুতী বা রেশমের ব্যবসা
নাম। এলেমবাজার নিলামবাজার ইলামবাজার। দাম মাত্র দুশো টাকা।
অক্ষর যাত্রা প্রকাশনীর আনন্দগোপাল হালদার কে ফোনে অর্ডার দিলেই বাড়িতে বসে বই টি সংগ্রহ করতে পারেন।
ফোন নং 9474907307
কেন বললাম, না এখানে ইলামবাজার, দ্বারোন্দা, সুরুল, রাইপুর, সুপুর সবার কথা এই বইয়ে আছে।
পড়ে দেখবেন। আশা করি ভালো লাগবে। অনেক তথ্য আছে। এপার ওপার অজয়ের দুপারের কথা ই আছে।
-----* আপনারা কিনে পড়লে দ্বিতীয় সংস্করণ টি
করতে পারি। নমস্কার ।
গল্প শুনছেন। " সেনপাহাড়ীর কথক ঠাকুর " কে কিছু দক্ষিণা দেবেননা!!
বছর শেষ। আজ ৩১ শে ডিসেম্বর। ২০২৫ এর শুভেচ্ছা কামনা করি। সবাই ভালো থাকুন।।
এই পর্যায়ের আরও দুটি পর্ব ও৷ পড়ুন।
আমি তো গল্পবলিয়ে।
No comments:
Post a Comment