Thursday, 2 January 2025

কথা - সাতকাহন। তাঁ তি বাগান

সাতকাহনিয়া গ্রামের তাঁতিবাগান

এ গাঁয়ের বয়স কত! জিজ্ঞেস করলে প্রবীণরা বলতেন ' গাছ পাথর নাই ' বাবা । তার মানে সে অনেক পুরনো। কারা না ছিল! আজ আর তারা যে ছিল তার নিদর্শন বলতে তাদের বাস্তুবাড়ী গুলো এত দিনের জল,ঝড়, ঝঞ্জা,র আঘাতে  ছোট ছোট ঢিপি। এমন ছোট বড় ঢিপি তে ভর্তি  সেই পুরনো গাঁয়ের ' নামো পাড়া '। একটু নীচু। উত্তরে। নদীর অনেক কাছাকাছি। নদী মানে অজয় নদ। তখন নদী টার আজকের দশা হয়নি। বছরের কয়েক মাস নৌকো চলত। নীলবাড়ির মাঠ আছে। কলাবাগানের ঘাট আছে। নীল বাড়িতে নীলের চাষ হত। ঐ পুরনো গাঁয়ে নীলের চৌবাচ্চা ছিল। 
মানে নীল তৈরী হত। তাহলে নীলের ব্যবসা হত। 
কলাবাগানের ঘাট থেকে ইলামবাজার শিমূল তলার সাহেব ঘাট। সাহেব মানে আরস্কাইন সাহেব।ইলামবাজারের তাঁর বিশাল কুঠিবাড়ি। বিশাল ব্যবসা। নীল আর গালার। চারপাশ থেকে মাল আসত তার কুঠিবাড়ি সংলগ্ন গুদাম ঘরে। 
সে তো অনেক কথা। অনেক লিখেছি। 
ছিল তো সবাই। মানে আমাদের চলতি শব্দ 'সব জাতের। তাঁতিরা ছিল। আজ তাঁতিদের কথা। 
অন্যদের কথা পরবর্তী পর্ব গুলিতে। 
ছিল মানে ছিল প্রায় ষাট ঘর। তাই বলতেন পুরনো মানুষরা। ষাট ঘর! সোজা কথা নয়। 
নয় তো বটেই। 
 আসলে আমি ভাবছি এরা কি আদি থেকেই এই গাঁয়ের মানুষ। না কি অন্য জায়গা থেকে এসে এখানে তারা বসতি স্থাপন করেছিলেন। 
নদীর ওপারে ইলামবাজারের চৌপাহারী জঙ্গল যেখান থেকে আরম্ভ হচ্ছে সেখানে, অর্থাৎ এখনকার সুখবাজারে  রায়পুরের সিংহ বাবুরা এখানে তাঁতিদের এনে বসিয়েছিলেন। তাহলে কি অজয় পার হয়ে এখনকার সাতকাহনিয়া বা অযোধ্যা গ্রামেও তাঁতিদের বসিয়েছিলেন। হওয়া খুবই সম্ভব। 
 রায়পুরের সিংহ বাবুরা সুরুলের চীপ সাহেবের সাথে ব্যবসা করে বিশাল ধনী হয়েছিলেন। 
মেদিনীপুর এর চন্দ্রকোনা এলাকা থেকে শোনা যায় হাজার ঘর তাঁতি দের তাঁরা ওখান থেকে নিয়ে এসে এখানকার নানা গ্রামে তাদের বসতি গড়ে দিয়েছিলেন। ভাবলে কেমন লাগে। হাজার ঘর তাঁতি দেশ মাটি ছেড়ে এখানে এলেন। নিশ্চিত ভাবেই ভালো কিছুর আশায়। হাজার ঘর তাঁতি 
প্রতিদিন বোনেন' গড়া' কাপড়ের থান। গড়া কাপড় হচ্ছে ঠাসবুনোট, মোটা কাপড়। নৌকোর পাল হতে পারে আবার আজকের জিন্সের মতো 
সৈনিক দের পোষাক হত সেই কাপড়ে। 
ধবধবে সাদা করার জন্য ছিল অনেক ঘর ধোবা। 
এখনকার শান্তি নিকেতনের বিনয় ভবনের মাঠে ছিল ধোবাদের পাড়া। এখনও লালবাঁধে ধোবারা 
কাপড় ধোয়। সেই কাপড় কে ধবধবে সাদা করার জন্য চাই নীল। সুরুলের চীপ সাহেবের বিশাল, কুঠিবাড়ি। ছোট খাটো দুর্গের মতো চারপাশে ইঁটের প্রাচীর। 
জলাশয়, বাগান, বিশাল বিশাল সুন্দর খিলানের অনেক ঘর। একতলা, দোতালা। এই চীপ সাহেবই বীরভূমের প্রথম কমার্সিয়াল রেসিডেন্ট হয়ে এসেছেন। সিভিল সার্ভিস থেকে। বড়লোকের ঘরের ছেলে। মানুষ টিও ভালো। অন্য নীলকর দের থেকে তিনি আলাদা। 
সুরুলের সরকার বাবুরা-ও এই চীপ সাহেবের সাথে প্রথমে গড়া কাপড়ের ব্যবসা করেই বিরাট ধনী হয়েছেন। বানিয়েছেন দুর্গাদালান সমন্বিত বিশাল দোতলা চকমেলানো প্রাসাদ। সে তো অনেক কথা। 
রায়পুরের সিংহ বাবুদের জমিদারী ছিলো ইলামবাজার এলাকায়। ছিল তাঁদের বিরাট কাছারিবাড়ি। গুদামঘর। হাজার ঘর তাঁতি 
প্রতিদিন হাজার খানা গড়া কাপড়ের থান তাঁদের 
সরবরাহ করেন। আর সিংহ বাবুরা সেই হাজার খানা কাপড় সাপ্লাই করেন চীপ সাহেবকে। 
মাঝখানে তাঁদের আয় হয় প্রতিদিন হাজার টাকা। 
কমকথা নয়। তখনকার দিনে হাজার টাকা। 
তখনকার দিন মানে মোটামুটি দুশো বছর। 
চীপ সাহেব সুরুলে এসেছিলেন ১৭৮২  সালে। 
রায়পুরের সিংহ বাবুরা 
সুরুলের সরকার বাবুরা-ও কাছাকাছি সময়ে। 
অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি। 
বাবুদের কথা বলতে হলে অনেক কথা বলতে হবে। সেও না হয় হবে। 
এই গাঁয়ে আজ আর একঘর তাঁতি ও নাই। 
অযোধ্যা গ্রামে অনেক গুলি তাঁতি পরিবার। 
কোন ঘরেই অবশ্য তাঁত চলেনা। এখানের শেষ তাঁত বুনেছেন অযোধ্যার শ্যামবাজার অংশের 
বংশী শীল। আর অযোধ্যায় সম্ভবত কমল তাঁতি। পদবি দে। অযোধ্যা গ্রামে তাঁতিদের মধ্যে 
 দালাল পদবীর দুটি পরিবার ছিল। এই দালাল রা 
দালালী ই করতেন। তাঁরা স্বাভাবিক ভাবেই ধনী হয়েছিলেন। তাঁরা নিজেরা তাঁত বুনতেন না। 
লোক নিয়োগ করতেন। সব তাঁতিদের ঘর থেকে পাইকারি হারে কাপড় কিনে রায়পুরের সিংহ বাবুদের কাছে সরবরাহ করতেন। মাঝ খানে তাঁদের লাভ হত ভালোই। একটি দালাল পরিবার অবশ্য তাঁত বুনতেন তাই নয় শাড়ির পাড়ে ভালো নক্সা তুলতে পারতেন। তিনিই ছিলেন -
তাঁত প্রায় সব ঘরেই ছিল। ভালো গামছা বুনতেন কেউ। রেশম, তসর ও বুনতেন তাঁরা। 
সুরুল থেকে বা রাজনগর, তাঁতিপাড়া থেকে তসর, রেশম সুতো নিয়ে আসতেন। 
 এখানে সাদা সুতোর রঙ করে নিতেন। মোটামুটি 
পঞ্চাশ - ষাট বছর আগেও তাঁরা  ছিলেন। 
অযোধ্যা গ্রামে চেষ্টা হয়েছিল তাঁতিদের নিয়ে সমবায় গড়ার। তাঁতঘর তৈরী হয়েছিল। ভালো উন্নত মানের তাঁত আনানো হয়েছিল। এই সমবায় সমিতির উদ্যোক্তা ছিলেন প্রয়াত নারায়ণ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সহ তাঁর সময়কালের বিশিষ্ট মানুষরা। 
যদিও তাঁত বাঁচেনি। যে উদ্দেশ্য নিয়ে সমবায় সমিতি গঠিত হয়েছিল - সেই উদ্দেশ্যও  সফল হয়নি। এখন সেখান থেকে শুধু রেশন বিলি হয়। 
আমার মনে হয় সামগ্রিক ভাবে সমবায় আন্দোলন টাই মুখ থুবড়ে পড়েছে অনেক দিন আগেই। 
যাই হোক আমাদের কথা হচ্ছিল পশ্চিম বর্ধমান জেলার, কাঁকসা থানা এলাকার অযোধ্যা বনকাটি এলাকার, সাতকাহনিয়া, অযোধ্যা গ্রাম নিয়ে। 
অযোধ্যা গ্রামের তাঁতিরা সচ্ছল ই ছিলেন। পুকুর কাটিয়েছেন।  তাঁতি পুকুর নামেই তার পরিচয়। 
আমবাগান তৈরী করেছেন। অযোধ্যা গ্রামের উত্তরে বিশাল আমবাগান এই সেদিনও ছিল। 
তার পশ্চিম দিকের বাগান টি তাঁতিদের। 
সাতকাহনিয়ার তাঁতিরাও আম বাগান তৈরী করেছিলেন। একেবারে নিজেদের বাস্তু ভিটার কাছাকাছি। গ্রামের উত্তর পশ্চিমে। বিরাট এক পুকুর, নাম গোলামপুকুর। কোন এক গোলাম নিশ্চয়ই কিনে নিয়েছিলেন। গ্রামের পশ্চিম দিকে 
মুসলিম দের বাস। তাঁরা এসেছেন মোটামুটি - বছর আগে। তখন পুরনো গ্রামের ভগ্ন দশা। 
গ্রামের পূর্ব দিকের বিরাট আমবাগান। একদিন ছিল অধিকারী ব্রাহ্মণ দের। পরে বিক্রি হয়ে যায়। 
মুসলিম আর তাম্বুলী সম্প্রদায়ের হালদার পরিবার কিনে নেন। 
অধিকারী রা এই গ্রাম পরিত্যাগ করেন। অন্যদের দাপটের ভয়ে। 
তাঁতিরা যে কে কোথায় গেলেন। অনেকে যে মারা গিয়েছেন তাতে সন্দেহ নাই। কেননা মারাত্মক কলেরা, প্লেগ,এক ধরনের ম্যালেরিয়া, যার নাম বর্ধমান জ্বর আছড়ে পড়েছিল সমগ্র এলাকাতেই। 
অনেকে মারা গেছেন। আর যাঁরা বেঁচে ছিলেন তাঁরা যে যেদিকে পেরেছেন পালিয়ে বাঁচতে চেয়েছেন। জমি, পুকুর, বাগান যা যেটুকু ছিল জলের দামে হয় বেচে দিয়ে গেছেন। কিম্বা অন্যরা 
যাঁরা তখন প্রভাবশালী হয়েছেন তাঁরা দখল করে নিয়েছেন। 
এই গ্রামে এক সৈয়দ বংশীয় সুফি সাধক, সৈয়দ শাহ তকী সাহেবের পুত্র সৈয়দ শাহ আলী জাওয়াদ, খুষ্টিগিরি থেকে এই গ্রামে এসে বসতি স্থাপন করেছিলেন। আনুমানিক - বছর আগে। 
তিনি ইউনানি চিকিৎসা ভালো জানতেন। বর্ধমানের রাজার মারাত্মক পিত্তশূল ভালো করে দিয়ে রাজাদের কাছ থেকে অনেক ভূসম্পত্তি লাভ করেন। অনেকে বলেন প্রায় সাতশো বিঘা, মতান্তরে চোদ্দশো বিঘা। সেই জমি চাষ করাবার জন্য এবং নিজেদের নিরাপত্তার জন্য বিহার, ঝাড়খণ্ড থেকে নিয়ে আসেন জোলা মোমিন মুসলমানদের। যাঁদের পূর্ব পুরুষরা ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন। ছিলেন সমাজের নিম্নবর্গের মানুষ। 
ইংরেজ দের সাথে এই সৈয়দ বংশীয় দের খুবই সুসম্পর্ক ছিল। 
গোলামপুকুরের আগের নাম কি ছিল তা জানা যায়না। কিন্তু আমার দৃঢ় অনুমান অন্য নাম ছিল। 
অসম্ভব নয় এটা তাঁতিদের কাটানো। নাম তা হলে হওয়া উচিত তাঁতিপুকুর। 
কেননা এই পুকুরের উত্তর পশ্চিম পাড়ে বাস ছিল তাঁতিদের। পুকুরের উত্তর পাড়ে লম্বা লম্বা তালগাছের সারি। একটা চারআঁটির কালো কুচকুচে, খুব মিষ্টি তালের গাছ। সেই তাল কুড়োবার জন্যে আমাদের দীর্ঘ অপেক্ষা থাকত। 
তাঁতি বাগান  যে বিরাট ছিল তা নয়। কমবেশী কুড়ি পঁচিশ টা আম গাছ। 
তাদের মধ্যে সেরা আমগাছটি ছিল বিরাট মহীরুহ। আর তার ফল ছিল অপূর্ব স্বাদ গন্ধের 
' খইনাড়ু ' আম। একেবারে নাড়ুর মতো গোল তার ফল। সেই আম কুড়োবার কি ধূম না ছিল। 
কাছেই কোঁড়া পাড়া। তারাই কুড়িয়ে নিত। আমরা দু চারটে পেতাম। আহা, কি অপূর্ব ছিল সেই আম। 
এই গ্রামের তাঁতিপাড়া, বা তাঁতি বাগানের সর্বশেষ জীবন্ত প্রতিনিধি ছিল সেই আমগাছটি। 
অন্যরা আগেই গেছে। হালদার বাবুরা কেটে বিক্রি করছেন। 
আমরা তখন ছোট। ভাবতাম নিশ্চয়ই এই গাছটাতে কেউ হাত দেবেনা। পুকুরের উত্তর পাড়ের তালগাছ গুলো আর একটাও নাই। 
অন্যান্য গাছ বলতে ছিল বেশ কয়েকটা খেজুর, 
কয়েত বেল , পলাশ সেসব ও পরিষ্কার হয়ে গেছে। 
 বাবুরা  এক এক করে সব  বেচে দিয়েছেন। 
বাকী ছিল এই বিশাল আমগাছ টি। 
তারপর একদিন তারা এলো। গাছ কাটা দের দল। 
তাঁবু পাতল কাছেই। রান্না বান্না, থাকা খাওয়ার জন্য। দড়ি, দড়া, বিশাল লম্বা লম্বা করাত। 
দাঁত গুলো তাদের চকচক করছে। 
গাছটির মোটা মোটা শাখা প্রশাখা গুলি আগেই কাটা পড়ল। সারা দিনরাত করাতের ঘ্যাসঘ্যাস আওয়াজ। 
আমাদের মাটির দোতালা নীচু ঘরের উপর কোঠায় ছোট্ট জানালার ধারে পড়তে বসি। রাতে সামনে হ্যারিকেন। ডালপাল গুলিকে টুকরো টুকরো করা হচ্ছে। করাতের নির্মম শব্দ। সামনে হ্যারিকেন জ্বলে। বই খোলা থাকে। পড়া হয়না। 
কানে বাজে শুধু করাতের শব্দ। আমার ছোট মনে কেবলই পাক খায় ' কেন কাটল, কেন কাটল এই 
আমগাছটিকেও। তখন কি আর বুঝি বাবুদের অনেক টাকার দরকার। এখনই কেটে বেচে দাও। কি জানি পরে কি হয়! সময়কাল সত্তরের দশকের প্রথম ভাগ। চারদিকে চলছে বৃক্ষ নিধন যজ্ঞ। বাবুরা সব বেচে দিচ্ছেন। বাবুদের বড় লোভ। 
তারপর একদিন তার গুঁড়ি তে করাত চলল। দড়ি দড়া বেঁধে টান দেওয়া আছে উত্তর দিকে। 
 কত মানুষের নানা কসরত। গাছ কাটার নানা কায়দা কানুন আছে তো। 
বিশাল আর্তনাদ করে সে একসময় ভূপাতিত হল।
 গিয়ে দেখলাম। পড়ে আছে তার কাটা দেহ। 
আর গুঁড়ি থেকে বের হচ্ছে লাল রস নয়, যেন টকটকে লাল রক্ত। 
তাঁতিবাগানের শেষ প্রতিনিধি কে নির্মম ভাবে হত্যা করা হল। শুধু আমাদের কারও কারও মনে হয়তোবা  রয়ে গেছে সেই ' তাঁতি বাগান ' আর তার সেরা ' খই নাড়ু আমগাছ ' টি কে। 
------------ ------------ ------------ ------------ ------------ 

 কথা - সাতকাহন।  আমবাগান  , তালসারি অধ্যায় 
ছবি। অন্য এক গ্রামের পুকুরপাড়ে তাল গাছের সারি। এমনটাই ছিল এই গ্রামেও।

No comments:

Post a Comment