সাতকাহনিয়া গ্রামের অধিকারী আমবাগান।।
ঠুকঠুক করে লাঠি ঠুঁকতে ঠুঁকতে, মালপাড়ার বিরাট বাসক ঝোপের ভিতর দিয়ে, একটু আড়ালে আড়ালে, পায়ে চলা পথে বৃদ্ধ সলু মিঞা
আমবাগানে ঢুকতেন। ভর দুপুর বেলা। এই পাড়ার ছেলেগুলো সব পাকা আম পেড়ে নিচ্ছে। তাঁরা কিছু পাচ্ছেন না। আমবাগান পাহারার জন্য 'রেখো বা রাখা ' হিসাবে একজন কে রাখা হয়েছে। সে ব্যাটা ভরপেট তালতাড়ি খেয়ে আমবাগানে দেয় লম্বা ঘুম। আমগাছ পাহারা দেবে কি! নিরাশ মানুষটি আপনমনে ই ঘাড় নাড়েন।
মনে মনে বোঝেন যে পারা যাবেনা।
আর তাঁকে বাগানের পশ্চিম মাথায় দেখা মাত্রই
পুব পাড়ার ছেলে দের দে দৌড়। যে যেদিকে পারে
গাছের আড়ালে, ভাঁট ফুলের ঝোপের ভিতরে
লুকিয়ে যায়। বাগানে যেন কেউ কোথাও নেই।
এমনকি হনুমান গুলোও পালিয়েছে।
পাকা আমের গন্ধে বাগান ম ম করছে। মাছির ভনভন।
তো আমরাও তো ছিলাম সে ই দলে। আমি আর হালদার ঘরের কানু। সে বাগানে হালদার দের অনেক খানি অংশ। আর সৈয়দ বংশীয় মুসলিম দের। গাঁয়ে যাঁদের ' মিঞা সাহেব ' বলা হত।
কানু বলত চল, কে কি বলবে, আমরাও বাগান পাহারা দিচ্ছি। আমাদেরও বাগান।
দুপুরে তো ঘুম নেই। কানু এসে চপলা পিসির ঘরের পিছন থেকে ডাক দিত। এই চপলা পিসি একাই থাকতেন। হালদার ঘরের ই স্বামীপরিত্যক্তা
মেয়ে। অবশ্য তখন তাঁরও যথেষ্ট বয়স হয়েছে।
তাঁর খামারের আমগাছটির আম খুব মিষ্টি। পিছনে রাস্তার দিকে যে ডালটা গেছে সে ডালেও অনেক আম ধরত। চপলাপিসি একটি আমও পেতেন না। " খা, খা, কারা খাচ্ছিস আমি সব জানি "। ঘরের থেকেই ডাক ছাড়ত।
কেউ পাত্তা দিলেই তো। ঐ ডালের আম পাকলেই হল। ক দিনেই শেষ।
দাদু দিদিমা ঘুমালে বেরিয়ে আসতাম। কানু আর আমিও সেই ডুমুরতলা হয়ে মাল পাড়া দিয়ে বাগানে।
আবার কোন কোন দিন ডাকবাংলোর কর্মচারী
পঙ্কজ বাবুর টিনের চালার এক কামরার কোয়ার্টারে। আমরাই ছিলাম পঙ্কজ বাবুর দুপুরের সঙ্গী। একাই থাকতেন। মাঝে মাঝে তাঁর ছেলে
বাসব আসত। সে ভালো ফুটবল খেলত।
এই সময়ে এলে বাসব ও আমাদের সাথে যোগ দিত।বাসার পিছনেই ছিল ডাকবাংলোর সীমানা।
সেখানে ছিল লোহার পিলারে কাঁটা তারের বেড়া।
কিছু কিছু জায়গায় তার ফাঁক। ফাঁক মানে ফাঁক করে নেওয়া হয়েছে। ডাকবাংলোর ভিতরে আছে
কমপক্ষে সাত আট টি আমগাছ। নানা ধরনের আম। একটা আম ছিল কাঁচা তেও, একবিন্দু টক ছিলনা। আমরা ডাকবাংলো ছেড়ে অধিকারী বাগানে ঢুকতাম। তারের বেড়ার ফাঁক দিয়ে।
বাগানের নাম অধিকারী বাগান।
একদিন অধিকারী রাই মালিক ছিলেন নিশ্চয়ই।
অধিকারী বামুন দের এ গাঁয়ে সবই ছিল। জমি জায়গা, বাগান, পুকুর সবই। ছিল তাঁদের বিষ্ণু দালান। শোনা যায় দোল, রাস এসব পরব হত।
একদিন তাঁরা এই গ্রাম ছেড়ে চলে যায় ছোট রামচন্দ্রপুরে। নাকি গাঁয়ের প্রভাবশালী দের দাপটের ভয়ে।
জলের দরে বাগান, পুকুর সব বেচে দিয়ে যান।
কিনে নেন হালদাররা আর মুসলিমরা।
কিন্তু এগাঁয়ের সাথে তাদের একটি পরিবারের যোগাযোগ থেকে গিয়েছিল। সীতারাম কাকা আর তাঁর দাদা কি ভাই, হালদার বাড়ির নানা অনুষ্ঠানে,
উৎসবে, পরবে তাঁদের ডাক পড়ত।
সীতারাম কাকা রা ভালো রান্না করতে পারত।
তখন ভোজেকাজে রান্না করাটাই হয়েছে পেশা।
জয়দেব কেন্দুলী র কাঙ্গাল ক্ষেপাচাঁদ আশ্রমে মহোৎসবে রান্নার জন্যও তাঁদের ডাক পড়ত।
কেননা আশ্রম পরিচালনা করেন সাতকাহনিয়া গ্রামের কাঙ্গাল ক্ষেপাচাঁদের শিষ্য রজনীকান্ত হালদার মশাই এর উত্তর পুরুষ রা। শিবদাস হালদার মশাই ছিলেন কর্মদক্ষ মানুষ। তিনিই মূলত মহোৎসব পরিচালনা করতেন। অন্য অনেক সহযোগীরাও ছিলেন কিন্তু তিনিই ছিলেন হাঁকডাকে দক্ষ মানুষ।
সেই হালদার বাড়ির ছেলে কানু। আমরা সমবয়েসী। অতএব স্বাভাবিক বন্ধুত্ব। আর পাড়ায় অন্য কোন ছেলে নাই।
একদিন বাগানে ঢুকেছি। আর দেখি সামনেই সলু মিঞা। আর লুকোবার উপায় নাই। তবু আমি একটা মোটা গুঁড়ি র আড়ালে।
কানু এগিয়ে গেল। কানুকে দেখে ' অ, হালদার দের শিবুর ভাই '। তা এই দুপুর বেলায় বাগানে, কি ব্যাপার!
দাদু, আমরা পাহারা দিচ্ছি। মাল পাড়ার ছেলে গুলো এসেছিল। আমরা তাড়ালাম। তুমি যাও, তোমার ঘরে আম পাঠিয়ে দেব।
বলছিস। বেশ। তা গাছের আড়ালে ঐ টা কে রে।
ঠিকই দেখেছে। অ মাষ্টারের লাতি "
বলতে হবে মাষ্টার কে। দ্যাখো গে তোমার লাতির কাণ্ড। দুপুর বেলায় কি করে!
ব্যস। আমার বুক ঢিপ ঢিপ। আমার শুকনো মুখ দেখে কানু ই বলল " ও দাদু আজকেই এসেছে। আমি ডেকে এনেছি। দুদিক পাহারা দিতে হবেনা '
হ্যাঁ তা বটে পুব দিকের বামুন পুকুর এর দিক থেকে অনেকে বাগানে ঢোকে।
বেশ, ঠিক আছে। আমি কিছু বলাবলি করবনা।
আমি যেন আম পাই।
ও দাদু কয়েকটা ভালো আম নিয়ে যাও। মাল পাড়ার ছেলে গুলো ফেলে পালিয়েছে। কানু ঝোপের আড়াল থেকে গোটা পাঁচেক আম এনে
বৃদ্ধের হাতে দিতেই তাঁর চোখ আনন্দে চকচক করে উঠল। ঘাড় নাড়তে নাড়তে তিনি ফেরার পথ ধরলেন। বেশ আজ আমি চললাম। এবার ফণী কে পাঠাতে হবে। সে ভালো পারবে।
এই আম বাগানে যে কত রকমের আম গাছ ছিল!
কত স্বাদের। কারও বেল গন্ধ, তো কারও জোয়ান গন্ধ, খই নাড়ু, সিন্দুরে ' ল্যাঙড়া, আরও কত রকমের। কোন গাছের আম কেমন আমরা ঠিক জানতাম। সবচেয়ে মিষ্টি আমের গাছ গুলোই ছিল আমাদের লক্ষ্য। গাছে তো চাপা সম্ভব নয়। ঐ কুড়নো ই ভরসা। আর পুব পাড়ার ছেলেরা গাছে উঠে যায়। তো কোন কোন দিন ডাকবাংলোর চৌকিদার রতন মালের ছেলে গুডু আমাদের আম পেড়ে দিত। পঙ্কজ বাবুও হ্যাঁ করে দিতেন ওকে।
কমপক্ষে দশ বারো টা আম না নিয়ে আমরা ঘর যেতামনা। গুডু কে দিতাম। পঙ্কজ বাবুকে দিতাম।
আম তো আমরা কোনদিন কিনে খাইনি। ভাবনাতেই ছিলনা। গাঁয়ের মানুষ কবে আবার আম, আতা, আঞ্জির,পেঁপে, তাল, বেল এ সব কিনে খেয়েছে!
কিনে খাবে কি! পয়সা কোথায়! কোন রকমে দুটি ভাত জোটে। তো তরকারি জোটেনা। কাঁচা লঙ্কা, নুন, আর পেঁয়াজ দিয়েই খায়।
ভাদ্র মাসে তালের মাড়ি চুষেই অনেকে পেট ভরায়। গোটা গাঁ তাল গাছে গাছে ভরা।
তারপর, তারপর এক সেই দিন।
আমবাগানে তাঁবু পাতল গাছ কাটা দের দল।
এলো বড় বড় করাত আর দড়ি, দড়া। আর রান্না রান্নার হাঁড়ি কুড়ি। বালতি।
আমরা অবাক বিস্ময়ে শুনলাম এই গোটা বাগান
কাটা হবে। বাবুরা সবাই বাগান বেচে দিয়েছে।
হ্যাঁ রে সব গাছ কেটে দেবে!
কানু নিরুত্তর থাকে।
পঙ্কজ বাবু র কোয়ার্টার এর ঠিক পিছনেই যে আম গাছ টা ছিল সেটা ছিল আমাদের খুব প্রিয়।
ল্যাঙরা আমের গাছ। মোটা নীচু গুঁড়ির দুপাশে দুই ডাল। গোল ছাতার মতো গাছটা।
এই গাছটাকে রাখা যায়না। আমার আকুল প্রশ্ন।
চলনা, বাবুদের গিয়ে বলি একটা গাছ ছাড় দাও।
একটা গাছ থাক।
কানুকে বলি চল তোদের বাড়ি যাই।বড় হালদার দের বাড়ি যাই। মুসলিম পাড়া যাই।
চল, কানু। বলে আমি হাঁটা দিই। কানু ও সঙ্গে আসে। কানু বলে, গাছকাটা দের দলের একজনকে দেখে " হ্যাঁ, এই লোক টাকে আমাদের ঘরে একদিন আসতে দেখেছি। "
কি সব আলোচনা হচ্ছিল ঘরে, যে সব পুকুর বাগান সরকার থেকে নিয়ে নেবে। বেশি থাকলেই।
তাই গাঁয়ে গাঁয়ে মালিকরা সব বাগান বিচে দিচ্ছে।
তাহলে কি হবে!
কি আর হবে!
চল। ঘর চল।
কানু চুপচাপ ঘরে ঢুকে গেল।
আমাকে আর ডাকলো না।
আমি তাদের বাইরের দরজার সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ওখান থেকে চলে এলাম।
দুপুরে করাত চলে। রাতেও চলে। শুয়ে সারারাত ধরে করাতের কর্কশ আওয়াজ শুনি।
এক একটা গাছ পড়ে আর আমার বুকের ভিতর টা যেন কেঁপে কেঁপে ওঠে।
------------ ------------ ------------ ------------
* যাঁকে সলু মিঞা বলেছি তার প্রকৃত নাম সৈয়দ মহম্মদ মুসা
ফণী মিঞা ; ভালো নাম সৈয়দ আনোয়ারুল হক।
গ্রাম। সাতকাহনিয়া
পোষ্ট। বনকাটি
No comments:
Post a Comment