Monday, 31 October 2022

প্রবন্ধ। বীরভূমের লোহামহল

 ।। বীরভূমের লোহামহল।। ৪ নং পাতা আরম্ভ।

  ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী এদেশের শাসনকর্তা হবার অনেক আগে থেকেই  অর্থাৎ বীরভূমের রাজা এবং স্থানীয় জায়গীরদার  ; দের অধীনে বা তাঁদের কে নির্দিষ্ট কর প্রদান করে স্থানীয় দক্ষ কর্মকার রা তাঁদের শাল তৈরী করে অনেক লোহা গলিয়ে বের করেছেন। কাঁচা লোহা কে পাকা লোহা করা হয়েছে। তার জন্য আলাদা লোক। এই " শালের " মালিকরা
" শালুই "। আবার স্থানীয় ভূস্বামী রা ও দক্ষ শালুই দের দিয়ে
শাল চালিয়েছেন। মাসড়া গ্রামের ছোট্ট চারচালা শিবমন্দির টি
যেটি বীরভূম জেলার প্রাচীণতম ( ১৬৩১ সালে নির্মিত)।
সেটি নির্মান করিয়েছিলেন  কর্মকার পরিবারের এক ধনী ব্যক্তি। তিনি ছিলেন " রাজকর্মকার "। " রাজলোহাপাল"।
নাম তার সিতবদাস। তাঁর মা সিদ্ধেশ্বরীর নামে এই মন্দির নির্মান করিয়েছিলেন। এখানকার শাল চালানো কর্মকার রা প্রায় সবাই এই লোহার দৌলতে প্রভূত ধনী হয়ে উঠেছিলেন।  নিশ্চিত ভাবেই তাঁর নেতৃত্বে রাজাদের ও শাল চলত। বা রাজাদের নিযুক্ত ব্যক্তি দের দ্বারা চালানো হত।  এই এলাকার
প্রায় সকল স্থানেই এই " শাল " ছিল। গ্রামের বাইরে বিপুলাকৃতির লৌহমলের স্তুপ ই তার প্রমান।
মলুটির রাজাদের প্রথম দিক কেটেছে রাজধানী ডামরা য়।
ডামরা ছিল লোহাগলানোর অন্যতম প্রধান কেন্দ্র।
সেখানে রয়েছে লৌহমলের বিরাট স্তুপ। সে অবশ্য মলুটি ; মাসড়া ; সহ সর্বত্রই রয়েছে। একসময় বালিয়া নারায়ণ পুর
হয়ে ওঠে প্রধানতম কেন্দ্র।
   শহর রামপুরহাট তখন ভবিষ্যতের গর্ভে। ছোট এক পল্লী মাত্র। তখন এই লোহার ব্যবসায়ে বর্ধিষ্ণু জমজমাট গঞ্জ
নারায়ণপুর। ধনজনপূর্ণ জনপদ। নারায়ণপুরের প্রসিদ্ধি
এই লোহার কারবারের জন্য। ১২৬০ বঙ্গাব্দে এখানে কাঁচা লোহা তৈরীর  জন্য ৭৫ টি " কোটশাল " এবং সেই কাঁচা লোহাকে পাকা করার জন্য ৭৫ টি " ডুকি শাল "। স্থানীয় মানুষেরাই এগুলি পরিচালনা করেন।
একটু দূরেই ব্রহ্মাণী নদী। নদীর ওপারে আরও ২৫ টি কোটশাল এবং ২৫ টি ডুকিশাল। কোটশালে মজুর বেশী প্রয়োজন হত। প্রায় ১০০ জন প্রতি শালে। ডুকি শালে মজুর কমই লাগে। আমাদের পাড়া গাঁয়ের কামার শালার মতো।
কোটশালের মজুর রা প্রায়শই মুসলমান। ডুকিশালে র মজুর রা হিন্দু।
বর্ষা কালে কোটশাল বন্ধ। গর্তে জল জমে যায়। চার মাস কাজ বন্ধই থাকত।
উৎপাদন ঃ প্রতি কোটশালে প্রতি বারের গলনে প্রায় কুড়ি পঁচিশ মণ লোহা পাওয়া যেত। মনপ্রতি দর পাঁচ সিকা থেকে দুই টাকা। পাকা লোহা মণ প্রতি দর পাঁচ টাকা থেকে সাড়ে পাঁচ টাকা।
প্রতি খেপে সমস্ত খরচ বাদ দিয়ে  কোটশালের লাভ প্রায় পঁচিশ ত্রিশ টাকা। আর পাকা লোহা বিক্রি করে লাভ প্রায়
একশো টাকা লাভ।
১২৯০ - ৯৪ সাল নাগাদ এই লোহার কারবার বন্ধ হয়ে যায়।
  বিদেশি লোহার আমদানিই মূল কারণ। যন্ত্র চালিত ব্যবস্থা র
সাথে প্রতিযোগিতায় এঁটে না ওঠা। তারপর ইংল্যান্ড থেকে আমদানি করা লোহার দামও বেশী। শেষ হয়ে গেল আমাদের দেশীয় শিল্প। এক নারায়ণপুরেই দশ হাজার মানুষের অন্ন সংস্থান হত।
এলাকার চরম আর্থিক উন্নতি ঘটেছিল।
------------ ------------ ------------ ------------ ------------ ৪ নংপাতা শেষ।




।। বীরভূমের লোহামহল।। ৫ নং পাতা আরম্ভ।
যাহারা শাল চালাইত তাহারা শালুই। এই শালুই দের তখন অনেক ধন। বিরাট তাদের প্রতাপ। বিশাল অট্টালিকা।
অর্থ আর ক্ষমতা র দম্ভ। সেই দম্ভই তাদের শেষ করে দিয়েছে।
  কাঁচা লোহা গলানো র কারিগর দের বলা হত শাশা। কাঁচা লোহাকে পাকা লোহা করত  মেহতর রা।
গোলাকার লোহার তাল এর নাম ডুকী। আর লম্বা পাতের মতো র নাম বাতা। খুব ভালো লোহার নাম  মুচ। প্রতি কোটশালেই এরকম কিছু পরিমান মুচ লোহা পাওয়া যাইত।
এর দাম বেশি। ইস্পাতের চেয়েও ভালো এই লোহা।
ব্রহ্মাণী নদীর জলপথ ই পণ্য পরিবহনের জন্য ব্যবহৃত হত।
মুর্শিদাবাদের আজিমগঞ্জের নিকটবর্তী  লৌহগঞ্জে এই লোহা চালান হইত।
" যে সময় নারায়ণপুরের খুব চলতি অবস্থা ; লোহার কারবারে
র খুব ধূমধাম ছিল ; সেই সময় রামশঙ্কর হালদার ( গন্ধবণিক) ; কৃষ্ণধণ মালুই (কর্মকার) ও গদাই বড়াল (সুবর্ণবণিক)  এর মতো সঙ্গতিসম্পন্ন ও সম্ভ্রান্ত লোক এ অঞ্চলে আর কেহ ছিল কি না সন্দেহ। শুনিতে পাওয়া যায়
শালুই দের একান্নবর্তী পরিবারে প্রায় আশী জন লোক ছিল "
  সমগ্র লোহামহলের এই লোহার কারবার ই এলাকার সমৃদ্ধির
কারণ।
   সে দিন কবেই শেষ হয়ে গেছে। আছে কিছু স্মৃতি। আর লৌহমলের বিরাট বিরাট স্তুপ।
বীরভূমের লোহা শিল্পের কথা বলতে গেলে ইন্দ্রনারায়ণ শর্মা র
নাম উল্লেখ করতেই হবে। আধুনিক পদ্ধতি তে লোহা উৎপাদনের জন্য কারখানা তৈরী র অভিপ্রায়ে বাৎসরিক পাঁচ হাজার টাকার বিনিময়ে তিনি এক বিরাট এলাকার লীজ নিয়েছিলেন। সে টা ১৭৭৪ সাল। কিন্তু তিনি সফল হতে পারেননি।
১৭৭৭ সালে মেসার্স মোটে এবং ফারকুহার চেষ্টা করেন।
মেসার্স সামার এবং হিটলী দীর্ঘ মেয়াদি মাইনিং লীজ নিয়েছিলেন।
১৭৭৯ তে ব্যবসা চালানোর জন্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি
ফারকুহার কে পনের হাজার টাকা অগ্রিম দেওয়া হয়।
সব শালই চলছে তখনও  দেশীয় পদ্ধতিতে ই।  ১৮৪৫ সালের
মিঃ ওয়েলবি এবং জ্যাকসনের রিপোর্ট।
১৮৫২ সালে ডঃ ওল্ডহ্যামের রিপোর্ট অনুযায়ী দেওচা ; ডামরা
বালিয়া নারায়ণ পুর এবং গণপুরে দেশীয় পদ্ধতি তে ই লোহা গলানো হয়। দেওচা তেই আছে ত্রিশ টি চুল্লী।
তবে তিনি তাঁর রিপোর্টে উল্লেখ করেছিলেন যে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে  বড়ো আকারে আধুনিক ফার্নেস গড়ে তোলার মতো
যথেষ্ট আকরিক লোহা বা উপযুক্ত পরিমানের জ্বালানী র অভাব আছে। 
------------ ------------ ------------ ------------ ৫ নং পাতা শেষ।


।। বীরভূমের লোহামহল।।  ৬ নং পাতা আরম্ভ।।
  সারা বছরে সমস্ত দেশীয় চুল্লী থেকে প্রায় ২৩৮০ টন লোহা উৎপাদিত হত। দেশীয় দের ই একচ্ছত্র আধিপত্য।
আবার ১০ মন কাঁচা লোহা থেকে ৭ মণ ১০ সের  পাকা লোহা
পাওয়া যায়। যা যথেষ্ট উৎকৃষ্ট মানের।
কাঁচা লোহাকে পিটিয়ে পিটিয়ে নমনীয় পাকা লোহায় পরিণত করা হয়। কিছু অঙ্গার মিশ্রিত ইস্পাত ও কোন কোন শালে
তৈরী হয়।
১৮৫০ সাল নাগাদ মিঃ ডি ; সি ; ম্যাকে  দেওচা মহম্মদ বাজার
কে কেন্দ্র করে আধুনিক পদ্ধতিতে লৌহ শিল্প গড়ে তোলেন।
প্রায় দশ বছর তিনি চালিয়েছিলেন।  ।  তাঁর মৃত্যুর পর শিল্প টি দেশীয় দের হাতে যায়। তাঁরা মাঝে মাঝে চালাতেন।
সেখান থেকে হাতফেরত হয়ে ১৮৭৪ সাল নাগাদ সাল নাগাদ
বার্ণ এণ্ড কোম্পানি র হাতে যায়। তাঁদের রিপোর্টে জানা যায় যে তাঁদের প্রতিদিন পাঁচ টন উৎপাদন ক্ষমতা সম্পন্ন একটি ব্লাস্ট ফার্ণেস এবং একটি ভার্টিক্যাল ইঞ্জিন এবং বাতাস সরবরাহের জন্য আর একটি ইঞ্জিন রয়েছে।
এখানে মূলত ঢালাই লোহা যা দিয়ে রেল স্টেশন এর চেয়ার ইত্যাদি তৈরী হত। এঁদের প্রায় লক্ষাধিক টাকার যন্ত্রপাতি ছিল।
এঁরা এই শিল্পে অনেক টা অগ্রগতি ঘটালেও শেষ পর্যন্ত বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন। নানা ভাবে চেষ্টা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত যাকে
বাণিজ্যিক ভাবে লাভজনক করে তোলা যায়নি।
এলাকায় লৌহ আকরিকের এবং উপযুক্ত জ্বালানী র অভাব
বিদেশ থেকে আমদানিকৃত লোহার সাথে দামে পাল্লা দিতে
না পারা ; স্থানীয় ভূস্বামী ; জমিদার ; রাজা র সাথে কর নিয়ে
নানা বিবাদ বিসংবাদ ; স্থানীয় কারিগর দের মজুরী বৃদ্ধি
ইত্যাদি নানা বিধ কারণেই এখানে আধুনিক পদ্ধতি তে লৌহ
শিল্প কে শক্ত ভিতের উপরে দাঁড় করানো যায়নি।
১৮৭৫ সালে প্রফেসর বল এর রিপোর্ট ' উদ্যোগ নেওয়া হলেও শেষ পর্যন্ত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। ইতিহাস পুনরাবৃত্ত হয়েছে "
নারায়ণপুর এর উত্তরে ব্রহ্মাণী র তীরে কালো লৌহমলের
  পাহাড় সমান বিশাল স্তুপ দর্শক দের বিস্ময় সৃষ্টি করে।
দেশীয় পদ্ধতি তে ই কি  বিপুল পরিমাণ লোহা এই
বীরভূমের লোহামহলে  একদা উৎপাদিত হয়েছিল!
বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গেছে সেদিনের কর্মমুখর লোহামহল। কত মানুষের কত রকম জীবিকা। কত উপার্জন।
কেউ মোরাম চাতাল এর নীচে মাটি কেটে লোহা পাথর তুলে
আনছে। সেই লোহাপাথর বস্তাবন্দি করে শালে শালে সরবরাহ করা হচ্ছে। উপযুক্ত জ্বালানী সংগ্রহ করে আনানো হচ্ছে।
কোটশাল তৈরীর জন্য কত মজুর। দশ হাত লম্বা ; দশ হাত চওড়া ; সাত হাত গভীর গর্ত খোঁড়া। মাঝে তার দেওয়াল তোলা। দেওয়ালের মাঝে গোলাকার গর্ত আবার নীচে গলিত লোহা বেরিয়ে আসার গর্ত। সাত আট হাত দূরে শক্ত খুঁটির উপরে উঁচু চালা তৈরি
করা। সেই চালার নীচে দু দিকে দুই শক্ত মাচা বাঁধা।
  গর্তের এক প্রকোষ্ঠে উপযুক্ত পদ্ধতিতে স্তরে স্তরে জ্বালানী
এবং লোহাপাথর সাজানো। সাজানো শেষে ' খরবোনা ' র মাটি দিয়ে পুরু করে  গোটা স্তুপ কে ভালো করে ঢেকে দেওয়া।
স্তুপে আগুন দেওয়া। সব স্তরের কাজে চাই ওস্তাদ লোক।
হাপরের সাহায্যে মাচার উপর থেকে অবিরাম হাওয়া চালানো। ফাঁকা প্রকোষ্ঠে র উপরের মাচা থেকে অভিজ্ঞ কারিগর দের আগুন বা গলনের প্রতি নজরদারি।
লোহা গলে নীচের ফোকর দিয়ে বেরুতে শুরু করলে তাকে
বের করার জন্য অভিজ্ঞ কারিগর দের কারিগরী।
  কাঁচা লোহাকে পাকা করা। মান অনুযায়ী আলাদা করা।

তারপর  তার ওজন। ব্রহ্মাণীর তীরে গোরু গাড়ি করে নিয়ে যাওয়া। তারপর নৌকা যোগে আজিমগঞ্জের লোহাগঞ্জে
বিক্রি র বাজারে নিয়ে যাওয়া। কত মানুষের কি বিপুল কর্মকাণ্ড।আজ হারিয়ে গেছে সেদিনের  কর্মচঞ্চল  বীরভূমের বিখ্যাত  লোহামহল।
গ্রন্থ ঋণ ঃ জেলা গেজেটিয়ার। বীরভূম। ' ও ম্যালি
  বীরভূম বিবরণ ঃ হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়।
বাঙলা ও বাঙালী র বিবর্তন ঃ ডঃ অতুল সুর
------------ ------------ ------------ ------------ ৬ নং পাতা শেষ।
প্রবন্ধ সমাপ্ত। 
 

No comments:

Post a Comment