Monday, 31 October 2022

গল্প। নতুন বৌ।

 পটের বিবি ঃ  নতুন  বৌ 

নতুন বৌ এর রূপের আলোয় ঘরের উঠোন একেবারে ঝলমল করছে। ফাগুন বিকেলের আলোতে সে রূপ যেন
তপ্ত সোনা। পাড়া ঘরের মেয়ে বৌ দের পলক যেন পড়েনা।
এত ফর্সা। চোখ ছাই ছাই নীল। গোটা গাঁ  জেনে গেল সুন্দরী বৌ একটা  এসেছে বটে। অভিজ্ঞ মহিলারা মুখ টিপে হাসছে।
আর কমবয়সী কালো মেয়ে গুলোর মনে হচ্ছে গায়ে হাত দিয়ে একবার দেখে।
  গাঁয়ের বয়স্কা মহিলারা টুকটুক করে কথায় কথায় বের করে
নিল ঠিকুজি কুলুজী। বৌ এর বাপের বাড়ির লোকরা এ গাঁয়ের  কারও কারও আত্মীয়। তারা তো কিছুটা জানেই।
শেষ মেশ জানা গেল নতুন বৌ এর ঠাকুমার মা না তার মা
সাহেবদের নীল কুঠী তে কাজ করত। রক্ত বড় শক্ত জিনিস।
জানে সর্বজনে। শুধু জানেনা কেমন করে কি হয়। বাপের মতো বেটা হয়। বা মায়ের মতো মেয়ে হয়। মানুষ অনুভবে কিছু বোঝে। বলে একেবারে মায়ের মতো মুখটি হয়েছে বা বাপের মতো লম্বা চওড়া।
আবার দোষ গুনের সময় ও বলে। দেখতে হবেনা কার বেটা।
" বাপকা বেটা আর সওয়ার কা ঘোড়া "
বা মা যেমন মেয়ে তেমন। এসব কথা কি আজকের। সে যে কত দিনের পুরনো তা কে জানে।
তা হ্যাঁ গো মেটে ঘরে এমন সুন্দরী বৌ। সাহেব দের মতো
ফর্সা। সামলে সুমলে রেখো বাপু। নজর তো পড়বেই।
স্বামী ছেলে টি ও খুব সৌখিন। চুলের টেরি বাগাতেই তার অনেক সময় লাগে। বেশ খাঁজ ওয়ালা চুল। কায়দা করে কিছুটা কপালের উপর নামানো। বাপের সরকারি চাকরি।
হোক খালাসি। রাস্তার কাজ তদারকিও  করে। পাকা পিচের
রাস্তা হচ্ছে গ্রামের পাশ দিয়ে। জঙ্গলের ভিতরে।
নতুন বৌ চান করতে গেলে শাশুড়ী সঙ্গে যায়। একটু দূরেই
বাবুদের কাটানো টলটলে জলের পুকুর। পুকুর নয় দিঘি।
দিঘির ওপারে বাবুদের বিরাট দালান। দালানের জানলা থেকে
বাবুদের ঘরের ছেলেরা মেয়েদের চান করা দেখে বোধহয়।
মেয়েরা গায়ে কাপড় জড়িয়েই চান করে।
কি একটা যন্ত্র আছে আবার ওদের। দূরের জিনিস কে কাছে দেখা যায়। শিকার করতে যাবার সময় সাথে নেয় সে যন্ত্র।
বাবুদের একটা বাগান বাড়ি আছে। সেটাও দোতালা দালান।
  সামনে পুকুর। বাঁধানো ঘাট। চারদিকে ফুল ফলের গাছ ।
কত রকমের আম গাছ যে আছে সেখানে। চাঁদনি রাতে সেখানে না কি নাচ গানের আসর বসে। বাবুরা থাকেন। আসেন
ইংরেজ সাহেব বাবুরা। তাঁরা ও শিকার করতে যান। আদিবাসী সাঁওতাল যুবক দের সঙ্গে নেন তাঁরা। ছোট ছোট
ছেলে মেয়েরা গুলির খোল গুলো কুড়িয়ে এনে দিলে তাদের
ফুটো  তামার পয়সা দেয় সাহেব বাবুরা।
  তো একদিন  নতুন বৌ এর বর দুলাল এর ডাক পড়ল বাবুদের কাছে। তাকে খবর দিল পাড়ার এক মাঝবয়সী বৌ।
তাকে তো সবাই চেনে জানে। তার কি কাজ সবাই জানে। এক সময় দেখতে ভালো ই ছিল। এখনও খুব মন্দ নয়। ভালো বাঁধন ।
মুখ ফুটে কেউ কিছু বলেনা। জানে বাবুদের আড়কাঠি।  তিনি নন্দরাণী। তার চোখে মুখে কথা।
কত রকমের ছলাকলা।
তো বাবু ছিলেন বাগানবাড়িতে তেই। দুলাল হাজির হল। নন্দ রাণী র সাথে। মনে তার কু ডাকছে। পা যেন চলতে চাইছেনা।
-- আয়। আয়  দুলাল। বস। বস। দুলাল দাঁড়িয়ে ই আছে। আরে বোস না। নন্দ রাণী কোন আড়ালে যেন  গেল
--- শোন তোরা আমার প্রজা তো। না কি।
দুলাল হাত জোড় করে আছে।
শোন  কদিন পরেই এখানে এক অনুষ্ঠান। অনেক বাবু আসবেন। সাহেব সুবো রা আসবে। তাদের সব কিছু দেখা শোনার ভার আমি দেব আমার জমিদারির সব সুন্দরী মেয়েদের। শুনলাম তোর বৌ টা না কি বেশ সুন্দরী। তা কোথা থেকে আনলি রে। এই বাগানবাড়িতে সেদিন বাঈজী রা আসবে। তার একদিন আগে থেকেই কার কি কাজ হবে সব বুঝিয়ে দেওয়া হবে। কি বুঝলি। তোর বৌ টা কে পাঠিয়ে দিবি।
নন্দরাণী নিয়ে আসবে।
দুলাল হ্যাঁ না কিছুই বলতে পারেনা। বাবু তার হাতে  একটা টাকা দিলেন। একটা গোটা টাকা!
--- বৌ টা কে দিবি।  যা  এবার।  আরে বাবা তোর বৌ তোর ই
থাকবে।  যা । এই নান্দী -
   ঘরে ফিরে এলো দুলাল। কিন্তু  মুখে তার কথা নাই। কি যে বলবে  নিজের বৌ কে।
ঠিক সন্ধ্যেতেই নন্দরাণী এসে হাজির। দাওয়ায় জমিয়ে বসে
নতুন বৌ কে ইনিয়ে বিনিয়ে কত কথা  বলল। এমন করে বলল যে মনে হবে  বাবু বাড়ির অনুষ্ঠানে নেমতন্ন।
মেয়ের মন। নতুন বৌ কিন্তু যা বোঝার বুঝে গেল কি হতে চলেছে ---
নন্দরাণী সব শেষে ওঠার আগে বলল " বুঝলি জলে বাস করে কি কুমিরের সঙ্গে বিবাদ করা যায় "
------------ ------------ ------------ ------------ ------------ ১ ম পাতা শেষ।


।।পটের বিবি ঃনতুন বৌ ।।  ২ নং পাতা আরম্ভ
যেতেই হল। একবার ভেবেছিল বাপের ঘর চলে যাবে। কিন্তু আবার এখানেই তো ফিরতে হবে। সে না গেলে যদি জমিদার বাবুর রাগ পড়ে স্বামী  শ্বশুর এর উপরে।
নিয়ে যেতে সেই নান্দী ই। সে ই তো সবাইকে  নিয়ে যায়। আরও আছে দু তিন জন। লক্ষ্মীরাণী ; পদ্মারাণী। অন্য সব গাঁয়ে ও আছে এই রকমের মেয়েরা। আদিবাসী সাঁওতাল পাড়ায় গোলাপি। অবশ্য ওদের ধরন আলাদা। বেশ স্বাধীন মনোভাব। নিজের শরীর নিয়েও। তো কি!  মনে কোন দাগই যেন পড়েনা ওদের। কোন প্রকাশ ও নাই।
কজন আদিবাসী কম বয়সী মেয়ে নাচ মহলে কাজ করছিল।
উপর তলা তে ও কাজ চলছিল। ঝাড় মোছ। বাঈজী দের আনতে না কি গাড়ি গেছে। আসছে। বারমহলে থাকবে ওরা।
ওদের কাছে রাতে থাকবে ক টা মেয়ে। ফাই ফরমাস খাটার জন্যে। নতুন বৌ দেখল তার তেমন কাজ নাই। এদিকে সন্ধ্যে হয়ে এলো। নন্দরাণী তাকে নিয়ে গেল দোতালায়। একটা খুব সাজানো ঘরে। এমন ঘর জীবনে কোন দিন দেখেনি সে।
" কি রে নান্দী  কান্না কাটি করবে না তো আবার "
  বাবু বোতল খুলে বসলেন। নান্দী একটু হবে না কি। লে লে।
দ্যাখ যদি খায় একটু। তো দে। আলাদা একটা গ্লাস নিয়ে এলো নান্দী।  নিজে খেল। ওকে বলল খেয়ে দ্যাখ। এত ভালো জিনিস তো আর দেখিসনি।  ওর স্বামী ; শ্বশুর রা ও খায়।
বাপের ঘরে ও দেখেছে। নিজের ঠাকুমার সঙ্গে সাহেব বাবুর ঘরে ও দেখেছে। ওর ঠাকুমা ও খেত। সাহেব বাবুর সাথে।
ওর ঠাকুমা ও সাহেব বাবুর ঘরে মেয়ে নিয়ে যেত শুঁড়ি পাড়া থেকে। দলুই পাড়া থেকে। নতুন বৌ তখন ছোট। তবে বুঝত।
মেয়ের মন। একেবারে আনাড়ি তা নয়।
এখানে সে তো বুঝেই গেছে তার কি কাজ। দিতে হবে। জমিদার বাবুকে তার শরীর টা নেবে । সে ও নন্দ রাণী র কাছ থেকে নিয়ে একটু
খেয়ে দেখল। ভালোই তো। আর একটু।
একসময় নন্দরাণী নীচে চলে গেল।
জমিদার বাবু র তর সইছিল না আর।
যা হবার সবই হল।
ছাড়তেই চায়না। পারলে সারা রাত ই যেন -
কতক্ষণ পরে ছাড়া পেয়েছিল কে জানে
যাই হোক। বাবু ইনাম দিলেন। চকচকে গোল চাকতি।
  --- আজ যা। কাল কিন্তু সাহেব বাবুদের মন ভরিয়ে দিতে হবে। ঠিক সময়ে চলে আসবি।
নন্দরাণী তাকে নিয়ে নিজেদের পাড়ায় চলল।
যেতে যেতে বলছে " আগে তো সুন্দরী নতুন বৌ এলে আগে
বাবুদের কাছেই   আসতে হত "।
" তা  তুই তো এলি বেশ কিছু দিন পরে লো। "
" কাল ভালো করে মন জুগিয়ে দিবি। তোর কপাল খুলে যাবে
- আর তোমার?
-" আমার ও কিছু হবে। আর তো তোদের মতো বয়েস নাই -
আমাদিকে আর কে ছোঁবে বল দিকি "
------------ ------------ ------------ ------------ ------------ ২ নং পাতা শেষ

।। পটের  বিবি ঃনতুন বৌ ।।  ৩ নং পাতা আরম্ভ।
তারপরের  দিনের সন্ধ্যা।
ঝাড়বাতি র আলো য় ঝলমল করছে নাচ মহল। সুগন্ধি ছড়ানো হয়েছে। আসরের মাঝখানে বাঈজী আলো করে বসে আছে। তার চারপাশে তার সাগরেদ রা। বেহালা ; সারেঙ্গী ; তবলা।
বর্ধমান না কলকাতা থেকে এই বাঈজী এসেছে।
নাচমহলের চারদিকে বাবুরা বসে আছেন চেয়ারে। সাহেব  বাবুদের আলাদা চেয়ার। লাল গদি আঁটা।
আজ অনেক মেয়েকে জুটিয়ে এনেছে নন্দ ; পদ্ম ; লক্ষ্মী রা।
নতুন বৌ সবাইকে দেখছে। তার চেয়ে কি কেউ বেশি সুন্দরী!
না তেমন তো মনে হচ্ছে না। তবে সাঁওতাল মেয়ে গুলো বেশ
সেজেছে। তারাই সব পরিবেশন করছে। অঢেল পানীয়। লাল
সাদা। আর কষা মাংস। মাংসের পকোড়া।
গানও চলছে। বাজনা ও। বাঈজী মাঝে একবার নাচ ধরল।
ঘাঘরা ঘুরল চক্রাকারে।ঘুঙুর এর তালে তালে বাজনা।
সেলাম ঠুকে ইনাম আদায়।
কত রকমের বাহবা।। হাততালি।
  শেষ মেশ বাবু রা ও নেমে পড়ল নাচে। বাঈজীর  সাথে। আর এই বার
বাকী সব মেয়ে রাও চারদিকে গোল করে হাতে হাত ধরে ঘুরতে লাগলো।
বাবুদের যার ভাগে যে পড়ল। তাকেই বগল দাবা করে নাচ।
নতুন বৌ এর দিকে নজর সবার। কিন্তু সবাই জানে ও আজ সাহেব বাবুর জন্যে। সাহেব বাবু তো এমন জড়িয়ে ধরল!
তাকে বগল দাবা করে প্রথমে ই চলে গেল দোতালায়।
- তুমি তো বহুত সুন্দরী আছে। তোমাকে আমি কলকাতা নিয়ে যাবে। তোমাকে আমি রাখবে। " " আমাদের রক্ত আছে তোমার শরীরে "। বহুত খুব
সাহেব তো তাকে ছাড়তেই চায়না। রাত পার না করে ছাড়বে বলে মনে হচ্ছে না। ক্ষমতা আছে বটে। শেষ করে ও শেষ হয়না
আবার আদর।
সাহেব তাকে অনেক  ইনাম দিল। সাহেবকে জমিদার বাবু আগেই জানিয়ে দিয়েছিল " আপনার জন্য চমৎকার চীজ থাকবে "।
আর এক সাহেব তার নজর ও ছিল  ওরদিকেই। তবে বড় সাহেবকে বাদ দিয়ে তো আর তার ভাগে আসবে না।
মনে মনে ইচ্ছে অন্য কোন বারে।
বাকী রা যে যেখানে পেরেছে জায়গা নিয়েছে।
বাবুর ঘরে বাঈজী।
নাচমহলে আজ  নরক গুলজার।
------------ ------------ ------------ ------------ ------------ ৩ নং পাতা শেষ

।।পটের বিবি ঃ নতুন বৌ।। ৪ নং পাতা আরম্ভ।
নতুন বৌ এর রক্তেই ছিল বিদেশি নাগিন কন্যার বিষ।
  নিজেকে বুঝতে তার একদম ই সময় লাগেনি।
  যা পার  ; যতটা পার  আদায় করে নাও জমিদার বাবুদের কাছ থেকে। সাহেব বাবু দের কাছ থেকে। গুছিয়ে নাও।
তার স্বামী কে ও খুশী করে দিল টাকা দিয়ে। সেই টাকা তে সে বাবুয়ানি করে। ফুটানি মারে। দামী মাল খায়। তার র‍্যালা দেখে কে!  তেমনি পোষাক । সাটিনের জামা। আর বোলচাল!
জমিদার বাবুর বাঁধা মেয়ে মানুষ হয়ে গেল সে।
আবার সাহেব বাবুরা আছে। বড় সাহেব ; ছোট সাহেব।
সবাই কে সে খুশী করে দিল।
জমিদার বাবু তার স্বামী কে কাজ দিয়ে দিল। প্রায়ই বাইরে যেতে হয়  খাজনা আদায়কারী র সঙ্গে।
বড় সাহেব তাকে নিয়ে একবার দিন কয়েকের জন্যে কলকাতা নিয়ে গেল। সেখানে ও কত সাহেবকে মজিয়ে দিল।
রোজগার করল দু হাতে।
সে বুঝেছে  টাকা থাকলে কেউ কিছু বলতে পারবেনা। কে আর কি বলবে। সে জমিদার বাবুর মেয়ে মানুষ।
টাকা থাকলে ই হল। শরীরে কি দাগ থাকে না কি। টাকাতে সব মুছে যায়। জমিদার বাবু তাকে জমি দিয়েছে। ঘর করে দিয়েছে। সাহেব বাবু তাকে সোনার চেন দিয়েছে। তার এমন
চকচকানি। যখন পরে বেরোয় লোকে জুলজুল করে দ্যাখে।
এখন নন্দ ; পদ্ম ; লক্ষ্মীরাণীরা তার কাছে হাত পাতে।
জমিদার গিন্নী মা তার দিকে তাকিয়ে থাকে।
সে বোঝে  জমিদার গিন্নী র চোখে  আগুন। মনে আগুন।
  সে আগুন ছড়িয়ে পড়তে পারে।
  কিন্তু সে কি করবে। সে তো আর আগুন নিভাতে পারবে না।
  তার রূপ আছে। শরীর আছে। সে বিক্রি করেছে।
  বাবুরা কিনেছে। বাবুদের টাকা আছে।
  না। তার মনে কোন বিকার নেই। কোন আফসোস নাই।
  তাকে ভোগ করল বাবুরা। সে ও ভোগ করল। কত জনকে চিনল ভিতরে বাইরে।
কত কি দেখল।
কলকাতা গেল।
আরও কত জায়গায় গেল।
কত কুঠী বাড়িতে রাত কাটাল।
কত সাহেব বাবুর সাথে ।
তার ছেলে মেয়ে রাও জন্মেছে কত রকমের রক্ত নিয়ে।
সে একমাত্র জানে। কোন টা কার।
কিন্তু সে সব থেকে ভালোবাসে সবচেয়ে ফর্সা ছেলেটাকে।
ওর শরীরে সাহেব বাবুর রক্ত।
  সাহেব বাবু তাকে চার্চের স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছে।
  তাহলে আর কি সে করতে পারে।
  সব তো করেছে এই শরীর টা র থেকেই। এটাই তার মূলধন।
  তার যা বেচার ছিল  বেচেছে।
  সবাই তো বাজারে এসেছে বেচার জন্যেই।
  এ জগৎ  এক বিরাট বাজার।

আবার সে জানে তাকে সাহেব বাবুদের কাছে পাঠিয়ে জমিদার বাবু কম রোজগার ; কম সুবিধা ভোগ করেনি।
এ দুনিয়ায়  দেওয়া আর নেওয়া র ই খেলা।
এ খেলা চলছে ই।
এ খেলা চলবেই।
অতএব -
------------ ------------ ------------ ------------ ------------ ৪ নং পাতা শেষ।  সমাপ্ত।
এই নতুন বৌ এর নাম কি ছিল কেউ জানেনা। সব নামই কাল্পনিক। সে কি আর আজকের ঘটনা। কে বলবে সে সব কথা। এক চুল পাকা বুড়ি মা  বয়েস তার কত সে জানেনা।
আমাকে বলেছিল। কম বয়সে তারা শুনেছিল। ইংরেজ সাহেবদের দেখেছিল। নীল চাষ করাতো। শিকার করতে যেত
নীলকুঠির জঙ্গলে। তিতির ; খরগোশ ; হাঁস মারত।
গুলির খোল কুড়িয়ে এনে দিলে মাঝখানে গোল ফুটো তামার পয়সা দিত সাহেব বাবুরা।
  সে ছিল এক পটের বিবি।
  আর বাবা  ঐ বাঈজী আর এই রকম রাক্ষসী মেয়ে দের জন্যই  ধ্বংস হয়ে গেল বাবুদের সব। এক বাবু যে কি করে
মরেছিল কেউ জানে না। অনেকে তখন নানা রকম কথা বলত
বলত রাণী মা ই না কি বিষ খাইয়ে মেরে দিয়েছিল।
কে জানে কি!  আর কি সব মনে আছে বাবা। সে সব হারিয়ে গেছে । আর মনে পড়ে না৷

প্রবন্ধ। বীরভূমের লোহামহল

 ।। বীরভূমের লোহামহল।। ৪ নং পাতা আরম্ভ।

  ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী এদেশের শাসনকর্তা হবার অনেক আগে থেকেই  অর্থাৎ বীরভূমের রাজা এবং স্থানীয় জায়গীরদার  ; দের অধীনে বা তাঁদের কে নির্দিষ্ট কর প্রদান করে স্থানীয় দক্ষ কর্মকার রা তাঁদের শাল তৈরী করে অনেক লোহা গলিয়ে বের করেছেন। কাঁচা লোহা কে পাকা লোহা করা হয়েছে। তার জন্য আলাদা লোক। এই " শালের " মালিকরা
" শালুই "। আবার স্থানীয় ভূস্বামী রা ও দক্ষ শালুই দের দিয়ে
শাল চালিয়েছেন। মাসড়া গ্রামের ছোট্ট চারচালা শিবমন্দির টি
যেটি বীরভূম জেলার প্রাচীণতম ( ১৬৩১ সালে নির্মিত)।
সেটি নির্মান করিয়েছিলেন  কর্মকার পরিবারের এক ধনী ব্যক্তি। তিনি ছিলেন " রাজকর্মকার "। " রাজলোহাপাল"।
নাম তার সিতবদাস। তাঁর মা সিদ্ধেশ্বরীর নামে এই মন্দির নির্মান করিয়েছিলেন। এখানকার শাল চালানো কর্মকার রা প্রায় সবাই এই লোহার দৌলতে প্রভূত ধনী হয়ে উঠেছিলেন।  নিশ্চিত ভাবেই তাঁর নেতৃত্বে রাজাদের ও শাল চলত। বা রাজাদের নিযুক্ত ব্যক্তি দের দ্বারা চালানো হত।  এই এলাকার
প্রায় সকল স্থানেই এই " শাল " ছিল। গ্রামের বাইরে বিপুলাকৃতির লৌহমলের স্তুপ ই তার প্রমান।
মলুটির রাজাদের প্রথম দিক কেটেছে রাজধানী ডামরা য়।
ডামরা ছিল লোহাগলানোর অন্যতম প্রধান কেন্দ্র।
সেখানে রয়েছে লৌহমলের বিরাট স্তুপ। সে অবশ্য মলুটি ; মাসড়া ; সহ সর্বত্রই রয়েছে। একসময় বালিয়া নারায়ণ পুর
হয়ে ওঠে প্রধানতম কেন্দ্র।
   শহর রামপুরহাট তখন ভবিষ্যতের গর্ভে। ছোট এক পল্লী মাত্র। তখন এই লোহার ব্যবসায়ে বর্ধিষ্ণু জমজমাট গঞ্জ
নারায়ণপুর। ধনজনপূর্ণ জনপদ। নারায়ণপুরের প্রসিদ্ধি
এই লোহার কারবারের জন্য। ১২৬০ বঙ্গাব্দে এখানে কাঁচা লোহা তৈরীর  জন্য ৭৫ টি " কোটশাল " এবং সেই কাঁচা লোহাকে পাকা করার জন্য ৭৫ টি " ডুকি শাল "। স্থানীয় মানুষেরাই এগুলি পরিচালনা করেন।
একটু দূরেই ব্রহ্মাণী নদী। নদীর ওপারে আরও ২৫ টি কোটশাল এবং ২৫ টি ডুকিশাল। কোটশালে মজুর বেশী প্রয়োজন হত। প্রায় ১০০ জন প্রতি শালে। ডুকি শালে মজুর কমই লাগে। আমাদের পাড়া গাঁয়ের কামার শালার মতো।
কোটশালের মজুর রা প্রায়শই মুসলমান। ডুকিশালে র মজুর রা হিন্দু।
বর্ষা কালে কোটশাল বন্ধ। গর্তে জল জমে যায়। চার মাস কাজ বন্ধই থাকত।
উৎপাদন ঃ প্রতি কোটশালে প্রতি বারের গলনে প্রায় কুড়ি পঁচিশ মণ লোহা পাওয়া যেত। মনপ্রতি দর পাঁচ সিকা থেকে দুই টাকা। পাকা লোহা মণ প্রতি দর পাঁচ টাকা থেকে সাড়ে পাঁচ টাকা।
প্রতি খেপে সমস্ত খরচ বাদ দিয়ে  কোটশালের লাভ প্রায় পঁচিশ ত্রিশ টাকা। আর পাকা লোহা বিক্রি করে লাভ প্রায়
একশো টাকা লাভ।
১২৯০ - ৯৪ সাল নাগাদ এই লোহার কারবার বন্ধ হয়ে যায়।
  বিদেশি লোহার আমদানিই মূল কারণ। যন্ত্র চালিত ব্যবস্থা র
সাথে প্রতিযোগিতায় এঁটে না ওঠা। তারপর ইংল্যান্ড থেকে আমদানি করা লোহার দামও বেশী। শেষ হয়ে গেল আমাদের দেশীয় শিল্প। এক নারায়ণপুরেই দশ হাজার মানুষের অন্ন সংস্থান হত।
এলাকার চরম আর্থিক উন্নতি ঘটেছিল।
------------ ------------ ------------ ------------ ------------ ৪ নংপাতা শেষ।




।। বীরভূমের লোহামহল।। ৫ নং পাতা আরম্ভ।
যাহারা শাল চালাইত তাহারা শালুই। এই শালুই দের তখন অনেক ধন। বিরাট তাদের প্রতাপ। বিশাল অট্টালিকা।
অর্থ আর ক্ষমতা র দম্ভ। সেই দম্ভই তাদের শেষ করে দিয়েছে।
  কাঁচা লোহা গলানো র কারিগর দের বলা হত শাশা। কাঁচা লোহাকে পাকা লোহা করত  মেহতর রা।
গোলাকার লোহার তাল এর নাম ডুকী। আর লম্বা পাতের মতো র নাম বাতা। খুব ভালো লোহার নাম  মুচ। প্রতি কোটশালেই এরকম কিছু পরিমান মুচ লোহা পাওয়া যাইত।
এর দাম বেশি। ইস্পাতের চেয়েও ভালো এই লোহা।
ব্রহ্মাণী নদীর জলপথ ই পণ্য পরিবহনের জন্য ব্যবহৃত হত।
মুর্শিদাবাদের আজিমগঞ্জের নিকটবর্তী  লৌহগঞ্জে এই লোহা চালান হইত।
" যে সময় নারায়ণপুরের খুব চলতি অবস্থা ; লোহার কারবারে
র খুব ধূমধাম ছিল ; সেই সময় রামশঙ্কর হালদার ( গন্ধবণিক) ; কৃষ্ণধণ মালুই (কর্মকার) ও গদাই বড়াল (সুবর্ণবণিক)  এর মতো সঙ্গতিসম্পন্ন ও সম্ভ্রান্ত লোক এ অঞ্চলে আর কেহ ছিল কি না সন্দেহ। শুনিতে পাওয়া যায়
শালুই দের একান্নবর্তী পরিবারে প্রায় আশী জন লোক ছিল "
  সমগ্র লোহামহলের এই লোহার কারবার ই এলাকার সমৃদ্ধির
কারণ।
   সে দিন কবেই শেষ হয়ে গেছে। আছে কিছু স্মৃতি। আর লৌহমলের বিরাট বিরাট স্তুপ।
বীরভূমের লোহা শিল্পের কথা বলতে গেলে ইন্দ্রনারায়ণ শর্মা র
নাম উল্লেখ করতেই হবে। আধুনিক পদ্ধতি তে লোহা উৎপাদনের জন্য কারখানা তৈরী র অভিপ্রায়ে বাৎসরিক পাঁচ হাজার টাকার বিনিময়ে তিনি এক বিরাট এলাকার লীজ নিয়েছিলেন। সে টা ১৭৭৪ সাল। কিন্তু তিনি সফল হতে পারেননি।
১৭৭৭ সালে মেসার্স মোটে এবং ফারকুহার চেষ্টা করেন।
মেসার্স সামার এবং হিটলী দীর্ঘ মেয়াদি মাইনিং লীজ নিয়েছিলেন।
১৭৭৯ তে ব্যবসা চালানোর জন্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি
ফারকুহার কে পনের হাজার টাকা অগ্রিম দেওয়া হয়।
সব শালই চলছে তখনও  দেশীয় পদ্ধতিতে ই।  ১৮৪৫ সালের
মিঃ ওয়েলবি এবং জ্যাকসনের রিপোর্ট।
১৮৫২ সালে ডঃ ওল্ডহ্যামের রিপোর্ট অনুযায়ী দেওচা ; ডামরা
বালিয়া নারায়ণ পুর এবং গণপুরে দেশীয় পদ্ধতি তে ই লোহা গলানো হয়। দেওচা তেই আছে ত্রিশ টি চুল্লী।
তবে তিনি তাঁর রিপোর্টে উল্লেখ করেছিলেন যে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে  বড়ো আকারে আধুনিক ফার্নেস গড়ে তোলার মতো
যথেষ্ট আকরিক লোহা বা উপযুক্ত পরিমানের জ্বালানী র অভাব আছে। 
------------ ------------ ------------ ------------ ৫ নং পাতা শেষ।


।। বীরভূমের লোহামহল।।  ৬ নং পাতা আরম্ভ।।
  সারা বছরে সমস্ত দেশীয় চুল্লী থেকে প্রায় ২৩৮০ টন লোহা উৎপাদিত হত। দেশীয় দের ই একচ্ছত্র আধিপত্য।
আবার ১০ মন কাঁচা লোহা থেকে ৭ মণ ১০ সের  পাকা লোহা
পাওয়া যায়। যা যথেষ্ট উৎকৃষ্ট মানের।
কাঁচা লোহাকে পিটিয়ে পিটিয়ে নমনীয় পাকা লোহায় পরিণত করা হয়। কিছু অঙ্গার মিশ্রিত ইস্পাত ও কোন কোন শালে
তৈরী হয়।
১৮৫০ সাল নাগাদ মিঃ ডি ; সি ; ম্যাকে  দেওচা মহম্মদ বাজার
কে কেন্দ্র করে আধুনিক পদ্ধতিতে লৌহ শিল্প গড়ে তোলেন।
প্রায় দশ বছর তিনি চালিয়েছিলেন।  ।  তাঁর মৃত্যুর পর শিল্প টি দেশীয় দের হাতে যায়। তাঁরা মাঝে মাঝে চালাতেন।
সেখান থেকে হাতফেরত হয়ে ১৮৭৪ সাল নাগাদ সাল নাগাদ
বার্ণ এণ্ড কোম্পানি র হাতে যায়। তাঁদের রিপোর্টে জানা যায় যে তাঁদের প্রতিদিন পাঁচ টন উৎপাদন ক্ষমতা সম্পন্ন একটি ব্লাস্ট ফার্ণেস এবং একটি ভার্টিক্যাল ইঞ্জিন এবং বাতাস সরবরাহের জন্য আর একটি ইঞ্জিন রয়েছে।
এখানে মূলত ঢালাই লোহা যা দিয়ে রেল স্টেশন এর চেয়ার ইত্যাদি তৈরী হত। এঁদের প্রায় লক্ষাধিক টাকার যন্ত্রপাতি ছিল।
এঁরা এই শিল্পে অনেক টা অগ্রগতি ঘটালেও শেষ পর্যন্ত বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন। নানা ভাবে চেষ্টা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত যাকে
বাণিজ্যিক ভাবে লাভজনক করে তোলা যায়নি।
এলাকায় লৌহ আকরিকের এবং উপযুক্ত জ্বালানী র অভাব
বিদেশ থেকে আমদানিকৃত লোহার সাথে দামে পাল্লা দিতে
না পারা ; স্থানীয় ভূস্বামী ; জমিদার ; রাজা র সাথে কর নিয়ে
নানা বিবাদ বিসংবাদ ; স্থানীয় কারিগর দের মজুরী বৃদ্ধি
ইত্যাদি নানা বিধ কারণেই এখানে আধুনিক পদ্ধতি তে লৌহ
শিল্প কে শক্ত ভিতের উপরে দাঁড় করানো যায়নি।
১৮৭৫ সালে প্রফেসর বল এর রিপোর্ট ' উদ্যোগ নেওয়া হলেও শেষ পর্যন্ত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। ইতিহাস পুনরাবৃত্ত হয়েছে "
নারায়ণপুর এর উত্তরে ব্রহ্মাণী র তীরে কালো লৌহমলের
  পাহাড় সমান বিশাল স্তুপ দর্শক দের বিস্ময় সৃষ্টি করে।
দেশীয় পদ্ধতি তে ই কি  বিপুল পরিমাণ লোহা এই
বীরভূমের লোহামহলে  একদা উৎপাদিত হয়েছিল!
বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গেছে সেদিনের কর্মমুখর লোহামহল। কত মানুষের কত রকম জীবিকা। কত উপার্জন।
কেউ মোরাম চাতাল এর নীচে মাটি কেটে লোহা পাথর তুলে
আনছে। সেই লোহাপাথর বস্তাবন্দি করে শালে শালে সরবরাহ করা হচ্ছে। উপযুক্ত জ্বালানী সংগ্রহ করে আনানো হচ্ছে।
কোটশাল তৈরীর জন্য কত মজুর। দশ হাত লম্বা ; দশ হাত চওড়া ; সাত হাত গভীর গর্ত খোঁড়া। মাঝে তার দেওয়াল তোলা। দেওয়ালের মাঝে গোলাকার গর্ত আবার নীচে গলিত লোহা বেরিয়ে আসার গর্ত। সাত আট হাত দূরে শক্ত খুঁটির উপরে উঁচু চালা তৈরি
করা। সেই চালার নীচে দু দিকে দুই শক্ত মাচা বাঁধা।
  গর্তের এক প্রকোষ্ঠে উপযুক্ত পদ্ধতিতে স্তরে স্তরে জ্বালানী
এবং লোহাপাথর সাজানো। সাজানো শেষে ' খরবোনা ' র মাটি দিয়ে পুরু করে  গোটা স্তুপ কে ভালো করে ঢেকে দেওয়া।
স্তুপে আগুন দেওয়া। সব স্তরের কাজে চাই ওস্তাদ লোক।
হাপরের সাহায্যে মাচার উপর থেকে অবিরাম হাওয়া চালানো। ফাঁকা প্রকোষ্ঠে র উপরের মাচা থেকে অভিজ্ঞ কারিগর দের আগুন বা গলনের প্রতি নজরদারি।
লোহা গলে নীচের ফোকর দিয়ে বেরুতে শুরু করলে তাকে
বের করার জন্য অভিজ্ঞ কারিগর দের কারিগরী।
  কাঁচা লোহাকে পাকা করা। মান অনুযায়ী আলাদা করা।

তারপর  তার ওজন। ব্রহ্মাণীর তীরে গোরু গাড়ি করে নিয়ে যাওয়া। তারপর নৌকা যোগে আজিমগঞ্জের লোহাগঞ্জে
বিক্রি র বাজারে নিয়ে যাওয়া। কত মানুষের কি বিপুল কর্মকাণ্ড।আজ হারিয়ে গেছে সেদিনের  কর্মচঞ্চল  বীরভূমের বিখ্যাত  লোহামহল।
গ্রন্থ ঋণ ঃ জেলা গেজেটিয়ার। বীরভূম। ' ও ম্যালি
  বীরভূম বিবরণ ঃ হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়।
বাঙলা ও বাঙালী র বিবর্তন ঃ ডঃ অতুল সুর
------------ ------------ ------------ ------------ ৬ নং পাতা শেষ।
প্রবন্ধ সমাপ্ত। 
 

বীরভূমের লোহামহল ৩ নং পাতা


।। বীরভূমের লোহামহল।।  ৩ নং পাতা আরম্ভ।
  প্রস্তর যুগের মানুষ তো নানা রকমের প্রস্তরের সন্ধানে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে গেছে। একদিন সে ভারী লোহাপাথর যেমন পেয়েছে তেমনই তামাপাথর ও পেয়েছে।
তাকে ভেঙ্গেছে। কিন্তু গলানোর পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে অনেক পরবর্তী সময়ে। লাল ল্যাটেরাইট মাটির স্তরের নীচে
ল্যাটেরাইট বোল্ডারের স্তরে সে খুঁজে পেয়েছে লোহাপাথর।
প্রাচীন " অসুর সম্প্রদায় " তাকে গলানোর কায়দা আবিষ্কার করেছে। যে কথা আগেই বলা হয়েছে।
আধুনিক মানুষ কিন্তু সেই প্রাচীন পদ্ধতিই অনুসরণ করেছে।
কাঠ ; কাঠকয়লা র স্তরের উপরে লোহাপাথর এর সাজিয়েছে স্তরে স্তরে। তারপর বিশেষ ধরনের মাটি দিয়ে সম্পূর্ণ ঢেকে দিয়েছে। বাতাস চলাচলের জন্য ব্যবস্থা রেখেছে। গলিত লোহা বেরিয়ে আসার জন্য ও পোড়া মাটির নল রেখেছে।
পাথরের ভিত্তির উপরে পাথর সাজিয়ে ঘিরে দিয়েছে। প্রায় আধুনিক চুল্লির মতো। এই বহিঃ স্তরের পাথরের উপর ও কাদা মাটি দিয়ে গেঁথে ঢেকে দিয়েছে। বিশেষ ধরনের মাটি অর্থাৎ
আজকের ফায়ার ক্লে সে খুঁজে নিয়েছে। এই মাটি ছাড়া আস্তরণ তৈরি যে ভালো হবেনা তা সে অভিজ্ঞতা য় বুঝেছে।
কোথাও কোথাও মাটির ভিতরে নির্দিষ্ট আকারের চতুষ্কোণ
গর্ত খুঁড়ে  তার দুটি প্রকোষ্ঠ তৈরী করে ; একটি প্রকোষ্ঠ
ঠিক পূর্ব পদ্ধতিতে সাজানো হয়েছে লোহাপাথর এবং জ্বালানী কাঠে। কখনও ঘুটিং ও মেশানো হয়েছে। তারপর সেই একই পদ্ধতিতে পুরো টা ঢেকে দেওয়া হয়েছে উপযুক্ত মাটি দিয়ে। প্রকোষ্ঠে র নীচে  র কয়েকটি নলের সাহায্যে পরের প্রকোষ্ঠে র সাথে যোগ রাকা হয়েছে। অনেক উঁচু চালা তৈরি করে তার উপর থেকে
দুজন ব্যক্তি অবিরাম হাপরের সাহায্যে বাতাস সরবরাহ করে গেছে চুল্লির নীচে দিয়ে। প্রায় চারদিন চার রাত সমানে পরিশ্রম করে  উপযুক্ত তাপ তৈরী করে সেই লোহাপাথর থেকে লোহা গলিয়ে বের করা হয়েছে । এই চারদিন চাররাতের জন্য উপযুক্ত এবং বেশী সংখ্যায় পরিশ্রমী মজুর দরকার হয়েছে।
------------ ------------ ------------ ------------ ------------ -৩ নং পাতা শেষ
 

বীরভূমের লোহামহল


।। বীরভূমের লোহা মহল।।  ২ পাতা আরম্ভ।
  সামগ্রিক ভাবে এই পর্ব চারটি হিমযুগ ( glacial)  এবং চারটি আন্তর্হিম যুগে ( inter glacial episode) এ বিভক্ত। হিমযুগের শেষে দেখা  দেয় চারটি  প্লাবন যুগ ও আন্তঃপ্লাবন যুগ। ( pluvial  এবং inter pluvial episode)  ।তাদের প্রভাব বিন্ধ্যপর্বতের পূর্বাঞ্চলে স্পষ্ট। এই প্লাবনের বিস্তার ছিল পশ্চিম ভারতের সৌরাষ্ট্র এর মধ্যাঞ্চল থেকে শুরু করে পূর্বে পশ্চিম বঙ্গের বর্ধমান ; বীরভূম ; মুর্শিদাবাদ হয়ে বাংলাদেশের উত্তর ভাগ বরাবর ত্রিপুরা পর্যন্ত এবং দক্ষিণে কেরল ; তামিল নাড়ু পর্যন্ত।
  হিমযুগ এবং প্লাবন যুগের আবহাওয়ার তীব্র পার্থক্য এর জন্য ভূমিস্তরের পার্থক্য ও স্পষ্ট ধরা পড়ে। প্লাবন যুগে শিলাখণ্ড এবং ভূমিক্ষয় জনিত পদার্থ সঞ্চিত হয়ে ভূমিস্তরে পার্থক্য সৃষ্টি করে। ভূগর্ভের প্রাচীন শিলাস্তরের উপরে এই যে ভূভাগ তা গঠিত হয়েছে প্লাবন যুগের অধঃক্ষেপ জনিত কারনেই। আনুঃ দশ হাজার বৎসর পূর্বে এখানের আবহাওয়ায় আসে সমতা এবং মনুষ্য বসবাসের উপযোগী হয়ে ওঠে। বর্ধমান বীরভূমের অজয় তীরের বনভূমিতে
প্রাচীন প্রস্তর যুগের মানুষের বিচরণ ক্ষেত্রের নানা নমুনা পাওয়া গেছে। আবার দুর্গাপুর নিকট বর্তী বীরভানপুরে নব্য প্রস্তর যুগের মানুষের অধিবসতির সন্ধান মিলেছে।
  মানুষের সভ্যতার উন্মেষ এবং বিকাশের উদ্ভব স্থল হিসাবে
" রাঢ় ভূমি " কে  চিহ্নিত করার অনেক কারণ ই রয়েছে।
আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক উদাসীনতায় এই এলাকার উপযুক্ত
অনুসন্ধান হয়নি।
" বর্ধমান কে বলা হয় " রাঢ়ের মধ্যমনি "। ধর্মমঙ্গলের কবি
ঘণরাম চক্রবর্তী বলেছেন " বর্দ্ধমান দেশ ভাই সভাকার নাভি "
  বর্দ্ধমান মূল দেহকাণ্ড হলেও তার দুই হস্ত প্রসারিত বীরভূম এবং বাঁকুড়া য়। দুই পা যেন ছড়িয়ে আছে ঝাড়খণ্ড ; পুরুলিয়া
আর পশ্চিম মেদিনীপুরে। পশ্চিমাংশে র " পশ্চিম রাঢ়" বা প্রকৃত " রাঢ়ভূমি "।
মাটির প্রভাব তো মানুষের আকৃতি প্রকৃতি তে ছাপ ফেলবেই।
পশ্চিম রাঢ়ের মানুষ তাই স্বাভাবিক রুক্ষ ; কর্কশ ; পরিশ্রমী এবং ঐতিহাসিক ভাবেই লড়াকু । ইতিহাস তার সাক্ষ্য দেয়।
------------ ------------ ------------ ------------ ------------ ২ পাতা শেষ


 

বীরভূমের লোহামহল। পাতা নং ১


।। বীরভূমের "  লোহামহল " ।। একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা  প্রণব ভট্টাচার্য।।  ১ ম পাতা
অতীতের বীরভূম যে প্রচুর পরিমানে লোহার মতো অতি প্রয়োজনীয় ধাতু উৎপাদন করত  তা আর আজ আমাদের অনেকের মনে নেই।
বীরভূমের পশ্চিম প্রান্তের  ডামরা ; দেউচা ; মাসড়া ; মলুটি ;
গণপুর ; মল্লারপুর ; বালিয়া ; নারায়ণপুর ইত্যাদি এলাকা
" লোহামহল " নামেই পরিচিতি লাভ করেছিল।
নিকটস্থ পশ্চিমের  ল্যাটেরাইট মাটির একটু গভীরেই উৎকৃষ্ট
মানের লোহাপাথর। যে লোহাপাথরে লোহার পরিমান গড়ে
৪০%। কোথাও কোথাও ৬০% পর্যন্ত।
সেই লোহাপাথর থেকে স্থানীয় পদ্ধতিতে লোহা উৎপাদিত হত।
যে পদ্ধতি অতি প্রাচীন। " অসুর "সম্প্রদায়ের মানুষেরা এই পদ্ধতিতে ই লোহা গলাতো। ডামরার কাছে অতি প্রাচীন সেই
চুল্লির সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল। " অসুর কাহানী " র  অসুরদের নেতার নামও " লোহাসুর "। তাঁর ছোঁড়া তীর যেখানে গিয়ে পড়ত সেখানে ভালো লোহাপাথর পাওয়া যেত। এমন ই
কাহিনী। পরবর্তী সময়ে এই অসুরেরা আরও পশ্চিমে সরে যায়  লোহাসুরের নেতৃত্বে । আরও ভালো লোহাপাথরের সন্ধানে। দূরে ছোটনাগপুর ; ঝাড়খণ্ডের পাহাড়ি মালভূমি র
দিকে।
  রাঢ় ভূখণ্ডের এই প্রান্তীয় এলাকা পশ্চিমের মালভূমির ই পূর্বে প্রসারিত অংশ। তাই ভূ চরিত্রে মিল। রাঢ় এই শব্দটির উৎস
কোল ভাষার " রৌঢ় দিশম "। নুড়ি ; পাথর ; পাহাড়ের দেশ।
নদী ; ঝর্ণাতেও পাথর। পাথরে পাথরে ধাক্কা খেয়ে ছুটছে জলধারা। রাঢ় মানেই রুক্ষ ; কর্কশ ; শক্ত মাটি র দেশ।
" লাঢ় "। লাঢ় এই শব্দটির প্রাচীনতম  সন্ধান  মেলে জৈন
ধর্মগ্রন্থ " আচারাঙ্গ সূত্রে "। জৈন সাধু " নির্গ্রন্থ পুত্র " মহাবীর
এই পথহীন ; জঙ্গলাকীর্ণ দেশে পরিভ্রমণ করেছিলেন।
সে আলাদা প্রসঙ্গ।
  এই এলাকার ভূত্বকের গঠন কার্য্য শেষ হয় ৪র্থ হিমযুগের শেষে - আজ থেকে প্রায় দশ হাজার বছর আগে। অজয় ;দামোদর ; ময়ূরাক্ষী ইত্যাদি নদনদীর সৃষ্টি সেই  সময়েই।
কালের বর্তমান পর্বের ( cainozoic era) শেষ যুগ (epoch)
দুটি প্লাইস্টোসিন এবং হেলোসিন নামে পরিচিত। প্লাইস্টোসিন
পর্বের শুরু হয়েছিল ৩০- ৩৫ লক্ষ বৎসর পূর্বে। এবং এই অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটেছিল ১০ হাজার বৎসর পূর্বে।
তারপর শুরু হয়েছে হেলোসিন পর্ব। এবং আমরা এখন বাস করছি এই পৃথিবীর বুকে সেই হেলোসিন যুগেই। বর্তমান পৃথিবীর ভূমিভাগ গঠন এই যুগেই শেষ হয়েছে। প্রাণী বা উদ্ভিদ জগতে যে সকল প্রজাতি এখন বর্তমান রয়েছে তাদের বিবর্তন ও এই প্লাইস্টোসিন যুগেই শেষ হয়েছে।
এই কালটি (epoch) আবহাওয়া তত্ত্বে " গ্রেট আইস এজ "
বা দীর্ঘতম হিমযুগ নামে পরিচিত।
------------ ------------ ------------ ------------ ------------ ১ ম পাতা শেষ


 

Sunday, 30 October 2022

।।বামা হনু।।

হয় গল্প। না হয়  গল্প হলেও সত্যি। 
 নাম ছিল তার বামা হনু। জন্ম আঁকুড়ে ডোমের ঘরে। পিছনে লেজের মতো একটু ছিল। বিছানায় শুতে কষ্ট হত। সে না কি গাছেই চেপে থাকত। 
 গাছেই ঘুমাত। লোকে তাকে হনু বলবে খুব স্বাভাবিক। ছিল অমিত শক্তি শালী। 
 যেমন তার চেহারা। বিশাল। যেমন লম্বা তেমন চওড়া। যেমন তার হাতে লাঠি ঘোরে - সামনে আসে সাধ্য কার। তেমনি তার তীর ধনু। গুলতি। 
 একবার একটা বট গাছের মোটা ডালকে টেনে নামিয়ে গাছের ডালপালা ভাঙ্গছে। ঘরে আছে অনেক ছাগল। খাওয়াতে হবে তো। 
 তো তার কাছে হঠাৎ ই উদয় হল এক ঘোড়ায় চাপা সৈন্য। এসেই জিজ্ঞেস করল   এই এলাকা 
 পাহারা দেয় বামা হনু র ঘর কোনদিকে? 
 বামা দেখল ততক্ষণে আরও একদল এসে হাজির হয়েছে। সব বাইরের মানুষ। পাগড়ি বাঁধা। কোমরে 
 তরোয়াল। 
 তো বামা বলল এসো কেউ। এই গাছের নামানো ডালটা একটু ধরো। আমি কটা ডালপালা ভেঙে নি। তারপর তোমাদের বামার ঘর দেখিয়ে দেব। 
একজন সৈনিক এসে ডালটা ধরেছে। আর বামা হাত ছেড়ে দিয়েছে। অমনি ডাল গেল এক ঝটকায় উপরে উঠে। সেই ব্যাটা সৈন্য মাটিতে পড়ল ছিটকে। অন্য রা অবাক চোখে তাকিয়ে আছে বামার দিকে। বামা বলল দাও একটা তোমাদের ধনু। ওরা দিল। ওরা ভেবেছিল সহজে তাতে ছিলা পরাতে পারবেনা। বামা অক্লেশে ধনু বাঁকিয়ে ছিলা 
 পরিয়ে দিল। এবার বলল দাও একটা তীর। 
 আর পরপর সাতজন দাঁড়াও। আমার একটানেই 
 সাতজন কে ফুঁড়ে তীর বেরিয়ে যাবে। 
 তো তাই আর কেউ কি দাঁড়ায়! 
  তখন বামা বলল বেশ আমি তীর টা ছুঁড়ছি ঐ গাছটা লক্ষ্য করে। ছুঁড়ছি কিন্তু তীর টা তোমাদের 
 বের করে আনতে হবে তবে বুঝব তোমাদের মুরোদ। সে তীরের ফলা গাছের গুঁড়ির এতটা ভিতরে গেল যে সে টাকে বের করে সাধ্য কার। 
 সৈনিক দের দল বুঝল এ যে সে মানুষ নয়। এর ক্ষমতা মারাত্মক। 
তখন বামা বলল শুন হে আমি ই বামা। বামা হনু বলে লোকে। আমরা কালু বীরের বংশধর। 
 সেই কালু ডোম লাউসেনের সেনাপতি। ইছাই ঘোষ কে যুদ্ধে হারিয়েছিল। 
 আমি এই  গাঁয়ের পাহারাদার। আর আমার সঙ্গে আছে আমার ই মতো পাহারাদার দের দল। 
 সব কটাকে কালুবীরের থানে একহাতে বলি দিয়ে দেব। মানে মানে কেটে পড়। 
 বর্গী সৈন্য রা বুঝল এখানে ঢোকা বা লুঠপাট করা সহজ হবেনা। এক বামা তেই রক্ষে নাই। তারপর আবার তার দলবল আছে। 
বর্গী সৈন্য দল এলাকা ছেড়ে কেটে পড়ল। 
------------ ------------ ------------ © প্রণব ভট্টাচার্য 
আমাদের এই এলাকা মানে অযোধ্যা - বনকাটি এলাকায় শোনা যায় বর্গী আক্রমণে র মুখে পড়েনি। বনকাটির শ্রী অনিল কুমার রায় মশাই 
 এর কাছ থেকে শোনা। ।।বামা হনু র গল্প।।