।।কথা সাতকাহন।। নবম
র্যালে কোম্পানির নতুন ' হাম্বার ' সবাইকে কিনে মোতি চাচার কি আনন্দ। গাঁয়ে আর কারো নাই।প্রচ্ছন্ন গর্বে দুবেলা কাঁধের গামছা দিয়ে সাইকেল টা মোছে। একেবারে চকচকে ঝকঝকে। ওর চোখ দুটো ও চকচক করে ওঠে।
তাকে আজ আর কারও মনে নাই। মনে রাখার কারণ ও নাই। ডাকবাংলো র সামান্য কুলি মজুর। খালাসি।
ঠিক সকাল সাড়ে সাতটা য় সে হাজির ডাকবাংলো অফিসের বারান্দায়। বাবু ডাকলে অফিসে র ভিতরে ঢোকে টিপছাপ দেয়। তারপর বাবুর কাছ থেকে যা শোনার শুনে নিয়ে সাইকেল টা ঠেলে বড় গেটের বাইরে গিয়ে সাইকেলে ওঠে।
সাতকাহনিয়া থেকে সাগর পুতুল। নদী বাঁধ ধরে। তীক্ষ্ণ তার নজর। তার যা কাজ সে করে সাইকেলে চেপেই। বাঁধের কোথায় গর্ত ; চিড় ; ফাটল সব তার নজরে। কোন গাছ মরল না ডাল শুকাল কিছুই তার নজর এড়ায়না। বাঁধে গোরু দেখেছে কি বাঁধ থেকেই মালিককে হাঁকডাক। ফেরে সে ই দুপুর পার করে।
কাজ খুব বাড়ে বর্ষার সময়। তখন নজর আরও কড়া। ইঁদুরের গর্ত ও নজরে রাখতে হয়। মাঝে মাঝে সাঁওতাল ছেলে গুলো গর্ত খুঁড়ে ইঁদুর বার করে যে। শিকড়বাঁধা মাঝি পাড়ার ছেলে গুলো কে কবার সে তাড়িয়েছে।
নদীতে জল বাড়ে। পঙ্কজ বাবু ডাক দেন। তাঁর সঙ্গে ছাতা নিয়ে নদী ধারে। জলের রঙ ; স্রোতের টান ; ফেনা দেখে সে ঠিক আন্দাজ করে কেমন বান আসতে চলেছে। , ঝোঁপ বেশী হয়েছে। চন্দ্রবোরা সাপ তো আছেই। তবু কোনো কোন দিন নামে। ফুল পেড়ে নিয়ে আসে।
তারপর গাঁয়ে ফিরে সেই ফুল নেবার জন্য কাড়াকাড়ি। কয় টা সে আলাদা করে রাখে। কোঁড়া পাড়ার মেয়ে বৌ গুলো খুব আবদার করে। আরও কত মেয়ে বৌ। এটা সে খুব উপভোগ করে।
মোতিচাচার অনেক গুলো ছাগল। সেই ছাগল গুলোর জন্যে কচি শ্যাওড়া ডাল নিয়ে আসে। ছাগলের খুব প্রিয়। আবার ঘরের খড়ের চালে ঈশান কোনে গুঁজবার জন্য মেয়ে বৌরা চেয়ে নেয়। ১৩ বৈশাখ। ধর্মরাজের পুজো। কালুবীর এর থানে পুজো। বাগুড়ার কালুবীর এর থানে বিরাট এক মূর্তি আছে।
উলঙ্গ দাঁড়িয়ে আছে। সে যে কোন ঠাকুর কে জানে। ওখানে একবার নামে। মেটে রা পুজো করে।
নতুন মেঘ দেখা দিচ্ছে। শ্যাওড়া ডাল গোঁজা থাকলে ঘরে বাজ পড়বে না। মানুষ বিশ্বাস করে।
গাঁয়ে ফিরে অফিসে গিয়ে বাবুকে সব কিছু বলে মোতি চাচার ছুটি। অফিসে র টেবিলে দুটি ডাল সমেত নাগকেশর ফুল নামিয়ে রাখে।
দিন প্রতিদিন। বাঁধে মোতিচাচা কে দেখা যাবেই। প্রতিটি অর্জুন ; শিমুল ; পলাশ ; বাবলা ; জিওল ; যজ্ঞডুমুর ; নিম ; বেল ; খেলকদম গাছকে সে চেনে। বিশাল শিমূলের কোটরে থাকা সবুজ টিয়া গুলো কেও সে বুঝি চেনে।
মোতিচাচা জানে এই বাঁধ অনেক দিনের পুরনো আর বাঁধের দুপাশে লাগানো এই গাছ গুলো ও। কিন্তু কত পুরনো সে সব জেনে কি লাভ। শুধু জানে ইংরেজ বাবুরা এই বাঁধ বানিয়েছিল। বানের জল আটকানো র জন্য। চাচা মনে মনে হাসে। সে জানে দু তিন বার বাঁধ ভেঙ্গেছে। বাঁধ দক্ষিণে সরে সরে গেছে। নদী খেয়ে নিয়েছে কত জমি।
সাতকাহনিয়া র শিমূল তলার ভাঙা বাঁধ ; কালীবাবুর ভাঙ্গা বাঁধ ; যজ্ঞ ডুমুর তলার ভাঙ্গা বাঁধ কতবার যে বাঁধ ভাঙ্গল আর কত কত জমি চলে গেল নদীর গর্ভে। বাঁধ যাতে না ভাঙ্গে সে চেষ্টা যে হয়নি তা নয়। খুঁটি পুঁতে ; পাথর ফেলে ; পাথর দিয়ে বাঁধিয়ে চেষ্টা হয়েছে। নদী সরে এসেছে অনেকটা। এদিকে। বর্ধমানের দিকে। ওপারে বিরাট চরা পড়ে গেছে। চাচা ভাবে আবার যদি তেমন বান আসে তবে আবার বাঁধ ভাঙ্গবে।
আর বাঁধ ভাঙ্গলেই বাবু আর কন্ট্রাক্টর দের লাভ। নদীর জল বাড়ল কি ; কনট্রাকটর দের আনাগোনা। রাতে ফিস্টি।
কখন ভাঙ্গে ;কখন ভাঙ্গে -
চাচা লেখাপড়া জানা লোক নয়। কিন্তু বাবু যদি জিজ্ঞেস করে কি মোতি কাজ কেমন হচ্ছে সে ঠিকঠাক বলে দেবে। জিভে তার ধার আছে। তাই অনেকে কিছুটা সমীহ করে।
সাতকাহনিয়া সেচ বিভাগের খালাসি মোতিচাচা। এরা নিজের কাজকে ভালো বেসে কাজ করত। শুধু চাকরি করা নয়। এসব মানুষ কমেই এলো। এদের কে মনে রাখার কোন দায় আমাদের নাই। এদের কে ভুলেছি ; উপেক্ষা করেছি আর তাই আজ এই দশা।
একদিন সরকারি নিয়মে মোতিচাচার চাকরি থেকে বিদায় হয়ে গেল। আর আমি ডাকবাংলো যাবনা। বাঁধে যাবনা। একমাস চাচা ঘর থেকে বেরোয় ও না। কারো সাথে কথাও বলেনা।
তারপর একদিন বাঁধ ধারের লোকরা অবাক হয়ে দেখল আবার চাচা চলেছে তার সাইকেলে চেপে। পার হয়ে যাচ্ছে বাগুড়া ; জয়রামপুর ; মঙ্গলপুর;কাপালিপাড়া ;আকুলিয়া ; দেকুড়ি ;নপাড়া ;গোপালপুর ;মালিয়াড়া ;মালচা ;সাগরপুতুল।
প্রতিদিন সকালবেলা বেরিয়ে ফেরা সেই দুপুর পার করে।
একদিন দেখি বাগুড়ার মোটা শিমূল টার গায়ে ঠেস দিয়ে বসে আছে।
দাঁড়ালাম। বললাম ' বসে আছো। উদাস চাউনি। ' ঘর যাও ' -
- হ্যাঁ যাই। যাব। ঘরে যেয়ে আর কি করব বাবা -
আমি বুঝি। ঘরে তো কেউ নাই। নিজের বলতে কেউ।
দুটো মেয়ে। কখনও কেমনো আসে। ঐ মেয়ে দের ছোট রেখে তাদের মা মরেছে।
বাউড়ী ঘরের এক মহিলা দুটো রেঁধে বেড়ে দেয়।
চাচা জানে সে নিয়ে গাঁ ঘরে কথা রটে। রটুক।
আর আছে ছাগল গুলো। ওগুলো কে খুব ভালো বাসে।সব আলাদা আলাদা নাম আছে। ডাক দিলেই সাড়া দেয়।
আর ঘরের দুয়োরে বসে থাকে এক পাল সাদা ; কালো ; মেটে রঙের কুকুর। দু টি ভাতের আশায়। পরম বিশ্বাসে।
যেদিন মারা গেল সেদিন ও ওরাই চারপাশে।
----------- ----------- ----------- ----------- ----------- © প্রণব ভট্টাচার্য।
No comments:
Post a Comment