Friday, 10 June 2022

সাতকাহনিয়া গ্রামের দশহরা উৎসব

।। সাতকাহনিয়া গ্রামের দশহরা উৎসব।। 

 নীলবাড়ির মাঠ আর কলাবাগানের ঘাট। 
 নদী স্নানে দেবী যান  অজয়ে। 
দেয়াশী রা বা যদি কারও মানসিক থাকে 
 তাঁরাই কোলে করে নিয়ে যান বিমূর্ত 
 চেহারার  দুই দেবী মূর্তি কে। নদী থেকেই 
 তাঁদের পাওয়া গিয়েছিল। সে অনেক দিন আগের কথা। 
 পিছনে ছাতা ধরে থাকেন একজন। চামর; ধূপ ;ধুনো। ঢাক ; ঢোল বাদ্যি। 
 সামনে বাজনদার এর দল। 
 পিছনে মানুষের ঢল। 
 সেবাইত অযোধ্যা গ্রামের ধীবর রা। 
 একদিন এই গ্রামেরই  বাসিন্দা ছিলেন তাঁরা। 
 নানা গ্রামে ছড়িয়ে থাকা তাঁদের আত্মীয়রা
 আসেন এই উৎসবে। শ্রীচন্দ্রপুর ; ইলামবাজার থেকে। 
 আসেন ডাঙ্গাল গ্রামের গঁড়াই রা। 
 একদিন তাঁরা এই গ্রামের মানুষ ছিলেন। 
 আদুরিয়ার  এক মণ্ডল পরিবার। 
 আরও অনেক অনেক গাঁয়ের মানুষ। 
 অনেকের মানসিক থাকে। পাঁঠা নিয়ে আসেন।
 অনেক বলি হয়। 
 আমাদের ছোট বেলায় দেখেছি হালদার বাবুদের 
 বাড়ি থেকে বড় গামলা ভর্তি চিঁড়ে ভোগের আয়োজন করা হত। 
  নীল বাড়ির মাঠে " ষোট " খেলা খুব জমে উঠত। 
  " ষোট " একধরনের কাবাডির মতো ই। 
 নরম ; চষা মাটিতে খেলার মাঠ। 
  পুরনো দিনের সেই মানুষ গুলো কে খুব  মনে পড়ে। 
  বটূ কোঁড়া ; দুলাল কোঁড়া ; ষষ্ঠী বাউরি ; গুডু মাল 
  ভক্তি কোঁড়া ; চণ্ডী বাউরী ; 
  এই রকম সব কত নামের মানুষ। 
  আর পেটে তালতাড়ি তো পড়তই। 
  চারদিকে লোক দাঁড়িয়ে " অব্বো অব্বো " মানে 
 মুখে শব্দ করে বাহবা দেওয়া - দিত। 
 খেলা আর শেষ হতে চাইতনা। যত জমে তত বাহবা। 
 চিঁড়ে ভোগ খেয়ে নদী চান শেষ করে তারপর ফেরা। 
  ফিরতে ফিরতে বেলা ঘুরে বিকেল। 
গাঁয়ের মাঝে প্রাচীন   বাবাজী বটতলা।  
অনেক নাম তার।  ডালিপুজোর বটতলা 
 দাঁড়ি পুজোর বটতলা। পশ্চিম দিকে ছিল গন্ধেশ্বরী থান। দু থাকের বেদী। 
 তাম্বুলী সমাজের দাঁড়িপাল্লা পুজো। ডালিতে করে 
প্রসাদের ফলমূল ; নৈবেদ্য আনত তাম্বুলী সমাজের
 ব্যবসায়ী রা। এ পুজো হত অবশ্য অঘ্রান মাসে। 
 বটতলা ঘিরে অনেক টা ফাঁকা জায়গা। 
 সেই বটতলার পাশেই মনসা মন্দির। ছিল ছোটখাটো  মাটির একটা ঘর। 
  পরে একটা ছোট্ট  দালান । তারপর পালি ভাগাভাগি। 
 হল আর একটা দালান মন্দির। আর এক তরফের। 
 পাশে এক ঝাঁকড়া পলাশ। ঘৃতকুমারী ; 
  বাঁশ ; আতা র ঝোঁপ আর কয়েকটা তাল গাছ। 
 সামনে কাঠের খুঁটির উপরে এক আটচালা। নীচেটা পরে 
 সিমেন্ট বাঁধানো হয়েছিল। তার সামনে যূপকাষ্ঠ। 
 সেই আটচালাতে মনসামঙ্গল গান হয়। বেহুলা লখীন্দরের পালা। 
 আগের দিন রাত থেকে গান আরম্ভ হয়। 
 দ্বিজ বংশীদাস ; কেতকা দাস ক্ষেমানন্দ এর পদ।

 গাইতেন ডাঙ্গাল গ্রামের দাস বৈরাগীর  দল। 
 একটি ই মিষ্টি র দোকান বরাবর বসে। 
 এক দুটি মনোহারী দোকান। 
চৌকিদার  কুমারিশ ডোম।  বানফোঁড়ার ওস্তাদ। 
 সে আসত। আর আসত অযোধ্যা বাগদি পাড়ার      এক দু জন ওস্তাদ । একদল যুবক ছেলে  বান ফুঁড়ত। 
 নদী ধারেই বাণ ফোঁড়া হত। সেখান থেকেই নাচতে নাচতে 
 গ্রামে ফেরা। সাথে মানুষের দল। থানের সামনে এসে অনেক ক্ষণ 
 চলত বাণ ফোঁড়া দের নাচ। বাতাসা ছড়ানো। সাথে ঢাক ঢোল তো আছেই। গাঁয়ের মুসলিম পাড়ার মেয়ে বৌ রাও আসত মেলা দেখতে। পুরুষ রা তো আসেই। উৎসব তো সকলের ই। 
 শেষ ই হতে চায়না। আরও। আরও। 
 তারপর ছাগ বলি র পর্ব। 
 যেবারে বেশী থাকে সেবারে দেরি হয়। 
 ছাগ বলি শেষ হলে মোটামুটি শেষ হয়ে আসে। 
 তারপর আবার সব ঘরে ফেরা। সন্ধ্যা নামব নামব। 
 গাঁয়ের লোকেরা কিছুসময় বটতলায় থাকে। কিছু কেনাকাটা করে। ছোট্ট গাঁয়ের একদিনের উৎসব। ঘরে ঘরে কুটুম জন থাকে। রাত টা আনন্দে ই কাটে। ভাত মুড়ি তালতাড়ি ;আর কচু কুমড়ো র তরকারি। অল্প মাছও জোটে কারও কারও। বা প্রসাদী মাংসের টুকরো। হালদার বাবুদের বাড়িতে ছোট খাটো 
 ভোজ। বলির গোটা  পাঁঠার মাংস ; খিচুড়ি ; তরকারি। হয়তো নেমতন্ন হবে। 

 এই দশহরা পরব টা এলেই আমার ছেলে বেলার
 কথাই মনে পড়ে। 
 নদী ধারে গিয়ে পশ্চিম দিকে তাকিয়ে থাকতাম। 
 মাতামা অন্নপূর্ণা মাসীমা রা দশহরা কবে পাঁজিতে দেখত। 
 পাঁজি টা তে আমার খুব আগ্রহ। কত রকমের ছবি থাকে। 
 দশহরা র ছবিতে দেখতাম  হাঙর এর উপরে এক সুন্দরী চেপে জলে ভেসে আসছেন। মাতামা বলত  মকর বাহিনী গঙ্গা। 
 নদী তে অল্প জল বাড়ত। মাটি গোলা ঘোলা জল। জলে নামতে ভয় লাগত। পশ্চিম দিকে তাকিয়ে থাকতাম। নদীটা তো ঐদিক থেকে আসছে। আমার মনে হত ঠিক ঐ রকমের 
 মকরের পিঠে চেপে সুন্দরী জলদেবী ভেসে আসবেন। 
 তারপর একটু বড় হলে বুঝলাম  না আসবেনা। কখনও আসেনি। জলে নামতে আর  ভয় পেতামনা। একবার চিৎ সাঁতার দিয়ে জলের টানে নীচে দিকে অনেক দূর  গিয়েছিলাম চলে। 
 তিন চার জন মিলে। তারা আজ আর কেউ নেই। 
 আমিও আর যাই না। 
 কতদিন যে যাই নি। 
------------  ------------ ------------ ------------ ------------ 

আমি সেই পুরনো দিনের কথা বললাম। এখনকার নয়। 
 এখন গরীব ঘরের যুব ছেলে দের খুব উৎসাহ। উৎসাহ নিয়ে 
 পরব টা কে জমাবার চেষ্টা করছে। বেশ কিছু দোকান বসাচ্ছে। বাইরের শিল্পী এনে বাউল সহ আধুনিক গানের 
 ফাংশান হবে। গ্রামের গরীব ঘরের ছেলেরা বালির ট্রাক থেকে 
 টাকা কালেকশান করে বিরাট মন্দির বানাচ্ছে। 
 খুব উৎসাহ তাদের। তাদের কথা পরে বলব। 
  ------------ ------------ ------------ ------------ দশহরা। ১৪২৯ সন। বৃহস্পতিবার।

No comments:

Post a Comment