Friday, 10 June 2022

কবিবর জয়দেব গোস্বামী। রাধাবিনোদ মন্দির


।। কবিবর জয়দেব গোস্বামী ঃ কেন্দুবিল্ল্ব এবং রাধাবিনোদ মন্দির।।  প্রণব ভট্টাচার্য
পশ্চিম হইতে পূর্বে প্রবাহিত প্রাচীণা ' অজাবতী "। অজয় এর প্রাচীন নাম। পূর্ব বাহিনী তাই পৌরাণিক মতে সে নদী। আবার
উপনদী গ্রহণ করে ভূগোল বিজ্ঞান অনুযায়ী সে নদ।
এই অজয়ের উত্তর পারে তাল ; তমাল ; বট ; অশ্বত্থ ; কেন্দু ;
শ্রীফলের ছায়া সুশীতল এক অতি ক্ষুদ্র পল্লী তে ; ব্রাহ্মন ভোজদেব মাতা বামাদেবীর কুটীরে ; পৌষের কৃষ্ণা চতুর্দশী তিথিতে আনুমানিক ১১২৩  সাধারণ অব্দে জয়দেবের জন্ম।
সেখ শুভোদয়ার ' বিবরণ থেকে জানা যায় রাজা লক্ষ্মণ সেন
কবি জয়দেবের চেয়ে চার বৎসরের বড়ো ছিলেন। রাজা লক্ষ্মণ সেনের জন্মবর্ষ ১১১৯ সাধারণ অব্দ থেকে রাজা বল্লালসেন ' লক্ষণাব্দ ' চালু করেন। সেই হিসাবে জয়দেবের জন্মবর্ষ হয় ১১২৩ সা অব্দ।
জয়দেব ছিলেন রাজা লক্ষ্মণ সেনের প্রিয় বন্ধু ; এবং সভাসদ।
" গোবর্দ্ধনশ্চ শরণো জয়দেব উমাপতি ;
  কবিরাজশ্চ রত্নানি পঞ্চৈতে লক্ষণস্য চ্ "
কবিবর দেহরক্ষা করেছিলেন ১১৭৩ সম্বতে বা ১২২৮ সা অব্দে। সেই হিসাব অনুযায়ী ১০৫ বৎসর তাঁর জীবনকাল।
মৃত্যু তিথি বলা হয়েছে " শুক্লাষ্টমী পৌষী উত্তরায়ণ সংক্রমে "
কবি জয়দেব ছিলেন বৃন্দাবনের নিম্বার্ক আশ্রম শ্রী শ্রী টাট্টিস্থান আশ্রমের ৪৬ তম আচার্য।
কেন্দুবিল্ব ঃ  কেন্দুবিল্ব বা কেঁদুলী। কেন্দু আর বিল্ববৃক্ষ
আচ্ছাদিত সামান্য এক পল্লী। নদী ধারে বট পাকুরের মেলা।
পাশেই বিখ্যাত কদম্বখণ্ডী মহা শ্মশান।
জয়দেবের সময় কেন্দুবিল্ব পূর্ব দিকে মন্দিরা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। মন্দির ময় মন্দিরা। ছিল একদিন। আজ সকলি ধ্বংস স্তুপ। মৌজার নাম কবির পুর। পাশেই বালারপুর গ্রাম।
গ্রামনামে রাজা বল্লালসেনের স্মৃতি।
কবি জয়দেবের পূজিত শ্রী শ্রী  রাধামাধবের মূল মন্দির কবেই
অজয়ের বন্যার আঘাতে ধ্বংস প্রাপ্ত। শোনা যায় সেই পাথরের মন্দির নির্মান করিয়েছিলেন রাজা লক্ষ্মণ সেন।
সে মন্দির ছিল সম্ভবত মন্দিরা তেই। দু টি প্রস্তর খণ্ড রক্ষিত
আছে পুরাতন সেই স্মৃতি চিহ্ন হিসাবে।
এই মন্দিরা তেই বাস করতেন কবি জয়দেব তাঁর স্ত্রী তথা সাধন  সঙ্গিনী পদ্মাবতী র সাথে।
উভয়েই ছিলেন নৃত্য ; গীত ; বাদ্য ; সুর তাল লয় ছন্দের
অসামান্য গুণী মানুষ।


গীতগোবিন্দম্ ঃ " গীতগোবিন্দ রচয়িতা কবি জয়দেব সংস্কৃত সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি এবং সংস্কৃত ভাষায়
সর্বাপেক্ষা মধুর গীতি কবিতার কবি বলিয়া সর্ব্ববাদীসম্মত
ক্রমে সম্মানিত হইয়া আছেন। "  - ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়।
" স্মরগরল খণ্ডনং মম শিরসি মণ্ডনং -
    ' দেহী পদপল্লব মুদারম "
  ভক্ত জন পরম ভক্তি তে বিশ্বাস করেন " দেহী পদপল্লব মুদারম " এই পাদপূরণ স্বয়ং ভগবান ই জয়দেবের রূপ ধরে
করেছিলেন। তেমন কাহিনী ই সুপ্রচারিত।
অনেকে গীতগোবিন্দে আদিরসের সন্ধান করেন। কিন্তু ডক্টর
সেন যথার্থই বলেছেন " জয়দেবের কাব্যে শ্লীলতা র গণ্ডী সাবধানে রক্ষিত হইয়াছে "।" বস্তুতঃ ভারতীয় ভক্তিমার্গের দৃষ্টি তে গীতগোবিন্দ কে চরম আদিরসাত্মক কাব্য বলে গ্রহণ করা হয়নি " - বলেছেন ডক্টর সুধীর কুমার করণ।

আজও অনেকের বিশ্বাস পৌষ সংক্রান্তি র ভোরে মা গঙ্গা উজান বেয়ে কেন্দুবিল্বের ঘাট পর্যন্ত আসেন। তাঁর ভক্ত জয়দেবের মনোবাঞ্চা পূরণের জন্য। তাই পুণ্যস্নানের জন্য
লক্ষ নরনারীর ভীড় জমে।

কেন্দুলী র মেলা ঃ  এ এক প্রাচীন মেলা। কবে থেকে শুরু তা বলা কিছুতেই সম্ভব নয়। গ্রামীণ স্নানের মেলা। অনাড়ম্বর ভাবেই একদিন শুরু হয়েছে।
গোপাল হালদার মশাই বলেছেন " কেন্দুলী তে জয়দেবের মেলা পৃথিবীর প্রাচীণতম মেলা - জনতার কবিপূজা জয়ন্তী উৎসব "
মকর সংক্রান্তি তে কেন্দুলীর মেলায় মোহান্ত দের ৪৬ তম কুলগুরু জয়দেবের তিরোধান দিবস হিসাবে পালন করে আসছেন নিম্বার্ক আশ্রমের মোহান্ত গন আশ্রমের প্রতিষ্ঠা কাল
থেকেই। নদী চর থেকে এই মেলাকে ভূখণ্ডে তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন এই মোহান্ত রাই।
জয়দেব কেন্দুলী র নিম্বার্ক আশ্রম ঃ " শ্রী ধাম বৃন্দাবন হইতে আগত স্বর্গীয় রাধারমণ গোস্বামী কেন্দুবিল্ব গদির প্রতিষ্ঠাতা।
- ডক্টর হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় এর অভিমত।
রাধারমণ গোস্বামী নিশ্চিত ভাবেই জেনেছিলেন যে এই কেন্দুলী ই কুলগুরু কবি জয়দেবের জন্মগ্রাম। তাই তিনি
এখানেই আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন।
কেন্দুলী নিয়ে উড়িষ্যা র দাবী নানা ভাবে ই খণ্ডিত হয়ে গেছে।
তাই সে প্রসঙ্গে প্রবেশের দরকার নেই।

বাউলদের মেলা ঃ সাধারণ মানুষের মেলা।  বৈষ্ণব দের মেলা। আবার বাউল দের ও মেলা।
অনেকে বলেন এই মেলা হল " বাউলদের বাৎসরিক উৎসব "
ডঃ অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন " খ্রীষ্টীয় অষ্টাদশ শতকে শ্রী নিত্যানন্দের পুত্র বীরভদ্র সহজিয়া দের বৈষ্ণব ধর্মের মধ্যে নিয়ে আসেন। তাঁরা তখন বৈষ্ণব সহজিয়া সম্প্রদায়। আর তাঁদের থেকেই এসেছেন বাউলেরা। "
শুধু মাত্র বাউলেরা নয়। আউল ; বাউল ; বৈষ্ণব ; নেড়ানেড়ি ; সতুয়া ; সাঁই ; দরবেশ ; ফকির - নানা ধরনের সম্প্রদায়ের
মানুষ এই মেলায় আসেন। এখন শিখ ধর্মের মানুষেরাও মেলায় মহোৎসব এর আয়োজন করেন।
আসলে জয়দেব সকলের। সব সম্প্রদায়ের। তিনি নাথ যোগী ;
কায়া সাধক ; পঞ্চোপাসক ; যোগী ; সহজ সাধক।
তিনি বুদ্ধ কে দশাবতারের মধ্যে স্থান দিয়েছেন। আবার গুরু গ্রন্থ সাহিবে ও তাঁর পদ রয়েছে। স্বাভাবিক ভাবে শিখরাও
তাঁকে পরম ভক্তি প্রদর্শন করেন।
ডক্টর সুকুমার সেনের মতে তিনি  " আধুনিক আর্যভাষার আদিকবি "
তিনি " পদ্মাবতী - চরণ - চারণ - চক্রবর্তী  "
তিনি " কেন্দুবিল্ব সম্ভব রোহিনী রমণ '
তিনি আমাদের প্রাণের ধন।
রাধাবিনোদ মন্দির ঃ  বিখ্যাত  টেরাকোটা শোভিত এই বিশাল মন্দিরটি র সম্পর্কে বীরভূম জেলা গেজেটিয়ারে
বলা হয়েছে " according to an inscription on a tablet
was built by the mother of Maharaja Kirti Chand Bahadur of Burdwan and dedicated to the god in Sakabda 1605.
বর্ধমানের মহারাজা কীর্তিচাঁদ বাহাদুরের জননী ভক্তিমতী
ব্রজকিশোরী দেবীর দ্বারা এই মন্দির নির্মিত।
অনবদ্য এর টেরাকোটা র কাজ। মূলত পৌরাণিক কাহিনী র
চিত্ররূপ কে অপরিসীম কুশলতায় শিল্পী রা নির্মান করেছেন।
এখন আর সম্মুখ ভাগেই টেরাকোটা র কাজ দেখা যায়।
রাম রাবণের যুদ্ধ কাহিনী ছাড়া ও বেশ কিছু সামাজিক চিত্রণ
উল্লেখযোগ্য। মন্দির দেওয়ালের কোনের মৃত্যুলতা বা বর্শা
বেশ পৃথক ধরনের। খুব দ্রুত ক্ষয় প্রাপ্ত হচ্ছে এই সব অলংকরণ। মন্দির দেওয়াল গাত্রের উত্তর ; পূর্ব ; পশ্চিমে র
দিকে নূতন করে প্লাষ্টার করা হয়েছে।
এই মন্দিরের প্রবেশ পথে প্রাচীন মন্দিরের শিলাখণ্ড চৌকাঠ হিসাবে রক্ষিত আছে।
মন্দির টি ভারতীয় পুরাতত্ব বিভাগ কর্তৃক সংরক্ষিত।
ও ম্যালির জেলা গেজেটিয়ার অনুযায়ী " The body of Jayadeva was buried and not burnt after his death ;
and his tomb is still to be seen at kenduli ; surrounded by beautiful groves and trees "
আজকের জয়দেব কেন্দুলী ঃ সার্ভেয়ার জেনারেল রেণেল সাহেবের ১৭৭৯ সালের ম্যাপে কেন্দুলী র উল্লেখ নাই।
পার্শ্ববর্তী ব্যবসা বাণিজ্য কেন্দ্র কোটা শীর্ষা ; জনুবাজার এর
উল্লেখ রয়েছে। কেন্দুলী বা তাকে ঘিরে ছোট ছোট কয়েকটি
পাড়া ; বা গ্রাম নিয়ে ১৯০১ সালের জনসংখ্যা মাত্র ৭৭১।
আজকের জয়দেব কেন্দুলী কিন্তু আকারে প্রকারে অনেক
বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন এক জমাট গঞ্জ। অজয়ের ওপারে সেনপাহাড়ী পরগনার বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষ বাজার করার
জন্য এখানে আসেন। অজয়ের উপরে অস্থায়ী পারাপার ব্যবস্থা করা হয়। কয়েক বৎসরের মধ্যে পাকা সেতু নির্মিত হবে। তার কাজ চলছে।
ওপারে সেনপাহাড়ী ঃ অজয়ের দক্ষিণ তীরে সেনপাহাড়ী জঙ্গল ভূমি। সেন রাজাদের পূর্ব পুরুষ দের আদি বাসভূমি।
ডক্টর সুকুমার সেনের মতে তাই নাম ' সেনপাহাড়ী "।
এই স্থান সেন রাজাদের পূর্ব পরিচিত। পাল রাজাদের আমলে র  সীমান্ত রক্ষার জন্য এখানে যে গড় ছিল - যা পরবর্তী সময়ে
দুর্দমনীয় ইছাইঘোষ এর দখলে যায় এবং পরবর্তী কালে
সেই গড় সেন রাজাদের অধীনস্থ হয়
এই ঘন ঘোর জঙ্গল ভূমিতে তখন অনেকে তন্ত্র সাধনা করেন।
কায়া সাধন বা নারী কে  সঙ্গিনী করে দেহ সাধনা। ' দেহভাণ্ড ই ব্রহ্মাণ্ড "। দেহসুখের মাধ্যমে চিত্তসুখের সন্ধান "।
দীর্ঘ জীবনের আশায় রাজা বল্লালসেন ও এখানে আসতেন।
নিম্নবর্গের নারী পদ্মিনী র সাথে সংসর্গের জন্য পিতা পুত্রের
মনোমালিন্য ঘটে। তখন রাজা লক্ষ্মণ সেন বেশ কিছু দিন
এখানে এই গড়ে এসে অবস্থান করেছেন। সম্ভবত এখানেই
রাজা লক্ষ্মণ সেনের সাথে কবিবর জয়দেব এর সাক্ষাৎ হয়।
জয়দেবের কবিত্বে সুপণ্ডিত রাজা লক্ষ্মণ সেন মুগ্ধ হন।
তিনি গীতগোবিন্দমের সুললিত পদ শুনে মোহিত হন।
তাঁকে রাজধানীতে আমন্ত্রণ জানান। এবং তাঁর রাজসভার
কবি হিসাবে মনোনীত করেন।
     " যদি হরিস্মরণে সরসং মনো
      যদি বিলাসকলাসু কুতুহলম
      মধুরকোমলকান্তপদাবলীং
      শৃণু তথা জয়দেবসরস্বতীম্
----------------- ------------ ------------ ------------ ------------ সমাপ্ত।
চিত্রঋন। সত্যশ্রী উকিল। 












 

No comments:

Post a Comment