।। কথা - সাতকাহন।। ২৭ অধ্যায়
একটা সম্পর্ক। ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে।
সহজেই কি তাকে মুছে ফেলা যায়!
হয়তো পুরোপুরি মুছে ফেলা যায়না। কিছু দাগ থেকে যায় ই।
বোলপুর বা ইলামবাজার কে সে ভুলতে পারেনা। অনেক স্মৃতি
জড়িয়ে আছে। অনেক কথা বাকী থেকে যাবে।
বোলপুরের পাক দেওয়া সিঁড়ি ওঠে দোতালার ঘরে বসে কত
রাজনৈতিক আলোচনা। তাত্ত্বিক তর্ক বিতর্ক।
একদিন মাষ্টার মশাই আছেন। আরও নেতারা আছেন।
হরশঙ্কর বাবু আছেন। তিনি তখন বোলপুর এর বিধায়ক।
পণ্ডিত মানুষ। আমাদের এত সহজ ভাবে মার্ক্সীয় অর্থনীতি ;
সমাজ নীতি বোঝাতেন। ঐ মেঝের পাতা চাটাই এর উপরে বসেই। আমরা ছাত্র। তাঁর পাঠ্যপুস্তক অনেকেই পড়েছেন।
একদিন আমিই মৃদু গলায় প্রশ্ন তুলেছিলাম একটা কমিউনিস্ট পার্টির কি কংগ্রেস এর মত দলের সাথে হাত মিলিয়ে চলা উচিৎ! উত্তর প্রত্যাশিত। দেশে দক্ষিণ পন্থী দের
প্রভাব থেকে দেশ কে বাঁচাতে হবে। তারা দ্রুত উঠে আসছে।
কংগ্রেসের ভিতরে তারা যেমন রয়েছে যাদের সাথে দক্ষিণ পন্থী দের ভালো সম্পর্ক। আবার বিপরীতে একটা প্রগতিশীল
গণতান্ত্রিক অংশ রয়েছে। এরা নেহেরু র সমাজতান্ত্রিক মডেলে বিশ্বাসী। এই অংশের সাথে কমিউনিস্ট দের সম্পর্ক রাখতে হবে। কৌশল গত কারনে ই।
'৭০ এর শেষ দিক থেকে এখানে আসা। বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধ এর সেই অসম লড়াই ; মুক্তিযোদ্ধা দের প্রাণ বলিদান
এখান থেকে বসে বসে শুনেছে। শুনে উদ্বেলিত হয়েছে - দেবদুলালের সংবাদ পরিবেশন বা ভাষ্যপাঠ কে। তিনি তাঁর
ঐ দুর্লভ কণ্ঠস্বরে একে এক অন্য মাত্রা দিয়েছিলেন।
পাক বাহিনীর নির্মম পাশবিক অতাচার ; গণহত্যা। তার বিরুদ্ধে এক জাতির মরণপন লড়াই। যার শুরু ভাষা আন্দোলন দিয়ে। বাঙ্গালী জাতির জন্য গর্ব হয়।
মনে প্রশ্ন জাগে শুধু নয় ঘৃণা হয়। আমেরিকা বা চীনের পাকিস্তান কে সমর্থন
প্রশ্নে। ভারতীয় সেনা বাহিনী ঢুকেছে পাকিস্তান আর্মি র সাথে লড়াই এ। মন সমর্থন করেছে। ইন্দিরা গান্ধী র প্রতি শ্রদ্ধা জেগেছে। ভারতের স্বাভাবিক বন্ধু সোভিয়েত রাশিয়ার নৌ বহর এগিয়ে আসছে। খুশী হয়েছে দু পারের মানুষ।
স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে। কি আনন্দ। কি আনন্দ আমাদের মতো ছেলেদের মনে।
' বাঙ্গালী ' এই বোধ আমার ভিতরে ছোট থেকেই কাজ করে।
বাংলাদেশ একবার গেছি। বাংলা ভাষায় চারদিক ভরা।
কি যে আনন্দ হয়। সে তো অন্যকে বোঝানো যাবেনা।
তেপান্তর নাট্য গ্রামে বাংলাদেশের এক নাটকের দল এসেছিল একবার। পাশাপাশি বসে গল্প করছি আমরা। খাবার সময় এলো। এক ভদ্রলোক পকেট থেকে সুগারের ওষুধ বের করলেন।
ওষুধের গায়ে বাংলায় লেখা গ্লিবিজাইড। মেটফরমিন।
বাংলা য় লেখা দেখে কি আনন্দ যে হল।
কোন ব্র্যাণ্ড নাম নেই। আমি ও সুগারের রোগী। দীর্ঘ দিন ওষুধ খাই। আমি জিজ্ঞেস করলাম একটু পুরনো দিনের মানে এখন তো অনেক নতুন ওষুধ। নতুন জেনারেশন। এই ওষুধ নিচ্ছেন।
বললেন স্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে ই বিনামূল্যে পাওয়া যায়। কম দামের ওষুধে ই যদি কাজ হয়। বুঝতেই পারছেন গরীব দেশ।
আর এদেশে লক্ষ লক্ষ ব্র্যাণ্ড। কোটি কোটি টাকা নিয়ে যায়।
এমন এত বড় বিশাল উন্মুক্ত ' লুঠ ক্ষেত্র '।
বোলপুরের ঐ পার্টি অফিস থেকে শিখেছি অনেক। রাজনৈতিক সচেতনতা বেড়েছে। মনীষা গ্রন্থালয় থেকে অনেক পেয়েছি। হীরেন্দ্র নাথ মুখোপাধ্যায় ;
পণ্ডিত ; আমি মনে করি কমিউনিস্ট আন্দোলনে এমন পণ্ডিত আর এসেছেন কি না! তাঁর 'তরী হতে তীর ' পড়ে মুগ্ধ হয়েছি।
রাহুল সাংকৃত্যায়ন পড়েছি আর অবাক হয়েছি এই জীবন
পথিকের জীবন দর্শনে। আর যত মৌল পাঠক্রম। রাশিয়ান শিল্পী দের আঁকা ছবি র বই আমার শিল্প চেতনা কে সমৃদ্ধ করেছে।
এই অফিসে বসেই যতদুর মনে পড়ে মুজিব হত্যার ঘটনাও
শুনেছি।
জরুরী অবস্থা ঘোষিত হয়েছে। মানতে পারছিনা। তর্ক হচ্ছে।
এই অফিসে বসে ই নেতাদের সাথে। না কোন কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষে এটা মানা অসম্ভব বলে মনে হয়েছে। নানা প্রশ্ন।
জয়প্রকাশ আসছেন। বিরোধিতা করা হচ্ছে। ব্যঙ্গ চিত্র আঁকতে হচ্ছে। স্টেশন এর একটা দেওয়ালে। আঁকছি। মনে কিন্তু নিয়ে ই আঁকছি।
গোপাল দার হোটেলে খেয়ে কিছু এলেমেলো ঘোরাঘুরি করে
আমাদের কয়েক জনের সারা রাত আলোচনা। আমি ই আলোচক। আমরা ছেলেরাই থাকি। ছোট্ট ঘর।
আজ আর কার কাকে মনে আছি জানি না। তবে সবাই ভুলে যাননি। শেষ বার শান্তি নিকেতন পৌষ মেলায় ছোট্ট স্টল দেওয়া হয়েছে। সেই সব বই তো আর নাই।
- আসুন।
- কি চিনতে পারছেন আমাকে। অনেক দিনের ব্যবধান।
ইলামবাজার বলাতেই চিনলেন। ' আরে ভাই এসো। এসো '
স্বীকার করলেন অস্তিত্বের ই সংকট। বসলাম।
বাম গণতান্ত্রিক একত্রিত আন্দোলন ই পথ।
কেন যে সব লাল ঝাণ্ডা কর্মসূচি ভিত্তিক একত্রিত হতে পারেনা। রাষ্ট্রের শ্রেণী চরিত্র বিশ্লেষণের এত কচকচি।
না হয় শূন্য থেকে ই শুরু করতে হবে।
আর একবার ইলামবাজারে দুই জেলার যুক্ত সভা। বামফ্রন্টের। ইলামবাজারের সি পি আই এম নেতাদের সাথে আমার যথেষ্ট জানা চেনা বন্ধুত্ব। বর্ধমানের জেলা নেতারা আছেন। সভা শেষে একজায়গায় বসে গল্প হচ্ছে। বীরভূমের
সি পি আই এর জেলা সম্পাদক অপূর্ব মণ্ডল। একদিন একসাথে কাজ করেছি।কিন্তু অনেক দিনের অদেখা।
- কি অপূর্ব দা আমাকে চেনা যায়। আমি প্রণব।
- আরে ভাই। তোমাকে কি ভোলা যায়। কি ; কেমন আছো ইত্যাদি। যাঁরা আমার অতীত টা জানেন না তাঁরা কিছুটা অবাক।
এই যে। কোথাও একটা অতীত সম্পর্ক বেঁচে থাকে।
ক্রমাগত বৈষম্য বাড়ছে। আরও বাড়বে। পুঁজি র দাপট আরও বাড়বে। মানুষ নিষ্পেষিত হয়ে যাবে। এত এত শিক্ষিত বেকার। আগামী দিন আরও ভয়াবহ। মানুষ অসহায়। এত অসহায়তা বোধ হয় আগে কখনো দেখা যায়নি। নানা স্তরীয়
অর্থনৈতিক বৈষম্য। সামাজিক অর্থনৈতিক নানা স্তর এই সময় কালে সৃষ্টি হয়েছে। আমি কোন সমাজ বিজ্ঞানী বা বোদ্ধা কেউ নই। আমি শুধু যা দেখছি তা কোন এক পর্বে বলব।
মুক্তি বার্তা কিন্তু সেই লাল ঝাণ্ডা য়। কাস্তে হাতুড়ি তেই।
যুবক যুবতী রাই ভবিষ্যৎ। সামনে তোমাদের অনেক অনেক অনেক বড় লড়াই।গণতান্ত্রিক পথেই সে লড়াই পরিচালনা করতে হবে।
রাষ্ট্র শক্তি র বিরুদ্ধে অনিবার্য লড়াই। আমি জানিনা তার রূপ কেমন হবে।
পৃথিবীর সব রাষ্ট্রশক্তি বা তাদের প্রধানের হাতেই ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। ছদ্ম স্বৈরাচারী। শাসকের বজ্রমুষ্ঠি ক্রমাগত শক্ত হচ্ছে। পৃথিবী যেন ক্রমাগত দক্ষিণে হাঁটছে। ভবিষ্যৎ বড়ই কণ্টকাকীর্ণ।
আজ রাষ্ট্র পরিচালনা য় সেই পুরনো দিন কবেই হারিয়ে গেছে। আজ বাণিজ্য নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা। অন্য কোন আদর্শ
সোভিয়েতের পরে নেই। ব্যতিক্রম কিউবা। তার মানবিক মুখ দেখা যায় ল্যাটিন আমেরিকার দেশ গুলিতে অন্তত স্বাস্থ্য পরিষেবার সাহায্য নিয়ে। সারা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ স্বাস্থ্য ব্যবস্থা তার।
এ সমাজ মানুষের ই রচনা। সাধারণ মানুষ আজ গৌণ।
তবু্ও মানুষ। মানুষের ভিতর থেকে প্রতিবাদী সত্তাকে শোষণ করে নেওয়া হচ্ছে প্রতিদিন।
মানুষ তবুও জাগবে। পথ ই পথ দেখাবে। প্রতিবাদী মানুষ
পথে নামবেই। ভবিষ্যতে লড়াই অনিবার্য।
----------- ----------- ----------- ----------- -----------
তবু একদিন সংযোগের সব সুতো ছিঁড়ে যায়।
খুব কষ্টে ই।
বীরভূমের স্থায়ী বাসিন্দা না হলে আমার কাজ কি মূল্য পাবে। ভাবি। আর কর্মসূচি ছাড়া কি সংগঠন বাঁচে।
অনেক কথাই মনে পড়ে। সিউড়ি অফিস ঘরটা। আমরা কয়েকজন সদ্য যুবক থাকতাম। লালচাঁদ ফুলমালী আসতেন।
তিনি তখন এম এল এ। এসেই অফিস বারান্দা সব ঝাঁট দিতে আরম্ভ করতেন। ডাঃ শরদীশ রায়ের উঁচু ধাপের চেম্বারের পাশ দিয়ে যেতাম। উনি থাকলে উঁকি দিতাম। ফাঁকা থাকলে দু'একটা কথা।
অন্য মনের মানুষ। সংকীর্ণতা ছিলনা।
মোরব্বা মিষ্টান্ন ভাণ্ডার এর আদি দোকানে আমাদের সকালের জলখাবার হত। খুব চেনা হয়ে গিয়েছিল বৃদ্ধ মানুষ টির সাথে। সেই বিশাল বিশাল তেঁতুল গাছ তলা হয়ে যে রাস্তা চলে গেছে নীচের দিকে। জেলখানার উঁচু প্রাচীর।
কোন কোন দিন বেড়াতে যেতাম ম্যাসাঞ্জোরের ব্যারেজের দিকে। কোন দিন করিধ্যা। বড় রসগোল্লা।
আবার কোনদিন তালতলা র ধার ধরে স্টেশনে র দিকে।
চুপচাপ স্টেশনে বসে বসে ভাবতাম। নির্জন স্টেশন আমার খুব ভালো লাগে। কি যেন ভাবতাম আমরা ; মনে আছে আর তোদের। কি জানি আমাকে ই আর মনে আছে কি না।
হাসিম ; সুনীল। আজ আর কারও মনে নেই কি যেন ভাবতাম।
----------- ----------- ----------- ----------- © প্রণব ভট্টাচার্য
নেট থেকে সংগৃহীত মার্কসের এই ভাস্কর্য। বাণিজ্যিক ব্যবহার নিষিদ্ধ