Sunday, 12 December 2021

জয়দেব কেন্দুলী ভক্তি ভবন।

।।  জয়দেব - কেন্দুলী। 
 ভক্তি ভবন। এই এলাকার সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। 
  বামফ্রন্ট সরকারের মাননীয় মন্ত্রী প্র‍য়াত ভক্তি ভূষণ মণ্ডলের
  নামাঙ্কিত এই ভবন। 
  সারা বছর ধরেই নানা বিধ অনুষ্ঠানে মুখরিত থাকে এই কেন্দ্র। 
  বীরভূম আর বাউল গান হবে না। তা তো হয়না। বাউল গান তো আছেই। কেন্দুলীর বাউলরা অনেকে ই আমন্ত্রিত থাকেন। 
  আর এ মাটি " গীতগোবিন্দম্"  এর সাধক প্রেমিক কবি 
  জয়দেব এর জন্মস্থান। এর বাতাসে " দেহি পদ পল্লব মুদারম
     এর সুর ধ্বনি। 
  সামনে বয়ে যাচ্ছে অজয়। প্রাচীনা " অজাবতী "।
  ওপারে সেনপাহাড়ী পরগনা। বাংলার সেন রাজাদের আদি বাসভূমি । দেখা যাচ্ছে ইছাই ঘোষের স্মৃতি দেউল। আমাদের এক পা ওপারে আর এক পা যে এপারে। 
  আজ ভক্তি ভবনে বসেছিল " জয়দেব অঞ্চল সংস্কৃতি সেবা 
সমিতির  ৪৬ তম বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। 
  এত গুণী মানুষের সমাগম ঘটেছিল আজকের এই অনুষ্ঠানে। 
   বীরভূমএর  কবি সাহিত্যিক রা তো ছিলেন ই। ছিলেন বর্ধমানের অনেক বিশিষ্ট মানুষ। পুলিশ আধিকারিক। জেলা শাসক স্বল্প সময়ের জন্য হলেও এসেছিলেন। সকলের অনুরোধে কথার পর 
 " তুমি কেমন করে গান করহে গুণী - গেয়ে শোনালেন। 
 চমৎকার গলা বা গায়কী। 
 কে না ছিলেন কবি অরুন চক্রবর্তী যাঁকে ছাড়া জয়দেবের কোন অনুষ্ঠান হয়না। কবি মল্লিনাথ মুখোপাধ্যায় ;  তৈমুর খান ; অসিকার রহমান ; ফজলুল হক ; দেবকুমার দত্ত ; ডাঃ অরুনাভ সেনগুপ্ত ;  কবি শিল্পী নীলোৎপল দা ; সরোজ কর্মকার ; সন্তোষ কর্মকার ; মোল্লা কামাল 
  তারাপদ হাজরা  তরুন কবি নিজামুদ্দিন এবং 
 প্রবীর দাস  ; মানস বন্দ্যোপাধ্যায় ; সাধন ভট্টাচার্য ; চূণীলাল মুখোপাধ্যায় সহ অনেক পত্রিকা সম্পাদক। প্রবীণ নবীন 
অনেক কবি সাহিত্যিক।  ভর্তি সারা হলঘর। কবিরা তাঁদের কবিতা পড়লেন। 
  জয়দেব অঞ্চল সংস্কৃতি সেবা সমিতির পরিচালক রা তো ছিলেন ই। শান্তি দা ; রণজিৎ দা ; সুভাষ  কবিরাজ ; আনারুল হক ; উত্তম দা রা। শান্তি দা র  " গীতগোবিন্দম্ " এর গান ছাড়া 
 তো অনুষ্ঠান শুরুই হয়না। 
 এই মহতী অনুষ্ঠানে  চার জন আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চাকারী কে  সংবর্ধনা দেওয়া হল। এঁদের মধ্যে  শ্রী সিদ্ধেশ্বর মুখোপাধ্যায় এবং মহঃ আয়ুব হোসেন তো দুই প্রত্ন প্রদীপ। 
 স্বনাম খ্যাত। এঁদের সাথে আমাকে এবং  মইনুদ্দিন অশোক কে ও সংবর্ধিত করা হল। ঐ দুই বিশিষ্ট ইতিহাস চর্চাকারী র 
 সাথে আমাদের মতো মানুষ এর  একই মঞ্চ থেকে সংবর্ধিত হওয়া -  সে বড় শ্লাঘা র বিষয়। 
  সংবর্ধনা র শেষে কিছু কথা। সকলের কথার সুর প্রায় এক। 
  উদ্ধার করতে হবে আমাদের নিজেদের মাটির ইতিহাস। অজয় অববাহিকা সহ 
- রাঢ় মাটি র ইতিহাস। চিনতে হবে নিজের মাটি কে ; মানুষ কে  ; খুঁজতে হবে মানুষের ইতিহাস। পরবর্তী প্রজন্ম কে এই বার্তা পৌঁছে দিতে অনুরোধ জানালেন মহঃ আয়ুব হোসেন সাহেব। 

পুনঃ। অনেকে তাঁদের লেখা বই দিয়েছেন। সে গুলি বিশেষ প্রাপ্তি। 
 মনের মাধুকরী - নারায়ণ কর্মকার ; অবরুদ্ধ চেতনা  - পরিমল সাধু। আমার কলম - প্রদীপ মণ্ডল। হৃদয়তান্ত্রিক বর্ণমালা - বাপ্পাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায়। 
  পত্রিকা। ঋত্বিক ; প্রতিদ্বন্দ্বী ; কবিতার কলম। অবশেষ। কুনুর কথা। 
 আর সংস্থার পক্ষ থেকে জজন্মশতবর্ষের আলোকে ভক্তি ভূষণ মণ্ডল।  দাস রাধাময়ের গান। 
 উত্তরীয় ; পুষ্পস্তবক ছাড়া মন কাড়া মানপত্র টি। জয়দেব কেন্দুলী নিকট বর্তী টিকরবেতা র বিখ্যাত কাঁসা পিতল শিল্পের 
 কথা মাথায় রেখে কাঁসার থালায় উৎকীর্ণ মানপত্র। 
     প্রণাম এ মাটিকে। 
জয়দেব কেন্দুলী। তাং ৯/১১/২১।
উপস্থিত ছিলেন আগেই বলেছি অনেক বিশিষ্ট মানুষ। সকলের নাম এখানে উল্লেখ করতে না পারার জন্য আন্তরিক দুঃখিত।

অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো

।।  " অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো "।।
   
  কে তিনি?
যে কোন প্রতিমার সামনে দাঁড়ালে ; আমার মনে জাগে সে প্রশ্ন
  আমি প্রতিমার শিল্পিত রূপ দেখি। যার প্রতি আবাল্যের টান।
  তার রঙ ; রূপ ; দু চোখ ভরে দেখি।
  এঁর শিল্প ভাবনা!  এই যে রূপ আমি দেখছি - কে প্রথম সৃষ্টি করলেন ; কার ভাবনা তে এলো এই রূপ?  বিস্মিত হয়ে ভাবি।
  বড় হয়েছি আর ক্রমাগত ভেবে গেছি  কি ইতিহাস আছে
লুকিয়ে এঁর পিছনে। কাকে জিজ্ঞেস করব। না থাক নিজেই
খুঁজি। খুঁজে ফিরি। মাতৃমূর্তি ই আমার ভালোবাসা।
  বাঙালী মাতৃভক্ত জাতি। আমার বাঙালী সত্তা আমার ভাবনা কে বিস্তৃত করে।  ' মা বলিতে প্রাণ করে আনচান '। শৈশবে মা হারানো ছেলের কাছে  ' মা ' এক আকুল আবেগ।
  কালী মূর্তির সামনে দাঁড়াই। সেই একই প্রশ্ন জাগে ইনি কে!
এই ভয়ংকরী নারী। রক্ত লোলুপা। খড়্গধারিনী। নৃমুণ্ড মালিনী। নানা রঙের নৃমুণ্ড।  পায়ের তলায় তাঁর সদা শিব।
  কে ইনি। কে ইনি। কে ইনি। ইনি কে।
' আমার কালো মেয়ের পায়ের তলায় দেখে যারে আলোর নাচন ' - বুকের ভিতরে ধাক্কা দেয়।
  আমাকে অনন্ত চিন্তার দিকে নিয়ে যায় ' অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো ' র বানী।
  এখান থেকেই আমার ভাবনা যেন গতিমুখ পায়।
যেদিন এই ব্রহ্মাণ্ড  সৃষ্টি হয়নি - এই ব্রহ্মাণ্ডের প্রতিটি বস্তু
রূপহীন। সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডের ভর শক্তি রূপে ( Energy) বিরাজিত
এবং একটি বিন্দু তে নিহিত। তাহলে সে বিন্দুর ভর কত?
   ভর ই যে শক্তি তা আমরা জেনেছি মহা বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের কাছ থেকে। E= mc2 ( m c square)      তার পরীক্ষাও করে ফেলেছে মানুষ। ভুল নেই।
  ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি পূর্ব যে মহা অন্ধকার যে অনন্ত অমা নিশা ইনি
কি তার ই  রূপ কল্পনা। তিনি কি অন্ধকার রূপ অসুর দের
হত্যা করে আলো র আবাহন কারিনী। আমি ভাবি যদি
physical বা chemical কোন reaction কে চিত্ররূপ দিতে হয়  কেমন হবে সে ধ্যান লব্ধ রূপ কল্পনা। তাঁরা তো সৃষ্টি র প্রতিটি পর্যায় এর রূপ কল্পনা করেছেন। আমি দেখি সেই রূপ  প্রতীক। তা সে দশ মহাবিদ্যা ই হোন আর অনন্তশয়ান বিষ্ণু ই
হোন - তাঁদের শিল্পী মন রূপের ধ্যান করেছে। রঙে ; রূপে সৃষ্টি
হয়েছে তাঁদের ধ্যান প্রতিমা। সকলি তো প্রতীক। সেই ভাবেই
আমি দেখি। দেখে আমার মন।
  সেই মহামনস্বী ব্যক্তিরা তো ধ্যান যোগে ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির কথা
  ভেবেছেন। তাঁরাও তো সেই ' মহাবিন্দু ' র কথা ভেবেছেন।
সেই উপনিষদের জ্ঞান তপস্বী রা। কি অসাধারণ ছিল তাঁদের
মনীষা। সেই মহাবিশ্ব মহা ব্রহ্মাণ্ড ধারণ কারী ' মহা বিন্দু ' ( zero dimenson) ;( singularity ) কে
আপনি God particle বলবেন বা ব্রহ্ম বলবেন  সে আপনার
ব্যাপার। এই বস্তু বিশ্বের প্রতিটি ধূলিকনাতে তিনি বিদ্যমান।
তিনি মানে তো Energy.  যার রূপ আজও আমরা জানিনা।
জানি সে মহাশক্তি। ভাঙ্গো। ভাঙ্গো পরমানুর অন্তর। খুঁজে আনো আদি কণা কে। সে কি Neutrino; কোয়ার্ক ; ইলেকট্রন?  যাঁকে ই খুঁজে আনো তার  anti আছেই। দুই সত্তা। পজিটিভ আর নেগেটিভ। তাদের
মিলনে ই তো শক্তি প্রবাহ। এই জগৎ ও তো দুই সত্তা র সমন্বয়। প্রকৃতি আর পুরুষ। সৃষ্টির আনন্দ উপলব্ধি করতে তিনি তো নিজেকে বিভাজিত করেছেন। তাহলে আদিতে তো তিনি একক সত্তা। '   একমেবাদ্বিতীয়ম '।
সেই আদিসত্তার কোষরূপ ' দহর ' ব্যাপ্ত হল বহুরূপে।
  আজও আমরা খুঁজে চলেছি সেই আদি রূপকে। আদি কণা যা সবার মাঝেই ছড়িয়ে আছে। প্রাণে অপ্রাণে।  পার্থক্য তো অতি সুক্ষ্ম।
বিজ্ঞান খুঁজছে। তাই তার স্বাভাবিক ধর্ম। আর তাঁরা ; সেই মহামনীষা র অধিকারী রা চেয়েছেন " হে বিশ্বস্রষ্টা ; আমাও দাও সেই ধীশক্তি ; সেই মেধা ; সেই চেতনা যাতে মহাজগৎ কে
বুঝতে পারি '। " ধিয়ো যো নঃ প্রচোদয়াৎ "।
  সেই চেতনা কি " consciousness itself is fundamental if not primary " - Dr Bhoumik
তাই বুঝি ডেকার্ট বলেছিলেন " Cogito ; ergo sum " (গ্রীকভাষায়).। I think ; therefore I am ।
উপনিষদ তাই 'সারা বিশ্বব্যাপী বিরাজমান এই অখণ্ড
চৈতন্য কে ই বলছে ব্রহ্ম ' " সর্বং খলিদ্বং ব্রহ্ম তজ্জলানিতি "।। ( ছান্দোগ্য)
ব্রহ্ম ; যিনি সমস্তের আরম্ভে এবং সমস্তের শেষে। " বিচৈতি চান্তে বিশ্বমাদৌ "। ব্রহ্ম স্রষ্টা ; জগৎ সৃষ্টি। আবার ব্রহ্ম যদিও
স্রষ্টা ; বিশ্বজগতের উপাদান ও ব্রহ্ম।

স্পেস টাইম ভেঙে পড়ে। কোল্যাপস করে এমন এক বিন্দুতে
যার ডাইমেনশন ' জিরো ডাইমেনশন '। দৈর্ঘ্য ; প্রস্থ ; উচ্চতা একত্রে শূন্য।
তাহলে কি আদিকনা নয়। "আদি কোয়ান্টাম ফিল্ড। সবচেয়ে
আদি অন্তর্নিহিত ক্ষেত্র। যেমন সমস্ত electron ই সেই অন্তর্নিহিত ফিল্ডের উদ্দীপনার প্রকাশ "
কি আশ্চর্য  এই ব্রহ্মাণ্ডের  সমস্ত ইলেকট্রনই absolutely identicals ; everywhere in the universe no matter
when or where they are created. The amount of their mass ; electric charge and spin are always exactly the same "
আবার যেটা অবাক করে  এই ব্রহ্মাণ্ডের একত্রিত  পজিটিভ
+ এনার্জি  আর একত্রিত - নেগেটিভ _  এনার্জি একেবারে
  সমান সমান। তাহলে মোট এনার্জি  শূণ্য।
  শূণ্য তবু শূণ্য নয়। পাশ্চাত্যের ' Nothing ' আর আমাদের
প্রাচ্যের ' Nothingness ' এক নয়।  Nothingness  is more than Nothing '।  নয় নয় সে শূন্য নয়  পূর্ণ  পূর্ণ  পূর্ণ
  ' হে পূর্ণ তব চরণের কাছে ' -
  " All is whole ; all arises from whole and if whole is subtracted from Whole ; all that remains is Whole "
" ওঁ পূর্ণমদঃ  পূর্ণমিদং পূর্ণাৎ পূর্ণমুদচ্যতে
   পূর্ণস্য পূর্ণ মাদায় পূর্ণমেবাবশিষ্যতে "।
" অপাবৃণু "।  হে জগৎ তুমি প্রকাশিত হও। খুলে ফেলো আবরন। উন্মোচিত হোক তোমার অন্তরের সত্য। সরে যাক পর্দা। "
   আলোক হীনতাই কি অন্ধকার। না কি তার ও বিশেষ চরিত্র আছে!  বিজ্ঞান খুঁজছে। ' ব্ল্যাক ম্যাটার ' নিয়ে কাজ হচ্ছে।
  সেই ' মহাতমসাবৃত ' যে অবস্থা  সে কি সৃষ্টি পূর্ব সময়ের আগেই ছিল। সে ই কি ধারক।  তার ই অভ্যন্তর থেকে সৃষ্টি হল
  বিপুল লক্ষ কোটি সূর্যের এনার্জি!
  কাল থেকে তো কালী। সে যে মহাকাল। ঐ যে ' মহাকালের
  কোলে দোলে -- '
উৎস তুমি ই। জাগাও আলো। তোমার নৃত্য ছন্দে  শক্তি energy  প্রবিষ্ট হোক । শব থেকে পরিণত হউন  আলোক রূপী
  শিব। শিব শক্তি র মিলন ই তো সৃষ্টি।
জাগো আলো। ঈশোপনিষদের সেই আলোক বন্দনা
" হিরণ্ময়েন পাত্রেণ সত্যস্যাপিহিতং মুখম "
  ঋকবেদের গায়ত্রী মন্ত্র ~  সূর্য বন্দনা  তাও তো সেই আলোক বন্দনা যা শুধু জগৎ কে প্রকাশ করছে না মাত্র ; যুক্ত
আমাদের বোধের সাথে " তৎ সবির্তুবরেণ্যং ভর্গো দেবস্য ধীমহি। ধিয়ো যো নঃ প্রচোদয়াৎ "
   আমার প্রার্থনা শোনো  - অন্ধকার থেকে আলোর দিকে নিয়ে
  চলো " অসতো মা সদ্ গময় ; তমসো মা জ্যোতির্গময় "
------------ ------------ ------------ ------------ ©  প্রণব ভট্টাচার্য
পাঠক আমি একান্তই অনধিকারী। আমার ধৃষ্টতা মাফ করবেন। ' আমার মধ্যেই তোমার প্রকাশ "। তাই শুধু ভাবি মাত্র।  আমার ভাবনা আপনাদের সাথে শেয়ার করলাম।
আমার ভুল ভ্রান্তি ক্ষমা করবেন।
গ্রন্থ সহায়তা।  ব্রহ্ম সত্য জগৎ সত্য ।  ডঃ মণি ভৌমিক
   Code  name God : The spiritual Odyssey of a man of Science.  Dr Monilal Bhowmik.
  উপনিষদ ঃ  গীতা প্রেস

লেখাটি কে আবার একবার ফিরিয়ে দিতে ইচ্ছে হল। অনেকে পড়েছেন। সুচিন্তিত মন্তব্য করেছেন। 
 সকলকে আন্তরিক ধন্যবাদ। 
 না হয় আর একবার পড়ুন। 
 

 
 

 

খাঁদি মাল আর সেই সময়ের কথা

।। সাতকাহনিয়ার  সাতকাহন কথা।। 
 ।। খাঁদি মাল  আর সেই সব দিনের কথা।। 
 কারও ঘরে মাছ মিলুক  আর না ই মিলুক -
একবার মাল পাড়ার খাঁদি র উঠোনে গিয়ে খোঁজ নাও 
 মিললে মিলতে পারে নয় মিলবে ই। সে চুনো পুঁটি হোক আর
ল্যাটা ; পাঁকাল  যাই হোক মিলবেই।  ঘরের উঠোনে র এককোনে আছে জালঢাকা  একটা গর্ত। তাতে চ্যাঙ ; ল্যাটা 
 জিয়োনো  থাকে। 
 নীচু মাটির দেয়াল। তালপাতার ছাউনি। তার কুঁড়েঘর। 
 পিছনেই বাসক ফুলের ঝোঁপ। ওদিকে বাঁশঝাড় ; আর লায়েক 
 বাবুদের ঠাকুর মন্দিরের ঢিপির উপরে বেশ কয়েকটা পলাশ গাছ। তারপর খেজুর ; মাঁদারের ঝোপ। তার ভিতর দিয়েই পায়ে চলা পথ। হালদার বাবুদের ইঁটের প্রাচীর ঘেরা বিরাট খামার। বিরাট এক নিম গাছ খামারের ভিতরে। 
 তার গায়েই হালদার বাবুদের খিড়কি পুকুর ' জরুলি'। 
 কি সুন্দর বাঁধানো তার ঘাট। চওড়া সিঁড়ি। 
 মালপাড়া থেকে সোজা পশ্চিম দিকে ঐ পায়ে চলা পথে গেলে 
মেলে ভুতু কুলুর ছোট্ট দোকান। ভূতনাথ গঁড়াই। বাবা মাহিন্দি 
 গঁড়াই। আসলে মহেন্দ্র। দলিলে বাবুরা ঐ মাহিন্দি ও লিখেছে। 
 একসময় ভালো জমি জায়গা ছিল। ভুতু র সময়ে সব শেষ। 
 সেই পুরনো খুব অভাবের দিনে সব বিক্রি হয়ে গেছে। জলের দরে। 
 ঘরে ঘানি ছিল। এ গাঁ ছেড়ে তাদের আত্মীয় রা সবাই চলে গেছে। এদিকে ওদিকে। ডাঙ্গাল গ্রামে। 
 ভুতু কুলুর ছোট্ট ডালি দোকানে দু চার পয়সা বা বড়জোর দু চার আনার তেল ; ঝাল ; নুন ; বিড়ি ; দোক্তাপাতা ;  নিতে আসে
 গাঁয়ের মাল পাড়ার আর বাউড়ী পাড়ার মানুষ জন। 
 আমার লেবেঞ্জুস দাদু। হ্যাঁ ওর দোকানে ছোট ছোট  গায়ে লাল নীল গোলাপি  দাগ দেওয়া লেবেঞ্জুস পাওয়া যেত। কাচের বয়ামে 
 থাকত। দশ পয়সায় দশটা। প্রায়ই যেতাম। এই কে দাম দেবে রে "।  দাদু দেবে গো " -। - অ বেশ '। 
 ওর দোকানে প্রায়ই খাঁদি বসে থাকত। অনেকক্ষণ ধরেই। 
 ওর ঘরের কাজ ও করে দিত। ফাই ফরমাস খাটতো। 
 খাঁদি র সাথে ওর এক আলাদা সম্পর্ক। ভুতু দাদুর বৌ মরে গেছে। কে জানে কতদিন আগে। সে দেখেনি। একটি মেয়ে গঙ্গা। সে বড় হয়ে উঠছে। বিয়ে র ভাবনা  বাবার মনে। কপালের ভাঁজ আরও চেপে বসে। 
 খাঁদু র নাকটা একটু চাপা হলেও মুখটি তার সুন্দর। কপালের উপরে দু'পাশে চুলে খাঁজ। সিঁথি তে অবশ্য সিন্দুর নাই। তার 
 স্বামী ও দুদিনের জ্বরে কবেই মরে গেছে। ওদের ব্যাটা পদা মানে শ্রীপদ। ওর চেহারাটি বেশ সুন্দর হয়ে উঠছে। যেমন লম্বা 
 তেমন ই গঠন। ভূতনাথ গঁড়াই নিজের নামটি লিখত কি সুন্দর টানে। একটু লিখতে পড়তে জানত। পদ কে সে নামটা লিখতে শিখিয়েছিল। আরও এক দুজন ছেলে তার কাছে অ আ ক খ  লিখতে পড়তে শিখত। 
 খাঁদি আসত শেষ বিকেলে। সন্ধ্যে গড়িয়ে রাতে ফিরত ঘরে। 
 গঁড়াই লণ্ঠন দেখিয়ে দিত। 
  কি যে অভাবের ছিল সেই সব দিন গুলো। কি করে যে পার 
 হত এক একটা দিন। শ্রাবণ ভাদ্র মাসে কারও ঘরে ভাত নাই। 
 এ গাঁয়ের  মাটিতে রোদ পড়ে না। এত তাল গাছ পুকুর পাড়ে।
 তালও ছিল নানা রকমের। চার আঁটি কালো কুচকুচে। 
 আর কি মিষ্টি তার মাড়ি। ঐ তাল মাড়ি একটু গুড় যোগাড় করে  -। আরে যোগাড় কোথা!  হালদার বাবুদের গুড় ঘরে 
 একটা নালি পথ ছিল। সেই নালি দিয়ে গুড়ের মাউত গড়িয়ে 
 বেরিয়ে আসত। তালপাতার ঠোঙা য় তা ধরে নিয়ে যেত কত জনে। খাঁদি ও নিত। কচু পাতায় বেশ খানিকটা চিংড়ি  চুনো পুঁটি  দিয়ে চারটি মুড়ি যোগাড় করত। সেই মুড়ি ; মাউত গূড় ; 
 আর তাল মাড়ি। আর তালের তাড়ি। রাত পেরোয়। দিন পেরোয়। দিনের পরে আবার সেই একই রাত। 
 পদ র বড় খিদে। সে মেটেনা কিছুতেই। এক সের চালের ভাত সে শুধু নুন লঙ্কা দিয়েই খেয়ে নিতে পারে। হালদার বাবুদের সরস্বতী পুজোর ভোজে সে এক গামলা খিচুড়ি খেয়ে লাঠি ঘোরাত। বনবন লাঠি ঘুরত। তার সাথে পাল্লা দিয়ে আরও কয়েক জন। প্রায় সবাই লাঠি খেলতে জানত। বোঙ্গা ; বটু ; দুলাল ; জটাই ; চৈতন সবাই একবার অন্তত  দু চার পাক ঘোরাতই। উত্তর দিকের গোয়াল চালার বারান্দায় বসে দেখতো গাঁয়ের লোকেরা। 
 ওব্বো ওব্বো দিত  মুখে। 
 লাঠি খেলা ; ঠাকুর বিসর্জন ; তারপর নাচ।পেটে তাড়ি সিদ্ধি।  জগৎ ভুলে দুহাত তুলে নাচ।  তারপর খিচুড়ি ভোজ। বাঁধাকপির তরকারি। চাটনি। কখনো কেমনো 
 মাছও জুটে যেত। টক ঝোল। তাই  ছিল এক মহাভোজ!  
 তার আগের দিন সরস্বতী দালানে বাবু ভাই ভদ্রলোক দের জন্য হত আলাদা ভোজ। পাতে মাছ ;  বোঁদে ; মিষ্টি পড়ত। 
 আশেপাশে র গাঁয়ের অনেকের নিমন্ত্রণ থাকত। 
 সে ভোজের শেষে বিশেষ কিছু কোঁড়া ; বাউরী ; মাল ঘরের 
  লোক প্রসাদ পেত। সে টা পাওয়ার জন্যে খুব লোভ ছিল অনেকের। 
  খাঁদি পদা কে ধরে ঘরে নিয়ে যেত। এবার পদার বিয়ে দিয়ে দেবে। তাহলে ই যেন তার নিশ্চিন্তি। পদা মাছ ধরতেও খুব ওস্তাদ হয়ে উঠেছে। মাঝে মাঝে তগি এড়ে বড় মাছ ধরে আনে।  হায়রে সে বড় মাছ কোথায় বেচবে খাঁদি। বড় মাছ 
 বিচতে গেলেই -। ' কোথায় পেলি এ মাছ '। এ তো বড়বাঁধের মাছ মনে হচ্ছে '। 
 " না গো নদীতে ধরেছে "। 
  " মজা '!  এ নদীর মাছ বটে না কি ' 
 খাঁদি পালাতে পারলে বাঁচে। 
 এখন কার মতো মাছ কিনে খাওয়ার চল গাঁ ঘরে প্রায় ছিলনা। আর এ গাঁয়ে চাল মুড়ি দিয়ে কিনে খাওয়ার মতো 
 তখন গোটা দশেক ঘর। 
 মাঝে মাঝে ছেঁড়া আঁচল দিয়ে পেছে ঢেকে  মাছ নিয়ে 
 অন্য গাঁয়ে চলে যেত। অধিকারী আমবাগানের ভিতর দিয়ে পায়ে চলা পথে বামুন পুকুরের পাড় ধরে ডাঙ্গাল গাঁয়ে দিয়ে আসত  গঁড়াই ঘরে। ঘোষ বাবুদের ঘরে। চাল আলু মুড়ি নিয়ে 
 আর দু চার আনা নিয়ে ঘরে ফিরত। দিন টা একটু ভালো যেত 
 তার পর দিন। 
  ভুতু কুলু শেষমেষ  খুঁজে বের করল গঙ্গার জন্যে ছেলে মানে বর। ঘুড়িষা গ্রামের কমল গঁড়াই। জমি জায়গা আছে। দু চার বিঘে। খাওয়া পরার অভাব হবে না। 
  খাঁদি ও খুঁজে বের করল তার পদ র বৌ। 
 কালীদাসী। হোক ময়লা। কিন্তু মুখটি মন্দ নয়। 
 গঙ্গা র বিয়ে দু এক বছরের মধ্যে হয়ে গিয়েছিল কমল গঁড়াই এর সাথে। হায়রে গঙ্গার জীবন! সে বোধ হয় শ্বশুর ঘর যায়নি। কমল আসত। তাদের দু টি মেয়ে হয়েছিল। তারপর অনেক অনেক কথা। গঁড়াই চুপচাপ ঘরের সামনে কুয়োর ধাপি তে বসে বিড়ি টানত। উদাস দৃষ্টি। ম্লান চোখে। ভাবনার যেন শেষ নাই। 

  কালীদাসী পদর ঘরে এলো। ওদের ঘরের সামনে খোলা উঠোনে  তুলসীমঞ্চের সামনে চারটে কঞ্চি পুঁতে  ছাদনা তলা। 
 ঘর বাঁধা।  সেই আদিম ঘর বাঁধার কৌশল।  সেই একই রীতি। 
 সামনে চারটে খুটির উপরে বাঁশ বেঁধে তালপাতা চাপিয়ে বিয়ের ভোজের আসর। কি আর খাওয়াতে পারে খাঁদি। তবু 
 যা হোক কিছু করেছে। মুড়ি ; কুমড়োর তরকারি ; আর পচুই মদ - এই জলখাবার। তাই সই। যথেষ্ট। রাতে ভাত আর একটা তরকারি। গরমের দিন। উঠোনে ই গড়াগড়ি। 
 বোঙ্গা র বউ আর এক কালীদাসী। দুই কালীদাসী র ভাব হয়ে গেল খুব তাড়াতাড়ি। 
  খাঁদি বসে আছে তার নিজের কুঁড়ের দাওয়ায়। 
  তাকিয়ে আছে সামনের দিকে। তাকিয়ে আছে কিন্তু কিছুই সে 
 দেখছেনা। শূন্য দৃষ্টি। তার মন যে কোথায় চলে গেছে  
  কতদূরে -  সে ই জানে বা হয়তো জানে না। 
 ------------ ------------ ------------ ------------ © প্রণব ভট্টাচার্য

Saturday, 11 December 2021

হাঁকু মিঞা আর কুলসুমার কথা

।। সাতকাহনিয়া র ।সাতকাহন কথা।। 

হাঁকু মিঞা আর কুলসুমা বিবির কথা।।

দুপুরে  ঘরে তাকে কিছুতেই পাওয়া যাবেনা। অবশ্য দেখা করতেই কে আর আসছে!
হাঁকডাক তো ছিল না মানুষ টির। খুব কম কথার মানুষ । বড় চুপচাপ।  যেন আত্মমগ্ন। কে যে তার নাম দিয়েছিল হাঁকু - কে জানে।
দুপুরে যা হোক দুটি জোটে। কিভাবে যে জোটে। কেউ জানেনা।  কে আর কার এত সব খোঁজ রাখে। কিন্তু গাঁঘর তো আলাদা। সবার কথা সবাই জানে। আর মেয়েরা;   তারা তো কত কিছু জানে।  জানবেই।
গাঁয়ের আমোদ তো সেখানেই। আর আছেই বা কি সাধারণ মানুষের জীবনে - আনন্দের উপকরণ! 
তো মিঞা সাহেবকে দুপুরে পাওয়া যাবে অন্য কোথাও নয়।
কোন না কোন পুকুর ডোবার জলের ধারে পাড়ে। ছোট্ট ছিপ।
ছোট্ট বঁড়শি। চুনো পুঁটি তে সে খুশী। দুপুর দিয়ে রাত চলবে।
  এ গাঁ য়ের আদি বাসিন্দা তার বাপ ঠাকুর্দা রা কেউ নয়।
  এ গাঁয়ে বলতে গেলে নিজের গাঁ ছেড়ে পালিয়ে চলে  আসা।
  হজরতপুর না কল্যাণপুরের  লোক সে।
চেহারা টি তার বেশ মনে আছে। মনে থাকার মতো না হলেও
আলাদা রকম। মাথার মাঝখানে টাক। দুপাশে কানের নীচে
পর্যন্ত বাবরি চুল নেমে এসেছে।সুন্দর করে আঁচড়ানো।
ছুঁচালো দাড়ি থুতনিতে। মাঝে মাঝে হাত বুলিয়ে নেয়। 
 
গালে দাড়ি  প্রায় নেই । হাল্কা গোঁফ। ছোট ছোট দুটি চোখ। তাতে আবার সুর্মা লাগায়। পরনে লুঙ্গি। গায়ে ফতুয়া। গরমে হাতা কাটা।  
এবার কুলসুমা বিবির কথা। ছোটোখাটো চেহারা। একটু ভারী।  গায়ের রঙ বেশ ময়লা। চকচকে ত্বক। ঘণ চুল।
মুখে মিষ্টি হাসি। আর কথা খুব মিষ্টি।
ছিল না কি কুমোর ঘরের মেয়ে।
   বাস্তবতা ই  যেন  হাঁকু মিঞা র সাথে তার ভাব ভালোবাসা  তৈরী করে দিয়েছিল। তাকে এনেছিল ঝাড়খণ্ড থেকে। ঘর সংসারের  কাজকর্ম  করা -
আর অসুস্থ স্ত্রী র সেবা যত্ন করার জন্যে। কুলসুমা নিজের মতো করেই সংসারের সব কাজ করত। সেবা যত্নে ও তার ত্রুটি ছিলনা। হাঁকু মিঞা র স্ত্রী ও তাকে কাছের করে নিয়েছিল।  জাত কুল মানের থেকে বাস্তব টাই বড়ো। মানুষ  মানুষ ই। 

তবে গাঁঘরে কথা তো থাকবেই। কথা চিরকাল ই আছে। থাকবেই। কথা ছাড়া   মানুষের  জীবন হয় না কি। মেয়ে মহলে কত কথা। আর এসব কথাতেই তো গোপন আনন্দ। "কুলসুম এর সঙ্গে কেমন সম্পর্ক বল দিখি "। শুনলাম পেটে বাচ্চা এসেছে "
যা স্বাভাবিক তাই তো হবে। একটা মানুষ সংসারের আপন হয়ে ই উঠেছে। তাকে তো আর ফেলে দেওয়া যায়না।
ফেলে বা তাড়িয়ে ও দেয়নি। দিলেও কুলসুমা র যাওয়ার আর
কোনো জায়গাও  ছিলনা।
না। ফেলে দেয়নি কুলসুমা কে। তাকে নিকাহ করল আব্দুল মিঞা। এতক্ষণ হাঁকু মিঞা বলেছি। সে তার ডাক নাম।
ভালো নাম  সৈয়দ আব্দুল হক।
ততদিনে এই গাঁয়ে চলে এসেছে তারা। তাঁর প্রথমা স্ত্রী র কয়েকজন  দূর সম্পর্কের আত্মীয় এ গ্রামে। জায়গা পেতে অসুবিধা হয়নি। বদরুদ্দোজা ; সাদরে আলা মশাই রা জায়গা দিলেন। আব্দুল মান্নান এর ও আত্মীয় হচ্ছেন।
যাইহোক কোনমতে দিন যায়। মাঝে মাঝে 'বাপুতে' জায়গা থেকে কিছু সংগ্রহ করে আনে। চাল ; টাকা। ওখানে কিছু জমি জায়গা ছিল হয়তো।
কুলসুম এর গর্ভে জন্মাল সখিনা। সেই ছিল একমাত্র সন্তান।
সখিনা খুব ভালো মেয়ে। প্রকৃতি র নিয়মে ই একদিন বড় হল।
  অভাবের সংসারে একটু সুখের মুখ কি সে দেখতে পাবেনা
  সাজতে সে ভালোবাসে। একটু স্নো ; পাউডার ; কুমকুম ; চিরুনী ; গন্ধতেল আর একটা আয়না। কি করে যেন যোগাড় করত। আহা!  কোন মেয়ের না সাজতে ইচ্ছে করে। গরীব বলে কি ইচ্ছে টা থাকবে না। আমি ভাবি  ' না সখিনা গরীবের শখ ভালো নয় ভাই - অনেক ফাঁদ পাতা আছে রে।
যাক সে কথা -------।                   অবাক কাণ্ড হঠাৎ একদিন
  তার থেকে বয়সে অনেক বড় এক মানুষের সাথে তার বিয়ে
হয়ে গেল। সে কি মেনে নিতে পেরেছিল!  কিন্তু উপায় কি।
তার স্বামী কাজী সুফি এজহারুল হক।  ভালো চেহারা। গাঁয়ের লোকেরা যেমন বলে ' উঁচু পুরু ' চেহারা। কাঁধে এক বিশাল ঝোলা। সন্ধ্যায় গ্রামে ঢোকে। আবার সকাল হলেই বেরিয়ে যায়। বেরিয়ে যায় তো যায় ই। মাস পার হয়ে যায়। তারপর হঠাৎ দেখা মেলে। লোকটিকে আমার অন্যরকম মনে হত।
ঠিক আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতো  এ মানুষ টি নয়।
নানা বিদ্যা তার আয়ত্ত্বে ছিল। আত্মমগ্ন মানুষ।  ঝোলায় তার হরেক কিসিম। অনেক বই পুঁথিপত্তর।  হোমিও ইউনানি ওষুধ।
জটিবুটি। কত কি। মাদুলি কবচ।
সকালে হেঁটে তমাল তলার পথ দিয়ে বাঁধ ধরে ইলামবাজারে
যায়। তারপর যে কোথা। জানা নেই। শুনেছিলাম বাড়ি না কি
মাড়গ্রাম। তবে খুষ্টিগিরি ; পাথরচাপুড়ী এসব জায়গায় নিশ্চয়ই যেতেন। কিছু রোজগার করে সখিনা র হাতে দিয়ে যেতেন। ধীরে তাঁদের দুই সন্তান জন্মাল। প্রথমে পুত্র সন্তান।
পরে এক কন্যা সন্তান। কষ্টেই মানুষ।
  ততদিনে হাঁকু মিঞা এবং  তাঁর প্রথমা স্ত্রী  মারা গেছেন।
সংসার ঘাড়ে চেপেছে কুলসুম এর। হায় কার বোঝা কে টানে।
আর সখিনা ছেলে মানুষ করবে না পেটের ভাত জোগাড় করবে। অন্যের বাড়িতে কাজ করে কিছু যা হোক পায়।
কিন্তু রোগ বাসা বাঁধল শরীরে। রাজরোগ। ক্ষয়। টি বি।
সে কি আর হোমিও তে সারে। তখন কোথায় হাসপাতাল।
কোথায় ওষুধ!  কিছুদিন ধুঁকে ধুঁকে বেঁচেছিল। ঐ যা।
তারপর এন্তেকাল। তার আগেই তার স্বামী সুফি সাহেব মারা গেছেন। কোথায় যে মারা গেছিলেন -
হায় কুলসুমা তুমি রয়ে গেলে। এবার তুমি সামলাও!
সেই সব দিন!  কি দিন যে গেছে। মানুষ দুটো খেতে পায়না।
চাল নাই। কোনমতে মেগেযেচে দূটো চাল যোগাড় হলে ও
একটু তেল ডাল আলু তো চাই। ঐ মেগে যেচে ই।
দিন প্রতিদিন। ভিক্ষা। আর কোন উপায় নেই। কি করবে পেটের দায়। নাতি নাতনি টাকে বড় করতে হবে যে।
অতএব কুলসুম পথে ই নামো। লজ্জা!  কিসের আর লজ্জা!
লজ্জা তোমার নয় মা। লজ্জা আমাদের   সমাজের।
   সত্তরের দশকে র শেষে বাম আমলে পঞ্চায়েত গঠিত হলে
  যথাসাধ্য সাহায্য সহযোগিতা ; বেঁচে থাকার আধারটুকু
সময়ে সময়ে তাঁকে দেওয়া হত।বিধবা ভাতা। মাথার উপরে ছিল শর পাতার চাল। এক দোচালা ঘর। ঘর করার জন্য কিছু টাকা। ঘরের জায়গার কাগজ। যা এসেছে প্রথম দেওয়া হয়েছে তাকে। তবু কি আর
শতছিদ্র ভরাট করা যায়।
  দীর্ঘ দিন বেঁচেছিল কুলসুমা বিবি। মিলন প্রায় বড় হয়ে উঠেছে। আশা ও বড় হচ্ছে।
  কুলসুমা যেন জন্মেই ছিল এই সব দায়িত্ব একার কাঁধে বইবার জন্য।
তোমার মুখটা বড় মনে পড়ে গো আমার। হয়তো সবাই ভুলেছে।
   করুন দুটি চোখে ছিল না বলা জীবনের কত কথা ।
------------ ------------ ------------  কথা - সাতকাহন এর ই অংশ।
     ©  প্রণব ভট্টাচার্য । ৫/১২/২১

লক্ষ্মী হিজড়েনী আর এক রাতের কথা

সাতকাহনিয়ার   সাতকাহন কথা।।
।।। লক্ষী হিজড়েনী আর এক রাতের কথা।।

আকাশে একফালি চাঁদ।
বাঁধের গায়ে বিরাট যজ্ঞডুমুর গাছটার উপরে ভেসে আছে।
যজ্ঞডুমুরের একটা মোটা ডাল বাঁধের উপরে আড়াআড়ি ভাবে। তার তলা দিয়েই যেতে হবে।
গাঁয়ের লোকেরা বলাবলি করে ঐ ডালে পা ঝুলিয়ে ওনারা বসে থাকেন। পা নাচায়। নিজে চোখে কেউ কেউ দেখেছে ও।
একজন তো ঘরে এসে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল।
হবে নাই বা কেন!  পাশেই নদী। নদীর পাড়ে শ্মশান। বিরাট শিমূল এর নীচে। ওপাশে ঘন পলাশবন। ঝিঁঝি ডাকে কান পাতা দায়। আর লক্ষ লক্ষ জোনাকি।
  হিজলের তলা দিয়ে ' গই ' পেরিয়ে পায়ে চলা বা গোরু র গাড়ি  রাস্তা চলে গেছে " ভুলো কালী " তলার বিরাট ঝাঁকড়া
অশ্বত্থ গাছটা র পাশ দিয়ে কয়া মাঠ ; কামারপাড়ার দো মাঠ
রূপাই চণ্ডী তলা হয়ে বসুধার রূপুটে পাড়ার দিকে।
  ইলামবাজার থেকে ফিরতে সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত। কলেজ থেকে ফিরতে দেরি হয়ে গেছে। আকাশে মৃদু আলোয় দূর থেকে দেখতে পাচ্ছে লাঠি হাতে কেউ দাঁড়িয়ে আছে বাঁধের উপরে।
আর এগুতে সাহস হচ্ছেনা। ভাবছে  চোর ডাকাত কি। না একা তো। আবার ভাবছে ;আর তার কাছে আছেই বা কি। ঝোলায় কয়েকটা বই মাত্র।
  কিন্তু সাইকেল টা যদি নিয়ে নেয়! তাহলে -
পিছনে ফিরে যাবে?
সে তো অনেক সময় যাবে। ঘরে দাদু দিদিমা ছটফট করবে।
  সে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল।
   ও আগিয়ে আসছে। থপথপ করে। আসুক -
  একেবারে কাছে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ল সাইকেলের হ্যাণ্ডেলের উপর। তারপর সাইকেল ছেড়ে জড়িয়ে ধরল তাকে।
গায়ে বেশ জোর। লক্ষী হিজরে।
মুখে পচাই মদের বিকট গন্ধ।
" শালা তু কে রে "।  " ও  অযুধ্যের  অমুক রক্ষিতের ব্যাটা "।
শালা সেদিনে তু খুব গাল দিয়েছিলি। আজ শালা তোকে ছাড়ছি না। 
চল আমাকে ইলামবাজারে পৌঁছে দে "। আমি যেতে লাড়ছি "
- না। লক্ষী দিদি আমি সাতকাহনার মাষ্টার এর লাতি "
- শালা। মিছে কথা। শালা আমি কারও দিদি লই। দাদা লই "
  আমি লক্ষী হিজরে মাগি। চল শালা চল। "
যতই ছাড়াবার চেষ্টা করি ততই সে আরও জোরে চেপে ধরে।

লক্ষী হিজড়েনী । ইলামবাজারের পাঁচু সাহার পচুই মদশালেই
তার আস্তানা। বট গাছের তলায়। ইলামবাজার থেকে অযোধ্যা বনকাটি এলাকা। এই তার এলাকা। এখানে তার সাথে ঢোলক বাজায় অষ্ট মেটে। বিচিত্র গলায় লক্ষী তালি দিয়ে গান গায়। ছেলে নাচায়। চাল মুড়ি নাড়ু দু চার টাকা  পয়সা আদায় করে। নিয়ে সন্ধ্যায় ধ্বজাই সাহার পচুই মদ শালে। সেখানের চালাতেই রাত পেরিয়ে যায় তার আর অষ্ট র।
অষ্ট র ঘর মদশালের পাশেই।তার সংসার আছে।  সহজে লক্ষী তাকে ছাড়েই না। অষ্ট কে সে এখানে নিয়ে এসেছে।
মাটির বড় ঘর করে দিয়েছে। বাবুদের ঘরে চাষ দেখে দিয়েছে। 
  একটু ভারী চেহারার লক্ষী। মেয়ে হয়েই জন্মাতে জন্মাতে
হঠাৎ আর পুরোটা হয়নি। এদের নিয়ে মানুষের ; ছেলে মেয়েদের কত কৌতূহল। অথচ মুখ ফুটে পরিষ্কার করে কেউ
কিছু বলেও না। জিজ্ঞেস ও করা যায়না।
মানুষ। অথচ এক বিচিত্র জীব।
  সে ও জন্মেছে কোন মায়ের গর্ভে। হায়রে সে মায়ের গর্ভের
নির্মিতি। হায়রে সে মায়ের মন। যখন তুলে দিতে হয়েছে তার
গর্ভের সন্তান টিকে সেই হিজরে দের হাতেই।
আর কি বিচিত্র জীবন  এই হিজরে দের।
চিরদিন ই তারা আছে। কিন্তু মানুষের সমাজ মানেনি। কি
সেদিন আর এদিন। 
  লক্ষীরা অল্পে সন্তুষ্ট ছিল। আর এখন দল বেঁধে এসে আধুনিকা রা  যারপরনাই অত্যাচার করছে। জোর করে গরীব মানুষের ঘর
থেকে হাজার হাজার টাকা ; শাড়ি এসব আদায় করছে।
তাদের মুখের সামনে দাঁড়ায় কার সাধ্যি। আর যদি কেউ বেশী
কিছু বলে   দল বেঁধে গোল হয়ে দাঁড়ায় তবে যা পরে আছে সব খুলে নেচে দেবে। মেয়ে বৌ রা যে যেদিকে পারবে ছুটে পালাবে। এই সেদিন এই গাঁয়ে কোঁড়া পাড়ায় এক ঘরে এমন করে আদায় করে নিয়ে গেল।
এভাবে আদায় করায় সরকারের অনুমতি আছে? ওরা বলে হ্যাঁ আমাদের কাগজ আছে। যা না যা যেখানে যাবি যা। "
হাসপাতাল থেকে নাম পেয়ে যাচ্ছে।
একটা চমৎকার নেটওয়ার্ক আছে - মনে হতে বাধ্য।
কিন্তু লক্ষীরা এমন টি ছিলনা। মনে পড়ে ছোট বেলায় আমাদের বাড়িতেও ওকে আসতে দেখেছি। দাদু কে পেন্নাম ও
করত। ভাত ও খেয়ে গেছে  কখনো কেমনো।
  আচ্ছা ঢোলক বাদকের সাথে ওর সম্পর্ক কেমন ছিল।
আমার তো মনে হত বেশ আন্তরিক। এক ধরনের ঘনিষ্ঠতা।
  এদের কি মন নাই!  শরীরের খিদে নাই!  কামনা বাসনা!
  আজও আমরা লক্ষী দের চিনি না। বা চিনতে চাই ও না।
  কি হবে এদের চিনে। এরা তো মূল স্রোতের কেউ নয়।
  কিন্তু এরা ও যে মানুষের গর্ভে জন্মেছে। তাদের ও বাঁচতে হবে।  বাঁচতে দিতে হবে। বাঁচার উপায় খুঁজে দিতে হবে।
শুধু দল বেঁধে ট্রেনে উঠে যাত্রী দের কাছে আদায়। যেমন দল
বেঁধে ওঠে মালদা - গৌড় স্টেশনে।
  আমি জানিনা। আছে কি না। একটা গণনা দরকার। তাদের
নিজস্ব কলোনি গড়ে দেওয়া ;শিক্ষার ; হাতের কাজের প্রশিক্ষণ দরকার ।  সরকার কে সহানুভূতিশীল হতে হবে।

  অনেক কাকুতি মিনতি তে ও সেদিন লক্ষীর হাত থেকে ছাড়া
পাইনি। লণ্ঠন হাতে নিয়ে নদী তে মাছ ধরতে আসা কয়েকজন কে মনে হল এদিকেই আসছে। শ্মশান ঘাটের কাছে নামবে।
  ঠিক তাই। মাল পাড়ার পদ ; ভোঁটা ; লেডু মালেরা। খুব
মেছোল। ভয় ডর নাই। তেমনি গতর। আর এই সময় ভালো মাছ ওঠে। আড় ; বোয়াল ; সহ নানা মাছ।
কোনমতে তাদের কাছে আমার ডাক পৌঁছালো।
  ওরা এসে আমাকে ছাড়াল।
ওরাই বলল "  এই লক্ষী এত রাতে আর তুই ইলামবাজার যেতে পারবিনা। " যাসনা। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল সে। তারপর
জিয়ল গাছের তলায় ধপ করে বসে পড়ে হাউহাউ করে কাঁদতে লাগলো।
কেন যে কাঁদতে লাগলো       কে জানে! 
রাতের আঁধারে নদী তীরে তার কান্না ছড়িয়ে গেল চরাচরে।
------------ ------------ ------------  - -----------©  প্রণব ভট্টাচার্য।

------------ ------------ ------------ ------------ -------©  প্রণব ভট্টাচার্য
।। কথা - সাতকাহন।। এর অংশ।

সে এক ভোলানাথ আর ডেলা দিদির কথা

আর এক ভোলানাথ ও ডেলা দিদির কথা
-----------------------------------------------------------
কত যে কথা। কে আর মনে রাখে।
নাম ভোলানাথ। বেশ লম্বা চওড়া চেহারা। কিছুটা পৃথুল। ফর্সা রঙ। প্রকৃত ই সুপুরুষ।
বাড়ি পার্শ্ববর্তী এলাকার আদুরিয়া - অমরপুর।
দক্ষ কাঠমিস্ত্রি এবং রাজমিস্ত্রি ও। কাজের সূত্রে অযোধ্যা - বনকাটি তে প্রায়ই আসতে হয়।
একদিন নজরে পড়ল দলুই পাড়ার এক সুন্দরী মেয়েকে। মুখশ্রী সুন্দর। কিছুটা গোলাকৃতি। খুবই ফর্সা। ভালো না লেগে উপায় নাই। লাগলোও।ডাক নাম ডেলা। ভালো নাম তো আছেই। সুধাময়ী।
সম্পর্ক গড়ে উঠল। ভালোলাগা ভালোবাসায় পৌঁছালো।
পড়ে থাকল জাত কুলের ব্যবধানের কথা।
সে সম্পর্ক পরিণতি পেল বিবাহে।
  সে বড় সহজ কথা নয় সেই সময়ে।
ভোলানাথ আর দলুই ঘরের মেয়ে সুধাবালা ধাত্রী র বিয়ে কি আর সমাজ মেনে নেয়। নিলনা। নেবেনা যে তা ভালোই জানত ভোলানাথ। কিন্তু তাদের প্রেম কোন বাধা মানেনি। জয়ী হল প্রেম  আর জাতিচ্যুত করল
তাদের সূত্রধর সমাজ।
আর কখনওই আদুরিয়া অমরপুর এলাকায় ফিরে যায়নি ভোলানাথ। তার আত্মীয় স্বজন রা আছে। হ্যাঁ ; এখনও আছে। জয়দেব কেন্দুলী র কাছে র বিখ্যাত গ্রাম জনুবাজারে তার ভাগনে রা আছে। সেখানেই বিয়ে হয়েছিল তার বোনের। রবি ; নন্দ তার ভাগনে।
তারা মাঝে মাঝে অযোধ্যা গ্রামে আসে। দলুই বাড়ির তাদের মামার বর্তমান বংশধর দের সাথে যোগাযোগ রাখে। বর্তমান বংশধর বলতে - ভোলানাথ সুধাময়ী র কোন পুত্রসন্তান ছিলনা। ছিল এক মেয়ে। নাম তার ভবানী। সেই ভবানীর ও গ্রামেই বিয়ে হয়েছিল।স্বামী র নাম - সিদ্ধেশ্বর। 
তাঁদের আবার তিন মেয়ে। বড় হরিদাসী ; আমাদের হারা দিদি র সাথে ই কথা বলছিলাম। মেজ বোন তারাদাসী মারা গেছে। আর ছোট লীলা আছে। কথা বলার সময় হারাদির ছেলে নাড়ু দলুই সাথে ছিল। তার জীবন ও বিষাদময়। তাঁর স্ত্রী ললিতা কেন যে আত্মহত্যা করে নাড়ুকে একা করে দিয়ে চলে  গেল। দুই মেয়েকে বড় করে তোলা। তাদের বিয়ের ব্যবস্থা করা।ছোটটির সম্বন্ধ চলছে।
মেয়েরা অবশ্য সুন্দরী। ভালো মেয়ে। নাড়ু ডেকোরেটারের ব্যবসা করে। মা কে ও খুব যত্নে রাখে। অনেক জায়গা ভ্রমন করিয়ে এনেছে।
যাক। অনেক লতায় পাতায় জড়িয়ে যাচ্ছে আমাদের গল্পকথা।
ভোলানাথ আর সুধাময়ী শুঁড়ি পাড়ার লাগোয়া দলুই পাড়ায় তাদের ছোট্ট কুটির বাঁধল। সেখানেই বসবাস করে। ভোলানাথের কাজের অভাব হওয়ার কথা নয়।
সুদক্ষ মিস্ত্রী। তার মতো মাটির ঘরের নৌকা চাল এর কাঠামো বানাতে আর কেউ পারতনা। অনেকে তার কাছে কাজ শিখেছে। আবার রাজমিস্ত্রি হিসাবে ও ছিল ওস্তাদ। অযোধ্যা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আদি বাড়ির কাঠামো তৈরী থেকে দেওয়াল প্লাস্টার ; মেঝে তৈরি সব তার হাতেই। আমার দাদু ; বিদ্যালয়ের  প্রতিষ্ঠাতা তথা প্রধান শিক্ষক এলাকার ' বড় মাষ্টার ' ননীগোপাল চট্টোপাধ্যায় এই মানুষ টিকে খুব ভালোবাসতেন। আমি ও ভোলাদাদু বলতাম। আর ডেলা দিদি। একমনে কাজ করতো। কথা কম বলত ভোলাদাদু।
দীর্ঘদিন বেঁচেছিল এরা। ভোলা দাদুর শরীর চর্চা বলতে ছিল সাঁতার। পুকুরের এপার ওপার করা। ৭৫ বছর বয়সেও তর্ক করে সাইকেল চালিয়ে ছেলেদের কাছে রসগোল্লা আদায় করত।ছেলেদের সাঁতার শেখাত।
আর ডেলা দিদি ; তার মতো ধাই মা তখন আর কেউ ছিলনা। ধাই মা বললেই  সেই দলুই পাড়ায় সুধাময়ী ধাত্রী। যথেষ্ট অভিজ্ঞতা ছিল।মায়ের কাছ থেকেই কাজ শিখেছিল। তরীবালা যথেষ্ট অভিজ্ঞ ছিল। নানা ভেষজ ওষুধ জানত। মেয়েদের বাচ্চা আসছেনা কি গোপন গর্ভপাত কি প্রসব যন্ত্রনা কমানো র নানা জড়িবুটি জানত সে। সেখান থেকেই শিক্ষা সুধাময়ী র।
তার নির্দিষ্ট পরিমান জানত। সামনেই জঙ্গল। সেখান থেকেই সংগ্রহ করে আনত লতা গুল্ম। এই জ্ঞান কে আমরা কাজে লাগালাম না। এই পরম্পরা বাহিত জ্ঞান কে আধুনিক বিজ্ঞানের আলোতে বিশ্লেষণ করে অনেক দামী কাজ করা যেতে পারত। আমাদের আধুনিক বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠান গুলির বা প্রশাসক দের আগ্রহই নাই।
শুধু চাকরি। মোটা বেতন।
ভোলাদাদু কিন্তু রোগভোগ বেশী করেনি। সামান্য এক দুদিনের অসুস্থতা। যাবার আগে বলেছিল ' আমাকে নিরামিষ রান্না করে দাও' '। সেই খেয়েই তার জীবন থেকে প্রস্থান। তবে শেষের দিকে খুবই অভাবে কেটেছিল  জীবন।  নিজের যন্ত্রপাতি গুলো ও বেচে দিতে বাধ্য হয়েছিল। তখন তো আর কাজ করার ক্ষমতা ছিলনা। প্রায় ভিক্ষুকের অবস্থা। অথচ এই অভাব ভোগ তার প্রাপ্য ছিলনা। কিন্তু হায় আমাদের সমাজ ব্যবস্থা! সামাজিক নিরাপত্তা বলে তো কিছু নাই। বার্ধক্যে দারিদ্রই সম্বল।
ডেলা দিদি তারপর ও বেঁচে ছিল বেশ কিছু বছর। যথেষ্ট ভুগতে হয়েছিল তাকে। শরীরের একদিক অসাড় হয়ে গিয়েছিল। সেবা যত্ন যথাসাধ্য করেছিল হারা দি বা তার ছেলে নাড়ু।
আমরা ভুলে গেছি এদের। বা মনে রাখার কি বা দায় এই স্বার্থমগ্ন সমাজের।
মা তরীবালা ; বাবা শচীনন্দন এর মেয়ে সুধাময়ী ধাত্রী
আর ভোলানাথের প্রেমকাহিনী  সেদিনের সমাজের রক্তচক্ষু কে উপেক্ষা করে  প্রেমকে মর্যাদা র আসনে বসিয়েছিল। সমাজের উপেক্ষা ছিল ; অবজ্ঞা ছিল ; কিন্তু তাঁরা দারিদ্রের সাথে ই মাথা উঁচু করে বেঁচেছিল।
গ্রামীণ সমাজে এই সব ধাত্রীমাতাদের অবদান কম ছিলনা। সমাজ সামান্য কিছু সম্মান তাদের যে করেনি তা নয়।
ছেলের অন্নপ্রাশন বা বিয়েতে তাদের আমন্ত্রন করা হত। ছেলের অন্নপ্রাশন এর থালার সাজানো সব খাবার প্রাপ্য ছিল এই ধাই মায়ের। তার সাথে শাড়ী ; কিছু টাকা তাদের দেওয়া হত।
এঁরাই তো একমাত্র ভরসা ছিলেন গর্ভবতী মহিলাদের। প্রসবের বেশ কিছুদিন আগে থেকেই গর্ভধারিণী র পরিচর্যা তাঁরা ই করতেন। আবার প্রসবের পরও কমপক্ষে এক মাস। তা ছাড়া নানা উপসর্গে তাঁদেরই ডাক পড়ত।
বাঁশের সুক্ষ ছিলা দিয়ে নাড়ি ছেদন করে তা মাটিতে পুঁতে আসার কাজ করা সেই ধাত্রীমাতারা একটা সময়ের প্রতিনিধি। যা উপেক্ষণীয় কিছুতেই নয়।
ধাত্রী পান্না রা ছিলেন।ধাত্রী বললেই যে নাম মনে এসে যায় প্রথমেই। কিন্তু আমাদের এই গাঁ ঘরে আমাদের ধাত্রী মা রা ও ছিলেন।
আজ তাঁরা  ইতিহাস।
  সে ও ভোলার নয়।

ভোলানাথ সূত্রধর। আদি বাড়ি আদুরিয়া অমরপুর।
   পিতা মাতা : জানতে পারা যায়নি।
সুধাময়ী ধাত্রী (দলুই) : পিতা। শচীনন্দন (শশী)
   মাতা। তরীবালা বা তরুবালা দলুই
হরিদাসী দলুই। এখন বয়স ৭২ বছর। পিতা :
  মাতা : ভবানী দলুই পিতা সিদ্ধেশ্বর
নাড়ু দলুই। এখন বয়স ৫১। পিতা : নবকুমার দলুই।
মাতা : হরিদাসী দলুই।
এই দলুই পাড়ার প্রাচীন মানুষ এই শচী ; শশী ; কর্ণ ; কুমা বা কুমাই দলুই রা। আর কেউ বেঁচে নেই। কিছুদিন পরে আর কিছু বলার মতো আর কেউ থাকবে না।
  গ্রাম। অযোধ্যা। পো। বনকাটি। থানা। কাঁকসা। জেলা প বর্ধমান।

আমি যে এই মাটিতে জন্মেছি

শুনুন। শুনুন
আমি এই মাটির মানুষ। জন্মেছি এই রাঢ় মাটিতে। অজয়ের কুলে
জল জঙ্গলের দেশের মানুষ।
ছোট থেকেই ঘুরে বেড়াই একা একা। হেঁটে হেঁটে বা 
বড় হলে  সাইকেলে।
যখন ছোট পাহাড় তো দেখিনি। অথচ ভূগোল বইয়ে পড়ি।
তো আমার গাঁয়ে ' বেণে পুকুরের " উঁচু পাড়ে উঠে ভাবতাম এই বুঝি পাহাড়।
দাদু গল্প বলতেন হিউয়েন সাঙ হেঁটে আসছেন পামির মালভূমি র উপর দিয়ে। মরুভূমি র মধ্যে দিয়ে।
আমার গাঁয়ের পশ্চিমে মোরাম চাতাল। উঁচু নীচু খোয়াই। খাদ। বর্ষায় প্রবল বেগে গিরি লাল জল নামে।
আমি হেঁটে বেড়াতাম সেই চাতালের উপরে।সেই চাতাল ই আমার পামির  
বৃষ্টি বন্ধ হলেই দে ছুট।
দেখতে হবে না জলের ছুটে যাওয়া
' মাতা মা ' সাথে করে নিয়ে যেত জঙ্গলে। লতা পাতা চিনতাম। এই বৈষ্ণবী আমাকে কোলে পিঠে মানুষ করেছে। কত ওষুধের গাছ লতা পাতা চিনেছি তার কাছ থেকে। 
শাল পাতা পচে ছাতু ফোটে। কত রকমের ছাতু।
কোনটা খায়। কোনটা খায়না-
মাটির নীচে ফোটে ' কুড়কুড়ে ' গোল গোল ছাতু। 
তুলতে যেতাম। মা মানে মাতামা র সাথে। আহা কি স্বাদ। উই ঢিবির উপরে ছাতু। খড়ের 'পোয়াল ' গাদায় ছাতু।
তার ঝাল। কি স্বাদ তার।
এই জঙ্গল ই আমার কাছে কঙ্গো র জঙ্গল।
এই অজয় ই আমার আমাজন। কি ভীষণ বর্ষায় তার বেগ।
' নামো পাড়া '। মানে গাঁয়ের উত্তর পশ্চিম দিকের মরে যাওয়া ' পোড়ো ' গ্রাম। অজয়ের বন্যায় আর 
 ম্যালেরিয়া ; কলেরায় সেই বড় গাঁ কবেই শেষ হয়ে গেছে। পড়ে আছে  কত না মাটির ঢিবি। গলে ক্ষয়ে যাওয়া তবু টিঁকে থাকা দেয়ালের কোনা। 
তার মনে হত এই তার ' মহেঞ্জোদারো '। সেই ঢিবি গুলোর উপরে নির্জন দুপুরে ঘুরে বেড়ায়। 
 মনে সাধ -খুঁড়তে হবে। রাখালদাস -
একটু বড় না হওয়া পর্যন্ত " গড় জঙ্গল " এ ঢুকতে পারিনি। তখন ঘন ঘোর অরণ্যানী। দুর্গম।' আর ' আলকুশি'র জ্বলুনি।  ইছাইঘোষের দেউল। সন্ধ্যে নামলেই গো বাঘা দের জ্বলজ্বলে চোখ। মশাল জ্বালিয়ে লোক যায়। দামোদরপুরে ' হেঁড়োল বাঁধি'। 
 হেঁড়োল গুলো সব জল খায় এখানে। জঙ্গলে র ভিতরে  পুকুর। নাম তার ' চৌদল্লা'। চতুর্দোলা থেকে। এখন সেখানে যে ঢুকি - সাধ্য কার! 
জঙ্গলের ভিতরে আছে গ্রাম। গ্রাম নাম তার সরস্বতী গঞ্জ। ভাবুন একবার - গঞ্জ। আছে অনেক আদিবাসী পাড়া। নাম আলী নগর। ভাবুন নামটা।
 আছে। আছে। আছে বই কি অনেক কথা 
আছে 'রক্তনালা' টুমনী নদী। হ্যাঁ বর্ষায় একবার কুমির উঠে এলো। এখানে বেশ গভীর। 
আছে বাঁধে র গায়ে শত বর্ষে র ও বেশী প্রাচীন সব শিমুল। কি সব তাদের গোড়া। খাঁজে ভাঁজে বড় তাঁবু। পাঁচ ছ জন ঢুকে যাবে আরাম করে। 
আছে বিরাট " রাজার দিঘী ' 
গড় কেল্লা খেড়োবাড়ি। নামটা দেখুন
'গড় কেল্লা '। গড় মানেও দুর্গ। কেল্লা মানেও দুর্গ।
গড় কেল্লা।
সময় কালের ব্যবধান প্রায়  হাজার বছরের।
সে কথা অনেক  শুনে ছেন আমার কাছে। কথা আর কাহিনী তে মেশানো। না হয়  আবার শুনবেন। 
অনেক গল্প অনেকে শোনাচ্ছেন। শোনাবেন বই কি! 
আপনারা ও শুনবেন। 
কিন্তু
আমার গল্প কথা। সে আমার ই।
 ' যে জন জানে    সে জন ই জানে '

ইউসুফ ভাই ও গালা শিল্প

ইলামবাজার।  গালা শিল্প । অজিত গুঁই এবং তাঁর ছাত্র ইউসুফ ভাই  ও অন্যান্য কথা।
- --------৷ যাঁরা আমার ২৭/১১/২১ তারিখের সিউড়ি কর্মশালার কথা পড়েছেন। তাঁদের জন্য এবং নূতন দের জন্য। একটু ছড়িয়ে বললাম। 
 দেখুন ভালো লাগে কিনা! 

জয়দেব - কেন্দুলী ভক্তিভবন এর বন্ধু দের উদ্দেশ্যে এই পর্বটি নিবেদন করলাম।  -----------------------------------------------------------------------

আমাদের এক পা এপারে আর এক পা ওপারে।
মাঝে বয়ে যায় অজয়।
দু  বেলা পারাপার।
যখন অজয় সেতু ছিলনা ; তখন ছিল অস্থায়ী পারাপারের ব্যবস্থা। কিছুটা কাঠ বাঁশের সাঁকো। কিছুটা নৌকো। বাগুড়া
গ্রামের ভিতর দিয়ে মোরাম রাস্তা। নদী চর এর উপর দিয়ে
একেবারে সাঁকো পর্যন্ত।
  তারপর অজয় সেতু র উদ্বোধন হল ১৯৬২ সালে। মুখ্যমন্ত্রী
ডাঃ বিধান চন্দ্র রায় উদ্বোধন করলেন। বহু মানুষ দেখতে গিয়েছিলেন। সবার ই খুব আনন্দ। এপার আর ওপারের যে নিবিড় সম্পর্ক। বর্ষা য় পারাপার বন্ধ হয়ে গেলে বড় কষ্ট মনে।
মাতামা ; দিদিমা র কোলে চেপে বা গোরুর গাড়ি তে সেই কবেকার ছোট বেলা থেকে ইলামবাজার যাওয়া।
দল বেঁধে হেঁটে যাওয়াই ছিল বুঝি আনন্দ।
সিনেমা দেখতে যাওয়ার আনন্দে পথ হাঁটার কষ্ট হারিয়ে যেত।
  প্রথম সিনেমা হল চালু হয়েছে ইলামবাজারে।
  বলছি যখন বলেই নি - আমার স্মৃতি তে আছে একটা ঘটনা।
  সিনেমার নাম ' মরুতীর্থ হিংলাজ '।
  রাতের অন্ধকারে পথ হাঁটছে তীর্থযাত্রীর দল। মরুভূমি র উপর দিয়ে। স্ক্রিনে সেই অন্ধকার যাত্রা।
হলের দর্শক দের চিৎকার ' আলো কই। আলো দাও  হে '।
হট্টগোল। তারপর বোধ হয় মাইকে বলা হল 'রাতের দৃশ্য '।
এমন ই হবে। '
কিছু দর্শক বোধহয় বেরিয়ে গেল।
আমাদের বাড়িতে দাদু দিদিমার ততদিনে অবধূতের সেই বিখ্যাত  বই পড়া হয়ে গেছে। সে ও কিছুটা শুনেছে।
অ্যাটলাস এর ম্যাপ বই নিয়ে বসে যায় কোথায় হিংলাজ খুঁজতে। এটা তার খুব প্রিয় ছিল। খোঁজা। কত সাল কি জানি সে আর তার  মনে নাই। তবে চণ্ডীচরণ চট্টোপাধ্যায় কোম্পানির  সে ম্যাপ বই এখনও আছে। আহা কি সুন্দর ছিল
সে ম্যাপ বই।
যাই হোক অযোধ্যা জুনিয়র হাই স্কুল থেকে ক্লাস এইট পাশ করে ইলামবাজারে গেল ক্লাস নাইন থেকে পড়তে। সে তো আরেক কাহিনী। সাইকেল চাই। নাই। দাদু চিঠি লিখল বাবাকে। বাবা একমাস পরে একটা সেকেন্ড হ্যাণ্ড সাইকেল ;
কিন্তু ভালো কন্ডিশনের  এনে দিয়ে গেল। সেন র‍্যালে কারখানার পাশ দিয়ে এলেও সে সাইকেল ছিল হারকিউলিস।
  একটু উঁচু।  সে সব কথা ' কথা - সাতকাহন ' এ কোন এক পর্বে লিখেছে সে। 
এই এলাকা থেকে যেত তারা পাঁচ জন।
  অজয়ের নদী বাঁধ ধরে। সে বাঁক গুনতে গুনতে যেত আর বাঁধের গায়ে গায়ে প্রাচীন শিমুল গাছ গুলিকে গুনতে গুনতে।
  শতাব্দী প্রাচীন সে সব গাছ। বিপুল তাদের গুঁড়ির বিস্তার ; খাঁজ।
  ইলামবাজার হাই স্কুলের দোতালায় একেবারে পূব দিকের ঘরে ক্লাস নাইন। সে ছিল বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র। কিন্তু বাংলা ; ইংরেজি একসাথে। স্কুলের পিছনে গেরুয়া রঙের জলের পুকুর । তার নাম ' লরি পুকুর '। তার উত্তরে প্রাইমারি স্কুলের পিছনের পুকুর টির ও নাম ' লরি পুকুর '।পরে জেনেছে আরও আছে। মনে প্রশ্ন ' লরি পুকুর '। এমন নাম কেন?  বাস লরি জানে। তার সাথে কি সম্পর্ক! কারও কাছ থেকে তো জানতে হবে।  আরও বেশ কিছু দিন পরে মাষ্টার মশাই কিরীটী বাবুর কাছ থেকে জেনেছে ' লরি ' রা ছিল গালার কারবারি। গালার
জিনিস তৈরী র কারিগর। তারা কারা?  ' লরি ' বা ' নুড়ি ' কারা।  কেউ কিছু ই বলে না। কেমন যেন লুকোছাপা ভাব।
অনেক পরে জেনেছে ' গুঁই ' রা ' দাস ' রা 'পাল ' রা এরা সব
  'লরি '। এখন আর এরা কেউ' লরি ' বলে পরিচয় ও দেয়না।অথচ পাড়াটার পুরনো নাম ই লরি পাড়া। আর ' লরি ' দের নামে কয়েকটা ই পুকুর। 
আর পদবী বা পেশা সব বদলে নিয়েছে। এখানেও সেই জাতের প্রশ্ন। নীচু জাত। উঁচু জাত।জল   চল  অচল।  অথচ তার বেশ কয়েকজন বন্ধু রয়েছে  সেই পাড়ার। তাদের বাড়ি তে ও গেছে। কে আর সে পরিচয় দেয়। কেন ই বা দেবে। সদ্য যুবক প্রয়াত রাধাশ্যাম গুঁই
অঙ্কের শিক্ষক হিসাবে যোগ দিয়েছেন হাই স্কুলে। 
 অত্যন্ত ভালো মানুষ। শেষ জীবনে উদাসী বৈষ্ণবের মতো জীবন কাটিয়েছেন। 
এই গুঁই পরিবারের বিখ্যাত গালা শিল্পী গোপাল ও নেপাল গুঁই কে রবীন্দ্রনাথ নিয়ে গিয়েছিলেন শ্রীনিকেতন শিল্প সদনে গালা শিল্পের প্রশিক্ষক হিসাবে। তাঁদের ই উত্তর পুরুষ অজিত গুঁই।
তিনিও কিছুদিন প্রশিক্ষণ দান করেছিলেন। তাঁর ই প্রত্যক্ষ ছাত্র শ্রীনিকেতন সুরুলের মসজিদ পাড়ার শেখ ইউসুফ ভাই।
তাঁরা স্বামী স্ত্রী গালা শিল্পের গুণী শিল্পী। চমৎকার তাঁদের হাতের কাজ। বীরভূম আর্টিসানি নামক সংস্থা একদিনের প্রশিক্ষণ শিবিরের আয়োজন করেছিলেন। হাতে কলমে কাজ
শেখার জন্য। বেশ কয়েকজন শিল্পশিক্ষার্থী যোগ দিয়েছিলেন। সংস্থা র পক্ষে অভিষেক সেনগুপ্ত আমাকে বিশেষ ভাবে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়ে ছিলেন। বিশেষ আমন্ত্রিত ছিলেন ' রাঢ় ভাবনা ' পত্রিকার সম্পাদক মাষ্টার মশাই সৌরেন্দ্র নাথ  চট্টোপাধ্যায়। শিল্পী বিধান বিশ্বাস ছিলেন অন্যতম উদ্যোক্তা।
ইউসুফ ভাই এর কাজ দেখলাম সারা দিন বসে। এই প্রথম
হাতে কলমে কাজ দেখা। তিনি যখন তাঁর মাষ্টার মশাই অজিত গুঁই এর কথা বলছিলেন - কৃতজ্ঞতা ফুটে উঠছিল
তাঁর চোখ মুখে। আর আমি ভাবছিলাম - না ; মরেনি। ইলামবাজার এর গালা শিল্পী রা বেঁচে আছেন ইউসুফ ভাই এর মধ্যে। কিন্তু এই কাজ করে সংসার চলেনা তাঁর। তাঁকে টোটো ও চালাতে হয়। হায় রে। আমরা কি পারিনা সম্মিলিত উদ্যোগে
এই গালা শিল্প কে বাঁচাতে। পারিনা ইলামবাজারের ' চৌপাহারী' জঙ্গল ভূমির মধ্যে বাস করা আদিবাসী পল্লী গুলির ' স্বয়ম্ভর গোষ্ঠী ' গুলির মহিলা দের মাধ্যমে লাক্ষা কীটের চাষের দ্বারা  গালা র উৎপাদন করতে বা জেলা শিল্পদপ্তরের মাধ্যমে তা বাজার জাত করতে।
  ভেবেছি অনুরোধ জানাব ইলামবাজার ব্লক প্রশাসন কে ভেবে দেখার জন্য। আমার ধারণা প্রশাসন সচেষ্ট হলে এই প্রয়াস সার্থক রূপ পাবে।
-------------------------------------------------------- ©  প্রণব ভট্টাচার্য
  জীবন ই শ্রেষ্ঠ শিক্ষক।  জীবনই শিক্ষা অঙ্গন ।
    আজীবন ই আমি ছাত্র। মানুষের মাঝেই ছড়িয়ে আছে জীবনের প্রকৃত  শিক্ষা। সকল শিক্ষক কে আমার প্রণতি। সকল শিক্ষার্থী কে আমার ভালোবাসা।
------------ ------------ ------------ ------------ ------------ 
আমি কি আমার এই লেখার মাধ্যমে ইলামবাজার পঞ্চায়েত সমিতির মাননীয় সভাপতি এবং মাননীয় 
 বি ডি ও সাহেবের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারি। 
 এ আমার অনুরোধ। 
আমার ইলামবাজারের বন্ধুদের প্রতি অনুরোধ এই লেখাটি আমার 'আঞ্চলিক ইতিহাসের  সামান্য এক  চর্চাকারী' হিসাবে র পরিচয়ে  তাঁদের কাছে পৌঁছে দিন।
------------ ------------ ------------ ------------ ---------

Tuesday, 13 July 2021

।।কথা - সাতকাহন।। ২৮ অধ্যায়

।। কথা - সাতকাহন।। ২৮ অধ্যায়
ভবিষ্যতে এ ছেলেকে দেখবে কে। তার তো কোন আত্মীয় এখানে নাই। চাল চুলো কিছু নাই।   আত্মীয় স্বজনেরা একসাথে এখানে গ্রামের বাড়িতে 
 এলে থাকার খুব অসুবিধা হয়ে যায়।তখন নানা আত্মীয়ের এ বাড়িতে আসার চল ছিল। শ্রীচন্দ্রপুরের  শ্যামা ঠাকুমা রা আসতেন। তাঁর মেয়ে তরু মাসীকে নিয়ে।  নানা জায়গায় চালাঘরে বা বারান্দায় ভাগাভাগি করে থাকতে হত সবাইকে
মিলে মিশে  কখনও বা পশ্চিমে র একচালা বারান্দা ঘরে ও কাউকে  জায়গা নিতে হয়। উত্তর দিক থেকে সে চালাঘরে আবার মাঝে মাঝে সাপ এসে ও ঢোকে।  সেই ভয় নিয়েই
মাটিতে তাল পাতার চাটাই মানে তালাই কাঁথা পেড়ে ঘুমাতে হত । একসময় ঘুম আসে। এসেই যায়। এ নিয়ে কারও কোন ক্ষোভ বিক্ষোভ ছিলনা। 
কোন দুর্ঘটনা অবশ্য ঘটেনি কখনও। 
 দিনের দিকে অযোধ্যা থেকে অনেকে বেড়াতে আসত। দাদু দিদিমা মানুষ ভালো বাসে। কেউ রাতে ও থেকে যেত। গল্পে গল্পে রাত বেড়ে যেত। 

এই গ্রামে তার একটা মাটির ঘরের জন্য উপযুক্ত জায়গা আর মিলছেনা। যে কটা জায়গা দেখা হচ্ছে সব জায়গা তেই
বাধা আসছে।
শেষ পর্যন্ত ডাকবাংলো র ধারে কিছুটা খাস জায়গা আর কিছুটা বনকাটির রায় দাদুদের জায়গা মিলিয়ে তিন কাঠা জায়গা র উপরে একটা ঘর তোলার পরিকল্পনা হল।
এ পাড়া থেকে ওপাড়া। পূর্ব বাউড়ী পাড়া।
এখন ভাবে ওখানে কি থাকা যেত! না সম্ভব ছিল। কিন্তু তখন
এসব ভাবনা কি কারো মাথায় আসেনি।
টাকা কোথায়?  যে ঘর তুলবে।
সে এথোড়া বাড়ি কে গেল। পৈতৃক বাস্তুভিটা টুকু  কাকা জ্যাঠা দের সমান করে ভাগ করে কিনে নিতে বলল।
  তাঁরা রাজি হলেন। স্ট্যাম্প পেপারে লেখা হল। সামান্য কিছু টাকা হাতে নিয়ে সে ফিরল। সেই টাকা তেই শুরু হল ভিত কাটার কাজ। দক্ষিণ মুখী বৈঠক খানা র মতো একটা ঘর।
মাঝে সিঁড়ি। ওপারে আর একটা ঘর। মূল ঘর পূর্ব মুখী।
  ঘরের কাঠামোর জন্য তাল গাছের কাঁড়ি চাই। দাদু  চেয়ে চিন্তে তিনটে তালগাছ জোগাড় করল। কলিমউদ্দিন সেলিমুদ্দিন দুই ভাই তাকে ফেড়ে চেঁছে বানিয়ে দিল কাঠামো
তোলার উপযুক্ত করে। যৎসামান্য পয়সার বিনিময়ে। এরা পরেও তার আরও উপকার করেছে। দেয়াল তুলল বেশ কয়েকজন মিলে।  কাঠামো তুলল দিদিমার বাপের বাড়ি র
অমূল্য মিস্ত্রি আর বনকাটির বাদল বনমালী দের বাবা মদন মিস্ত্রী।
খড়ের ছাউনি। ছাউনির নিচে শরকাঠির পাকানো গোছা - 'গুরুল'। কড়িকাঠের উপর মোটা করে এই গুরুল পেতে তার উপর মাটি লেপে উপর কোঠা। তখন এমনটা হত।দপদপ করত।  পাতনের জন্য মোটা কাঠের পাটা কোথায় আর পাওয়া যাবে।
বিল্ল্বেশ্বর বাগদী ঘরের দেয়াল ঘষে মেজে ' খড়ুটি ' করে দিল। বড়ো ভালো মানুষ ছিল। নানা রকমের কাজ জানত।
অল্পস্বল্প রাজমিস্ত্রী র ও কাজ।
  বাকি টাকা আনার জন্য বেশ কয়েকবার এথোড়া যেতে হয়েছে। কখনও বা খালি হাতে ফিরতে হয়েছে। অথচ যাতায়াতের খরচ আছে। ঐ টিউশনি র টাকা।
ঘর একটা দাঁড়াল বটে। কিন্তু এপাড়া ওপাড়া সংসার নিয়ে টানাটানি করা কি আর যায়। সীমানা প্রাচীর হয়নি। যা ভবিষ্যতে আর হবে না। বা ঐ ঘরে বসবাস ও হবে না। পৈতৃক ভিটা টুকু গেল মাত্র। অবশ্য থাকলেও কি তার থাকা হত ওখানে। 
  চারদিকে উইপোকার ঢিবি। কয়েক দিন গ্রামের কিছু ছেলে কে নিয়ে ওই ঘরে বসে পড়ায়। কোন রকমে একটি দরজা বসেছে। জানালার ফাঁকে বাঁশের কঞ্চি গোঁজা। দু এক দিন প্রায় সমবয়সী গরীব মানুষের ছেলেদের নিয়ে সন্ধ্যায় বা রাত্রে বসে। নানা আলোচনা ; গল্প হয়। ব্যস ; বড় জোর এই টুকু ই। রাত্রে আর থাকা হয়নি কখনো সেই ঘরে।থাকার মতো অবস্থা ও ছিলনা। কেননা মামারা চলে যাবার পর আবার বৃদ্ধ  দাদু দিদিমা একা। দেখতে তো সে ই। সাংসারিক এবং পারিপার্শ্বিক  এক বিশেষ পরিস্থিতি তে এই ঘর তোলা হয়েছিল। 
  ইতিমধ্যে পশ্চিম বঙ্গে রাজনৈতিক পালা বদল ঘটে গেছে।
সিদ্ধার্থ বাবুর জমানার কালো দিন মুছে নতুন দিন এসেছে।
  এসেছে বামফ্রণ্ট। পশ্চিম বঙ্গের ইতিহাসে এক অতি গুরুত্বপূর্ণ বাঁক বদল। জ্যোতি বাবু ঘোষণা করেছেন রাইটার্স থেকে রাজ্য পরিচালিত হবেনা। ক্ষমতা র বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে।  পঞ্চায়েত গঠিত হবে।  এই সময়ের কথা আলাদা ভাবে অন্য অধ্যায়ে  বলতে হবে।
'৭৮ এর অজয়ের প্রলয়ঙ্করী বন্যা। শত শত মানুষ গৃহ হীন।
মুলতঃ পূর্ববঙ্গীয় মানুষেরা যাঁরা নদী চর ; মানায় বাস করতেন। বসুধা সম্পূর্ণ ভেসে গেছে।  ভেসে যাওয়া মানুষ কে
উদ্ধার করতে আখের রস সিদ্ধ করার যে ' ডেঁক ' সে নিয়েই
বনকাটি র নিমাই সমাদ্দার রা জলে নেমে পড়েছে। সে ছিল অসম সাহসী।
অযোধ্যা হাই স্কুলের কোন রুম আর ফাঁকা নাই। শরণার্থী তে
ভর্তি। তাদের জন্য যথাসম্ভব শুকনো খাবার জোগাড় করা হয়েছে। কো- অপারেটিভ বিল্ডিং এর চত্বরে বিরাট বিরাট
কড়াই এ খিচুড়ি চেপেছে। প্রয়াত মোহন চ্যাটার্জি র নেতৃত্বে
ওদিক টা দেখা হচ্ছে। অনেকে স্বেচ্ছাসেবক এর দায়িত্ব পালন করছেন। রান্না শালা সামলানোর জন্য অনেক কে যুক্ত করা হয়েছে। আবার ভাণ্ডার সামলানোর জন্য দুজন পাকা লোককে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।  পানাগড় থেকে নেতৃত্ব স্থানীয় রা মাঝে মাঝে এসে খোঁজ খবর নিয়ে যাচ্ছেন। ত্রান সামগ্রী নিয়ে আসছেন কর্মী বাহিনী। স্বেচ্ছাসেবক রা।
গবাদি পশুদের জন্য খড় জলের ব্যবস্থা হয়েছে। বাচ্চাদের দুধ। ওষুধ। চিকিৎসক। অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও নানা ভাবে সাহায্য করছেন।  এই পরিস্থিতি সামলে ওঠা সহজ কথা
ছিলনা। ছোট খাটো বিতর্ক ; মনোমালিন্য ; বা ক্ষোভ বিক্ষোভ যে দেখা দিচ্ছে না তা নয়। বিনোদ মণ্ডল একদিন বেশ জোর গলায় বিলি বন্টন নিয়ে প্রতিবাদ করল। সাতকাহনিয়া র মানুষ দের ঘর দোর যায়নি। কিন্তু চরম অভাব। শর আর খড় দিয়ে
ছাওয়া ঘরের ভিতর আর কারো শুকনো নাই।ত্রিপল দরকার।  কেরোসিন তেলের হাহাকার। আমাদের নিজেদের ঘরে ও নাই।
হাফ প্যান্টের উপর গামছা বেঁধে হাতে লাঠি নিয়ে কেরোসিন তেল আনতে   সে আর কানু যাচ্ছে ইলামবাজার। তখন জল অনেক নেমে গেলেও কোথাও কোথাও হাঁটু জল আবার সাঁতার জল। বসুধা পার হওয়া দুষ্কর। তবু পার হয়েছে।
ইলামবাজার এ কানুর শ্বশুর মশাই প্রয়াত শ্রীধর পাল মশাই
পাঁচ লিটার  তেল জোগাড় করে দিলেন। ইলামবাজার হাই স্কুল বিল্ডিং এও বন্যা দুর্গত মানুষদের আশ্রয় শিবির। সেখানেও একই ব্যবস্থা করেছেন ওপারের কর্মী বাহিনী।
সাবধানে তেল  আনতে হচ্ছে। পাকা রাস্তা র উপর দিয়ে বড় বড় মাছ পেরিয়ে যাচ্ছে। লাঠি দিয়ে দু টো মেরে কোন রকমে তালপাতা দিয়ে ঝুলিয়ে ডাঙ্গাল হয়ে বাড়ি এসেছে।
পাড়া প্রতিবেশী দের লম্ফ জ্বলার মতো একটু একটু করে
দিতে হয়েছে। এক দল মানুষ কে নিয়ে কো অপারেটিভ বিল্ডিং এ যাওয়া হল। যাদের ঘরে খাবার নেই তারা এখানে খাবে। ব্যবস্থা হল।
  গুসকরা মোড়ে র কাছে অনেক মানুষ ; স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা
খাবার ; পোষাক দুর্গত মানুষ দের হাতে তুলে দিচ্ছেন।
অনেকে গুসকরা রাস্তা ; মোরাম চাতালের উপর উঠে এসেছিলেন। মূলতঃ তাঁরা ই আর বসুধা বিলপাড়ার মানুষ রা
এই সাহায্য পেয়েছিলেন।
সে কি ভয়ংকর  দিন রাত। এখনো মনে পড়লে গায়ে কাঁটা দেয়। জল বাড়ছে। তবে এই রূপ নেবে তা ভাবা যায়নি।
মাটির বাঁধ এককিলোমিটার ভেঙ্গেছিল। সাতকাহনিয়া য়।
সে কি কাজে ইলামবাজার গিয়েছিল। ফেরার সময় দেখে বাঁধের গোড়ায় জল। বাঁধ যেন কাঁপছে।
  পূর্ব দিকটা ধূ ধূ সাদা। কমপক্ষে এক হাজার বিঘা দোফসলি জমি গড়ে তিন ফূট বালি চাপা পড়ে গেছে। কত চাষির লম্বা লম্বা আখ ছিল। আরও কত ফসল। আর মৃত গবাদি পশুর
দেহ ছড়িয়ে আছে সর্বত্র।বসুধা বরুল  বিল মাঠে সব চেয়ে
বেশী।
  জল বেশ দ্রুত ই নেমে গিয়েছিল। নীচে আরও দু তিন জায়গায় ভেঙ্গেছিল। এগারো মাইল গুসকরা মোড়ে গিয়ে
দেখা পেল আকুলিয়ার মানুষের। কি খবর। না মোটামুটি সব ঠিক আছে। হ্যাঁ গো ক্ষুদু দের কি খবর।  না। ঠিকই আছে।
কালিকাপুর ঠিক আছে। মৌখিরা র একতলা বিশিষ্ট ঘর জলে ভরে গিয়েছিল। সব মানুষ  জমিদার বূড়ো বাবু দের দোতালা দালান ঘর গুলো তে  আশ্রয় নিয়েছিল। সে প্রায় কম পক্ষে শ দুয়েক মানুষ। দুর্গাদালান জলে ভর্তি। প্রতিমার কাঠামো কোমর জলে দাঁড়িয়ে  আছে।
   ১০ ই আশ্বিন।বুধবার  দিন  তারিখ টা বুকে গেঁথে আছে এই এলাকার মানুষের। আশ্বিনে বৃষ্টি নামলে সেই ভয় আজও তাড়া করে।
  ----------- ----------- ----------- ----------- ------- ©  প্রণব ভট্টাচার্য
( খড়ুটি ' মানে হচ্ছে মাটির দেয়ালের উপর বালি মাটি দিয়ে প্লাষ্টার। কর্ণিক  এবং ঘষার পাটা দিয়ে  সমতল করন) 
গুরুল  - পাকা শর কাঠি দশ বারোটা আঁটি করে খড় দিয়ে বাঁধা। যেমন মাপ তেমন জুড়ে জুড়ে করা যায় 
ডেঁক  - আখের রস সিদ্ধ করার বড় কানা ওয়ালা গোলাকার পাত্র

Sunday, 11 July 2021

।।কথা - সাতকাহন।। ২৬ অধ্যায়

।। কথা - সাতকাহন।। ২৭ অধ্যায়
  একটা সম্পর্ক। ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে।
   সহজেই কি তাকে মুছে ফেলা যায়! 
  হয়তো পুরোপুরি মুছে ফেলা যায়না। কিছু দাগ থেকে যায় ই।
বোলপুর বা ইলামবাজার কে সে ভুলতে পারেনা। অনেক স্মৃতি
জড়িয়ে আছে। অনেক কথা বাকী থেকে যাবে।
বোলপুরের পাক দেওয়া সিঁড়ি ওঠে দোতালার ঘরে বসে কত
রাজনৈতিক আলোচনা। তাত্ত্বিক তর্ক বিতর্ক।
একদিন মাষ্টার মশাই আছেন। আরও নেতারা আছেন।
হরশঙ্কর বাবু আছেন। তিনি তখন বোলপুর এর বিধায়ক।
পণ্ডিত মানুষ। আমাদের এত সহজ ভাবে মার্ক্সীয় অর্থনীতি ;
সমাজ নীতি বোঝাতেন। ঐ মেঝের পাতা চাটাই এর উপরে বসেই। আমরা ছাত্র। তাঁর পাঠ্যপুস্তক অনেকেই পড়েছেন।
একদিন আমিই মৃদু গলায় প্রশ্ন তুলেছিলাম একটা কমিউনিস্ট পার্টির কি কংগ্রেস এর মত দলের সাথে হাত মিলিয়ে চলা উচিৎ!  উত্তর প্রত্যাশিত। দেশে দক্ষিণ পন্থী দের
প্রভাব থেকে দেশ কে বাঁচাতে হবে। তারা দ্রুত উঠে আসছে।
কংগ্রেসের ভিতরে তারা যেমন রয়েছে যাদের সাথে দক্ষিণ পন্থী দের ভালো সম্পর্ক। আবার বিপরীতে একটা প্রগতিশীল
গণতান্ত্রিক অংশ রয়েছে। এরা নেহেরু র সমাজতান্ত্রিক মডেলে  বিশ্বাসী। এই অংশের সাথে কমিউনিস্ট দের সম্পর্ক রাখতে হবে। কৌশল গত কারনে ই। 
'৭০ এর শেষ দিক থেকে এখানে আসা। বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধ এর সেই অসম লড়াই ; মুক্তিযোদ্ধা দের প্রাণ বলিদান
এখান থেকে বসে বসে শুনেছে। শুনে উদ্বেলিত হয়েছে - দেবদুলালের সংবাদ পরিবেশন বা ভাষ্যপাঠ কে। তিনি তাঁর
ঐ দুর্লভ কণ্ঠস্বরে একে এক অন্য মাত্রা দিয়েছিলেন।
পাক বাহিনীর নির্মম পাশবিক অতাচার ; গণহত্যা। তার বিরুদ্ধে  এক জাতির মরণপন লড়াই। যার শুরু ভাষা আন্দোলন দিয়ে। বাঙ্গালী জাতির জন্য গর্ব হয়।
মনে প্রশ্ন জাগে শুধু নয় ঘৃণা হয়।  আমেরিকা বা চীনের পাকিস্তান কে সমর্থন
  প্রশ্নে। ভারতীয় সেনা বাহিনী ঢুকেছে পাকিস্তান আর্মি র সাথে লড়াই এ। মন সমর্থন করেছে। ইন্দিরা গান্ধী র প্রতি শ্রদ্ধা জেগেছে। ভারতের স্বাভাবিক বন্ধু সোভিয়েত রাশিয়ার নৌ বহর এগিয়ে আসছে। খুশী হয়েছে দু পারের মানুষ।
  স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে। কি আনন্দ। কি আনন্দ আমাদের মতো ছেলেদের মনে।
' বাঙ্গালী ' এই বোধ আমার ভিতরে ছোট থেকেই কাজ করে।
  বাংলাদেশ একবার গেছি। বাংলা ভাষায় চারদিক ভরা।
কি যে আনন্দ হয়। সে তো অন্যকে বোঝানো যাবেনা।
  তেপান্তর নাট্য গ্রামে বাংলাদেশের এক নাটকের দল এসেছিল একবার। পাশাপাশি বসে গল্প করছি আমরা। খাবার সময় এলো। এক ভদ্রলোক পকেট থেকে সুগারের ওষুধ বের করলেন।
ওষুধের গায়ে বাংলায় লেখা গ্লিবিজাইড। মেটফরমিন।
বাংলা য় লেখা দেখে কি আনন্দ যে হল।
কোন ব্র‍্যাণ্ড নাম নেই। আমি ও সুগারের রোগী। দীর্ঘ দিন ওষুধ খাই। আমি জিজ্ঞেস করলাম একটু পুরনো দিনের মানে এখন তো অনেক নতুন ওষুধ। নতুন জেনারেশন। এই ওষুধ নিচ্ছেন।
  বললেন স্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে ই বিনামূল্যে পাওয়া যায়। কম দামের ওষুধে ই যদি কাজ হয়। বুঝতেই পারছেন গরীব দেশ।
  আর এদেশে লক্ষ লক্ষ ব্র‍্যাণ্ড। কোটি কোটি টাকা নিয়ে যায়।
  এমন এত বড় বিশাল উন্মুক্ত ' লুঠ ক্ষেত্র '।
বোলপুরের ঐ পার্টি অফিস  থেকে শিখেছি অনেক।  রাজনৈতিক সচেতনতা বেড়েছে। মনীষা গ্রন্থালয় থেকে অনেক পেয়েছি। হীরেন্দ্র নাথ মুখোপাধ্যায় ; 
  পণ্ডিত ; আমি মনে করি কমিউনিস্ট আন্দোলনে এমন পণ্ডিত আর এসেছেন কি না! তাঁর 'তরী হতে তীর ' পড়ে মুগ্ধ হয়েছি।
  রাহুল সাংকৃত্যায়ন পড়েছি আর অবাক হয়েছি এই জীবন
পথিকের জীবন দর্শনে। আর যত মৌল পাঠক্রম। রাশিয়ান শিল্পী দের আঁকা ছবি র বই  আমার শিল্প চেতনা কে সমৃদ্ধ করেছে।
   এই অফিসে বসেই যতদুর মনে পড়ে মুজিব হত্যার ঘটনাও
  শুনেছি।
জরুরী অবস্থা ঘোষিত হয়েছে। মানতে পারছিনা। তর্ক হচ্ছে।
এই অফিসে বসে ই নেতাদের সাথে। না কোন কমিউনিস্ট পার্টির  পক্ষে এটা মানা অসম্ভব বলে মনে হয়েছে। নানা প্রশ্ন।
   জয়প্রকাশ আসছেন। বিরোধিতা করা হচ্ছে। ব্যঙ্গ চিত্র আঁকতে হচ্ছে। স্টেশন এর একটা দেওয়ালে। আঁকছি।  মনে  কিন্তু নিয়ে ই আঁকছি।
  গোপাল দার হোটেলে খেয়ে  কিছু এলেমেলো ঘোরাঘুরি করে
আমাদের কয়েক জনের সারা রাত আলোচনা। আমি ই আলোচক। আমরা ছেলেরাই থাকি। ছোট্ট ঘর। 
  আজ আর কার কাকে মনে আছি জানি না। তবে সবাই ভুলে যাননি। শেষ বার শান্তি নিকেতন পৌষ মেলায় ছোট্ট স্টল দেওয়া হয়েছে। সেই সব বই তো আর নাই।
- আসুন।
- কি চিনতে পারছেন আমাকে। অনেক দিনের ব্যবধান।
ইলামবাজার বলাতেই চিনলেন। ' আরে ভাই এসো। এসো '
স্বীকার করলেন অস্তিত্বের ই সংকট। বসলাম।
  বাম গণতান্ত্রিক একত্রিত আন্দোলন ই পথ।
কেন যে সব লাল ঝাণ্ডা কর্মসূচি ভিত্তিক  একত্রিত হতে পারেনা। রাষ্ট্রের শ্রেণী চরিত্র বিশ্লেষণের এত কচকচি।
  না হয় শূন্য থেকে ই শুরু করতে হবে।
আর একবার ইলামবাজারে দুই জেলার যুক্ত সভা। বামফ্রন্টের। ইলামবাজারের সি পি আই এম নেতাদের সাথে আমার যথেষ্ট জানা চেনা বন্ধুত্ব। বর্ধমানের জেলা নেতারা আছেন। সভা শেষে একজায়গায় বসে গল্প হচ্ছে। বীরভূমের
সি পি আই এর জেলা সম্পাদক অপূর্ব মণ্ডল। একদিন একসাথে কাজ করেছি।কিন্তু  অনেক দিনের অদেখা।
- কি অপূর্ব দা আমাকে চেনা যায়। আমি প্রণব।
- আরে ভাই। তোমাকে কি ভোলা যায়। কি  ; কেমন আছো ইত্যাদি। যাঁরা আমার অতীত টা জানেন না তাঁরা কিছুটা অবাক।
এই যে। কোথাও একটা অতীত  সম্পর্ক বেঁচে থাকে।

  ক্রমাগত বৈষম্য বাড়ছে। আরও বাড়বে। পুঁজি র দাপট আরও  বাড়বে। মানুষ নিষ্পেষিত হয়ে যাবে। এত এত শিক্ষিত বেকার। আগামী দিন আরও ভয়াবহ। মানুষ অসহায়। এত অসহায়তা বোধ হয় আগে কখনো দেখা যায়নি। নানা স্তরীয়
অর্থনৈতিক বৈষম্য। সামাজিক অর্থনৈতিক নানা স্তর এই সময় কালে সৃষ্টি হয়েছে। আমি কোন সমাজ বিজ্ঞানী বা বোদ্ধা কেউ নই। আমি শুধু  যা দেখছি তা কোন এক পর্বে বলব।

  মুক্তি বার্তা কিন্তু সেই লাল ঝাণ্ডা য়। কাস্তে হাতুড়ি তেই।
যুবক যুবতী রাই ভবিষ্যৎ। সামনে তোমাদের অনেক অনেক  অনেক বড় লড়াই।গণতান্ত্রিক পথেই  সে লড়াই পরিচালনা করতে হবে। 
  রাষ্ট্র শক্তি র বিরুদ্ধে অনিবার্য লড়াই। আমি জানিনা তার রূপ কেমন হবে। 
পৃথিবীর সব রাষ্ট্রশক্তি বা তাদের প্রধানের হাতেই ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। ছদ্ম স্বৈরাচারী। শাসকের বজ্রমুষ্ঠি ক্রমাগত শক্ত হচ্ছে। পৃথিবী যেন ক্রমাগত দক্ষিণে হাঁটছে। ভবিষ্যৎ বড়ই কণ্টকাকীর্ণ। 
আজ রাষ্ট্র পরিচালনা য় সেই পুরনো দিন কবেই হারিয়ে গেছে।  আজ বাণিজ্য নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা। অন্য কোন আদর্শ
সোভিয়েতের পরে নেই। ব্যতিক্রম  কিউবা। তার মানবিক মুখ দেখা যায়  ল্যাটিন আমেরিকার দেশ গুলিতে অন্তত স্বাস্থ্য পরিষেবার সাহায্য নিয়ে। সারা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ স্বাস্থ্য ব্যবস্থা তার।
  এ সমাজ মানুষের ই রচনা। সাধারণ মানুষ আজ গৌণ।
   তবু্ও মানুষ। মানুষের ভিতর থেকে প্রতিবাদী সত্তাকে শোষণ করে নেওয়া হচ্ছে প্রতিদিন।
  মানুষ তবুও জাগবে। পথ ই পথ দেখাবে। প্রতিবাদী মানুষ
পথে নামবেই। ভবিষ্যতে লড়াই অনিবার্য।
----------- ----------- ----------- ----------- -----------

তবু একদিন সংযোগের সব সুতো ছিঁড়ে যায়।
খুব কষ্টে ই।
বীরভূমের স্থায়ী বাসিন্দা না হলে আমার কাজ কি মূল্য পাবে। ভাবি। আর কর্মসূচি ছাড়া কি সংগঠন বাঁচে।
অনেক কথাই মনে পড়ে। সিউড়ি অফিস ঘরটা। আমরা কয়েকজন সদ্য যুবক থাকতাম। লালচাঁদ ফুলমালী আসতেন।
তিনি তখন এম এল এ। এসেই অফিস বারান্দা সব ঝাঁট দিতে আরম্ভ করতেন। ডাঃ শরদীশ রায়ের উঁচু ধাপের চেম্বারের পাশ দিয়ে যেতাম। উনি থাকলে উঁকি দিতাম।  ফাঁকা থাকলে দু'একটা  কথা।
অন্য মনের মানুষ। সংকীর্ণতা ছিলনা।
মোরব্বা মিষ্টান্ন ভাণ্ডার এর আদি দোকানে আমাদের সকালের জলখাবার হত। খুব চেনা হয়ে গিয়েছিল বৃদ্ধ মানুষ টির সাথে। সেই বিশাল বিশাল তেঁতুল গাছ তলা হয়ে যে রাস্তা চলে গেছে নীচের দিকে। জেলখানার উঁচু প্রাচীর।
কোন কোন দিন বেড়াতে যেতাম ম্যাসাঞ্জোরের ব্যারেজের দিকে। কোন দিন করিধ্যা। বড় রসগোল্লা।
আবার কোনদিন তালতলা র ধার ধরে স্টেশনে র দিকে।
চুপচাপ স্টেশনে বসে বসে ভাবতাম। নির্জন স্টেশন আমার খুব ভালো লাগে। কি যেন ভাবতাম আমরা ; মনে আছে আর তোদের। কি জানি আমাকে ই আর মনে আছে কি না।
হাসিম ; সুনীল।  আজ আর কারও মনে নেই  কি যেন ভাবতাম।
----------- ----------- ----------- ----------- © প্রণব ভট্টাচার্য
নেট থেকে সংগৃহীত মার্কসের এই ভাস্কর্য। বাণিজ্যিক ব্যবহার নিষিদ্ধ

।।কথা - সাতকাহন।। ২৭ অধ্যায়

।। কথা - সাতকাহন।। ২৭ অধ্যায়
  একটা সম্পর্ক। ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে।
   সহজেই কি তাকে মুছে ফেলা যায়! 
  হয়তো পুরোপুরি মুছে ফেলা যায়না। কিছু দাগ থেকে যায় ই।
বোলপুর বা ইলামবাজার কে সে ভুলতে পারেনা। অনেক স্মৃতি
জড়িয়ে আছে। অনেক কথা বাকী থেকে যাবে।
বোলপুরের পাক দেওয়া সিঁড়ি ওঠে দোতালার ঘরে বসে কত
রাজনৈতিক আলোচনা। তাত্ত্বিক তর্ক বিতর্ক।
একদিন মাষ্টার মশাই আছেন। আরও নেতারা আছেন।
হরশঙ্কর বাবু আছেন। তিনি তখন বোলপুর এর বিধায়ক।
পণ্ডিত মানুষ। আমাদের এত সহজ ভাবে মার্ক্সীয় অর্থনীতি ;
সমাজ নীতি বোঝাতেন। ঐ মেঝের পাতা চাটাই এর উপরে বসেই। আমরা ছাত্র। তাঁর পাঠ্যপুস্তক অনেকেই পড়েছেন।
একদিন আমিই মৃদু গলায় প্রশ্ন তুলেছিলাম একটা কমিউনিস্ট পার্টির কি কংগ্রেস এর মত দলের সাথে হাত মিলিয়ে চলা উচিৎ!  উত্তর প্রত্যাশিত। দেশে দক্ষিণ পন্থী দের
প্রভাব থেকে দেশ কে বাঁচাতে হবে। তারা দ্রুত উঠে আসছে।
কংগ্রেসের ভিতরে তারা যেমন রয়েছে যাদের সাথে দক্ষিণ পন্থী দের ভালো সম্পর্ক। আবার বিপরীতে একটা প্রগতিশীল
গণতান্ত্রিক অংশ রয়েছে। এরা নেহেরু র সমাজতান্ত্রিক মডেলে  বিশ্বাসী। এই অংশের সাথে কমিউনিস্ট দের সম্পর্ক রাখতে হবে। কৌশল গত কারনে ই। 
'৭০ এর শেষ দিক থেকে এখানে আসা। বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধ এর সেই অসম লড়াই ; মুক্তিযোদ্ধা দের প্রাণ বলিদান
এখান থেকে বসে বসে শুনেছে। শুনে উদ্বেলিত হয়েছে - দেবদুলালের সংবাদ পরিবেশন বা ভাষ্যপাঠ কে। তিনি তাঁর
ঐ দুর্লভ কণ্ঠস্বরে একে এক অন্য মাত্রা দিয়েছিলেন।
পাক বাহিনীর নির্মম পাশবিক অতাচার ; গণহত্যা। তার বিরুদ্ধে  এক জাতির মরণপন লড়াই। যার শুরু ভাষা আন্দোলন দিয়ে। বাঙ্গালী জাতির জন্য গর্ব হয়।
মনে প্রশ্ন জাগে শুধু নয় ঘৃণা হয়।  আমেরিকা বা চীনের পাকিস্তান কে সমর্থন
  প্রশ্নে। ভারতীয় সেনা বাহিনী ঢুকেছে পাকিস্তান আর্মি র সাথে লড়াই এ। মন সমর্থন করেছে। ইন্দিরা গান্ধী র প্রতি শ্রদ্ধা জেগেছে। ভারতের স্বাভাবিক বন্ধু সোভিয়েত রাশিয়ার নৌ বহর এগিয়ে আসছে। খুশী হয়েছে দু পারের মানুষ।
  স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে। কি আনন্দ। কি আনন্দ আমাদের মতো ছেলেদের মনে।
' বাঙ্গালী ' এই বোধ আমার ভিতরে ছোট থেকেই কাজ করে।
  বাংলাদেশ একবার গেছি। বাংলা ভাষায় চারদিক ভরা।
কি যে আনন্দ হয়। সে তো অন্যকে বোঝানো যাবেনা।
  তেপান্তর নাট্য গ্রামে বাংলাদেশের এক নাটকের দল এসেছিল একবার। পাশাপাশি বসে গল্প করছি আমরা। খাবার সময় এলো। এক ভদ্রলোক পকেট থেকে সুগারের ওষুধ বের করলেন।
ওষুধের গায়ে বাংলায় লেখা গ্লিবিজাইড। মেটফরমিন।
বাংলা য় লেখা দেখে কি আনন্দ যে হল।
কোন ব্র‍্যাণ্ড নাম নেই। আমি ও সুগারের রোগী। দীর্ঘ দিন ওষুধ খাই। আমি জিজ্ঞেস করলাম একটু পুরনো দিনের মানে এখন তো অনেক নতুন ওষুধ। নতুন জেনারেশন। এই ওষুধ নিচ্ছেন।
  বললেন স্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে ই বিনামূল্যে পাওয়া যায়। কম দামের ওষুধে ই যদি কাজ হয়। বুঝতেই পারছেন গরীব দেশ।
  আর এদেশে লক্ষ লক্ষ ব্র‍্যাণ্ড। কোটি কোটি টাকা নিয়ে যায়।
  এমন এত বড় বিশাল উন্মুক্ত ' লুঠ ক্ষেত্র '।
বোলপুরের ঐ পার্টি অফিস  থেকে শিখেছি অনেক।  রাজনৈতিক সচেতনতা বেড়েছে। মনীষা গ্রন্থালয় থেকে অনেক পেয়েছি। হীরেন্দ্র নাথ মুখোপাধ্যায় ; 
  পণ্ডিত ; আমি মনে করি কমিউনিস্ট আন্দোলনে এমন পণ্ডিত আর এসেছেন কি না! তাঁর 'তরী হতে তীর ' পড়ে মুগ্ধ হয়েছি।
  রাহুল সাংকৃত্যায়ন পড়েছি আর অবাক হয়েছি এই জীবন
পথিকের জীবন দর্শনে। আর যত মৌল পাঠক্রম। রাশিয়ান শিল্পী দের আঁকা ছবি র বই  আমার শিল্প চেতনা কে সমৃদ্ধ করেছে।
   এই অফিসে বসেই যতদুর মনে পড়ে মুজিব হত্যার ঘটনাও
  শুনেছি।
জরুরী অবস্থা ঘোষিত হয়েছে। মানতে পারছিনা। তর্ক হচ্ছে।
এই অফিসে বসে ই নেতাদের সাথে। না কোন কমিউনিস্ট পার্টির  পক্ষে এটা মানা অসম্ভব বলে মনে হয়েছে। নানা প্রশ্ন।
   জয়প্রকাশ আসছেন। বিরোধিতা করা হচ্ছে। ব্যঙ্গ চিত্র আঁকতে হচ্ছে। স্টেশন এর একটা দেওয়ালে। আঁকছি।  মনে  কিন্তু নিয়ে ই আঁকছি।
  গোপাল দার হোটেলে খেয়ে  কিছু এলেমেলো ঘোরাঘুরি করে
আমাদের কয়েক জনের সারা রাত আলোচনা। আমি ই আলোচক। আমরা ছেলেরাই থাকি। ছোট্ট ঘর। 
  আজ আর কার কাকে মনে আছি জানি না। তবে সবাই ভুলে যাননি। শেষ বার শান্তি নিকেতন পৌষ মেলায় ছোট্ট স্টল দেওয়া হয়েছে। সেই সব বই তো আর নাই।
- আসুন।
- কি চিনতে পারছেন আমাকে। অনেক দিনের ব্যবধান।
ইলামবাজার বলাতেই চিনলেন। ' আরে ভাই এসো। এসো '
স্বীকার করলেন অস্তিত্বের ই সংকট। বসলাম।
  বাম গণতান্ত্রিক একত্রিত আন্দোলন ই পথ।
কেন যে সব লাল ঝাণ্ডা কর্মসূচি ভিত্তিক  একত্রিত হতে পারেনা। রাষ্ট্রের শ্রেণী চরিত্র বিশ্লেষণের এত কচকচি।
  না হয় শূন্য থেকে ই শুরু করতে হবে।
আর একবার ইলামবাজারে দুই জেলার যুক্ত সভা। বামফ্রন্টের। ইলামবাজারের সি পি আই এম নেতাদের সাথে আমার যথেষ্ট জানা চেনা বন্ধুত্ব। বর্ধমানের জেলা নেতারা আছেন। সভা শেষে একজায়গায় বসে গল্প হচ্ছে। বীরভূমের
সি পি আই এর জেলা সম্পাদক অপূর্ব মণ্ডল। একদিন একসাথে কাজ করেছি।কিন্তু  অনেক দিনের অদেখা।
- কি অপূর্ব দা আমাকে চেনা যায়। আমি প্রণব।
- আরে ভাই। তোমাকে কি ভোলা যায়। কি  ; কেমন আছো ইত্যাদি। যাঁরা আমার অতীত টা জানেন না তাঁরা কিছুটা অবাক।
এই যে। কোথাও একটা অতীত  সম্পর্ক বেঁচে থাকে।

  ক্রমাগত বৈষম্য বাড়ছে। আরও বাড়বে। পুঁজি র দাপট আরও  বাড়বে। মানুষ নিষ্পেষিত হয়ে যাবে। এত এত শিক্ষিত বেকার। আগামী দিন আরও ভয়াবহ। মানুষ অসহায়। এত অসহায়তা বোধ হয় আগে কখনো দেখা যায়নি। নানা স্তরীয়
অর্থনৈতিক বৈষম্য। সামাজিক অর্থনৈতিক নানা স্তর এই সময় কালে সৃষ্টি হয়েছে। আমি কোন সমাজ বিজ্ঞানী বা বোদ্ধা কেউ নই। আমি শুধু  যা দেখছি তা কোন এক পর্বে বলব।

  মুক্তি বার্তা কিন্তু সেই লাল ঝাণ্ডা য়। কাস্তে হাতুড়ি তেই।
যুবক যুবতী রাই ভবিষ্যৎ। সামনে তোমাদের অনেক অনেক  অনেক বড় লড়াই।গণতান্ত্রিক পথেই  সে লড়াই পরিচালনা করতে হবে। 
  রাষ্ট্র শক্তি র বিরুদ্ধে অনিবার্য লড়াই। আমি জানিনা তার রূপ কেমন হবে। 
পৃথিবীর সব রাষ্ট্রশক্তি বা তাদের প্রধানের হাতেই ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। ছদ্ম স্বৈরাচারী। শাসকের বজ্রমুষ্ঠি ক্রমাগত শক্ত হচ্ছে। পৃথিবী যেন ক্রমাগত দক্ষিণে হাঁটছে। ভবিষ্যৎ বড়ই কণ্টকাকীর্ণ। 
আজ রাষ্ট্র পরিচালনা য় সেই পুরনো দিন কবেই হারিয়ে গেছে।  আজ বাণিজ্য নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা। অন্য কোন আদর্শ
সোভিয়েতের পরে নেই। ব্যতিক্রম  কিউবা। তার মানবিক মুখ দেখা যায়  ল্যাটিন আমেরিকার দেশ গুলিতে অন্তত স্বাস্থ্য পরিষেবার সাহায্য নিয়ে। সারা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ স্বাস্থ্য ব্যবস্থা তার।
  এ সমাজ মানুষের ই রচনা। সাধারণ মানুষ আজ গৌণ।
   তবু্ও মানুষ। মানুষের ভিতর থেকে প্রতিবাদী সত্তাকে শোষণ করে নেওয়া হচ্ছে প্রতিদিন।
  মানুষ তবুও জাগবে। পথ ই পথ দেখাবে। প্রতিবাদী মানুষ
পথে নামবেই। ভবিষ্যতে লড়াই অনিবার্য।
----------- ----------- ----------- ----------- -----------

তবু একদিন সংযোগের সব সুতো ছিঁড়ে যায়।
খুব কষ্টে ই।
বীরভূমের স্থায়ী বাসিন্দা না হলে আমার কাজ কি মূল্য পাবে। ভাবি। আর কর্মসূচি ছাড়া কি সংগঠন বাঁচে।
অনেক কথাই মনে পড়ে। সিউড়ি অফিস ঘরটা। আমরা কয়েকজন সদ্য যুবক থাকতাম। লালচাঁদ ফুলমালী আসতেন।
তিনি তখন এম এল এ। এসেই অফিস বারান্দা সব ঝাঁট দিতে আরম্ভ করতেন। ডাঃ শরদীশ রায়ের উঁচু ধাপের চেম্বারের পাশ দিয়ে যেতাম। উনি থাকলে উঁকি দিতাম।  ফাঁকা থাকলে দু'একটা  কথা।
অন্য মনের মানুষ। সংকীর্ণতা ছিলনা।
মোরব্বা মিষ্টান্ন ভাণ্ডার এর আদি দোকানে আমাদের সকালের জলখাবার হত। খুব চেনা হয়ে গিয়েছিল বৃদ্ধ মানুষ টির সাথে। সেই বিশাল বিশাল তেঁতুল গাছ তলা হয়ে যে রাস্তা চলে গেছে নীচের দিকে। জেলখানার উঁচু প্রাচীর।
কোন কোন দিন বেড়াতে যেতাম ম্যাসাঞ্জোরের ব্যারেজের দিকে। কোন দিন করিধ্যা। বড় রসগোল্লা।
আবার কোনদিন তালতলা র ধার ধরে স্টেশনে র দিকে।
চুপচাপ স্টেশনে বসে বসে ভাবতাম। নির্জন স্টেশন আমার খুব ভালো লাগে। কি যেন ভাবতাম আমরা ; মনে আছে আর তোদের। কি জানি আমাকে ই আর মনে আছে কি না।
হাসিম ; সুনীল।  আজ আর কারও মনে নেই  কি যেন ভাবতাম।
----------- ----------- ----------- ----------- © প্রণব ভট্টাচার্য
নেট থেকে সংগৃহীত মার্কসের এই ভাস্কর্য। বাণিজ্যিক ব্যবহার নিষিদ্ধ

অন্য কিছু কথা আমার নিজের

আমার যে ধারাবাহিক চলছে 
" কথা -সাতকাহন " সে টা থামিয়ে আজ একটু অন্য রকম কথা বলি 
 কথা তো লতার মতো। 
 আমি এর আগে আপনাদের কাছে বারবার বলেছি এই সকল কথা 
দেখুন আমি খুব সাধারণ মানুষ। লেখাপড়া তেমন হয়নি। যেমন টা হলে মনে করা যেত কিছু একটা বটি। 
 নিজের লেখা বই নাই। 
ISSN  কোন পত্রিকা র সম্পাদক ও নই 
অতি সামান্য এক সাধারণ আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চাকারী মাত্র। 
এই চর্চা আমার অনেক দিনের 
 বলতে পারেন সেই কোন বালক বেলায় আমার মনে গেঁথে গিয়েছিল  অঞ্জনা নদী তীরে চন্দনীগাঁয়ে    পোড়ো মন্দির খানা গঞ্জের বাঁয়ে 
 জীর্ণ ফাটল ধরা  এককোনে তারি 
অন্ধ নিয়েছে বাসা কুঞ্জবিহারী 
আমার মন কেমন করত      ঐ ভাঙ্গা মন্দির 
 অন্ধ ভিখারি ৷    লেজ কাটা কুকুর  ---
ঐ ভাঙ্গা মন্দির টা আমার বুকে গেঁথে গেছে সেই কবে কার  বালকবেলায় 
ভাঙ্গা মন্দির দেখলে দাঁড়িয়ে পড়ি। 
 এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে ছুটে যাই এখনও 
 খুঁজি তার গড়ে ওঠার ইতিহাস 
আবার আজকের করুন দশা 
 আর্থ সামাজিক পরিস্থিতি টাকে বোঝার চেষ্টা করি 
পত্তন আর পতনের মাঝে তো একটি মহামুল্যবান "ত"।
তার খোঁজ পণ্ডিতেরা জানেন 
 আমি কোন পণ্ডিত নই। একাডেমিক লোক ই নই 
 গবেষক। কোন ভাবেই নই। 
 আমি চেয়েছি আমার চারপাশ টা বুঝতে
 মানুষ । মানুষ ই তো সব। 
 চাই মানুষ তার মাটির কথা জানুক। চিনুক নিজের শিকড়। শিকড় বিচ্ছিন্ন এই জাত 
 যদি সামান্যও পারি। 
কাঠবিড়ালি র মতো 
 মোটা মোটা দামী বই কোথায় পাব। 
 কেনার সামর্থ্য ছিলনা 
অনেক দামী বই  পুরনো মাটির বাড়িতে নষ্ট হয়ে গেছে 
যা গেছে তা গেছে 
আমার এই এলাকা কাঁকসা আউসগ্রাম এর জঙ্গল মহল  ইছাইঘোষ এর দেউল  অজয়ের এপার ওপার নিয়ে কুড়ি কিলোমিটার ব্যাসার্ধের জায়গায় আমার ঘোরাঘুরি 
 এখানেই এখন লিখি৷ এই ফেসবুকে র পাতায় 
কেউ আমন্ত্রণ না জানালে কোথাও লিখিনা 
আমার কোন উচ্চাশা নাই 
অনেক সময় ফেলে এসেছি। মনকে ই বলি " তুই ফেলে এসেছিস কারে - মন মন রে আমার 
 তবু আমার লেখা আপনাদের ভালো লাগে 
 চমৎকার সব মন্তব্য লিখে আমাকে প্রাণিত করেন 
 আপনাদের ধন্যবাদ 
 কি করব বলুন গবেষক এর মতো প্রতিটি বাক্যের তথ্য সূত্র দিতে পারিনা 
ভুলে গেছি কোথায় পড়েছি যেন 
রেফারেন্স বই এর খোঁজে কোথায় যাব বলুন 
 কে দেবে আমাকে বই 
এখন দিচ্ছে এই মাধ্যম। পাচ্ছি নানা পি ডি এফ 
 একবার সাময়িক সদস্য হয়ে এক বিশ্ববিদ্যালয়ের 
 সেণ্ট্রাল লাইব্রেরি তে গিয়েছিলাম দিন কতক 
 আমার দরকার ছিল  মাৎস্য ন্যায় পর্ব 
 একান্তে শুনলাম যে দামী দামী সব বই অধ্যাপক দের দখলে ই থাকে। তাই থাক 
 কোন পণ্ডিত তো আর উপেক্ষিত  অবজ্ঞাত গ্রামের ভাঙ্গা মন্দির টির কথা আপনাদের শোনাবেন না। না কোন গবেষক 
   আমি চেষ্টা করি 
আমি চেষ্টা করেছিলাম একটা পুকুরের নাম কেন 
" সন্ধান "। খুঁজে ছিলাম তার কথা কাহিনী 
 অনেক পণ্ডিত আমার লেখা পড়েন। 
লাইক ও দেননা। মন্তব্য তো দূরের কথা। ভাবি সত্যিই তো তাঁরা ওজনদার। আমার পোষ্ট তো নূতন কিছু নয়। তাতে লাইক দিয়ে নিজের ওজন কমাবেন কেন - 
 এই আপনারা এখানে যাঁরা আছেন তাঁদের ভালোবাসাই আমার পাথেয় 

কেউ কাউকে মনে রাখেনা 
 আমি চেষ্টা করেছিলাম মাত্র
এই কথাটি কাকে বলব     মনে রেখো

রয়ে গেল আরও কিছু কথা     বাকি 
 আমি যেন  সেই  বাতি ওয়ালা 
 মাটির প্রদীপ হাতে দাঁড়াই    ঘন অন্ধকারে
পথের বাঁকে

(মাটির প্রদীপ। আঞ্চলিক ইতিহাস। প্রণব ভট্টাচার্য এর লেখালেখি 
Blogger ইনস্টল করা থাকলে সুবিধা না হলে Crome এ তাড়াতাড়ি খোলে পার্সোনাল ব্লগ 
matirpadip.blogspot.com in 
খুলবেন।) 

(শুধু মাটির প্রদীপ  নামে একটি সহযোগী গ্রুপ আছে। সেখানে বন্ধুদের ভালো ইতিহাস বিষয়ক লেখা শেয়ার করি। নিজের পড়ার জন্য ও রেখে দিই। চর্চা হচ্ছেনা। চর্চা হচ্ছেনা। ভুল কথা। যাঁরা করার করছেন। এখানে অনেক ভালো পোষ্ট থাকে। 
 বন্ধুরা এখানে শেয়ার করতে পারেন। 
 এই মাধ্যম কেই এখন ভালো বেসেছি।)
(কথা - সাতকাহন ; শুধু মাত্র  আত্মকথন নয়। সেই সময় ; পারিপার্শ্বিক ; রাজনৈতিক পরিস্থিতি ; চারপাশের মানুষ  সকলকে নিয়ে এই আত্মজৈবনিক ধারাবাহিক। ভাবতে হচ্ছে এখানে কতটা বলা উচিৎ হবে। আমার ঐ লেখায় কোন কষ্ট কল্পনা নাই।)

।।কথা - সাতকাহন।। ২৮ পর্ব

।। কথা - সাতকাহন।। ২৮ অধ্যায়
ভবিষ্যতে এ ছেলেকে দেখবে কে। তার তো কোন আত্মীয় এখানে নাই। চাল চুলো কিছু নাই।   আত্মীয় স্বজনেরা একসাথে এখানে গ্রামের বাড়িতে 
 এলে থাকার খুব অসুবিধা হয়ে যায়।তখন নানা আত্মীয়ের এ বাড়িতে আসার চল ছিল। শ্রীচন্দ্রপুরের  শ্যামা ঠাকুমা রা আসতেন। তাঁর মেয়ে তরু মাসীকে নিয়ে।  নানা জায়গায় চালাঘরে বা বারান্দায় ভাগাভাগি করে থাকতে হত সবাইকে
মিলে মিশে  কখনও বা পশ্চিমে র একচালা বারান্দা ঘরে ও কাউকে  জায়গা নিতে হয়। উত্তর দিক থেকে সে চালাঘরে আবার মাঝে মাঝে সাপ এসে ও ঢোকে।  সেই ভয় নিয়েই
মাটিতে তাল পাতার চাটাই মানে তালাই কাঁথা পেড়ে ঘুমাতে হত । একসময় ঘুম আসে। এসেই যায়। এ নিয়ে কারও কোন ক্ষোভ বিক্ষোভ ছিলনা। 
কোন দুর্ঘটনা অবশ্য ঘটেনি কখনও। 
 দিনের দিকে অযোধ্যা থেকে অনেকে বেড়াতে আসত। দাদু দিদিমা মানুষ ভালো বাসে। কেউ রাতে ও থেকে যেত। গল্পে গল্পে রাত বেড়ে যেত। 

এই গ্রামে তার একটা মাটির ঘরের জন্য উপযুক্ত জায়গা আর মিলছেনা। যে কটা জায়গা দেখা হচ্ছে সব জায়গা তেই
বাধা আসছে।
শেষ পর্যন্ত ডাকবাংলো র ধারে কিছুটা খাস জায়গা আর কিছুটা বনকাটির রায় দাদুদের জায়গা মিলিয়ে তিন কাঠা জায়গা র উপরে একটা ঘর তোলার পরিকল্পনা হল।
এ পাড়া থেকে ওপাড়া। পূর্ব বাউড়ী পাড়া।
এখন ভাবে ওখানে কি থাকা যেত! না সম্ভব ছিল। কিন্তু তখন
এসব ভাবনা কি কারো মাথায় আসেনি।
টাকা কোথায়?  যে ঘর তুলবে।
সে এথোড়া বাড়ি কে গেল। পৈতৃক বাস্তুভিটা টুকু  কাকা জ্যাঠা দের সমান করে ভাগ করে কিনে নিতে বলল।
  তাঁরা রাজি হলেন। স্ট্যাম্প পেপারে লেখা হল। সামান্য কিছু টাকা হাতে নিয়ে সে ফিরল। সেই টাকা তেই শুরু হল ভিত কাটার কাজ। দক্ষিণ মুখী বৈঠক খানা র মতো একটা ঘর।
মাঝে সিঁড়ি। ওপারে আর একটা ঘর। মূল ঘর পূর্ব মুখী।
  ঘরের কাঠামোর জন্য তাল গাছের কাঁড়ি চাই। দাদু  চেয়ে চিন্তে তিনটে তালগাছ জোগাড় করল। কলিমউদ্দিন সেলিমুদ্দিন দুই ভাই তাকে ফেড়ে চেঁছে বানিয়ে দিল কাঠামো
তোলার উপযুক্ত করে। যৎসামান্য পয়সার বিনিময়ে। এরা পরেও তার আরও উপকার করেছে। দেয়াল তুলল বেশ কয়েকজন মিলে।  কাঠামো তুলল দিদিমার বাপের বাড়ি র
অমূল্য মিস্ত্রি আর বনকাটির বাদল বনমালী দের বাবা মদন মিস্ত্রী।
খড়ের ছাউনি। ছাউনির নিচে শরকাঠির পাকানো গোছা - 'গুরুল'। কড়িকাঠের উপর মোটা করে এই গুরুল পেতে তার উপর মাটি লেপে উপর কোঠা। তখন এমনটা হত।দপদপ করত।  পাতনের জন্য মোটা কাঠের পাটা কোথায় আর পাওয়া যাবে।
বিল্ল্বেশ্বর বাগদী ঘরের দেয়াল ঘষে মেজে ' খড়ুটি ' করে দিল। বড়ো ভালো মানুষ ছিল। নানা রকমের কাজ জানত।
অল্পস্বল্প রাজমিস্ত্রী র ও কাজ।
  বাকি টাকা আনার জন্য বেশ কয়েকবার এথোড়া যেতে হয়েছে। কখনও বা খালি হাতে ফিরতে হয়েছে। অথচ যাতায়াতের খরচ আছে। ঐ টিউশনি র টাকা।
ঘর একটা দাঁড়াল বটে। কিন্তু এপাড়া ওপাড়া সংসার নিয়ে টানাটানি করা কি আর যায়। সীমানা প্রাচীর হয়নি। যা ভবিষ্যতে আর হবে না। বা ঐ ঘরে বসবাস ও হবে না। পৈতৃক ভিটা টুকু গেল মাত্র। অবশ্য থাকলেও কি তার থাকা হত ওখানে। 
  চারদিকে উইপোকার ঢিবি। কয়েক দিন গ্রামের কিছু ছেলে কে নিয়ে ওই ঘরে বসে পড়ায়। কোন রকমে একটি দরজা বসেছে। জানালার ফাঁকে বাঁশের কঞ্চি গোঁজা। দু এক দিন প্রায় সমবয়সী গরীব মানুষের ছেলেদের নিয়ে সন্ধ্যায় বা রাত্রে বসে। নানা আলোচনা ; গল্প হয়। ব্যস ; বড় জোর এই টুকু ই। রাত্রে আর থাকা হয়নি কখনো সেই ঘরে।থাকার মতো অবস্থা ও ছিলনা। কেননা মামারা চলে যাবার পর আবার বৃদ্ধ  দাদু দিদিমা একা। দেখতে তো সে ই। সাংসারিক এবং পারিপার্শ্বিক  এক বিশেষ পরিস্থিতি তে এই ঘর তোলা হয়েছিল। 
  ইতিমধ্যে পশ্চিম বঙ্গে রাজনৈতিক পালা বদল ঘটে গেছে।
সিদ্ধার্থ বাবুর জমানার কালো দিন মুছে নতুন দিন এসেছে।
  এসেছে বামফ্রণ্ট। পশ্চিম বঙ্গের ইতিহাসে এক অতি গুরুত্বপূর্ণ বাঁক বদল। জ্যোতি বাবু ঘোষণা করেছেন রাইটার্স থেকে রাজ্য পরিচালিত হবেনা। ক্ষমতা র বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে।  পঞ্চায়েত গঠিত হবে।  এই সময়ের কথা আলাদা ভাবে অন্য অধ্যায়ে  বলতে হবে।
'৭৮ এর অজয়ের প্রলয়ঙ্করী বন্যা। শত শত মানুষ গৃহ হীন।
মুলতঃ পূর্ববঙ্গীয় মানুষেরা যাঁরা নদী চর ; মানায় বাস করতেন। বসুধা সম্পূর্ণ ভেসে গেছে।  ভেসে যাওয়া মানুষ কে
উদ্ধার করতে আখের রস সিদ্ধ করার যে ' ডেঁক ' সে নিয়েই
বনকাটি র নিমাই সমাদ্দার রা জলে নেমে পড়েছে। সে ছিল অসম সাহসী।
অযোধ্যা হাই স্কুলের কোন রুম আর ফাঁকা নাই। শরণার্থী তে
ভর্তি। তাদের জন্য যথাসম্ভব শুকনো খাবার জোগাড় করা হয়েছে। কো- অপারেটিভ বিল্ডিং এর চত্বরে বিরাট বিরাট
কড়াই এ খিচুড়ি চেপেছে। প্রয়াত মোহন চ্যাটার্জি র নেতৃত্বে
ওদিক টা দেখা হচ্ছে। অনেকে স্বেচ্ছাসেবক এর দায়িত্ব পালন করছেন। রান্না শালা সামলানোর জন্য অনেক কে যুক্ত করা হয়েছে। আবার ভাণ্ডার সামলানোর জন্য দুজন পাকা লোককে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।  পানাগড় থেকে নেতৃত্ব স্থানীয় রা মাঝে মাঝে এসে খোঁজ খবর নিয়ে যাচ্ছেন। ত্রান সামগ্রী নিয়ে আসছেন কর্মী বাহিনী। স্বেচ্ছাসেবক রা।
গবাদি পশুদের জন্য খড় জলের ব্যবস্থা হয়েছে। বাচ্চাদের দুধ। ওষুধ। চিকিৎসক। অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও নানা ভাবে সাহায্য করছেন।  এই পরিস্থিতি সামলে ওঠা সহজ কথা
ছিলনা। ছোট খাটো বিতর্ক ; মনোমালিন্য ; বা ক্ষোভ বিক্ষোভ যে দেখা দিচ্ছে না তা নয়। বিনোদ মণ্ডল একদিন বেশ জোর গলায় বিলি বন্টন নিয়ে প্রতিবাদ করল। সাতকাহনিয়া র মানুষ দের ঘর দোর যায়নি। কিন্তু চরম অভাব। শর আর খড় দিয়ে
ছাওয়া ঘরের ভিতর আর কারো শুকনো নাই।ত্রিপল দরকার।  কেরোসিন তেলের হাহাকার। আমাদের নিজেদের ঘরে ও নাই।
হাফ প্যান্টের উপর গামছা বেঁধে হাতে লাঠি নিয়ে কেরোসিন তেল আনতে   সে আর কানু যাচ্ছে ইলামবাজার। তখন জল অনেক নেমে গেলেও কোথাও কোথাও হাঁটু জল আবার সাঁতার জল। বসুধা পার হওয়া দুষ্কর। তবু পার হয়েছে।
ইলামবাজার এ কানুর শ্বশুর মশাই প্রয়াত শ্রীধর পাল মশাই
পাঁচ লিটার  তেল জোগাড় করে দিলেন। ইলামবাজার হাই স্কুল বিল্ডিং এও বন্যা দুর্গত মানুষদের আশ্রয় শিবির। সেখানেও একই ব্যবস্থা করেছেন ওপারের কর্মী বাহিনী।
সাবধানে তেল  আনতে হচ্ছে। পাকা রাস্তা র উপর দিয়ে বড় বড় মাছ পেরিয়ে যাচ্ছে। লাঠি দিয়ে দু টো মেরে কোন রকমে তালপাতা দিয়ে ঝুলিয়ে ডাঙ্গাল হয়ে বাড়ি এসেছে।
পাড়া প্রতিবেশী দের লম্ফ জ্বলার মতো একটু একটু করে
দিতে হয়েছে। এক দল মানুষ কে নিয়ে কো অপারেটিভ বিল্ডিং এ যাওয়া হল। যাদের ঘরে খাবার নেই তারা এখানে খাবে। ব্যবস্থা হল।
  গুসকরা মোড়ে র কাছে অনেক মানুষ ; স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা
খাবার ; পোষাক দুর্গত মানুষ দের হাতে তুলে দিচ্ছেন।
অনেকে গুসকরা রাস্তা ; মোরাম চাতালের উপর উঠে এসেছিলেন। মূলতঃ তাঁরা ই আর বসুধা বিলপাড়ার মানুষ রা
এই সাহায্য পেয়েছিলেন।
সে কি ভয়ংকর  দিন রাত। এখনো মনে পড়লে গায়ে কাঁটা দেয়। জল বাড়ছে। তবে এই রূপ নেবে তা ভাবা যায়নি।
মাটির বাঁধ এককিলোমিটার ভেঙ্গেছিল। সাতকাহনিয়া য়।
সে কি কাজে ইলামবাজার গিয়েছিল। ফেরার সময় দেখে বাঁধের গোড়ায় জল। বাঁধ যেন কাঁপছে।
  পূর্ব দিকটা ধূ ধূ সাদা। কমপক্ষে এক হাজার বিঘা দোফসলি জমি গড়ে তিন ফূট বালি চাপা পড়ে গেছে। কত চাষির লম্বা লম্বা আখ ছিল। আরও কত ফসল। আর মৃত গবাদি পশুর
দেহ ছড়িয়ে আছে সর্বত্র।বসুধা বরুল  বিল মাঠে সব চেয়ে
বেশী।
  জল বেশ দ্রুত ই নেমে গিয়েছিল। নীচে আরও দু তিন জায়গায় ভেঙ্গেছিল। এগারো মাইল গুসকরা মোড়ে গিয়ে
দেখা পেল আকুলিয়ার মানুষের। কি খবর। না মোটামুটি সব ঠিক আছে। হ্যাঁ গো ক্ষুদু দের কি খবর।  না। ঠিকই আছে।
কালিকাপুর ঠিক আছে। মৌখিরা র একতলা বিশিষ্ট ঘর জলে ভরে গিয়েছিল। সব মানুষ  জমিদার বূড়ো বাবু দের দোতালা দালান ঘর গুলো তে  আশ্রয় নিয়েছিল। সে প্রায় কম পক্ষে শ দুয়েক মানুষ। দুর্গাদালান জলে ভর্তি। প্রতিমার কাঠামো কোমর জলে দাঁড়িয়ে  আছে।
   ১০ ই আশ্বিন।বুধবার  দিন  তারিখ টা বুকে গেঁথে আছে এই এলাকার মানুষের। আশ্বিনে বৃষ্টি নামলে সেই ভয় আজও তাড়া করে।
  ----------- ----------- ----------- ----------- ------- ©  প্রণব ভট্টাচার্য
( খড়ুটি ' মানে হচ্ছে মাটির দেয়ালের উপর বালি মাটি দিয়ে প্লাষ্টার। কর্ণিক  এবং ঘষার পাটা দিয়ে  সমতল করন) 
গুরুল  - পাকা শর কাঠি দশ বারোটা আঁটি করে খড় দিয়ে বাঁধা। যেমন মাপ তেমন জুড়ে জুড়ে করা যায় 
ডেঁক  - আখের রস সিদ্ধ করার বড় কানা ওয়ালা গোলাকার পাত্র

আমার দাদু। অযোধ্যা প্রা বিদ্যালয়ের রূপকার। প্র‍য়াত ননীগোপাল চট্টোপাধ্যায়।। কথা - সাতকাহন।।

।। কথা - সাতকাহন।।  ২৯ অধ্যায়।
বারবার দাদুর কথা ফিরে ফিরে আসছে।
আসলে তার জীবনে দাদু দিদিমা র ভূমিকা মা বাবার মতো ই। আর দাদুই তার জীবনের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক। 
আবার ও আসবে। কেননা মানুষ টি একটা এলাকার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল কে পরিশীলিতভাবে গড়ে তোলার জন্য কি অক্লান্ত পরিশ্রম করেছিলেন।
অনেকটা সময় পিছিয়ে যেতে হচ্ছে। সাল ১৯৪৭। ১৫ ই আগষ্ট। প্রথম স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের উন্মাদনা।
অযোধ্যা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রবৃত্তি পরীক্ষার দ্বিতীয় ব্যাচের ছাত্র প্রয়াত নির্মল চট্টোপাধ্যায় এর স্মৃতি চারণ
" প্রথম স্বাধীনতা দিবস উদযাপিত হচ্ছে। বিদ্যালয় থেকে প্রভাত ফেরী বেরিয়েছে ছাত্র ছাত্রী দের দল। আনুমানিক
জনা কুড়ি। ' বড়মাষ্টার ' গলায় ঝুলিয়েছেন হারমোনিয়াম।
সাথে লক্ষীনারায়ন চক্রবর্তী মশাই। তাঁর ও গলায় হারমোনিয়াম। সহ শিক্ষকেরা সাথে আছেন। লাইনের উপর
নজর রাখছেন। সামনের মেয়েরা কানন বালা ; পারুল বালা রা শঙখ ধ্বনি করছেন। গান হচ্ছে
    ' চক্রশোভিত ওড়ে নিশান /
        নব ভারতের বাজে বিষাণ '
রাস্তার দু পাশে উদ্বেলিত মানুষ। প্রথম তারা এভাবে প্রভাত ফেরী দেখছে ।
    এই হচ্ছে সেদিনের দৃশ্য। ' বড়মাষ্টার '। ননীগোপাল চট্টোপাধ্যায়। তার দাদু। কানন বালা তার মা। পারুলবালা তার
' ফুল মা '।
নির্মল চট্টোপাধ্যায় বলে ওঠেন " ও গো এ শুধু একটা স্কুল মাত্র নয় ' - শিক্ষা ; সংস্কৃতির মন্দির "
  ননীগোপাল চট্টোপাধ্যায় মশাই তাঁর শ্বশুর বাড়ি র গ্রাম টা কেমন দেখতে সাইকেলে চেপে বাঁকুড়া গোগড়া ; পাপুরদা ( শালতোড়া নিকট বর্তী)  গ্রাম থেকে এসেছিলেন এখানে।
শ্রীচন্দ্রপুর গ্রামে। (আদুরিয়া - অমরপুর  এলাকা).।
  অযোধ্যা - বনকাটির পার্শ্ববর্তী এলাকা।
  প্রাচীন গোপভূম এর  এই সেনপাহাড়ী এলাকার এই সকল গ্রামে তখন কোন স্কুল ই নেই। কিছু গুরুমশাই এর পাঠশালা
মাজুরিয়া গ্রামে টোল আছে।
   অযোধ্যা গ্রামে পাঁচ গ্রামের মানুষেরা আসেন। হাট বসে।
তখনকার দিনের গঞ্জ। ধ্বজাধারী সাহা মশাই এর বৈঠক খানা বারান্দায় বিশিষ্ট মানুষ দের আড্ডার আসর বসে।
অনেকে আসেন ডাঙ্গাল গ্রামের  গোবিন্দ ঘোষ
নিমটিকুড়ি র ভোলানাথ বাসুরী ; বনকাটি র তারাকিঙ্কর মুখোপাধ্যায় ; সাতকাহনিয়া র  হাটু হালদার ; পাড়ার বনবিহারী সাহা মশাই সহ আরও অনেকে। যথেষ্ট সম্পন্ন মানুষ সব এঁরা। অনেক জমি জায়গা র মালিক। কাজের সূত্রে বাইরে অনেক কেই যেতে হয়। বাইরের প্রভাব তাঁদের মাধ্যমে আসে।
এলাকায় কোন স্কুল নাই। সকলে মিলে স্থির করেন স্কুল একটা স্থাপন করতেই হবে।
অযোধ্যা গ্রামের উত্তরে বিশাল আমবাগানের ' রথ তলার ডাঙ্গায় ' জায়গা দেখা হল। জমি দান করেছিলেন অযোধ্যার চট্টোপাধ্যায় পরিবারের প্রয়াত সুরেশ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সহ আরও অনেকে। হয়তো রেজিষ্ট্রী দলিল পরে হয়েছিল।
  ছোট্ট মাটির দেওয়ালের ঘর উঠল।
প্রধান শিক্ষক হিসাবে আমলাজোড়া গ্রামের রামসেবক মুখোপাধ্যায় মশাই কে আনা হল। অনাদি বন্দ্যোপাধ্যায় ; শশীভূষণ রক্ষিত মশাই রা সহ শিক্ষক।
বিদ্যালয়ের পথ চলা শুরু হল। সেই হল প্রথম যুগ।
রামসেবক মুখোপাধ্যায় মশাই কয়েক বৎসর পর চলে গেলেন। 
একজন দক্ষ প্রধান শিক্ষকের দরকার।
ঠিক সেই সময়েই তাঁরা সন্ধান পেলেন শ্রীচন্দ্রপুরের অশ্বিনী মুখোপাধ্যায় মশাই এর ভগ্নীপতি ননীগোপাল চট্টোপাধ্যায় মশাই এর। বাঁকুড়া থেকে গুরু ট্রেণিং করা এই মানুষ টি
একাধারে শিক্ষক আবার গান বাজনার ও লোক। পেশাদার যাত্রা দলে ও হারমোনিয়াম মাষ্টার। ' মোশন মাষ্টার '।
সেই গুণী মানুষ টি তখন  মানসিক পরিস্থিতি র কারণে কিছুদিনের জন্য এখানে রয়েছেন।
  এই এলাকার সব বিশিষ্ট মানুষ দের অনুরোধে তিনি রাজী হলেন এই বিদ্যালয় কে গড়ে তোলা বা প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব নিতে।
শুরু হল এক নূতন অধ্যায়। এলাকায় একদল উদ্বুদ্ধ কর্মী যুব বাহিনী চাই। শুরু করলেন যাত্রা থিয়েটারের দল। ক্রমে সে দল প্রায় পেশাদারী দক্ষতা অর্জন করে। কলকাতা র রঙ্গালয়ে অভিনীত হচ্ছে যে পালা তা এখানে হচ্ছে। পরে পেশাদার দলের মতো নিজেদের ট্রাঙ্ক ভর্তি ড্রেস এবং অন্যন্য আনুষঙ্গিক দ্রব্যাদি। মিউজিক এর জন্য বাঁকুড়া থেকে ও উপযুক্ত লোক আনেন। আবার নদীর ওপারে র উদয়পুরের
রাধাশ্যাম কে ও তৈরি করে নেন। আদুরিয়া অমরপুর থেকেও
অভিনেতা নিয়ে আসেন। দুর্গাদাস দত্ত।
যাত্রা দলের ম্যানেজার শক্তিপদ চট্টোপাধ্যায় (মরন - ডাক নাম)। এ দল নিয়মিত পরে বিভিন্ন জায়গায় যাত্রা করতে গেছে।
  এই কর্মী বাহিনী কে সাথে নিয়ে শুরু হল স্কুল বিল্ডিং গড়ে তোলার কাজ। ইঁট পোড়ানো হল। ভোলানাথ সূত্রধর  রাজমিস্ত্রী। মানুষের দ্বারে দ্বারে সাহায্য ভিক্ষা করা হচ্ছে।
অবলা কান্ত সরকার মশাই একটি মোটা শালগাছ দিলেন।
কোন সরকারি অনুমোদন ও নাই। শিক্ষক দের মাইনে ও নাই।
  ছাত্র ছাত্রী দের বাড়ি থেকে এবং দান সংগ্রহ করতে হয়।
চাল ; ডাল ; তরি তরকারি ইত্যাদি। টিকিট কেটে কবিগানের আসর বসানো হচ্ছে। মানুষ দের ভিতরে নারান বাবু সহ অন্যান্য যুবকের দল কাপড় পেতে সাহায্যভিক্ষা করছেন।
ননী গোপালের স্ত্রী ও আছেন। তাঁর হাতে আছে শেষ সম্বল
একগাছা চুড়ি। তিনি সে টা ই খুলে দিচ্ছেন। এই নারান বাবু ;
নারায়ণ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় হাই স্কুল গড়ে তোলার জন্য প্রাণপাত পরিশ্রম করেছেন। তিনিই  অযোধ্যা হাই স্কুলের রূপকার। প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক হরিহর সিংহ মহাশয় এর বয়ানে যদিও তারও গোড়া পত্তনের শুরু  সেই
ননীগোপাল চট্টোপাধ্যায় মশাই এর উদ্যোগে ই।
রজনীকান্ত হালদার মশাই গোপাল মাষ্টার কে নিয়ে এলেন
নদী তীরবর্তী এই নির্জন শান্তশ্রীর গ্রাম  সাতকাহনিয়া য়।
  এক উকিল সেন বাবুর ছেড়ে যাওয়া  বাড়ি টি তাঁর জন্য বরাদ্দ হল। কিছু ডাঙ্গা জমি দান করে তিনি এক ঘর ব্রাহ্মণ কে গ্রামে প্রতিষ্ঠিত করলেন। গ্রামের অধিকারী ; লায়েক ;
প্রভৃতি ব্রাহ্মণ পরিবার গুলি গ্রাম ছেড়ে চলে গেছেন অনেক আগেই।
  এখানে ছাত্র ছাত্রী দের বাড়ি তে রেখে দালান ঘরে বসিয়ে আলাদা ক্লাস হয়। আবাসিক ব্যবস্থা। ডাঙ্গাল গ্রামের গোবিন্দ ঘোষ মশাই এর ছেলে বিশ্বনাথ বাবুর অভিজ্ঞতা আমি নিজ মুখে শুনেছি। কঠোর শৃঙখলা ; নিয়মানুবর্তিতা। পঠন পাঠন এ
কোন ফাঁকি চলবে না। শিক্ষার প্রাথমিক ভিত যেন হয় মজবুত। এ দিকে তাঁর কঠোর দৃষ্টি।
  স্কুল এর পূর্ব দিকে দুটি বিরাট আমগাছ। মাটি দিয়ে গোড়া বাঁধানো। গোবর মাটি  দিয়ে নিকানো। আলপনা আঁকা।
উন্মুক্ত পরিবেশে পঠন পাঠন। গান " তোমারি গেহে পালিছ স্নেহে " " আজি যত তারা তব আকাশে "
স্কুল বিল্ডিং এর সামনে দক্ষিণে ফুলের বাগান। যে বাগানের বেড়া দেবার জন্য বাঁকুড়া র অমরকানন থেকে বেড়া কলমীর
ডাল নিয়ে এসেছেন। তার আগে এখানে এটি ছিলনা।
  যে বাগানে একদিন একশো দশ রকমের ফুলগাছ ছিল।
  যার জন্য ভবিষ্যৎ এ স্কুল পুরস্কার পাবে।
  ১৯৪৪ সালে বিদ্যালয় জেলা বোর্ডের অনুমোদন পায়।
  শিক্ষকদের ও মাস মাহিনা র অনুমোদন হয়। টিনের ছাউনি ব্যবস্থা হয়। রাণীগঞ্জ বাজার থেকে সে টিন কিনে আনা হয়। 
পরবর্তী সময়ে এই বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসাবে যোগ দিয়েছেন
গুণী শিক্ষকেরা। প্রয়াত রুধির কুমার সাহা ; প্রয়াত যোগেশ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ; সুভাষ বাবু। তাঁদের অন্যতম চণ্ডীরাম মুখোপাধ্যায়।
তখনকার দিনে মানে ১৯৪৪সালের ম্যাট্রিকুলেশন এ ফার্স্ট ডিভিশন। তারপর টেক্সটাইল টেকনোলজি তে ডিপ্লোমা।
অনায়াসে ই তিনি বাইরে মোটা মাহিনার চাকুরী করতে পারতেন। সম্ভবত নদীয়ার তাহেরপুর এ জুট টেকনোলজির কোন প্রতিষ্ঠানে ইন্সট্রাক্টর পদে যোগ দিয়েছিলেন।
  যে কোন কারনেই হোক ( যতদুর জানি সেখানকার আবহাওয়া সহ্য হয়নি)  তা ছেড়ে এখানে শিক্ষক হিসাবে যোগ দেন। অযোধ্যা গ্রামে স্বাধীন ভাবে শাড়ী র ব্লক প্রিন্টিং এর
প্রতিষ্ঠান খুলেছিলেন। খুবই গুণী মানুষ ছিলেন। ছিলেন জ্ঞান পিপাসু মানুষ। তিনি ছিলেন তাঁর সময়ের থেকে ; এই এলাকার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল থেকে এগিয়ে থাকা মানুষ।
  এলাকার বয়স্ক মানুষেরা আজও  ননীগোপাল চট্টোপাধ্যায় মশাই কে  তাঁর নামে নয়। চেনেন " বড় মাষ্টার " নামে। তাঁর নাম শুনলে 
কপালে হাত ঠেকানোর লোক কমে এলো।
প্রথম ছাত্রবৃত্তি পরীক্ষার যে ব্যাচ তার তিন জন মেয়ে আর একজন ছেলে কে গোরু গাড়িতে চেপে দুর্গাপুরে সগড় ভাঙ্গা র  হাই স্কুলে পরীক্ষা দিতে যেতে হয়েছিল। সাথে তিনি আর একজন অভিভাবক। কাননবালা ; পারুলবালা ; ষষ্ঠী পদ দে
এবং অযোধ্যা বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের এক মেয়ে। তাঁর নাম টি সঠিক সংগ্রহ করা যায়নি।
" বড় মাষ্টার " রা জন্মান। প্রকৃত শিক্ষকেরা জন্মান। দারিদ্র্য কে বরণ করে এঁরা আদর্শে অবিচল থাকেন। তাই বুঝি  এঁদের জন্য কোন রাজ্য বা রাষ্ট্রীয়
পুরস্কার বরাদ্দ হয়না।
----------- ----------- ----------- ----------- --- © প্রণব ভট্টাচার্য।
( শিক্ষা সমাচার ; কুনুর কথা প্রভৃতি পত্রিকায় আমার লেখা
প্রবন্ধ আছে। আমি কুনুর কথার পাতা গুলি তুলে দিলাম। ডাবল ট্যাপ করবেন তা না হলে আবছা দেখাবে)