।। সাতকাহনিয়া র ।সাতকাহন কথা।।
হাঁকু মিঞা আর কুলসুমা বিবির কথা।।
দুপুরে ঘরে তাকে কিছুতেই পাওয়া যাবেনা। অবশ্য দেখা করতেই কে আর আসছে!
হাঁকডাক তো ছিল না মানুষ টির। খুব কম কথার মানুষ । বড় চুপচাপ। যেন আত্মমগ্ন। কে যে তার নাম দিয়েছিল হাঁকু - কে জানে।
দুপুরে যা হোক দুটি জোটে। কিভাবে যে জোটে। কেউ জানেনা। কে আর কার এত সব খোঁজ রাখে। কিন্তু গাঁঘর তো আলাদা। সবার কথা সবাই জানে। আর মেয়েরা; তারা তো কত কিছু জানে। জানবেই।
গাঁয়ের আমোদ তো সেখানেই। আর আছেই বা কি সাধারণ মানুষের জীবনে - আনন্দের উপকরণ!
তো মিঞা সাহেবকে দুপুরে পাওয়া যাবে অন্য কোথাও নয়।
কোন না কোন পুকুর ডোবার জলের ধারে পাড়ে। ছোট্ট ছিপ।
ছোট্ট বঁড়শি। চুনো পুঁটি তে সে খুশী। দুপুর দিয়ে রাত চলবে।
এ গাঁ য়ের আদি বাসিন্দা তার বাপ ঠাকুর্দা রা কেউ নয়।
এ গাঁয়ে বলতে গেলে নিজের গাঁ ছেড়ে পালিয়ে চলে আসা।
হজরতপুর না কল্যাণপুরের লোক সে।
চেহারা টি তার বেশ মনে আছে। মনে থাকার মতো না হলেও
আলাদা রকম। মাথার মাঝখানে টাক। দুপাশে কানের নীচে
পর্যন্ত বাবরি চুল নেমে এসেছে।সুন্দর করে আঁচড়ানো।
ছুঁচালো দাড়ি থুতনিতে। মাঝে মাঝে হাত বুলিয়ে নেয়।
গালে দাড়ি প্রায় নেই । হাল্কা গোঁফ। ছোট ছোট দুটি চোখ। তাতে আবার সুর্মা লাগায়। পরনে লুঙ্গি। গায়ে ফতুয়া। গরমে হাতা কাটা।
এবার কুলসুমা বিবির কথা। ছোটোখাটো চেহারা। একটু ভারী। গায়ের রঙ বেশ ময়লা। চকচকে ত্বক। ঘণ চুল।
মুখে মিষ্টি হাসি। আর কথা খুব মিষ্টি।
ছিল না কি কুমোর ঘরের মেয়ে।
বাস্তবতা ই যেন হাঁকু মিঞা র সাথে তার ভাব ভালোবাসা তৈরী করে দিয়েছিল। তাকে এনেছিল ঝাড়খণ্ড থেকে। ঘর সংসারের কাজকর্ম করা -
আর অসুস্থ স্ত্রী র সেবা যত্ন করার জন্যে। কুলসুমা নিজের মতো করেই সংসারের সব কাজ করত। সেবা যত্নে ও তার ত্রুটি ছিলনা। হাঁকু মিঞা র স্ত্রী ও তাকে কাছের করে নিয়েছিল। জাত কুল মানের থেকে বাস্তব টাই বড়ো। মানুষ মানুষ ই।
তবে গাঁঘরে কথা তো থাকবেই। কথা চিরকাল ই আছে। থাকবেই। কথা ছাড়া মানুষের জীবন হয় না কি। মেয়ে মহলে কত কথা। আর এসব কথাতেই তো গোপন আনন্দ। "কুলসুম এর সঙ্গে কেমন সম্পর্ক বল দিখি "। শুনলাম পেটে বাচ্চা এসেছে "
যা স্বাভাবিক তাই তো হবে। একটা মানুষ সংসারের আপন হয়ে ই উঠেছে। তাকে তো আর ফেলে দেওয়া যায়না।
ফেলে বা তাড়িয়ে ও দেয়নি। দিলেও কুলসুমা র যাওয়ার আর
কোনো জায়গাও ছিলনা।
না। ফেলে দেয়নি কুলসুমা কে। তাকে নিকাহ করল আব্দুল মিঞা। এতক্ষণ হাঁকু মিঞা বলেছি। সে তার ডাক নাম।
ভালো নাম সৈয়দ আব্দুল হক।
ততদিনে এই গাঁয়ে চলে এসেছে তারা। তাঁর প্রথমা স্ত্রী র কয়েকজন দূর সম্পর্কের আত্মীয় এ গ্রামে। জায়গা পেতে অসুবিধা হয়নি। বদরুদ্দোজা ; সাদরে আলা মশাই রা জায়গা দিলেন। আব্দুল মান্নান এর ও আত্মীয় হচ্ছেন।
যাইহোক কোনমতে দিন যায়। মাঝে মাঝে 'বাপুতে' জায়গা থেকে কিছু সংগ্রহ করে আনে। চাল ; টাকা। ওখানে কিছু জমি জায়গা ছিল হয়তো।
কুলসুম এর গর্ভে জন্মাল সখিনা। সেই ছিল একমাত্র সন্তান।
সখিনা খুব ভালো মেয়ে। প্রকৃতি র নিয়মে ই একদিন বড় হল।
অভাবের সংসারে একটু সুখের মুখ কি সে দেখতে পাবেনা
সাজতে সে ভালোবাসে। একটু স্নো ; পাউডার ; কুমকুম ; চিরুনী ; গন্ধতেল আর একটা আয়না। কি করে যেন যোগাড় করত। আহা! কোন মেয়ের না সাজতে ইচ্ছে করে। গরীব বলে কি ইচ্ছে টা থাকবে না। আমি ভাবি ' না সখিনা গরীবের শখ ভালো নয় ভাই - অনেক ফাঁদ পাতা আছে রে।
যাক সে কথা -------। অবাক কাণ্ড হঠাৎ একদিন
তার থেকে বয়সে অনেক বড় এক মানুষের সাথে তার বিয়ে
হয়ে গেল। সে কি মেনে নিতে পেরেছিল! কিন্তু উপায় কি।
তার স্বামী কাজী সুফি এজহারুল হক। ভালো চেহারা। গাঁয়ের লোকেরা যেমন বলে ' উঁচু পুরু ' চেহারা। কাঁধে এক বিশাল ঝোলা। সন্ধ্যায় গ্রামে ঢোকে। আবার সকাল হলেই বেরিয়ে যায়। বেরিয়ে যায় তো যায় ই। মাস পার হয়ে যায়। তারপর হঠাৎ দেখা মেলে। লোকটিকে আমার অন্যরকম মনে হত।
ঠিক আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতো এ মানুষ টি নয়।
নানা বিদ্যা তার আয়ত্ত্বে ছিল। আত্মমগ্ন মানুষ। ঝোলায় তার হরেক কিসিম। অনেক বই পুঁথিপত্তর। হোমিও ইউনানি ওষুধ।
জটিবুটি। কত কি। মাদুলি কবচ।
সকালে হেঁটে তমাল তলার পথ দিয়ে বাঁধ ধরে ইলামবাজারে
যায়। তারপর যে কোথা। জানা নেই। শুনেছিলাম বাড়ি না কি
মাড়গ্রাম। তবে খুষ্টিগিরি ; পাথরচাপুড়ী এসব জায়গায় নিশ্চয়ই যেতেন। কিছু রোজগার করে সখিনা র হাতে দিয়ে যেতেন। ধীরে তাঁদের দুই সন্তান জন্মাল। প্রথমে পুত্র সন্তান।
পরে এক কন্যা সন্তান। কষ্টেই মানুষ।
ততদিনে হাঁকু মিঞা এবং তাঁর প্রথমা স্ত্রী মারা গেছেন।
সংসার ঘাড়ে চেপেছে কুলসুম এর। হায় কার বোঝা কে টানে।
আর সখিনা ছেলে মানুষ করবে না পেটের ভাত জোগাড় করবে। অন্যের বাড়িতে কাজ করে কিছু যা হোক পায়।
কিন্তু রোগ বাসা বাঁধল শরীরে। রাজরোগ। ক্ষয়। টি বি।
সে কি আর হোমিও তে সারে। তখন কোথায় হাসপাতাল।
কোথায় ওষুধ! কিছুদিন ধুঁকে ধুঁকে বেঁচেছিল। ঐ যা।
তারপর এন্তেকাল। তার আগেই তার স্বামী সুফি সাহেব মারা গেছেন। কোথায় যে মারা গেছিলেন -
হায় কুলসুমা তুমি রয়ে গেলে। এবার তুমি সামলাও!
সেই সব দিন! কি দিন যে গেছে। মানুষ দুটো খেতে পায়না।
চাল নাই। কোনমতে মেগেযেচে দূটো চাল যোগাড় হলে ও
একটু তেল ডাল আলু তো চাই। ঐ মেগে যেচে ই।
দিন প্রতিদিন। ভিক্ষা। আর কোন উপায় নেই। কি করবে পেটের দায়। নাতি নাতনি টাকে বড় করতে হবে যে।
অতএব কুলসুম পথে ই নামো। লজ্জা! কিসের আর লজ্জা!
লজ্জা তোমার নয় মা। লজ্জা আমাদের সমাজের।
সত্তরের দশকে র শেষে বাম আমলে পঞ্চায়েত গঠিত হলে
যথাসাধ্য সাহায্য সহযোগিতা ; বেঁচে থাকার আধারটুকু
সময়ে সময়ে তাঁকে দেওয়া হত।বিধবা ভাতা। মাথার উপরে ছিল শর পাতার চাল। এক দোচালা ঘর। ঘর করার জন্য কিছু টাকা। ঘরের জায়গার কাগজ। যা এসেছে প্রথম দেওয়া হয়েছে তাকে। তবু কি আর
শতছিদ্র ভরাট করা যায়।
দীর্ঘ দিন বেঁচেছিল কুলসুমা বিবি। মিলন প্রায় বড় হয়ে উঠেছে। আশা ও বড় হচ্ছে।
কুলসুমা যেন জন্মেই ছিল এই সব দায়িত্ব একার কাঁধে বইবার জন্য।
তোমার মুখটা বড় মনে পড়ে গো আমার। হয়তো সবাই ভুলেছে।
করুন দুটি চোখে ছিল না বলা জীবনের কত কথা ।
------------ ------------ ------------ কথা - সাতকাহন এর ই অংশ।
No comments:
Post a Comment