।। সাতকাহনিয়ার সাতকাহন কথা।।
।। খাঁদি মাল আর সেই সব দিনের কথা।।
কারও ঘরে মাছ মিলুক আর না ই মিলুক -
একবার মাল পাড়ার খাঁদি র উঠোনে গিয়ে খোঁজ নাও
মিললে মিলতে পারে নয় মিলবে ই। সে চুনো পুঁটি হোক আর
ল্যাটা ; পাঁকাল যাই হোক মিলবেই। ঘরের উঠোনে র এককোনে আছে জালঢাকা একটা গর্ত। তাতে চ্যাঙ ; ল্যাটা
জিয়োনো থাকে।
নীচু মাটির দেয়াল। তালপাতার ছাউনি। তার কুঁড়েঘর।
পিছনেই বাসক ফুলের ঝোঁপ। ওদিকে বাঁশঝাড় ; আর লায়েক
বাবুদের ঠাকুর মন্দিরের ঢিপির উপরে বেশ কয়েকটা পলাশ গাছ। তারপর খেজুর ; মাঁদারের ঝোপ। তার ভিতর দিয়েই পায়ে চলা পথ। হালদার বাবুদের ইঁটের প্রাচীর ঘেরা বিরাট খামার। বিরাট এক নিম গাছ খামারের ভিতরে।
তার গায়েই হালদার বাবুদের খিড়কি পুকুর ' জরুলি'।
কি সুন্দর বাঁধানো তার ঘাট। চওড়া সিঁড়ি।
মালপাড়া থেকে সোজা পশ্চিম দিকে ঐ পায়ে চলা পথে গেলে
মেলে ভুতু কুলুর ছোট্ট দোকান। ভূতনাথ গঁড়াই। বাবা মাহিন্দি
গঁড়াই। আসলে মহেন্দ্র। দলিলে বাবুরা ঐ মাহিন্দি ও লিখেছে।
একসময় ভালো জমি জায়গা ছিল। ভুতু র সময়ে সব শেষ।
সেই পুরনো খুব অভাবের দিনে সব বিক্রি হয়ে গেছে। জলের দরে।
ঘরে ঘানি ছিল। এ গাঁ ছেড়ে তাদের আত্মীয় রা সবাই চলে গেছে। এদিকে ওদিকে। ডাঙ্গাল গ্রামে।
ভুতু কুলুর ছোট্ট ডালি দোকানে দু চার পয়সা বা বড়জোর দু চার আনার তেল ; ঝাল ; নুন ; বিড়ি ; দোক্তাপাতা ; নিতে আসে
গাঁয়ের মাল পাড়ার আর বাউড়ী পাড়ার মানুষ জন।
আমার লেবেঞ্জুস দাদু। হ্যাঁ ওর দোকানে ছোট ছোট গায়ে লাল নীল গোলাপি দাগ দেওয়া লেবেঞ্জুস পাওয়া যেত। কাচের বয়ামে
থাকত। দশ পয়সায় দশটা। প্রায়ই যেতাম। এই কে দাম দেবে রে "। দাদু দেবে গো " -। - অ বেশ '।
ওর দোকানে প্রায়ই খাঁদি বসে থাকত। অনেকক্ষণ ধরেই।
ওর ঘরের কাজ ও করে দিত। ফাই ফরমাস খাটতো।
খাঁদি র সাথে ওর এক আলাদা সম্পর্ক। ভুতু দাদুর বৌ মরে গেছে। কে জানে কতদিন আগে। সে দেখেনি। একটি মেয়ে গঙ্গা। সে বড় হয়ে উঠছে। বিয়ে র ভাবনা বাবার মনে। কপালের ভাঁজ আরও চেপে বসে।
খাঁদু র নাকটা একটু চাপা হলেও মুখটি তার সুন্দর। কপালের উপরে দু'পাশে চুলে খাঁজ। সিঁথি তে অবশ্য সিন্দুর নাই। তার
স্বামী ও দুদিনের জ্বরে কবেই মরে গেছে। ওদের ব্যাটা পদা মানে শ্রীপদ। ওর চেহারাটি বেশ সুন্দর হয়ে উঠছে। যেমন লম্বা
তেমন ই গঠন। ভূতনাথ গঁড়াই নিজের নামটি লিখত কি সুন্দর টানে। একটু লিখতে পড়তে জানত। পদ কে সে নামটা লিখতে শিখিয়েছিল। আরও এক দুজন ছেলে তার কাছে অ আ ক খ লিখতে পড়তে শিখত।
খাঁদি আসত শেষ বিকেলে। সন্ধ্যে গড়িয়ে রাতে ফিরত ঘরে।
গঁড়াই লণ্ঠন দেখিয়ে দিত।
কি যে অভাবের ছিল সেই সব দিন গুলো। কি করে যে পার
হত এক একটা দিন। শ্রাবণ ভাদ্র মাসে কারও ঘরে ভাত নাই।
এ গাঁয়ের মাটিতে রোদ পড়ে না। এত তাল গাছ পুকুর পাড়ে।
তালও ছিল নানা রকমের। চার আঁটি কালো কুচকুচে।
আর কি মিষ্টি তার মাড়ি। ঐ তাল মাড়ি একটু গুড় যোগাড় করে -। আরে যোগাড় কোথা! হালদার বাবুদের গুড় ঘরে
একটা নালি পথ ছিল। সেই নালি দিয়ে গুড়ের মাউত গড়িয়ে
বেরিয়ে আসত। তালপাতার ঠোঙা য় তা ধরে নিয়ে যেত কত জনে। খাঁদি ও নিত। কচু পাতায় বেশ খানিকটা চিংড়ি চুনো পুঁটি দিয়ে চারটি মুড়ি যোগাড় করত। সেই মুড়ি ; মাউত গূড় ;
আর তাল মাড়ি। আর তালের তাড়ি। রাত পেরোয়। দিন পেরোয়। দিনের পরে আবার সেই একই রাত।
পদ র বড় খিদে। সে মেটেনা কিছুতেই। এক সের চালের ভাত সে শুধু নুন লঙ্কা দিয়েই খেয়ে নিতে পারে। হালদার বাবুদের সরস্বতী পুজোর ভোজে সে এক গামলা খিচুড়ি খেয়ে লাঠি ঘোরাত। বনবন লাঠি ঘুরত। তার সাথে পাল্লা দিয়ে আরও কয়েক জন। প্রায় সবাই লাঠি খেলতে জানত। বোঙ্গা ; বটু ; দুলাল ; জটাই ; চৈতন সবাই একবার অন্তত দু চার পাক ঘোরাতই। উত্তর দিকের গোয়াল চালার বারান্দায় বসে দেখতো গাঁয়ের লোকেরা।
ওব্বো ওব্বো দিত মুখে।
লাঠি খেলা ; ঠাকুর বিসর্জন ; তারপর নাচ।পেটে তাড়ি সিদ্ধি। জগৎ ভুলে দুহাত তুলে নাচ। তারপর খিচুড়ি ভোজ। বাঁধাকপির তরকারি। চাটনি। কখনো কেমনো
মাছও জুটে যেত। টক ঝোল। তাই ছিল এক মহাভোজ!
তার আগের দিন সরস্বতী দালানে বাবু ভাই ভদ্রলোক দের জন্য হত আলাদা ভোজ। পাতে মাছ ; বোঁদে ; মিষ্টি পড়ত।
আশেপাশে র গাঁয়ের অনেকের নিমন্ত্রণ থাকত।
সে ভোজের শেষে বিশেষ কিছু কোঁড়া ; বাউরী ; মাল ঘরের
লোক প্রসাদ পেত। সে টা পাওয়ার জন্যে খুব লোভ ছিল অনেকের।
খাঁদি পদা কে ধরে ঘরে নিয়ে যেত। এবার পদার বিয়ে দিয়ে দেবে। তাহলে ই যেন তার নিশ্চিন্তি। পদা মাছ ধরতেও খুব ওস্তাদ হয়ে উঠেছে। মাঝে মাঝে তগি এড়ে বড় মাছ ধরে আনে। হায়রে সে বড় মাছ কোথায় বেচবে খাঁদি। বড় মাছ
বিচতে গেলেই -। ' কোথায় পেলি এ মাছ '। এ তো বড়বাঁধের মাছ মনে হচ্ছে '।
" না গো নদীতে ধরেছে "।
" মজা '! এ নদীর মাছ বটে না কি '
খাঁদি পালাতে পারলে বাঁচে।
এখন কার মতো মাছ কিনে খাওয়ার চল গাঁ ঘরে প্রায় ছিলনা। আর এ গাঁয়ে চাল মুড়ি দিয়ে কিনে খাওয়ার মতো
তখন গোটা দশেক ঘর।
মাঝে মাঝে ছেঁড়া আঁচল দিয়ে পেছে ঢেকে মাছ নিয়ে
অন্য গাঁয়ে চলে যেত। অধিকারী আমবাগানের ভিতর দিয়ে পায়ে চলা পথে বামুন পুকুরের পাড় ধরে ডাঙ্গাল গাঁয়ে দিয়ে আসত গঁড়াই ঘরে। ঘোষ বাবুদের ঘরে। চাল আলু মুড়ি নিয়ে
আর দু চার আনা নিয়ে ঘরে ফিরত। দিন টা একটু ভালো যেত
তার পর দিন।
ভুতু কুলু শেষমেষ খুঁজে বের করল গঙ্গার জন্যে ছেলে মানে বর। ঘুড়িষা গ্রামের কমল গঁড়াই। জমি জায়গা আছে। দু চার বিঘে। খাওয়া পরার অভাব হবে না।
খাঁদি ও খুঁজে বের করল তার পদ র বৌ।
কালীদাসী। হোক ময়লা। কিন্তু মুখটি মন্দ নয়।
গঙ্গা র বিয়ে দু এক বছরের মধ্যে হয়ে গিয়েছিল কমল গঁড়াই এর সাথে। হায়রে গঙ্গার জীবন! সে বোধ হয় শ্বশুর ঘর যায়নি। কমল আসত। তাদের দু টি মেয়ে হয়েছিল। তারপর অনেক অনেক কথা। গঁড়াই চুপচাপ ঘরের সামনে কুয়োর ধাপি তে বসে বিড়ি টানত। উদাস দৃষ্টি। ম্লান চোখে। ভাবনার যেন শেষ নাই।
কালীদাসী পদর ঘরে এলো। ওদের ঘরের সামনে খোলা উঠোনে তুলসীমঞ্চের সামনে চারটে কঞ্চি পুঁতে ছাদনা তলা।
ঘর বাঁধা। সেই আদিম ঘর বাঁধার কৌশল। সেই একই রীতি।
সামনে চারটে খুটির উপরে বাঁশ বেঁধে তালপাতা চাপিয়ে বিয়ের ভোজের আসর। কি আর খাওয়াতে পারে খাঁদি। তবু
যা হোক কিছু করেছে। মুড়ি ; কুমড়োর তরকারি ; আর পচুই মদ - এই জলখাবার। তাই সই। যথেষ্ট। রাতে ভাত আর একটা তরকারি। গরমের দিন। উঠোনে ই গড়াগড়ি।
বোঙ্গা র বউ আর এক কালীদাসী। দুই কালীদাসী র ভাব হয়ে গেল খুব তাড়াতাড়ি।
খাঁদি বসে আছে তার নিজের কুঁড়ের দাওয়ায়।
তাকিয়ে আছে সামনের দিকে। তাকিয়ে আছে কিন্তু কিছুই সে
দেখছেনা। শূন্য দৃষ্টি। তার মন যে কোথায় চলে গেছে
কতদূরে - সে ই জানে বা হয়তো জানে না।
No comments:
Post a Comment