Sunday, 11 July 2021

আমার দাদু। অযোধ্যা প্রা বিদ্যালয়ের রূপকার। প্র‍য়াত ননীগোপাল চট্টোপাধ্যায়।। কথা - সাতকাহন।।

।। কথা - সাতকাহন।।  ২৯ অধ্যায়।
বারবার দাদুর কথা ফিরে ফিরে আসছে।
আসলে তার জীবনে দাদু দিদিমা র ভূমিকা মা বাবার মতো ই। আর দাদুই তার জীবনের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক। 
আবার ও আসবে। কেননা মানুষ টি একটা এলাকার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল কে পরিশীলিতভাবে গড়ে তোলার জন্য কি অক্লান্ত পরিশ্রম করেছিলেন।
অনেকটা সময় পিছিয়ে যেতে হচ্ছে। সাল ১৯৪৭। ১৫ ই আগষ্ট। প্রথম স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের উন্মাদনা।
অযোধ্যা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রবৃত্তি পরীক্ষার দ্বিতীয় ব্যাচের ছাত্র প্রয়াত নির্মল চট্টোপাধ্যায় এর স্মৃতি চারণ
" প্রথম স্বাধীনতা দিবস উদযাপিত হচ্ছে। বিদ্যালয় থেকে প্রভাত ফেরী বেরিয়েছে ছাত্র ছাত্রী দের দল। আনুমানিক
জনা কুড়ি। ' বড়মাষ্টার ' গলায় ঝুলিয়েছেন হারমোনিয়াম।
সাথে লক্ষীনারায়ন চক্রবর্তী মশাই। তাঁর ও গলায় হারমোনিয়াম। সহ শিক্ষকেরা সাথে আছেন। লাইনের উপর
নজর রাখছেন। সামনের মেয়েরা কানন বালা ; পারুল বালা রা শঙখ ধ্বনি করছেন। গান হচ্ছে
    ' চক্রশোভিত ওড়ে নিশান /
        নব ভারতের বাজে বিষাণ '
রাস্তার দু পাশে উদ্বেলিত মানুষ। প্রথম তারা এভাবে প্রভাত ফেরী দেখছে ।
    এই হচ্ছে সেদিনের দৃশ্য। ' বড়মাষ্টার '। ননীগোপাল চট্টোপাধ্যায়। তার দাদু। কানন বালা তার মা। পারুলবালা তার
' ফুল মা '।
নির্মল চট্টোপাধ্যায় বলে ওঠেন " ও গো এ শুধু একটা স্কুল মাত্র নয় ' - শিক্ষা ; সংস্কৃতির মন্দির "
  ননীগোপাল চট্টোপাধ্যায় মশাই তাঁর শ্বশুর বাড়ি র গ্রাম টা কেমন দেখতে সাইকেলে চেপে বাঁকুড়া গোগড়া ; পাপুরদা ( শালতোড়া নিকট বর্তী)  গ্রাম থেকে এসেছিলেন এখানে।
শ্রীচন্দ্রপুর গ্রামে। (আদুরিয়া - অমরপুর  এলাকা).।
  অযোধ্যা - বনকাটির পার্শ্ববর্তী এলাকা।
  প্রাচীন গোপভূম এর  এই সেনপাহাড়ী এলাকার এই সকল গ্রামে তখন কোন স্কুল ই নেই। কিছু গুরুমশাই এর পাঠশালা
মাজুরিয়া গ্রামে টোল আছে।
   অযোধ্যা গ্রামে পাঁচ গ্রামের মানুষেরা আসেন। হাট বসে।
তখনকার দিনের গঞ্জ। ধ্বজাধারী সাহা মশাই এর বৈঠক খানা বারান্দায় বিশিষ্ট মানুষ দের আড্ডার আসর বসে।
অনেকে আসেন ডাঙ্গাল গ্রামের  গোবিন্দ ঘোষ
নিমটিকুড়ি র ভোলানাথ বাসুরী ; বনকাটি র তারাকিঙ্কর মুখোপাধ্যায় ; সাতকাহনিয়া র  হাটু হালদার ; পাড়ার বনবিহারী সাহা মশাই সহ আরও অনেকে। যথেষ্ট সম্পন্ন মানুষ সব এঁরা। অনেক জমি জায়গা র মালিক। কাজের সূত্রে বাইরে অনেক কেই যেতে হয়। বাইরের প্রভাব তাঁদের মাধ্যমে আসে।
এলাকায় কোন স্কুল নাই। সকলে মিলে স্থির করেন স্কুল একটা স্থাপন করতেই হবে।
অযোধ্যা গ্রামের উত্তরে বিশাল আমবাগানের ' রথ তলার ডাঙ্গায় ' জায়গা দেখা হল। জমি দান করেছিলেন অযোধ্যার চট্টোপাধ্যায় পরিবারের প্রয়াত সুরেশ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সহ আরও অনেকে। হয়তো রেজিষ্ট্রী দলিল পরে হয়েছিল।
  ছোট্ট মাটির দেওয়ালের ঘর উঠল।
প্রধান শিক্ষক হিসাবে আমলাজোড়া গ্রামের রামসেবক মুখোপাধ্যায় মশাই কে আনা হল। অনাদি বন্দ্যোপাধ্যায় ; শশীভূষণ রক্ষিত মশাই রা সহ শিক্ষক।
বিদ্যালয়ের পথ চলা শুরু হল। সেই হল প্রথম যুগ।
রামসেবক মুখোপাধ্যায় মশাই কয়েক বৎসর পর চলে গেলেন। 
একজন দক্ষ প্রধান শিক্ষকের দরকার।
ঠিক সেই সময়েই তাঁরা সন্ধান পেলেন শ্রীচন্দ্রপুরের অশ্বিনী মুখোপাধ্যায় মশাই এর ভগ্নীপতি ননীগোপাল চট্টোপাধ্যায় মশাই এর। বাঁকুড়া থেকে গুরু ট্রেণিং করা এই মানুষ টি
একাধারে শিক্ষক আবার গান বাজনার ও লোক। পেশাদার যাত্রা দলে ও হারমোনিয়াম মাষ্টার। ' মোশন মাষ্টার '।
সেই গুণী মানুষ টি তখন  মানসিক পরিস্থিতি র কারণে কিছুদিনের জন্য এখানে রয়েছেন।
  এই এলাকার সব বিশিষ্ট মানুষ দের অনুরোধে তিনি রাজী হলেন এই বিদ্যালয় কে গড়ে তোলা বা প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব নিতে।
শুরু হল এক নূতন অধ্যায়। এলাকায় একদল উদ্বুদ্ধ কর্মী যুব বাহিনী চাই। শুরু করলেন যাত্রা থিয়েটারের দল। ক্রমে সে দল প্রায় পেশাদারী দক্ষতা অর্জন করে। কলকাতা র রঙ্গালয়ে অভিনীত হচ্ছে যে পালা তা এখানে হচ্ছে। পরে পেশাদার দলের মতো নিজেদের ট্রাঙ্ক ভর্তি ড্রেস এবং অন্যন্য আনুষঙ্গিক দ্রব্যাদি। মিউজিক এর জন্য বাঁকুড়া থেকে ও উপযুক্ত লোক আনেন। আবার নদীর ওপারে র উদয়পুরের
রাধাশ্যাম কে ও তৈরি করে নেন। আদুরিয়া অমরপুর থেকেও
অভিনেতা নিয়ে আসেন। দুর্গাদাস দত্ত।
যাত্রা দলের ম্যানেজার শক্তিপদ চট্টোপাধ্যায় (মরন - ডাক নাম)। এ দল নিয়মিত পরে বিভিন্ন জায়গায় যাত্রা করতে গেছে।
  এই কর্মী বাহিনী কে সাথে নিয়ে শুরু হল স্কুল বিল্ডিং গড়ে তোলার কাজ। ইঁট পোড়ানো হল। ভোলানাথ সূত্রধর  রাজমিস্ত্রী। মানুষের দ্বারে দ্বারে সাহায্য ভিক্ষা করা হচ্ছে।
অবলা কান্ত সরকার মশাই একটি মোটা শালগাছ দিলেন।
কোন সরকারি অনুমোদন ও নাই। শিক্ষক দের মাইনে ও নাই।
  ছাত্র ছাত্রী দের বাড়ি থেকে এবং দান সংগ্রহ করতে হয়।
চাল ; ডাল ; তরি তরকারি ইত্যাদি। টিকিট কেটে কবিগানের আসর বসানো হচ্ছে। মানুষ দের ভিতরে নারান বাবু সহ অন্যান্য যুবকের দল কাপড় পেতে সাহায্যভিক্ষা করছেন।
ননী গোপালের স্ত্রী ও আছেন। তাঁর হাতে আছে শেষ সম্বল
একগাছা চুড়ি। তিনি সে টা ই খুলে দিচ্ছেন। এই নারান বাবু ;
নারায়ণ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় হাই স্কুল গড়ে তোলার জন্য প্রাণপাত পরিশ্রম করেছেন। তিনিই  অযোধ্যা হাই স্কুলের রূপকার। প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক হরিহর সিংহ মহাশয় এর বয়ানে যদিও তারও গোড়া পত্তনের শুরু  সেই
ননীগোপাল চট্টোপাধ্যায় মশাই এর উদ্যোগে ই।
রজনীকান্ত হালদার মশাই গোপাল মাষ্টার কে নিয়ে এলেন
নদী তীরবর্তী এই নির্জন শান্তশ্রীর গ্রাম  সাতকাহনিয়া য়।
  এক উকিল সেন বাবুর ছেড়ে যাওয়া  বাড়ি টি তাঁর জন্য বরাদ্দ হল। কিছু ডাঙ্গা জমি দান করে তিনি এক ঘর ব্রাহ্মণ কে গ্রামে প্রতিষ্ঠিত করলেন। গ্রামের অধিকারী ; লায়েক ;
প্রভৃতি ব্রাহ্মণ পরিবার গুলি গ্রাম ছেড়ে চলে গেছেন অনেক আগেই।
  এখানে ছাত্র ছাত্রী দের বাড়ি তে রেখে দালান ঘরে বসিয়ে আলাদা ক্লাস হয়। আবাসিক ব্যবস্থা। ডাঙ্গাল গ্রামের গোবিন্দ ঘোষ মশাই এর ছেলে বিশ্বনাথ বাবুর অভিজ্ঞতা আমি নিজ মুখে শুনেছি। কঠোর শৃঙখলা ; নিয়মানুবর্তিতা। পঠন পাঠন এ
কোন ফাঁকি চলবে না। শিক্ষার প্রাথমিক ভিত যেন হয় মজবুত। এ দিকে তাঁর কঠোর দৃষ্টি।
  স্কুল এর পূর্ব দিকে দুটি বিরাট আমগাছ। মাটি দিয়ে গোড়া বাঁধানো। গোবর মাটি  দিয়ে নিকানো। আলপনা আঁকা।
উন্মুক্ত পরিবেশে পঠন পাঠন। গান " তোমারি গেহে পালিছ স্নেহে " " আজি যত তারা তব আকাশে "
স্কুল বিল্ডিং এর সামনে দক্ষিণে ফুলের বাগান। যে বাগানের বেড়া দেবার জন্য বাঁকুড়া র অমরকানন থেকে বেড়া কলমীর
ডাল নিয়ে এসেছেন। তার আগে এখানে এটি ছিলনা।
  যে বাগানে একদিন একশো দশ রকমের ফুলগাছ ছিল।
  যার জন্য ভবিষ্যৎ এ স্কুল পুরস্কার পাবে।
  ১৯৪৪ সালে বিদ্যালয় জেলা বোর্ডের অনুমোদন পায়।
  শিক্ষকদের ও মাস মাহিনা র অনুমোদন হয়। টিনের ছাউনি ব্যবস্থা হয়। রাণীগঞ্জ বাজার থেকে সে টিন কিনে আনা হয়। 
পরবর্তী সময়ে এই বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসাবে যোগ দিয়েছেন
গুণী শিক্ষকেরা। প্রয়াত রুধির কুমার সাহা ; প্রয়াত যোগেশ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ; সুভাষ বাবু। তাঁদের অন্যতম চণ্ডীরাম মুখোপাধ্যায়।
তখনকার দিনে মানে ১৯৪৪সালের ম্যাট্রিকুলেশন এ ফার্স্ট ডিভিশন। তারপর টেক্সটাইল টেকনোলজি তে ডিপ্লোমা।
অনায়াসে ই তিনি বাইরে মোটা মাহিনার চাকুরী করতে পারতেন। সম্ভবত নদীয়ার তাহেরপুর এ জুট টেকনোলজির কোন প্রতিষ্ঠানে ইন্সট্রাক্টর পদে যোগ দিয়েছিলেন।
  যে কোন কারনেই হোক ( যতদুর জানি সেখানকার আবহাওয়া সহ্য হয়নি)  তা ছেড়ে এখানে শিক্ষক হিসাবে যোগ দেন। অযোধ্যা গ্রামে স্বাধীন ভাবে শাড়ী র ব্লক প্রিন্টিং এর
প্রতিষ্ঠান খুলেছিলেন। খুবই গুণী মানুষ ছিলেন। ছিলেন জ্ঞান পিপাসু মানুষ। তিনি ছিলেন তাঁর সময়ের থেকে ; এই এলাকার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল থেকে এগিয়ে থাকা মানুষ।
  এলাকার বয়স্ক মানুষেরা আজও  ননীগোপাল চট্টোপাধ্যায় মশাই কে  তাঁর নামে নয়। চেনেন " বড় মাষ্টার " নামে। তাঁর নাম শুনলে 
কপালে হাত ঠেকানোর লোক কমে এলো।
প্রথম ছাত্রবৃত্তি পরীক্ষার যে ব্যাচ তার তিন জন মেয়ে আর একজন ছেলে কে গোরু গাড়িতে চেপে দুর্গাপুরে সগড় ভাঙ্গা র  হাই স্কুলে পরীক্ষা দিতে যেতে হয়েছিল। সাথে তিনি আর একজন অভিভাবক। কাননবালা ; পারুলবালা ; ষষ্ঠী পদ দে
এবং অযোধ্যা বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের এক মেয়ে। তাঁর নাম টি সঠিক সংগ্রহ করা যায়নি।
" বড় মাষ্টার " রা জন্মান। প্রকৃত শিক্ষকেরা জন্মান। দারিদ্র্য কে বরণ করে এঁরা আদর্শে অবিচল থাকেন। তাই বুঝি  এঁদের জন্য কোন রাজ্য বা রাষ্ট্রীয়
পুরস্কার বরাদ্দ হয়না।
----------- ----------- ----------- ----------- --- © প্রণব ভট্টাচার্য।
( শিক্ষা সমাচার ; কুনুর কথা প্রভৃতি পত্রিকায় আমার লেখা
প্রবন্ধ আছে। আমি কুনুর কথার পাতা গুলি তুলে দিলাম। ডাবল ট্যাপ করবেন তা না হলে আবছা দেখাবে)

No comments:

Post a Comment